হোমিও ফোঁটা ও আটাশে এপ্রিল । শিবলী মোকতাদির
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০১৯, ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ, | ১৪৯৯ বার পঠিত
ফিতে
অই তো আমার কর্তিত মাথা ভেসে যায় জলস্রোতে
নদী করিছে বহন প্রাচীন কাল থেকে। আর একবার
যদি দৈবক্রমে কোথাও দেখা পেতো তার
তবে বলে দিতো মুণ্ডু ভাসানো হয়েছে কোথা হতে
বিচ্ছেদ হয়েছে ধড়। সেই অর্ধ দেহ আজো পড়ে আছে
খাদের কিনারে। দুপাশে চোরাবালি আর পাথরের
মাঝে ঘেঁষতে পারেনি কেউ। যারা কাছে এসে
সনাক্ত করবে দেহটিকে। অথবা এর পরে ফের
ঘৃণায় ফেলে দেবে জলস্রোতে। মনে আছে ধীরে ধীরে
কাঁকরে ভরেছে দেহ। স্রোতের পানিতে উর্বর ভূমিতে
নীল কিছু বৃক্ষ জন্মেছিলো। আজ দস্যুরা এসে তীরে
শুধু নিয়ে গেছে তার কেশভার থেকে টকটকে লাল ফিতে।
হোমিও ফোঁটা
মধুরতম শীত এলো;
তথা— গ্রাম্য-গরীবকে শীতার্ত করে দিতে;
আমাকে যথা, আবারো এলো;
নীতিময় নাট্যেমাখা গীত—
পরশ আর পশমে চমক দিয়ে।
এদিকে আগুনের আন্দোলনে নেমেছে শ্রাবণ
গ্রামসুদ্ধ সেই এক হাহাকারে
ফাঁকা আর ফক্ফকা জনজীবনের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাহীন
বাকি সব ক্রমান্বয়ে— নাদানে-নওজোয়ানে
ভয় ভুলে গর্তে নিয়েছে ঠাঁই।
উদাস কর্তা আমি, শাসনে সমস্ত জাগাই
কী করি, কী করি…
বাকিটা আলাপ রাখো তো জগাই
গৃহিণীকে বলো; আমাদের থার্মোমিটার
কেন আজ মাত্রাভেদে অযথা নাচায়!
সংবাদ
প্রবাহ তোমার সরু পথে,
আমরা পাচক যতটুকু জানি;
মেঘে মেঘে পূর্বে যাও —গোধূলির আয়োজনে
তবু বাষ্প সন্ধানে
যে সনে পুত্র হারিয়েছো বনে
নয়নে ধরেছো তার ছবি,
শতরাত্রী আর শতভিষা, কেঁদে বলে—
মৃদুমন্দ বেগে
রোদনে চেয়েছো শুধু পুত্র শতরূপা।
ঝলক
সঞ্চিত নৈরাশ্যের মাঝে তুমি এলে বিদেশি ভ্রমর
নয়নের নিকট হতে আমাকে দেখাবে বলে
এই ফুল-কতটা লোকজ, কতটা গ্রামীণ!
আমি মাফলারে দীর্ঘায়িত শীত চাপা দিয়ে
সুন্দরের মর্মরিত অধিপাঠ করবো বলে;
তোমাকে বলেছি- ফুল নয়,
আমি ফলের গীতিময়তা ভালোবাসি।
কখনো অতিরঞ্জিত কখনোবা অতিমাত্রিক।
জানি, তবু তুমি ফুলের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।
বলিষ্ঠ ও স্বতন্ত্র পাপড়ির প্রত্যাশিত দুঃখ, শোক
জরা ও যন্ত্রণার আবেদন বয়ে আনবে।
আমার চোখ উঠবে ভিজে।
বাতাস বইবে তখনই হঠাৎ বেহুদা বসন্তের
ঝরে পড়বে পালক। স্থিরচিত্রে গজিয়ে উঠবে
দুরভিসন্ধির বল্লম হাতে জলে-স্থলে অসংখ্য প্রজাপতি
কতিপয় কীট ও পরাশ্রয়ী দুরাচার।
ফলে ছাতিম ফুলে মিশে যাবে যৌনতার ঘ্রাণ
এই নিয়ে শিশির আর সন্তানে চলবে কর্মহীন এক ক্যারিক্যাচাল।
তাদের ভেদ আর ভাষণে নরক হবে গুলজার।
আজানের পর আজান চলবে, সুতরাং শান্ত হলেও
বাহাস চলবে দেদারছে চলন্তকাল।
আমার বিবিধ কালের, সালের জমানো বিস্ময়গুলো
বিকিরণে বিস্তারিত হবে,
ভেঙে যাবে ব্যাঞ্জনবর্ণের হাট।
গ্যাঁট খুলে গেলে তসবির দানাগুলো যেভাবে ছিটকে পড়ে
ব্যক্তিগত নির্মিত শৈলীর নীতি ও রীতির শীলিত স্বরূপ—
সেইভাবে অকারণে ফুল ও ফলের প্রভূত সংগ্রামে
অন্ধের আলেয়া নিয়ে আমাকে দেখতে হবে;
কেবলই পোড়া পোড়া চিত্রদাহ।
ফুল বলবে আমাকে ভাঙো। ফল বলবে আমাকে জোরো।
আমি কি আর আস্ত হবো না?
কুড়িয়ে পাওয়া যুদ্ধাহত কিছু বৈকালিক বাতাস
যদি আমার পক্ষে থাকে, শোনো—
স্বোপার্জিত অভিজ্ঞতায় শ্যাওলা বা পারদের ন্যায়
ফের আমি একত্রিত হবো।
ভ্রমর, ওগো ভ্রান্তবিলাসী ভ্রমর- স্বরবর্ণের দেশে গিয়ে
তুমি বরং ফুল ফোটানোর কৌশলটুকু খোলাসা করে দিয়ে এসো
তাতে চুমুর চক্রান্তে বাধা পড়–ক
সে দেশের প্রতিটি বালিকা ও বালক।
মিলনাকাক্সক্ষায় তাদের হাতে দিও, যদি পারো—
পাপড়ি ও পরাগের ঝলক।
লিঙ্গে প্রবাহিত
বিদেশি চোরের ন্যায় স্নিগ্ধ নাগরিক এলে তুমি
নীচু দেশে ভ্রান্তি, ভাঁজে আড়ালে দিয়েছো ঢেউ
সমবেত আর তীক্ষ্ন সমকামী।
ফলে মুদ্রা সোনাগত, ফলে যে রূপের অধিকারী
নীতির ধরনে হায়! চিনির প্লাবনে যৌথ প্রতিলিপি;
পাঠালে নাবিক- পত্রে নাম নাপিতের বাড়ি বাড়ি।
শুধু এই যৌন ভুল, মাত্রা আর লিঙ্গে প্রবাহিত
চিত্রে ভাবি সুর- ও তর্কে বালিকা রূপ
তোমাকে দেয়, ভাবে ও ভাবায় জাতিগত।
আজ ধূসর তালিকা হাতে গোধূলির এই ফাঁকে
প্রিয় আবাসিকে কালি ও কালের যমজ সন্ত্রাসে—
লোকসানে, বাহিত পতনে, মৃত্যুতুল্য গান যদি ডাকে?
বহু দিন পর, আদালতে শত তালাকের বাঁকে বাঁকে
গোত্রহীনা বালকের আগে-পিছে গঠনে ঘটনা ঘটে
যেন হরণ করেছে জাগ্রত জামের বনে তাকে।
সেই অভিকর্ষে ধর্মে পড়ে টান, মরুময় দৃশ্যে পড়ে যতি
এতো যে প্রাণের অনুমতি— আমার দেহকে তুমি;
তীব্র রোগে মহা অবনতি আর অসুখের জন্য করেছো উন্নতি।
আটাশে এপ্রিল
উদার প্রবাহে ছুটে যাচ্ছে লোকটি, গজিয়ে-ওঠা নানা শূন্যতার মধ্য দিয়ে।
এঁকেবেঁকে বিবিধ দৃষ্টান্ত ও দৃশ্যবাহিত রূপে।
কিছুটা স্থূলোদর। ভোজনবিহারী। যাচ্ছে উদীচ্য দিক বরাবর।
ভোরের পর ঘটেছে সকালের সঞ্চার। নানান কা- ও কাকের কলরবে
মাঝেমাঝেই উধাও হয়ে যাচ্ছে লোকটি।
অনেকটা বিকারগ্রস্ত ঋণাত্মক আর বিয়োগান্ত মানুষের মতো।
মনে হচ্ছে জ্ঞানলুপ্ত, বিপথগামী। তবু স্বতন্ত্র স্পর্ধায়
জোরকদমে এগিয়ে যাচ্ছে শুধুই দীর্ঘ আখ্যায়িকার মূল চরিত্রবলে।
এভাবে তুলনার বিনাশ শেষে দেখা গেল নতুন ত্বকের মতো
শান্ত আর স্নিগ্ধ এক বহেড়া গাছের ছায়ায় খানিকটা জিরিয়ে নিচ্ছে সে।
ব্যাস আর ব্যাসার্ধের বাহিরে এসে নিশুতির মতো নিরানন্দে।
ঘামের ঘনিষ্টতাকে অনেকটা আপন মনে করে পড়েছে ঢলে অগভীর ঘুমে।
দেখি- উপরাজ্যের এতকিছু ফেলে
শিশুতোষ ব্যাকরণে আচ্ছামতো জড়িয়ে আছে সে।
এক হাতে কচি লাউ, অন্য হাতে গ্যাসবিল। তাকে কেন্দ্র ক’রে
দূরত্বের দুরবিনে দেখা যায় এপাশে বাজার। ওপাশে ব্যাংক-বাড়ি।
হেমন্তের পর এসেছে বসন্ত।
সব কেমন শান্ত আর শুকনো পাতার মতো অহেতুক এলোমেলো।
তবু জগৎযাচিত হয়ে কে যেন তীব্র এক চিৎকারে জাগিয়ে দিলো তাকে।
আর অমনি কতো জারুল আর জামরুল
ঝুরঝুর করে খসে পড়লো বৃত্ত কষে তাকে।
যেন পিঠে পড়লো হাজারো কিল।
ওদিকে আগন্তুক চিলচিৎকারে ডাকে আর হাসে— এই যে নকুল-দা,
বাড়ি যাবেন না? আজ তো আটাশে এপ্রিল!
লাৎসিউম
ত্রিশঙ্কু হয়ে আছি, ত্রিশূলে গাঁথবে কী করে?
বুকে তো স্থল নেই, আছে জল অথই সমুদ্র
হে নিনাদকারিণী থামো, আমি অতি ক্ষুদ্র
আগে মরি একা, পরে হত্যা করো অবসরে।
এই এত অস্ত্র, দেখে তো শিল্প মনে হয়
ঘৃণাও ঘুরে যাবে বাতাসে রেনুর সাথে দূরে
দেখো, মনে রেখো, মরেও গজাবো অঙ্কুরে
তাহলে ধ্বংস, রক্তে-রাঙানো অতোটা সহজ নয়।
ধরো আজ কোজাগরী, পাত্রে পড়েছে চাঁদ
সেই তাপে গলে যাচ্ছে দেশ, প্রদেশের মায়া
আকাশ ঊর্বর তাতে ফিনিক্সের পড়েছে ছায়া
উড়ে তারা কোথায় যায়? পৃথিবীর পরে যে ফাঁদ!
সেখানেও বন্দি আছে, বরফে নির্মিত কারাগারে
ভাতের বদলে ভর্ৎসনা দেয় মাটির বাসনে ভরে
আছে পিঙ্গল প্রজাপতি প্রেতের পদতলে মরে
দ্বীপ-দ্বীপান্তে তারা আসে-যায় চড়ে নভোযানে।
যেখানে ফুল ফুটে আছে ফলের নিয়মে ব্রতে
পাপড়িতে পাপ, পোশাকে পাথরে গেঁথেছে মালা
দু-চোখে দীপ্তি দাও পরিধান-নিমিত্ত ছালা
যেন আমি যেতে পারি ভেসে দূর হেডিসের স্রোতে।