দেয়ালচিত্র । রোমেল রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ, | ৩৮১ বার পঠিত
হইচই হাসি কান্না চিৎকার আর শোনা যাবে না! আমরা দেয়াল! একটা বাড়ির দেয়াল! সারা বাড়ি মিলে আমরা অনেকগুলো দেয়াল! গায়ে গায়ে জুড়ে আছি অনেক বছর! কোন কোনটায় নোনা ধরেছে! চুন সুরকি পলেস্তারা খসে পড়ছে, কোন কোনটায় লেগে আছে নানান সময়ের দাগ! বাড়ির বাচ্চাদের আঁকাজোখা! হতচ্ছাড়া সব কথাবার্তা রেখার এদিক সেদিক! এপর্যন্ত চার দফা রঙ করা হয়েছিল বাড়িটায়! এদের ছেলেমেদের বিয়ের সময়তেই! ধীরে ধীরে বুড়ো হয়ে গেলো বাড়ির মালিক আর মালিকিন! যারা ভীষণ মমতা নিয়ে আমাদেরকে খাড়া করিয়েছিল! তিলতিল করে জমিয়েছিল টাকা! তারপর জমি কেনা, দখল বুঝে নেয়া! সেখানে বাড়ি করার ফিকির করা! ইট বালি সিমেন্ট রড কেনাকাটা করবার পর একদিন মিস্ত্রিরা এসে কাজ শুরু করলো! তারপর কাজ এগোতে লাগলো আর মালিক আর মালিকিনের খোয়াব জ্যান্ত হতে লাগলো! ওদের ছোট্ট ছেলেমেয়ে গুলো আসতো নিজেদের বাড়ির কাজ দেখতে! হয়তো ওদের গর্ব ছিল অন্য যারা ভাড়া বাড়ি থাকতো তাদের কাছে! তারপর বাড়ি হয়ে গেলে একদিন হইচই করে ট্রাক ভর্তি মালসামান নিয়ে কিছু কাছের আত্মীয় আর প্রতিবেশীদের ডেকে খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে কিছুটা ধর্মীয় আচার করে দেয়ালের ভাঁজে ভাঁজে বোনা বাড়িটার মধ্যে উঠে এলো ওরা সবাই!
লাভ নেই! একে একে সবার মধ্যে জীবাণুটা ছড়িয়ে গেলো! তারপর কে কাকে কাঁধে করে নেবে শেষ যাত্রায়? সব শেষ হয়ে গেলো ঝড়ের মতো! দেয়ালে লটকে থাকা রবীন্দ্রনাথের দাড়িতে সন্ধ্যার অন্ধকার ঝুলে আছে! অথচ একফোঁটা বাতি জ্বালবার কেউ নেই বাড়িতে! শেষ লাশটায় পচন ধরলে পরে কর্পোরেশনের লোকেরা এলো!
সেই থেকে প্রতিটা দিনরাত ছায়া দিয়ে আড়াল দিয়ে আছি আমরা এ বাড়ির লোক গুলোকে! কতো আনন্দ ব্যথা উচ্ছ্বাসের সমুদ্র ডিঙিয়ে এরা এলো! কতো হাজারো গল্পের ঢেউ! তারপর ঘুমিয়ে পড়া! এখনো বলে দেয়া যায় এই যে ওদের বুড়ো শোবার ঘরটার দেয়াল ধরে এদের ছোট ছেলেটা হাঁটা শিখেছে! ঐ বারান্দায় বসে ওদের মেয়েটা গান শিখত! একবার বাগানে কি যেন দেখে ভুত ভুত চিৎকার দিয়ে সারা বাড়ি মাথায় তুলল! শিউলি গাছাটা এখন বুড়ো হয়ে গেছে! যখন ছেলেমানুষ ছিল তখন ওর পাশে একটা মুর্গির খোপ ছিল! বাড়ির মালিকিন শখে কয়েকটা মুর্গি পুষেছিল! লোকে বলতো, মহিলার হাত ভালো! তাই কদিনের মধ্যে খোপ উপচে পড়েছিলো! ছেলেমেয়ে গুলোকে ঘরের ডিম খাওয়াত! মেঝো মেয়েটা ছিল গোঁয়ার! একবার সে গো ধরে বসলো তার এটাচ বাথরুমওয়ালা ঘর চাই! এমনভাবে গো ধরল মেয়েটা যে, তখন হাতে টাকা না থাকলেও ধার করে এনে ওর ঘরের একটা জানালা ভেঙে বানানো হল বাথারুম! আর আমরা পেলাম আমাদের পরিবারে আরও কিছু নতুন সদস্য দেয়ালকে! প্রথম প্রথম নতুন দেয়াল গুলো খুব ভয়ে ভয়ে কথা বলতো আমাদের সাথে,বয়সে অনেক ছোট তো! কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আপনে নিলাম আমরা! যেহেতু একটা দীর্ঘ জীবন এক যায়গায় কাটাতে হবে আমাদের! দক্ষিণের একটা খুপরি মতো বারান্দায় অবসরের সময়টা কাটিয়ে গেছেন বাড়ির মালিক লোকটা! এম্নিতে যখন চাকরি করতেন তখনো সন্ধ্যায় ফিরে জামাটা খুলে এক কাপ চা নিয়ে কিংবা সামান্য ঝালমুড়ি নিয়ে একটা মোড়ায় বসে যেতেন! তারপর এক সময় খোঁজ নিতে বেরোতেন অন্য ঘরে ছেলেমেয়ে গুলো কি করছে কি পড়ছে এইসবের! ছুটির দিন গুলোতেও এখানে বসে থাকতেন, তার স্ত্রী প্রায় জিজ্ঞেস করতো, এখানে ঘুপচির মধ্যে গুঁজে থাকো কেন? বসার ঘরে গেলে পারো কিংবা খোকা খুকুদের ঘরে! লোকটা কোন কথা বলতো না শুধু মুচকি হাসত! কিন্তু আমরা জানি! তার ঐ দক্ষিণের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে ভালো লাগতো! অন্ধকারের মধ্যে প্রায় প্রায় উনি ফিসফিস করে বলে উঠতেন, তোরা কি জানিস মানুষ হবার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বেঁচে থাকা থেকে একদিন সরে যেতে হয়! আমরা আসলে তখন বুঝতে পারি নি! এখন পারি, এই যে আমাদের ঢের বয়েস হয়েছে! দেয়াল গুলো খসে পড়ছে! ইট নড়বরে হয়ে গেছে! চলে যাবার বা ফুরিয়ে যাবার সঙ্গীত বেজে উঠেছে সেটা টের পাচ্ছি বলেই এখন মায়া লাগে ভীষণ! শক্ত দিন গুলোকে যাপন করবার পরেও এখনো কেবল মনে হয় পিপাসা মেটে নি! হয়তো একদিন কোন বিল্ডার্সের হাতে তুলে দেবে এই বাড়িটা! তারপর হুড়মুড় করে এক ঝটকায় ভেঙে চুরমার করে দেবে আমাদের! তারপর আমাদের সেই অস্থিমজ্জার ধুলো ঝেড়ে সেখানে জন্মাবে হাজার হাজার দেয়ালেরা! সেই আনন্দ টের পেলেও দুলে উঠতে পারি না, কারণ আমি তো সামিল হতে পারবো না সেই কল্লোলে! কিন্তু এই পরিবারটার গল্পের সঙ্গে দুটো প্রজন্ম পাড়ি দিয়ে তিনটে প্রজন্মে যেই নাম্লাম মাত্র, কিন্তু পাড়ি দেবার আগেই যেন এক ছোবলে সব নীল হয়ে গেলো! মহামারী এসে যখন একে একে সমস্ত দেশ গিলে খেলো! তারপর একদিন এই বাড়িটার উপর আছর করলো! আমাদের প্রতিটা দেয়াল প্রতিটা মুহূর্তে আতঙ্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো! মানুষ গুলো বাঁচবে তো? প্রথমে এরা সবাই গৃহবন্দী হল! অনেক বছর পর টানা এতদিন সবাই সবার কাছাকাছি থাকতে থাকতে আবার শুরু হল, আনন্দ, উল্লাস, কান্না, খুনসুটি, ক্রোধ! তারপর খুব ধীরে অভাব দেখা দিলো! সারা দেশের অল্প আয়ের সুখি মানুষদের সুখ যেভাবে খাবারের চিন্তায় উবে গেলো সেরকম আরকি! হাতের টাকা গুলো ফুরিয়ে আসলো! একটা সময় খাবারের সংকট দেখা দিলো আর এদেকে নেমে যেতে হল, এটা সেটা বিক্রি করে টাকা যোগাড় করতে! শেষমেশ রিলিফের লাইনে! সেটাও ব্যথার না! বিপদের মানুষই পরে! কিন্তু একদিন সবার আগে আমরা দেয়ালেরা জানতে পারলাম এ বাসায় মহামারীর অসুখটা ঢুকে পড়েছে! ব্যস! আতঙ্কে আমরা অস্থির হয়ে উঠলাম! কিন্তু আমাদের ভাষা তো ওরা বুঝবে না! কাকে কিভাবে জানাবো? লাভ নেই! একে একে সবার মধ্যে জীবাণুটা ছড়িয়ে গেলো! তারপর কে কাকে কাঁধে করে নেবে শেষ যাত্রায়? সব শেষ হয়ে গেলো ঝড়ের মতো! দেয়ালে লটকে থাকা রবীন্দ্রনাথের দাড়িতে সন্ধ্যার অন্ধকার ঝুলে আছে! অথচ একফোঁটা বাতি জ্বালবার কেউ নেই বাড়িতে! শেষ লাশটায় পচন ধরলে পরে কর্পোরেশনের লোকেরা এলো!
মানুষ গুলোর গল্প আমদেরকে ফেলে চলে গেলো! হায়! এই দুঃখে এখন আমাদের ইচ্ছে হয় হুড়মুড় করে ধ্বসে পরে যাই! কিংবা একটা বুল্ডোজার দিয়ে কেউ আমাদের গল্প ধুলো করে দিয়ে যাক! আমাদের দেয়াল গুলোতে এখন শুধুই হাহাকার! ইদানীং আমাদের মনে হয়, মানুষের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িও মরে যায়!
… ১৮ এপ্রিল ২০২০ …