অনুপল (পঞ্চম প্রবাহ) । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:৫১ অপরাহ্ণ, | ১৫৫৯ বার পঠিত
অনুপল—১৯৯ : অপরিচ্ছন্ন
বৃষ্টিতে ধুয়েমুছে সাফ রাস্তার আবর্জনা
হৃদয়ে হাহাকার নিজেকে অপরিচ্ছন্ন ভেবে।
অনুপল—২০০ : নির্বিশঙ্ক
রাবার বাগানে পাতা ঝরছে ঝরুক:
আমরা বরং এটা দেখি—
শিকারির এয়ারগান তাক করেছে সঠিক নিশানা,
দিকচক্রবালে তবু আশ্চর্য মালা হয়ে উড়ছে
অযুত নির্বিশঙ্ক মরাল।
অনুপল—২০১ : মাছি
দূর হও চোখের সামনে থেকে—
যার উদ্দেশে কথাটি বলা সে এক নাছোড়বান্দা মাছি,
মৃত্যুভয়হীন হাজার চোখ দিয়ে আমাকে গিলে খাচ্ছে।
মাছির চোখ করে এতক্ষণ আমায় দেখছিল
এখন ভনভন শব্দে মাথার চারপাশে উড়ছে।
অনুপল—২০২ : বাঁচা—মরা
যে লোক মরতে—মরতে বেঁচে গেছে তাকে অভিনন্দন।
বাঁচতে—বাঁচতে যে মারা যাচ্ছে অভিনন্দন তার প্রাপ্য।
বাঁচা—মরার বাইরে যে চলে গেছে সে বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছে
তার জন্য কোনো অভিনন্দন যথেষ্ট নয় এখন।
অনুপল—২০৩ : ঘর
ঘরটি খালি, এর মানে এই নয়
এটা কোনোদিন ভরা ছিল না।
পাশের ঘরটি ভরা দেখে কেন ভাবছ
ওটা কখনও খালি হবে না।
অনুপল—২০৪ : সিমুলাক্রাম—১ : আয়না
আয়নায় নিজেকে দেখে ক্লান্ত
আয়না ক্লান্ত আমায় দেখে।
অনুপল—২০৫ : সিমুলাক্রাম—২ : ছবি
তুমি নেই, তাতে কিছু যায়—আসে না
যতক্ষণ ছবি হয়ে ঝুলছ দেয়ালে।
অনুপল—২০৬ : সিমুলাক্রাম—৩ : মুখোশ
চলো মুখোশ বদল করি—
তুমি আমারটা নাও, আর আমি
ঝটপট তোমারটা পরে ফেলি।
কেন মিছেমিছি ভয় পাচ্ছ বলো?
বিপত্তির কিছু নেই এখানে,
দুজনে যেহেতু মুখোশে ঢাকা আছি!
অনুপল—২০৭ : প্রণয়
সর্ষে ফুলের মধু চুষে নিচ্ছে ক্ষুদে মৌমাছি,
নিজের ব্যগ্র বোঁটা সদর্পে উঁচিয়ে ধরেছে সর্ষেফুল
ওর মধুপানে সুবিধা করে দিতে।
দূরে বসে যে ওদের দেখছে তার চোখে জল
সর্ষেফুল ও প্রজাপতির হিংসাজাগানিয়া প্রণয়ে।
অনুপল—২০৮ : আঙুরলতা
ইচ্ছে ছিল আঙুরলতা হয়ে জন্ম নেব
মাটির গভীরে শিকড় ছেড়ে দিয়ে
সিনা টান করে দাঁড়িয়ে থাকব মাটিতে।
আঙুরলতা হয়ে জন্ম নিয়েছি বটে—
কটু ফলের ভারে সারাক্ষণ ঝুঁকে থাকি মাটিতে।
অনুপল—২০৯ : শ্লীলতা
শ্লীল বলে কিছু হয় না জীবনে
মধুর প্রণয় অশ্লীল মনে হয়
প্রণয়ে নিহিত উদ্দেশ্যের কথা ভেবে।
অনুপল—২১০ : মিথ্যা
চলো ছাদে বসে কিছু মিথ্যা স্বপ্নের জাল বুনি
মাথার ওপর ক্লিশে চাঁদ অক্লেশে নিভে যাক আকাশে
আমরা দুজন অক্লেশে নিভে যাই মিথ্যার জাল বুনে।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা বাস স্টেশনে:
চোখে রোদচশমা, লাজুক হেসে বললেন
কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছেন।
গোলাপের আসল রঙ তিনি জেনে গেছেন,
আর…মানুষ চিনতে তাঁর এখন ভুল হয় না।
অনুপল—২১১ : দৃশ্যান্তর
আজ আর মনে নেই কত লক্ষবার দেখেছি
আমাদের জরাজীর্ণ বাড়ির ছাদে তুমি দাঁড়িয়ে—
শীতের মখমল রোদ গায়ে মেখে ভেজা চুল শুকাচ্ছ।
দৃশ্যটি পরিচিত হতে-হতে অপিরিচিত হয়ে গেল,
যেদিন তুমি ছাদ থেকে ব্যালকনিতে সরে গেলে
ওটা তোমার জন্য বিপজ্জনক এই অজুহাতে।
সেদিন থেকে এই দৃশ্যটি আর মনে পড়ছে না
—কোনো একদিন তুমি কেশবতি ছিলে
ছাদে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল উড়িয়ে দিয়েছ হাওয়ায়।
একভার ভাব, কত সহজে আমরা মরে যাই!
ভেজা চুলের তুমি আর নেই, ভাঙা ছাদ,
ওটা এখন বিলীন স্মৃতির কিনারায়।
আমি শুধু মনে করার চেষ্টা করি,
কত লক্ষবার তোমাকে দেখেছি
ভঙ্গুর ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়েছ ভেজা চুলে।
একবার ভাব কত সহজ শীতের মখমল রোদ
তোমার চুলের গোছায় লুটোপুটি খাচ্ছে।
আর, ওদিকে তুমি মনে করতে চাইছ—
কবে কখন তোমাকে আমি, হয়ত রসিকতার ছলে
ছাদ থেকে ফেলে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলাম!
অনুপল—২১২ : ভুল—৬
কিছু ভুল শুধরানো যায় না—
মাকড়শার জালে পোকা নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে
শতবার চাইরেও এই ভুল শোধরানো যাবে না।
অনুপল—২১৩ : মানুষ ও ল্যাম্পপোস্ট
ল্যাম্পপোস্টকে মানুষ ভেবে জড়িয়ে ধরেছে মাতাল
ওর হেড়ে গলার কান্না ভাসছে ইথারে।
ইচ্ছে করছে ওর মতো কাউকে জড়িয়ে ধরি—
মানুষকে ল্যাম্পপোস্ট ভেবে হেড়ে গলায় কাঁদি কিছুক্ষণ।
আমার কান্নায় নাহয় খানিক বিরক্তই হবে
রাতের আলোক-উজ্জ্বল নিরীহ ল্যাম্পপোস্ট!
অনুপল—২১৪ : বিকল্পহীনতা
সমস্যাটি বিকল্পের নয়, বিকল্পহীনতার—
জানালার গ্রিলে বসে যে চড়ুই পুচ্ছ নাচায়,
বহুদিন হয় তাকে দেখি না!
হয়ত জায়গা বদল করেছে, হতে পারে
চিরতরে উড়াল দিয়েছে নিরুদ্দেশে।
জানালায় সজাগ রয়েছি বিকল্পের আশায়—
সে না আসুক, তার জায়গা নেবে নতুন চড়ুই।
আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছে—
জানালার গ্রিল আজ বহুদিন চড়ুইবিহীন।
অনুপল—২১৫ : কবর
সে বুঝতে পারছে ওরা তাকে শুইয়ে দিয়েছে
বাতিল খামের মতো রেখে যাচ্ছে জননীরব শহরে।
অনুপল—২১৬ : স্থানান্তর—২ : ছাইদানি
নীরবে জায়গা বদল হল দুজনের,
শখের ফুলদানি ভেঙেছে মুহূর্তের অসাবধানে
তুমি রাগ করে মলিন ছাইদানি সেখানে বসিয়েছ
দেখতে অবশ্য মন্দ লাগছে না।
অনুপল—২১৭ : স্থানান্তর—৩ : পোকা
জনকের কবর সবুজ ঘাসে ছেয়ে গেল
নাদুসনুদুস পোকাটি দেখলাম
ঘাসের শিকড় উপড়ে ভিতরে ঢুকছে
আরও সুস্বাদু কিছু পাওয়ার লোভে।
অনুপল—২১৮ : কামড়
এইবার ঠিক কামড়ে দেব—
স্থিরপ্রতিজ্ঞ ঘেয়ো কুকর টহল দিচ্ছে রাস্তায়।
আমি শঙ্কিত—
কখন ও লেজ গুটিয়ে ঢুকে পড়ে ডেরায়!
অনুপল—২১৯ : রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা বাস স্টেশনে:
চোখে রোদচশমা, লাজুক হেসে বললেন
কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছেন।
গোলাপের আসল রঙ তিনি জেনে গেছেন,
আর…মানুষ চিনতে তাঁর এখন ভুল হয় না।
অনুপল—২২০ : উষ্ণতা
মশাগুলোকে দেখে বড্ডো মায়া হচ্ছে
উষ্ণতার লোভে ওরা ঘরে ঢুকেছিল।
বাইরে শীতের হাওয়া বইছে জোরে
মিহিদানা কুয়াশা রক্তের ফোঁটা
ঘরের ছাদ চুঁইয়ে টপটপ ঝরছে।
হিমে জবুথবু মশারা এখন বন্য হয়েছে
ওদের শীতবিকল ডানায় রক্তের গন্ধ।
ওদিকে আমি শীত-বিশীর্ণ ত্বকে গুটিশুটি,
উষ্ণতা টের পাচ্ছি মশাদের হুল ফোটানোর গুঞ্জনে।
ফিরে ফিরে সে এক রঙবাহার—
লাউফুলে বসা ভ্রমর তিরতির কাঁপছে
টকটকে লাল পলাশবন কেঁদে খুন
কোকিলকালো ফাগুনে।
অনুপল—২২১ : আত্মজ্ঞান
বেচারা সক্রেটিস!
নিজেকে জানার লোভ ছিল ওর।
এই নেশা ওকে খেল।
ওকে করুণা করা প্রয়োজন—
আত্মজ্ঞানের ভাঙা রেকর্ড বাজানোর অপরাধে।
সক্রেটিসকে পেলে হয়ত বলতাম—
আরে ইয়ার, কেন মিছেমিছি বাকতাল্লা মারছ বল তো,
ছেলেগুলার মাথা খাচ্ছ দিনরাত…! ওটা নেই জগতে!
নিজেকে জানা এবং না জানা দুটোই সমানকথা—
‘চালিয়ে যাচ্ছ’ এইটে হল আসল ব্যাপার।
সুতরাং, ওর হেমলক পানে যারা দুঃখিত তাদের বলছি—
শোক ঝেড়ে ফেলে চলুন কিছু মদ্যপান করা যাক,
মদ্যপানের পর আমরা না হয় গোল্লাছুট খেলব কিছুক্ষণ।
আত্মজ্ঞান নামে যদি কেউ থাকেন উনি উদয় হবেন সেখানে।
মনে রাখবেন, মহানভে সারাক্ষণ ওটাই চলছে
সেখানে কেউ আপনাকে মাপার জন্য বসে নেই।
অনুপল—২২২ : সর্ষে ক্ষেত
ভালো লাগছে…
হলুদ সর্ষে ক্ষেতে শুয়ে আছি
মাথার ওপর মক্ষিকারা উড়ছে—
মন আচ্ছন্ন হলুদ মৃত্যুর গুঞ্জনে।
অনুপল—২২৩ : মদ্যপ
ন্যাড়া ধানখেতে বসেছে মদ্যপ—
চুমুকে পান করে রিক্ত মৌমাছির গুঞ্জন
শীতের হিম হাওয়া কেঁদে ফিরে ধানখেতে।
অনুপল—২২৪ : নগ্নতা—১
নগ্নতা ভাষাহীন মৃত্যুর দুহিতা।
অনুপল—২২৫ : নগ্নতা—২
সাদা কাগজ ও নগ্নতা অভিন্ন
যতক্ষণ না কেউ আাঁচড় কাটছে,
সেলাইকল ঘুরছে ওকে মুড়ে দিতে।
অনুপল—২২৬ : নগ্নতা—৩
তুমি হয়ত বাঁচতে চেয়েছ, তাই আচ্ছাদন;
রোদে ত্বক পুড়ে যাচ্ছে, ঠাণ্ডায় জমে গিয়েছিলে,
বৃষ্টি অকাতরে ঢুকে পড়ছে ত্বকের ছি্দ্র গলে—
এসব হচ্ছে প্রয়োজন, টিকে থাকার চেষ্টা ক’টা দিন।
নগ্নতার এতে কিছু যায় আসে না, তাকে নির্বিকার দেখি
আচ্ছাদন ও টিকে থাকার ব্যাপারে।
অনুপল—২২৭ : নগ্নতা—৪
তুমি সুদেহী কিংবা পেলব নও
রুক্ষ বা কুশ্রী বলার উপায় নেই
তুমি হয়ত বিশেষণহীন,—তাই নগ্ন।
অনুপল—২২৮ : নগ্নতা—৫
জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানে দূরত্বটা আড়াল,
ওটা আচ্ছাদন, ওটা হচ্ছে জীবন।
আচ্ছাদন উঠে গেলে দূরত্ব ঘুচে যায়,
ওটা নগ্নতা,—জীবনের অন্তিম সীমানা।
অনুপল—২২৯ : নগ্নতা—৬
মৃত্যুর চেয়ে ভারী যে নগ্নতা
তার উত্তাপে তুমি পুড়ে যাচ্ছ।
দূরে দারুচিনিবন নীরবে শিহরে,
নাগরিক স্নানাগারে বিভোর তুমি—
নিজেকে নগ্ন দেখার আপন খেয়ালে।
অনুপল—২৩০ : স্থান ও সময়
ছাইদানি ভেঙে গেছে বলে দুঃখিত কেন হে ধূমপায়ী?
নিজেকে শান্ত রাখো লাইবনিজ বচনে—
স্থান ও সময় বলে কিছু হয় না জগতে
বস্তুর আবির্ভাবে মেলে স্থানের পরিচয়
বস্তুর বিন্যাসে ঘটে কালের উদয়
স্থান ও সময় বিলীন এভাবে ছাইদানির বিয়োগে।
তুচ্ছ ছাইদানির পতনে শোকার্ত কেন হে ধূমপায়ী?
ওকে যেতে দাও ওর নিজস্ব নিয়মে—
স্থান ও সময় নিয়মের অনুগামী,
তুচ্ছ ছাইদানির ভবিতব্যে বাঁধা দুজনের স্থিতি।
নিজেকে সুস্থির রাখো প্রবচনে—
কালের বিলোপ ঘটে ছাইদানির বিলোপে!
তুমি দাঁড়িয়ে যথারীতি শূন্যস্থানে—
স্থান ও সময় বিলীন ভগ্ন ছাইদানির বিয়োগে।
অনুপল—২৩১ : আত্মহত্যা
জানতে চেও না, তন্দ্রা থেকে মুকুলিত ফুল
কেন ঝরে পড়ে বিষাদ পূর্ণ হওয়ার আগে।
অনুপল—২৩২ : বসন্ত—১
ফিরে ফিরে সে এক রঙবাহার—
লাউফুলে বসা ভ্রমর তিরতির কাঁপছে
টকটকে লাল পলাশবন কেঁদে খুন
কোকিলকালো ফাগুনে।
অনুপল—২৩৩ : বসন্ত—২
রাস্তায় অজস্র হলুদ মানুষের ঢল দেখে এসেছি—
বিকেলের পড়ন্ত রোদ ওদের মুখে এসে পড়ছিল।
উঠানের হলুদ গাঁদাফুল যদিও পাংশু হতে চলেছে
বুকে মোচড় টের পাই হলুদাভ মুখগুলো ভেবে।
অনুপল—২৩৪ : বসন্ত—৩
পাণ্ডুতমাসু, তোমায় দেখে বুক ধক্ করে উঠছে। বিবর্ণ গাঁদাফুলের গাছে পানি ঢালছ, ওকে বাঁচিয়ে তোলার আশায়। ও মরে গেলে তুমি হয়ত দুঃখ পাবে। ওর আলোকিত হলুদে নিজেকে হলুদ ভাবার সুখে ঘটাতি হবে খানিক।
কী যায় আসে বলো গাঁদাফুল শুকিয়ে ঝরে গেলে? কিছু কি সত্যি যায় আসে গাঁদাফুলের, -যখন তুমি ফুসফুসে হলুদ সুখ টানতে না পারার দুঃখে পাংশুমুখ ঝরে যাবে ক্ষণিক পরে?
অনুপল—২৩৫ : বসন্ত—৪
বসন্তের কথা আর বলো না। কৃষ্ণচূড়ায় লালে লাল শহরে কালো উর্দি উকিলবাবু আদালতে যাবেন বলে বেরিয়েছেন। জ্যামে আটকা পড়ে রঙবাহার ফুলের মাস্তানি সইছেন বেচারা মুখ করে। পক্ককেশ উকিলবাবুকে বেশ লাগছে দেখে,—টিনএজ টিনএজ ভাব হচ্ছে মনে।
ওদিকে কোকিলবাবু ত্রিভঙ্গ মুরারি কৃষ্ণচূড়ার ডালে বসে বীর বাহাদুর সেজেছেন। ট্রাফিকের বাঁশির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সিটি মেরেই যাচ্ছেন। ভালো লাগছে ওর রংবাজি দেখে।
বসন্তের কথা কী আর বলব! খোঁপায় ফুল গুঁজে রমণী ও নওল কিশোরী সারবেঁধে ছুটছেন। যুবা ও নওল কিশোর যুগপৎ আনচান বসন্ত হিল্লোলে। মন্দ লাগছে না ওদের দেখে; —প্রেমভাব জাগছে মনে বসন্তবায়ুর প্রকোপে।
ভীষণ হট্টগোল হচ্ছে চারিধারে। রাস্তায় খোঁড়াখুড়ি চলছে। গাইতি-কোদাল সমানে শব্দ তুলছে কনক্রিটে। বুলডজার উপড়ে নিয়েছে অবৈধ বসতি। ঠাসঠুস শব্দে উন্নয়ন চলছে। কুঠার দাঁত বসিয়েছে কৃষ্ণচূড়ার ডালে। উদাস মুখ করে সিটি মেরেই যাচ্ছে ত্রিভঙ্গ মুরারি কোকিল।
বসন্তর কথা কত বলব! মাঞ্জা মেরে কবি সোজা উঠে পড়েছেন মঞ্চে। কবিতার এটোকাঁটা খৈ হয়ে আকাশে উড়ছে। কবিকে দেখে লাগছে বেশ, ছোকরা-ছোকরা ভাব হচ্ছে, দেদার ঝাড়ছেন কবিতা বাসন্তী ললনা সম্মুখে; —ওর বাতকর্মের মুদ্রাদোষ উধাও বসন্ত—বিলাসে।
কোকিলবাবু যথাপূর্বক সিটি মারছেন কুঠারবিদ্ধ কৃষ্ণচূড়ার ডালে। রেশমদানা ধূলি উড়ছে শহরে। কপোত-কপোতি পুলকিত ধূলিধসূর ফাগুনের আবির্ভাবে। খুব গান হচ্ছে চারিদিকে। গানের কথারা খেইহীন ছুটকো মাস্তান, দুদ্দাড় ঢুকে পড়েছে বসন্তে চপল রমণীর অন্তর্বাসে, সমানে হানা দিচ্ছে যানজটে, অকাতরে নিজেকে পৌঁছে দিচ্ছে বেচারামুখ উকিলবাবুর শ্রবণে।
বসন্তের কথা কত আর বলি! সব কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তালগোল পাকিয়ে খেই হারাচ্ছি অসীমে। গণ্ডগোল গণ্ডগোল লাগছে সবকিছু,—উকিল, কোকিল, কবি ও গায়কে মালামাল লালে লাল তালগোল পাকানো ফাগুনের প্রথম প্রহরে।
অনুপল—২৩৬ : প্লাবন
বইয়ের পাতা উলটাতে ইচ্ছে করে না—
নিজেকে বাচাল আহাম্মক মনে হয়
আদুর গায়ে খোলা মাঠে বসে থাকা ভালো মনে হয়।
আকাশ থেকে তেড়েফুঁড়ে নেমে আসছে চিল
দূরে চিমনিতে আহাম্মক ধোঁয়া পাক খায় আকাশে
যাত্রীবোঝাই ট্রেন ভেপু বাজিয়ে সুদূরে মিলায়—
বোকাসোকা মুখ করে মানুষের সাজানো সংসার,
ওটা দেখতে ভালো লাগছে এখন।
গায়ে কাপড় রাখতে ইচ্ছে করে না—
ন্যাংটা পাগল হয়ে বেরিয়ে পড়েছি রাস্তায়।
ছুটতে-ছুটতে অগত্যা পৌঁছে গেছি খোলা মাঠে
আদুর গায়ে পাগল পাগল ভালো লাগছে এখন
চরাচর জুড়ে বৃষ্টি-প্লাবন নেমে আসছে জানি
তার অপেক্ষায় বসে আছি ন্যাংটো আদম।