পাণ্ডুলিপি থেকে । সেঁজুতি বড়ুয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:২৩ পূর্বাহ্ণ, | ১৭৭০ বার পঠিত
কবি সেঁজুতি বড়ুয়া’র কবিতার বই হৃৎ বের হয়েছে ২০১৮ সালের একুশে বই মেলায়। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী রাজীব দত্ত এবং প্রকাশ হয়েছে চৈতন্য প্রকাশনী থেকে। বইটি একুশে বইমেলায় পাওয়া যাবে। বইয়ের মূল্য রাখা হয়েছে ১৫০ টাকা
স্বপ্নমৈথুন
এভাবে, একদিন…স্বপ্নের মৈথুন
নরোম পালক, মহুয়ানৃত্য, গভীর রাত্রি খুন
বাড়ি ফেরা আর হয়নি ও বেলা
আজ ছুটি। তাই ছোটাছুটি ম্যালা!
ওহ্ ! ঘুম জাগানিয়া নিঃসাড় সখি,
নতুন আলোয় প্রভাতের রাঙা পাখি-
‘চুমুকে অধর তৃপ্ত হয়েছে,
. তৃপ্ত হয়েছে আঁখি!’
নীলকন্ঠ নীলাভায় আমি ডানাওয়ালা ইকারুস হয়ে যাই
অপেক্ষার ডুরেরঙ বাতিগুলো নিরুদ্দেশ যাত্রায় এবার আমার সঙ্গী হয়ে থাকুক, থাকুক…
সমস্ত সুখের দিন, নাগরিক উৎসবগুলো, উৎসবমুখর সমস্ত প্রাণবন্ত হাসিমুখ
তুখোড় উচ্ছ্বাসগুলো, এই প্লাবনধারা, স্ফূর্তিবাজ লোকে লোকারণ্য ভিড়
পৃথিবীর উপচে পড়া সমস্ত রূপ-রস-গন্ধ, এইসব রোদে গলা রাস্তাগুলো
সমস্ত কিছুই নাহয় আমার সঙ্গী হয়ে ম্লানমুখী, নতজানু হয়ে
তারাদের মিছিলে মিছিলে চাঁদনী পশরে চলুক, চলুক…
বসন্ত আসার আগেই বসন্তের ধুলো ওড়া উদ্দাম চনমনে রোদ ধরা দিক, দিক…
নিদ্রালু দেবদূত মেঘ দয়া পরবশ হয়ে আপসে কাছাকাছি আসুক, আসুক…
নাহয় আমিই সেই প্রচলিত সত্যটুকু সামান্য ভরসা ভেবে সবিনয়ে কিছু মায়া অবয়ব
দীর্ঘ দীর্ঘ বিরান পথ বৈদেহী আঁচলে বেঁধে এই কাল, দ্রৌপদী মহাকাল একাই পেরুবো!
বিস্তৃত ঢেউয়ে নিমগ্ন হবো সমুদ্রোপকূলীয় কোন নিভৃত পাহাড় খোঁড়লে
যেখানে প্রোথিত আছে শিশির জড়ানো মেঘ, বিষাদের রঙে আঁকা কোটি কোটি ময়ুর পালক…
আহা, উড়িবার সাধে দগ্ধ-বিদগ্ধ হয়ে আমি শুধু লেলিহান সূর্যের কাছে যাই
আহা, আমিও যন্ত্রণাকাতর খুব! নীলকন্ঠ নীলাভায় আমি ডানাওয়ালা ইকারুস হয়ে যাই!
পৃথিবী কাব্য
পৃথিবী তাহলে রাতের বেলা পৃথিবীতে নামে!
ঝোপঝাড় ভেঙে নামে, নামে অথবা বাতাসে চেনা
পথঘাট চিনে নিতে অসুবিধা হয় বলে উঁচু শিং
কালো মোষ নড়নচড়নে সাড়া দিতে ছোটে পথে
সে কী এক অনুভবে, মন্ত্রবলে, পৃথিবীর টানে…
সে টান কি ঘর দ্যাখে? দ্যাখে ছায়া চুপচাপ?
অথচ মাটির নিচে সুনসান ঝুরঝুরে এমন পাথুরে বুকে
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টান…লোকে যাকে বলে মায়া, সহজিয়া
মেলামেশা? কত নদী, চরাচর, উপবন, উঁচু ডাঙা,
নদীবাঁধ, জলঘর, হাওড়-বাঁওড়ভূমি, ফসলের ক্ষেত!
পৃথিবীকাব্য ঘোরে…বীজসুধা মুখে নিয়ে সোজা বেঁকে চুরে!
তীরের ফলার মতো সে বাণে বিদ্ধ হয় ঘাড় আর পিঠ
সে বাণে বিদ্ধ হয়ে মূল নদী বহু দূ-রে সরে যায়
বহুদূরে জেগে ওঠে নতুন চারণভূমি…ফোঁটা ফোঁটা
জলকণা ঠোঁটে খুঁজে বহুকষ্টে যথাকালে দীঘি গড়ে তোলা!
পৃথিবী জাতিস্মর বুঝি? ভেড়ুয়া মাতাল দিন জলস্রোতে
ভেসে ভেসে হাতছানি ডাকে- এসো, দেখা করি আবাবিলে
পৃথিবী আটকে আছে শুধু পুরাতন স্মৃতি বুকে
উড়ে যাওয়া কিছু ছাই, পুড়ে যাওয়া কাঠ-কয়লা
থৈ থৈ কাদা-মাটি, আঁধারের অমানিশা নিয়ে…
আমেন
তিনি নাকি আদ্যোপান্ত সরল, যাহার ভেতর আঁধার
দেখেন তারেই টানে তোলেন। বুকের কাছে আসন
ফেলেন সহজ অবহেলায়!
ইমানুয়েল বলত লোকে। উনি বলেন, ‘আমেন!’
এক যে ছেলে বাপ-মা হারা অষ্টপ্রহর জ্বলে
আর কারো নয় মাথা ব্যথা, পাশ ফিরে সব চলে
তিনি এলেন নিঃশব্দে রাতপ্রহরী হয়ে
নিলেন টেনে বুকের ভেতর বলেন, ‘আমার বাবা!’
এক যে মেয়ে ভুললো পথের করুণ পরিণতি
ঘর হতে পা ফেলেই যেন সুড়ঙ্গমুখ খোঁজে
বহুকালের উল্কা হাওয়া উড়িয়ে নিলো ওকে
লোকে ভাবলে : এ কী রে উৎপাত!
তিনি ভাবলেন, আমিই পথিক এখন পথ দেখাই
আশ্রিতকুল ঘিরে সাধক স্বপ্ন দ্যাখে ভবে
একটি যদি থাকত ওদের অশোক শোভন আশ্রয়?
অনাথ অবুঝ সন্তানেরা থাকত তবে আলোয়
পাড়ায় তখন গল্প ধুন্ধুমার, কুপিত চোখে ফেটে
পড়ে দারুণ ঘৃণার স্রোতে : সন্ত, এবার নতুন কী হবে?
অবশেষে দিনটি হলো শেষ। গলিত দেহ পাওয়া গেল
সহস্র জখমে!
সবাই দ্যাখে তাপস হাসেন ঊর্ধ্বমুখ পানে-
‘সব সাধনা বিফলে কি সাধ্য যদি মেলে!’
বন্ধু হে
দাঁড়াও, ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়ানোর এই অকুণ্ঠ রেলিংয়ের পাশে!
রবিবাসরীয় সামান্য আলোতে দ্যাখো, বন্ধুত্বের তীর্যক সুধাটুকু
তোমারই দীঘল ছায়ায় ক্যামন মায়াময় শীতলতা ছড়াচ্ছে…
আর আমি জানালার শার্সিতে- ঝিরঝিরে বৃষ্টির চাপা রাগ, অভিমানে
কাকে যেন নিমিষেই ধুয়ে যেতে দেখি! সে জলের রেখা, অভিমান
আঙুলে জড়ালে একফোঁটা স্ফটিক ঘূর্ণিতে দেখি- দুই আবেগী মেঘের ফুল
ঝড়োবেগ, এমন দমকা বাতাসে – নিজেদের প্রাথমিক পরিচয়পর্ব সেরে
চুপিচুপি ভেসে যাচ্ছে রমনার অস্তাচলে, গোপন অভিসারে…
বন্ধু হে, এমন নিবিড় সম্পর্ক আর বিভাজিত সম্মোহনে
কচুরিপানার ফুল কবে নিজে ভিজেছিল রাতের অনিঃশেষ শিশিরে শিশিরে…
দাঁড়াও, তোমাকে দেখি, কতোদিন এমন মায়াবী আলোতে বৃষ্টির
ধুয়ে যাওয়া গোপন শার্সিতে তোমাকে দেখি না!
বৃষ্টি বিলাস
আসো বৃষ্টি আসো, আসো- আমাদের এ নরক নগরীতে
আসো কংক্রিটে, বেদনার ভারে, ময়লাস্তুপে, বধ্যভূমিতে
ঝড় হানো, হানো ত্রাস-সন্ত্রাসে
বজ্র হুঙ্কার, বিস্ফোরিত বানে…
লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ো না কখনো, রক্তঘ্রাণে ঝরো
নষ্ট সমাজে মিশে গিয়ে শুধু বৃষ্টিবর্শা ঢালো!
দ্যাখো না, কেমন খেলা ফেলে আজ ছায়াবাজি করি
উন্মত্ত হই অস্ত্রে?
লক্ষ্য যেখানে টেনে আনে সোজা, কাতর বিলাপে কাজ কি?
সূর্যসেনের এদেশে জন্ম
বিপ্লবী প্রাণ প্রীতিলতার
চেতনাজুড়ে নজরুল আছে
সমগ্রতায় রবীন্দ্রনাথ…
নারকীয় শোক-উত্তাপ দিন…বাড়ছে ক্রমে প্রাকৃতের ঋণ
স্নায়ুর ভিতরে মুদ্রিত পাঠে- ঘুম অসাড়তায় কেঁপে কেঁপে উঠি!
রাত ফুরালেই মাছরাঙা ভোর
দিন ফুরালে নিভে যায় জ্যোতি
কপালে তীব্র মৃত্যুকরুণা, মৃত্যুতিলক আঁকি…
নামো বৃষ্টি নামো, নামো- রক্তের নদী, মৃত স্রোতে নামো
আঁখিপল্লব, হাড়কঙ্করে জাগ্রত করো পুনর্জন্ম!
হে বৃষ্টি, হে ভরাপ্লাবন, প্ররোচনাময় রৌদ্র এলেও
বিষণ্ন জল, জলের ফোঁটায় শোকসন্তপ্ত সমাধি এঁকো…
হৃৎ
তুমি বসন্ত জেগে ওঠো
ঝুলবারান্দায়, অলিন্দে, লোনাওঠা ভূল দেয়ালে
যেখানে নকশীকাঁথা কাজ কাব্যের শরীরে খেলা করে
মাঘী পূর্ণিমা আজ
অরণ্য রাত্রির ছায়া ছুঁয়ে যায় চাঁদের মোমের শরীরে
দেবশিশু মন্ত্র পড়েনি এখনো
তোমার আগেই সাঁওতালী নাচ ঘুঙুর পরেছে পায়ে
কামজ কোকিল ডাকে নিরন্তন হারানো সাথীকে
ঋতুরাজ, তুমি কি এখনো বিনম্র অহঙ্কারে মাখামাখি
আছো? ক্লান্ত হতে হতে শরীরে জ্বলেছে অঙ্গার!
বিমুগ্ধ কবি আমি। এসব বুঝি না কিছু
জানি, কৃষকের গরু গেলে সেও যায়
. পুড়ে যেতে চিতার অনলে।