তিরমনের বাঘ । রোমেল রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০১৯, ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ, | ১৪৯৭ বার পঠিত
তিরমন বাঘ দেখে। তিরমনের ধারণা বাঘ দেখা তার শুরু হয় হয়তো দুলাল নিখোঁজ হয়ে যাবার পর যেদিন সে এই শহরে আসে সেইদিন থেকে। কিংবা দুলাল হয়তো তারে এই বাঘ দিয়ে যায়। তিরমন দেখে একটা বিরাট রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। তিরমন দেখে তার শোবার চকির নিচে মেঝেতে একটা বাঘ হাতপা ছাড়ায়ে শুয়ে থাকে। ঠিক যেমন পোষা বিলাই ঘুমায়। তিরমন উঠে পা ঝুলিয়ে বাঘের পেটে বুড়ো আঙুল দিয়ে খোঁচা দেয়। বাঘটা অনেক কষ্টে চোখ মেলে। তিরমন তারপর বাঘের গলায় একটা গলাবন্ধনি লাগায় তারপর একটা শিকল। ঠিক যেভাবে সাহেব লোকেরা কুত্তা নিয়ে শহরের রাস্তায় বের হয় তেমন ভাবে তিরমন তার বাঘটাকে নিয়ে বের হয়। ফলে শহরের রাস্তায় হাউকাউ লেগে যায়।
লোকজন দৌড় দেয়। তিরমনের ভালো লাগে। সে আগায় যায় আর তারে দেখে চারপাশ ফাঁকা হয়ে যায়। নিজেরে মন্ত্রী মিনিস্টারের থেকেও উপরের জিনিস মনে হয় তিরমনের। কারণ তারে দেখে অনেকেই গাড়ি ফেলে পালায়। এমনকি পুলিশও তাকে দেখে দৌড়ানি দেয়। তিরমন দপদপিয়ে এগিয়ে যায় তার শিকলে বান্ধা বাঘটাকে নিয়ে। একটা বহুতল দালানের সামনে এসে দাঁড়ায় তিরমন। তাকে দেখে দারোয়ান তীরের বেগে ছুটে পালায়। তিরমন হাসি হাসি মুখে এগিয়ে যায়। লিফট বেয়ে এগারো তলার এক অফিসে যায়। এই অফিসে তিরমন কিছুদিন কাজের বুয়ার কাজ করেছিলো। এখানে সে সাক্ষাৎ করবে এই অফিসের মালিকের সঙ্গে। তিরমন যেইনা দরজা খুলে ঢুকে পড়ে বাঘ সহ মুহূর্তের মধ্যে হুলুস্থুল ঘটে যায় অফিসে। যে যেখানে পারে মাথা ঢুকিয়ে লুকায়। টেবিলের নিচে, বাথরুমে। তিরমন সেইদিকে মনোযোগ দেয় না সে মালিকের কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়, শুধু তার বাঘটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে অফিসটার দিকে তাকায়। তাতেই কেউ কেউ চিৎকার দিয়ে বাঁচাও বাঁচাও আকুতি জানায়। কেউ কেউ দোয়া পড়তে থাকে। তিরমন মালিকের কেবিনের দরজা ঠেলে ঢোকে বাঘটাকে নিয়ে। মুহূর্তে পিংপং বলের মতো এক লাফে টেবিলের উপর উঠে পড়ে মালিক লোকটা। তিরমন বলে, স্যর করেন কি! ছি ছি! নামেন। মালিক বলে, এটা কি জিনিস! তিরমন বলে, বাঘ! আমার পোষা বাঘ! জ্যান্ত! মালিক বলে, এখানে কি চায় সে? তিরমন বলে, আপনারে দেখতে আসছে। মালিক হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে বলে, বিদায় হও! তিরমন বলে, বিদায় তো হবো।
তার আগে আসেন টেবিলের নিচে নামেন। চার হাতপায় ভর দিয়া কুত্তার মতন বসেন, আপনেরে আইজ বাঘ দিয়া পোন্দাবো! মালিকের চোখ আতঙ্কে জমে যায়। তিরমন বলে, আপনের তো মাইয়া মানুষের পোঙ্গা হাতাইতে ভাল্লাগে, শারি টানতে ভাল্লাগে তাই ভাবলাম বাঘের পোন্দানি আপনার ভাল্লাগবে। আসেন স্যর কুত্তার মতন চার হাতপায়ে বসেন। মালিক লোকটা হাত জোড় করে বলে, আমারে মাফ করে দাও! আমি বাঁচতে চাই মা! তিরমন বলে, মাফ করাকরির কারবার নাই গো স্যর! আপনের খাসলত বদলাবে না। কাইল আরেক বেটির কাপড় খাব্লাবেন আপ্নে। আসেন যা বলতেছি তাই করেন। মালিক লোকটা চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, মাফ চাই। কতো টাকা চাও বল? তিরমন শিকলে একটা ঝাড়া দেয় ফলে বাঘটা নড়েচড়ে ওঠে। ফলে মালিক লোকটা হুড়মুড় করে টেবিল থেকে নেমে জানলা খুলে জানালার ফ্রেমে উঠে দাঁড়ায়। তিরমন হাতের শিকলটায় আবার ঝাড়া দেয়। যেন সে ক্রোধে চাবুক মারছে মেঝেতে। বাঘটা মুহূর্তে এক লাফে টেবিলে উঠে মালিকের দিকে তাকায় আর মালিক লোকটা জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে আতঙ্কে। তিরমন বেরিয়ে যায়। রাস্তায় নেমে সে হাঁটতে থাকে। ফুটপাথ দিয়ে তার শিকলে বাঁধা বাঘ নিয়ে হেঁটে যাওয়া দেখে রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে থাকা লোকদের কারো কারো মধ্যে বিস্ময়ের থমথমে জ্যাম লেগে যায়। কেউ কেউ গাড়ির জানালা থেকে লাফিয়ে বের হয়ে পালাতে ছোটাছুটি করে, কেউ কেউ গাড়ির জানালা আটকে ঝিম মেরে বসে থাকে। যেন এক না বাস্তব ব্যাপারস্যাপার। তিরমন হাঁটতে হাঁটতে তার একালার কাউন্সিলরের অফিসে যায়।
সিঁড়ি বেয়ে দোতলা অফিসে উঠতেই যথারীতি হাউকাউ লেগে যায়। কাউন্সিলর লোকটা শূকরের মতো ঘাড়েগর্দান শরীর নিয়ে রিভালবিং চেয়ারের মধ্যে এঁটে থাকে। তার নড়াচড়া ভয়ে জমাট হয়ে যায়। তিরমন বিনয়ের সঙ্গে বলে, ভালো আছেন ভাইজান? আইজকা কিন্তু গোসল দিয়া আসি নাই। বাঘ নিয়া আসছি। বাঘটার খালি খিদা পায়। দেখছেন কেমুন সুন্দর বাঘ। কাউন্সিলর কিছুই বলে না যেন সে বজ্রপাতে মরে শক্ত হয়ে গেছে। তিমনের আরাম লাগে যখন সে দেখে চেয়ারের হাতলের মধ্যে বন্দি হয়ে যাওয়া কাউন্সিলর ভয়ে ঘামতে থাকে কিন্তু কোন নড়াচড়া করে না, যেন সে একটা লাশ। তিরমনের বাঘটা জিহ্বা বের করে চিবুকের চারপাশ চাটে। ঘর্ঘর করে। এতেই অফিসের চারপাশে ঘাপটি মেরে থাকা জানোয়ার গুলো হুহু করে কাঁদতে লাগে যেন আর কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত হবে। তিরমনের মনে পড়ে, এই এলাকায় যখন সে এসেছিলো। চা বিক্রির ব্যবস্থা নিয়ে রাস্তার পাশে বসেছিল। তার কয়েকদিনের মধ্যে সে জানতে পারলো, এখানে চা বিক্রি করতে গেলে চাঁদা দিতে হয় ভাইকে। আশপাশের দোকানদারদের কাছ থেকে তরিকা জেনে নিয়ে সেও যুক্ত হয় নতুন দোকানী হিসেবে। চাঁদা না দিলে রাস্তার পাশে দোকান নিয়ে বসতে দেবেন না ভাইয়ের গুণ্ডারা। কিন্তু সমস্যা একটাই তিরমনের শরীরটার উপর তাদের লোভ পড়ে। কাউন্সিলরের লোকদের একটা আড্ডা জমে থাকে তার চায়ের দোকানের চারপাশে। এরপর একদিন এলাকা পরিভ্রমনে বেরিয়ে কাউন্সিলর তার দলবল নিয়ে তার দোকানে চা খেতে আসে। তাকে নিরিখ করে দেখে। তারপর সে নিচু স্বরে বলে, রাইতে অফিসে আসিস! গোসল কইরা আসিস।
তিরমন বুঝতে পারে না কয়েক মিনিট। যখন কাউন্সিলরের শাগরেদ বলে, ভাইর আবার কামলাগোর ঘামের গন্ধ পছন্দ না। এট্টু সাজুগুজু কইরা আসিস, কপাল ফিরা যাবে। তিরমন যায় না। হয়তো সেদিন রাতে কাউন্সিলরের সকল প্রস্তুতিতে জল ঢেলে দেয় তার না যাওয়া। বরং তিরমন তার দোকানে চা খেতে আসা দুই পুলিশকে এই কথা জানায়। তাদের একজন চা খেতে খেতে হেসে দিয়ে বলে, এক- দুইবার শুইলে কিছু হয় না! এইখানে ব্যবসা টিকাইতে গেলে একটু- আধটু শোয়াশুয়ি লাগে। তর তো কপাল ভালো কাউন্সিলর ডাকছে। তার কুত্তা গুলান যে টানাটানি করে নাই এইটাই ভাগ্য! তিরমন হতভম্ব হয়ে থাকে। সেই কাউন্সিলরের মুখোমুখি আজ তিরমন। তার বাঘ লাফ দিয়ে কাউন্সিলরের টেবিলে ওঠে। তিরমনের চোখে পানি এসে যায়। তার মনে পড়ে, এরপর একদিন কাউন্সিলরের কয়েকজন পোষা মহিলা এসে তাকে ডেকে নিয়ে যায়। তারা যেখানে তাকে নিয়ে যায় সেখানে গিয়ে তিরমন বুঝতে পারে সে বন্দি হয়ে গেছে।
সেদিন কাউন্সিলর একটা চেয়ারে বসে চোখ বুজে ছিল আর একজন কেউ তার মাথা বানিয়ে দিচ্ছিল। কাউন্সিলর ধমকের সুরে বলে, এলাকায় ঢুকতে না ঢুকতেই তুই গুটি বিক্রির ব্যবসা শুরু কইরা দিছস? চালু মাল! পুলিশে ধরায় দিবো। তিরমনের মাথায় মধ্যে ঝা ঝা করতে থাকে এই মিথ্যা অভিযোগ শুনে। তারপরের অংশ তিরমনের মনে করতে ইচ্ছা হয় না। কিংবা হয়তো এমন হয় আগেরবার রাতে তিরমন না যাওয়ায় পরের দিন তার দোকান হয়তো ভেঙে দিয়ে যায় কাউন্সিলরের লোকেরা। এই স্মৃতি মনে পড়তেই ফুঁসে উঠে তিরমন তার বাঘটার শিকল ধরে নাড়া দিতেই। কাউন্সিলরের মুখোমুখি তাকিয়ে থাকা বাঘটা একটা থাবা দেয় কাউন্সিলরের গালে। এক খাবলা মাংস উঠে আসে এবং সে চেয়ার নিয়েই হুরমুড়িয়ে পড়ে যায়। বাঘটা মেঝেতে পড়ে থাকা কাউন্সিলরের শরীরটাকে নাড়ায়, যেভাবে শিকার করা ইঁদুর নিয়ে বিড়াল খেলা করে; তারপর বাঘটা তিরমনের কাছে ফিরে আসে। যেন বাঘটা জানায়, এক থাবাতেই বিরাট সাহসী কাউন্সিলর ভ্যাটকায় গেছে। তিরমন একদলা থুঃ ফেলে বেরিয়ে আসে। তিমনের গ্রামের বাড়ি যেতে ইচ্ছা হয়। ভীষণ ইচ্ছা হয়। কিন্তু সেখানে গেলে যদি দুলালের সঙ্গে আর দেখা না হয়? তার ভয় হয়। তার কেবল মনে হয়, সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে আর দুলাল তার সামনে দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেছে।
গ্রামে গিয়ে যদি দুলাল তাকে না পায় তবে সে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে। দুলাল তারে বিষম ভালোবাসে। দুলাল আর তার ছিল একটা টোনাটুনির সংসার। একটা মাছের ঘেরে তাদের ঘর ছিল। দুলাল বাজার করে আনত কিংবা তিরমন শাকপাতা যোগাড় করতো মাঠ থেকে তারাপর তারা রান্নাবান্না করে খাওয়াদাও করতো আর গালগল্প। চারদিকে মাছের ঘের। সেই বিস্তীর্ণ জলের পুকুর গুলোর এক পাশে তাদের সংসার। রাত্রে জলের বুকে মাছের ঘাই মারার শব্দ। সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দুলাল বিচিত্র ফাজিল ফাজিল কথাবার্তা শোনাত তিরমনকে। সেইদিন গুলার কথা ভাবলে চোখে জল আসে। বাতাস বাড়লে দুলাল হয়তো আলজান পরী- ভাঙন মাঝির কেচ্ছা থেকে একমাত্র মুখস্ত স্তবকটা পড়ত।
আলজান রূপসীর নামে গুণগুণ
সে যেন সবুজ মাঝে সোনালু আগুন।
ভাঙন মাঝির মন পোড়ে সে আগুনে
বাতাস উদাস হয় সে কাহিনী শুনে।
কুমকুমি নদী কূলে আসে আলজান
তারে দেখে কুপোকাত মাঝির পরাণ।
ভাঙনের বুকে যেন ঢেঁকি দেয় পাড়
আলজান জিজ্ঞাসে, খোঁজ করো কার?
সহসা চেতন ফিরে মাঝি বলে, তারে।
পুনরায় আলজান বলে, কে আমারে?
সহসা ভাঙন মাঝি সাহস নিয়েই
বলে ফেলে, ধরো খুঁজি আমি তোমারেই!
নিমিষে ক্রুব্ধ হয়ে বলে আলজান,
জানো না আগুন আমি ছাই করি প্রাণ।
ভাঙনের অন্তরে প্রেম ঢেউ ওঠে
যেন দড়ি ছেঁড়া গরু বিপুলার গোঠে।
মনের সুরেতে মাঝি বলে এইবার,
সকল দিবার রাজি চরণে তোমার।
আলজান রেগে বলে, মরণ আমার;
পিরিতে বিষম ডর জানো না আমার।
ভাঙনের মুখে জাগে বেদনার রেখা
সহসা চমকে উঠে বিদ্যুতের লেখা!
হাঁটু ভেঙে বসে পরে হাত মেলে বলে,
তুমি যদি রাজি হও নামি এক জলে!
প্রতিবার দুলাল এই স্তবক পড়তো। তিরমন তাকে জিজ্ঞাস করতো কেমনে সে এইসব শিখেছে? দুলাল রহস্য করে বলতো, আমার মইধ্যে এম্নেই আছে এইসব। তিরমন হয়তো বিভ্রান্ত হতো কিংবা দুলাল হয়তো বলতো যে, সে এর আগে একজন জ্ঞানী লোকের বাড়িতে কামলার কাজ করতো। সেখান সেই জ্ঞানী লোকটা এইসব সুর করে পড়তো। দুলালের এই অংশটা শুনে শুনে মুখস্ত করেছে। তারপর দুলাল বাঘের গল্প বলতো। বিচিত্র সেইসব গল্প শুনে শুনে কখনো কখনো তিরমনের মনে হতে থাকে, লোকটার ছেলেমানুষ আছে। কিংবা তার মনে হয় লোকটার মাথায় সামান্য গণ্ডগোল আছে তা না হইলে, কেউ বাঘ পোষার খোয়াব দেখে? নিজেরাই খাইতে পাই না বাঘরে খাওয়াবো কি? তবু গল্প গুলো শুনতে ভালো লাগে তিরমনের। তারা সুখে শান্তিতে বাতাসের মধ্যে ভেসে যেতে থাকে। দুলাল তিরমনকে বলে, ডানাওয়ালা বাঘের গল্প, কানকোওয়ালা বাঘের গল্প; কিংবা পাতালে মিশে থাকা এক পাতাল বাঘের গল্প! তিরমনের ভয় লাগতো, মানুষটা পাতাল বাঘের গল্প জানে কেমনে? তারা কি ভালো বাঘ নাকি মন্দ বাঘ? পাতাল বাঘ আর বাঘিনী নাকি আন্ধারে হাঁটাচলা করে।
তারা আলোতে দেখতে পায় না। আমাবস্যায় তারা জমিনে উঠে আসে শিকার করে টেনে নিয়ে যায় পাতালে। তারপর তারা অপেক্ষা করে আরেক আমাবস্যার! এইসব গল্পের মধ্যে একদিন মধ্য নিশিতে একদল অস্ত্রধারী লোক এসে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় দুলালকে। তিরমনের মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। সে কিছুই বুঝতে পারে না। ফলে সে ছোটাছুটি করে এর বিহিত করতে। সে চেয়ারম্যানের কাছে যায়। তারা কেউ পাত্তা দেয় না। থানায় গিয়ে খোঁজ পায় না। অনেকদিন সে এভাবে খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। সাংবাদিকদের কেউ তারে নিয়ে নিউজ করে। সেই নিউজ এক- দুই কিস্তির পর আর বের হয় না। তবে তিরমন ছোটাছুটি করতে করতে জানতে পায়, এদেশে এমন ঘটে। অন্য কোন মামলায় হয়তো ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে দুলালকে। দিনের পর দিন থানার সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে তিরমন। সবাই তাকে দেখে কিন্তু কেউ পাত্তা দেয় না। একদিন দেবদূতের মতো এক লোক উদয় হয়। লোকটা তিরমনকে বলে, চেয়ারম্যানের কাছে যাও। সে তদবির করবার পারে।
তিরমন চেয়ারম্যানের কাছে যায়। হাত পা ধরে কান্নাকাটি করে। চেয়ারম্যান বলে, কি জানি কোথায় কি করছে। এম্নে এম্নে কি আর ধইরা নিয়া যায়? দ্যাখ যাইয়ে কোথাও কাইজে করিছে নালি নেশাপাতির কারবার করিছে গোপনে। তিরমন তার স্বামীর স্তুতি করে। চেয়ারম্যান বলে, অতো কথা কইয়ে কাজ নেই। মামলা যখন খাইছে তখন তারে সহজে পাবি নানে। তার চাইয়ে এইখানে আমার বাড়িতে থাক। মাজায় বাতের মলম লাগানোর একজন বান্দি খুঁজতিছি আমি সেই কাজে লাইগে যা। তোর স্বামীর ছাড়া পাতি দেরি হবেনে। তিরমন বলে, সে তার স্বামীরে ছাড়া বাড়ি ফিরবে না। চেয়ারম্যান বলে, স্বামীর কাম কি? এহেনে থাক, লাগলি আমি স্বামীর কাম কইরে দিবানি। তিরমন বেরিয়ে আসে। থানায় ঘুরতে থাকে। তারপর আবার একদিন সেই দেবদূতের মতো লোকটার সঙ্গে দেখা হয় তিরমনের। লোকটা যখন জানতে পায় চেয়ারম্যান তাকে সাহায্য করতে নারাজা উল্টা সে তারে কামনা করেছে। তখন লোকটা বলে, আচ্ছা আমি তোমার বরের খোঁজের একটা ব্যবস্তা নিচ্ছি।
তারপর একদিন লোকটা জানায়, তার স্বামী দুলাল দেশের কোন জেলখানায় আছে তার সন্ধান। এবং দুলালের চার বছরের জেল হয়েছে সেই খবর। তিমনের ইচ্ছা করে চেয়ারম্যানকে দুই টুকরা করে ফেলবার। ততদিনে তিরমনের সব কিছু চলে যায়। সে পথে নেমে আসে। বাপের বাড়ি ফিরে যেতে রাজি না সে। শ্বশুর কূলে কেউ নাই তার। তিরমন তার নাক ফুল বন্ধক রাখে। সেই টাকায় সে দুলাল যেই শহরের জেলখানায় আছে সেই শহরে আসে। এই শহরে আসার দিন থেকে তিরমনে দেখে তার পাশে এই বাঘটাকে। তার কেন জানি ভয় লাগে না। সে বুঝতে পারে এটা দুলালের পোষা বাঘ! তারপর শুরু হয় তিরমনের অন্য জীবন। খাবারের জন্য তুলকালাম লড়াই চলে। অবশেষে যখন সে একটা অফিসে কাজের বুয়ার কাজ পায় তখন অন্তত তার খবারের কষ্ট মেটে। কিন্তু সেই কাজ খুব বেশি দিন তার পক্ষে করা সম্ভব হয় না। মালিক লোকটা তিমনের উপর হামলে পড়ে। তিরমন বেরিয়ে আসে। কিছুদিন সে ভিক্ষা করে। তারপর সেই টাকা থেকে জমানো কিছু টাকা দিয়ে একটা কেটলি, একটা চুলা আর কয়টা কাপ নিয়ে বসে যায় রাস্তার কিনারে। আর ফাঁকে ফাঁকে সে হাজতে লাইন করতে থাকে।
একদিন সে তার স্বামীর দর্শন পায়। সেইদিন তারা দুইজন লোহার নেট আর গারদের দুইপাশে দাঁড়িয়ে শুধু কান্দে। শুধুমাত্র তারা দুইজন এইটুকু জানতে পারে যে, তিরমন এখন এই শহরে, এই জেলখানা রোডের আশপাশে রোজ সারাদিন অপেক্ষায় থাকে। আর দুলাল জানায় হাজতে তার নাম, শরিফুল ইসলাম। চেয়ারম্যান পুত্রের নামে তার নাম। তারপর দুলালকে পুলিশ বলে, সময় শেষ! তারপর তাদের দেখাদেখি শেষ হয়। তিরমনের এই দেখাদেখি শেষ হওয়া মাত্র মনে পড়ে যেইদিন দুলাল তাকে বিয়ের জন্য দেখতে আসে সেদিনের গল্প। দুলালের এক দূরসম্পর্কে চাচা বলে, মেয়ের রঙ তো চাপা!
তার উপর শুকনা খড়ির মতন গায়ে কিছু নাই। তিরমনের এক খালা বলে, বিয়ার পর জামাই বানায় নিবো নে গতর। বাক্য শুনে আড়ালের মহিলারা হেসে ওঠে। তিমনের ভাইয়েরা ভীষণ বিরক্ত হয় খালার এই অতিমধুর রসিকতায়। দুলালকে যখন জিজ্ঞাস করা হয় তার পছন্দ কিনা? দুলাল বলে ওঠে, আমি এই মাইয়ারেই বিবাহ করবো! সেই বাক্য শুনেও আড়ালের মহিলারা হেসে ওঠে। তিরমন চোখ মুছতে মুছতে আগায়। সেদিন রাতে তিরমন পরম আনন্দ নিয়ে ঘুমাতে যায়। বহুদিনপর তার চোখে শান্তির ঘুম আসে। চোখ বন্ধ হলেই বাঘটা জন্ম নেয়। তারপর তিরমন বাঘ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। বাঘ নিয়ে বের হয়ে মাঝেমাঝে তিরমনের ইচ্ছে হয়, বাঘের পিঠে চড়ে এক লাফে জেলখানার দেয়াল টপকে ঢুকে গিয়ে দুলালকে বের করে নিয়াসে। কিন্তু সে পর্যন্ত বাঘ নিয়ে আর যাওয়া হয় না। শুধু এইসব মানুষদেরকে খুন করতে করতে বাঘটা নিয়ে সে এগিয়ে যায়।
কাউন্সিলর যেদিন তার দোকান উঠিয়ে দেয় তার কদিন পর তিরমন দুটো ফ্লাক্স নিয়ে হেঁটে হেঁটে চা বিক্রি শুরু করে। শুধুমাত্র এই জেল রোডেই সে চা বিক্রি করে। তার কাস্টমারদের বেশিরভাগ কয়েদীদের সঙ্গে দেখা করতে আসা আত্মীয়রা। তিরমন এই জেলখানা রোড ছেড়ে যেতে রাজি না। দুলালকে সে তার চোখ ফসকে যেতে দেবে না। সে চা বিক্রি করে আর অপেক্ষায় থাকে কবে দুলালের ছুটি হবে! তিরমন ভাবে দুলাল বের হলে তারা কি আবার গ্রামে ফিরে যাবে? সেইখানে তাদের ভিটে নেই। ফিরবে কার কাছে? যদিও মাটির টান সে টের পায়।
কিন্তু মানুষ কই? যেই মানুষেরা দুলালকে হাজতে পাঠায়। সেই গ্রামে কি দুলাল টিকতে পারবে? তিরমন ভাবে, দুলাল জানিয়েছে হাজতে সে হাতের কাজ শিখছে। বিচিত্র জিনিস বানানো সে শিখে গেছে, বের হয়ে তারা এই কাজ করবে। তিরমন নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করে এই জন্তুদের ভিড়ে প্রতিদিন নিজেকে বাঁচাতে বাঁচাতে। কোন কোন দিন তিরমন ঠিক করে এই অচেনা শহরে দুলাল- সে আর তাদের বাঘ থেকে যাবে। আবার কখনো কখনো তিরমন দেখে যে, দুলাল আর সে ডানাওয়ালা বাঘের পিঠে চড়ে আকাশে উড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে।