পাণ্ডুলিপি থেকে । সেঁজুতি বড়ুয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ৯:১০ পূর্বাহ্ণ, | ১৫৪৮ বার পঠিত
—সেঁজুতি বড়ুয়া অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৯ এ প্রকাশিত হয়েছে সেঁজুতি বড়ুয়ার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ শঙ্খচূড় ঘ্রাণ। প্রচ্ছদ শিল্পী রাজীব দত্ত, প্রকাশক চৈতন্য। ৬৪ পৃষ্ঠার বইটির দাম ১২০ টাকা।
মাদলের এপিটাফ
কৃষ্ণচূড়ার আশ্চর্য বিষধর লালে
মশালের ধিকিধিকি হিংস্রফলাতে
সেজেছে বনদেবী, আদিবাসী গ্রাম
মা, জানো তো এমন ঘুমহীন চোখে
দাঁতালো আক্রোশে মাদলের পিঠে
হাতুড়ির ঘায়ে পেটাতে পেটাতে…
ভয়গুলো সব কোথায় উবে গেছে!
ক্ষেপাটে মানুষ জেনে গেছে আজ
কার কাটা ক্ষতে, কতটা মলম
এককাতারে জোনাকি শরীরে
নারী-পুুরুষেরা পাহারা দিচ্ছে
মানুষ না যেন, নেকড়ের দল
গজরাচ্ছে, ফুঁসে উঠছে…
মাদল বাজছে, দ্রিমিদ্রিমি ঢাক বাজছে
মাটির চাঙড়ে রক্তবীজ থেকে লাশ উঠছে
চোখ তোলা মণি মৃতদেহটা- সুরেন টপ্য
কুয়াশা কাতর ছিল বড়ো সে
মাঘেও কাঁপতো না কালো শরীরে
ওহ ফুলমণি! কাহালু পাড়ার কিশোরী মেয়েটা
শিশুদের সাথে বেলা—অবেলায় খেলে বেড়াতো
সেও একদিন রূপকথা হয়ে কোথায় হারালো
অতল গহ্বর থেকে উঠে এলো তার নগ্ন শরীর
জন্মাবধি অনিশ্চয়তায় দেশ ছেড়েছে
এই অনুভবে অপ্রকৃতস্থ শত শত মুখ
হাড়ের প্রলেপে ঘৃণার আগুন ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয়!
ভয় উবে গেছে, গ্লানি মুছে গেছে
আজ যেন শুধু প্রতিশোধ দিন
মা চেয়ে দেখো, আদিবাসী গ্রামে
চেতনার রঙে অবেলার দ্রোহ…
মাদল বাজছে, দ্রিমিদ্রিমি ঢাক বাজছে
এককাতারে জোনাকি শরীরে
নারী-পুুরুষেরা সশস্ত্র পাহারা দিচ্ছে
দূরে, নির্জনে বসে ধুরন্ধর তক্ষক কাকে প্রেমাকুল ডাকে
আর কুয়াশায় চাদর জড়িয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে যায়, বাবা
বিছানায় শীতের প্রকোপে কাঁপে- তিনটে ঘুমন্ত ভা্ইবোন
তখনো মায়ের লাল তিলে রাতের বাসী চুমুর অবিমিশ্র দাগ
তুমুল সমর্পণে ধুয়ে যায় সমস্ত পাপপূণ্য, সম্পর্কের রাগবেহাগ
রতিক্লান্তিতে অতৃপ্ত ছায়াটা বারবরই এভাবে নিরুদ্দেশ …
শঙ্খচূড় ঘ্রাণ
বনস্থলে পুড়ছে কাঁচামাংস, খেয়ে যাও কাঠঠোকরার দল
নিশ্চিন্তে ছালচামড়া ছাড়াও, ওহে কাক চিল শকুনের শব
দেহটা খুবলে নিয়ে খাও, হায়েনা মাংসখেকো শেয়াল
তুলে নাও মগজ এবং চোখ, হিংস্র মাতাল কাপালিক
শাড়িটা শুকাতে দিও রোদে, প্র্র্র্রাক্তণ হিংস্র হত্যাকারী
সে ছিল, হৃদয় ছিল তার
কালো চোখ, শঙ্খচূড় ঘ্রাণ
সে জীবন এমনি বয়ে গেছে
প্রজাপতি শীতল জামা গায়!
আলোদের, রোদের গন্ধ শুঁকে
বেড়াতো— বালিকা শৈশবে
কপালের টিপের সমান মন
ছটফট করে শিকারীর জালে
আহা, জাল তারও ধর্ম আছে
অবিরাম শিথিল করে সুতা
সে সুতায় বন্দী অরুন্ধতী
জর্জরিত ভালোবাসার টানে!
সাগরে ভাসছে কাটা মাথা, কাকে কী বলবে পানকৌড়ি?
ঝাউবনে বালিতে লুকানো আঙুল, কাকে হায় দোষ দেবে রাজহাঁস?
কুকুরের মুখে নরোম চিবুক, হাতকড়া কাকে পরাবে শালিক?
—ভালোবেসে আজ সে মৃত, কোনো দোষ না করেও ক্ষত-বিক্ষত!
এ গল্প সবার জন্যে নয়
কারো জন্যে তেজী ঘোড়সওয়ার হতে পারোনি বলে
অভিমানে ঝাঁপিয়ে পড়তে তুমি ছুটে গিয়েছিলে ছাদে
দেখলে, চাঁদের প্রগলভতায় অজস্র সাহসী জোনাকি
ডানার ব্যস্ততায় স্মরণযোগ্য করে রাখছে রাতটাকে
সেখানে আলোর অন্তঃপুরে তৃপ্ত না হয়ে ফিরছে না কেউ
জোনাকিশাস্ত্রে প্রেম বলে কিছু নেই, আলোই বিশুদ্ধ কাম
সেই অফুরান রোশনাইয়ে তুমি ভিজলে কী ভিজলে না
বন্ধুত্বের অভিষেকে শিখে গেলে উদ্দাম উপভোগ্য কাম
এখন তোমার কাছে নারীসঙ্গ মানেই উত্তেজক শরীর
অসামান্য ক্রোধে পিষে ফেলতে উদ্যত তোমার আঙুল
তোমার উলুঝুলু তাকানোতে অসহায়বোধ করেন মা
সাবেক প্রেমিকা, উপহাসে একদিন কস্তুরীর কথা বললে
আত্মবিশ্বাসী হাসি টেনে বলো, রাতে উদ্যানে দেখা হয়
কথায় কথায় নড়াইলের মেধাবী শ্রীপর্ণার কথা শুধালে
হাসি চেপে বলো, হলের মেয়েরা ভালো? সব দেহপসারিনী
বেচারি ভাবে, অনায়াসে ছুঁতে পারা মানুষটার একি দুর্দশা
সেই দুর্দশা স্থিত হয়, চপল মুদ্রারত নৃত্যময় শীতল মৃত্যুতে
তখন ধারালো বৃষ্টিতে গুপ্তপাহাড় থেকে নামে তেজী ঘোড়া
অবিকল তোমার চেহারায় অভিমানী ঘোড়সওয়ারী তাতে
গুপ্ত বাসনায় যাকে ঘিরে রেখেছে একঝাঁক অতৃপ্ত জোনাকি!
নিরীহ লোকটা
লোকটাকে ‘ভালোমানুষ’ বলে ছেড়ে দিও না
নরোম মাটিতে ওর মতোই দু’পেয়ে শ্বাপদ
‘নিরীহ, নিরীহ’ মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রকাশ্যে!
ওর চেহারার অসহায়ত্বে একেবারে গলে যেও না
কেননা ধূর্ত চোখে অনিবার্য ধ্বংস-ছায়া এঁকে
সংসারের সবাইকে সে পেঁচিয়ে নিচ্ছে সুতায়
ভরদুপুরে নিরীহ লোকটার কামার্ত হাতে
লাটাই এবং সুতায়…ভালোবাসার স্তুতিতে
ভূপাতিত, তলিয়ে যাচ্ছে দোদুল্যমান কিশোরী
লোকটাকে ‘সরল-বোকা’ বলে স্বস্তি পেয়ো না
ওর মতো দুঃশ্চরিত্র, দু’পেয়ে দাঁতাল শুয়োর
‘খুনি, খুনি’ চোখে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে সমাজ!
জার্নি
অজস্র, অজস্র ধুলার ধাওয়া খেতে খেতে
তার আগন্তুক শরীরে জমে, অমাবশ্যার প্রলেপ
এমন নিঃসঙ্গ আস্তরণ— না কঠিন, না কোমল
জানে, যাত্রীজীবনে এরকমই ওঠা-নামা থাকে
পিঠে বয়ে চলে সেই পিছুটান, নৈঃশব্দের বালি
সহযাত্রীরা কেউ চুপচাপ, কেউ সুখকর বিশ্রামে
সে চিন্তায় আড়ষ্ট থাকে, বাসের বেপরোয়া ঘর্ষণে
আসলে নিজেই জানে না সে, কোথাকার বাসিন্দা
তার মতো মানুষেরা কোন্ গ্রামে জড়ো হয়ে থাকে?
ঘর নেই বলে বাসে চেপে সেই বৈকুণ্ঠপুরে সেও পালায়
পথে, শঙ্খমুখী নদীটি ঝুঁকে অতিপ্রাকৃত পাতাল খোঁড়ে
অজস্র, অজস্র ধুলার ধাওয়া খেতে খেতে শেষহীন পথে
গাছগুলো এমন বিক্ষিপ্ত বাসের ধুলোসহ দুরত্বকে মাপে
পাখিরা সভয়ে বাসের রাস্তাটা ছেড়ে নিরাপদে দাঁড়ায়
আর সে বাসের ভাঙা আয়নায়, বৈকুণ্ঠপুর খোঁজে!
বেওয়ারিশ কবরনামা
দূরে, নির্জনে বসে ধুরন্ধর তক্ষক কাকে প্রেমাকুল ডাকে
আর কুয়াশায় চাদর জড়িয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে যায়, বাবা
বিছানায় শীতের প্রকোপে কাঁপে- তিনটে ঘুমন্ত ভা্ইবোন
তখনো মায়ের লাল তিলে রাতের বাসী চুমুর অবিমিশ্র দাগ
তুমুল সমর্পণে ধুয়ে যায় সমস্ত পাপপূণ্য, সম্পর্কের রাগবেহাগ
রতিক্লান্তিতে অতৃপ্ত ছায়াটা বারবরই এভাবে নিরুদ্দেশ হয়
নক্ষত্রপতন বাড়ে! আর উন্মাদ গান্ধী পোকারা বাবার শার্টে
কে যেন কণ্ঠিবদল নিয়ে খুব ইনিয়ে বিনিয়ে রাধা-রমন গায়
জঙ্গলে সে গান শুনতে বাবা যেন নিজেই বনময়ূর! ঘোরগ্রস্ত নাচে
দেবতাকে ঘিরে বনশীর্ষে তখন শ্রীতমা, রাধিকারা উৎকট সাজে
আঁশ মিটলে সুড়ঙ্গ একদিন কাছে টেনে মুখে গুঁজে দেয় মৃতঘাস
সেই মৃতঘাস আজও সতেজ হয়নি— লাশের বেওয়ারিশ কবরে
সেখানে বিষন্ন মা ঘুঘুকে দেখে ছেলে বলে, এ আমাদের বাবা নয়!