বৃক্ষশোক । রোমেল রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ এপ্রিল ২০১৯, ১১:৫১ অপরাহ্ণ, | ১৩৭৪ বার পঠিত
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কুকুর বাঘা, চন্দন এবং মতিন বহুদিন পর একজায়গায় বসে ঝিমায়। দূরে দেখা যায় চাঁদনী দৌড়ে আসছে। আজকে চাঁদনীকে নিয়ে এদের মধ্যে কোন হাউকাউ নাই। ক্যাম্পাসের কুকুরদের মধ্যে এইসময়ে জনপ্রিয়তায় শীর্ষে থাকা বাঘা বলে, দেহিছো চাঁদনীর কারবারডা? এরাম একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনেও সাইয়োডা লেট কইরে আসতিছে! সুদর্শন চন্দন যার শরীরের রঙ সাদাকালোর মিশ্রণ, যা দেখলে আমাদের অস্ট্রেলিয়ান গরুর কথা মনে পড়ে। এবং ক্যাম্পাসের কুকুর সমাজে চন্দন প্রসঙ্গে রসিকতা চালু আছে, অতীতকালে হয়তো কোন অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড়ের সঙ্গে তার বংশের কারোর লেনদেন ঘটেছিলো! ইতিহাস যাই হোক। চন্দনের চামড়ার এই সৌন্দর্য তাকে অন্য সকল লাল, কালো বা সাদা কুকুরদের থেকে আলাদা করেছে এবং সে জানে তার উপ্রে ক্যাম্পাসের স্পাইসি কুকুরীরা ক্রাশ খায়! ফলে চন্দন চাঁদনীকে দেখে লেজ নাড়তেই। বাঘা বলে ওঠে, আজকে কলাম প্রেম পিরিতির ইস্টাইক! মতিন এই দলে নতুন যোগ দিয়েছে। বয়সে সে এই কুকুরদের হাঁটুর বয়সী। ফলে সে ফিক করে হেসে দিয়ে বলে, কাকা কথাডা কলাম ঠিক কও নি! বাঘা বলে ওঠে, তুই চুপ কর দিনি বাড়া। আমারে প্রেম পিরিতি বুঝোতি আইছিস? প্রেম ভালোবাসা করতি করতি ভার্সিটি এলাকার চাইর দিক আমার বাচ্চাকাচ্চায় ভরায় ফেললাম, আমারে বুঝোচ্ছিস বিটা কুকুরগের কেমিস্ট্রি? চন্দন বলে, মনডা ভাল্লাগতিছে না বাঘা ভাই! কি করলো ক্যাম্পাসটারে দেখিছো? গাছ কাইটে ন্যাড়া বানায় ফেলিছে! চিনা যায় না চাইরপাস! ইরা বলে পরিবেশ বান্ধব ক্যাম্পাস বানাবে! বাঘা বলে, হ নতুন বরাদ্দ আনবেনে আর কি! গাছা লাগানো আর সেই গাছ বড় করার জন্যি! তারপর আবার এই কাটা গাছে বিক্কির করা টাকাও মারবে। কতো কি কারবার! উন্নয়ন আসলি গাছ কাটা হয়। আবার উন্নয়নের নামে টবে টবে ক্যাকটাস লাগানো হয়। উন্নয়ন এট্টা কঠিন মিথ্যে! তখন চাঁদনী পৌঁছায়। হাঁপাতে থাকে। মতিন ছলকে উঠে বলে, আছো কিরাম? চাঁদনী বলে, চুপ বান্দর! বাঘা জিজ্ঞাস করে, এতো ব্যস্ত দৌড়োয় না আসলিও পারতা।
বাদ দেন দিনি। আপনি সাইয়ো চান্স পালি পলিটিক্যাল লেকচার মারেন। বাঘা বলে, পলিটিক্স রে অস্বীকার করার কিচ্ছু নাই চন্দন, শুধু দৈহিক সৌন্দর্য দিয়ে দুনিয়া জয় করা যায় না। চন্দন বিরক্তি নিয়ে বলে বসে, অই সাইদুলের চা দোকানে এক মাস্টার আসে রোজ। হেভি চা সিগারেট খায়, দলবলরে খাওয়ায়। হেভি উচ্চ মার্গের দর্শন বিজ্ঞান রাজনীতির তত্ত্ব নিয়ে কড়া লিকারের আলোচনা করে। তার কথা সবাই হা হয়ে শোণে।
লেট যহন করিছো আরেট্টু দেরি কল্লি ক্ষতি হতো না। চাঁদনী বলে, উঁহু! লেট করা আমার পছন্দ না। তবু লেট হয়ে যায়। কি করবো কও! চারিদিকি ভালোবাসা, পয়েন্টে পয়েন্টে লোকজন হায় হ্যালো করে! এট্টু না দাঁড়ালি গোস্বা হয়! চন্দন বলে বসে, ক্যান ইলেকশনে দাড়াবা নিকি স্যরগে মতন লাল নীল হলুদ সবুজ দলে? চাঁদনী বলে, রাহো দিনি বাল! দেখিচো ঐ বড় শিরিষ গাছটারে আজকে দুপুরে কাটিছে? ইসস! ভাবা যায় না কতো স্মৃতি অই গাছের তলায়। বাঘা বলে, আর অই দিকি তো নাইরকেল গাছ গুলোরে লাইন ধইরে কাইটে চুয়া কইরে দিছে। মতিন বলে, ইরা কি করতি চায় সব গাছ কাইটে? চন্দন বলে, উন্নয়ন মারাতি চায়! ঢালাই কইরে শান বান্ধানো এলাকা বানাবে! চাঁদনী বলে, আমি শুধু বুঝতি পাল্লাম না এট্টা জিনিস, শালার একজন মানুষ একটা কথা বলল না? সবাই তাকায় তাকায় দেখল? অথচ মানুষগের কিছু হলি লাইন দিয়ে দাঁড়ায়ে মানব্বন্ধন মারায়! একজন লোক এট্টা কাগজ বুকে নিয়েও দাঁড়ালো না গাছ গুলোর জন্যি? কেউ বলল না গাছ কাটা বন্ধ করেন! বাঘা বলে ওঠে, তপন দার দোকানে ঘুরাঘুরি করতি করতি শুনলাম ছুয়াল মাইয়েরা আলাপ করতিছে টুকটাক! তাগের কারা নাকি ছবি তুইলে ফেসবুকে দিছে! এই পর্যন্তই শেষ! মতিন বলে, মনে মনে সবাই উন্নয়নের পক্ষে। মানে গাছ কাটার পক্ষে। বাঘা বলে, তা নাও হতি পারে, তয় সিস্টেম যে সবাইরে সিস্টেম কইরে ফেলাইছে সেইডে বুঝা যাইচ্ছে এই গাছ কাটা দেইখে! চাঁদনী বলে, হয় পাখি গুলো ঘর ছাড়া হইছে। সেদিন দেখলাম শহীদ মিনারের পাশের বট গাছটায় বইসে সব লাইন দিয়ে কান্নাকাটি করতিছে। মতিন উত্তেজনায় বলে ওঠে, ভিসির মাথায় হাইগে দিতি পারে না? নালি রেজিস্ট্রারের ঘাড়ে। চন্দন বলে, তাতে কার কি? উরা কি আর বোঝবেনে আমাগে ভাষা? উল্টো যাইয়ে দ্যাখ্ এই ভার্সিটিতে যারা গাছ নিয়ে কাজ করে, যারা সুন্দরবন নিয়ে লিকচার মারায়ে পেট চালায় তারাও চুপ! যারা গাছগাছড়ার বিভিন্ন জাত-বেজাত নিয়ে গবেষণা করে তারা চোখে টিনের চশমা পইরে ঘুইরে বেড়াচ্ছে! মতিন আরো ক্রেজি হয়ে বলে ওঠে, তালি এই দায় কার? ভিসির? উনি যেহেতু হেডম্যান এই ভার্সিটির উনিই সকল কিছুর দায় নিতি বাধ্য। তালি উনারে কামড় দিলি কিরাম হয়? চন্দন বলে, ছাগলের মতো কথা কইস না বাড়া! কামড়াবি কহন? উনি গাড়িরতে নাইমে অফিসে ঢোকে আবার গাড়িতে কইরে ফেরে। মতিন বলে, ক্যান যহন কোন অনুষ্ঠান যোগ দিতি এই বিল্ডিং তে অই বিল্ডিং হাইটে যায় তহন দেবো কইষে কামড়াইয়ে। চন্দন বলে, উল্টো তার দলবলের তাড়া খাবি নি! মতিন আরো উত্তেজিত হয়ে বলে, তাতে কি সাইয়ো? না হয় এই অপরাধের প্রতিবাদ করতি যাইয়ে কয়েকটা লাথি খালাম ক্ষতি কি। লড়াই করতি হলি মাইর গুঁতো খাওয়া লাগে। বাঘা এতক্ষণ চুপ ছিল সে বলে, এট্টু চুপ যাও দিনি বাপজান। বেশি ফরফর কইরে না। তুমি ভিসি রে কামড়াবা আর ঠিক তার পরেরদিন দেখবা কর্পোরেশনের লোকেরা কেচকি কল আর বিষভরা ইনজেকশন নিয়ে আইসে হাজির হবে। কুকুর মুক্ত ক্যাম্পাস বানাতি। তোমার এক কামুড়ের গুঁতোয় সব কুকুরের জীবন বরবাদ হবে। চন্দন বলে, তাও ঠিক! চাঁদনী বুঝতে পারে মতিন ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে নাই। সে বলে, শোন মতিন আমরা হলাম যাইয়ে কুত্ত! আর যারা খুন হইসে উরা হচ্ছে গাছ। আর আমাগের সবাইরে নাড়ায় খাচ্ছে মানুষ। আমরা সবাই মিলে এই দুনিয়ার এট্টা চক্র। সবাই মিলে সেই চক্রটারে জ্যান্ত রাখিছি। কিন্তু মানুষের হাতে বিধ্বংসী ক্ষমতা আছে। আমরা তারে খোঁচা দিলি তারা আমাগেরে অই গাছের মতন খুন কইরে ফেলাবে। আমরা তো তাও গাছের জন্যি শোকসভা করতিছি। আমরা মরলি তাও কেউ করবে বইলে মনে হয় না। মতিন ঘাড় বেকিয়ে বলে, তা বইলে ম্যান্দা মাইরে থাকপো? বাঘা বলে, প্রজাতির সংখ্যা বাড়াতি হবে। স্বপ্ন দেখতি হবে একদিন দুনিয়ায় আমাগের রাজ্য কায়েম হবে। চন্দন বলে, বাদ দেন দিনি। আপনি সাইয়ো চান্স পালি পলিটিক্যাল লেকচার মারেন। বাঘা বলে, পলিটিক্স রে অস্বীকার করার কিচ্ছু নাই চন্দন, শুধু দৈহিক সৌন্দর্য দিয়ে দুনিয়া জয় করা যায় না। চন্দন বিরক্তি নিয়ে বলে বসে, অই সাইদুলের চা দোকানে এক মাস্টার আসে রোজ। হেভি চা সিগারেট খায়, দলবলরে খাওয়ায়। হেভি উচ্চ মার্গের দর্শন বিজ্ঞান রাজনীতির তত্ত্ব নিয়ে কড়া লিকারের আলোচনা করে। তার কথা সবাই হা হয়ে শোণে। কিন্তু সেই শালারেও দেখলাম না এই গাছ কাটা নিয়ে এট্টা কথা কতি। বাঘা কয়, হা হা! জ্ঞান বিক্কির করা ছাড়া এরা এক পা এগোয় না। যদি প্রমোশন আইটকে যায়। চাঁদনী বলে, আমার মা বলতো যে অই নাইরকেল গাছ গুলো যহন ছোট ছোট তহন নাকি উনি এই ক্যাম্পাসে আইছেলেন! আহারে! চন্দন বলে, এমন ডিজাইন কি করা যাতো না যাতে গাছ গুলো কাটা পড়তো না? এতো ইঞ্জিনিয়ার এতো আর্কিটেকচার কারোর মাথায় আসলো না গাছ গুলো বাঁচানো? বাঘা বলে, সবই করা যায় আবার সবই যায় না, বেশি লাভ লুটপাট যদি হয় শর্টকার্ট। বাদ দেও মানুষের এইসব নির্মমতার কেচ্ছা, আসো আমরা শোক করি। নিহত বৃক্ষদের জন্য আহাজারি করি। তাদের প্রাণের জন্যে আমাদের প্রাণের কান্না জানাই। এর চেয়ে বেশি কিছু করা আমাদের দ্বারা সম্ভব না। কুকুর জন্মের সমস্যা আপাতত একটাই, অনুগ্রহে বাঁইচে থাকতি হয়! প্রতিবাদ বড়জোর একটা কামড় দেয়া পর্যন্তই! তারও প্রতিষেধক মানুষের হাতে আজ আছে। ক্ষমতার বিরুদ্ধে কুকুরেরা দাঁড়াবে কি করে? আসো আমরা কান্দি! আমরা চিৎকার দেই আমাদের আত্মার আত্মীয়দের শোকে আমরা এক হই।
তারপর তারা চারজন মুখোমুখি হয়ে নতজানু দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ নিরবে। ক্রমে ধীর থেকে উচ্চ স্বরে তারা চারজন মিলে আহাজারি করতে থাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে। চৈত্রের চান্দের নিচে সেই ডাক ছড়িয়ে যেতে থাকে দেয়াল দালান রাস্তা আর উচ্চ ভবন গুলোর ঘুলঘুলি কাঁচ গ্রিল ছুঁয়ে… ক্যাম্পাসের বৃক্ষময় এবং বৃক্ষশূন্য প্রান্তরে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা নিহত গাছগুলোর শরীরের উপর দিয়ে; প্রতিধ্বনিত হতে থাকে প্রাণের জন্যে প্রাণের এই ক্রন্দন। নৈশ প্রহরীদের কেউ কেউ হয়তো টের পায়। কুকুরদের এই কান্না আলাদা কান্না এই কান্না বৃক্ষ হত্যার শোকে সম্মিলিত প্রাণের কোরাস। তাদেরও হয়তো ইচ্ছে করে আকাশের দিকে তাকিয়ে সুরে সুর মিলিয়ে ব্যথা জানাতে। কিন্তু সিস্টেম এটাকে সমর্থন করে না। ফলে বৃক্ষ হত্যার দায় কাঁধে নিয়ে যারা নিশ্চিন্তে ঘুমায়, তাদের হৃদয় আজ ঢালাই করা কংক্রিটে আবৃত, তাদের কাছে বিরোধী শক্তিকে দমনের প্রতিষেধক আছে বলেই তারা নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারে। কেবল বৃক্ষহীন প্রন্তরে বৃক্ষশোকে অসহায় কুকুরদের মিলিত কান্না হাহাকার করে।