মুখোশামি । অর্ক চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:১০ পূর্বাহ্ণ, | ৩৯৩ বার পঠিত
১
— মুখের ওপর ওটা কি রে?
—শ্বাস নিচ্ছে কি করে?
— ফাঁক আছে, ফাঁক আছে, ফাঁক থেকেই যায়!
—আরে তোরা বুঝতে পারছিস না ওটা কি?
— না তো, কেন, তুই জানিস?
— একদম। কিছুদিন মানুষের বাড়িতে পোষ্য হবার এটাই তো সুবিধা!
— তবে বলে ফেলুন জাঁহাপনা!
— আরে আমাকে মুখে ওরম একটা জিনিস পরিয়ে দিয়েছিল একবার। বাড়িতে এটা ওটা খেয়ে নিচ্ছিলাম। তাই শাস্তি। যাতে মুখ না খুলতে পারি। আংটা দিয়ে আটকানো। চোয়ালে কি যে ব্যাথা হয়েছিল কি বলবো! তারপরই তো কেটে পড়লুম!
— হুম। মানুষগুলো জব্দ হয়ে গেছে বলছিস?
— হ্যাঁ, ওদের মুখে আংটা আটকানোর জন্য কি নতুন কোন প্রাণী এলো নাকি?
— দেখা তো যাচ্ছে না!
— তবে একটা জিনিস খেয়াল করেছিস? মানুষগুলোকে আগে যত দেখা যেত রাস্তাঘাটে এখন কিন্তু তেমন দেখা মিলছে না।
— কেস খেয়েছে বলছিস?
— মনে তো হয় তাই!
২
আজকাল খোলা হাওয়া যা পাওয়া যায় শুধু ঘরের ভিতর। বাইরে বেরোলে আগে ফুল প্যান্ট পরতো অমল। আজকাল মাস্কও পরতে হয় মনে করে। মহামারীর প্রকোপ কমলেও হতচ্ছাড়া ভাইরাস যায়নি এখনো। তাই বাইরে বেরোলে ঠোঁট মুখোশের মধ্যে দিয়েই ওঠা নামা করে। জোরে জোরে হাঁটতে গিয়ে হাঁপ ধরলে মুখটা হাপরের মত খোলা বন্ধ হতে থাকে। শেষ কয়েক মাসের গৃহবন্দী অবস্থায় শুধু মেদ বেড়েছে তাই নয়, দাঁত দিয়ে রক্ত পড়াও শুরু হয়েছে। প্রথমে পাত্তা দেয়নি অমল। অমন তো আগেও হয়েছে মাঝে মাঝে। কিন্তু এবার একটু বেশিই হতে শুরু করেছিল।
ঘুম থেকে উঠলেই মুখের ভিতর রক্তের অস্বস্তিকর স্বাদ। চকোলেট খেতে গেলে ব্রাউনের মধ্যে রেডের উঁকিঝুঁকি। ভয়টা পেয়ে বসাতে ডেন্টিস্ট দেখালো অমল। ক্যাভিটি, প্লাক ডিপোজিশন। কত্ত কি! যাক সে নয় কিছুটা মিটলো, কিন্তু রক্তপাত একেবারে বন্ধ হল না। ডাক্তার বললেন, “চিন্তার কিছু নেই! আপনার ইন-ব্রিদিং এর প্রবণতা আছে, অর্থাৎ, মুখ দিয়ে শ্বাস নেন! মুখের গঠনের জন্য অনেকের এমন হয়। এতে হাওয়া লেগে মাড়ির ক্ষতি হয়। আপনার দাঁত খুব ভালো। সমস্যা কেবল মাড়িতে।” অমলের দৃঢ় ধারণা, মুখোশের মধ্যে দিয়ে শ্বাস নিতে গিয়েই এইসব ইন-ব্রিদিং-টিদিং এর ঝামেলা টামেলা হয়েছে। নাহলে, কই, আগে তো হয়নি এমন টানা রক্তপাত?
মাথার ভিতরকার সিনেমা শেষ। এবার বাইরের দৃশ্য দেখার পালা। আধো অন্ধকারে সজাগ চোখে ঠাহর করলো অমল। সাদা-কালো কুকুরটা দাঁড়িয়েছে সামনে, রাস্তার মোড়ে। কিন্তু চেঁচাচ্ছে না তো? নখদাঁত বেরোয়নি! উল্টে ল্যাজ নড়ছে পেন্ডুলামের মত। তবে কি ফাইনালি চিনতে পারলো ওকে? অমল ভয়ে ভয়ে গিয়ে ওর সামনে দাঁড়াতেই জুলজুল চোখে করুণ মুখ করে ওর দিকে তাকালো কুকুরটা। অমল মুখোশ নামিয়ে মাটিতে বসে আদর করে দিল ওর মাথায়।
আজকাল বিকেলের দিকে হাঁটতে বেরোলে মেঠো রাস্তায় উঠে মাস্কটা খুলে ফেলবে, ভাবে অমল। তারপর হঠাৎ একটা সাইকেল, একটা বাইক এসে পড়ে কোথা থেকে। চালকরা কেউ মুখোশ পরে নেই! ভয়ে আবার নাকের ওপর তুলে নেয় কিছুটা নামিয়ে ফেলা সার্জিকাল মাস্কখানা। ক্ষেত পাহারা দেওয়া একটা কুকুর দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসে। অমল কুকুর ভালোবাসে, তাই কুকুর ওর সঙ্গে ঝামেলা করতে এলে মনে বড় গভীর দুঃখ নেমে আসে। সান্ধ্য মন একেকদিন একেকটা আত্মতৃপ্তিকারী ব্যাখ্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে:
— ব্যাটা নিশ্চই বাচ্চাগুলোর জন্য আমায় খেঁকাচ্ছে। ভাবছে আমি ছেলে বা মেয়েধরা!
— বাচ্চাগুলো তো বড় হয়ে গেছে! তাও? …
— ও কি রোজই আমায় অন্য লোক ভাবে? নতুন লোক?
— গন্ধ পায়না? চিনতে পারে না কেন?
— মুখ দেখতে পারছে না বলেই কি? …
৩
— ভয় দেখাতে এসেছিল মুখের ওপর কিসব পরে? এমন চেঁচিয়েছি না, পালিয়েছে এক দৌড়ে!
— অরে পাগলা, ওটাকে মাক্স বলে।
— মাক্স? কি করে জানলি?
— অরে গেলবছর যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলুম রাস্তায়, ক্লাবের ছেলেগুলো আমায় হাসপাতালে নিয়ে গেল না? ওখানে দেখেছি, অনেক ডাক্তার মুখে অমন মাক্স পরেছিল।
— ডাক্তারদের পরার জিনিস তো সবাই রাস্তাঘাটে পরে ঘুরছে কেন?
— দুনিয়াটাই হাসপাতাল হয়ে গেল নাকি?
— হয়ত! সবাই রোগী, তাই সবাই মাক্স পরা ডাক্তার।
— আমরা তো ঠিকই আছি! আমাদের তো কোন রোগ হল বলে মনে হচ্ছে না!
— হলেও কি সব বোঝা যায় রে? হয়তো দেখবি টুপ করে একদিন…
— অরে আমরা তো ফেউ, ফেকলু! আমাদের কে পোঁছে, বল? মরলেই বা কি?
— ভোট দিই না বলেই কি আমাদের পাত্তা দেয় না মানুষের দল?
—গাড়ি ধাক্কা, পাথর ছোঁড়া, যা বলেছিস, মরার মধ্যেও তো একটা মানসম্মান থাকা উচিৎ!
— মরে পড়ে থাকি মাঠেঘাটে। শরীর পচে যায়, ফুলে ঢোল! কবে মিউনপাল গাড়ি এসে নিয়ে যাবে, আদৌ নিয়ে যাবে কিনা কেউ জানে না!
— সবার ভাগ্যে কি আর ঐ মিউনপাল গাড়ি জোটে?
— যাক যা বলছিলাম, আজকাল আম্বুগাড়ির শব্দটা কত বেড়ে গেছে দেখেছিস! দিনরাত লোকে হাসপাতালে যাচ্ছে। বলছি শোন, মানুষগুলো বড়োরকম একটা ঝামেলায় পড়েছে!
— তার মানে এখন মরলে মিউনপাল গাড়িটাড়ি পাবো না বলছিস?
— হ্যাঁ, এখন মরাটা ঠিক কাজ হবে না!
৪
অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। এবার ফিরতে হবে। অমল ভয়ে ভয়ে আসছে সেই জায়গাটায় যেখানে বদখদ কুকুরটা থাকে। দেখলেই তেড়ে আসে। পেছনপেছন আসতে থাকে চিৎকার করতে করতে। ফিরে তাকালে দুপা পিছিয়ে যায়। হাঁটা লাগালে আবার ঘেউ ঘেউ করে ফলো করে। তবে ঐ একটা জায়গা পর্যন্ত। তারপর আর আসে না। কুকুর মাত্রেই তো খুব টেরিটোরিয়াল। রাগও যেন স্থানিক! মনে মনে একটা দৃশ্য ভেবে নেয় অমল:
সাদা-কালো কুকুরটা তাড়া করেছে। মুখোশে মুখ ঢেকে ছুটতে শুরু করেছে অমল। অন্ধকার গিলে খেতে আসছে চারদিক থেকে। কুকুরটার চিৎকার ইয়ারফোন ভেদ করে ঢুকে আসছে বিপদঘন্টার মত! কিসে একটা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে অমল। কুকুরটা ঘাড়ের কাছে শ্বাস ফেলছে। দাঁতগুলো বেরিয়ে এসেছে। কামড় দেবার ঠিক আগের মুহূর্ত। যেটায় হোঁচট খেয়ে পড়েছিল অমল সেই ইঁটটা এক ঝলকে তুলে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছে কুকুরটার মাথায়। তার মুখোশে রক্তের ছিটে এসে লেগেছে। আত্মরক্ষার তাগিদ নাকি হিংসা, জানা নেই তবে ঐ এক মুহূর্তে অমল যেন দারা সিং হয়ে উঠেছে। কুকুরটার নিথর শরীর মাটিতে পড়ে। মাথার গর্ত থেকে রক্ত বেরিয়ে মুখে রক্তের মুখোশ পরিয়ে দিয়েছে। অমলের সর্বাঙ্গে একটা কাঁপুনি শুরু হয়েছে।
হঠাৎ ধুনকি ভেঙে গেল। মাথার ভিতরকার সিনেমা শেষ। এবার বাইরের দৃশ্য দেখার পালা। আধো অন্ধকারে সজাগ চোখে ঠাহর করলো অমল। সাদা-কালো কুকুরটা দাঁড়িয়েছে সামনে, রাস্তার মোড়ে। কিন্তু চেঁচাচ্ছে না তো? নখদাঁত বেরোয়নি! উল্টে ল্যাজ নড়ছে পেন্ডুলামের মত। তবে কি ফাইনালি চিনতে পারলো ওকে? অমল ভয়ে ভয়ে গিয়ে ওর সামনে দাঁড়াতেই জুলজুল চোখে করুণ মুখ করে ওর দিকে তাকালো কুকুরটা। অমল মুখোশ নামিয়ে মাটিতে বসে আদর করে দিল ওর মাথায়। মগজের সিনেমায় যেখানে গর্ত করে দিয়েছিল ইঁট মেরে, পরম পাপমিশ্রিত ভণ্ড ভালোবাসায় সেইখানে হাত বুলোতে লাগলো। আদরে কুকুরটার চোখ বুজে এল।
পরিশিষ্ট
আদরের আঙুলে চোখ বন্ধ হতে অক্ষিগোলকের অন্ধকারে সারমেয় দেখতে পেল, মাটিতে পড়ে রয়েছে তার নিষ্প্রাণ দেহ। রক্তধারা মুখের ওপর মুখোশের মত এক তরল প্রলেপ তৈরী করেছে। সে মুখোশ মুখ ছেড়ে মাটি বরাবর রক্তনদী হয়ে বয়ে চলেছে। সামনে বসে থাকা হতভম্ভ লোকটার হাতে রক্তাক্ত ইঁট। মুখ থেকে খুলে এসেছে মাক্স। মানুষের দুনিয়ায় বিপদ নেমে এসেছে। সবাই অসুস্থ, অথচ সবাই ডাক্তার!