মনোদৈহিক রাজনীতির নয়া ভঙ্গি । সালাহ উদ্দিন শুভ্র
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ আগস্ট ২০১৭, ১১:১২ অপরাহ্ণ, | ১৯৩৮ বার পঠিত
উম্মে ফারহানার গল্পের বইয়ের নাম ‘দিপাবলী’- যার অর্থ করলে দাঁড়ায় অনেকগুলো আলোক শিখা। এই আলো ইউরোপ অঞ্চলের রেনেরসাঁর মতো মনে হবে, তবে অমিল আছে। অমিলটা ফারহানার নারীবাদী অবস্থানের দিক থেকেই কেবল তৈরি হয়নি। অন্যদিকে তার পুর্ববঙ্গীয় থাকার রাজনীতি থেকেও তৈরি হয়েছে। গল্পের মধ্য দিয়ে উম্মে ফারহানার রাজনীতির একটা অবয়ব পড়তে পারা যায়। তবে সেই রাজনীতি রাজপথের, মিছিল-মিটিঙের না। বরং বিপ্লবের। মনোদৈহিক রাজনীতির একটা নয়া ভঙ্গি তিনি হাজির করেছেন। তার ভাষা সাবলীল, জড়তাবিহীন, তীক্ষ্ন। তার চরিত্রদের বোল্ডনেস সহসা বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায় না।
তার দিপাবলী গল্পের বইয়ে মোট গল্পসংখ্যা ১২। সবকটি গলে।পর আলাদা স্বাদ ও বুনন আছে। চরিত্রগুলো বেশিরভাগই নারী। পুরুষদের নারীর প্রতি কটাক্ষ, হীন বিচার, ভোগের মনোবৃত্তির দিকে তার চরিত্রদের রূঢ় অবস্থান আছে। মানে রূজুভাবে আপসহীন তারা। অপমানের প্রতি, হেয় হওয়ার দিকে তার চরিত্রদের তীব্র প্রত্যাখান ও প্রতিবাদ।
কিন্তু এমন একেঘেয়ে নয় তার গল্পগুলো। নারীর যে সারল্য, তার আকাঙক্ষা, সুখানুভূতির দিকে আগ্রহ এসব নিয়ে সে নিজেকে নিজে সঁপে দেয় নিজেকে পুরুষের দিকে। নারীর একরকম অ্যাবসর্ব করার ক্ষমতা থাকে। যা হয়ত তার সংস্কার, তার মজ্জাগত সামাজিক শিক্ষা, তার ভয়, হীনমন্ন্যতা- যা সে লালন করে আসছে বছরের পর বছর। ফারহানা এসব শূচিবাই পরম মমতার সঙ্গে তীব্র প্রতিরোধসহকারে গুঁড়িয়ে দিতে চান।
ফারহানার ‘বান্ধবী’ গল্পটি অসাধারণ। আকারে বড় ও প্রাঞ্জল। একটানা পড়ে ফেলা যাবে। গল্পটা কোথাও ঝুল যায়নি, মেদ জর্জরিত হয়নি। একটার পর একটা ঘটনা, অনেক চরিত্র, গভীর মনোবেদনায় জড়িত দুই বা ততোধিক নারীর পরস্পরের সঙ্গে লেপ্টে থাকা, রাগ, বিষাদ, অপছন্দের গল্পটি লেখকের মূল রাজনৈতিক লাইনের দিকে ইঙ্গিত করে।
তার অন্য গল্প নিয়েও আলাপ করা যায় বিস্তর। রংবাজ যেনম, এক প্রেম ও ইল্যুশনের গল্প। উম্মে ফারহানার গল্পের চরিত্রদের ডাঁট আছে আগেই বলেছি। কিছু চরিত্র নিম্মবিত্তের হলেও মধ্যবিত্তই তার মূল উপজীব্য। ভাষায় তিনি একেবারেই হাল আমলেও। পুরুষের চরিত্র স্খলন অনুসরণ করেন তিনি নিবিড়ভাবে। সতীত্ব নিয়ে তার নিজস্ব তাত্ত্বিক অবস্থান রয়েছে। তার গল্পগুলোতে যৌনতার প্রসঙ্গ বারবার আসলেও, সতীত্বের ধারণা নিছক যৌনতা নির্ভর নয়।
‘বান্ধবী’ গলে।পর আমির বয়ানে আছে, ‘আমার যথেচ্ছ চলাফেরা, আর অনিয়ন্ত্রিত সম্পর্কগুলো নিয়ে আমি লজ্জিত বা কুণ্ঠিত না হলেও আমি বুঝতে পারি এ বিষয়গুলো আমাকে একা করে দিচ্ছে। অনেক মেয়ে সামনে আমার সঙ্গে মেশে , ভালোভাবে কথা বলে, আড়ালে যা তা গসিপ করে। তারা কেউ সতি সাবিত্রি নয়, একটা সম্পর্ক ভাঙলে নিয়ম করে ঝগড়া আর চোখের পানি নাকের পানির পর তারাও আরেক সম্পর্কে জড়ায়। না বনলে বাপ-মায়ের ঠিক করা পাত্রের গলায়ও মালা দেয়। কিন্তু আমার মতোন কোনো কমিটমেন্টের তোয়াক্কা না করে যখন যার সঙ্গে ইচ্ছা ঘুরে ফিরে বেড়ানো, ভালো না লাগলে ডিসমিস করে দেওয়ার মতো গাটস এদের নেই।’
এখানে ফারহানা সমাজের মেকি ‘নেকাব’ খুলে ফেললেন। না ঘরকা, না ঘাটকা যে আধুনিকতা, স্মার্টনেস, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের মেয়েদেরও আছে তা টুটে দিয়েছেন।
এই গল্পের আরেক জায়গায় আছে। কান্তা নামের মেয়েটি বলছে, ‘কান্তা প্রলাপের মতন বলছিলো, মানে আমার চেহারাটা আরেকটু বড় হইলে, বুবস আরেকটু বড় হইলে, স্কিন আরেকটু ফ্রেশ হইলে… হ্যাঁ…. অনলি ইফ আই ওয়্যার আ বিট মোর
অ্যাট্রাকিটভ’- অর্থাৎ ভিজ্যুয়ালাইশেন যুগে নারীর জন্য বিপদ হয়ে উঠেছে সে নিজেই। তার পার্সোনালিটি, অর্ন্গত বেদনারা সব আসছে বাইরে থেকে, অন্যের সঙ্গে তুলনার সাপেক্ষে। ফেটিশিজমে ভুগছে সে। ফলে পাথ হারাচ্ছে। সম স্বার্থ বোধ তার লুপ্ত হয়েছে।
এই প্রস্তাবের পাশাপাশি উম্মে ফারহানার বিপ্লবটা ঘটেছে, ‘আফা বাইর অয়া গেলেগা আমি হের জামাইর গরঅ ডুকলাম। বো তহনো বিছানার থে উডে নাই। আফার শরম পাওয়া ফুলা মুখ, আর নাদান কতা ভুইল্যা গিয়া হের জামাইয়ের শইল্যের উপরে চইড়া বইলাম। ডাক্তার সাবে পয়লা বুজে নাই আমি কি করতাছি, পরে বুইঝবার পরে হাইস্যা দিলো, বেডার এই হাসিটাই আমারে এক্কেরে মাইরা হালায়।
আইজকা আমি হেই বাড়ির কামঅ যাইতাম না, আগেই ছুডি লইছলাম। কুন তাড়াহুড়া করলাম না। আস্তে আস্তে শাড়িবেলাউজ পিনলাম। ডাক্তর সাবে ট্যাহা বাইর করনের লাইগ্যা টেবিলের উপরের থাইক্যা মানিব্যাগ খুজতাছিল, খালি একখান তোয়াইল্যা পিন্দা। আমি হের হাত দইরা কইলাম, “আইজ আমনে আমারে ডাকছেন না, আমি নিজেই আইছি”। হে ব্যাক্কলের লাহান মুহের দিক চায়া রইছে দেইখ্যা আমিই হাইস্যা দিছি। হে রাইগ্যা উঠবার লইল কি না বুঝলাম না, আগেই কইলাম, “রাগ কইরেন না, আমি কাম কইরা খাই, শইল বেইচ্যা খাইনা, আগে ট্যাহা লইছি, আইজ লইতাম না। আফা জানবার পারলে আমনেরে কি কইবো জানি না, আমারে ত ঘিন্না করব, কইব দুদকলা দিয়া কালসাপ পুষছি”। ডাক্তর সাবে মাতাডা নিচা কইরা ফালাইলো’
এখানে ময়নার মা সমকক্ষতা তৈরি করলেন। শ্রেণি ব্যবধান ভেঙে দিলেন। তা যৌনতার মধ্য দিয়ে হলেও তা রাজপথের মিছিল এর তুলনয় কম রাজনৈতিক নয়। বরং সমাজে এই যে মধ্যবিত্ত তাদের নৈতিকতার বড়াই দিয়ে দমিয়ে রাখে নিম্নবিত্তকে, শিক্ষার তফাত দিয়ে, যৌনতায়ও নিম্নবিত্তকে অপদস্থ করার যে কালচরা, পুরুষের যে অভ্যাস তা ভেঙে দিয়েছেন ফারহানা।
তার অন্য গল্প নিয়েও আলাপ করা যায় বিস্তর। রংবাজ যেনম, এক প্রেম ও ইল্যুশনের গল্প। উম্মে ফারহানার গল্পের চরিত্রদের ডাঁট আছে আগেই বলেছি। কিছু চরিত্র নিম্মবিত্তের হলেও মধ্যবিত্তই তার মূল উপজীব্য। ভাষায় তিনি একেবারেই হাল আমলেও। পুরুষের চরিত্র স্খলন অনুসরণ করেন তিনি নিবিড়ভাবে। সতীত্ব নিয়ে তার নিজস্ব তাত্ত্বিক অবস্থান রয়েছে। তার গল্পগুলোতে যৌনতার প্রসঙ্গ বারবার আসলেও, সতীত্বের ধারণা নিছক যৌনতা নির্ভর নয়। তা অনেক বেশি আত্মমর্যাদার প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। যৌনতাকে ঘিরে যেসব সামাজিক ট্যাবু প্রচলিত আছে তাতে তিনি জোরসে আঘাত করেন। যৌনতাকে বুঝবার কিছু কিছু প্রস্তাবও তার আছে। যা আগের দুটি গল্পের উদাহরণ থেকেও বুঝা যায়।
ভাষায় তিনি প্রচুর ইংরেজির ব্যবহার করেছেন। কথার তুবড়ি ছুটেছে তার গল্পে। ধারাল, শাসাল সব ডায়ালগ। গল্পের ডেসক্রিপশন, চরিত্র নির্মাণ, ডায়ালগ সবকিছুতে সাজুয্য আছে। পরিমিতি আছে। উদ্দেশ্যও আছে। তিনি পরিপূর্ণ অনেকটাই। আরো গভীরে যাওয়ার নিয়তও নিশ্চয় আছে। আর সেই এলেমও তার আছে।
তার বইটি ২০১৬ সালে চৈতন্য প্রকাশনি বইমেলায় বাজারে আনে।