পিঁয়াজনৈতিক অর্থব্যবস্থায় একজন চোরের সূচক । রোমেল রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ডিসেম্বর ২০১৯, ৭:১০ পূর্বাহ্ণ, | ১৪১০ বার পঠিত
হে মানবগণ, একদা তোমাদের রাষ্ট্রে পিঁয়াজের মূল্য অত্যধিক বৃদ্ধিঘটে, যা ক্রয় সীমানার অনেক বাইরে চলে যায় ফলে তোমরা উভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করিতে থাকো এবং অনুভব করো তীব্র তুমুল পিঁয়াজ সংকটের; জীবনে পিঁয়াজের গুরুত্ব তোমরা তখনই টের পাও এবং তোমরা স্পষ্ট হও এই বিষয়ে যে, একদঙ্গল বণিকের হাতে সমগ্র পিঁয়াজের বাণিজ্য বন্দি এবং তাহারা রাষ্ট্রীয় মদদে এইসব মজুদদারি করতে সক্ষম হয় কিংবা সজ্ঞানে এই আচমকা সৃষ্ট সংকট তৈরিতে সমর্থ হয় কেনোনা তোমরা সকলেই জানো যে, এইসব বণিকেরা সরকার ব্যবস্থার খাদেম, ফলত ইহারা এই অপকর্মের এক অঘোষিত সনদ পাইয়া থাকে যা ইহাদেরকে জলহস্তীর ন্যায় স্বাস্থবান করিয়া থাকে; কিন্তু হে মানবগণ ধিক্কার তোমাদিগকে কেনোনা তোমরা কেবলই রসিকতা করিতে জানো, জানো না প্রতিবাদ করিতে; তোমরা কি ভুলিয়া গিয়াছ তোমাদিকের পুর্ববর্তী প্রজন্মের বিদ্রোহের ইতিহাস, তোমরা তো তাহাদের উত্তরসূরি, তবে কেন বোবার ন্যায় থাকো, তোমরা কি মনে করো দৈব এসে সকল উদ্ধার করিবে নাকি তোমরা ‘মানিয়া নেবার সংস্কৃতি’তে বিশ্বাস রাখো! আমি জানি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নব্যবস্থা তোমাদিগের হারমজ্জায় ভীতি পৌঁছাইয়া দিতে সফল হইয়াছে, ফলে তোমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যে ভীতি শিরশির করিয়া প্রবাহিত হয় রাষ্ট্রের মুখোমুখি বিক্ষোভে দন্ডায়মান হইবার উপক্রম হইলেই, তথাপি আমি ধিক্কার দেই তোমাদিগের এহেন নিরবতায়, তোমরা কি জানোনা নীরবতা কিংবা মানিয়া লইবার সংস্কৃতি চোরসংস্কৃতি বা লুটপাটতন্ত্রের স্বাস্থ্যবৃদ্ধি ঘটায়? তোমাদের এহেন দুর্বিষহ অবস্থার জন্য তোমরাই দায়ি এবং কতিপয় ধনীকে ধনী থেকে আরও ধনীতে উপনীত করিবার জন্য তোমরাই দায়ি কেনোনা তোমাদের মৌনতা এই বৈষম্যের সমাজ নির্মাণে জ্বালানি হিসাবে কাজ করিয়াছে, আর তোমারা সর্বদাই রসিকতার আবডালে ঘাপটি মারিয়া নিজেদের দুর্বলতার আত্মরক্ষা ঘটাও কেনোনা পিঁয়াজের কৃত্রিম সংকটের সেই দিনগুলোতে তোমরা এহেন নিম্ন রুচির রসিকতা উৎযাপন করিতে লাগিলে যে, বিবাহ, জন্মদিন কিংবা খাৎনায় তোমরা পিঁয়াজ উপহার দিয়া ফটো তুলিয়া উহা লইয়া ট্রল ট্রল খেলা খেলিয়া মূলত নিরবতাই উৎযাপন করিয়াছ! পথে নামো নাই কেউ! তোমাদিগের এমত আবালত্বে লানৎ বর্ষিত হোক, কেনোনা তোমরাই ধনীকে ধনী করিতেছ নিজেদের ফতুর করিয়া, কেনোনা তোমরা বিশ্বাস রাখো তোমাদিগের চোর মন্ত্রী, আমলা, নেতাদিকের উপর যাহারা এইসব সংকটের শেকড়বাকড়!
অতঃপর হে মানবগণ, বল তোমরা এই চোর সংস্কৃতিতে কে প্রকৃত চোর? এবং একজন ছ্যাঁচড়া চোরের সূচক কোনটি? অচিরেই ধ্বংস হইবে তোমরা যদিনা তোমরা এই লুটেরা সমাজ ভাঙ্গিতে সমর্থ হও!
কেনোনা সংকটের দিনগুলোতে মন্ত্রী নেতারা তোমাদিগকে আশ্বাস দিলো, ‘ফরেন হইতে পিঁয়াজ আমদানি হইয়া আসিতেছে’ আর তোমরা অপেক্ষায় দিন গুনিতে লাগিলে এবং সেই দিনগুলোয় তোমরা উচ্চমূল্যে পিঁয়াজ কিনিয়া খাইলে এবং আরেকদল না খাইয়া পিঁয়াজবিহীন জীবন চর্চা করিবার চেষ্টায় বেজার মুখ করিয়া ঘৃণা করিতে লাগিল যাহারা পিঁয়াজ কিনিয়া খাইতে সমর্থ তাহাদেরকে! ফলে তোমরাই নিজেরাই নিজেদেরকে ঘৃণা করিতে লাগিলে প্রকৃত শয়তানকে বাদ দিয়া। হে মানবগণ, খেয়াল করো ইহা সেই সমাজ যাহা নির্মাণে তোমাদের আশকারা আছে, যেই সমাজ লুটেরাদিগের জন্য আরামদায়ক এবং তোমাদের মধ্যে বৈষম্যের এমন এক পরিস্থিতি জারি করিতে সক্ষম যাহাতে, তোমরা পরস্পর ভ্রাতৃঘাতি হইয়া ওঠো। বল হে মানবগণ, এই চরম বৈষম্যের সমাজ কি তোমরা ভাঙ্গিবে না? একদা পিঁয়াজ আসিল দেশে সমুদ্রপথে জাহাজে করিয়া, আকাশ পথে উড়োজাহাজে করিয়া এবং আমরা দেখিলাম বস্তা বস্তা সেইসব পিঁয়াজের নান্দনিক রসালো ফটোগ্রাফ আর আশ্বস্ত হইলাম, ‘এইবার এক লম্ফে নামিয়া আসিবে পিঁয়াজের মূল্য’ এমন এক কল্পে! কিন্তু হে মানবগণ তোমরা নিশ্চয়ই মনে করিতে পারো, চাহিদার তুলনায় অধিক পিঁয়াজ আসিবার পরেও মূল্য কমে না এবং সিস্টেম গণমস্তিষ্ক ব্যস্ত এবং বিভ্রান্ত রাখিবার জন্য কতিপয় এজেন্ট নিয়োগ দিয়া ট্রাক ভর্তি পিঁয়াজ নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করিতে লাগিল সমগ্র দেশের বিভিন্ন বাজারে যা ছিল চাহিদার সম্মুখে রসিকতার মতন! ফলে বণিকেরা জলহস্তী হইতে অতিকায় হস্তিতে রূপান্তরিত হইয়া উঠিতে লাগিল আর তোমরা মাথা কিংবা নিতম্ব চুল্কাইতে চুল্কাইতে জীবনযাপন করিতে লাগিলে! হে মানবগণ, তোমরা কি খোঁজা হইয়া গিয়াছ? তোমরা কি দেখো নাই পিঁয়াজের ধুম্রজালের মধ্যে যখন তোমরা নিমজ্জিত তখন সকল সব্জি ও অন্যান্য পণ্যের দাম আকাচুম্বি হইয়া উঠিয়াছিল এবং তোমরা বেকুবের ন্যায় পিঁয়াজ পিঁয়াজ করিয়া ব্যস্ত থাকিলে আর ধনী হইতে আরও ধনী হইতে লাগিল কতিপয় বণিকেরা! লানৎ তোমাদিগকে, তোমরাই তোমদিগের ভাগ্যের জন্য দায়ি, তোমরাই আঘত করিতে নারাজ এবং তোমরাই উস্কানি দিয়া থাকো লুটতন্ত্রকে কেনোনা তোমরা সকল কিছু সহ্য করিয়া নেও! ধ্বংস হও তোমরা তোমাদিগের ভাগ্যের ন্যায়!
অতঃপর শোনা যাইতে লাগিল কৃষকের ক্ষেত হইতে অপরিণত পিঁয়াজ চুরি হইয়া যাইতেছে! ফলে ক্ষেতে ক্ষেতে চোর ধরিবার জন্য পাহারা বসিল, এবং কোথাও কোথাও পিঁয়াজচোর ধরা পড়িল! ফলে পিঁয়াজ চোরের সালিশ লইয়া একটি ক্ষুদ্র সংলাপের অবতারণা এইরূপ হয় যে…
- চেয়ারম্যান এই ছিমরা আমার ক্ষেতের পিয়েজ চুরি করিছে!
- ঐ চুরি করিছিস?
- জি!
- জি? ভয় করে না?
- বাড়িতে বাজার না থাকলি চুরি করতি ভয় করে না! আর বড় চোরের সামনে লজ্জা কিসির?
- বড় চোর কিডা?
- আপনি! উচিৎ ছেল আপনার গোডাউন লুট করা!
[ সবাই হেসে ওঠে ]
- চুপ বেয়াদপ! দাড়া দেখতিছি তোর রস কতো। আগে ক পিঁয়েজ কেন্ চুরি করিছিস?
- তাইলে করবোডা কি? দাম যেইটের বেশি সেইটেই তো চুরি করা লাভের? বাজার নেই ঘরে! বাজারে আগুন! খাবো কি?
- তা বইলে আমার ক্ষেতের থে?
- তোমার সাথে আমি পারবো, ধরা পড়লি জানে বাঁচপো! চেয়ারম্যানের সাথে পারবো না তাগের বন্দুক আছে, সরকার আছে মাথার উপরে! উনার গুদামে চুরি করতি গেলি তো গুলি!
- হেই চুপ! এইসব কি কথাবার্তা!
- এরে থানায় নিয়া যা! সালিশের লাইন এর না!
- স্যর ও পাগল আছে ছাইরে দেন!
- উঁহু! বেশিই পাগল! ডলা খাওয়া দরকার! থানায় নিয়া যা!
- আপনিও চলেন, একসাথে যাই দুইচোর!
[ সবাই হেসে ওঠে ]
অতঃপর হে মানবগণ, বল তোমরা এই চোর সংস্কৃতিতে কে প্রকৃত চোর? এবং একজন ছ্যাঁচড়া চোরের সূচক কোনটি? অচিরেই ধ্বংস হইবে তোমরা যদিনা তোমরা এই লুটেরা সমাজ ভাঙ্গিতে সমর্থ হও!