যাপিত জীবন নস্টালজিয়ার ভিতর । শিবলী জামান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ এপ্রিল ২০২১, ২:১৭ পূর্বাহ্ণ, | ১৩৬৫ বার পঠিত
বদরুজ্জামান আলমগীরের কাব্যময়তার জগত একধাপে আবিষ্কার করা যায় না। তাঁর শিল্পসৌকর্যের জৌলুস ক্ষণে ক্ষণে প্রকাশিত হয়। তিনি তাঁর কাব্যে দেশপ্রেমকে এক মহতী প্রেরণা হিশেবে দেখেছেন।কাব্যের প্রায় সব কবিতাই বঙ্গের জল হাওয়ায় ঋদ্ধ।লৌকিক শব্দ, লৌকিক আচার,সংস্কার, প্রেম, বিরহ, রোমান্টিকতা, বিষাদ, মুক্তিযুদ্ধ, মার্কসবাদ, পুঁজিতন্ত্র, জাতীয়তা এবং আন্তর্জাতিকতা সবই তিনি ছেঁকে তুলেছেন তাঁর কবিতায়।মুক্ত ছন্দের প্রতি বিশেষ অনুরাগ, কখনো অক্ষর বৃত্তের মধ্য পয়ার ছন্দের খানিক রেশ থাকলেও ট্র্যাডিশনাল ছন্দ তাঁর আয়োজনে তেমন নেই। কিন্তু তারপরও তিনি মুক্ত হয়েও মুক্ত নন, ছন্দকেই তিনি কবিতার প্রাণ মনে করেন, কারণ তাঁর রক্ত-মাংস কবিতার প্রেরণায় লালিত।
সময়ের গঠিত শীর্ষ বিন্দুর আর্তিই কবিতা। সময়ের আছে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। বইয়ের প্রথম কবিতা ‘অন্তর্গত’ জীবন ভাগাভাগির সুতীব্র কামনা; তিনি এক সত্তার শতায়ু চেয়ে আর্তি প্রকাশ করেন এভাবে—
“তোমার শত বর্ষাধিক আয়ু হোক
এ-অভিকল্যাণ আশা পূর্ণ হতে
আমার আয়ু যদি লাগে,তা-ও নাও।”
কবি কার শতায়ু চাচ্ছেন? তা এক রহস্যময় ব্যাকুলতা দিয়ে ঢাকা। এ কবিতার আরেকটি চরণে রয়েছে এক বিস্ময় জাগানিয়া অনুরোধ, যার মধ্যে দুলছে মহা জগতের দ্বান্দ্বিক আর্তি—
“সাঁতার শিখে নিও বিনম্র শিখা।”
তার পরই কবি কৃষানীর ভিতর দেখেন হাজার বছরের হাজারো মা— তাঁর দেখার রুপটি এ-রকম—
“এমন একটি স্নিগ্ধতা তোমার ভিতর দেখি
হাজার বছর আগেকার একজন কৃষানী যেন
নিজের পিঠে তুলে নেয় সকল শৈত্যপ্রবাহ
আর সবার জন্য নির্ধারণ করে ওমের কল্যাণ।”কবি মনের এই ব্যাকুলতাই কবিতার বীজ যা কবিকে জীবনভর তাড়িয়ে নিয়ে যায়। যেদিন এই ব্যাকুলতা থাকে না সেদিন থেকে কবিই আর কবি থাকেন না, বলার সে ব্যাকুলতাই একজন কবিকে কবি করে রাখে। বদরুজ্জামান আলমগীরের এ ব্যাকুলতা মনে করিয়ে দেয় তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের কথা। কোথায় যেন তাঁরা পরষ্পরের প্রতি সংক্রামক ভাবে সাড়া দেন। নাজিম হিকমত বারবার ফিরে গেছেন তাঁর স্বপ্নের কাছে, দেশের কাছে, প্রিয়তমার কাছে।
এখানে একজন নারী হাজারো নারী হাজারো মা, যিনি শুধু সন্তানের কল্যাণ কামনাতেই থেমে যান না নিশ্চিত করেন পৃথিবীর কল্যাণ,যার মধ্যে কবি দেখেছেন কন্যা-জায়া-জননীর রুপ ও স্বভাব; কিন্তু তার পরও কেন কবি কবিতার শেষ চরণে এসে বলেন—
“তোমার মধ্যে শতবর্ষের দ্বিধা হোক।”
এ জিজ্ঞাসার জবাব খোঁজা এক ধরনের মুশকিল, আর এই মুশকিলত্ব খুঁজতে যাওয়া-ই কবিতা। এই কবিতায় আলো ফেললেই আমরা মুখোমুখি হই অনেক ভাবনা আর প্রশ্নের । এখানে আমরা তিনটি প্রশ্ন নিয়ে কথা বলবো—
একঃ এখানে কবি কার শতায়ু কামনা করেন?
দুইঃ কেন অগ্নিশিখাকে সাঁতার শিখতে অনুরোধ করেন?
তিনঃ কবি কার মধ্যে শতবর্ষের দ্বিধা জন্মাতে বলেন?
এই তিনটি প্রশ্নের মধ্য দিয়েই বদরুজ্জামান আলমগীরের কবিতায় প্রবেশ করে আমরা পাই “পথ” নামক কবিতাটি—
“বলতে বলতে
বলা হয়ে গেল
আগাগোড়া সব কথাকেবল হলো না বলা
সেই একান্ত ব্যাকুলতা ।চলতে চলতে
চলা হয়ে গেল
শত মাইল সে- ও জানিকেবল হলো না ছোঁয়া
সেই দুঃখের দানাখানি।”
এই ছোট্র কবিতার মধ্য দিয়েই আমরা দেখার চেষ্টা করবো কবির ব্যাকুলতা কোথায় আর কোন দুঃখের দানাখানি তিনি ছুঁতে চান?
কবি মনের এই ব্যাকুলতাই কবিতার বীজ যা কবিকে জীবনভর তাড়িয়ে নিয়ে যায়। যেদিন এই ব্যাকুলতা থাকে না সেদিন থেকে কবিই আর কবি থাকেন না, বলার সে ব্যাকুলতাই একজন কবিকে কবি করে রাখে। বদরুজ্জামান আলমগীরের এ ব্যাকুলতা মনে করিয়ে দেয় তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের কথা। কোথায় যেন তাঁরা পরষ্পরের প্রতি সংক্রামক ভাবে সাড়া দেন। নাজিম হিকমত বারবার ফিরে গেছেন তাঁর স্বপ্নের কাছে, দেশের কাছে, প্রিয়তমার কাছে। তিনি যেমন বলেন—
“এক পাহাড়ের চূড়াই তুমি আনাতুলিয়ার একটি গ্রাম
তুমি আমার সবচেয়ে রূপবতী মহিমান্বিত নগরী
তুমি আর্ত চিৎকার,
আমার দেশ।
যে পদচিহ্ন তোমাকে খুঁজছে
সে তো তোমারই। ”
তেমনি বদরুজ্জামান আলমগীরের কন্ঠে শুনি—
“সামনে মাউনটেইন লরেল
পিছনে একহারা নিঃসঙ্গ পাইনখুঁজি গৃহস্থ বাড়ির অপরিচ্ছন্ন আকনমেন্দি
ধানদুর্বার মিল
আমপাতায় সহোদর ষাঁড়ের ধ্বনি।”
কবি মনের ব্যাকুলতা নিয়ে পথ পরিক্রমার মাধ্যমে জীবনের সত্য উন্মোচনের অন্বেষায় দুঃখের যে দানাখানি ছুঁতে চান তা মূলতঃ আখাঙ্খার শীর্ষ বিন্দুটি। প্রত্যেক কবি এই শীর্ষ বিন্দুর স্পর্শ পাওয়ার আশায় জীবনভর লিখে যান। আর এই লেখার মধ্য দিয়েই কবি শেষ পর্যন্ত নিজেকে ‘নির্মাণ’ ফরাসি তাত্ত্বিক ‘জ্যাক দেরিদা’র ভাষায় বলা যায় “বিনির্মাণ” করতে সক্ষম হন। কেননা প্রতি মুহূর্তে ভাব আর শব্দের বুননে কবিতায় চলে এক ভাঙা গড়ার খেলা। এই সততঃ বহমান দ্বান্দ্বিকতার ভিতর দিয়ে কবি বিকশিত করেন তার ভাবনাকে, সত্ত্বাকে। আর পূনঃ পূনঃ পাঠকের মনে বুলিয়ে দেন নোতুন নোতুন রঙিন পালকের পরশ। বদরুজ্জামান আলমগীরও এই প্রবহমানতার ব্যতিক্রম নন। কারণ দু’কূল ভাঙবে জেনেও তিনি কবিতার সর্বনাশা খরস্রোতকে ধারন করেন দুই পাঁজরের মাঝে।
কবির কবিতার ভাব ও ভাষায়, বিন্যাস ও বুননে স্বরে এবং সুরে বাংলার লোকজ জীবনবোধটি বার বার ধরা পড়ে। আর তাতে মিশে থাকে এদেশের মাটি জল হাওয়ার গন্ধ। ‘হাতে আমার জলের নুড়ি’ কবিতাটি যেন তেমনি এক রোদ-বাতাসের গল্প; একজন মানুষের জীবন নকশি কাঁথার মতো সুন্দর হয়ে উঠার গল্প।
তাঁর কবিতার ভিতর দিয়ে গেলে মনে হয় তাঁর ভিতর এক সাব-অলটার্ন তাড়না কাজ করছে, আবার মনে হয় তিনি ফিরেছেন লোকায়ত সংস্কৃতির কাছে, ফিরেছেন উত্তরাধুনিকতার কাছে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত কেউই তাকে নিতে পারেনি। তিনি একধরনের শৈল্পিক ঈশ্বরত্ব বয়ান করেছেন যার মধ্যে আমাদের চারপাশের জল হাওয়া একেবারে লুটোপুটি খাচ্ছে। দৈনন্দিন রূপটিকে “সামান্য ঘর কথা” কবিতায় কবি তুলে ধরেন এভাবে—
“তুমি আনাজপাতি কিনে নিয়ে এসো
আমি চটজলদি ভাত চাপিয়ে দেই।
আগামী সপ্তায় বাজারে যাওয়া আমার পালা।
——————
কিছু ভেবোনা – মাছ কুটা হয়ে যাবে
মাঝরাত জেগে তুমি মাছ এনেছো
একটা একটা করে মাছ কুটে নেবো আমি
মোটেও ভেবো না
আয়নার মা’র শিক্ষা আমি সর্বাঙ্গীন কাজে লাগাবো।”
বদরুজ্জামান আলমগীরের কবিতায় লৌকিক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে কবিতার অপরিহার্য অঙ্গ হিশেবে আর ছড়িয়েছে অলংকারের দ্যুতি। যেমন ‘কয়রাকান্দা’ কবিতায় তিনি বলেন—
“ভগবানের বুকে একফোঁটা চোখের জল ফেলবে
সে সাহস তাদের কোথায়!তারপরও নিতান্ত মানবিক অভ্যাসবশত
স্রষ্টার অনড় চৌকাঠে আকুল প্রার্থনা উপস্থাপন করে।”
আহা! ‘স্রষ্টার অনড় চৌকাঠ’ আমরা আর পেরোতে পারিনা। এই কবিতার পূর্ণ পাঠে আমরা খুঁজে পাই মানিক বন্দোপাধ্যায়ের “পদ্মা নদীর মাঝি” উপন্যাসের দু’একটি টুকরো—
“দ্রোহের ভাষা এই বসতকারীর জানা নাই
পরিবর্তনে তাদের আশঙ্কা সীমাহীন
দেবতার ধার্যকৃত অভিসম্পাতে ক্ষুদ্র জনপদ স্তব্ধতায় নির্বাক।
তারা শিউরে ওঠে প্রতিশ্রুত ডাঙায়“বন্যার তীব্র জলরাশির ওপর অসহায় সংঘবদ্ধ
পিপড়ামন্ডলির সাদৃশ্যে তাহারা একত্রিত।”
‘সামান্য ঘর কথা’ কবিতায় পাই, আনাজপাতি, সপ্তা, খিড়কি, গোপাট ইত্যাদির শব্দের সাবলীল প্রয়োগ। ‘শিরোনাম পাইনি’ কবিতাটি যেন লোকজ শব্দের ফুলেল সমাহার— চক্কর, তাজ্জব, ভাংগুলি, ঘড়া, কাঙ্খে, পোয়াতি, লৌতাতানো, ফাজিল শব্দগুলো যেন কবিতাটির চিত্রকল্প গুলোকে আমাদের মনে আরো বাস্তব করে তোলে। এই কাব্যের পরতে পরতে আরো আমরা পাই, কৌরাল পাখি, ঠাডা, লৈয়া, চান্নিপশর, পিরান, ঘুড্ডি, পক্ষী, লাহান এর মতো শব্দ যা তাঁর কবিতা ভার বহন করে। কেননা এক একটা লৌকিক শব্দের গায়ে লেগে থাকে হাজার বছরের পুরনো গন্ধ, একটা মিথ, একটা রূপকথা।
শুধু লৌকিক শব্দ নয় কবি তাঁর কবিতায় তুলে এনেছেন অনেক লৌকিক আচার ও সংস্কার। তিন-সন্ধ্যাবেলায় একা একা গ্রামের পথে বড় মাছ নিয়ে গেলে শ্যাওরা গাছ বা বড় তেতুল গাছ থেকে পেত্নীরা নেমে এসে যে মাছ ছিনিয়ে নিতে চায়- এই গল্প বাংলার প্রতিটি গ্রামের মানুষের মনে গেঁথে আছে ইশ্বর এবং আল্লাহর মতো। ‘সামান্য ঘর কথা’ কবিতায় আমরা এই মিথকে পাই এভাবে —
“ভালো কথা, বুড়িকান্দার গোপাট পার হবার সময়
গুটিকয় পেত্নী মাছ ধরে টানাটানি করবে
নাকি সুরে কথা বলে
তোমাকে বিভ্রাটে ফেলার চালাকি নেবে—কি মাছ আঁনছো শুনি
আলাজিলা বুঁঝি কাইক্কা আর বোঁয়াল মাছ লৈয়া যাঁও
আমার মাছ কৈ ?”
‘প্রণতি পাষাণ’ কবিতায় কবি করেন একজন মায়ের সেই চিরন্তন আত্মিক-লোকজ দাবী—
“আমার দুঃখী কিষানীর ক্ষুধার দোহাই
কিছু চাওয়া নাই কিছু পাওয়া নাইখালি আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।”
যা আমাদের নিয়ে যায় সেই মধ্য যুগের পাটনী নারীর দাবীর কাছে।
আবার দেখি সন্তান সম্ভবা নারীদেরকে যে চিরকাল আমাদের মা-চাচীরা বারণ করেছেন রাত বিরাতে ঘরের বাইরে যেতে, যা কবি এভাবে বলেন—
“আর শোন নতুন প্রতিনিধি এলে
রাতে ঘরের বাইরে যেতে হয় না।”
এই নানা লোকজ উপাদান কবিকে দিয়েছেন মাটিঘেঁষা-শক্তিশালী স্বতন্ত্র বাচনভঙ্গি। এ প্রসঙ্গে ‘হাতে আমার জলের নুড়ি’ কবিতায় ব্যবহৃত ছড়াটির কথাও বলা যায়—
“কাউয়া করে কলনা মলরে বঁইধু
কোকিল ডালে শীতল মরেরে
পাঙ্খার বেতুল তুলিতে তুলিতেরে বঁইধু
আমার আঙ্গুল বেদন করেরে।কুপপক্ষী নিশি রাইতে গো শোন
কুসময়ে জিলকাইয়া ডাকেরে
আল্লাচাল পিছদ্বারাতে ফেলিগো বঁইধু
আমার চক্ষের পানি ঝরঝররে।”
আবার ‘শাল দুধের গাথা’ কবিতায় আছে—
“উড়িয়া যাও গো পবনের বাতাস
মা ফাতিমা কাইন্দা কয়
পুত্রশোকে জ্বলছে আগুন
বাতাসে কী গাও জুড়ায়!”
জমির মালিক মহাজনকে বলতে শুনি—
“গমের ফলন ভালো হলি
বিষ্টি বাদলায় ফসল নষ্ট না হলি
তোকে সের পাঁচ গম দিবানি
নোতুন বউ আছে ঘরে
ওটারে নিয়া চৌকিত বসি রুটি খাইস।”
বদরুজ্জামান আলমগীরের প্রেমের কবিতায় সুখ-দুঃখ, রাগ-অভিমান, বিরহ-মিলন, রোমান্টিকতা-বিষাদ জড়াজড়ি করে আছে। যাপিত জীবনের সকল বৈপরিত্যকে সঙ্গী করেও প্রেমের জীয়ন কাঠিই যে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে, অপেক্ষায় রাখে, প্রতীক্ষায় রাখে, আশাবাদী করে তোলে এমনই একটি কবিতা ‘সাত পুরুষের ঘড়া’। এটি কবি অক্ষরবৃত্ত ঘেঁষা মুক্তক সমিল ছন্দে সাজিয়েছেন এভাবে—
“শ্যাম অঙ্গে তোলো নারী দ্বিধা কাঞ্চন ভরা
সঙ্গোপনে মেলে ধরো সাত পুরুষের ঘড়া।
———–অনিয়ম পায়ে এসো মৎস্যগন্ধা মায়া
নুন্নির মূলে খাড়া ভাটি গাঙ্গের নাইয়া।
—————
আকালের হাওয়া বসে বিরান খামার
আনো ঘরে দুধভাত কিষানী আমার।”
কবিতাটিতে ছন্দের পরিকল্পিত রূপ কখনও স্বরবৃত্ত হয়েও উঁকি দেয়, এমনকি এখানে কবি যতি চিহ্নের স্বাধীনতাও ভোগ করেছেন, নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তবে এক কবির বেলায় এই চ্যালেঞ্জ কতটা প্রয়োজনীয় তা কিন্তু প্রশ্নের অবকাশ রাখেই।
‘বলোগীত’ কবিতাটিতে কবি উন্মোচিত করেছেন বিষাদের রূপ— হেমন্তের নিঃসঙ্গ দুপুর— কত সহজেই আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় জীবনানন্দ দাশের সামনে!
“যতোদিন না শুনি তোমার
মন্ত্রবৎ গানের মোহর
সখী কি করে আমি
মরি বলো
হেমন্তের নিঃসঙ্গ দুপুরে।”
‘পূর্ণ দৈর্ঘ্যের অর্ধেক’ কবিতায় আমরা দেখি চাওয়া— পাওয়ার এক দ্বান্দ্বিক সম্মিলন—
“যে টুকু মিথ্যা মিশানো
আমার প্রতিজ্ঞার সঙ্গে
সে-ও নাও গ্রহন কর
———–
আমাকে যদি চাও সর্বাঙ্গে
প্রাণে ও দেহে
দ্বিধা করো না।”
এখানে যেন মিলে যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘এবার হয়েছে সন্ধ্যা’ কবিতার সেই ক’টি লাইন—
“তুমি ভালোবেসেছিলে সব
বিরহে বিখ্যাত অনুভব
তিলপরিমাণ
স্মৃতির গুঞ্জন— নাকি গান
আমার সর্বাঙ্গ করে ভর?”
(শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা)।
‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ কবিতায় পাই—
“পা নাই যে চলতে পারি
তোমার কথার লগে
পথের কাঁটা তুলতে পারি
একটু আগে আগে।
—————–
আঁধার আছে মেলতে জানি
চান্নিপশর রাতে
আগুন আছে জ্বলতে পারি
পুড়বো তোমার সাথে।”
প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রে কবিকে খুব বাড়তি মহিমা দিতে আমরা চাইবো না। অন্তত, এখানে যে কবিতাগুলোর উল্লেখ আমরা করলাম, সেগুলোর ক্ষেত্রে। আধুনিক নাগরিক জীবনের ব্যক্তিগততার বাড়াবাড়ির মধ্যে মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমি-তুমি মার্কা এক ধরনের প্রেমের সম্পর্ককে বেশ উচ্চ মূল্য দেয়া হয়। বিয়ের মতো একটা প্রায় সার্বজনীন ব্যাপারে নারী পুরুষ যুক্ত বলে আর নারী- পুরুষের শারীরিক আকর্ষন মানবজীবনের জোরালো সত্য বলে প্রেমকে চিরন্তন ও সার্বজনীন মানবিক সম্পর্ক হিশাদেবোবে দেখানো বেশ সহজ। এতে করে শারীরিক সম্পর্কের মধ্যে যে একটা কদর্যতা বা লোভাতুর ব্যাপার আছে, কিংবা বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে প্রাত্যহিকতর যেসব তুচ্ছতা আছে, তা থেকে মুক্ত রেখে নর-নারীর সম্পর্ককে হাজির করা সহজ হয়।এখানে কবি সহজ ব্যাকুলতা নিয়ে পথ চলার মধ্য দিয়ে তাঁর কাব্যিক চিৎকার, কান্না, হাহাকার, হতাশা, ক্রোধ, আশা, সংকল্প আর প্রেমকে প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে বড় ঘটনা। “সুতীকাপড়ের বীর” কবিতায় পাঁচ-সাত বছরের বালকের বিস্ময়ের সঙ্গে কবি এঁকেছেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি। যে শিশু হাতের ভিতর রংধনু দেখতে ভালোবাসে, ভালোবাসে প্রজাপতির রঙিন ডানা, ভালোবাসে শিশির ভেজা ঘাসে খালি পায়ে হাঁটতে, সে-ই একদিন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে এভাবে—
“প্রথম দেখি এক মুক্তিবাহিনী
মাথাভর্তি চুল, দাড়িগোঁফে মুখের তেমন কিছু
দেখাই যায়না
উল্টা করে হাঁটু অবধি লুঙ্গি বাধা
সুতী কাপড়ের বীর।
মিজবাহ উদ্দিন মিজুকে দেখিকাঁধে স্টেনগান
প্রথম দেখি।”
এই সুতীকাপড়ের বীর আমাদের প্রকৃত বীর। যাঁরা আজও বেঁচে আছেন তাঁরা হয়ে আছেন আমাদের অলংকার, আর যারা শহীদ হয়েছেন তাঁরা হলেন আমাদের অহংকার । মুক্তিযোদ্ধা শব্দটা এদেশের সাধারন মানুষের মুখে তেমন শোনা যায়না, তারা বলেন মুক্তিবাহিনী। বদরুজ্জামান আলমগীরও মুক্তিবাহিনী শব্দটিই ব্যবহার করেছেন ।আসলে এই শব্দ ধারন করে সমগ্র বাংলাদেশকে। একজন মুক্তিবাহিনীর ভিতর কবি দেখতে পান আমাদের জাতীয় পতাকাকে আর বলেন এভাবে—
“অসম্ভব সবুজ বর্নের লাল অগ্নিপাত।”
জাতীয় পতাকার কথা ভাবলেই মনে পড়ে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সেই ক্ষত-বিক্ষত লাইনের কথা—
“জাতির পতাকা আজ খাঁমছে ধরেছে
সেই পুরনো শকুন।”
আমাদের কষ্ট আমরা আজও সেই শকুনকে তাড়াতে পারিনি!তাইতো বদরুজ্জামান আলমগীর লিখেছেনঃ
“ক্যামেরা মুখর সাংবাদিক বন্ধু,তারকাপন্থী মঞ্চকর্মী
স্বপ্নভূক লেখক সম্প্রদায়,রাজনৈতিক সহকর্মী
ইউনিভার্সিটির কক্ষসখা
সবাই আনাচে কানাচে জুতসই সাফ সাফ ক্লিন।”
এই জাতির জন্য এর চেয়ে সুন্দর লজ্জা আর কি হতে পারে?কারণ মুক্তিযুদ্ধ কোন সামান্য দাগ নয়।অথচ আজ আমরা “ভোলাভুলির মুখ পোড়া” ভুলে গিয়ে হনুমানের মতো নিজের মুখ পোড়চ্ছি।হনুমান মুখ পুড়িয়েছিল তার সদিচ্ছার জন্য আর আমরা মুখ পোড়াচ্ছি আমাদের বদ ইচ্ছার জন্য;মানুষের সঙ্গে পশুর পার্থক্য এটুকুই।
হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হওয়ার আরেক আয়োজন ‘সঞ্জীব দাস’নামের কবিতাটি।যেন হাজার হাজার কষ্টমুখর জলের ঢেউ বুকে ঝাপ্টাঝাপ্টি করে।স্বরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তের এক অদ্ভুত করুণ মিশ্রণ এখানে রক্তাক্ত হচ্ছে -মিশে যাচ্ছে।সমিল ছন্দের এই চমৎকার কবিতাটি পাঠ করা যাক—
“নীরবতা নীরবতা সঞ্জীব দাস
ঘোড়াউত্রা খলবল্ভাঙা রাজহাঁস।হাওয়া থরোথর ওই কাল মহাকাল
গাঙ বয় পায়ে পায়ে মায়ের কপাল
বুক পেতে কেন হও নিরাশ নিরাশ
নীরবতা নীরবতা সঞ্জীব দাস।ঘোর লাগে মেঘে মেঘে চিতার পাশে
দেবতা বরুণ নাচে পানির ত্রাসে
ঘর ভাসে দোর ভাসে শাবাস শাবাস
নীরবতা নীরবতা সঞ্জীব দাস।”
সনাতন কিংবা সারাসীনদের মৌলবাদের উন্মাদনায় কবি অস্থির, অসহায় কিন্তু প্রতিবাদী।তাইতো বলতে পারেন—
“আঙ্গুর ফলের টকে গেলমানের তাপে বিভোর
লোকেদের কি করে বুঝাই
আমি বারবার সমর্থন পাই অনিশ্চয়তার নির্ভরতার কাছে।”
বদরুজ্জামান আলমগীর তাঁর তার ব্যক্তিগত উচ্চারণকে তাৎপর্যবহ করে তুলেছেন— প্রেমে,প্রতিবাদে,বিরহে, স্বপ্নে ও স্মৃতিকাতরতায়।এক একটি তুচ্ছ— ভুলে যাওয়ার মতো,এড়িয়ে যাওয়ার মতো উপাদান স্মৃতির মতো মিষ্টি করুণ মোড়কে বিবর্তিত হয়ে উঠে আসে তাঁর কবিতায়।অন্তরঙ্গ সময় ও স্থানের দিক থেকে পেছনে ফেলে আসা দিনগুলির কথা ‘ছোট দাগ, কবিতায় তিনি বয়ান করেন এভাবে—
“ক্লাস টু- তে পড়া বন্ধুটি
জ্বরে পড়ে আর ওঠেনি
একসাথে ছড়া-কাটা উমরা খান
ভিতরে ভিতর গভীর গোপনে রয়ে যায়
ভুলতে পারি না”।
————
অনিল স্যারের পূরণ— ভাগে অঙ্কের সহজ জটিলতা
কোনদিন মন থেকে উঠে যায় না।”
এর সঙ্গে যেন মিলে যায় আবুল হাসানের “পাখি হয়ে যায় প্রাণ” কবিতার সেই চরণগুলি—
———–
“ফাতিমা ফুপুর প্রভাতকালীন কোরানের
মর্মায়িত গানের স্মরণে তাই কেন যেনো আমি
চলে যাই আজো সেই বর্নির বাওড়ের বৈকালিক ভ্রমনের পথে,
যেখানে নদীর ভরা কান্না শোনা যেত মাঝে মাঝে
জনপদবালাদের স্ফুরিত সিনানের অন্তর্লীন শব্দে মেদুর!মনে পড়ে সরজু দিদির কপালের লক্ষী চাঁদ তারা
নরম যুঁইয়ের গন্ধ মেলার মতো চোখের মাথুর ভাষা আর
হরিকীর্তনের নদীভূত বোল!”
পুঁজিবাদ মানুষকে, মানুষের সম্পর্ককে শেখাচ্ছে পৃথক হওয়ার কৌশল, আর তাই প্রিয়তমাকে অজস্র অভিবাদন জানিয়ে, সকল বিফলতাকে মাথায় নিয়ে ‘পুঁজিবাদের ভিতর’ কবিতায় কবি বলতে পারেন—
“এসো পুনরাবর্তনের গ্লানি দূর করি
তুমি আমার কাছে নিরাবেদন হতে পারো নাসব বিফলতা শিরোধার্য করে
চলো আলাদা হই!”
এই কবিতায় কবি পুঁজিবাদের বিস্ময়কর ক্ষমতা দেখে গভীর দুঃখে আঁকেন মোট ছয়টি বিস্ময় চিহ্ন!
ভালোবাসা ছাড়া আর কোনকিছুই যে মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারেনা, স্বাধীনতা দিতে পারেনা কিংবা ভালোবাসার ওমের মধ্যেই যে আমরা সবচেয়ে নিরাপদ, এজন্য কোন সঙ্ঘের প্রয়োজন যে আজ আর নেই এই অনুভব ছড়িয়ে আছে ‘নিরাপত্তা কাউন্সিল’ নামক কবিতায়। তখন আমরা সত্যিই বুঝতে পারি ভালোবাসার শক্তির কাছে সকল মারণাস্ত্র ভয়ে কাঁপে। কিন্তু একই সঙ্গে কবিতাটি যেন এক রাজনীতি সচেতনতার উৎস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গুঁড়িয়ে দিয়ে পুলিশ-সেনা আশ্রিত এক দুঃসহ রাষ্ট্র কাঠামোর ইঙ্গিত। যা দেখে কবির দাবী—
“পুলিশ আর সেনাবাহিনী গুটিয়ে নেবার
এখনই মোক্ষম সময়।”
শুধু তাই নয় এই কবিতায় আমরা আরও শুনতে পাই নারী পুরুষের বৈষম্য ভেঙ্গে ফেলার সুর—
“ছেলেটি যে কেবল পুরুষ বলেই
নির্ধারকের তকমা পায়
তা উইথড্র করার বিহিত করো।”
এই দু’টি কবিতা খুব সহজেই আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় কবি শহীদ কাদরীর কথা।বদরুজ্জামান আলমগীর কবি এবং কবিতার প্রতি দায়বদ্ধ থেকে অগ্রজ কবিদের আবেগ, অনুভূতি এবং স্বপ্ন দ্বারা নির্মিত চিত্রকল্পের গাঁথুনির সঙ্গে তাঁর দৃশ্যকল্পকে জুড়ে পরম মমতা ও দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়েছেন বহুদূর।
‘বৃষ্টির সঙ্গে দেখা’ কবিতাটি আমরা যখন পড়ি—
“প্রচন্ড মাটি কাঁপানো শব্দে
উপনিষদ থেকে উঠে এলেন বর্ষার প্রথম নিনাদ
তিনি বজ্রপাত!”
তখন মনে পড়ল শহীদ কাদরীর ‘বৃষ্টি’ কবিতাটির কথা—
“এবং হঠাৎ সুগোল তিমির মতো আকাশের পেটে
বিদ্ধ হলো বিদ্যুতের উড়ন্ত বল্লম ।”
‘ঘোরলাগার যোগসূত্র’ কবিতায় আমরা দেখি—“নিশীথে কোমড় জড়ানো সকালের উদ্ভাস
নারীর চিত্রকলা খাজুরাহো টেরাকোটায়
কামকলার শ্যাওলা ও শীৎকারনতুন সম্পর্ক-বিজ্ঞানে আরেক দিগন্তে বিন্যাস”
মানুষের মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা অবদমিত এক বাসনা, হাজার বছর ধরে চলমান বাৎসায়ন।
‘মৃৎশিল্পের ঘটনা’-তে শত প্রলোভন,টাকা আর যৌবনের সম্মোহনের ভিতর বেরিয়ে আসে পুঁজিবাদের হিংস্র থাবা আর ধারালো দাঁত।
“মেয়েটির মুখমন্ডল অতি খোয়াবলাগা
বড়ো ক্রীড়ার মধ্যে পড়ি
সম্মোহনে পিছনে পিছন যাই।হঠাৎ তাজ্জব হই
মেয়েটি তার নিশিপাওয়া বিড়াল চোখ
কন্টাক্ট ল্যান্স খুলে নেয়!বেড়িয়ে পড়ে
সেই চিরায়ত অনাগ্রহী চোখ।এভাবে মৃৎশিল্প মার খায় সিরামিকের কাছে।”
এই কাব্যে বাংলার জল-বাতাসের বাইরে গিয়ে একটিমাত্র কজমোপলিটান কবিতা
আমরা পাই— ‘ম্যানহাটন সাবওয়ে’ যা পুঁজিবাদের নৃশংশ পরিনতির সুতীব্র প্রকাশ-যেখানে—
“ক্ষরণচিহ্নগুলি একটি বড় ক্ষতের কাছে নিরাময় চায়।”
যা ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুল্লিতে লাফিয়ে পড়ার মত। এই কবিতার একটি আসাধারণ চিত্রকল্প এরকম—
“ম্যানহাটন সাবওয়ের পরতে পরতে স্তব্ধ মেঘরাশি
গোখরোর চোখের উপর পরাক্রান্ত সিংহের সভা।
অগনন বিভিন্নতা ও সংকল্পে চলমান
বলা ভালো এক সঞ্চরণশীল নৃতাত্বিক মিউজিয়াম।”
যা সত্যিই বিস্ময় জাগানিয়া!
সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ সংগ্রাম মুখর। এই সংগ্রাম করার শক্তি মানুষ সংগ্রহ করে তার আপন মনের স্বপ্ন থেকে।স্বপ্ন ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচতে পারেনা তেমনি আশা মানুষকে দেয় জীবনীশক্তি। তাই আমরা ‘টানা’ কবিতায় শুনতে পাই বদরুজ্জামান আলমগীরের শক্তিশালি উচ্চারণ—
“চোখ লাগাতে পারিনা
সবকিছু গোছগাছ করেটরে
সামাল দিতে ঘেমে উঠি সাত টানাটানির সংসারচোখ লাগাতে পারি না
তার স্বপ্ন দেখবো কোত্থেকে।অজস্র নির্ঘুমের ভিতরও
লগি টেনে নিয়ে যায় একটি অসম্ভব দুরাশাদুনিয়াটা বদলে ফেলার স্বপ্ন।”
এখানে হঠাৎ মনে পড়ে যায় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটি ছোট্ট কথা—
“কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?”
‘খসড়া গদ্যের সুই’ কবিতায় কবিকে বড় আশাবাদী মনে হয়।জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বলে শেষ করার আগেই কবি বলেন—
“কাঠের বাবুই পাখির বাসা থেকে
সোনামুখী সুই পাবার আশায়
নির্ঘুম রাত্রিময় জাগি ।ওটা মিলন।”
‘জন্মান্তরবাদী’ কবিতায় বদরুজ্জামান আলমগীর যেভাবে নিজেকে উন্মোচিত করেছেন, যেভাবে নিজের সঙ্গে নিজে বোঝাপড়া করেছেন— তাতে তাঁর জীবন-মরনের এক জৈবিক আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন এভাবে—
“আবার যদি আল্লার অনুমতিক্রমে জন্ম নিতে পারি
কৃষকের পুত্র হবোসঠিকতার ধার মাড়াবো না আর
বেহিসাবের পাশে পাল্লা দিয়ে দৌড়াবো।
————তোমাকে বলি
ঠিক ইমপ্র্যাকটিকেল জীবনটা পুনর্বিবেচনায় নেবো।
সবাই লাস্যবতী নদীটির পাড়ে গিয়ে বসতে চায়
আমি ভাঙ্গনপ্রবন
ভুল নারীর অবিকল পাশ ঘিরে দাঁড়াবো।”
এভাবেই কবির এক ধরনের জীবনতৃষ্ণা আমরা পাই।যেন তার সঙ্গে আমাদের চৈতন্যেরও এক নবতর অধ্যায় যোগ হয়।
‘পিতাপুত্র’ কবিতা উদ্বেগ উৎকন্ঠায় ভরা এক মানবিক চৈতন্যের নাম। এখানে কবি পিতাপুত্রের বন্ধনকে একই চিত্রে আঁকেন। এতে চিত্ররুপময়তাই শুধু নয়, দারুণ এক গল্প যেন আকুলিবিকুলি করছে।অন্ধকারের প্রতি আবহমানকাল থেকে যে ভয় মানুষের মনে জমাট বেঁধে আছে তাকে দূর করতে পুত্র পিতার আসার অপেক্ষায় কুপিবাতি নিয়ে বজ্রবিদ্যুতের রাতে একা দাঁড়িয়ে থেকে জানিয়ে দিচ্ছে গত হয়ে যাওয়া একটি কালের কথা।কিন্তু যখন—
“মিকাইল ফেরেশতার এক ধমকে
বাতি নিভে ছারখার।”
হয়ে যায় তখন তারা প্রাকৃতিক জৈবত্বের সন্ধানে নামে,কখন চমকাবে বিদ্যুৎ,কখন তারা আলোর ঝলকানিতে পথ চিনে সামনে এগোবে।শেষ চরণত্রয়ে দেখি—
“বজ্রপাতের আশায় আমরা দুজন
অপেক্ষা করি
আমি আর বাবা!”
‘পাথরে জলের স্বভাব’ কবিতার নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বিপ্রতীপ এক ভাবনা। বিপ্রতীপ হলেও কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারেনা; বরং পরস্পরের মাঝে লুকিয়ে থাকা মিলনের এক তীব্র আকাংক্ষা দেখতে
“পাথরের ভিতর যে জলের সুষমা
নিত্য বহমানতার কথা কেউ বিবৃত করেন বলে মনে পড়ে না।”
বন্ধুত্ব, বিচ্ছিন্নতা, হাহাকার আর প্রতিজ্ঞার এক চমৎকার বয়ান প্রকাশ পেয়েছে ‘কথা ছিল’ নামের কবিতায়। আমাদের দমিত পীড়িত পিষ্টময় সমাজে কোন আকাঙ্ক্ষা-ই আর তার যথাযথ মানবিক আদলটি পায় না।কেবলই নষ্ট হয়ে যায়।আমরা মূলতঃ নষ্টকালকে নির্মাণের সান্তব কাজেই নিয়োজিত থাকতে বাধ্য হচ্ছি। সময় আসে সময় যায়, কবি মনের অসংখ্য বাসনা রয়ে যায় মনেরই ভিতর। তবুও পাগল মায়ের পুত্র হবার কিংবা বাউলের দোতরার ছেঁড়া তার হবার অথবা বেশ্যার চোখের পানির ফোঁটা হবার-তাকে ছায়া দেবার মতো শত আকাঙ্ক্ষা কবির মন থেকে কখনো দূরে সরে যায় না— যেতে পারেনা। তাইতো ঘর হারা মানুষের বেদনাকে কবি ধারণ করেন চুম্বনের দাগের সমিলে হারিয়ে যাওয়া ভিটে-মাটির শেষ চিহ্ন হিশেবে; সাঁইয়ের সিনায় সিনা লাগিয়ে হাসানের ঘোড়ার সওয়ার হয়ে দুঃখের আনন্দ মেলা নিয়ে একা ছিন্ন দ্বিখণ্ডিত গ্রামের ভিতর দিয়ে জোর কদমে পা ফেলে এগিয়ে যেতে চান ‘সেই ভাঙা ময়ূরের গ্রামে’ সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে। এই কবিতায় আমরা সেই বোবা কান্নার শব্দ শুনতে পাই।
এভাবেই বদরুজ্জামান আলমগীর কখনো ব্যক্তিগত, কখনো সামাজিক, কখনো রাজনৈতিক আবার কখনো বা পৌরাণিকতার ভিতর দিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন তাঁর কবিতাকে।এই এগিয়ে যাওয়ার পথে অনেক কবির অনেক কবিতাকে স্পর্শ করেছেন, ধরে দেখেছেন কখনো জড়িয়েও নিয়েছেন।নিচের চরণগুলি পড়া যাক—
“চুম্বনের মাঝখানে জ্বলে আধুলির ছেঁড়া দাউদাউ”।
—(‘রুপকথা’;বদরুজ্জামান আলমগীর)
তখন মনে পড়ে যায় আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘বিচ্ছেদ ২’ কবিতার এই চরণটি-
“লাল গোলাপের ঝোপে বিঁধে থাকে শ্বেত তলোয়ার।”
—(‘বিচ্ছেদ ২’ ;আবদুল মান্নান সৈয়দের শ্রেষ্ঠ কবিতা)“চড়ুই পাখির ঠোঁটে কোন আগুন থাকতে পারে না
তুমি কেন চিবুকে অগ্নি ধারণ কর?”
—(‘আয়নায় চড়ুই পাখি’;বদরুজ্জামান আলমগীর)
“তোমার ঠোঁটের মধ্যে, নারী,
ধ’রে আছো আত্মা আমার।”
—(‘নারী ১৩’ ;আবদুল মান্নান সৈয়দের শ্রেষ্ঠ কবিতা)
সুররিয়ালিজমের সুরটি এমন আরো ক’টি লাইনের মধ্যেই কবি গেঁথে দিয়েছেন অনন্য এক গুচ্ছ রক্ত করবীর মত।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, রফিক আজাদ,আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ,নির্মলেন্দু গুণ এবং শামসুর রাহমান সহ বাংলাদেশের আরো অনেক কবির বহু কবিতা উচ্চকন্ঠ, রাজনীতিপ্রবণ আর বাস্তবের মোকাবেলায় রক্তাক্ত।কিন্তু তাঁরা কেউই নিজেদের এসব রচনাকে বৈধতা দেবার প্রয়োজনে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত নন্দনতত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করার প্রয়োজন অনুভব করেন নি।
আর বদরুজ্জামান আলমগীর কবিতাকে গ্রহন করেন নিজেরই এক পৃথক অস্তিত্ব হিশেবে যা আর নোতুন কোন সংজ্ঞায়নের অপেক্ষা রাখে না। বিশ্ব-প্রকৃতিতে বিদ্যমান সকল উপাদানের মধ্যে লুকায়িত সম্পর্কগুলোকে আবিষ্কারের মাধ্যমে তিনি পেয়ে যান কবিতার উপমা বা অনুষঙ্গ বা খোদ কবিতাকে।এজন্যই তিনি যেখানে স্মৃতি-স্বপ্নের ব্যক্তিগততায় কোমল শব্দের প্রবাহকে অন্তরঙ্গ করে তুলতে পেরেছেন, সেখানেই সফল হয়েছেন বেশি। শিথিল কথকতা-ই তাঁর শক্তি;এই শিথিলতাকে ছন্দ বা সুরের মোহে এলায়িত ভঙ্গিতে যেখানে বশ মানাতে পেরেছেন,সেখানেই ঘটেছে তাঁর কবিতার পরম স্ফুর্তি।তাই তিনি উপর্যুক্তদের মতো উচ্চ কন্ঠ নন,কবিতায় তাঁর স্বর বয়ানের ঢঙে নীচু,ভাষা প্রাঞ্জল,বক্তব্য স্পষ্ট,আকারে ক্ষুদ্র হয়েও ইঙ্গিতে সুদূর প্রসারী।
একটা বিষয় একেবারে শুরু থেকেই তাঁর রচনায় আছে ,তা হলো শব্দের ব্যাকুলতা। একেবারে যথাস্থানে থেকে অন্য শব্দ বা নীরবতার জন্য অপেক্ষা তাঁর কাব্যে আছে। এই শব্দ ব্যাকুলতাকেই মাঝে মাঝে কবিতা বলে ভ্রম হয়। কারণ এমন ব্যাকুলতা বাংলা কবিতায় খুব বেশি দেখা যায় না।
‘শঙ্খচিলের বাড়ি’ কবিতাটি মনে করিয়ে দেয় বব ডিল্যানের সুর থেকে কবীর সুমনের গাওয়া গানের লাইন—
“কতোটা পথ পেরুলে তবে পথিক বলা যায়।”
কবিতার আড়াল কত তুমুল হতে পারে তারই অতি চমৎকার আয়োজন হচ্ছে ‘তরবারির নিচে অশ্রুবিন্দু’ কবিতাটি।কয়েকটি চরণ—
“উত্তর দিকে মুখ করে হাঁটলেই
পিঠে হাত নেড়ে বাতাস কড়া নাড়ে———————
তেত্রিশ বছরের অপরিচিত নিত্য সহচরী ঢেউ
মনে করিয়ে দেয়আগুনে পোড়ার দাগগুলি দেখে দেখে যেও!”
সকল মানুষের মনেই হয়তো কিছু স্ববিরোধিতা থাকে-তাই রক্তগঙ্গা আর ফুল কুসুম, দীঘির জল আর চোখের জল,বাড়ি আর বিচ্ছেদ এই বিপরীতমুখী ধারাগুলির প্রকাশ ‘স্ববিরোধিতা’ নামক কবিতায় বিদ্যমান।মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তাই কবি বলেন—
“বজ্রপাতের আশায় আশায় থাকি”।
‘শাল দুধের গাথা’ কবিতা যেন বাংলাদেশের বুকে ঘটে যাওয়া মহান মুক্তিযুদ্ধেরই বিজয়গাথা। যদিও এ জাতি আজও জানেনা স্বাধীনতা কি,মুক্তি কি?
বাংলা সাহিত্যে রাজা দুষ্মন্ত আর শকুন্তলা যেমন আছে তেমনি আছে রাধা আর কৃষ্ণ। কবি রাজা নন কৃষ্ণ হতে চান।তাইতো বলেন—
“নিজের উঠানে দুই ভাগ নদী খরস্রোতা
একদিকে নিজ নাম অন্য পাড়ে কূলনাশী রাধা।”
এখানে খুব সহজেই বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগের কবিদের লেখার কথা,যেমন ‘চন্ডীদাস’ বলেছিলেন—
“কাল জল ঢালিতে সই কালা পড়ে মনে।
নিরবধি দেখি কালা শয়নে স্বপনে।
কাল কেশ এলাইয়া বেশ নাহি করি।
কাল অঞ্জন আমি নয়নে না পরি।।”
এইটুকু বিরহ সইতে না পারলে সত্যিই বদরুজ্জামান আলমগীরকে মানাতো না।
‘বাড়ি’ কবিতাটি যেন আবহমান কাল থেকে কবি পর্যন্ত সকল পরবাসী মানুষের এক অনবদ্য মহাকাব্য।তাইতো শুনি—
“এক চক্ষুষ্মান অন্ধকে বলে দাও
হাজী বলিমামুদ প্রকৌশলকৃত
সাদামাটা অতি সাধারণ বাঁশ বেত টিনের অনভিজাত
এক সামান্য বাড়ির মোকাম।”
‘পাতা’ কবিতায় ঝরে পড়া পাতার মধ্যে কবি যে ব্যাকুলতা দেখেছেন তা শুধু পাতারই না কবিমনের ব্যাকুলতারই বহিঃপ্রকাশ—
“পাতারা ঝরে পড়ার পর
এই প্রথম বুঝি
তাদেরও ব্যাকুলতা ছিল।”
বদরুজ্জামান আলমগীরের স্মৃতিকাতরতা বার বার ফিরে ফিরে আসে।এমনই একটি কবিতা ‘নিধনিয়ার ধন।’প্রথম লাইনেই আমরা গোটা কবিতাটি পেয়ে যাই এভাবে—
“সেই দিনগুলি মুহূর্তের জন্য ফিরে আসে।”
কি দিন, কবেকার দিন, কোথাকার দিন, কেমন দিন? এই প্রশ্নগুলির উত্তরের জন্য কবিতাটির গভীর পাঠ প্রয়োজন।কবি আরো বলেন—
“সব নিমাই যোগ হয়,আনতে যাই সাম্যবাদের আতাফল ও প্রথা
আমরা বলি যা একসাথে ভাগ করে নেব।”
এই কবিতার স্তরে স্তরে লুকিয়ে থাকা “তাজা জান্তব দিনাবলির” আশায় মুক্তিবাহিনী ঝারু মিয়া নিজের জীবনের মত পুত্রকেও এগিয়ে দেন আরেক অনিশ্চয়তার দিকে-
“সে বাজি ধরে সেই প্রান্তিক ভেষজের কণা।
বিনা প্রশ্নে ঝাঁকি খাবার অনায়াস উর্ধ্বে ওঠে সর্বনাশা খেলার লেনদেন।
আমরা জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে পথ খুলে নিই”।
ধানপাটসরিষাজীবী মুক্তিবাহিনী ঝারু মিয়া খেলার সামনে খালি বলেন,
বাবারা, আজ মঙ্গলবার,দিন ভালো নয়,আজ বাদে কাল যাও।”
এই যে ঝারু মিয়ার উৎকন্ঠা,উদ্বেগ তা শুধু তাঁর একার নয়,এই আশংকা সকল বাবাদের।
“রুপকথা” কবিতায় আমরা পাই কবি মনের বেদনা বিঁধুর বেহাগের সুরটি—
“এভাবে ঢেউয়ের পয়ারে ডুবে
নাকফুল শঙ্কিত মেয়েটির রুপকথা।আশাবতী সন্ধ্যায় ছলাৎছল কাঁদো একা একা
হাওয়ার প্রতিকুল হাওয়ায় হাওয়ায়”।
এ যেন আমাদের মনের অফুরান আশা- যা একাকী ছিন্ন স্বপ্নের মতো করিকাঠে ঝুলে থাকে ।আর মনে পড়ে শামসুর রাহমানের সেই কথা—
“স্বপ্নগুলো—
দেয়ালে দেয়ালে ঝোলে সার্টিনের পর্দার মতন।”
একটি শব্দ থেকে আর একটি শব্দে,একটি লাইন থেকে আর একটি লাইনে, একটি কবিতা থেকে আর একটি কবিতায় পাড়ি দিতে কবি পার করে দেন শত বছর আর তাই মহাকালের মাঝে কবিতা একটি বিন্দু হয়ে দুলতে থাকে।বদরুজ্জামান আলমগীরের কবিতায় আমরা সেই বিন্দুটির দেখা পাই।
‘কবিতার নাম বলি’ কবিতাটি দারুণ কতগুলো চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে।এখানে অনিবার্য মনে পড়ে যায় আল মাহমুদের ‘কবিতা এমন’ কবিতাটির কথা।কেন মনে পড়ে,কোথায় মিল?দুটি কবিতাকে মিলিয়ে দেখি- শব্দে ছন্দে খুব একটা না, তবে অনুভূতিতে সমিল—
“কবিতা নোতুন বউ
দেউরির আড়ালে তার টুং টাং চুড়ির আওয়াজ।”
—বদরুজ্জামান আলমগীর।“কবিতা তো মক্তবের মেয়ে, চুল খোলা আয়েশা আক্তার।”
—আল মাহমুদ।“পদ্মায় ইলিশের মুখে আতরে গোলাপে তাজা সংশয়”
—বদরুজ্জামান আলমগীর।“মাছের আঁশটে গন্ধ,উঠানে ছড়ানো জাল”
—আল মাহমুদ।
আবার শুনি—
“কবিতা নৈঃশব্দ
আকাশ ভেঙে নেমে আসা প্রাচীন প্রপাত
অমিত্রাক্ষর বৃষ্টির নাতি নাতকর”
যা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় বাংলা সাহিত্যের মধু কবি-মাইকেল মধুসুদন দত্তের কথা।
‘দুই দিক’ ছোট্ট কবিতাটি যেন বিন্দুর মাঝে সিন্ধুরই অভিব্যক্তি—
“তোমার সঙ্গে আবার
ভাগ করে নিই তৃষ্ণার ধ্বনি”
আহা!কি অপরুপ আকুলতা!
বইয়ের শেষ কবিতা ‘ঈশ্বরের পৈথান’।এই কবিতা বাস্তবতা আর আধ্যাত্মিকতার মিশেল এক রমনীয় ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো।এর আলোচনা সর্বপ্লাবী বন্যার জলের মত।আমি শুধু দুটি লাইন উল্লেখ করছিঃ
“আমার কাছে প্রার্থনা আর শস্যের দানা
সমান দুই রেখা”।
পথ সে রাজপথই হোক আর আলপথই হোক পথে বের হলেই মনে পড়ে অসমাপ্ত কাজের কথা-একজীবনে যা কোনমতেই শেষ করা হয়ে ওঠে না।‘পথ’ নামক এই ছোট্ট ছন্দময় কবিতাটি দিয়েই আমরা বদরুজ্জামান আলমগীরের কবিতার ব্যাকুলতা আর দুঃখের দানাটিকে ছুঁতে চেয়েছিলাম, রবার্ট ফ্রস্ট সেই উত্তরটি তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘Stopping by Woods on a Snowy Evening’ এর শেষ লাইন কটিতে দেন
( Woods are—— before I sleep.) যা শামসুর রাহমানের অনুবাদে এসেছে এভাবে;
‘কাজল গভীর এ-বন মধুর লাগে,
কিন্তু আমার ঢের কাজ বাকী আছে
যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে,
যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে ।’
প্রত্যেক কবির একটা ল্যান্ডস্কেপ থাকে, প্রতিটি কাব্যের থাকে, প্রতিটি কবিতারও থাকে। বদরুজ্জামান আলমগীরেরও আছে। কিন্তু তারপরও পৃথিবীর কবিতার ইতিহাসের দিকে তাকালে প্রায় সকল কবির মাঝে কোথাও না কোথাও, কোন না কোনভাবে অগ্রজের ছাপ পাওয়া যায়। এই কবিও এর ব্যতিক্রম নন। তবে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে যেটা বলা যায় তা হলো— বাংলা কবিতা জগতে ‘পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর’ একটি ‘ফুটপ্রিন্ট’।