স্বপ্নবড়ি । রাজিব মাহমুদ
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:৪৮ পূর্বাহ্ণ, | ৩২৭১ বার পঠিত
এটা একটা ঘুমে পাওয়া গল্প; স্বপ্নে পাওয়া বলবনা কারণ সেরাতে ঘুম আর স্বপ্নের মাঝে আমি একটা রেলপথ বিছানো রাস্তা দেখেছিলাম, চারিদিকে পাথর-ঘেরা। এই রেলপথে যে ট্রেনটা চলে সেটা দেখতে অনেকটা শাহবাগের শিশু পার্কের দু’পাশ খোলা ট্রেনটার মত যাতে লম্বা প্লাস্টিকের বেঞ্চি বসানো থাকে। আমি দেখলাম যে স্বপ্নের ট্রেনের জন্য আমি অপেক্ষা করছি একটা প্ল্যাটফর্মে। ট্রেন ছাড়ার সময় পার হয়ে হয়ে আরও অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরও ট্রেনের দেখা নেই। আশেপাশের অন্যান্য অপেক্ষমাণ যাত্রীদের মধ্যে বিরক্তির প্রকাশটা চাপা গুঞ্জন থেকে আস্তে আস্তে প্রতিবাদী স্লোগানে রূপ নিচ্ছে। একজন সিনিয়র সিটিজেন অপেক্ষা করছেন একজন অল্পবয়সী তরুণীকে সাথে নিয়ে। বিরক্তিতে ফোঁস ফোঁস শব্দ করার সময় তাঁর ভুঁড়ি হাল্কা ভাবে কেঁপে উঠছে কিছুক্ষণ পর পর। তিনি তরুণীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই তাহলে সেই বিখ্যাত ড্রিমট্রেন? দেরি যে হচ্ছে তার কোন এ্যানাউন্সমেন্ট পর্যন্ত নেই।’
অনেক দূর পর্যন্ত ট্রেন লাইন বিছিয়ে আছে লম্বা মইয়ের মত; যেন কেউ মই উঁচিয়ে আকাশে উঠতে গিয়ে তাল হারিয়ে পড়ে গ্যাছে-মইটা এলোমেলো পড়ে আছে টুকরো টুকরো চুনাপাথর চারপাশে নিয়ে।
যেদিকে তাকিয়ে আছি তার উল্টো দিক থেকে কারো হেঁটে আসার শব্দ পেলাম। মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখি একটা লোক। লম্বা কুর্নিশ করল সে। লোকটা দেখতে অনেকটা সার্কাসের ভাঁড়ের মত: ঢোলা রাম্পার স্যুট, মাথায় রঙিন কোঁকড়ানো চুল, রং মাখানো পাতলা ঠোঁট, রক্তাভ চেরি ফলের মত নিখুঁত জ্যামিতিক সুগোলতায় আঁকা সার্কাসের ভাঁড়ের নাক। গালের উপর পোলকা ডটেড টোল যেটা আরও বিস্তৃত করে সে বলল,
‘জনাব! যাওয়ার আগে একটা স্বপ্নবরি লইয়া যান। দাম মাত্র দশ টাকা।’
‘স্বপ্নবড়ি মানে?’
লেখেন কিন্তু ছাপায়েন না। মানুষ বিভ্রান্ত হবে। ভাষা নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও আবিষ্কার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এগুলো বছরের পর বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল।’ উনি দ্রুত চুমুক দিতে থাকলেন কফিতে…
‘আপনে তো কবি। কবিতা লিখতে পারতেসেন না কয়দিন ধইরা। লইয়া যান একখান স্বপ্নবড়ি জনাব। কবিতা বাইর হইব তুফানের মত। তয় আকাশের পানি মানে বৃষ্টি দিয়া খাইলে উপকার পাইবেন বেশি। বরির লগে পানি ফিরি।’
স্বাভাবিকভাবেই বেশ অবাক হলাম: আমার সম্পর্কে এই ভাঁড় এত কথা জানল কীভাবে? বিস্ময় চেপে বললাম-
‘স্বপ্নবড়ি কী সেটাই তো জানলাম না। আর আপনিই বা কে?’
‘জনাব এইটা খাঁটি জিনিষ। কাঁচা চান্দের আলো আর তেরো রকম ফুলের বাস দিয়া এইটা তৈয়ার করা হয়। এত সস্তায় এই জিনিষ পাইবেন না । একটা নিয়া খাইয়া দ্যাহেন।’
‘কী!! চাঁদের আলো আর ফুলের গন্ধ দিয়ে তৈরি মানে কী? ফাইজলামি করেন?’
‘না জনাব, ফাইজলামি করিনা । আপনে তো কবি। চিন্তা কইরা দ্যাখেন আপনে যদি শব্দ দিয়া কবিতা ল্যাখেন আর সেইটারে বই বানাইয়া বাজারে ব্যাচেন তাইলে আমি চান্দের আলো আর ফুলের বাস দিয়া বরি বানাইয়া বেচতে পারুম না ক্যান, কন তো?’
‘কিন্তু আপনার ব্যবহার করা কাঁচামাল তো এ্যাবস্ট্রাক্ট বা বিমূর্ত মানে ধরা যায় না’
‘জনাব শব্দও তো একোই ব্যাপার। শব্দ হাত দিয়া ধইরা কেউ কচকচ কইরা খাইসে এইডা হুনছেন কুনোদিন?’
বেশ ভড়কে গেলাম। যা বলছে কথা ঠিক। চাঁদের আলো, ফুলের গন্ধ আর শব্দ সবই তো বিমূর্ত। শেষেরটাকে যদি কাগজে ধরা যায় তাহলে প্রথম দুইটাকে বড়ি আকারে কেন যাবে না? মাই গড! এই ব্যাটা নিশ্চয়ই ছদ্মবেশী যাদুকর।
আমি আমার বিস্ময় চেপে ঘোড়েল ক্রেতার মত বললাম, ‘কিন্তু দশ টাকা তো অনেক বেশি। পাঁচ টাকায় হলে…’
‘জনাব দামাদামি নাই। এক দাম।’ মুখ শক্ত করে বলে স্বপ্নবড়িওয়ালা।
দাম মিটিয়ে বড়িটা নাড়াচাড়া করতে থাকি। জিনিষটা দেখতে দারুণ, রাস্তার ধারে বিক্রি করা চীনা বাদামের চেয়ে বড় বাদামগুলোর মত যেগুলোর খোসা ছাড়ালে ভেতরে ৩ থেকে ৪ টা দানা থাকে। কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে মাঝখানে চাপ দিতেই ‘ট্রিপ’ শব্দ করে খোসাটা দুই পাশে সরে গেল। ভেতরে বেশ বড় সাইজের দুইটা গোল বেয়ারিং বলের মত জিনিষ। তবে রংটা নীলাভ সাদা। খাওয়ার নিয়মাবলী জানতে মুখ তুলে দেখি বাড়িওয়ালা নেই। হঠাৎ চোখে পড়ল আমার ব্যাগের পাশে একটা অদ্ভুত একটা কাঠের বোতল। হাতে নিয়ে দেখি বোতলের উপর পেন্সিল দিয়ে লেখা, “বিশুদ্ধ বৃষ্টিজল”। চকিতে মনে পড়ল যে বাড়িওয়ালা আমাকে বড়িটা বৃষ্টির পানি দিয়ে খেতে বলেছিল।
এসময় ট্রেনটা ঝকঝক ঝকঝক শব্দ তুলে স্টেশনে ঢুকে পড়ল। ট্রেন থামার আগেই যাত্রীরা গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে ছুটোছুটি শুরু করে একটা বেশ ধুন্ধুমার বাঁধিয়ে দিল। খালি ট্রেন। স্বপ্ন নগরী থেকে কোন যাত্রী বোধহয় আসেনি। নির্দিষ্ট কোন ওঠার জায়গা বা দরজাও নেই। যে যেখান দিয়ে পারছে উঠছে। হঠাৎ দেখলাম সেই সিনিয়র সিটিজেনের সাথের তরুণীটি আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে সে খুব সাবলীল ভঙ্গিতে বলল,
‘আপনি কী ড্রিমট্রেনের যাত্রী?’ আমি কোন উত্তর দেবার আগেই তরুণী দ্রুত বলে গেল, ‘আপনি প্লিজ আমার হাযব্যাণ্ডের পাশের সীটে বসবেন। সিট রাখা আছে।’
‘ওকে… কিন্তু কেন? আর তাছাড়া আপনি তাহলে কোথায় বসবেন?’
‘আমি আসলে যাচ্ছিনা। তবে এটা ও এখনো জানে না।’
কথোপকথনের এই পর্যায়ে সুঠামদেহী দীর্ঘ এক যুবকের উদয়; যেন আকাশ ফুঁড়ে হাল্কা ভাবে মাটিতে পা রেখেই তরুণীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আসা মাত্রই সে তাড়া দিল, ‘কী হল চলো! আমার উইন্ডকার দারায় আসে। ড্রাইভার তারা দিতেসে। ভাড়ার গাড়ি তো।’
তরুণী যুবকটিকে দেখিয়ে বলল, ‘আমি ওর সাথে চলে যাচ্ছি আকাশের ঐপারের একটা স্টেশনে। ঐ বুড়া ভামটা আমাকে টাকার জোরে বিয়ে করেছে। আমিও রাজি হয়েছিলাম; ভেবেছিলাম বাকি জীবনটা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে কেটে যাবে। কিন্তু সংসার শুরু করে বুঝলাম যে জীবনে টাকার দরকার আছে ঠিক-ই কিন্তু শুধু টাকার চিন্তা করে একটা বুড়ার সাথে আসলে এভাবে থাকা যায় না। বেঁচে থাকার জন্য একজন ভালো সঙ্গী খুব দরকার। আর তাছাড়া বুড়া খুব তাড়াতাড়ি মরবেও না কারণ তার বড় কোন অসুখ নাই।’
এ সময় ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠলে। ওরা হাত ধরাধরি করে চলে যায়। সিনিয়র সিটিজেনের জন্য আমার করুণা, মমতা, রাগ আর দীর্ঘশ্বাস মাখা একটা মিশ্র অনুভূতি হল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে উনার পাশে বসব না। ইন ফ্যাক্ট ঐ ট্রেনে ওঠার উৎসাহটাই যেন কোথায় হারিয়ে গেল- একটা দমকা বাতাসের মত প্রবল অনুৎসাহ গ্রাস করল আমাকে। । ড্রিমট্রেন না হাতি! আর ঠিক তখনই যেন হাল্কা একটা ধাক্কা খেয়ে নড়ে উঠল ট্রেনটা। সিনিয়র সিটিজেন ভদ্রলোক তাঁর আসন থেকে উঠে উদ্বিগ্ন ভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। নিশ্চয়ই তাঁর স্ত্রীকে খুঁজছেন। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
ট্রেন চলতে শুরু করেছে। যাত্রীদের মধ্যে একটা হুল্লোড় ছড়িয়ে পড়ল। শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন-নগরীর উদ্দেশ্যে ড্রিমট্রেনটা স্টেশন ছাড়তে যাচ্ছে। তবে এই উত্তেজনার সাথে একটা অজানা আশঙ্কাও যেন গা জড়াজড়ি করে আছে। স্বপ্ননগরী তার স্বপ্নময়তা আর অচিনপুরীয় এক ছমছমতা নিয়ে যেন অপেক্ষা করে আছে এই নতুন অভিযাত্রীদের জন্য। এদিকে আমি ঠিক কেন ট্রেনটায় শেষ পর্যন্ত উঠলাম না সেটা নিজের কাছে পরিষ্কার করতে না পারার অস্বস্তি নিয়ে প্ল্যাটফর্মে উদ্দেশ্যহীনভাবে পায়চারি শুরু করলাম। কাঠের পানির বোতলটা থেকে পানি মুখে দিয়ে বড়ি দুইটা মুখের ভেতরে ছুঁড়ে দিলাম। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি একটা তন্দ্রাবস্থা। দেখলাম একটা হাল্কা সোনালী আলোর ভেতরে ছোট ছোট লুডুর ছক্কার মত কিছু জিনিষ ভাসতে ভাসতে এঁকে বেঁকে সামনের দিকে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝলাম যে ওগুলো আসলে শব্দ-শব্দগুলোর অক্ষরগুলোর দিকে চেয়ে থাকলাম কিন্তু পড়তে পারলাম না। একটা অচেনা ফুলের মিষ্টি গন্ধ আসছে। মনে হল গন্ধটা আসছে মাটির অনেক গভীর থেকে। কিন্তু পায়ের নিচে কোন মাটি খুঁজে পেলাম না। কেমন একটা শূন্যে ভেসে থাকার মত অনুভূতি হল। তবে ব্যাপারটা বেশ স্বাভাবিকই মনে হল কারণ আমি নিজেকে পড়ে যাওয়া থেকে আটকানোর জন্য হাঁচর পাঁচর করে আশে পাশের কিছু ধরার চেষ্টা করলাম না।
হঠাৎ আবিষ্কার করলাম যে শব্দগুলো বেরিয়ে আসছে আমারই শরীরের নানা জায়গা থেকে: নখের নীচ থেকে, কানের ছিদ্র থেকে, চোখের কোনা থেকে, এমনকি নাভির গভীর থেকেও। মনে হল এরা যেন হাওয়ার ভেতরে বাক্য আঁকতে চেষ্টা করছে। সেসব বাক্যের যেমন নানা রং তেমনি তাদের বাহারি মেজাজ: বাদামী অভিমানী বাক্য, শুভ্র প্রশান্ত বাক্য, লাল যৌবন-থরথর বাক্য। শব্দগুলো যেন বহুদিন আমার শরীরে বন্দী থাকার পর ছাড়া পেয়েই ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে, একে অন্যের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে। আস্তে আস্তে নিজেকে বেশ হাল্কা মনে হল; একটা অদ্ভুত ভার মুক্তির স্বস্তিতে কেমন একটা আবেশ ছড়িয়ে গেল মাথা থেকে পা পর্যন্ত।
মনে পড়ল সুইস ভাষাবিদ ফার্ডিন্যান্ড ডি সস্যুরের কথা যিনি বলেছেন ভাষা শুধুই একটা ফর্ম যার কোন সাবস্টেন্স নেই। তিনি দাবাখেলার গুটির উপমা দিয়ে দেখিয়েছেন যে দাবার একটি রাজা বা মন্ত্রী যা দিয়েই তৈরি হোক না কেন তাতে সেই রাজা বা মন্ত্রীর দাবার বোর্ডে চলাচলের নিয়ম এতটুকু বদলায় না। যেমন ধরা যাক দাবার বোর্ডে একটি তামার তৈরি রাজাকে সরিয়ে যদি সোনার তৈরি রাজা বসানো হয় তাতে রাজার ক্ষমতা বিন্দুমাত্র বৃদ্ধি পায় না বা কমেও যায় না। অর্থাৎ ভাষা শুধুই একটি বাহ্য আকার, আভ্যন্তরীণ কোন পদার্থ নয়। যে কারণে কোন আন্ত-পদার্থ ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। ভাষা মূলত: একটা বাহ্য আকার বা ফর্ম। কী মারাত্মক উপমা! ভাষাকে ধরা-ছোঁয়া যায় না অথচ এই ধরা-ছোঁয়ার জগতের প্রায় প্রতিটি বস্তু/অবস্তুকে ভাষার ধ্বনি-শব্দ-বাক্যে ধরা যায় বা অন্তত: ধরার চেষ্টা করা যায়। অর্থাৎ অবস্তু ধারণ করছে বস্তুকে। আমার মনে পড়ে যায় স্বপ্নবড়িওয়ালার সেই যাদুকরী তুলনা-যদি বিমূর্ত শব্দে কবিতা লিখে তাকে কাগজে মূর্ত করে বাজারে ব্যাচা যায় তাহলে একটি মূর্ত স্বপ্নবড়ি কেন বিমূর্ত স্বপ্ন তৈরি করতে পারবে না?
আমার সামনে শূন্যে বয়ে যাওয়া বাক্যগুলো ভাসতে ভাসতে অনেকদূর চলে যায়। ওগুলোকে অনুসরণ করে বেশ কিছুদূরে তাকিয়ে দেখি বাক্যগুলো থেকে দু’টো মানব শরীর লতিয়ে উঠছে। আস্তে আস্তে অবয়ব দুইটা সম্পূর্ণ হলে চিনতে পারি ওদের-ড্রিমট্রেনে স্বামীর সাথে না উঠে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যাওয়া সেই মেয়েটা আর তার প্রেমিক। তারা কথা বলছে। আমি তাদের শরীরের ভেতরটা দেখতে পাচ্ছি পরিষ্কার। তারা যে শব্দগুলো মুখ দিয়ে ছুঁড়ছে আর যেগুলো তাদের শরীর-বন্দী হয়ে আছে সেগুলোর প্রকৃতি একদমই আলাদা। মুখে তারা বলছে ‘ভালোবাসা’, ‘সুখ’, ‘পরিত্রাণ’, ‘আনন্দ’ আর ভেতরের শব্দগুলোর মধ্যে যেগুলো পড়া যাছে সেগুলো হল ‘দীর্ঘশ্বাস’, ‘ঘৃণা’, ‘অতৃপ্তি’ আর ‘বিনাশ’।
এ পর্যায়ে আমার ঘুমটা পাতলা সরের মত কেটে যায়। চোখ খুলে দেখলাম নিজের বিছানায় শুয়ে আছি। জানালার বাইরে বিকেলটাও মেঘলা। হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠল। কাজের ছেলেটা এসে বলল কে একজন আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। বসার ঘরে গিয়ে দেখি ধোপদুরস্ত পোশাকের একজন মাঝবয়েসী মানুষ বসে আছে। চেহারাটা চেনা হলেও ঠিক মনে করতে পারছি না যে কোথায় দেখেছি। উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘আপনাকে এই অসময়ে বিরক্ত করার জন্য আমি খুবই লজ্জিত। আমি আপনার একজন পাঠক। আপনার একটা কবিতা নিয়ে একটু কথা বলেই চলে যাব।’
‘না না ঠিক আছে। আপনি প্লিজ বসেন’
‘তাহলে শুরু করি’ উনি বসতে বসতে বললেন।
‘জ্বি।’
‘আপনার একটা কবিতা আছে ভাষা নিয়ে’
‘কোনটা?’
‘কবিতাটা আসলে আপনি এখনো লেখেননি, তবে লিখবেন। হয়ত আজকেই লিখবেন। ইন ফ্যাক্ট এই কবিতার ধারণাটা আপনি পেয়েছেন কিছুক্ষণ আগে, ঘুমের মধ্যে।’
আমার হতবাক দৃষ্টি পুরোপুরি উপেক্ষা করে উনি বলে চললেন,
“এই কবিতা বলবে যে ভাষা গর্ভবতী হয় ও নানা অনুভূতির জন্ম দেয়। ‘বর্ণ’, ‘ধ্বনি’, ‘শব্দ’ এগুলোর কাজ হচ্ছে সেইসব অনুভূতিগুলোকে খোপে ভরে একটা আকার দেয়া। অর্থাৎ এগুলোর প্রয়োজন পড়ে ভাষাকে এক ধরণের বাহ্য উপস্থিতি দেয়ার জন্য। আদতে ভাষা আসলে একটা আন্তঃ ব্যাপার। আপনি কী এরকম কিছুই বলতে চান? মানে আমি কি আপনার ভাবনাগুলোকে ধরতে পারছি?”
‘হ্যাঁ…হয়ত বা…যদিও আসলে আমি এখনো আমার ভাবনাগুলোকে সেভাবে গোছাতে পারিনি। এই কিছুক্ষণ আগে আবছা স্বপ্নদৃশ্যের মত কিছু জিনিষ দেখলাম। বলতে পারেন কিছু পরাবাস্তব চিত্রকল্প ধরণের ব্যাপার। আপনি না আসলে হয়ত এই চিত্রকল্পগুলো নিয়ে ভাবতাম। তবে এটা নিয়ে কবিতা লিখতাম কিনা জানি না। কিন্তু আপনি কী করে…’
‘সেটা পরে বলছি। প্রথমেই দুঃখ প্রকাশ করছি আপনার ভাবার সময়টাকে দখল করে নেয়ার জন্য। কিন্তু আসলে না এসে উপায় ছিল না। আমি একজন ভাষা বিজ্ঞানী এবং দীর্ঘদিন কাজ করেছি ভাষা নিয়ে। আর তাই আমার কাছে বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
‘ও আচ্ছা তাই নাকি? বাহ! আসলে ভাষার প্রকৃতি ও গঠন নিয়ে আমারও যথেষ্ট আগ্রহ আছে। তবে আমি ভাষাকে শুধুই ব্যবহারের পক্ষপাতী নই। কিন্তু আপনি হঠাৎ আমার কবিতার বিষয়বস্তু নিয়ে আগ্রহী হলেন কেন? বিশেষ করে যে কবিতাটা আমি এখনো লিখিই নি!’ আমি বললাম।
‘আগে বলুন আপনি কি এই ভাষার গর্ভবতী হওয়ার ব্যাপারটায় বিশ্বাস করে?’
‘দেখুন ভাষা একটা সপ্রাণ ব্যাপার এটা আমার সবসময়ই মনে হয়েছে। এটা শুধুই শব্দ-বর্ণের পোষাকে ধরা কোন আকার নয়। বরং এভাবে দেখলে ভাষাকে অনেক খাটো করে দেখা হয়। যেন ভাষার শুধুই একটা ছেনাল শরীর আছে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য। যেন এর মন বা আত্মা বলে কিছু নেই। আর আমরা কবিরা শুধুই ভাষার সেই শরীরের বেসাতি করি। কিন্তু ব্যাপারটা আদতেই সেরকম নয়।’
এরপর বেশ অস্বস্তি রকমের নীরবতা কিছুক্ষণের। ভদ্রলোকের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা গেল। যেন মনে মনে কিছু কথা আউড়ে নিচ্ছেন।
‘আপনি চা-কফি কিছু খাবেন?’ আমি নীরবতা ভেঙ্গে বললাম।
‘উম্ম্…কফি। ব্ল্যাক।’ অন্যমনস্ক গলায় বলে উঠলেন ভাষা বিজ্ঞানী।
আমি আমার জন্য চা আর ভদ্রলোকের জন্য কফি বললাম। আবারো কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। উনি হঠাৎ-ই গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই সুইস ভাষাবিদ ফার্ডিন্যান্ড ডি সস্যুরের নাম শুনেছেন। বিশ শতকের এই প্রধান ভাষাবিদ বলেছেন যে ভাষা শুধুই ফর্ম, সাবস্টেন্স নয়। অর্থাৎ ভাষা আসলে একটা আকার মাত্র। এর ভেতরে কোন পদার্থ নেই। উনি দাবার গুটির উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন…’
‘হ্যাঁ সস্যুরের এই তত্ত্বটা আমি জানি। তবে এ ব্যাপারে সস্যুরের সাথে আমার দ্বিমত আছে। আমি মনে করি সাবস্টেন্স ছাড়া ভাষার ফর্মই থাকে না। আর সে কারণেই ভাষা যদি শুধু ফর্ম হয়েও থাকে সাবস্টেন্স ছাড়া সেই ফর্ম একটা মূল্যহীন খোসার মত। কাজেই ভাষার সাবস্টেন্সকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।’
এই পর্যায়ে ভদ্রলোক রেগে গেলেন। ‘আপনাদের কবিদের নিয়ে এটাই সমস্যা। আপনারা সবসময় আবেগ তাড়িত হয়ে সবকিছু দেখেন। বৈজ্ঞানিক একটা পর্যবেক্ষণকে ঘোলা করতে আপনাদের জুড়ি নেই’-বলে উনি ঘড়ির দিকে তাকালেন।
এর মধ্যে কফি চলে এলো।
‘আপনার এই কবিতাটা কি ছাপতেই হবে?’ উনি কফিতে চুমুক দিয়ে বেশ অস্থিরভাবে বললেন।
‘এখনো তো লিখিই নি…’
‘লেখেন কিন্তু ছাপায়েন না। মানুষ বিভ্রান্ত হবে। ভাষা নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও আবিষ্কার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এগুলো বছরের পর বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল।’ উনি দ্রুত চুমুক দিতে থাকলেন কফিতে।
‘কিন্তু একজন বিজ্ঞানী হিসেবে আপনি তো এটা তো জানেন যে শুধু ভাষা- সম্পর্কিত জ্ঞান কেন, পৃথিবীর কোন জ্ঞানই স্থির নয়। আগের আবিষ্কার বা চিন্তাকে প্রশ্ন করেই মানুষ এগিয়ে গ্যাছে।’
হঠাৎই উনাকে ভীষণ বিমর্ষ মনে হল। কফির কাপটা শব্দ করে পিরিচে রেখে উনি উঠে পড়লেন। আমি উনাকে এগিয়ে দেবার জন্য উঠতে উঠতে উনি সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ পৌঁছে গেছেন। অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে হাঁটছেন ভদ্রলোক। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করে বললাম, “আপনার পরিচয়টা কিন্তু বললেন না, অন্তত: নামটা…”
সিঁড়ির শেষ মাথা থেকে ঠাণ্ডা গলায় উত্তর এলো, ‘সস্যুর। ফার্ডিন্যান্ড ডি সস্যুর।