উত্তর-উপনিবেশি মন ও শরীরের গল্প । সালাহ উদ্দিন শুভ্র
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ মার্চ ২০১৭, ১১:৩৮ অপরাহ্ণ, | ২৩২৩ বার পঠিত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম গল্পের নাম ছিল ‘ভিখারিনী’। এর শুরুটা এমন :
“কাশ্মীরের দিগন্তব্যাপী জলদস্পর্শী শৈলমালার মধ্যে একটি ক্ষুদ্র গ্রাম আছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটিরগুলি আঁধার আঁধার ঝোপঝাপের মধ্যে প্রচ্ছন্ন। এখানে সেখানে শ্রেণীবদ্ধ বৃক্ষচ্ছায়ার মধ্য দিয়া একটি-দুইটি শীর্ণকায় চঞ্চল ক্রীড়াশীল নির্ঝর গ্রাম্য কুটিরের চরণ সিক্ত করিয়া, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপলগুলির উপর দ্রুত পদক্ষেপ করিয়া এবং বৃক্ষচ্যুত ফুল ও পত্রগুলিকে তরঙ্গে তরঙ্গে উলটপালট করিয়া, নিকটস্থ সরোবরে লুটাইয়া পড়িতেছে।”
আর তার প্রথম উপন্যাস ‘বউ-ঠাকুরানির হাট’। এর শুরুটা এমন :
“রাত্রি অনেক হইয়াছে। গ্রীষ্মকাল। বাতাস বন্ধ হইয়া গিয়াছে। গাছের পাতাটিও নড়িতেছে না। যশোহরের যুবরাজ, প্রতাপাদিত্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র, উদয়াদিত্য তাঁহার শয়নগৃহের বাতায়নে বসিয়া আছেন। তাঁহার পার্শ্বে তাঁহার স্ত্রী সুরমা।
সুরমা কহিলেন, ‘প্রিয়তম, সহ্য করিয়া থাকো, ধৈর্য ধরিয়া থাকো। একদিন সুখের দিন আসিবে।’
উদয়াদিত্য কহিলেন, ‘আমি তো আর-কোনো সুখ চাই না। আমি চাই, আমি রাজপ্রাসাদে না যদি জন্মাইতাম, যুবরাজ না যদি হইতাম, যশোহর-অধিপতির ক্ষুদ্রতম তুচ্ছতম প্রজার প্রজা হইতাম! তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র — তাঁহার সিংহাসনের, তাঁহার সমস্ত ধন মান যশ প্রভাব গৌরবের একমাত্র উত্তরাধিকারী না হইতাম! কী তপস্যা করিলে এ-সমস্ত অতীত উলটাইয়া যাইতে পারে!’…”
দুই ধারার সাহিত্যের শুরুর প্রেক্ষাপট ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির। অ্যাস্থেটিক্স আলাদা। গল্প হলো গ্রামীণ, দরিদ্র, জীর্ণ অসহায় পরিবার নিয়ে। উপন্যাস লেখা হলো রাজা বা রাজপুত্র অর্থাৎ বিত্তবান, অনেকটাই নাগরিক জীবন নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘গোরা’ সর্বাধুনিক নাগরিক জীবনকাহিনি। এছাড়া তার অন্য কিছু উপন্যাসও আধুনিক, নাগরিক সংকট নিয়ে। টিকে থাকার সংকট, অর্থাৎ নিতান্ত মানবিক ক্রাইসিস তাদের নেই। গল্প ‘ছুটি’ টিকে থাকার সংকট, উন্মূল হওয়ার সংকট নিয়ে লেখা। ‘জীবিত ও মৃত’ গ্রামীণ সংস্কারের সংকট। মরিয়া কাদম্বরীকে প্রমাণ করতে হয় সে বাঁচিয়া ছিল। এই সংকট উপন্যাসে নেই। তারা আরো আয়েশি, তাদের সংকট নিতান্ত ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার। বাংলায় রবীন্দ্রনাথ যে-সময়টাতে ছোটগল্প নামিয়ে আনলেন তখন ইংরাজ শাসন জাঁকিয়েই বসেনি কেবল, এর যেন শেষ নেই এমন রাজনৈতিক বিশ্বাসও দানা বাঁধছিল। অন্যদিকে উপনিবেশের বিরুদ্ধে তরুণ-যুবা এবং সৃষ্টিশীলরা শান দিচ্ছিলেন তাদের রাজনীতি ও সৃষ্টিকর্মে। এই উত্তর-উপনিবেশিত মন ও তার প্রকাশ ছোটগল্পেই বেশি করে নিয়ে আসলেন রবীন্দ্রনাথ। নাগরিক জীবনের বিপরীতে আপামর ভারতীয় জনতা যে অবহেলিত, অনগ্রগতির মধ্যে রয়ে গেছে তা জানানোর জন্য ছোটগল্পের ময়দান যেন তিনি পেলেন।
পরবর্তীতেও এই ধারাটি রয়ে গেছে তো বটেই শক্তিশালী হয়েছে। উত্তর-উপনিবেশের দিকে যত ঝুঁকেছেন লেখকরা তত তারা ফিকশনে গ্রামকে, ‘প্রান্তীয়’ মানুষদের নিয়ে এসেছেন। কারণ শহর বেদখল হয়ে গেছে উপনিবেশি মন ও মেজাজের কাছে। নিজেদের যা বাকি ছিল তা আছে ওই গ্রামে, কৃষকের কাছে, নানা বর্ণের ও পেশার মানুষের কাছে। তাদের তুলে আনার মধ্য দিয়ে নিজেদের দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়াস ছোটগল্পের প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে। গ্রাম নিয়ে, নিম্মবিত্তের মানুষদের নিয়ে, গল্প লেখার চল ফলে আছেই।
বাংলাদেশেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উত্তরসুরীরা তা বজায় রাখছেন। নিজস্বতা সহকারেই তারা প্রতিভার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। ছোটগল্পকে মরতে দিচ্ছেন না। ঢাকা থেকে দূরে গিয়ে হলেও তারা তা টিকিয়ে রাখছেন। পাপড়ি রহমান সেই সেনানীদের একজন — তিনি যেন এক তপস্যায় নেমেছেন গল্প লেখার। ব্যস্ত নাগরিক জীবনের মধ্যে থেকেই, প্রচলিত অর্থে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাপ্তি না থাকলেও, গল্প লিখে চলেছেন। গল্পে তিনি পূর্ববাংলা, এখানকার অবহেলিত মানুষদের জীবনের বিচিত্র ভাব, জীবনেবোধ, বেঁচে থাকা, যৌনতাকে তুলে আনছেন। তাদের দর্শন, ভাষা সব মিলিয়ে পাপড়ির ছোটগল্প মহাকাব্যিক এক জীবনগাথার দিকে যায়। বিস্তীর্ণ এর পটভূমি, বিশাল এর ব্যাপ্তি, কোলাহলমুখর, আবার পরতে পরতে বেদনার শীর্ণ অথচ গভীর রেখাটি বয়ে চলেছে, চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে অধবোধনের জিজ্ঞাসা। পাপড়ি গল্পের ছলে ফাটল ধরিয়ে দিচ্ছেন সমাজ, সংস্কারে। নৈতিকতা, বিধিনিষেধের সংসারে সেসব ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়ছে অভাগা মানুষের মন আর শরীরের চাহিদা।
পাপড়ির গল্পের চরিত্ররা কোথাও যেন যেতে চায়। তাদের কপালের লিখন খণ্ডানোর দিকেই কী? হতে পারে। কোথায় সেই অদৃষ্ট তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তাদের কেবল আসহায় যাওয়া আছে। তারা নানা মানসিক রোগে ভোগে। একটা ইল্যুশনের মধ্যে থাকে। বাস্তবের ভিতর আরেক অবাস্তব তাদের অন্তরমানসে জন্ম লয়। বাস্তবের জীবন যেন তাদের জন্য নয়। তাদের কোথাও থাকার কথা, অন্য কোথাও। এবারের বইমেলায় পাপড়ি রহমানের ‘নির্বাচিত গল্প’ বইটির প্রথম গল্পটার কথাই ধরা যাক। ইন্তির এপিলেপ্সি রোগ হয়েছে। পরিবারপরিজন সব হারিয়ে সে আশ্রয় নিয়েছে আরেক নারীর কাছে। তার নাম আলেয়া। তারও এক মেয়ে ছাড়া কেউ নেই। তিন নারীর সেই যাপন। আলেয়া ইন্তিকে কেন যে রাখে নিজের সঙ্গে তা পরিষ্কার নয়। যদিও কিছু টাকা পায় মাসকাবারি। কিন্তু মনে হয় মানবিক কারণটাই প্রধান। এই মানবিকতাটা আসলে হয়তো একই অদৃষ্টের টানে সৃষ্ট। ইন্তির একেকবার একেক খেয়াল চাপে। একবার মনে হয় সে মা হবে। তার মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং সে মা হবে। মা হওয়ার স্বপ্নে ইন্তি বিভোর। অল্পেই রেগে যায় সে। বাস্তব জীবনবোধ লুপ্ত। তবু তাকে রেখে দেয় আলেয়া। বাস্তবিক জ্ঞানের কেউ তার জন্য নিরাপদ নয়, তাকে কেউ বন্ধুত্ব দেয় না। সেই আলেয়ার জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে ইন্তি।
কোনো এক মায়াপারাবারের দিকে যেন পাপড়ির চরিত্ররা যেতে চায়। তারা বিভ্রমে ভোগে। একের পর এক বিভ্রম। তা আর কাটে না। একের কল্পনার ভূমি অন্যে সঙ্গী করে নেয়। ‘নারী ও নাশপাতি বিভ্রাট’ গল্পে আব্দুস সালাম যে-নারীর প্রেমে পড়ার কথা সে-নারীকে ভুলে গিয়ে এক নাশপাতির নেশায় মজে যায়। নাশপাতিতে সে পথভ্রষ্ট হয়, নাশপাতিতে সে সমাহিত হয়। প্রত্যাখ্যাত সেই নারী, কী অদ্ভুত, অন্য পুরুষকে বিয়ে করার পর আবার নাশপাতিকেই সঙ্গী করে! নার্সারি থেকে অন্য পুরুষকে বিয়ে করার পর সেও একটা নাশপাতি কিনে বাসায় যায়।
পাপড়ির অনেক গল্প বাংলার মধ্যযুগের আখ্যানগুলোর মতো। পুঁথিতে যেসব আখ্যান পাওয়া যায় সেগুলোর মতো। অথবা ময়মনসিংহ গীতিকার কথা ধরা যাক। তেমন একটা মেজাজ কেন, শারিরীক গড়নেও মিল পাওয়া যাবে তার গল্পে। কাহিনি, চরিত্রদের স্বভাব, গীতল একটা ধারা, জীবনের কোনো এক দার্শনিকতাকে কথাচ্ছলে হাজির করা — এসব বিষয় পাপড়ির গল্পে রয়েছে। অনেক গল্পেই তিনি গান অথবা কবিতা জুড়ে দিয়েছেন। গল্পের মধ্যে থেকেই তারা গল্পের বাইরের দৃশ্যপট হাজির করে পাঠকের সামনে। গল্প বিস্তৃত না করেও এর দৃশ্যকে ছাড়িয়ে দেন পাপড়ি এভাবে।
তার গল্পে নারীশরীরের বিবরণও মধ্যযুগীয়। ‘পদ্মাবতী’ যেন আবার ফিরে এসেছে। মেটাফোর ব্যবহারের ক্ষেত্রে পাপড়ি আমাদের গ্রামীণ প্রকৃতিলগ্ন। সেখান থেকেই তিনি সেসব ধার করেন। এটাও উত্তর-উপনিবেশি চরিত্রলক্ষণ।
‘হলুদ মেয়ের সীমান্ত’ গল্পের মেয়েটির নামই তো হীরামন। এর শুরুটা এমন :
“তঞ্চবটি গ্রামে একদিন হলুদ উৎসব ঝেঁপে নেমে আসে। হলুদ রঙের তোড়ে ভেসে যায় প্রকৃতি। উড়নচণ্ডী বাতাস পুষ্পের সোনালি রেণু উড়িয়ে নিয়ে যায়। আসমানে, জমিনে যত্রতত্র গুঁড়ো গুঁড়ো পুষ্পরেণু ঝরে পড়ে। আর তঞ্চবটির বুকের ভেতর বয়ে-চলা কালিন্দীর জল উড়নচণ্ডী বাতাসে উথালপাথাল করে।”
যারা সেলিম আল দীনের নাটক দেখেছেন বা পড়েছেন তারা জানেন, তিনি বলেছেনও — বাংলায় মধ্যযুগের নাটকে এমনতর সাহিত্য বিদ্যমান ছিল। মানুষ সেখানে প্রকৃতির মঞ্চের এক কুশীলব। মানে অন্য সবকিছুর মধ্যেই মানুষ, আবার মানুষ অন্য সবকিছুকে প্রকাশ করছে। দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পদর্শন নামে বৈষ্ণব সাহিত্যে একটি ধারা বিদ্যমান ছিল। এটিও উপনিবেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজেদের দিকে যাওয়ার একটি রাস্তা হিসেবে অনেক শিল্পী বেছে নিয়েছেন। পাপড়ি সেই রাস্তার মুসাফির। তার গল্পের চরিত্ররা প্রকৃতির সঙ্গে উঠেবসে। প্রকৃতির মতো তারাও যেন মেঘ, পাখি, ফুল, অথবা নিরবধি নদী; — যার তলায় বেদনা, উপরে উচ্ছ্বসিত আনন্দ, কুলুকুলু তার বয়ে চলা, সে মায়াঅঞ্জনে বিদ্ধ। তার দৃষ্টি স্বপ্নাতুর। সে একের ভিতর অন্য।
আফ্রিকার উত্তর-উপনিবেশি সাহিত্যের স্বভাবের সঙ্গেও মিল পাওয়া যাবে। তারাও নিজ পরিচয় উদ্ধারে কেন্দ্র থেকে সরে গিয়ে সাহিত্য চর্চা করেছে। বিভিন্ন জাতি অথবা গোষ্ঠী তাদের ইতিহাস, পুরাণের দিকে গিয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের মিলেমিশে থাকার বিষয়টিও তাদের সাহিত্যে এসেছে। আফ্রিকার উত্তর-উপনিবেশিক চরিত্ররা প্রকৃতির সন্তান, পাপড়ির নির্বাচিত গল্পের চরিত্ররাও প্রকৃতির সন্তান।
লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে এক মায়া সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের দিকে তারা যেতে চেয়েছেন উপনিবেশকে প্রত্যাখ্যান করে। এর নাম আমরা দিয়ে থাকি ম্যাজিক রিয়েলিজম। আগেই বলেছি পাপড়িতে ‘ম্যাজিক রিয়েলিজম’-এর মতো কিছু ব্যাপার আছে। তা লাতিন থেকে তিনি নেননি বলা যাবে। বাংলার পুঁথিসাহিত্য, ওরাল সাহিত্য থেকে নিয়েছেন। আমাদের এখানেও জাদুবাস্তবতার মতো কল্পনানির্ভর বিবরণ, মেটাফোরিক্যাল উপস্থাপনা আছে।
তার একটি গল্পের নাম ‘ছহি বড় সোনাভান’। এর একটা অংশে আছে :
“সোনাভান নাম মেরা ছিনা আরামেতে ।। তোমার প্রসংশা আমি শুনিয়া কানেতে ।। সেই হতে দেল মোর আছে বেকারার।।”
এই গল্পে পারুলের মা পুঁথি পড়ে, মেয়েকে শোনায়। যদিও গলা তার আর আগের মতো নাই। আরেক ছেলে ঈমান আলিকেও সে পুঁথি শুনিয়েছিল জন্মের সময়। পারুলের মা স্বামী মরে যাওয়ার পর বাবার সংসারে পড়শি হয়ে লাথঝাঁটা খেয়ে পড়ে থাকে বারো বছর। কিন্তু এই দুঃসময়েও সে ভোলে না — ‘মানু লাগে মানুর জন্য।’ সেই পারুল আর তার মা ঢাকায় আসলে হানিফার সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে হয় পারুলের মায়ের। কিন্তু পুঁথি পড়া থামে না। হানিফার সঙ্গে বিবাদও হয়। হানিফা পারুলের মাকে ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু আবার একদিন ফিরে আসে। এসে ডাক দেয় ‘সোনাভান’ বলে। পারুলের মায়ের সমস্ত অস্তিত্ব যেন নড়ে যায়। পুঁথির চরিত্র সোনাভান কী সে নিজেই?
পাপড়ির চরিত্রদের এই মতি। তারা কোথা থেকে এসেছে ঠাহর করতে পারে না। নাগরিক চরিত্র তাদের নেই। চতুর না বেশিরভাগই। যদিও দুই-একটা গল্পে নাগরিক পাষণ্ডতা, রিরংসা পাওয়া যায়। যেমন — তার ‘মেঘহীন রাত ছিল পূর্ণগ্রাস চাঁদ ছিল’ গল্পের শুরুটা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করি :
“ঋতুর রহস্য বোঝা মুশকিল।
মাঘের বিকেল। হঠাৎ করে আমি আবিষ্কারক হয়ে উঠি। নূরীর বুকের মাংসে গুটি বেঁধে স্তন হয়েছে। এই আবিষ্কার আমাকে ঝাঁকি দিয়ে যায়। সে-ঝাঁকিতে আমার এতদিনের চেতনায় কেমন একটা চাষাভাব জেগে ওঠে। চাষার ঘামে ও কামে তড়পায় শস্যের পিপাসা।”
সেই পিপাসা মেটাতে গিয়ে নূরী শিকার হয় এক লোভী পুরুষের; তাকে মেনে নিতে হয় নিষ্ঠুরতা।
উত্তর-উপনিবেশি সাহিত্যের আরেকটি গুণ হলো তা ভয়তাড়িত। মানে ট্রমা কাজ করে তার মধ্যে। শোষণ ও নিষ্পেষণের মধ্যে থাকতে থাকতে এই ধারার ফিকশনের চরিত্ররা বিহ্বলতার মধ্যে থাকে। তাদের যেন গতজন্মের কোনো পাপ ছিল। অথবা তারা বজ্রাহত, মর্মাহত, তাদের সঙ্গে কোনো এক অদৃশ্যের চেনাজানা আছে। কী তারা সেটা বলতে পারে না। তবে সেই গায়েবি তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। সে জীবনের কোথাও থিতু হতে পারে না। ‘উন্নয়ন’ তার কর্ম নয়। সেই ভাষাও তার জানা নেই। পাপড়ির চরিত্ররাও এমন।
যৌনতাও উত্তর-উপনিবেশি সাহিত্যের আরকেটি দিক। কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রয়েড এই সাহিত্যকে খুব বেশি প্রভাবিত করেছে। পাপড়ির গল্পে আমরা ফ্রয়েডের প্রভাব দেখতে পাবো।
‘ফকিরচানের শীতঘুম’ গল্পে ফকিরচান শীত আসলেই কেবল ঘুমায়। বছরের বাকি সময় ঠিক থাকলেও শীতে তার ঘুম নামে চোখে। ব্যাঙের মতো। তার বউ সরবতী বিষয়টি আগে জানত না। সংসারে আছে আরেক চরিত্র জমিলা, সরবতীর শ্বাশুড়ি। যখন ফকির সুস্থ থাকে তখন রাতে তাদের সোহাগশব্দে হিংসা জাগে জমিলার। সরবতীকে সে ঈগলের মতো চোখে চোখে রাখে। ফকিরচান এরপর একবার আবারো শীতঘুমে গেলে জমিলা হাত চেপে ধরে সরবতীর। সরবতীর হাতের চুড়ি ভেঙে যায়।
এখানে জমিলা সরবতীর অভাব পূরণের দায় বোধ করে। ফকিরচান পুরুষ কিন্তু জমিলা নারী। ফ্রয়েডের মতে নারীর মধ্যে এমন এক ইগো তৈরি হয় যা তাকে যৌনতাড়িত করে। সে পুরুষলিঙ্গের অধিকারী ভাবতে থাকে নিজেকে। সরবতীর দিকে জমিলার সেই যৌন অধিকারবোধ তৈরি হয়। এসব যৌনতার উৎসও ভয় ও বঞ্চনা, যা উত্তরউপনিবেশি মনের প্রতিক্রিয়া। অবদমিত মনের বাসনা বিভিন্ন উপায়ে নিজের প্রকাশ ঘটায়।
উপনিবেশি চরিত্ররা হয়ে থাকে ভুখা, অনটনের সংসারযাত্রী, রোগা, নিয়তিতাড়িত, অসুস্থ … ইত্যাদি। পাপড়ির গল্পের চরিত্ররাও তা-ই।
পাপড়ির ‘নির্বাচিত গল্প’ বইয়ে অনেক গল্প আছে। সব নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয় এখন। তবে তার মূল সুরটা ধরে আলোচনার চেষ্টা করেছি। নইলে তার গল্পে উল্লেখিত ফুল, ফল, গুল্ম ইত্যাদি নিয়েও আলোচনা করা যেত। এগুলোও উত্তরউপনিবেশি সাহিত্যের গুণাবলির মধ্যে পড়ে। পাপড়ি বিভিন্ন এলাকার ভাষাও তুলে এনেছেন যথাযথভাবে। পুঁথি সংগ্রহে তার নিষ্ঠা ও শ্রমের তারিফ করতে হয়। তিনি নারীবাদী, তার গল্পে নারীরা উচ্চ মর্যাদায় আসীন। তাদের রয়েছে ব্যক্তিত্ব ও প্রেম। যৌনতায় তারাও সক্রিয়। পুরুষের কাছে তাদের কোনো ধারাবাঁধা নেই। পাপড়ি রহমানের গল্প পাঠক পড়বেন আশা করি।
তার বইটি প্রকাশ করেছে চৈতন্য। প্রচ্ছদ করেছেন চারু পিন্টু। দাম ৪৫০ টাকা।