লোকগানের শেষ নবাব রামকানাই দাশ । সুমনকুমার দাশ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ, | ২৪৭১ বার পঠিত
সুমন তার গদ্যের শিরোনামেই বলেছেন লোকগানের শেষ নবাব আমাদের রামকানাই দাশ। আমরাও তার সাথে সমত্ব প্রকাশ করছি। জন্ম হয়েছে বিধায় স্থানও আছে, কিন্তু এই বরেণ্য শিল্পীর জন্মস্থান এখন আর কোনো একটা অঞ্চলের নাম বললে মনে হয় তাকেই ছোট করে ফেলতেছি, তাঁর জন্মস্থান দেশের মাটিতে এটাই সত্য। উনি সবার সব খানের। তাঁর ‘সুর’ যত দূরে গিয়ে শেষ হয়, যে শেষ বিন্ধুতে বিলীন হয় তাঁর কন্ঠ, সেখানেই তাঁর জন্ম। ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রামকানাই দাশ মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এই দিনটাকে মনে রেখে রাশপ্রিন্ট-এ পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা-জ্ঞাপন করছি।
এই যে হাওরাঞ্চল, এ এক অন্য জনপদ। দেশের অপরাপর অঞ্চলের সঙ্গে এখানকার সমাজ-সংস্কৃতি একেবারেই মেলে না। শুষ্ক মৌসুম আর বর্ষা – দুই ঋতুতে এখানে দুই দৃশ্য। শুষ্ক মৌসুমে যেখানটায় কৃষকেরা ফসল ফলান বর্ষায় সেখানেই মাথাসমান পানিতে একাকার। গ্রামের চারপাশে এত পানি, তবুও বাড়ির ছোট্ট বালকটির সেখানে ডুবে গিয়ে মৃত্যুর তেমন একটা আশঙ্কা থাকে না। কারণ জন্মের পর ওই অঞ্চলের শিশুকে শিখিয়ে দিতে হয় না কেমন করে সাঁতার কেটে মৃত্যুকে মোকাবেলা করতে হয়, যেমনটা শিখিয়ে দিতে হয় না গানচর্চার ক্ষেত্রেও। হাওরের শিশুটি যেমন জন্মের কয়েক বছর পর আপনাআপনিই শিখে যায় সাঁতার, একইভাবে শিখে ফেলে গানও। হাওরের মানুষের এভাবেই বেঁচেবর্তে থাকা। কেউ হয়তো নিজের প্রচেষ্টায় এলাকা ছাড়িয়ে দেশ কিংবা রাষ্ট্রসীমার গণ্ডি ছাড়িয়ে আরো বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে নন্দিত হোন। রামকানাই দাশ শেষোক্ত ধারারই একজন। তাঁরও বাড়ি হাওরাঞ্চলে, সেখানে মানুষের জীবনযাপন ও গানগাওয়া একসূত্রে গাঁথা।
রামকানাই দাশের জন্ম সুনামগঞ্জে, ১৫ এপ্রিল ১৯৩৫-এ। সুনামগঞ্জ মানেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিশাল-বিশাল হাওর। ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখানকার মানুষের বুক চিতিয়ে বেড়ে উঠতে হয়। সন্ধ্যার পর প্রতি রাতে এখানে বসে নানা ধরনের লোকগান ও লোকনাট্যের আসর। তাই কোটি মানুষের মতোই রামকানাই হাওরের সংস্কৃতি-গান-বিনোদন দেখে-দেখেই কৈশোর পেরিয়ে যুবক হয়েছেন। মাঝে-মধ্যে নিজেও শামিল হয়েছেন সেসব আসরে। আরো অনেকের মতো দারিদ্র্যের কারণে তাঁরও পড়াশোনা হয়নি, আবার অনেকের মতো তিনি ‘দেখা থেকে শেখা’ – এ পদ্ধতিতে একজন সুদক্ষ শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। আপন খেয়ালে গান গাইতেন। গাইতে-গাইতেই হয়ে উঠেছিলেন লোকগানের একজন জহুরি। সেই জহুরির আলো-জ্বলানো সময়ের অবসান ঘটল ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। তাঁর সৃষ্টিই এখন কেবল তাঁর পরিচয়, তাঁর কণ্ঠই এখন কেবল তাঁর পরিচয়।
রামকানাই দাশ ছিলেন লোকগানের অগ্রগণ্য সাধকদের একজন। তিনি বেড়ে ওঠেছেন গ্রামে, তাই সেখানকার গানের ধারার বৈচিত্র্যময় রূপটির সঙ্গে তাঁর পরিচয় তো সে-সময়ই রোপিত হয়েছে। যাত্রাগানে তবলা-বাদক হিসেবে সংগীত-জীবন শুরু করায় লোকগানের ধারায় তাঁর সম্পৃক্ততা আগে থেকেই ছিল।
রামকানাই দাশ প্রাচীন গানগুলো সরাসরি তাঁর পূর্ব-প্রজন্মের কাছ থেকে সুরসমেত সংগ্রহ করে একইভাবে গেয়েছিলেন। এজন্যই তাঁর কণ্ঠ মাটিঘেঁষা, এজন্যই তাঁর কণ্ঠ আদি ও অকৃত্রিম। প্রাচীন গানের সুর ও কথার কোনো অদলবদল তিনি সহ্য করতেন না। নিজে তো করেন-ই নি বরং অন্যকে সেটা করতে দেখলে খেদ প্রকাশ করতেন। এজন্য জীবদ্দশায় কারো-কারো ঈর্ষারও পাত্র হয়েছিলেন। তবে তাতে দমে যাননি। বরং নিজের কাজটুকুই সুষ্ঠুভাবে করে যেতেন। রামকানাই যে কেবল প্রাচীন গান গাইতেন তা নয়, এসব সংগ্রহও করতেন। সংগৃহীত এসব গান নিয়ে প্রাচীন লোকগান নামে একটি পাণ্ডুলিপিও প্রস্তুত করেছেন। গানগুলোর অকৃত্রিমতা যেন বিনষ্ট না-হয়, এজন্য এসব গানের স্বরলিপিও তৈরি করে নিয়েছিলেন। প্রাচীন লোকগানের সুরের আদলে নিজে অন্তত তিনশো গান রচনা করেছেন। আক্ষরিক অর্থেই রামকানাই দাশের কাছে বাংলা লোকগান ঋণী হয়ে রইল।
বাংলা লোকগানের প্রচার ও প্রসারে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, রণেন রায়চৌধুরী, খালেদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু চৌধুরী, অমর পালদের অবদান অনস্বীকার্য। তবে নির্মলেন্দু চৌধুরী যে কিছু কিছু লোকগানের কথা ও সুরের বিকৃতি করেছিলেন, সেটাও এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক। অন্যদিকে রণেন রায়চৌধুরীদের হুবহু লোকগানের সুর ও কথাকে অনুসরণ করাটাও একইসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন। রামকানাই দাশ ছিলেন যেন রণেনেরই সার্থক উত্তরসূরি। তবে লোকগানে রামকানাইয়ের আনুষ্ঠনিক প্রত্যাবর্তন কিন্তু বেশিদিনের নয়। খুব ছোটো বয়সে বাবার হাত ধরে তবলায় চাটি মেরে যাত্রাগানের আখড়াই বাজিয়ে সংগীত জীবনে প্রবেশ করেছিলেন। এরপর উচ্চাঙ্গসংগীতে পারদর্শিতা অর্জন করলেও পরিণত বয়সে রবীন্দ্রসংগীতের একজন সুদক্ষ প্রশিক্ষক হয়ে ওঠেন। শেষবয়সে লোকসংগীতের সিডি প্রকাশ করে সংগীতবোদ্ধাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর শাস্ত্রীয় সংগীত ও লোকসংগীত উভয় ধারায়ই তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকে। তাঁর কণ্ঠের তীব্রতা এতই আকর্ষণীয় যে, একবার তিনি গান গাইতে শুরু করলে শ্রোতাদের সময়জ্ঞান সব উবে যেত। শহুরে শ্রোতাদের মুগ্ধ করার জন্য লোকগানে তিনি কখনোই কৃত্রিমতার আশ্রয় নেননি। এর ফলে তাঁর পরিবেশিত গানে লোকগানের আদিস্বাদটুকু পাওয়া যায়।
লোকগানের নানা ধারা-উপধারা ইতিমধ্যেই হারিয়ে গেছে। অনেক ধারা পশ্চিমা ও বিদেশি আগ্রাসনের ঝড়ো-হওয়ায় উড়ে যেতে বসেছে, সেসবকে কোনোমতে আকড়ে ধরে রেখেছিলেন রামকানাই দাশরা। তাঁর মৃত্যুতে লোকগানের এখনো না-হারানো অবশিষ্ট ধারাগুলো ঠিক কোথায় গিয়ে ঠেকে-সেটাই এখন দেখার বিষয়। সস্তা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এবং দ্রুততম সময়ে নাগরিক শ্রোতাদের কাছে পরিচিতি অর্জনের জন্য যাঁরা বা যেসব শিল্পী গান পরিবেশন করছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য অবশ্যই পরিষ্কার। এসব ব্যক্তির কাছে লোকগানের কোনো কদরই নেই, মূলত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য তাঁরা ‘লোকগানের শিল্পী’ পরিচয় তৈরি করে নিজস্ব সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার দিকেই বেশি নজর দিচ্ছেন। গানের প্রতি দরদি না-হওয়ায় লোকগানের বিকৃতি করতে তাঁদের ভেতরে কুণ্ঠাবোধই তৈরি হচ্ছে না।
বাংলার লোকগান যেহেতু এখন নাগরিক শ্রোতা-গবেষক ও ভিনদেশীদের কাছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, তাই কেউ-কেউ এর পরিপূর্ণ সুবিধাটুকুও নিতে চাইছেন। সুবিধাপ্রত্যাশী সেসব ব্যক্তিরা লোকগানের প্রকৃত রং-রূপ-বর্ণ অনুধাবণ না-করেই কেবল জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য এ ধারার চর্চায় আসছেন। এমনও লক্ষ্য করা যায়Ñজীবনভর রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত করেই যে শিল্পী প্রতিষ্ঠাপ্রত্যাশী ছিলেন, তাঁরাই এখন বোল পালটে লোকগানের চর্চায় নাম লেখাচ্ছেন। এটা অবশ্য দোষের বিষয় নয়। সমস্যাটা হচ্ছে-খোলস পালটে তাঁরা লোকগানের মূল মাজেজা না-বুঝে কেবল জনপ্রিয়তা লাভের জন্য এ ধারার চর্চায় চলে আসায় লোকগানের প্রকৃত উদ্দেশ্য বিঘ্নিত হচ্ছে। সুবিধাভোগী এসব শিল্পীর উত্থানের কারণে লোকগানের সুর ও ধারার বিকৃতি ঘটছে।
রামকানাই দাশ ছিলেন লোকগানের অগ্রগণ্য সাধকদের একজন। তিনি বেড়ে ওঠেছেন গ্রামে, তাই সেখানকার গানের ধারার বৈচিত্র্যময় রূপটির সঙ্গে তাঁর পরিচয় তো সে-সময়ই রোপিত হয়েছে। যাত্রাগানে তবলা-বাদক হিসেবে সংগীত-জীবন শুরু করায় লোকগানের ধারায় তাঁর সম্পৃক্ততা আগে থেকেই ছিল। তবলা বাজিয়েছেন উকিল মুনশি, শাহ আবদুল করিম, আবদুস সাত্তারসহ প্রখ্যাত বাউলসাধকদের সঙ্গেও। এছাড়া শুরুর দিকে তিনি কীর্তন ও উরিগান গাইতেন। সবমিলিয়ে তাঁর রক্তে অনেক আগে থেকেই লোকগানের রূপ-রস ছিল। শেষবয়সে এসে যখন শাস্ত্রীয়সংগীতের পাশাপাশি লোকগানে মনোনিবেশ করলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই জীবনের শুরুর দিককার অভিজ্ঞতা বেশ কাজে লাগে। মধ্য জীবনে এসে শহুরে সভ্যতার সঙ্গে রামকানাইয়ের পরিচয় এবং বসবাস শুরু হলেও তিনি কখনোই গ্রামীণ লোকজীবন ও লোকগান থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। ফলে লোকগানের জগতে পদাপর্ণ করে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছিলেন।
হারিয়ে যেতে-বসা অজ্ঞাত গীতিকারদের রচিত প্রাচীন লোকগান পরিবেশনের পাশাপাশি শিতালং শাহ, রাধারমণ, দুর্বিন শাহ, আজিম ফকির, হরি আচার্য, দেবেন্দ্র বাইন প্রমুখ লোকসাধকদের রচিত গানও গেয়েছেন রামকানাই দাশ। যাত্রাগান-এর ‘মুখ্য বাইন’-এর পাশাপাশি ‘বিবেক’ চরিত্রে অভিনয় করে গান পরিবেশন করেছিলেন একসময়। গেয়েছেন বাউল, উরি, ফকিরালি, গোষ্ঠ, কীর্তন, ঘাটুসহ নানা ধারার গান। প্রাচীন গানের বৈচিত্র্যময় রূপটিই তিনি শেষ বয়সে দেশ-বিদেশে অকৃত্রিমভাবে তুলে ধরেছিলেন। বাংলা লোকগানের ‘শেষ নবাব’ ছিলেন রামকানাই দাশ। তাঁর মৃত্যুতে তাই এখন সাথিহারা বাংলার লোকগান, বন্ধুহারা লোকগীতিকারেরা। তবে তাঁর সুর-বিছানো পথে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হেঁটে গেলে, সেটাই হবে তাঁর জীবনভর সাধনার প্রকৃত সার্থকতা।