নব্বইয়ের কবিতা: দশকে নিমগ্ন চেতনা নাকি নিমগ্ন চেতনার দশক । নাহিদা আশরাফী
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ৮:৪৪ অপরাহ্ণ, | ৬৩৩ বার পঠিত
‘এক দশকে সংঘ ভেঙে যায়
সংঘ তবু পায়না সত্যকে’ —লিখতে বসে শঙখ ঘোষের এই কথাটাই শুরুতে মাথায় এলো কেন কে জানে।বাংলা কবিতা, দশক ধরে তাকে বন্দি করা কতটা সমীচীন বা কতটা শিল্পমানসম্পন্ন এ বিষয়ে আমি এখনও নিশ্চিত নই। তবু সে অনিশ্চিতের ঘরে বসে নব্বইএ যারা কবিতা লিখেছেন অথবা কবিতা যাদেরকে পুরোপুরি খেয়েছে সেইসব চুল খোলা আয়শা আক্তার অথবা অমলকান্তিদের কথা লেখার চেষ্টা করব। জানি সব কথা, সবার কথা এখানে উঠে আসা সম্ভব নয়। তবু কিছুটা ধরতে যাওয়ার গনিতসুত্র, ছুঁয়ে দেবার তাত্ত্বিক বাসনা। শুরুতেই বলে নেয়া প্রয়োজন এ আলোচনা নব্বই দশকের শুধুমাত্র বাংলাদেশের কবি ও কবিতা নিয়ে।
নব্বইয়ের কবিতা চরিত্র কোন দিকে ধাবিত? কী কী দিক নির্দেশনা বিশেষভাবে প্রকট? তার ভাষাভঙ্গি, উপমাচিত্র, চিত্রকল্পের অবয়ব, রচনাশৈলীর নতুনত্ব, চেতনা, আধুনিক মনষ্কতা, দার্শনিক ও ঐতিহাসিক রুপরেখা এবং সর্বোপরি ভাষা-রূপ ও ভাব-রূপের কতটা নিগুঢ় উপস্থাপন সম্ভব হয়েছে, তা পরবর্তী দশকের হিসেবে বাছ-বিচারের সময় কি এসেছে? সেই সাথে আরেকটা বিষয় বিচার্য এই নব্বইয়ের দশক ভাব ও ভাষা প্রয়োগে বিগত দশকের তুলনায় কতটা গভীর ও কতটা সংহত। সে কী কেবলই নিজকে প্রকাশোন্মুখ এক অস্থিরতার আগুন নাকি, বিগত দশকের শেকল ভাঙতে না পারার ক্ষোভ, আত্মানুসন্ধানের চকোলেট শাপিং, দুরূহতা, নিঃসঙ্গতা আর অস্পষ্টতার মেলাঙ্কোলি। প্রসঙ্গত যে পূর্বজ কবিদের কবিতা শেকড়সন্ধানী পরবর্তী কালের কবিদের লেখায় পরম্পরার সূত্র ধরে আসতেই পারে। এটাকে দূষণীয় বলা বা অগ্রাহ্য করার মধ্যে আমি বলবো না কোন শেকল ভাঙার সংগীত রয়েছে। বরং অগ্রজের অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গি, অনুষঙ্গের উপলব্ধি ঐতিহ্যের মত কখনো কখনো অনুজদের কবিতায় জ্বলজ্বল করতেই পারে। সেই ঐতিহ্যকে সাথে নিয়েই নিজস্ব গদ্যভাষারীতি ও সমীক্ষাধর্মী কাব্যশৈলী নির্মাণের ঝুঁকি নিয়েছেন নব্বই দশকের বেশ কিছু কবি। সাথে নিয়েছেন আধ্যাত্মবাদ, মরমীয়া সুর ও আঞ্চলিক লোকগাথা, প্রবাদ— প্রবচন, বেদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, কোরআন ।
কবিতায় তাচ্ছিল্য, পরিহাস, ব্যঙ্গ নতুন কিছু নয়। রোম সাম্রাজ্য হোরেস ব্যঙ্গ কবিতার মাধ্যমে সামাজিক অসঙ্গতি আর অপূর্ণতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে খুব ভদ্র ভাষায় দেখিয়ে দিয়েছেন। আবার একই সময়ে জুভেনাল মারাত্মক তীর্যক, ধারালো ও অশ্লীল ভাষার মাধ্যমে আক্রমনাত্মক কাব্যভাষা তৈরি করেছিলেন।
ছন্দে হোক, টানাগদ্যের একেবারে ভিন্ন এক রীতি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে হোক লোকজ বিষয়-আশয় অত্যন্ত আধুনিক প্যাটার্নে ফুটিয়ে তোলার অভিনবত্ব নব্বইয়ের কবিদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য না করে উপায় থাকে না । তাদের অধিকাংশ লেখাতেই এই ঐতিহ্যলগ্না রূপরেখাটি সুস্পষ্ট। এ তালিকায় রহমান হেনরী, তাপস গায়েন, কুমার চক্রবর্তী, খলিল মজিদ, জফির সেতু, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, টোকন ঠাকুর, মুজিব মেহেদী রিষিণ পরিমল আমির খসরু স্বপন, শাহনাজ মুন্নী, আয়শা ঝর্না, রনজু রাইম, পাবলো শাহি, তুষার গায়েন, বায়তুল্লাহ কাদেরী এরকম আরো কিছু নাম নব্বইয়ের কবিতার আকৃতি প্রকৃতি সারল্য কাঠিন্য বহির্মুখীতা অন্তর্মুখিতা আত্মমগ্নতা, স্বতঃস্ফূর্ততা বোঝার জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে।
কয়েকটি উদহারন দেয়া যাক
১—
‘পাশের বাড়ির মেয়ে চোখ দিলো জন্মের পর। সেই থেকে প্রতি ভোরে মা খাওয়াতেন নজরের পানি। অসংখ্য সূরায় ভরে দিতেন গলায় ঝোলানো কালো সুতোর তাগা। লাল মোরগটা নিয়ে যেতো বৃদ্ধ ফকির। তার সাথে বদচোখের বিষ।… আমি কি শিশু মাগো- নজরে দেইনি মুখ স্তনের বোটায়? কেন তবে এই ভয়? আমাকে দিয়েছে সে তো অন্য নজর, যে নজর হরদম হৃদয় পোড়ায়।(নজর – মুজিব ইরম)
২—
… কবেকার গন্ধময় জৈগুন বিবির কিচ্ছাতে শুকাতে দিয়ে বরেন্দ্রর ঘাসেফিরেনো পত্তুর তুমি ভাবুক৷ দ্রাবিড়,… (অনার্য মাদুলী— বায়তুল্লাহ কাদেরী)
৩—
আমার পীর এ সাদা হাসটা।
মনের আনন্দে যে স্নান করেছে পূর্ণ দীঘিতে
এখন আমি পীরের নামে আমার প্রাণ জলে ভাসাবো
দুপুরের উজ্জ্বল রোদগুলো আমার পীরভাই।
যে মুছে দেয় অন্তরের জ্বর (পীর— সরকার আমিন )
কয়েকটি প্রশ্ন অবধারিতভাবে আমার মনে মাঝেমধ্যেই ছলাৎ শব্দে ঘাই তোলে। দশকের কবি বাছাই করেন কে? লেখক নিজে, পাঠক, প্রকাশক নাকি অন্য কেউ? আমি ঠিক জানি না দশকওয়ারি এই বিতর্ক কবে থেকে শুরু হয়েছিল। আমার জানা নেই রবীন্দ্রনাথ কোন দশকের? জীবনানন্দ জসীমউদ্দীন কোন দশকের? শেকল ভাঙার বিশ্বাসে বিশ্বাসী মানুষ আমি তাই দশকের বন্দিদশায় কবি ও কবিতাকে দেখে হাসফাসিয়ে উঠি, আমার মর্মমূলে আঘাত লাগে। খোন্দকার আশরাফ হোসেন যাকে সবাই আশির দশকের কবি হিসেবেই চেনেন তিনি নিজেই তার দশকওয়ারী অবস্থানকে বেশ রসে ভিজিয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তার বয়ান টুকু তুলে ধরছি সঙ্গতকারনেই।
’ষাট দশকের বাসেই উঠব উঠব করে ভাবছিলাম, দেখি খুব ভিড়, ঠেলাঠেলি, বাসের ভেতরে, ছাদে, পাদানিতে অসংখ্য কবি;বাস ছেড়ে যেতে যেতে দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, জায়গা নেই। আমার ওঠা হলো না।… তারপর সত্তর দশকের বাস গেল, সেখানেও প্রচুর ভিড়, হৈ চৈ, শ্লোগান, উঠব উঠব করে ওঠা হল না। আশির দশকের বাস দেখি হেলে দুলে আসছে, ফাঁকা, ভিড়-ভাট্টা নেই। উঠে পড়লাম।’
মাহবুব কবির সম্পাদিত ‘নব্বইয়ের কবিতা’ সংকলন গ্রন্থটিকে কেন্দ্র করে মুজিব মেহেদী একটি আলোচনা লিখেছিল। এটি গ্রন্থালোচনা হলেও মূলত এই রচনার মাধ্যমে নব্বই দশকের কবিতার উপরে একটি চমৎকার বিশ্লেষণধর্মী ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যের আভাস মেলে। মুজিব মেহেদী তার এই প্রবন্ধে নব্বইয়ের কবিতার কিছু বৈশিষ্ট্য ও প্রকরণ তুলে ধরেছিলেন। বৈশিষ্ট্যগুলো হল—
প্রত্নখনির সন্ধান স্পৃহা, শাশ্বত বাঙালি— জীবন ঘনিষ্ঠতা, বিজ্ঞান,গনিত ও প্রযুক্তিনিষ্ঠা, আদিবাসী ও উপজাতি সম্প্রদায়ের জীবনচিত্রণ, পরোক্ষ উদ্ধৃতি বা পুননির্মাণপ্রবণতা, স্কিজো— ভাষাচ্ছন্নতা, ইতিহাস-ঘনিষ্ঠতা, সাইবার সিটিজেনশিপ, নিসর্গের নবরুপায়নেচ্ছা, আধ্যাত্মিক ও মরমিয়া স্বরন্যাসিকতা, ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞাননিষ্ঠা। তিনি শুধু বৈশিষ্ট্যই লেখেননি প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের সমর্থনে নব্বই দশকের বেশ কয়েকজন কবির কাব্য ভাবনাকেও তুলে ধরেছেন। যেমন—
আধ্যাত্মিক ও মরমিয়া স্বরন্যাসিকতা বোঝাতে—
কায় ভাসিলো পথের ধুলায় আমি ভুলে থাকি আজ গৃহে ফিরিবার দিন… রহস্য বিভঙ্গ আরো পরে থাকে মেঘের কাপড় আমি গৃহ বাঁধি তার বাড়ি… (ধুলো পাঠ, মোস্তাক আহমাদ দীন)
সাইবার সিটিজেনশিপ বোঝাতে—
… হলোই সে ত’ হালকা সিসিফাস বোঝা? সিসিফাস থলে কাঁধে নিয়ে হে আমি তুচ্ছ শুককীট (গ্রেগর সামসা)…
(টঙ্গী ডাইভারশন রোড, অদিতি ফাল্গুনী )
এমন আরও কিছু উদাহরণ তিনি দিয়েছেন যা নিঃসন্দেহে নব্বইয়ের কবিতার ডাইভারসিফিকেশন অফ লিটারারি সোর্সেস বোঝাতে সহায়ক তবে এর বাইরেও তাকাবার কিছু দৃশ্য থাকে, বোঝার কিছু জায়গা থাকে। বহমান জল কোথাও আটকে গেলে যেমন তাকে জলাবদ্ধতা বলে , শিল্প ও সাহিত্যকলা তেমনি আবদ্ধ হয়ে গেলে আমি তাকে কলাবদ্ধতা বলি। নব্বইয়ের কবিতার কিছু কলাবদ্ধতার সুলুক সন্ধান করি চলুন-
কত রবি জ্বলে রে, কে বা আখি ম্যালে রে
নব্বইয়ের কবিতায় অনেক কিছুর সন্ধান মিললেও রাজনৈতিক চেতনাবাদ অথবা সমাজ পরিবর্তনে সুস্পষ্ট কোন নান্দনিক বা সংগ্রামী কাব্যধারার সন্ধান আমরা তেমন করে পাইনা। আশির দশকের কবিতায় স্বৈরাচার বিরোধী যে প্রতিবাদী তৎপরতা কবিতার পরতে পরতে আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম নব্বইয়ে বহু বিশ্লেষণেও তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। কিন্তু কেন? তবে কি নব্বইয়ের কবিরা রাজনীতি বা গনতান্ত্রিক স্লোগানমুখী কাব্যধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন নাকি কথিত গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অথর্ব ও অনগ্রসরমান অবস্থায় তাদের উপরে স্থবিরতা,হতাশা ও বিষন্নতা ভর করেছিল যাতে রাজনীতি সচেতন কাব্যভাব সৃষ্টিতে নব্বইয়ের কবিরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। আপন চেতনার বলয়ে থেকে শব্দের অভিনবত্বে ও তত্ত্বের নীরাক্ষায় কিছু চমক ও ব্যক্তিক অনুভবের রহস্যময় প্রকাশ ঘটানোতেই কবিরা ব্যপ্ত ছিলেন।
এখন আবারো প্রশ্ন তৈরি হতেই পারে যে একটা দশক কী সমগ্রের প্রকাশের জন্য যথেষ্ট নাকি আদৌ তা সম্ভব। আর কেউ কেউ যে এই স্থবিরতা ভাঙতে চেষ্টা করেনি এমন দাবিও করা যাবে না। তবে ভাঙতে গিয়ে কতটা শৈল্পিক হয়েছে কতটা চুরমার হয়েছে, কতটা প্রোডাক্ট বা বাইপ্রোডাক্ট আমরা পেয়েছি তা বিশ্লেষণের যথেষ্ট দাবি রাখে।
এই স্থবিরতার বিপরীতেও কেউ কেউ আঁখি মেলেছে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় মানুষের জীবন, ক্ষুৎ-পিপাসা ও তাদের সোদা মাটির গন্ধ তুলে আনতে চেয়েছে কবিতায়। তেমন কিছু পঙতি আমি তুলে ধরতে চাই—
১—
একটি জরায়ুর বৈধতা দিয়ে রাষ্ট্র আমাকে বলেছে,
’ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ কিন্তু জরায়ুর
গভীরে পা রাখতেই আমি অজস্র সন্তানের শুভেচ্ছা পেতে থাকি
আমি তাদের কাউকে এড়াতে পারিনা; সঙ্গমকালীন জরুরী নিরাপত্তার জন্য এবার রাষ্ট্রের কাছে আমি
একদল দাঙ্গা পুলিশ যাইবো
—(আলফ্রেড খোকন)
২—
বৃক্ষের ভেতর মূর্ছনা ছিল, বাটের ঘাটে একা।
সূর্যের প্রার্থনায় শেষ রাত, ঝিমুনিতে ঘোর।
কান পেতে শুনেছি তাদের ফুসফাস
ঘূর্ণন-পাকে খুলেছিল রাতের অক্ষর।
ঈশানে ছিল নীরবতা, নালন্দার মাঠ
চন্দনপুকুর পেয়েছিল টের—
কিরকম বিশ্ব ভাসে হৃদয়ে— তাদের ।
— (শামীম রেজা)
হঠাৎ মিডিয়ার ঝলকানি লেগে ঝলমল করে চিত্ত
নব্বইয়ের কবিতা হঠাৎই মিডিয়াকরনের এক ঝলমলে দুনিয়ায় পা রাখতে শুরু করলে ক্রিকেটের মত কবিতাও টি টুয়েন্টি ইনিংসের এর খপ্পরে পড়ে তালগোল পাকিয়ে ফেললো। শুরু হল কবিতার চিত্রায়ন, দৃশ্যায়ন আরো নানাবিধ অলংকরণ। ফলতঃ কিছু কবির চিত্তচাঞ্চল্য তৈরি হল, রাতারাতি জনপ্রিয় হবার বাসনাকে সুপ্ত বা ঘুমন্ত রাখার শক্তি তাদের মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। রেষারেষি, ঠেলাঠেলি আর মুহুর্মুহু করতালির নেশায় আসক্ত হওয়া এই সব মিডিয়া কবিরা টকমিষ্টি শো তে তাদের কাব্যের বিভাবরীর তুলনায় ফেস প্রেজেন্টেশান এর লম্বা লাইনে নাম লেখাতে শুরু করলেন। নব্বইয়ের শেষের দিকে একাধিক চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব আরো আরো কত আয়োজনে কবিদের মনোযোগ ছড়িয়ে গেল! খুব স্বাভাবিক কারনেই কবিতা তার প্রয়োজনীয় নিবিষ্ট পরিচর্যা ও ধ্যান হারিয়ে কিছুটা হতচকিত মনে আবছায়ায় অভিমানী কিশোরীর মত পায়ের আঙুল দিয়ে সাহিত্যের নিকোনো উঠোনে দাগ টানতে থাকে আর জলটলমল চোখে তাকিয়ে দেখে স্রষ্টা তারে ফেলে চলেছে কোথায়। গা ভাসানোর জন্যে মিডিয়া নির্মিত সুসজ্জিত সুইমিং পুল পেয়ে তারা সাহিত্যসমুদ্রে আর ডুবতে চায় না।
নব্বই দশকের কবিদের কাব্য ভাবনাকে যথেষ্ট এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে লিটলম্যাগের একটা বিশাল ভূমিকা ছিলো। নব্বইয়ের প্রকৃত কবিগনও এই বিষয়টি অনুধাবনে যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তারা তথাকথিত বাণিজ্যিক ঘরানার পত্রিকার চাইতে ছোটকাগজে তাদের সাহিত্যের বিস্তার আর পরিধিকে বাড়িয়েছেন। ফলত প্রচলিত ফরম্যাট ও প্রাতিষ্ঠানিক রুল টানা খাতায় কবিরা তাদের কাব্য সুধাকে ফ্রেমবন্দী না করে ছোটকাগজের অসীমে করেছেন প্রেমবন্দী। এটি অবশ্যই নব্বইয়ের এক অর্জন বটে।
তবু বারবার বলি ব্যতিক্রম এখানেও আছে৷ কেউ কেউ অতি ঔজ্জ্বল্য ছেড়ে নিজের মত করেই কবিতা— কিশোরীর হাত ধরে। অভয় দেয়।
‘সে কোন মর্মরে, বলো! দ্বিধাবতী অপরাজিতায়
নীলাভ দ্যুতিমা জ্বলে; অনুভবে টলোমলো জল:
বাতাসে অবাধ্য স্বর ফিস ফিস কথা বলে যায়:
সে-কোন মর্মরে বলো।’
(ধ্বনিমা— সৈয়দ তারিক)
অথবা
’শালবনের দীর্ঘ পাতারা
অধিকৃত মাটিতে জ্যামিতিক মেদমজ্জায়
ঢেকে রাখে
ঢাল, বর্শা, শড়কি, বল্লম
হাজার বছরের শরীর বাঁচিয়ে।’
(উপকথা: জন্ম আর মৃত্যুপাকে— মাসুদুল হক)
হুজুর বলেন চমৎকার এমন কথায় অমত কার
নব্বই দশকের কবিতায় হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো কিছু বিষয় না চাইতেও জুড়ে বসেছে যা শিল্প নির্মাণে কতটা ভূমিকা রেখেছে বলা মুশকিল তবে চটকদার বিজ্ঞাপনের মত চিত্তচাঞ্চল্য তৈরি করেছে কবি এবং পাঠক উভয়ের মধ্যেই। এতে কবিগণ যেমন অংশ নিয়েছেন তেমনি সমভাবে (সমভাবে নয় বরং বলা যায় বেশিভাবে) অংশ নিয়েছেন একজন কবিকে ঘিরে গড়ে ওঠা একদল চাটুকার ও সুবিধা আদায়কারী কিছু কবি হতে চাওয়া তেলবাজ। শৌখিনতায় মোহাবিষ্ট এই তেলবাজদের বদ্ধমূল ধারণা হল গুরুকে তেল দিলেই আর গুরু পিঠ চাপড়ে দিলেই যা কিছু তার কলম থেকে বেরুবে তাই কবিতা হয়ে যাবে। দলবাজি, গুরুবাজি, শিষ্যতান্ত্রিক বলয়ে পড়ে গুরু কবির কি দক্ষিণা লাভ হয়েছে জানিনা, তবে শীর্ষ কবির দয়ায় প্রসাদ হিসাবে কিছু দৈনিক বা লিটলম্যাগে তাদের নাম জায়গা করে নিয়েছে। আর এসবের ভিড়ে কবিতার বাগান থেকে ক্লোরোফিল হারিয়ে গেছে। ফলশ্রুতিতে বিবর্ণ, বিপন্ন, অসুস্থ, চটকদার, বিজ্ঞাপনধর্মী কিছু কবিতার সন্ধান আমরা পেয়েছি। এইসব দল ও গোত্রের খপ্পরে না পড়লে নব্বই দশক থেকে আমরা আরো সমৃদ্ধ কিছু কবিতা পেতাম হয়তো।
কবিতায় তাচ্ছিল্য, পরিহাস, ব্যঙ্গ নতুন কিছু নয়। রোম সাম্রাজ্য হোরেস ব্যঙ্গ কবিতার মাধ্যমে সামাজিক অসঙ্গতি আর অপূর্ণতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে খুব ভদ্র ভাষায় দেখিয়ে দিয়েছেন। আবার একই সময়ে জুভেনাল মারাত্মক তীর্যক, ধারালো ও অশ্লীল ভাষার মাধ্যমে আক্রমণাত্মক কাব্যভাষা তৈরি করেছিলেন। আমরা ভলতেয়ারের উইটি প্রেজেন্টেশন দেখেছি। বিংশ শতাব্দীর কবি ওগডেন ন্যাশকে দেখেছি যার স্যাটায়ারিক ভার্সেস এক সময় আমেরিকায় স্থান ও বিষয় বিশেষে উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহৃত হত। এতগুলো কথা বলার কারণ নব্বইয়ের কবিতায় কাব্যজগতের এই বিরাট অধ্যায়ের উন্মোচন করতে গিয়ে আমি বারংবার হোচট খেয়েছি। দু’একজন কবির একটা চেষ্টা ছিলো বটে তবে তা আমার মত অজ্ঞ অভাজনের মনে দশকওয়ারী কোন রেখাপাত করতে পারেনি। এক দশকের অসংখ্য কবিদের মধ্য থেকে একজন দুজন অথবা পাঁচজনকে আলাদা করে ভাবতে হলে তা দশকের সার্থকতা নয় ব্যক্তিসার্থকতা বলেই মনে করি। তাই এই অলসতা ও স্থবিরতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা এরকম দু’একজন কবির কবিতা উল্লেখ করা যেতেই পারে। এক্ষেত্রে ব্রাত্য রাইসু , সাখাওয়াত টিপু এরকম দু-একটি নাম ছাড়া আর কোন নাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মধ্যবিত্তের শব্দসম্ভারে কিছুটা বিদ্রুপের মণ্ড মিলিয়ে এক ভিন্ন রুচি ও মাত্রা তৈরির চেষ্টা ছিলো। কিন্তু সেই চেষ্টা কতটা সাধারণের মনস্পর্শী হয়েছে বলা মুশকিল।
একটা বিষয়ের অবতারণা না করলেই নয়। নব্বই দশকের কবিদের কাব্য ভাবনাকে যথেষ্ট এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে লিটলম্যাগের একটা বিশাল ভূমিকা ছিলো। নব্বইয়ের প্রকৃত কবিগণও এই বিষয়টি অনুধাবনে যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তারা তথাকথিত বাণিজ্যিক ঘরানার পত্রিকার চাইতে ছোটকাগজে তাদের সাহিত্যের বিস্তার আর পরিধিকে বাড়িয়েছেন। ফলত প্রচলিত ফরম্যাট ও প্রাতিষ্ঠানিক রুল টানা খাতায় কবিরা তাদের কাব্যসুধাকে ফ্রেমবন্দী না করে ছোটকাগজের অসীমে করেছেন প্রেমবন্দি। এটি অবশ্যই নব্বইয়ের এক অর্জন বটে।
বেগম আকতার কামাল ’বাংলাদেশের কবিতা নব্বইয়ের দশকের প্রবণতা ও প্রান্ত’ শীর্ষক প্রবন্ধে মন্তব্য করেছেন নব্বইয়ের কবিতার কাঠামো তিনটি ’চিহ্নে’ পরিব্যপ্ত: ’ক. বিশ্ব ও বস্তুচেতনার ক্ষেত্রে বিশৃঙখল চৈতন্যের অভিঘাত; খ. রাজনীতি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সঙ্গে গড়ে-ওঠা বিচ্ছিন্নতার অতিক্রমণ-লক্ষ্যে প্রতিবাস্তব জগতে প্রবিষ্ট হওয়া; গ. আধুনিক বাংলা কবিতার প্রতিষ্ঠিত ফর্মের সঙ্গে অসদ্ভাব গড়ে তোলার বৈনাশিকতা অর্থাৎ আত্মবিরুদ্ধ হয়ে পড়া।’ তিনটি চিহ্নে আলো ফেললে নব্বইয়ের কাব্যভাবনার নতুনত্ব, অভিনবত্ব ও একই সাথে অসংলগ্ন আঙ্গিকনিরীক্ষার বিষয়টি সহজেই দৃশ্যমান হবে।
কবিতা মূলত কি দাবি করে বা বহন করে ? রহস্যময়তা, নতুন ভাষা সৃষ্টির দায়বদ্ধতা, উত্তরাধুনিকতা, ঐতিহ্য অভিমুখীতা, চেতনাবোধের জাগরণ, আত্মমগ্ন ভূমির উর্বর ও শিকড়ঘনিষ্ঠ প্রতিধ্বনি, সংকট, সম্ভাবনা, সংগ্রাম, দ্রোহ নাকি অভিনব বিনির্মাণ? আমি জানি না। সব জন্মই যেমন রহস্য ও রোমাঞ্চকর, কবিতাও তাই। ছায়া ধরার খেলা। নব্বই দশকের কবিরা তা কতটা ধরতে পেরেছেন বা পারেননি সেটি বিচারে আরো কিছু কাল বোধহয় আমাদের অপেক্ষা করা প্রয়োজন। আরো কিছুকাল দশককেও সময় দেয়া প্রয়োজন। হয় কি , যখন কোন গাছে ফুল সুন্দর হয় তখন অই গাছকে ফুলের নামে ডাকা হয়। যখন ফল ভালো হয় তখন ফলের নামে ডাকা হয়। আর বৃক্ষ যখন জীবনদায়িনী হয় তখন তাকে ঔষধি বলা হয়। নব্বই দশক তেমন করে দশকের মহীরুহ বা কবিতার ঔষধিবৃক্ষ হয়ে উঠতে পারলো কি? প্রশ্নটির উত্তর আমিও খুঁজছি ,আপনাদেরকেও সেই দায়িত্ব বর্তালাম।
সাধক সত্যানন্দের একটা কথা খুব মনে ধরে আমার,
‘অনেক কথার অনেক দোষ
বুঝেশুনে কথা কোস।’ —আমি শুনেছি তারপর বোঝার চেষ্টা করেছি। শুনেছি মানে নব্বইয়ের কবিতার কলরব, কুহুরব শুনবার আকাঙ্ক্ষায় কান পেতে রেখেছি। যেটুকু শুনতে পারেছি তার সফলতা অবশ্যই নব্বইয়ের কবিতার। আর যা শুনতে পারিনি তার ব্যর্থতা বোধকরি আমারই।