শাহ আবদুল করিম : তাঁর স্মৃতি, তাঁর গান । সুমনকুমার দাশ
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ, | ২১৫৫ বার পঠিত
একাধিক গানের আসরে শাহ আবদুল করিমের স্বকণ্ঠে গান শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বাউল, মুর্শিদি, বিচ্ছেদ, গণসংগীত – বিচিত্র তাঁর গানের ধরন। মিহি সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে তিনি মাতিয়ে রাখতেন শ্রোতাদের। যখন মঞ্চে উঠতেন, তখন থেমে যেত আশপাশের সব কোলাহল। করিম বলতেন, ‘গান গাইমু এক শর্তে। কেউ কুনু শব্দ করতা পারতাইন না।’ শ্রোতারা হাত নেড়ে আর মাথা দুলিয়ে এ নির্দেশ মান্য করতেন। ঠিকই নীরব ও নিস্তব্ধ হয়ে পড়ত চারপাশ। সেখানে কেবল বিরাজ করত করিম শাহের মায়াবি সুরের সম্মোহনী পরিবেশ।
গ্রামীণ উঠোনে ত্রিপল টানিয়ে আর খড় বিছিয়ে প্রস্তুতকৃত আসরে করিম তাঁর বহু-পুরোনো বেহালায় সুর তুলতেন। গানের তালে দুলে উঠত তাঁর কাধ বরাবর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লম্বা পাটের আশের মতো চুলরাশি, সাদা পাঞ্জাবি আর সুতি লুঙ্গি। করিম চোখ বুজতেন আর গাইতেন একের পর এক নিজের লেখা প্রচলিত-অপ্রচলিত গান। এভাবে গানে গানে কেটে যেত পুরো রাত। ভোরের দিকে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বাড়ি ফিরতেন গানপ্রিয় গ্রামীণ শ্রোতারা।
২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর শাহ আবদুল করিম দেহত্যাগ করেছেন। কিন্তু এখনো তাঁর গানের ধরন, ভঙ্গি ও স্বাতন্ত্র্য হাওরবাসীর নিয়মিত আড্ডার মুখ্য বিষয়। করিম যখন গাইতেন, তখন তন্ময় হয়ে শুনতেন হাজারো শ্রোতা। সেসব শ্রোতা এখন করিমের শূন্যতা অনুভব করে আফসোস করেন। প্রবীণ ব্যক্তিদের অনেককেই বলতে শুনি, ‘করিম নিমাই সন্ন্যাস পালা খুব চমৎকার গাইতেন।’ কিন্তু কেমন ছিল তাঁর নিমাই সন্ন্যাস পালা গাইবার কণ্ঠ? সেটা কি তাঁর অপরাপর গানের মতন? জানি না, কারণ কখনো তাঁর নিমাই সন্ন্যাস পালা শুনিনি। তাই কেবল অনুভব করি -দরাজ গলায় করিম গাইছেন বিষ্ণুপ্রিয়ার দুঃখগাথা।
করিমের অন্যতম প্রিয় দুই শিষ্য আবদুর রহমান ও রণেশ ঠাকুরের নেতৃত্বে বাউলেরা শহিদবেদিতে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে খালি গলায় গাইছিলেন – ‘কেন পিরিতি বাড়াইলায় রে বন্ধু ছেড়ে যাইবায় যদি…’। আবেগপ্রিয় লোকজন এ গান শুনে কান্না সামলাতে পারেননি। অঝরে যেন শ্রাবণের বৃষ্টি নেমেছিল সবার চোখ থেকে। কাউকে ভালোবেসে হারানোর কষ্ট সেদিনই প্রথমবারের মতো অনুভব করলাম।
শাহ আবদুল করিমের মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে একবার তাঁকে একান্তে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম নিমাই সন্ন্যাস পালার কথা। তিনি মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘সে তো কবেকার কথা। এখন আর গাই না।’ ‘কেন গাইছেন না?’ – এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘বাউলগান এত বেশি আসরে গাইতে হয়, নিমাই সন্ন্যাস পালা গাওয়ার সুযোগ আর হয়ে ওঠে না। এ ছাড়া আগের তুলনায় হিন্দু ধর্মীয় পালাগানের আসরও তো ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।’ আমি কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরাই। তাঁর কাছে জানতে চাই বাউলতত্ত্বের খুঁটিনাটি বিষয়াদি। তবে তিনি জবাব দেন না। কেবল বলেন, ‘মানুষকে ভালোবাসাই বাউল-দর্শনের সার কথা।’
যে করিমের গান আসরে-আসরে শ্রোতাদের চোখে-মুখে মুগ্ধতার অনুরণন তোলে, সেই তিনি কিন্তু চলাফেরা ও চালচলনে ছিলেন খুবই সাদাসিধে। তাঁর নির্লোভ ও নিরহংকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আজো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আদর্শ ও নৈতিকতার প্রশ্নে তিনি সবসময় অবিচল ও দৃঢ়চেতা ছিলেন। সব ধরনের কূপমণ্ডুকতা, কট্টর ধর্মান্ধতা ও প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে তাঁর গানের ভাষা ও বক্তব্য ছিল প্রগতি ও মুক্তবুদ্ধির পক্ষে। দেশের সবকটি প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে নিরন্তর সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছেন।
শাহ আবদুল করিমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি ঘটনা প্রায় কিংবদন্তিসম। করিমের স্মৃতিশক্তি তখন অনেকটাই কমে এসেছিল। তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ছেলে শাহ নূরজালালের হাত ধরে যোগ দিয়েছিলেন। ওইদিন সংবর্ধনার শেষ মুহূর্তে করিমের হাতে সোয়া তিন লাখ টাকার একটা চেক তুলে দিয়েছিলেন আয়োজকেরা। করিম ভেবেছেন, সোয়া তিন হাজার টাকা! তিনি বলেছিলেন, ‘এত টাকা! এই সোয়া তিন হাজার টাকা দিয়ে আমি কী করব?’
শাহ আবদুল করিমের বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে আয়োজকেরা তাঁর ভুল শুধরে দেন। করিম টাকার সঠিক পরিমাণ জানার পর একলাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। তিনি তাঁর ছেলের নাম ধরে ডাক দিয়ে বলেন, ‘চল বাড়ি যাই। সর্ব্বনাশ, অত টাকা! এগুলো নিয়্যা আমরা কিতা করমু? আমরার টাকার দরকার নাই, মানুষ যে ভালোবাসা দিছে, সেইটাই বড়ো প্রাপ্তি। চল চল বাড়ি চল।’ এই হলো শাহ আবদুল করিমের নির্লোভ মানসিকতা। আজকালকার অনেক শিল্পী যখন টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে দিশেহারা, তখন একেকজন আবদুল করিম লোভহীনতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
শাহ আবদুল করিমের লেখা গান সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লক্ষণীয়। এসব দেখে মাঝে-মধ্যে ভাবি – একজন গীতিকারের লেখা এত এত গান শ্রোতাপ্রিয় হয় কীভাবে? করিমের লেখা ও সুর করা অন্তত শ-খানেক গানের প্রথম পঙ্ক্তি অনায়াসেই বলে দেওয়া সম্ভব, যেগুলো কিনা কিশোর-তরুণ-যুবক-বয়স্ক সব বয়সী মানুষের কাছে সমানভাবে প্রিয়। বাংলা গানের ভুবনে শাহ আবদুল করিমের লেখা গানের জনপ্রিয়তা সত্যিকার অর্থেই অনতিক্রম্য।
অনতিক্রম্য সেই মানুষটি ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দেহত্যাগ করেন। সেদিন ছিল রোদঝলমলে সকাল। হঠাৎ শুনলাম বাউলসাধক শাহ আবদুল করিম আর নেই। চোখের পলকে যেন রং-রূপ-রস-গন্ধে ভরা জীবনটা হয়ে গেল বর্ণহীন, ফিকে। পৃথিবী যেন স্তব্ধ মনে হলো। এই সাধকের জীবন ও দর্শনে আমি বহুকাল বাঁধা পড়ে আছি। সেই বন্ধন থেকে জন্ম নিয়েছিল এক অদ্ভুত বোধের – শাহ আবদুল করিম মরতে পারেন না।
যে বাঁধনে শাহ আবদুল করিম আমাকে বেঁধেছিলেন, সেই একই বাঁধনে বাঁধা পড়েছিলেন শত-সহস্র মানুষ। মৃত্যুর পর যখন তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হয় সিলেটের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে, তখন হাজারো বাউল-অনুরাগী ভিড় জমিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর খবরে কাঁদতে পারিনি আমি। গলার কাছে দলা পাকিয়ে ছিল গুমোটবাঁধা কান্নার বাষ্প। আমি কোথায়-কার কাছে যাব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মনে আছে, কেউ একজন আমাকে টেনে নিয়েছিলেন বুকে। অঝরে কেঁদেছিলাম আমি। সংবিৎ ফিরে পেলাম যখন, তখন দেখি অপেক্ষমান হাজারো বাউল-অনুরাগী দুপুরের কড়কড়ে রোদে দরদর করে ঘামছেন। কারো কারো ঘাম আর অশ্র“তে একাকার হয়ে গেছে পুরো মুখায়ব।
করিমের অন্যতম প্রিয় দুই শিষ্য আবদুর রহমান ও রণেশ ঠাকুরের নেতৃত্বে বাউলেরা শহিদবেদিতে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে খালি গলায় গাইছিলেন – ‘কেন পিরিতি বাড়াইলায় রে বন্ধু ছেড়ে যাইবায় যদি…’। আবেগপ্রিয় লোকজন এ গান শুনে কান্না সামলাতে পারেননি। অঝরে যেন শ্রাবণের বৃষ্টি নেমেছিল সবার চোখ থেকে। কাউকে ভালোবেসে হারানোর কষ্ট সেদিনই প্রথমবারের মতো অনুভব করলাম।
সেই ছোটোবেলা থেকে আবদুল করিমের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়। যখন স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করি, তখন সুরে-বেসুরে দলবেঁধে বন্ধুরা গাইতাম ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’সহ তাঁর লেখা কত শত গানের পঙ্ক্তি। করিমের গানে এভাবেই নিমজ্জিত হয়েছিলাম। তিনি ছিলেন আমাদের পাশের উপজেলা দিরাইয়ের উজানধল গ্রামের বাসিন্দা। ফলে গানের আসর কিংবা চলতে-ফিরতে তাঁর সঙ্গে প্রায়শই দেখা হতো। কিন্তু ঘনিষ্ঠতাটা হয়ে উঠছিল না। পরে যখন স্কুল পাস করে নিজ জেলা সুনামগঞ্জ ছেড়ে সিলেটের নামকরা কলেজে ভর্তি হই, তখন মানুষের মুখে মুখে শাহ আবদুল করিমের নাম অনন্য মর্যাদায় উচ্চারিত হতে শুনি।
সুনামগঞ্জের বাইরে এত এত মানুষ শাহ আবদুল করিমকে ভালোবাসে, সেটা লক্ষ করে উদ্বেলিত হয়েছিলাম। আমি তখন নিজেকে তাঁর এলাকার মানুষ বলে পরিচয় দিতে শুরু করেছি। ধীরে ধীরে তাঁর গান নিয়ে পঠনপাঠন বাড়িয়ে দিলাম। একপর্যায়ে তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কও তৈরি হলো। এই সম্পর্ক একসময় ঘনিষ্ঠতায় রূপ নিল। সেই ঘনিষ্ঠতা ও ভালোলাগা থেকেই তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে একের পর এক গ্রন্থ রচনা করি। এভাবেই করিমের জীবন ও সংগীতের সঙ্গে নিজেকে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে ফেলি। করিমের বাউলগানের বিপুল সৃষ্টির মায়ামোহে পড়েই জড়িয়ে পড়ি বাউলগানের শুলুক সন্ধানে।