না রই সতী আমি না হই অসতী । বদরুজ্জামান আলমগীর
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:০৫ অপরাহ্ণ, | ৭১৩ বার পঠিত
ঢেউগুলো যমজ বোন নাম ভাষান্তরিত কবিতার বইটি করার আগে আমার ধারণা ছিল অনুবাদের কাজ একচ্ছত্রভাবে ভাষা বিষয়ক একটি মুসাফিরি, কিন্তু পরে বাস্তবিক কাজটা করতে গিয়ে বুঝতে পারি তা যতোটা না দুই ভাষার মোকাবেলা তার অধিক নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক খোঁড়াখুঁড়ি, মানবিক আচার আচরণের লেনদেন।
ঢেউগুলো যমজ বোন বইটি করার অন্তরালে যে কারণগুলো প্রণোদনা ও মানদণ্ড হিসাবে কাজ করে থাকতে পারে:
আমি বাঙলার মরমিয়া অন্বেষা করেছিলাম হৃদপেয়ারার সুবাস বইটিতে। সেই অন্বেষা আমাকে উত্তর দিয়েছিল এভাবে- বাঙলার মরমিয়া প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে নয়, মরমিয়া, সমর্পণ, দয়া আসন পেতে আছে লোকধর্মের প্রাণে।
তারপর আমার সীমিত সাধ্যে সারাদুনিয়ার মরমিয়ার প্রকৃতি অনুধাবন করার মানসে আমি আন্তর্জাতিক মরমী কবিতার একটি সংকলন করার কথা ভাবি।
বাস্তবিক মরমী কবিতা বাছাই করতে গিয়ে আমার প্রতীতি জন্মায় যে- বাঙলা অঞ্চলে মরমিয়ার আর্তি লোকধর্মনির্ভর, কিন্তু সংহত পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো লোকধর্মের আনকোরামি থেকে বহুদূরে সরে এসে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের শৃঙখলায় কাঠামোবদ্ধ হয়ে আছে।
পশ্চিমের অপ্রাতিষ্ঠানিক মরমিয়া অনেকটাই উদবাস্তু; কেননা, রাষ্ট্রের ও পুঁজিবাদের ঘেরাটোপের বাইরে ইউরোপ এমেরিকায়, কী জাপানে চীনেও কোন পরিসর নাই। ফলে বাঙলায় যে মরমিয়া আসন পাতে বৈষ্ণব, বা সুফীবাদ বা বাউল ধর্মের বারামখানায় সংহত দেশগুলোতে তা সর্বপ্রাণবাদের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হয়।
ফলে ভারতের বাইরে প্রধানত সর্বপ্রাণবাদী কবিতার সংসারে, কখনও বা তাও, বা জেন কবিতা থেকে আমাকে কবিতা বাছাই করতে হয়। শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোন আন্ডারগ্রাউন্ড ধর্ম থাকে না। যে জাতিগোষ্ঠী একটি সামগ্রিক মুক্তির লড়াইয়ে নিষ্ঠ- তাদের মরমী কবিতায় একটি ভিন্নমাত্রার স্পন্দন দেখতে পাই।
এবার অনুবাদ করার ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জটা আমি মোকাবেলা করি একটি কবিতাকে ভাষান্তরিত করার পর তার মধ্যে কবিতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে। একটি ভাষা থেকে আরেকটি ভাষায় রূপান্তর করার পর এটি কবিতা নয়, কেবল একটি ছাঁচ হিসাবে থাকে। যে-কোন ভাষা একটি ইতিহাস, একটি নৃতত্ত্ব- কেবল কিছু অক্ষরের সমাহার মাত্র নয়।
সংহত দুনিয়ায় মানুষ আশা করে, দাবি করে রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে, অসংগঠিত দেশে মানুষ আশা করে নিকটাত্মীয়ের কাছে, পরমেশ্বরের সকাশে। ফলে দুই অঞ্চলের ভাষার ভঙ্গিমা আলাদা, ভাষার ব্যক্তিত্ব পৃথক। প্রমিত ভাষা ও আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে যেমন তফাৎ থাকে।
প্রমিত ভাষা কাজের ভাষা, অপ্রমিত ভাষা ভাবের ভাষা। আমার অভিজ্ঞতার নিরিখে এটুকু বুঝতে পারি- কেবল প্রমিত ভাষায় প্রাণের গভীরের কথা বলা যায় না। বাঙলা অঞ্চলে নিগূঢ় কথাটি বলার ভাষিক উপায় প্রধানত অসংগঠিত গৌণ ভাষা।
মনের আকুতি ঝরে কীর্তনের পয়ারে, রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীতে, নজরুলের, রাধারমণের, লালন সাঁইজির, শত গীতিকবির পদাবলীতে। আমার ভাষান্তরে আমাদের গীতি কবিদের মন, মনন আর ভাষায় আশ্রয় করেছি। এ-কারণেই হয়তো কোন ইংরেজি কবিতার লাইন – গড ইজ হেয়ার ইনসাইড মাই হার্ট-এর বাঙলা করি- আমার প্রাণের ভিতর হিয়ার ভাঁজে লুকিয়ে থাকে মাবুদ।
পশ্চিমের ভাষা নির্দিষ্ট, আমাদের ভাষা অনেক দোলাচল আর অলংকারে প্রীত ও শঙ্কিত। এই দুই অসমতলকে একটি সমতল এভিনিউতে আনার চেষ্টার ফলে পাঠকের জন্য তা কখনও কখনও দুরূহ অভিযাত্রা হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে পাঠকের ধৈর্যই একমাত্র আশা, অঞ্জলি লহো মোর।