আগুন আকাশকে ছুঁতে পারে না, বিশ্বাস আকাশকে ছোঁয় । ঋতো আহমেদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৯:২৪ অপরাহ্ণ, | ৮৮২ বার পঠিত
১
২৮ শে নভেম্বর, ১৯৯০। ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হাই স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন। শহর ছেড়ে একটু বাইরের দিকের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বাবা তার কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। সকালে অফিস যাওয়ার সময় আমাদের দু’ভাইকে সাইকেলে নামিয়ে দিয়ে যান। আর ফেরার পথে আমরা যে যার মতো হেঁটে বাসায় ফিরে যাই। এই ছিল আমাদের রুটিন। এদিকে, পরের সপ্তাহে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। টিফিন পিরিয়ডে সাধারণত স্কুলের বাইরে, রাস্তার ওপাশে ইয়াসিনের দোকানে গিয়ে টিফিন খাই আমরা। টিফিন বাবদ দুটাকা বরাদ্দ ছিল আমাদের। ভেতরে মাখন দেয়া বন রুটি আর লম্বাটে প্যাঁচানো এক ধরনের কুকিজ ছিল আমাদের প্রিয়। সেগুলোই খাচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনি লোকজন বলাবলি করছে ভার্সিটির ছাত্ররা মিছিল নিয়ে আসতেছে।
সেই ছোট্ট বয়সে, তখনও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের কিছুই মাথায় ঢুকতে শুরু করেনি। জানা হয়নি যে, এরও তিন বছর আগে ঢাকার রাজপথে নূর হোসেন নামের একজন শহিদ হয়েছিলেন। যার শরীরে লেখা ছিল এক আশ্চর্য কবিতা— স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক। জানা হয়নি তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের কুকীর্তির কথা। জানা হয়নি ছাত্রসমাজের ফুঁসে ওঠার কথা, আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। দীর্ঘ নয় বছরে পুলিশের গুলিতে একে একে জাফর জয়নাল কাঞ্চন দীপালি সাহা সহ বহু ছাত্রের নিহত হওয়ার কথা। জানা হয়নি জেহাদের লাশকে কেন্দ্র করে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে গড়ে ওঠা সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের কথা। আমার কৌতুহল তখন মিছিল দেখার। এর আগে ভোটের মিছিল দেখেছি বহুবার। সেগুলো ছিল আনন্দের। তালাচাবি মার্কায় প্রতিবারই দাঁড়াতেন জহিরুল ইসলাম কডু ভাই। আমাদের বাসার সামনে দিয়ে ট্রাকে করে মিছিল নিয়ে যেতেন। আর কী এক অজানা কারণে যেন প্রতিবারই ফেল মারতেন।
কিন্তু এইযে মিছিল এলো, এটা কেমন মিছিল! সবাই যেন রেগে আছেন। চিৎকার করছেন। সামনের সারিতে আপুদের দেখতে পেলাম, ব্যানার ফেস্টুন হাতে এগিয়ে আসছেন। পেছনে ছেলেরা হাত উঁচু করে শ্লোগান দিচ্ছেন। ঠিক কী ছিল সেই শ্লোগান, এখন আর স্পষ্ট মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, দুপুরের ওই কড়া রোদের মধ্যেও সবাই খুব উত্তেজিত অবস্থায় গর্জে উঠছিলেন। রাতে পাশের বাসার আঙ্কেলের মুখে শুনতে পেলাম, বাবাকে বলছেন, আজ শহরের ভেতর ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। দু’জন মারাও গেছে। দেশের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাচ্ছে দিনকেদিন। এতোদিন এসব শুধু ঢাকায় হোতো। এখন মফস্বলেও শুরু হলো। কী যে হবে।— মুহূর্তে চমকে উঠেছিলাম। সেই মিছিলটাই নয়তো। পরে জেনেছি, ওটা শহরের কলেজ-ছাত্রদের অন্য এক মিছিল ছিল। ফিরোজ ও জাহাঙ্গীর নামের দু’জন ছাত্র পুলিশের গুলিতে সরাসরি নিহত হন। এর এক সপ্তাহ পর, ৬ই ডিসেম্বর পতন ঘটে সেই স্বৈরাচারের।
তারপর কেটে গেছে তিরিশটি বছর। ব্রহ্মপুত্রের শরীর বেয়ে গড়িয়ে গেছে বহু জল। আমারও শরীর বেড়েছে, বিকশিত হয়েছে মন ও মনন। আর, রামবাবু রোডের সেই মহাকালী স্কুলের পাশে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে ওঁদের জন্য গড়া ছোট্ট একটি স্মৃতি-স্তম্ভ। অবহেলায়, অনাদরে। বিস্মৃতিতে।
কিন্তু হঠাৎ এতো বছর পর কেনই-বা এই স্মৃতির চারণ। হ্যাঁ, গত কয়েকদিন ধরে আমি আচ্ছন্ন হয়ে পাঠ করছিলাম বিমল গুহ। আর পড়তে পড়তে এই-যে নিচের কবিতাটায় এসে তলিয়ে গেলাম আপন কৈশোরে, যাপিত জীবনের ওই এক টুকরো স্মৃতিবিস্মৃতির অতলে। স্মরণ করতে চাইলাম আমার নব্বই।
আবার আড়মোড়া কেটে দুপায়ে দাঁড়ায়
বাংলাদেশ— ..
উনিশ শ’ নব্বইয়ের বাংলাদেশ…
নব্বইয়ের রাজপথ রক্তে লেখে স্বাধীনতা-নাম
নব্বইয়ের রাজপথ উল্লাস ভঙ্গিতে দেখে
যুবহাতে পতপত বিজয় পতাকা।
এইযে কবিতা— কবিতা কেন পড়ি আমরা? কীভাবে কাজ করে কবিতা আমাদের সাথে? আমাদের জীবন-অভিজ্ঞতার সাথে? ‘যদিও এই লেখা, কোনো বিচার বা বিশ্লেষণ নয়। কেবলই নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া কবিতার অভিজ্ঞতা, প্রতিক্রিয়া। এইমাত্র।’ ১৯৯৪ সালের ২৯ শে জানুয়ারি, দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত, শঙ্খ ঘোষের কবিতা নিয়ে জয় গোস্বামীর গদ্য ‘আলো অন্ধকার আয়ু’ তে এমনটাই বলছিলেন জয়। কখনও কখনও কবিতার অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যায় তাহলে। কবিতার কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে আমরা অতীতেও ফিরে যাই। মিলিয়ে নিই নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া একেকটি ঘটনার সারাৎসার। মিলিয়ে নিই অর্জন, অনুভব। মিলিয়ে নিই সত্য মিথ্যার অনুধাবন। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় মোড়ক। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আত্ম-আবিষ্কার। কখনো-বা রোমন্থনে নতুনভাবে উপস্থাপিত হয় পুরোনো স্মৃতি। মনে হয় এ-ই তবে ছিল!
২
আগুন আকাশকে ছুঁতে পারে না
বিশ্বাস আকাশকে ছোঁয়
বাতাস পাহাড়কে নাড়াতে পারে না
প্রেম পাহাড়কে নাড়ায়
আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে চোখে রক্তগোলাপ ফুটে আছে
পাহাড়ের গায়ে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হবো কি— দাক্ষায়ণী?
বিষাদগ্রস্ত মানুষের মুখ দেখলে আমার আগুনের কথা মনে পড়ে
আমি আলোকবর্তিকা হাতে তোমাকে খুঁজি
তোমার উদ্দীপ্ত ইচ্ছার কথা ভাবলে
তিল তিল জন্ম নেয় রক্তকণিকায় স্পন্দন
আমি নবসৃষ্টির রূপকার।
তোমার শরীর খারাপ
আমি দিনদুপুরে জ্যোৎস্নার কথা ভাবি
রাতে ঈশ্বরের বিছানায় শুয়ে কবিতা লিখি ক্লান্তি ও অবসাদের
অলৌকিক সুই ও সুতোয় তোমাকে সেলাই করি শিল্পের কাঁথায়।
আগুনের কাছে বিশ্বাস রেখে প্রার্থনা করি—
তুমি সেরে ওঠো
অতীতের সব গ্লানি মুছে যাক স্নেহে
প্রেমপালিতা তুমি হরিণীর মতো যেই কাছে এসে বসো, আমি
ত্রিকালদর্শীর মতো ভবিষ্যতের কথা বলতে বলতে
আকাশের নাভিমূল ছুঁই
তুমি মহাশ্বেতা।
(আলোকবর্তিকা/অহংকার, তোমার শব্দ)
এই কবিতাটি একজন কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা— ভাবা যায়! কতোটা পরিণত হয়ে তবেই তাঁর কাব্য জগতের নিমগ্ন প্রবেশ। তিরিশ বছর বয়সে প্রথম বই ‘অহংকার, তোমার শব্দ’ প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। ৪৫ টি কবিতা নিয়ে এই বইয়ের কবিতাগুলোর রচনাকাল ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধ বিদ্ধস্ত সময়কালে লেখা এই কবিতাগুলোর শরীরের দিকে যদি তাকাই আমরা,— কি দেখতে পাই? সবকিছু দীর্ঘ নিঃশ্বাসে উড়ে যায়। ক্ষয়িষ্ণু মোমের শিখা অন্ধকার বুকে তুলে নেয় ক্রমাগত। নারীর পাশে দুগ্ধপোষ্য শিশু জঠর অভ্যন্তর থেকে সোনালী চামচ মুখে কালকূট বিষ তুলে খায়। কতদূর যাবে? কতদূর যাবে এই স্বাধীনতায় সদ্য স্নাত বাংলাদেশ। কীভাবে যাবে তুমি। আগুন তো আকাশকে ছুঁতে পারে না। বাতাস নাড়াতে পারে না পাহাড়। তাহলে গন্তব্যে পৌঁছাতে আমাদের পথ কী হবে। আমাদের আকাঙ্ক্ষার নাগালে যেতে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আজ কিসের? হ্যাঁ, বিশ্বাস আর ভালোবাসার— প্রেমের। কেন-না বিশ্বাস আকাশকে ছোঁয়। প্রেম পাহাড়কে নাড়ায়। যদি এই দুটোই আমাদের থাকে তবে চলার পথে হাঁটতে হাঁটতে কখনো ক্লান্ত হবো না। বিষাদগ্রস্ত হবো না। হবো নবসৃষ্টির রূপকার।
বইটিতে প্রতিটি কবিতায় ছড়িয়ে আছে প্রেম। প্রেমের ভেতর দিয়ে স্থান ও কালের রূপকার এই কবির প্রথম দশটি বছরের (১৯৭২-১৯৮২) দিকে তাকিয়ে আমরা দেখতে পাই সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের অনেক উত্থান আর পতন ঘটে চলেছে। সেই সাথে কবিও নানান অন্তর্ঘাতের ভেতর দিয়ে নিজেকে ভেঙে আবারও গড়ে নিচ্ছেন। কখনো-বা সমসাময়িক কোনো ঘটনা তার মানসপটে সৃষ্টি করে গেছে গভীর ক্ষত। সেই ক্ষতকে ঢেকেই আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে এগিয়ে গিয়েছেন। ‘আমার বুকের মধ্যে নিমেষেই ছলকে ওঠে স্বদেশের মুখ আর আমি জন্মাবধি নিজের ব্যর্থতার কথা ভেবেও আত্মহননের গান গাইতে পারি না।’ কী সেই ব্যর্থতার কথা বলতে চেয়েছেন বিমলদা? বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ পরবর্তী দেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিল, ১৯৭৫ এ এসে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নের হননে আচমকা অদ্ভুত ভাবে থমকে যায়, থমকে যায় সমগ্র দেশ। বাকরুদ্ধ শহরের বুকে বিষাদ আর ভয় ছড়িয়ে যায় মুহূর্তে। এইটাই ছিল আমাদের ব্যর্থতার একটি বড়ো মাইল ফলক। এরপর একে একে আরও ব্যর্থতার ঘটনা ঘটে চলে। নগ্ন ও নোংরা ক্ষমতালিপ্সা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটকে পদে পদে এগিয়ে নিয়ে চলে সময়রেখার সামনের দিকে। যার ভুক্তভোগীরা হলেন বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশের কবি শিল্পী সাহিত্যিকগণ। লকডাউনের মধ্যে দেশ পত্রিকার ফেসবুক পেজে ইদানিং অণুগল্প প্রকাশিত হচ্ছে। সেখানে ক’দিন আগে কবি শ্রীজাত’র যুদ্ধ বিষয়ক তিনটি অণুগল্প প্রকাশিত হয়। ওর মধ্যে একটি গল্প ছিল এমন: এক সৈনিক একটি শহরের মিউজিক স্কুল বিদ্ধস্ত করে ফিরে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় সে দেখতে পায় একটি বাচ্চা মেয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে স্থানীয় ভাষায় কিছু লিখা রয়েছে। সৈনিকটি প্ল্যাকার্ডের ছবি তুলে নেয়। পরবর্তীতে গুগলে ট্রান্সলেট করে হতভম্ব হয়ে যায়। ওখানে লেখা ছিল, স্কুল ধ্বংস করেছ ঠিকই কিন্তু তোমরা ধ্বংস করতে পারোনি আমাদের সিম্ফনিগুলো। ‘নিমেষেই ছলকে ওঠে স্বদেশের মুখ আর আমি জন্মাবধি নিজের ব্যর্থতার কথা ভেবেও আত্মহননের গান গাইতে পারি না।’ কীভাবে কানেক্ট হচ্ছে ১৯৭৫/৭৬এ লিখিত কবিতা আর ২০২০এর অণুগল্প। কীভাবে কানেক্ট হচ্ছি পাঠক। পাঠকের জীবন অভিজ্ঞতা। শত ব্যর্থতার পরও স্বদেশের মুখ আমাকে আত্মহননের পথে হাঁটতে দেয় না। এই স্বদেশের মুখ মানে তো মায়া, প্রেম, ভালোবাসা— আমাদের স্বপ্ন। দেশ গড়ার যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, বন্দুকের নলের মুখে হয়তো সাময়িক স্তব্ধতা আসতে পারে তাতে, ট্যাংক কিংবা কামান হয়তো বাহ্যিকভাবে আমাদের বাকরুদ্ধ করে রাখতে পারে কিছুটা সময়, কিন্তু স্বদেশকে নিয়ে আমাদের দেখা স্বপ্নগুলোকে গুড়িয়ে দিতে পারে না। এমনকি কোনো বুলেট বা গোলাই পৌঁছাতে পারে না আমাদের অন্তরাত্মার গভীরে প্রথিত সেই স্বপ্নের কাছে। আমাদের হৃদয়ের সিম্ফনিকে ধ্বংস করতে পারে না কেউ। আমরা আবারও স্বপ্ন দেখি। ভালোবাসি। আমাদের হৃদয় প্রেমের মাধ্যমেই জয় করতে চায় সমস্ত অন্ধকারকে।
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে যেখানে দাঁড়ালে
সেইখানে বহমান নদী ঢেউয়ে ঢেউয়ে গলাগলি করে
পাশাপাশি বাস করে হাঙর কুমির
সেইখানে হিংস্রতায় সকালের সূর্য খুন হয়
. ছেয়ে যায় তপ্তলাল শিখা চারদিকে
(অসমাপ্ত যাত্রা/অহংকার, তোমার শব্দ)
একবারে সরাসরি, স্পষ্ট ও দৃপ্ত উচ্চারণ। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কোথায় আসা গেল। এ কোন সময়ে পৌঁছে গেছে দেশ। নাকি নীলাঞ্জনা। কে এই নারী? জলের দোলায় দুলতে দুলতে নবীন সাহস জলের বিস্তার পেয়ে যায়। অজানা ভবিষ্যতের অন্ধকারে বাড়িয়ে দেয় হাত। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে রাজপথ অলিগলি, ভাঙাপুল জলাভূমি পার হলে সে দেখতে পাবে সারি সারি ক্ষুধায়-আর্ত মানুষের মুখ। মৃত্যুও যেন ফেরি করে বেড়ায় সেখানে জীবন বীমার পোস্টার। নীলাঞ্জনাকে উদ্দেশ্য করে বিমলদা এঁকে যাচ্ছেন এমন এক স্থান-কালের চিত্র যেখানে ভাঙা সানকি, মাটি আর কাঁকরের পাশে শেয়াল শকুনের কোলাহল। এ চিত্র সেই সময়ের দুর্ভিক্ষের চিত্র। কখনো নীলাঞ্জনা, কখনো লাবণ্য, কখনো শুভা কিংবা মহাশ্বেতাকে উদ্দেশ্য করে লিখে গেছেন এইসব সময়-ছবি। লিখেছেন, ‘তোমার শরীর খারাপ/আমি দিনে দুপুরে জ্যোৎস্নার কথা ভাবি।’ এখানেও এইযে তুমি, কে সে? কবির প্রেমিকা? এ কি কেবল এক প্রেমেরই কবিতা? ক্লান্তি আর অবসাদের কবিতাও লিখছেন কবি। অলৌকিক সুই ও সুতোয় সেলাই করছেন প্রেমিকাকে শিল্পের কাঁথায়? নাকি অন্য কোনো মানে আছে আরো? এও তো হতে পারে: যদি ভেবে নিই আকাশ আমাদের স্বপ্ন— কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। সেই গন্তব্যে সেই স্বপ্নের কাছে পৌঁছাতে হলে আগুন বা বাতাসের মতো বাহ্যিক কোনো শক্তিই কাজে আসবে না। সে জন্য চাই অন্তরের গভীর থেকে উৎসারিত বিশ্বাস আর প্রেম। আর এইযে ‘তোমার শরীর খারাপ’ একে তো আমরা সমগ্র দেশ ভেবে নিতে পারি। দেশের এমন দুরাবস্থায় আমরা আবারও স্বপ্ন দেখি উঠে দাঁড়াবার। ঈশ্বরের বিছানায় শুয়ে কবিতা লিখি। অলৌকিক সুই ও সুতোয় শিল্পের মাধ্যমে সারাতে চাই ওর ক্ষত। আগুনের কাছে বিশ্বাস রেখে প্রার্থনা করি মানে তো বাইরের শক্তি আর ভেতরের শক্তি মিলিয়ে প্রার্থনা করি যেন দেশের অবস্থাটার উন্নতি হয়, সমস্ত অসুস্থতা আর অন্ধকারকে কাটিয়ে দেশ যেন সেরে ওঠে। যেন অতীতের সব গ্লানি মুছে যায়। হরিণীর মতো প্রেমিকা যেই কাছে এসে বসে, অনাগত ভবিষ্যতের কথা, স্বপ্নের কথা বলতে বলতে আকাশের নাভিমূল ছুঁই মানে তো আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যকেই ছুঁই।
কবিতার বহুমুখীতা কবিতার অর্থের প্রতীকী দ্যোতনা কবিতাকে মহৎ করে তোলে। বাক্যের অর্থের নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে বারবার কবিতার শব্দকে অসীমের দিকে ছুড়ে দেয়ার ক্ষমতা যে কবিতায় বেশি সে কবিতাই হয় কালজয়ী। শক্তির কবিতা নিয়ে জয় যেমন বলেছেন ‘মহৎ কবি সংকেত করার ক্ষমতাকে বহুদিন ধরে কবিতার মধ্যে সঞ্চিত করে রাখতে পারেন বলেই তিনি বড়ো কবি। দিন, কাল, জীবন এবং বয়স পাল্টে পাল্টে গেলেও তার কবিতা নতুন নতুন অর্থ উদঘাটন করে তার পাঠকের কাছে।’ বিমলদার কবিতার ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটা বেশ ঝরঝরে।
হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস কেঁপে উঠে রক্তের শিরায়
অজন্মা সংগীতে গায়—
‘ঐ আসে ট্রেন আসে শিস দেয় যুবা-বায়’,
অসহায়
চোখফুল ফুটে আছে পরিপূর্ণতায়
দূর নীলিমায়!
(পরঞ্জয়/অহংকার, তোমার শব্দ)
৩
‘একসময় আমার হৃদয়ে জাগে প্রেম, কবিতার প্রেম। কবিতা ও প্রেমিকা হাত ধরাধরি করে আমাকে নিয়ে গেলো স্বপ্নের ভুবনে। সেদিন থেকে কবিতাই হয়ে উঠলো আমার জীবন, আমার স্বপ্ন।’..বিমলদার কথা। ‘কবিতায় আমি শব্দের সম্ভাবনাকে সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে এর স্বরূপ উদ্ঘাটন ও মানবসত্তার বিকাশের পথ চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।’ তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই ‘সাঁকো পার হলে খোলা পথ’ (১৯৮২-১৯৮৫)এর কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে এই ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিঃসঙ্গতায় সত্য ও সুন্দরের কাছে হার মানতে মানতে এই বইয়ের কবিতাগুলোর শুরু। ‘তৃতীয় বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিলে/ তোমার সুন্দর মুখ ঢাকলো/ যেমন স্থির দুপুরে একটি গাছ ছায়াকে লুকিয়ে রাখে নিজের অস্তিত্বে কিছুক্ষণ/ তুমি সত্যের মুখোমুখি হতে পারলে না/ একটি সত্যকে তুমি গোপনে লালন করেছো বহুদিন তুমি নিঃসঙ্গ।’ এখানেই লক্ষণীয় যে কীভাবে নিঃসঙ্গ শব্দটির বহুমাত্রিক সম্ভাবনা বিস্তৃতি লাভ করছে। ‘তোমার নিঃসঙ্গতা মানে অবসন্ন শরীর/ তোমার নিঃসঙ্গতা মানে ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিলে প্রেমের ফিকির/ তোমার নিঃসঙ্গতা মানে সুন্দর-অসুন্দরের বৈষম্য/ ক্রমে ক্রমে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়া অকালবার্ধক্য।’ এর পরপরই আসছে ‘বাতাসে পুরোনো গন্ধ’, ‘কোনো স্বস্তি নেই’, ‘মধ্যরাতের কথকতা’, ‘ভিন্ন পথে যাবো’, ‘পূর্বপুরুষের কাছে’, ‘নষ্ট রাত’, ‘ক্ষুধা’ আর ‘অসঙ্গতি ১’ এর মতো কবিতাগুলো। পড়তে পড়তে ভেতরে রক্তের উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। আটপৌরে সহজ-সাধারণ শব্দগুলোই কী অসাধারণ হয়ে উঠেছে যেন। অসম্ভব বাঙময়তায় আবিষ্ট এই কবিতাগুলো মনের অজান্তেই আবৃত্তি করে উঠবেন পাঠক। অনুভব করবেন শিরায় শিরায় রক্তের ভিতরে দারুণ এক উত্তেজনা। কবিতা পাঠের ভেতর দিয়ে শুধু মানসিক চৈতন্যই নয় বিমলদার এইসব কবিতায় ছড়িয়ে আছে এক ধরনের আহ্বান। যেই আহ্বানে সাড়া দিতে পাঠকের মন ও মননের সাথে উঠে আসতে চায় শরীরও।
ভাঙাসেতু পার হয়ে একটি লোক
রুদ্ধশ্বাসে দৌড়চ্ছে কেবল
আতঙ্কে বুদ্ধির নেশায়
হয়তো অন্ধ-আবেগে আশরীর ঘেমেছিলো তার—
লোকটি কে?
(কবি/সাঁকো পার হলে খোলা পথ)
উদ্ভ্রান্ত, আশরীর রক্তের উন্মাদনায় ব্যতিব্যস্ত একটি মানুষের ছবি এঁকেছেন এই কবিতায়। বারবার প্রশ্ন তুলছেন লোকটি কে হতে পারে। কোনো দেশপ্রেমিক? নাকি ক্ষেতমজুর? চোখে মুখে ঝোড়ো হাওয়ার ছাপ। শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে সে লাজুক নারী ও প্রকৃতি কাঙাল কোনো কবি। অথবা নিচের কবিতাটির কথাই ধরা যাক—
এক শয়তান ছদ্মবেশ ধারণ করে আজ দুইদিন
আমার মাথার মধ্যে বসে আছে
খররৌদ্রে ভীষণ পায়চারি করে একা একা,
এঘর-ওঘর যায়
নিমেষে দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে ফিরে আসে
আমার মাথায়—
(পরস্পর মুখোমুখি/সাঁকো পার হলে খোলা পথ)
ছদ্মবেশ ধারী কে এই শয়তান? মাথার ভেতর জায়গা করে নিয়েছে। কাজকর্ম সব ভণ্ডুল করে দেয়। মৃত্যুভয় দেখায় প্রত্যহ। আমার মতোই বালিশে মাথা রেখে শোয়। কখনো কখনো বুকের উপর চেপে দেয় মস্ত পাথর। পালাতে চাইলেও পালাতে পারি না। আমি তাকে তাড়াতে পারি না কিছুতে। এই শয়তানের মুখোমুখি কে না হয়েছি আমরা। এ তো আমারই আরেক আমি। আমার ভেতরে তার বাস। আমার প্রতিচিন্তা সে। আমার ভেতরের যে আমি অন্ধকারে বাস করে। মৃত্যু ভয় জাগায়। সেই আমি’র মুখোমুখি এই আমি। ‘যেদিকে পালাতে চাও— যাও/ দৌড়তে দৌড়তে তুমি কতদূর যাবে?’ আরেকটি কবিতা আছে দেবদূত বিষয়ক।
আমার ভেতরে এক দেবদূত বসে নির্বিকার
খেলছে অর্গলবদ্ধ লুকোচুরি হাউমাউ খেলা,
অর্বাচীন লোমকূপে জমে আছে তৃষিত লবণ
মায়াবী সুতোয় আহা ঝরছে নামছে অবিরাম
লোনাজল বয়সের পুড়ন্ত ইঙ্গিত।
(কিসের বৈরিতা/ সাঁকো পার হলে খোলা পথ)
কখনো শয়তান কখনো-বা দেবদূত আমাদের ভেতর মুহুর্মুহু খেলা করে। আমাদের স্বপ্নে জলে শর্তহীন ভোর। মনে প্রশ্ন জাগে— আর কতকাল পর আসবে আমাদের স্বপ্নের দিন। সংসার জুড়ে শকুনেরা পাখা ঝাপটায়। ভাগাড়ে মিছিল নামে। গাঙচিল উড়ে যায় শূন্য আকাশে তৃষাতুর। আমরা এগোই অনন্ত রাত্রির দিকে। লোকালয়ে শুনতে পাই মানুষের হাহাকার। মানুষগুলোর যেন কিছু একটা হয়েছে আজ। বাংলার মানুষ যেন কী-রকম হয়ে গেছে! হারিয়ে যাচ্ছে সৃষ্টির উদ্দামতা।— এইসবই পদে পদে ফুটে উঠেছে এই বইয়ের প্রতিটি পংক্তিতে। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের কবিতা যাঁদের হাতে নতুন প্রাণ পেয়েছে, নতুন শিল্পকৌশল আর প্রজ্ঞাপারমিতায় উন্নীত হয়েছে, বিমল গুহ তাঁদের মধ্যে অন্যতম অগ্রণী। অদ্ভুত তাঁর জীবনের অতলান্ত ছোঁয়ার ক্ষমতা। শাশ্বত তাঁর উচ্চারণ। চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, প্রতীক, অলংকার আর অনুপ্রাসের ব্যবহার অসাধারণ। তিনি বলেন— ‘কবিতাই আমার অন্বিষ্ট। কবিতা এখন হাসিকান্না, ক্রোধ, প্রতিবাদ, ঘৃণা কিংবা ভালোবাসা প্রকাশের অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবিতা যেহেতু শিল্পের সবটুকু নির্যাসকে গ্রহণ করে একটি সম্পূর্ণ রূপ নিয়ে দাঁড়াতে সক্ষম, তাই শিল্পের চূড়ান্ত আবেদন নিয়ে কবিতা মানুষের মনে ঠাঁই করে নেয়।’ সর্বোপরি বিমলদার কবিতা অত্যন্ত স্বচ্ছ, ধারালো আর প্রবলরকম মেরুদণ্ড সম্পন্ন। নির্মম শিল্পিত ধারাবাহিকতায় তিনি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেন আমাদের ইতিহাস-চেতনার মধ্য দিয়ে আমাদের ব্যক্তি-চেতনা, সমাজ-চেতনা আর রাষ্ট্র-চেতনা। আশ্চর্যভাবে জাগিয়ে তোলেন আমাদের ভেতরের সেই আমি-কে।