ডায়রি অফ অ্যা উইম্পি কিড । জাহেদ আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুন ২০১৭, ১১:৪২ অপরাহ্ণ, | ৪৫৪০ বার পঠিত
দিনভর বৃষ্টিতে স্নিগ্ধ অন্ধকার হয়ে আছে বাড়িটির চারিধার। শ্যামলসিক্ত চরাচর। না, কথাটা আদৌ সর্বাংশ সত্য হইল বলা যাবে না। দৃশ্যত তা-ই, সিক্ত ও শ্যামল, প্রকৃত প্রস্তাবে পুরোটা তা না। বিনয় নয়, যে-কথাটা আপনার নিজের বুকের অথবা মাথার বা হৃদয়ের ভেতর হইতে উৎসারিবে, কিংবা অন্য কোনো অজ্ঞাত স্থল-জল-অন্তরীক্ষ হইতেও উৎসারণ ঘটিতে পারে, সেই কথাটা বলতে আপনি অভ্যস্ত নন। আপনার অক্ষরদীক্ষা, আপনার আচরিত ধর্ম ও সমাজশিক্ষা, আপনাকে সেইটে শেখায় না। আপনাকে উপরন্তু কঠোর কৌশলে নিরস্ত করে সেদিকপানে যেতে, এবং আপনি নিজেও উদগ্রীব সমাজের সম্মানিত সদস্যপদ লভিতে, কাজেই কবেকার কালিদাসকাল হইতে এতাবধি আপনি উজ্জয়িনীপুরেই বিরাজিছেন, আর আপনার শ্যামলসিক্ত চরাচর অবিকল-অবিকৃত ও অফুরান। অথচ ঘটনা হলো, যত শ্যামলই কিংবা যতই সিক্ত হোক, বাংলাদেশের শহরতলিগুলোতে এখনও নিসর্গচিহ্ন উবে না-গেলেও নিপাট-নিভাঁজ-নিষ্পঙ্ক তো নয় সেকেলে ন্যাচারাল সিনারিজের ন্যায়। রবীন্দ্রনাথের বইয়ের বৃষ্টি ও তজ্জনিত অন্ধকার আঘ্রাণ এখনকার বইপাতায় পেলে সেইটে মেকি মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় বৈকি। কিন্তু সবুজাভা আজও বহাল, অন্ধকারের মিষ্টি বিষাদও অনুপস্থিত নয়, এরপরও বলা যাবে না কেন অদ্য শ্যামলসিক্ত চরাচর? বলা যাবে না কেন, যাবে, বলতে কে আটকাবে আপনাকে! একটু টোন-ডাউন করে বলার মতন প্রকৃতিচিত্রবাস্তবতা আজও তো বিরাজে। সে-সবই ঠিক আছে। কিন্তু কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। সবুজ ছবিটা ভাঙাচোরা বা আধা বা আস্ত-আনামৎ যেভাবেই হোক আছে, বৃষ্টি হয়, বৃষ্টিবিকিরিত অন্ধকারও অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু সুরটা নাই। কোথায় যেন সুরটা ব্যাহত, ফলে গান নাই গাছে গাছে, ওয়েল্ডিং মেশিনারিজ ও অট্টালিকা বানানেওয়ালাদের আওয়াজ শহরতলির ভাঙা-ভাঙা সবুজের ফাঁকে ও ফোকরে। কেমন যেন খাপছাড়া আশপাশ। অনেকটা ওই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সিনেমার ছাড়াভাঙা প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত সেলুলয়েড ফ্রেমের মতন। অথচ স্ক্রিন জুড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। চেনাজানা গাছপালাও মর্মরিত জলস্পর্শে। একটানা ভারী বর্ষণ। কখনো জোর আওয়াজে, থেকে থেকে বিরতি দিয়ে, থেমে থেমে কখনো-বা। আর বৃষ্টিদিনের সুন্দর সুসহ শীত। অনুষ্ণ নরম আরাম। সারাদিন বৃহস্পতিবার। আশ্চর্য ব্যাপার, সারাদিনের মধ্যে একবারও শুক্র অথবা মঙ্গল না-প্রবেশিল! অথচ মন্থর আলস্য। সর্বত্র বস্তুসমক্ষে যেন ঘুমজড়িমা মাখা। গাঢ় ঘুম। সুন্দরবনাঞ্চলের খাঁটি মধুর মতো ঘন ঘুম সারাদিন। রাইতের বেলা অনিদ্রা আপনার নিত্যসঙ্গী, ইন্সোম্নিয়া বা আর-কোনো বদখত কি মিঠা ব্যাধিনামে আপনি তারে ডাকিতে নারাজ, প্রায় গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে নৈশ অনিদ্রা আপনার। উপভোগ্য, আলবৎ, উদযাপনযোগ্য অনিদ্রা। আজকে একটানা আওয়াজে ঘুমাবার দিন, নিদ্রালোকদীপ্তির দিন, অথচ মওকা পাওয়া সত্ত্বেও আপনি ঘুমাইলেন না সারাদিনে। একদিন পস্তাইবেন। যখন মরিয়া যাইবেন, তখন তো ঘুমের টাইম পাবেন না। যা-হোক। ঝরিতেছে বৃষ্টি দিনভর, সহসা তার থামাথামি নাই বলেই মনে হয়, আজি দিনভর রাতভর অঝোর ঝরঝর। অনেকটা এই ডায়রি যেমন — ডিডি, ডিজিটাল ডায়রি — থেমে থেমে, থেকে থেকে, জিন্দেগিভর। বৃষ্টিটা — ভাগ্যিস! — অ্যানালগ আজও।
দশটা চুয়ান্নয় বৃষ্টি দিলো ধুমিয়ে স্পেইসশিপ উপুত করে। এর আগে এবং এর পরেও অবশ্য বর্ষণমন্দ্রিত পরিপার্শ্ব। বস্তুত বর্ষা তার সুনাম রাখল অন্তিম শ্রাবণদিনে। এবং মনে হচ্ছে দেখেশুনে যে ইট ইজ টু বি কন্টিন্যুড। সাইন অফ দি রেইন এখন উইন্ডোসংলগ্ন অড়বড়ই আর লেবুগাছটার পাতায় পাতায়। রেইনি দিনের সাউন্ডএফেক্ট ঢেউটিনে, জানালাকার্নিশে, গাছপত্রালিতে, এবং সর্বোপরি হাঁসের প্যাঁকপ্যাঁক-গাঁকগাঁক আর গাইগোরুর মেঘের মন্থরতামাখা হাম্বারব। সবকিছুতেই বৃষ্টির বিলম্বিৎ খেয়াল বাজিতেছে। এ এমন দিন, ওয়ান্স-আপঅন-অ্যা-টাইম ইন বেঙ্গল এই কিসিমের রেইনিডে এলে নিউলি-ম্যারেড কাপলেরা ফাঁকতাল খুঁজত শুধু মুরুব্বিদের মুচকিহাস্য এড়িয়ে কেমন করে দুয়ারে খিল তোলা যায়। একান্নবর্তী পরিবার তখনকার প্যাটার্ন, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী লিখিত ‘বারো ঘর এক উঠোন’ উপন্যাসের ছবি নিখুঁত না-হলেও অনেকটা তা-ই, বছরভরা ধান-পাট চাষের কাজকম্ম এই সময়টায় এসে একটুখানি বিরাম পায় যেন, হুঁকো ফুঁকে পুঁইলতার পাশে দাওয়ার কোণে মাটির তোলা-উনোনে চালভাজা কুড়মুড় করেই দিন কাবার করে দিত নব্যবিবাহিত যুবকেরা। আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র জুড়ে বৃষ্টিকাল কন্টিন্যু করত, অলমোস্ট দুনিয়াভাসা বারিষা। কাজেই বৃষ্টির তেজ, বৃষ্টিস্টিম্যুলেশন, শরীরে সাপের-শঙ্খলাগাজনিত বিবশ বাসনা — আজকের যুগের তুলনায় তখন কতখানি বিপজ্জনক প্ররোচনা জাগাত বৃষ্টিদিনে আবহমান বাংলার নব্যযুবাদেহে, তা তো অনুমান করা দুরুহ হয় না। আর তখনকার মুরুব্বিরা ব্যাপারটা বুঝতেন, বৃষ্টিসিজনে নবদম্পতি ছেলে-ছেলেবউ বা নাতি-নাতবৌয়ের হেন আচরণ, এহেন প্রকাশ্য দিবালোকে বাপদাদার চোখের উপর দরজা-আঁটা কারবার, বড়দের উদার প্রশ্রয়ে বেশ মুখটেপা স্বাগতনয়নে দেখতেন। বড়জোর গলা-খাকারি দিয়া ব্যাপারটা সিভিলাইজেশনের সীমারেখায় টেনে রাখতেন। কে-না জানে যে, শব্দের গতি আলোকাপেক্ষা বহুগুণে বেশি। কিন্তু যা-হোক, এই বৃষ্টিসমাজচিত্র অবশ্য আমাদের জন্মের আগের। আমরা পেয়েছি ইশকুলফ্রেন্ডলি বৃষ্টির দিন। মানে, বৃষ্টিসিজনে ইশকুল ঢিলেঢালা থাকত, আধাবেলা বাদে বৃষ্টি সাঁতরে বাড়ি ফেরা যেত। গল্পটা আরেকদিন, অন্য কোনো সময়, ভবিষ্যতের কোনো বৃষ্টিডে এলে। এখন, কথা হলো, আগের কালের বৃষ্টির সেন্সুয়াল দিকটি চিত্তাকর্ষক ছিল। বর্তমানকালে, যে-যা-ই বলুন, রেইনিসিজন একেবারেই অযৌন, ফলে মানবজাতির বিস্তার ও প্রসারে এখনকার বৃষ্টি আগেকার মতন অবদান রাখতে পারছে না।
গতকাল হয়েছিল সবাক বৃষ্টিপাত, সারাদিন সারারাত, আজকেও সবিরাম। রবীন্দ্রনাথ সাহেবের গানে সেই-যে এক ময়নামতির মাঠে দেখা মেয়েটির কথা আছে, যে-মেয়েটিকে আমাদের বিশ্বকবি সাহেব কৃষ্ণকলি নামে ডেকেছেন এবং বলেছেন যে গাঁয়ের লোকে মেয়েটারে কালো বলে চেনে এবং জনসমক্ষে চেনায় যেইটা আবার নৌকাভ্রমণথার্স্টি কবির মনঃপুত হয় না, কাজেই তিনি তার স্বভাবমতন মেয়েটার বাপদত্ত নাম ভুলিয়ে দিলেন, সম্বোধিলেন কৃষ্ণকলি নামে, এবং মেয়েটার মা-বাপের রাখা নামটা আমাদের আর জানাই হলো না কোনোদিন। রবিমামার এই এক স্বভাব, সবকিছুর নাম নিজের মর্জিমাফিক পাল্টে দেয়া। কাজটা তিনি এতই ফ্রিকোয়েন্টলি করেছেন যে ক্যাল্কুলেটরে হিসাব নিয়া কুলাইয়া ওঠার মতো অবস্থা রাখেন নাই। বিনয় বলেছিলেন যে মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়। এই কথাটার প্রমাণ আমরা হাতেনাতে পেয়েছি জীবনযাপনের নানান ফোকরে। আমাদের ঠাকুরবাড়ির কনিষ্ঠ পুত্রসন্তানটি যাহার বা যা-কিছুরই নিকটে গেছেন, তাহার তথা তা-সবেরই নোমেনক্লেচার নিয়া হামলে পড়েছেন, বেচারা-বেচারিদিগের পৈতৃক গরিমার নামখানা পাল্টায়ে দিয়েছেন। উড়িয়ে দিয়েছেন সমস্তকিছুর প্রচলিত নামগর্ব। খর্ব করেছেন নামগরিমা, না বাড়ায়েছেন — তর্ক সেইটা না। কবিমর্জি নিয়া তর্ক চলে না। ব্যাপারটা ঠাকুর করেছেন, সম্ভবত দুনিয়ার খুব কম কবিই তাঁর মতন এতটা ব্যাপক সংখ্যায় আকিকানুষ্ঠান-অন্নপ্রাশনের পুরোতগিরি করার স্কোপ পেয়েছেন, কথা আপাতত এইটা। বাংলার তাবৎ ফুলপাখিতরুলতাগাছবিরিখের নাম রবি নিজের কলমে নতুন করে রেখেছেন, এমনকি নিজের বউয়ের নামখানাও কলমের এক খোঁচে দিয়েছেন বদলিয়ে। বেচারি বাজার-সরকারের মেয়ে, গরিবের ঘরের, গায়ের বরন কালো, গেঁয়ো ও অসংস্কৃত, অন্দরমহলে এসেই যখন গেছে তো ফুটফর্মাশ দিতে যায়ি কিছু-একটা তো সম্বোধিতে হবে, এখন ঠাকুরবাড়িতে খেঁদিপেঁচি নামে সান্ধ্যাহ্নিকে ডাকাডাকি তো চলবে না, কাজেই নামখানা দাও বদলিয়ে। এবং মজার ব্যাপার যে, বাড়ির সব বউঝিয়েদের নামের শেষে উনি (কিংবা উনারা তথা বাবামশাই-দাদামশাই মিলে যে-একটা ঠাকুরখান্দান তারা) আসমান জুতে দিয়েছেন, মানে অম্বর তথা তার স্ত্রীবাচ্যার্থ অম্বরী, কিংবা আর্টকাল্চার অর্থাৎ নন্দন তথা তার ফেমিনিন নন্দিনী ইত্যাদি। কিন্তু ভেবে দেখুন ব্যাপারখানা একবার, রবীন্দ্রনাথ এতই অবধারিত হয়ে উঠলেন একটা জাতির কাছে — না, ভুল বললাম, উভয় বাংলার পুরা জাতির কাছে নন, রবীন্দ্রনাথ অবভিয়াস মুখ্যত অক্ষরজ্ঞাত একটা অংশের কাছে, যে-অংশটা আবার জাতির কলকাঠি নাড়ায়, ঢাকঢোল পিটায়, ঝাঁঝর বাজায় ইত্যাদি — অ্যানিওয়ে, এহেন মহীরুহপ্রতীম অবধারিত হয়ে-ওঠার ফলে সেইসব হারানো সুরের নামগুলিরে আর ফিরিয়া পাওয়া হইল না। আপনার চারপাশের যে-কোনো ফুল বা গাছের নাম নিয়ে এইটা বাজায়ে দেখতে পারেন। দেখবেন যে ঠাকুরের রাখা নামে আপনি সেই ফুলটারে সেই গাছটারে এতাবধি ডাকিয়া যাইছেন। বহু পুঁছতাছ করে আপনি হয়তো ফুলের লোক্যাল নেইমটা জানতে পারবেন। শুধু যদি সাহিত্যশিল্পের বেলায় নামগুলো জারি রইত, পরিতাপের কিছু ছিল না তাতে। রবীন্দ্রনাথ অচিরেই তো হয়ে উঠলেন নিত্যকৃত্যেরও অনুষঙ্গ। ফলে কৃষ্ণকলি নামটাই অমর হইল, করিমুন্নিসা বা কামিনীবালা নামখানি রবীন্দ্রাভিপ্রায়ের যাঁতাকলে জায়গা পাইল না দেবলোকে। ব্যাপারটা আরও ইন্ট্রেস্টিং যে, এক জীবনানন্দ ছাড়া বাকি সকলেই তাদিগের পোয়েটিক ডিকশন জুড়ে রবীন্দ্রনাথপ্রস্তাবিত ফুলনাম-তরুনাম বিনিয়োগ করেছেন, নজরুলের গানেও দেখবেন যে মাধবীলতা-মধুমালতী ইত্যাদি ফুল সুলভ, উত্তররৈবিক তিরিশি জীবন-ব্যতীত চতুষ্পাণ্ডব তো রবি-ফিচারিং কয়েনেইজ্ দুই-হাতেই ইস্তিমাল করেছেন, জীবনানন্দই শুধু গাছের-ফুলের-কীটের অকাব্যিক নামগুলোই যথাসাধ্য লগ্নি করেছেন। ব্যাপারটা সিগ্নিফিক্যান্ট কিন্তু। তো, সেইটাই, রবীন্দ্রনাথের দোষ নাই কোনো। বরং কবির কাজই তো এইটা। দুনিয়া নতুন নামে নামাঙ্কিত করে যাওয়া, য়্যুনিভার্সটাকে রিডিফাইন করা, আসমুদ্রহিমাচল রিডিস্কাভার করা, কাজেই রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে এমআই-অ্যাইজেন্ট টম ক্রুজের চেয়েও সফল। অপরাজিত, অপ্রতিহত অদ্যাবধি, অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রায়, মিশন সাক্সেসফুল কবি হি পরমন্তপ। দুঃখে বক্ষ বিদীর্ণ হইয়া যায় যখন দেখি যে রবীন্দ্রশিক্ষিত অনেক ইয়ারবখশি এহেন গোঁ ধরেন যেন কৃষ্ণকলির বাপের ডাকা নামটা যা-ই-হোক অতি-অবশ্যই নির্নন্দন-নির্গুণ, অতি-অবশ্যই অশ্রাব্য হইতে বাধ্য। ওহো ইয়ার, ব্যাপার তা না-ও তো হইতে পারে। এখন দুঃখ করে তো লাভ নাই। রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা সারিয়া লইয়া ঠাকুর তাঁর সোনার তরী নিয়া পাড়ি দিয়াছেন অমরলোকে। এই ফুরসতে আমরা বাইর করিয়াছি রিসার্চপূর্বক যে, রবীন্দ্রনাথ সাহেবের সাহিত্যে একটা মাল অনুপস্থিত, — বিলকুল নাই সোজা বাংলায়, — সেইটা হইল গালিগালাজ। না, তা-ও বলা ঠিক হবে না, গালিগালাজ রবীন্দ্রসাহিত্যে আছে, অভিযোগের তর্জনী উঠাইতে তিনি আজিকার কোনো পোলাপান প্রতিবিপ্লবীর চেয়ে এতটুকু কম স্পর্ধাসাহস দেখিয়েছেন এমনও নয়, বরং অনেক বেশি এবং বাপের দুর্দান্ত ব্যাটার মতন দুঃসাহসও প্রদর্শিয়াছেন পাতা-পত্রান্তরে, কেবল তাঁর বকাবাদ্যির ভঙ্গিটা আমার-আপনার মতো পল্লবগ্রাহী কিছু অথবা শাখামৃগবৃত্তি ঢিল-ছোঁড়াছুঁড়ি কিছু না, তাঁর গালিগালাজ বর্ণনাত্মক। তবে খিস্তিটা আমরা তাঁর সাহিত্যে একেবারেই পাই না, আক্ষেপের অন্ত নাই তাই। খিস্তি নাই বলে, একেবারে কাঁচা খিস্তিটা রবীন্দ্রসাহিত্যে অ্যাবসেন্ট বলে, বেশিদিন তিনি আর লাস্টিং করতে পারবেন বলেও মনে হচ্ছে না। তাঁর জন্য শোকসন্তপ্ত হয়ে একখানি নিবন্ধনোট রচনার দিন বোধহয় এসেই গিয়েছে। কেবল একটা পাথেয় নাই বলেই, খিস্তিহীনতায় হায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়, তিনি আর বেশিদিন টিকতে পারবেন বলে মনে হয় না। বাংলার তাবৎ গাছপাখিফুলপালা ঠাকুরের, আর জগতের যত খিস্তিখেউড় তাবতের সোল্-ডিস্ট্রিব্যুটার আপনি-আমি — গরবিনী ব্যাপারই তো, কী বলো বউঠাকরুন? আইজ্ঞা, তা-ই। রাইতে-দিনে ভাইয়ে-ভইনে / গালি হাঁকাও মদ্দা ভাই / সব কবিতাই মিনমিনা বাল / বীরবিক্রম তোমারটাই / / গালিয়া বানাও বস্তা বস্তা / আনন্দের আর সীমা নাই / তুই আর মুই ছিন্নমস্তা / লাইন দেইখ্যা হাইট্টা যাই। … তা, রেইনিদিনে এমন পদ্য তো সদ্য পাগলেও বানাইতে পারে। এইসব শ্রদ্ধা, এইসব মুগ্ধতা, এইসব উচ্ছ্বাস … এইগুলা আকাইম্মা। গালিগালাজেই মোরা ভুলাইব ভবি, নিজেরই নিতম্বপ্রদেশে এক্সট্রালার্জ ছিদ্র বানায়ে আর্কিমিডিস্ ও রবীন্দ্রনাথ উভয়েরে এক্কেরে এক-লেখাতেই পিছু হটাইব, হুঁহুঁ। রবীন্দ্রনাথের অব্যবহিত আগের আরেক ঠাকুর তথা রামকৃষ্ণের বউ শ্রীমা সারদা দেবী সেদিন কথাটা মারাত্মক কয়েছিলেন ভায়া, মনে আছে? সেই-যে গো, ভক্ত-আশেকানদিগের পূজাপেন্নাম দেখে বেহদ্দ মা সারদা বিরক্তিবশতই হয়তো বলেছিলেন : “কালের ঠাকুর, কালেই ভেসে যায়।” সেইটাই। কী প্রগাঢ় পণ্ডিত সজনীকান্ত ও তস্যাতিতস্য ফরেন-ন্যাটিভ উচ্চনাসিকা মালমাত্তাদিগেরে তোমরা কি পূর্বে হেরো নাই? তারপরও তোমরা সজনীকান্ত হইতেই ইয়াআলি নিনাদে ঝাঁপাইতেছ? তো, মন্দ কি, ঝাঁপাও। অনিবার এমন রেইনিদিনে কেন-যে খালি ঠাকুর-অবতারদিগেরেই মনে পড়ে, কেন-যে হৃদয় পুঁচকে পণ্ডিতদিগেরে লাইকিতে চায় না, হায়! অ্যানিওয়ে। একটা কথা ভুলেই গিয়েছি বলতে যে, রবীন্দ্রনাথ নিজের পিতৃদত্ত নামখানা কিন্তু বদলান নাই, দুনিয়ার সমস্তকিছু নতুন নামে কাতিব করিয়া তুলিলেও নিজের পুরানা নামটারেই তিনি দিনের-পর-দিন তেল-জল দিয়া নতুন ও প্রতিষ্ঠিত করিয়া গিয়াছেন। ঠাকুরবুদ্ধির লগে পেরে ওঠা তো গালিনির্মাতা আপনার-আমার মিশন না।
যখনই আপনি মনে মনে ভাবছেন যে এই বুঝি বৃষ্টি বিরাম পাইল, তখন পূর্বাপেক্ষা সজোরে-সবেগে বইতে লেগেছে বৃষ্টি, মহা আমোদে সে আপনারে আঁতান্তরে ফেলে তেরোগুণ তুড়ির শব্দে নাচিছে তা-তা-থৈ। এমন তো হতেই পারে যে আপনি বিকট কোনো কর্মসম্পাদনোদ্দেশে বেরোবেন বসতবাটীর বাহিরে, সে আপনার মনস্কাম বুঝিতে পাইয়া রাত্তিরেই ঠিক করিয়া রাখিয়াছে প্ল্যানপ্রোগ্রাম, এই হলিডে-অবকাশে যেন আপনি হিপহিপহুররে রেইনিশৃঙ্খলে ফেঁসে যেয়ে যেতে না-পারেন ওগো আজ ঘরের বাহিরে, এইটা পাক্কা। যা-হোক, মন্দ বলছি না, এই সিজনে এবার এতদঞ্চলে রেইনপাতমাত্রা আশঙ্কাজনক হারে অল্প। খোদা জানে এবারের মতো পরেরবারও পুনরাবৃত্তি হয় কি না আভাগীর বেটি বৃষ্টির স্বল্পমাত্রা নাচন। গোটা এই দেশের তো বদনাম হয়ে যাবে তাতে, দেখানো যাবে না মুখ দূরদুরান্তের শ্রীহট্টভক্তআশেকান ইয়ার-বখশিদিগেরে, এমনিতে অবশ্য বাবা শা’জলাল আছেন বিধায় পর্যটন কর্পোরেশনের আয়-ইনকাম নিয়ে এখনো দুশ্চিন্তার কিছু নাই, কিন্তু জলবায়ুওয়ালাদের কন্সার্ন আমলে নেয়াও তো দরকার। হাওরছাড়া খালি একটা মাজার দিয়া ব্যবসাপাতি হয়তো ভালোই চালানো যাবে, প্রেস্টিজ তো থাকবে না হে! রেইনরিয়্যাল্ সিটি সিলেটের প্রেস্টিজ্ ও প্রাইড তো তার বৃষ্টিই, তাই না? কাজেই বৃষ্টি নিয়া আপোস নাই। সিলেটি বৃষ্টি তো সিলেটি বৃষ্টিই, চিটাগাঙে যেয়ে এই জিনিশ তো লভিবার নয়। এবং শ্রীহট্টবর্ষণ তো ওই দার্জিলিং রেইন না। ফারাক কোথায় দুইটায়? দার্জিলিং রেইন মাথায় নিয়া আপনি হিমালয়শিখর উঠিয়া আবার নামিয়াও আসিবেন, দুই-তিনগাছা চুল আপনার ভিজব নিশ্চয়ই। কিন্তু সিলেটবৃষ্টিতে এ-ঘরের দাওয়া হইতে একলম্ফে ও-ঘরের দাওয়ায় যাইতে লেগেই হৃদি-দেহ-মন-মাথা ভাসিয়া যাইব সর্বাঙ্গ শোভাশ্রাবণজলে। রেয়াত নাই বৃষ্টিবিপুল শ্রীহট্টমন্দিরে এসে ভেজা-সপসপ হওয়া হইতে একজনারও। জ্বরজারি-হ্যুপিংকাশি সিলেটের ব্যাঙসমাজে তেমন-একটা নাই বললেই চলে। হলে হবে রাজরোগ, মানে বৈরাগ বা সন্ন্যাস, মানে এই বৃষ্টিবীথি ছেড়ে যেতে বেঁকে বসতে পারেন আপনি। এইটা একটা ঝুঁকি নিশ্চয়, এটুকু ঝুঁকি তো নিতেই হয় একজন অভিযাত্রীকে, নয় কি?
তিন-চারটে খয়েরি-চিবুক পাখি পুবদিকের জমিনে তুরতুরিয়ে চরে ফিরছে। সকালবেলার পাখি। সবার আগে জেগে উঠেছে। কুসুমবাগ তো গোটা লোকালয়েই নাই, কাজেই তারা এই কচুরিপানাস্তুপে ঠোঁটতল্লাশি করে খুঁজিছে ব্রেকফাস্ট। আমার ব্যবস্থা আছে, আশা করি আপনারও তাই, যেন পাখিদেরও জুটে যায় প্রেটি-গুড ব্রেকফাস্ট। অবশ্য বৃষ্টি হয়েছে একটানা দুইদিন, ভিজেছে ভূভাগ, ফলে কেঁচো ও অন্যান্য মাটিপোকার মাংশল শরীর খুঁজে পেতে বেগ হচ্ছে না পাখিদের। হাঁসেদেরও তা-ই। বৃষ্টিশেষের রোদ ক্রমে বিস্তার পেতে চাইছে নিমগাছ ছাড়িয়ে দূরে। বেশ সুপ্রভাত-সুপ্রভাত ভাব চারিপাশে। ছেড়ে এলাম পাখিদেরে। এসে বইয়ের তাকিয়া থেকে টেনে নিলাম পাখিবই। ‘বাংলাদেশের পাখি’। শরীফ খান প্রণীত বইটি দু-খণ্ডে সম্পূর্ণ, শিশু অ্যাকাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত। (সুবিস্তৃত গবেষণাগ্রন্থও প্রকাশ হয়েছে উনার, পাখি বিষয়েই, অন্য প্রকাশনাগার থেকে অবশ্য, যদিও শিশুবইজোড়াই অধিকতর উপভোগ্য) খুব চমৎকার সংক্ষিপ্ত লেখা আর চিত্রসম্বলিত বই। পেপারব্যাক বাইন্ডিং। বইয়ের পাখিগুলো বহুকাল আগে আমি যখন প্রবেশিকা শ্রেণিতে পড়তাম, তখন ‘শিশু’ পত্রিকায় এসব ছাপা হয়েছে। একটানা বহুদিন পত্রিকাটা বেরিয়েছে পাখিপ্রচ্ছদে। টিলাগড়ের ‘গ্র্যান্ড ব্যুক স্টল’ থেকে এই পত্রিকা কিনতাম প্রতিমাসে পাঁচ টাকা দিয়ে কেবল পাখিপ্রচ্ছদগুলোর জন্য। বইদোকানটা আজ আর নাই সম্ভবত। শরীফ খানের পাখিলেখাগুলো বই হিশেবে বেরিয়েছে বেশ বছর-দশেক আগে। এ-মুহূর্তে সেকন্ড পার্ট হাতে নিয়ে দেখতে পাচ্ছি এখানে ২১টি দেশি পাখির পরিচিতি দেয়া আছে। উল্টেপাল্টে ইতস্তত আদর করছি আলতো আঙুলে এই পাখিপুস্তিকাটি। পাখিসিনেমা, পাখিবই। একুশটা পাখির প্রতিকৃতি ও জীবনবৃত্তান্ত ছাপা হয়েছে। এর মধ্যে কেবল ‘ছিট ব্যাবলার’ পাখির রঙিন ছবি খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। আঁকা আছে। ফোটোগ্রাফ তোলা সম্ভব হয়নি নিশ্চয়। অ্যানিওয়ে। একুশটা পাখির নাম উচ্চারণ করে এই সকাল শুরু করা যাক। জলপাখিদের মধ্যে রয়েছে একে একে : পানকৌড়ি, ডাহুক, জলপিপি, মাছরাঙা, বালিহাঁস, বক, রঙিলা বক ও মদনটাক; মাঠপাখিদের মধ্যে যেমন : কসাই, নীলকণ্ঠ, লাটোরা, ছিট ব্যাবলার, মোহনচূড়া; অন্যান্য পাখির কাতারে এরা : বসন্তবৌরি, কেশরাজ, লেজনাচুনে, দিনকানা এবং পাপিয়া। পিউ কাঁহা … পিউ কাঁহা …
ঠাঠা রইদ মাথায় নিয়া আপনে গেলেন বিয়া খাইতে, যেতে যেতে দুই বেজে পনেরো পার, টেবিলে খানা লাগতে লাগতে পৌনে তিন, বাতানুকূল বিবাহভোজনগৃহ হইতে বেরিয়ে দেখেন বৃষ্টি বিছায়ে রেখেছে তার মোহনীয়া মায়াফাঁদ। লও ঠ্যালা, সামলাও এইবার, পানবিড়ি খাইতেও তো লোকে একটু নিজের মতন নির্জন কোণাকানা চায়, বৃষ্টিতে সেই জো নাই। বিতিকিচ্ছিরি সিচ্যুয়েশন বলা যাইত, তবে সেইটা আপনে বলতে পারছেন না — কারণ, মন্দ লাগছিল না মানুষজনের ইতিউতি উদ্বিগ্ন ও উদ্ব্যাস্ত চরাফেরা। আমাদের দেশে এখন বিয়াশাদি তো কম্যুনিটি সেন্টারে সম্পন্ন হয়। এমনকি এখন বর্তমানে এমন অঘোর গাওগেরাম খুঁজে বের করা যাবে না একটাও যেইখানে লোকে বিয়ে-থা আপন বসতবাটীতে আয়োজন করছে। একদম অজপাড়াগাঁয়েও কম্যুনিটি সেন্টার। আর সেইসব সেন্টারে একটাই বছরভরা আয়োজন, একমেবাদ্বিতীয়ম, বিয়ে। এখন ইদানীং অবশ্য কম্যুনিটি সেন্টারের অন্যান্য খাতে ব্যবহার প্রবর্তন হয়েছে দেখতে পাই। বিবাহবার্ষিকী, বার্থডে সেলিব্রেশন, বিদেশযাত্রা উপলক্ষ্যে বন্ধুবান্ধব-স্বজনাত্মীয় সমভিব্যাহারে ট্রিট, পোলিটিক্যাল পার্টির অ্যান্যুয়াল কাউন্সিল, ব্যবসায়ী সমিতির এজিএম, এনজিওর হেনতেন সেমিনার, বর ও কনে উভয় তরফের পৃথগন্ন গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠান তো অবশ্যই এবং এমনকি সুন্নত-এ-খৎনা আয়োজনেও কম্যুনিটি সেন্টার ভেন্যু হিশেবে প্রেফার করছে লোকে। একটা চেহলাম তথা চল্লিশাও খেয়েছে এই প্রতিবেদক, যদি জানতেই চান, কম্যুনিটি সেন্টারে। দেখবেন যে বিদেশের ব্যাঙ্কুয়েট হ্যলগুলো ভোজনের জন্য নির্ধারিত স্পেইস ছাড়াও লোকের কথাবার্তা-কুশলাদি কিংবা মূল খানাপর্বের আগে-পরে যদৃচ্ছা পানাহার-গল্পগুজব তথা রিক্রিয়েশনের নানাবিধ সুবন্দোবস্ত রাখে। এইখানে সেসবের বালাই নাই। খাও হুড়মুড়িয়ে এবং খেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে যাও। তবু দুই-চাইরজন থাকে যারা ছুরির নিচেও দম লইতে জানে। এদের কথা আলাদা। সর্বসাধারণ অভ্যাগতদের জন্য কম্যার্শিয়্যাল কম্যুনিটি সেন্টারগুলোতে এন্টার্টেইনিং সুযোগ-সুবিধাদি বৃদ্ধিকরণ অতীব প্রয়োজন। কেননা আপনি দেখবেন যে আপনার হপ্তার একটা উল্লেখযোগ্য সময় এইসব কম্যুনিটি সেন্টার বিহারে কেটে যায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পে ঝান্ডুদা যেমন হোটেলে হোটেলে বছরভর বিহার করে বেড়ান একটামাত্র স্যুটকেইস বয়ে, আপনিও তেমনি সপ্তাহভর কম্যুনিটি-সেন্টারবিহারী। গিফ্ট নিয়া বা গিফ্ট ছাড়া। ব্যাপারটা আপনার ইচ্ছে-অনিচ্ছেনিরপেক্ষ। সমাজের সভ্য হইবেন আপনে, আর কম্যুনিটি সেন্টার অ্যাভোয়েড করে চলবেন, পরিহার করবেন নেমন্তন্ন, তা তো হবার নয়। ফিরে চল অরণ্যে স্লোগ্যান নিয়া আন্দোলনে নামলে অবশ্য আলাদা কথা। কাজেই এই জায়গাটা, কম্যুনিটি সেন্টার, আরেকটু ক্রিয়েটিভলি ইউজ করার দিকে নজর দেয়া চাই। সিনেমাপ্রেক্ষাগৃহেও তো আর যাই না আমরা, বা বাজারে আমাদের পঞ্চায়েতি গসিপিং নাই ইন্ডিয়ার রাজস্থান প্রভৃতি প্রোভিন্সের ন্যায়, এইসব কম্যুনিটি সেন্টারগুলোই আমাদের স্যোশ্যালাইজেশনের অনন্যোপায় প্ল্যাটফর্ম। সেহেতু এই জায়গাটাকে মিথস্ক্রিয়াবান্ধব করে বানানো জরুরি। বিবাহকৃত্যাদিগুলো, আমাদের দেশে, একদা বাপদাদার আমলে যা-ও একাধটু ফুর্তিফার্তার ফল্গুধারা না-হলেও যথেষ্ট পার্টিসিপেইটোরি ছিল, এখন আমাদের আমলে স্রেফ ভাত-খাওয়ার লঙ্গরখানায় পর্যবসিত হয়েছে। একটা গাবর জাতি ছাড়া আর কোনো পরিচয় যারা দিতে চাইবে উত্তরপ্রজন্মের কাছে, এই নিয়া তারা নিশ্চয় ভাবে এবং ভাববে। অ্যানিওয়ে। বিয়া খাইতে যেয়ে আমরা খাদ্যবস্তুর ডিশ টেবিলে সার্ভ করার আগে এবং খেয়ে ঢেঁকুর তুলে বিদেয় নেয়া পর্যন্ত যে-একটা ব্যাপক টাইম স্পেন্ড করি কম্যুনিটি মিলনায়তনে, ভেবে দেখুন, এই সময়টায় ব্যক্তিগত-খোপে-থাকা মানবগোষ্ঠী কিছুটা হলেও গুহামানুষের স্ট্যাটাস থেকে নিজেদেরে উত্তরিত করে নিতে পারে নিশ্চয়। এইসব নিয়া নিশ্চয় ভাবিত হবে আমাদের ছেলেমেয়েরা। আমরা তো এখন ভূমিখেকো-বনখেকো-গরিবখেকো-ক্ষুদ্রঋণখেকো প্রভৃতির বাইরে তেমনকিছু হওয়ার চেতনায় নাই। রিসেন্টলি অবশ্য জঙ্গি নিয়া কালেক্টিভ কনশাস্ হয়েছি। কিন্তু ওইটা আদৌ স্বতঃস্ফূর্ত সংস্কৃতিশিকড়ের কনশাস্নেস্ বলা যাবে কি? রিকশাভ্যানচালক ভদ্রলোকের যে-একটা সাংস্কৃতিক স্ট্যান্ডার্ড ও সক্রিয়তা, টাকাব্যাকুল আমরা তার ত্রিসীমাতেও গরহাজির। সবখানে একটা আলটপকা স্যুপার্ফিশিয়্যাল্ সচেতনতা। ভাবের বা ভানের বাণিজ্য অবশ্য বজায় রেখেই চলছি ষোলোআনা। আর শেখে-সৈয়দে এবং চাটুজ্জে-চৌধুরী মিলে লুটিয়া চলেছি মিহি-বিরাট ভাণ্ডার। এ কী বাপু গণ্ডারের কাল! হোয়াটেভার। কম্যুনিটি সেন্টারে ক্রমে রেইনফ্যল্ কমে আসে। ততক্ষণে বেলা ভাটির দিকে অবশ্য। অপরাহ্ন অলমোস্ট সন্ধ্যার গায়ে যেয়ে হেলিয়েছে গা। হায়! এমন বরিষনমুখর সন্ধ্যা … আর কী হে হবে দেখা … রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে এ-জীবন উড়িয়া যায় দ্যাখো অচিন কোন্-এক না-ফেরা বন্দরের পানে …
কিন্তু কবে ও কোথায় বৃষ্টি তোমায় রেয়াত দিয়েছে বলো তো? যদিও এই সিজনে তেমন বলবার মতন বৃষ্টিপাত হয় নাই, কিন্তু গত দুই-তিনদিনে যেটুকু হয়েছে তাতে করে তো অন্তত অভাবজনিত ক্ষোভ প্রশমিত হয়ে যাবার কথা। আর এইটা আলবৎ ঠিক যে বেশ ক-বছর ধরে সেভাবে ভাসান পানি হচ্ছে না, বন্যা হয়েছিল সর্বশেষ ২০০৪ সালে, যার ফলে চাষের ছাড়া খালবিল-পুকুর-হাওরের মাছ পাতে জুটছে না। আমাদের নালা-জ্যাম-লাগা সাধের নগরীর স্যুয়ারেজ ক্যানেলগুলো বন্যা ছাড়া নগরোন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ঘটপূর্ণ প্রযুক্তিবুদ্ধি দিয়া সাফা করবার মুরদ তো অঙ্গুলিমাপ্য। ফলে বৃষ্টিনির্ভরতা আমাদের প্র্যাক্টিক্যাল কারণেই অনস্বীকার্য। বলতে-না-বলতেই তিনটা বাজিয়া সাতাশ মিনিটের রাত্তিরে এল সজোরে-সরবে বৃষ্টিমিছিল ধেয়ে। এখন সশব্দ সেই বৃষ্টি শুনতে শুনতে একটা ছড়া মনে পড়ছে। ছেলেবেলায় আদর্শলিপি বইয়ের পাতায় পাওয়া বহুলাবৃত্ত সেই ছড়াটার ঈষৎ-পরিবর্তিত অধুনা ভার্শন সেইটা। নার্সারি রাইমের একটা বাংলা পাঠোপকরণে সেদিন চোখে পড়ল। দুই-লাইনের বাচ্চাতোষ উত্তরাধুনিকতা : আয় বৃষ্টি কষে / আমরা আছি বসে। এইটুকুই। কিন্তু আমাদের নার্সারিবেলায় ছিল ব্যাপারটা : আয় বৃষ্টি ঝেঁপে / ধান দিব মেপে / লেবুর পাতা করমচা / যা বৃষ্টি ধরে যা। যা-হোক, ঘটনা এইটুকু। আমাদের ইদানীংকার কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে গেঁয়ো ও শহুরে সর্বশ্রেণির শিশুশিক্ষার্থীদের কাছে সবকিছুই মোড়ক বদলিয়ে প্রেজেন্ট করতে হচ্ছে বৈকি। বব ডিলানের গান যেন। ফর দ্য টাইমস দ্যে আর অ্যা চেইঞ্জিং। সময় তো বদলেছে বাপু। বটে এই এক জুজু। সময়। কিম্ভুতুড়ে। এর স্কন্ধে সওয়ার হয়ে এরেই ডিনাই করা। সময়কে ভুলিয়ে দেয়া সময়ের কাঁধে চেপে। ব্যাপারটা ভালোই শিখেছি আমরা। মন্দ না। ভাবছিলাম, আমাদের শিশুরা তাহলে লেবুপাতা চটকে একটু খুশবুটাও নেবে না নাসিকায়? একটো-দুটো করমচা চিনবে না? যাপনে যা নাই, জীবনে যা অনুপস্থিত, কেন তা জানাতে যাবে সাহিত্যকবিতাগানাবাজানা? বাহ্! এইটা একটা কথা হইল, বলেন দিকি? জীবনে যা আছে, কেবল তারই খতিয়ান টুকবে কবিতা? যা নাই, তা আসবে না কবিতায়? যা ছিল চোদ্দপুরুষ পূর্বাব্দে, কবিতায় সেইটা পুনর্জীবিত-পুনরুজ্জীবিত হবে না? যা যাপনে-জীবনে আসার কল্পনা তো বহুদূর, ঘুমের মধ্যে স্বপনেও যা হেরিবে না মানুষ কোনোদিনও, — কবিতা সেই দৃশ্যও তবে দেখাবে না? যাপনলগ্ন হোক কবিতা, নিশ্চয়ই এইটা কাম্য সকলের, যাপনের বাইরেও ঘোরাফেরা জারি রাখুক। কোমলপ্রাণা বাচ্চাটা তার বাপ-বাপান্ত অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস কবিতা ছাড়া আর কোথায় যেয়ে খুঁজবে বলেন তো? কবিতা যাপনলগ্ন-জীবনঘন করে রাখার ব্যাপারটা আরেকদিক থেকে স্রেফ বন্দিত্ব বৈ কিছু নয়। ব্যবহারগুণে কবিতায় জীর্ণ পাতাঝরাও অবাক বসন্ত হয়ে দেখা দেয় বারেবারে। এ যদি না-হয়, স্রেফ যদি জীবনযাপনঘনিষ্ঠতা কাব্যের ফোকাস হয়, তাহলে ইন-ফিউচার কবিতার শেষনিঃশ্বাস দেখতে হবে চেয়ে চেয়ে। এইসব অবশ্য বৃষ্টিমিউজিকজনিত প্রলাপ।
সারাদিনব্যাপী বৃষ্টি ধারাবাহিক। অতি শ্লথ লয়ের বৃষ্টিপাত। ফোকরে-ফাঁকে রোদ উঁকি দিচ্ছে, ফের মুখ লুকোচ্ছে মেঘের মখমলে। একটু একটু জলপতনের স্বর, পিটুর-পিটুর আওয়াজ, রোদের স্বর অতি মিহি সিল্কের ন্যায় আরামের। একনাগাড়ে বৃষ্টিবর্ণিল তিনদিন। পত্রিকায় শীর্ষসংবাদ হবার মতন বৃষ্টি-বাদলানুষ্ঠান। রেইনি রিপোর্ট হতে পারে এমন : অবশেষে দেশের বৃষ্টিবিখ্যাত অঞ্চলে এল অত্যাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিদিব্যরথ। পনেরো জন বৃষ্টিতে আপ্লুত। কুড়ি-পঁচিশ জন ভ্রুকুঞ্চিত। অনেকেরই চিবুক ও ওষ্ঠ বৃষ্টিবিস্ময়ে মারাত্মক মর্মরঞ্জিত। নয়-দশ জন কড়া ভাষায় বৃষ্টিকে শাসায়েছেন, সতেরো জন বরিষনের সমালোচনায় মুখর, তেত্রিশ জন বৃষ্টিবিদ্রুপে ব্যস্ত সময় পার করছেন। নগরীতে একজন মাত্র পাওয়া গিয়েছে যে বৃষ্টি নিয়া উচ্ছ্বাস ছড়াচ্ছে একমনে। গ্রেটিট্যুড টুয়ার্ডস রেইন প্রকাশিতে দেখা যাচ্ছে কড়ে-গোনা চাইর-পাঁচজনারে। তেরো-চোদ্দকোটি ক্রিটিক একযোগে বিবৃতি দিয়েছেন যে এর ফলে — এই লাগাতার বৃষ্টিকীর্ণ কবিতাভাবাপন্ন আবহাওয়ায় — সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে উত্তরাধুনিক বাংলা কবিতা। বাংলা কবিতার আকাশে আজি বৃষ্টিজনিত দুর্যোগের ঘনঘটা। বাংলা কবিতা আজ স্মরণকালের ভয়াবহতম বৃষ্টিদুর্গত। ত্রাণ-সহযোগের আশা সুদূরপরাহত। চৌদিকে-দশদিগন্তরে বৃষ্টিশ্রদ্ধা আর বৃষ্টিবিপন্ন বিস্ময় আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। এর ফলে হুমকির মুখে এবং অনেকাংশে ধ্বংসকবলিত হাজার-বছরব্যাপী-চর্চিত অকবিতার এককোণে বহু সাধনা ও ঘৃণায় গড়ে-তোলা বিগত দুই-দশকের মহাবাংলাকবিতা। সমস্ত অর্জন আজ শ্রদ্ধাবলুণ্ঠিত হয়ে পড়ার উপক্রম, বলছেন হুঁকোপ্রিয় সমালোচকেরা। আশু এই বৃষ্টিশ্রদ্ধা কঠোর হাতে দমাতে না-পারলে বাংলা কবিতা ও অন্যান্য সর্ববিধ শিল্পসাহিত্য বান্ডিলে চলে যাবে বলে বক্তা ক্রিটিকদিগের আশঙ্কা। সাহিত্যপ্রশাসনের এ-ব্যাপারে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ কর্তব্য বলে জোরালো অভিমত ব্যক্ত করেন কোবিদগণ। বাংলা লিখনের কাল্চারে বৃষ্টি নিয়া উচ্ছ্বাস ও শ্রদ্ধার কোনো জায়গা রাখার পক্ষপাতী নন সর্বধন্য কোবিদকুল, রাখতে ব্যগ্র বরং অশ্রদ্ধা, নিরুচ্ছ্বাস, চাপা ঘৃণা, স্বল্পশ্বাস, অনবলীঢ় অনুদ্ভাস, চক্ষু-কুঁচকানো, কুঁচকিব্যথা এবং সর্বোপরি বিপুল পরিমাণে মাম্ব্লিং তথা আলজিভের জড়তাজনিত আমতা-আমতা। বাংলাদেশে জীবনযাপনে বৃষ্টি নাই, অতএব বাংলা কবিতায় বৃষ্টি থাকবে না, তাদের দাবি এইটাই। কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে এ-মুহূর্তে, এবং দীর্ঘ তিনদিন ধরে একনাগাড়ে, শেষ খবর পাওয়া আদৌ যাবে কি যাবে না তা বলা যাচ্ছে না যদিও। প্রতিবেদকের প্রাণের খত্রা, খবরে প্রকাশ, পুরা মাত্রায় বিদ্যমান।
সন্ধের পরে গেছিলাম আলোশিকার অভিযানে। ব্যাপারটা শুনে যেমনতর ও যতটা বিপ্লবী মনে হচ্ছে, তেমনতর ঘটনা আদৌ না কিন্তু। যথা আলোশিকার মানে নয়কো অন্ধকারের বক্ষ ছেদিয়া আলো ছিনাইয়া আনা। ব্যাপারটা সিম্পল। মাছধরা। মাছমারা। ক্যাচিং ফিশ। তবে এর আয়োজন আলাদা। তা, আপনি তো সর্বজ্ঞ, আপনি দিব্যজ্ঞানী, খপ করে ধরে ফেলবেন জোচ্চুরিটা, ফাঁস করে দেবেন জারিজুরি : মিয়া, রাত্তির নয়টা অব্দি তোমারে দেখা গেল রোজগারঘরের একহারা টানা বারান্দায় বসে একেলা ঝিমাইতেছ মুর্গিখামারের মালিকের ন্যায়, একে একে সব সহকর্মী ত্যাজিয়া আসিল তোমারে, বৃষ্টিপরিত্যক্ত তুমি নিদারুণ নৈসঙ্গফোঁপানো সুরে ঈষৎ পরিবর্তিত প্যারোডি করে একনাগাড়ে গেয়ে যাচ্ছিলে ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দুর বসন্তগানে বর্ষা পাঞ্চ করে — এমনও বরিষাদিনে / বাড়ি ফেরো মাংশ কিনে / বারোয়ারি ডাস্টবিনে / ফুলে ওঠে ছানা // এমনও বরিষারাতে / আলো নেভাও বিছানাতে / থাকিও না পাঁচে-সাতে / লুকায়ো ঠিকানা — ইঙ্গিতটুকু স্পষ্ট। নয়টার দিকে অগত্যা ধরিলে পথ গেহে ফিরিবারে। রেইনবস্ত্র পরিধান সত্ত্বেও ধুমভেজা বাইক পা-টিপিটিপি। বৃষ্টিতে চেনা বাজার চেনা বিতান অচিন হয়ে রয়। কিন্তু বলতে বসেছি ফিশিং নিয়া। আখ্যান মম কৈবর্ত্যজন্মের। কাহানি অফ ক্যাচিং ফিশ। ডিশ ওয়াশিং পোটেটো কাটিং শর্টস্টোরি দিয়া তো তব মন অর্জন হইল না মম, ধনার্জন তো দূরপরাহত, আর বিদ্যার্জন তো অতীতের পেট়ে। অ্যানিওয়ে, যেইটা বলছিলাম, সন্ধের পর গিয়াছিনু আলোকশিকারে। ব্যাপারখানা আজিকার নয়। আজি হতে পাক্কা পঁচিশ বছর আগেকার সন্ধ্যা। আজি হতে পাক্কা পঁচিশ বছর আগেকার বৃষ্টি। আজি হতে পাক্কা পঁচিশ বছর আগেকার মাছধরা। আজি হতে পাক্কা পঁচিশ বছর আগেকার মাতুলালয়। এ তো দেখি ইয়াংবেঙ্গল গণ্ডার হে! খেয়েছে পঁচিশ বছর আগে, ঢেঁকুর তুলছে এসে এখন এই পঁচিশ বছর বাদে! নেক্সট পর্বে নেক্সটটুকু শুনুন।
তবু আমার হিয়া বিরাম পায়নাকো, ওগো স্মৃতিজাগানিয়া, তোমায় স্মৃতিবিতান হইতে চয়িত দুইয়েকখানা কলি শোনাব মম সংগীতের। কড়ি ও কোমলে মেশা গান এই বৃষ্টিনিশিভর। অয়ি বৃষ্টিনিশীথিনী! শোনো তবে সংহিতা আমার, পঁচিশ বছর আগেকার, অঞ্জলি লহো মোর ভঙ্গিবহুল উচ্ছ্বাসপূর্ণ এই স্মৃতিচিত্রিকায়। তোমাকে দেখাই খুলিয়া আমার গোল্ডেন ট্রেজার, তোমার পাতেই তুলিয়া দেই হাড় ও মজ্জার সুরুয়া আমার, আজিকার নয় জেনো এই গান খ্রিস্টজন্মপূর্বেকার। বৃষ্টির দিনে দ্যাখো গোয়ালে গাইগোরুদের রভসভরা জাবর-কর্তনের শব্দ শোনা যায়। দ্যাখো সারাদিন ধরে তারা ঘরের ভেতরে। দ্যাখো তারা যায় নাই তিনদিন-চারদিন ঘাসক্ষেতে ঘরের বাহিরে। একদিন, অয়ি প্রিয়তমা, আমাদেরও ছিল এইরূপ সুখভোগ সংগতি। দিন-কয়েক ঘর হইতে না-বেরোলে একদিন চলত আমাদের। অন্তত আকাশ মাথার উপর পড়ত না ভেঙে। একদা কাচারিগৃহের চালার উপর বৃষ্টিপাতজনিত মধুর উৎপাতে খাজনা আমদানির হিসাবরক্ষণকর্মে একাধটু ঢিলে পড়লে ক্ষেপে যেতেন না কোনো জমিদার। একদা কুঠিবাড়িতে কেমন ঘোর বর্ষা নামত, রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলি সেই সিনেমা রাখিয়াছে ধরে। একদিন জমিদার ও জমিহারা উভয়ের জীবনেই ঋতু বর্ষা আবির মাখায়ে যেত অল্পবিস্তর হলেও। একদিন বাবু ও উপেন দুইজনা দুই ভিন্ন নজরে হেরিত বর্ষাকাল, উভয়ের আঁখি হইত সজল পৃথকতর স্বপনে ও তন্দ্রায়। একদিন গান রচিত হতো বর্ষার বন্দনায়। একদিন কালিদাস, একদিন রবীন্দ্রনাথ, একদিন আমাদের পাশের পাড়া শিববাড়ির গানের টিচার গোকুলবাবু ঘনঘোর বৃষ্টির দিনে মেঘমল্লারে গলা ভাঁজতেন কখনো মন্দ্র কখনো-বা তারসপ্তকে। একদিন সুমন লিখতেন বৃষ্টি নিয়ে বস্তিচিত্র সম্বলিত অনবদ্য সব গান। সুমন লিখেছিলেন গানে : “ঘর বেঁধেছে পথের ধারে যাদের দল / তাদের কাছে মেঘ মানেই নোংরা জল / সেই জলেতে বেদম ভিজে একটা লোক / মেঘদূত এর নাম রেখেছে আহাম্মক।” অঞ্জন গেয়েছেন কয়েকটা গান, এর মধ্যে ‘বৃষ্টি’ গানটা আমার প্রজন্মের মানুষের অ্যান্থেম। যথা : “আমি বৃষ্টি দেখেছি / বৃষ্টির ছবি এঁকেছি / আমি রোদে পুড়ে ঘুরে ঘুরে / অনেক কেঁদেছি / আমার আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখার খেলা থামেনি / শুধু তুমি চলে যাবে / আমি এ স্বপ্নেও ভাবিনি।” ঠিক বৃষ্টি বিষয় নয় এ-গানের, বিষয় বিরহ অথবা প্রেম চিরকেলে, কিন্তু অন্য কয়েকটা গানে অঞ্জন বৃষ্টিচিত্র ধরেছেন অন্যভাবে। একটা একদম ড্রামাটিক চলচ্চিত্রের দৃশ্যপ্রতিম গান যেমন : “একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে / থাকবে না সাথে কোনো ছাতা / ধরা পড়ে যাবে মাঝরাস্তায় / ভিজে যাবে চটি জামা মাথা / অদূরে কোথাও কোনো রেডিওতে / ‘এই পথ যদি-না শেষ হয়’ / বৃষ্টির রঙ হয়ে যাবে নীল / আর আকাশের রঙটা ছাই” … ইত্যাদি। কিন্তু এই গানটাও তো বৃষ্টি পাশ কাটায়ে অন্য কোথা অন্য কোনোখানে যেতে চাইছে চলে। এইসব মনে পড়ে। এই সমস্তকিছু ছাপিয়ে বেজে যায় ‘ডিফ্রেন্ট টাচ’, বাজে ‘শ্রাবণের মেঘগুলি জড়ো হলো আকাশে’, শুনি ‘মেঘেদের যুদ্ধ’ আর ‘থেমেছে হাঁসের জলকেলি’ যখন ‘পথিকের পায়ে-হাঁটা থেমেছে’ দেখিয়া যাই। বৃষ্টিশ্রদ্ধা জাগ্রত হয় হৃদয়ের গহীন কন্দরে, উদিত হয় আৎখা আখাম্বা উচ্ছ্বাস বৃষ্টিবিমোহিত। “দোষ করেছি বৌঠান / আমার দু-দশখানা কবিতা-অপরাধ” — বৃষ্টিদিনে মনে পড়ে কেন-যে এমন কবিতালাইন! জয়ের কবিতা, ‘পাতার পোশাক’ গ্রন্থান্তর্ভূত, জয় গোস্বামীর। রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত গোটা কবিতাটা খণ্ডে খণ্ডে দীর্ঘ। লাগাতার বৃষ্টির মতন মধুর আসক্তিবিকীর্ণ। মনে পড়ে আরও কত কত খণ্ডছবি, চিত্রগুপ্তি, মন্ত্রগাথা, আচ্ছন্ন সুরচূর্ণাবলি! মনে পড়ে আমাদের এক বন্ধুর প্রেম, বৃষ্টিনামে সম্বোধন প্রেমিকাকে বিরামহারা, লাইনে লাইনে অনিবার্য অবধারিত বৃষ্টিপ্রেজেন্স। মনে পড়ে, এইসব, মনে পড়ে সখা হে! একদিন, মনে পড়ে, গিয়াছিনু গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টিরাতে আলোশিকারে, সেই কবে, যেন খ্রিস্টজন্মপূর্বাব্দে, ধরেছিনু মাছ এই জীবনের কচুরিপানাভাসা হাওর-জলাশয়ে। একদিন, কবে যেন, কোন সুদূর মাতুলালয়ের তিগাঙ্গা হাওরে! তিন গাঙের মুখচুম্বনস্থলের হাওর — সুরমা, কুশিয়ারা আর কুড়া নাম্নী সেই গাঙত্রয় — আজ যদি জিগ্যেশ করে এসে কোনো নদীহীন-বৃষ্টিরিক্ত মরুদেশের মশহুর গানহীন গরিলা আরবীয় উটের ন্যায় উঁচাইয়া গ্রীবা : গাঙ নিয়ে এত উচ্ছ্বাস, গান নিয়ে এত ভক্তি, বৃষ্টিপূর্ণ ঘর ও বাহির নিয়া আস্ত-কলেবর শ্রদ্ধা প্রকাশের কী-এমন যৌক্তিকতা বাপু! অনুত্তর রহি। হে নিরুচ্ছ্বাস আর অভক্তি-অশ্রদ্ধার মরুমুগ্ধ অপ্রেমপ্রবক্তাবৃন্দ! আমার এই আলোশিকার গল্প, দু-দশখানা গাঙ আর গানের অপরাধ! আমার এই উজানি মাছের বৃষ্টিস্ফীতা শাওনযামিনী …
আজি হতে বছর-বাইশ আগের এক সন্ধ্যা। স্থান ভাদেশ্বর নামে এক দূর দিগন্তলীন রহস্যলোকালয়। সেইখানে এই নিরন্তর-বাকবাকুমরত নোটকারের মাতুলালয়। দিন কোনো-এক ঝুম বর্ষাকাল। তিগাঙ্গা হাওর পেরিয়ে এক নদী। একহারা লম্বা গড়নের নদী, চওড়া পারস্য রমণী যেন, ভরভরন্ত সোমত্ত অঙ্গসৌষ্টব। নদীর নাম কুশিয়ারা। বাংলা বইয়ের পাতার ভেতর ফোটা নাম তো আর মানুষের মুখে থাকে না, বা থাকলেও খুব কম লোকালয়েই সুলভ সেইটা। যে-লোকালয় যত বেশি বনেদি, বইয়ের পাতার পত্তনির আগে থেকেই তাদের জবানে নিসর্গের প্রতিটি বস্তুপুঞ্জ কথা কয়ে ওঠে। এই লোকালয়ের সেইদিক থেকে প্রসিদ্ধি বিস্তর। কুশিয়ারা নদীটির নাম এইখানে লোকজবানে কুড়াগাঙ। কুশিয়ারা হয়েছে কুড়া, হাওরাঞ্চলের একটা পাখির নামও একই, কী মিষ্টি ব্যাপার, নদী হেথা গাঙ। তিনটে নদী মিলিয়াছে এসে এইখানে একটু অদূরে, এর সংলগ্ন হাওর এক, কাজেই এথাকার হাওরটির নাম তিগাঙ্গা হাওর। লোকে তো আর তা ডাকবে না। লোকে আপনার-আমার মতন ভাষাচৈতন ব্যাকরণবৃদ্ধ অথর্ব না। লোকে হাঁকডাক ছাড়াই সৃজনশীল। হরদম তারা সৃজনেই দিনগুজরান করে, হুঁকোর খুশবুদার টিকি থেকে শুরু করে একাদশ সদস্যবিশিষ্ট নবপরিবারে এন্তার বালবাচ্চা পয়্দানো বছর-বছর সমস্তই তো শুদ্ধার্থে সৃজনই, সৃজনশীল বলিয়া তাই বলে তারা দাবি করে না আলাদা স্পটলাইট কোনো। প্রথম অথবা অন্তিম কোনোপ্রকার কোনো আলোর আশকারা ছাড়াই, জ্ঞানদীপ্তি কি এনলাইটেনমেন্ট ছাড়াই, তারা আমৃত্যু সৃজনশীল। কুশিয়ারা যেমন কুড়া, তিগাঙ্গা তেমনি তিয়াঙ্গা। নামটা শুনলেই কেমন তৃষ্ণা পায় না আপনার? তৃষ্ণার অঙ্গ এই ব্যাপ্ত জলাশয়খানি। তিনিই তৃষ্ণা, তিনিই তৃষ্ণানিবারণকারিণী। তৃষ্ণা অঙ্গে নিয়াই তিনি তিয়াঙ্গা। শাব্দ অর্থে যদিও তিনি তিনটে গাঙের ছেদবিন্দু, সঙ্গমস্থল, মোহানা। আপনার-আমার বছর-বিয়োনি সৃজনকল্পনার ঔরসে-গর্ভে এই জিনিশ সম্ভবিত? মনে হয় না। পারতেন বটে ফেসবুকিয়ান বুক্নিমারা মননশীলেরা। তাদিগের কথা আলাদা, তারা অনুমানসর্বস্ব তথা অনুমানসর্দার, তারা আন্দাজিপনার গরবমুখর রাজাধিরাজ। তো, গল্প পথ হারাইয়া ফেলবে শেষে, গল্পে ফিরি। তিয়াঙ্গা পারায়ে যেয়ে কুশিয়ারাপার ধরে একটা ছাদ-ছৈহীন কুশিনৌকা। কুশিনৌকা মানে হলো কোশানাও। বয়ঃসন্ধিবিব্রত কিশোরীর ন্যায় ছিপছিপে সেই নাওশরীর। পিনিপিনি বৃষ্টি হচ্ছে। যেন অতিকায় এক গোলাপঝাড় হইতে পাপড়িপিছলানো জল পড়ছে সহর্ষ শিহরি শিহরি। ছাতা ছাড়াই ম্যুভ করা যায় এমনটাই সিভিল-সুশীলসোসাইটি বৃষ্টি। ছিপছিপে সেই নৌকাখানা আরোহীবোঝাই। একই পরিবারের আরোহী সবাই। জ্ঞাতিসৌত্রিক ভাই-মামা প্রমুখ। মেজোমামার হাতে ছয়ব্যাটারির টর্চ। সৌদিঅ্যারাবিয়ান। খুবই পাওয়ার্ফুল আলো। অভিযানের মূল অস্ত্র অথবা হাতিয়ার এইটা। আলোশিকার এই অভিযানের অফিশিয়্যাল নেইম। কাজেই টর্চের রোল অত্যন্ত ভাইট্যাল এখানে, টর্চলাইটের, দেড় কিংবা ছয় যা-ই হোক ব্যাটারি সংখ্যায়। এমন মনে করার কারণ নাই যে আমিই শিকারী, ছিলাম শিকার-সহকারী বস্তুত। যোগালি বলে যারে। কেমন সেই সহকারিতা, যোগালিগিরি? টর্চলাইট ছাড়াও সঙ্গে ছিল একটা হ্যালোজেন আলোকবর্তিকা, ল্যান্টার্ন ইন-ফ্যাক্ট, সেই ল্যান্টার্নহাতল হাতে ধরে ঝুলিয়ে লিড-শিকারীর পিছনদেশে অবস্থান ছিল আমার জব-রেস্পোন্সিবিলিটি। নিরন্তর নিরবচ্ছিন্ন আলো দেখাইয়া যাওয়া। আমার পেছনে খালুই হাতে একজন, সমবয়সী মামাতো ভাই, বছর সাত-আষ্টেকের। আলোশিকারী অভিজ্ঞচোখা ব্যক্তিটি দ্বিতীয় কে হবে আর, আমাদের মেজোমামা ছাড়া! তার খ্যাতি জগজ্জোড়া মৎস্যরাশি হিশেবে। এত সংস্কৃত তো আর গাঁয়ের লোকের মুখে নাই, তাদের কাছে বিশ্রুত তিনি মাছ-রাইশা বলে। এমনকি গাঁদাফুলের গোড়ায় জমা কুলকুচিজল হইতেও উনি মাছ ধরতে পারেন বলিয়া জনশ্রুতি আছে জগতে। অ্যানিওয়ে। শিকারাস্ত্র স্রেফ কোঁচ/কোঁচা — ছয়ফিট-অনুমান লম্বা চিকন মুলিবাঁশের অগ্রভাগে একগোছা লৌহশলাকা, শলাকার ফলাগুলো সুচিক্কণ, শলাগুচ্ছ টাইটফিট বাঁধা। কোঁচের তীক্ষ্ণ ঘায়ে গেঁথে উঠে আসে হাতে একেকটা মাছ। ওহো, অস্ত্র আরেকটা আছে কোঁচের চেয়েও শক্তিশালী সেইটা তো পুর্বাহ্নেই বলিয়া নিয়াছি, — পুনরপি ন-দোষায়, — সেইটা আলো। সবচেয়ে শ্রেয় হলো টর্চের আলো, টর্চালোক ইতস্ততঃ দিগ্বিদিক ছড়িয়ে-ছেৎরে না-পড়ে কেন্দ্রীভূত থাকে শুধু অব্জেক্টের গায়ে। একান্ত টর্চের আলো দুর্লভ হলে অন্য যে-কোনো অযান্ত্রিক বা যান্ত্রিক আলো দিয়া কাজ সারতে পারেন। লম্ফ দিয়া পারেন যেমন, মশাল বা হ্যারিকেনও চলতে পারে, কিংবা চার্জলাইট বা হ্যালোজেন দিয়াও। তবে টর্চ ব্যতিরেকে শিকারে ভালো আউটপুট এক্সপেক্ট করেন যদি তো অবশ্যই শিকারে এক্সপার্টাইজ থাকা চাই আপনার। যেভাবেই শিকার করুন, যে-তরিকাতেই, বর্ণিত যে-কোনো কায়দায় — ১/২টা শোল, টাকিশোল ৫/৬টা, খলশে-বাঁশপাতা-সরপুঁটি আরও গোটা ৭/৮ তো জুটবেই। নসিব নেহায়েত মন্দ-কুফা না-হলে এইটুকু অর্জন সম্ভব ঘণ্টাখানেকের শিকারপ্রকল্প কার্যক্রমের নগদ ফল হিশেবে। এখন, দেখা যাক, বাংলা কবিতায় ধীবরজীবন তথা কৈবর্তবৃত্তি তথা মাছধরার অভিজ্ঞতা এসেছে কি না। আস্তে আস্তে দেখি, ফিরে ফিরে, দেখতে দেখতে যাই বৃষ্টিবিপুলা আল্লার দুনিয়া।
সিজনের শেষলা বৃষ্টি বলে একে, এতদঞ্চলে, এই বৃষ্টিপাত রহি রহি একপক্ষকাল অব্যাহত রইবে বলিয়া আন্দাজ ঋতুবেত্তাদিগের। বলবার কথা একটাই যে, এরা স্থানীয় ঋতুবেত্তা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জলবায়ুবিদ নন, এদের আছে এক-ধরনের ইন্ডিজেনাস নলেজ, ফেসবুকফেইম তো নাই-ই, এরা লোক্যাল ঋতুর ভালোমন্দ নিয়া ভাবেন-চিন্তেন, ডিএফআইডি কি অন্য কোনোকিসিমের কোনো চ্যানেলেরই ফান্ড এদের নসিবে নাই এবং এরা এসবের তোয়াক্কাও করেন না। যাগ্গে। শেষলা বৃষ্টি বলা হলো, লাস্ট রেইন ইন দি টেরিটোরি, কথাটা আরেকটু ভাঙা যাক। আমরা মানভাষায় যেমন বলি পয়লা/পহেলা, সূচনা বোঝাতে, তেমনি এতদঞ্চলের লোকে অন্তিম/উপসংহার বোঝাতে যেয়ে বলে শেষলা। ব্যাপারটা অ্যাজ্ সাচ সিম্পল। শেষের বৃষ্টি, সিজনশেষের বৃষ্টিপাত, লোকে বলছে শেষলা বাদলি। বৃষ্টিবিধুরতা অর্থে বাদলি। বাদল থেকে বাদলি, লোকে যেমন বলে মেগবাদলির দিন। তো, অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দিচ্ছে, এই বাদলি মোটামুটি স্টে করবে শারদীয়া বিসর্জন অব্দি, উমাদেবী স্বামীর ঘরে যাবেন কাঁদতে কাঁদতে, বাপের ঘর থেকে স্বামীর ঘরে যেতে গেলে এইটা মাস্ট, এই কান্নাটা, না-কাঁদলে কথা ওঠে, সমাজ দুয়ো দেয়, এ কী ছিরি মেয়ে বাপু, ঢ্যাংঢ্যাং করে নাগরের লগে গেল চলে, বাপ-ভাইয়ের লেইগা কান্না না-করুক একটুও ফোঁপাইবি না! কাজেই লোক-দেখানো হোক, লৌকিকতা হোক, এই বিদায়কালীন বৃষ্টিপাত, এই ট্র্যানজিশন্যাল কান্নাকাটি, এইটা আমাদের ট্র্যাডিশন, গোল্ডেন ঐতিহ্য আমাদিগের। ফলে এইসময় দেবী একটু কান্নাকাটি করবেন, বুকে যদিও সোয়ামী-সোহাগা আনন্দফুর্তির বান ডাকিছে, আসিছে শীতকাল, মিলন হবে কতক্ষণে তুখোড় শীতসনে, কেননা উইন্টার ইজ দি বেস্ট অ্যামং অল সিজন্স, কাজেই প্রমাণ হয় কি যে ঐতিহ্যের রক্ষাকর্ত্রী আদপে মেয়েরাই? বিজ্ঞজন জানেন। মনে পড়বে, সৈয়দ হকের একটা গল্প আছে ‘গাধা জ্যোৎস্নার পূর্বাপর’ নামে, — সেইখানে এমন একটা সিচ্যুয়েশন আছে যে একটা মেয়ে বিবাহবেদি থেকে স্বামীর পালকিতে উঠে যাওয়ার সময় স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি কান্নাকাটি করছে দেখে গ্রামবাসীরা কানাকানি করছে যে এই মেয়ের নিশ্চয়ই একটা-কোনো অ্যাফেয়ার আছে, না-থেকে পারেই না, সে নিশ্চয় এই স্বামীর ঘরে যেতে চাইছে না, তাহলে তো একটা আবেগ খেলত ওর আচরণে, একটা আনন্দের আবেগ, এবং একটু কম কানত-টানত ইত্যাদি। কিন্তু গল্পটা তাই-বলে এই কান্নাকাটি না, গল্পটা অন্য জায়গায়, সেইটা সাংঘাতিক দুর্ধর্ষ ব্যাপার, সৈয়দ হকের প্রোজ তো প্রিয় অনেকেরই, এবং প্রিয় তার গল্পপ্রবন্ধগুলো, এইটা সেই গল্পপ্রবন্ধ ধারার অবিস্মরণীয় স্পেসিমেন একটা। গাধা শব্দটা দারুণ ধন্দে ফেলে দিয়েছিল পয়লা পড়ার সময়, ইশকুল-পাশ-করা বালকোত্তীর্ণ বাছুর আমরা তখন, পুরো গল্প তো আবৃত্তি করে পড়া গেল, বুঝলামও মনে হলো, কিন্তু গল্পের কোথাও গাধা তো দেখিলাম না, খালি ওই জ্যোৎস্না ক্যারেক্টার নিয়া ন্যারেটর হিশেবে লেখকের ফাটাফাটি বয়ানভঙ্গি, কী স্টাইল বাপ-রে-বাপ! অচিরেই বুঝতে পারি যে গাধা এইখানে একটা গালি, রিবিউক করা অর্থে একটা আলতো স্ল্যাং, আমরা গাওগিরামে বলে থাকি এমন : তুই ব্যাটা গাধা একটা, কিচ্ছু তোর ঘিলুতে ঢোকে না। কাজেই গল্পলেখক জ্যোৎস্না মেয়েটাকে বকা দিচ্ছেন এই বলে যে — বোকা মেয়ে! এমন করে লোকের সামনে এক্সপোজ করে দিতে নেই নিজেরে। একটু লোক-দেখানো কান্না কানলেই তোর এত হুজ্জোৎ পোহাতে হইত না। — এই ব্যাপারটা নিজে নিজে বুঝতে পেরে কলম্বাসের/ভাস্কো-দা-গামার মহাদেশ-আবিষ্কারের আনন্দ পেয়েছিলাম এককালে। অ্যানিওয়ে। কলম্বাসের মহাদেশরসগোল্লা আবিষ্কারের নেপথ্যগুপ্ত নৃশংসতা আর বেবাক বুজরুকি-জারিজুরি নিশ্চয় এদ্দিনে ফাঁস হয়েছে আমাদিগের কাছে। এই ঋতুকান্না চলছে দিন-তিনেক ধরে, একপক্ষ স্থায়ী হবে ভেঙেচুরে, এর মধ্যিখানে কোরবানির ঈদ আছে, সেই-সময় একটা ভালো বর্ষণ হবে কোটি-কোটি গোবাদিবিসর্জনের শোকে, এইটাও লক্ষ করে আসছি দীর্ঘকাল। পরে-পরেই পূজা, শুভ শারদীয়া, কাজেই বৃষ্টি ও লিভিং প্রতিমা দেখার সিজন শুরু হলো বলে! ফের মিলেঙ্গে, রেইনি ফিয়াঁসে মম, দুঃখ কোরো না, বাঁচো, বেঁচে ওঠো, অনিন্দ্য সুন্দরী হয়ে ওঠো তুমি, বাইজেন্টাইন সম্রাজ্ঞীর ন্যায়। ঘিরে থাক তোমারে পৃথিবীর সমস্ত সুখ, শঙ্খনীল এই বৃষ্টির কারাগারে, যেন আমরা গাইতে পারি হেঁড়ে গলা ছেড়ে জেমসের ‘আকাশী’ গানটা।
বাইপাসের সড়ক ধরে এগোতে যেয়ে পিথাগোরাসের মুখ মনে পড়ছিল। আমাদের বন্ধু পিথাগোরাস, জ্যামিতিপিতা, উনার সঙ্গে ফেসবুকে অবশ্য কানেক্টেড না আমি। কিন্তু উনাকে তো চিনি, ইশকুলবেলা থেকেই, ইনার কারণে জ্বালাযন্ত্রণাও কম পোয়াতে হয় নাই। কিন্তু এদ্দিন বাদে তারে পড়ছিল মনে এই বৃষ্টিবিপুল মহাসড়কযাত্রাপথে কেন ও কোন কারণে সেইটা আপাতত বলি। ত্রিভূজ-ত্রিকোণ জাল কাঁধে কেউ চলেছে মন্থর হেঁটে বাইপাসরোডের কিনার ধরে, কেউ নেমে পড়েছে সড়কঢালু জমিনে, কেউ অদূরের জলজমা গর্তমতন জায়গায় হ্যাঁচকা ঝাঁকি দিয়ে টেনে চলেছে জাল পানিভুবনে। তেমন তাড়া কারোর মধ্যে নেই, ছায়াশ্বাসী দিন, রোদ্দুরের ঝাঁঝ দূরস্মৃতি, সূর্য নেই দৃশ্যপটে, এবং এরা সৌরজগতের বাসিন্দা বলে যেন মনেই হচ্ছে না। মাছ ধরছে এরা, বাইপাসরোডের দু-ধার ধরে, কারো সঙ্গে কারো যোগ নাই যেন। দূরে দূরে এক থেকে অপরে, তা-বলে নিঃসম্পর্ক নন কেউই, সহজেই অনুমেয় যে এরা আশপাশের লোক্যালিটির লোক, মাছ ধরতে এসে কথা বলতে নেই, তাতে মাছ ওঠে কম, কুফা যায় লেগে, পানিপির বাবা খোয়াজ খিজিরের মিথ মনে খেলা করে তাদের, আমাদেরও, উনি খুব গরম পির, এমনিতে শান্তসুশীলসুবোধ, ক্ষেপলে রক্ষা নাই। এইসব স্যুপারস্টিশ্যাস বিলিফ হোক অথবা হ্যানত্যান যা-কিছুই, লোকমগজে ক্রিয়াশীল, খুব-যে ক্ষতিকর তা-ও নয়। এবং যুগ যুগ ধরে এইসব লোকায়তিক চালিকা, কাল্চারের পরানভোমর এসবেরই ভিতরে পোরা, কাজেই হেলায় উড়িয়ে দেবার নয়। এমনিতে ফুঁ দিয়ে উড়াইয়া দিবার লোকে তো দুনিয়া ভরিয়া আছে আজিকালি, মুখে মুখে বিশ্বমারার দল, ইশারায় শিস দিয়া সৌরনীহারিকা শোয়ানোর সোনার-চান পিতলাঘুঘুগণ, তারা বাংলা আধখেঁচড়া বাক্যাংশ দিয়াই শ্বেতভবন-প্যান্টাগন ভূমিস্যাৎ করিয়া দেন। দেশকালপাত্রাধারে এদেরে ধরিবার জো নাই। এই প্রজাতি, সুখের বিষয়, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান। কথা হচ্ছিল জ্যামিতিক জাল ও তদানুষঙ্গ নিয়া। বৃষ্টির একটা জ্যামিতিকতা আছে এইটা কে অস্বীকার করবে? কেউই অস্বীকার করে না যে বৃষ্টি সরলরেখায় পৃথিবীতে আসে। দৃশ্যত বক্র যদিও, কতকটা তের্চা তার পতনকালীন দশা, নৃত্যভঙ্গিমা খানিকটা অ্যাক্রোব্যাটিক, তবে প্রকৃত প্রস্তাবে বৃষ্টিরেখাসমূহ সমান্তরাল কি না তা ম্যাথমেটিশিয়ান মেপেজুখে দেখবেন। কথা হলো, জগতের একটা-কোনো কোণ, একটি মুহূর্তও জ্যামিতিকতার বাইরে নয়। বৃষ্টিদিন সেদিক থেকে ব্যত্যয় হবার কারণও নাই। যে-জালটা কাঁধে দেখা যাচ্ছিল বেশি, সেগুলো ঝাঁকিজাল, সিলেটে এই জালের চালু নাম উড়াইল-জাল, উড়াইয়া ফালাইতে হয় সম্মুখের সুপরিসর জলরাশিদেশে, এবং জলভাগে এর গোলছাতার বৃত্তাকার অবতরণ বটে দেখনযোগ্য এক দৃশ্য। যথেষ্ট মুনশিয়ানা লাগে এই জাল সঞ্চালনায়। এছাড়া আছে খেয়াজাল, কঞ্চিবাঁশের তৈয়ারি ত্রিভূজ কাঠামের আওতায় মিহি ছিদ্রের নেট/মশারি দিয়া বানাইতে হয়; এতদঞ্চলে বলে পেলাইন জাল, এইটা বাওয়া সহজ। হাতের কনুই আর মণিবন্ধের একটা কারসাজি দিয়া ধাক্কা মারিয়া ছন্দোবদ্ধভাবে এইটা চালাইয়া যাইতে হয়। একটু পর পর উর্ধ্বে তুলে দেখতে হয় মাছ পড়ল কি পড়ল না, পাতালতাতন্তু ঝাঁকি দিয়া ফালাইয়া আবার ঝাঁকি দিয়া দিয়া পানিতে চালাইতে হয়। এ-ই তো, সহজ। ধৈর্য মহৎ গুণ কি না জানি না, এইটা পরীক্ষা করে দেখিও নাই, মহত্ত্বপরীক্ষার কোনো ল্যাব নজরে ঠেকে নাই সেভাবে। কিন্তু ধৈর্য মাছধরার একটা প্রাথমিক ও প্রধান শর্ত, মৎস্যশিকারের একটা আবশ্যকীয় গুণ হলো ধৈর্য, ফিশিং জিন্দেগিতে এক-দুইবার যারা করেছেন তাদের তো ওটুকু সম্যক জানা আছে। এবং পেয়েছেন তারা প্রভূত আনন্দও। রচনায় লিখতে যেয়ে মুখস্থ-মারা মাছধরার বানোয়াট আনন্দ নয়, রিল্-লাইফ আর রিয়েল-লাইফ দীপিকা পাড়োকন গুলিয়ে ফেললেও আমরা যারা গুলাই নাই তারা তো জানি আনন্দঝর্ণার স্বরূপ ও অবস্থিতি, ফিশিং হইতে সত্যি সত্যি অনির্বচনীয় ফুর্তি লভ্য। অনলাইন পত্রিকায় দীপিকার ক্লিভেজ অবমুক্তকরণ নিয়া বাংলার ঘরে ঘরে ব্যাপক তোলপাড়, সভ্যতাশাস্ত্রজ্ঞদের প্রতর্কক্রীড়ায় দীপিকার পক্ষে দেহসিদ্ধান্ত ও অধিকার সুরক্ষায় বাংলা কাইৎ হইলেও বর্ষাকাল ও মৎস্য বিষয়ে বঙ্গ নিশ্চুপন্ত। অনির্বচনীয় বলিউড, বোম্বশেল্, ক্লিভেজ্ ও কয়েৎবেল, বলা বাহুল্য। অনির্বচনীয় যেহেতু, কিবোর্ড অতএব এইখানেই ইস্তফা দিতেছে।
শেষ হবার ব্যাপারটা, তা যে-কোনোকিছু ক্রমশ শেষ হয়ে আসার ব্যাপারটা, কেমন যেন। হুট করে শেষ হলে, অ্যাব্রাপ্ট এন্ডিং যাকে বলে, ব্যাপারটা তেমন মনোযাতনাকর হয় না। কিন্তু ক্রমশ শেষ হওয়া, ক্রমশ ফুরায়ে আসা, সাংঘাতিক বিষাদের একটা ব্যাপার। অশীতিপর বয়সে ক্রমশ আয়ু-অবসানের ব্যাপারটাই ধরি। ডিসগাস্টিং মনুষ্য জন্মমৃত্যু, কাউন্টিং ডাউন, শুধু শুধুই। বিমর্ষ লাগে, মনখারাপ-মনখারাপ একটা ভাব থাকে, এমন ক্রমবিলীয়মান গোধূলিদৃশ্যের ন্যায় নিঃশেষধর্মী বিষয়ব্যাপারগুলোর সঙ্গে। সেইসব বিষয়ব্যাপার, যা-কিছুর সঙ্গে আপনি ধীরে ধীরে অরিয়েন্ট হয়েছেন, অ্যাডাপ্টেড করিয়েছেন নিজেকে, অ্যাক্যুয়েইন্টেড হয়েছেন ক্রমে, সেই বিষয়টা আপনাকে এবং আপনি সেই বিষয়টাকে চিনে নিয়েছেন একটু একটু করে। হুট করে শেষ-হওয়া ব্যাপারগুলোতে একটা ধাক্কা থাকে, মৃদু হোক অথবা ব্যাপক, ব্যাপারটা আর-যা-ই-হোক মনোযন্ত্রণার কারণ হয় না সাধারণত। উপন্যাস পড়ছিলেন একটা, অনেকদিন ধরে এর চরিত্র ও চালচিত্রের সঙ্গে নিজেও চলাফেরা করছিলেন, বুঝতে পারলেন যে এক-তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট আছে আর, মনটা খারাপ হয়ে যায় না? বা একটা সিনেমা দেখছিলেন, ক্লাইমেক্স ইত্যাদির পর ক্যাথার্সিস দেখে বুঝতে পারছেন যে শেষ হয়ে আসিছে বেলা, মনটা দমে যায়। এই-যে শেষ-হয়ে-যাওয়াজনিত বিষাদ, এ নিয়া গান আছে অনেক, ইংরেজিতে আছে, বাংলায় আছে। একটা গান গেয়েছে এলআরবি, খুব সুন্দর গান, ওভারঅল এই ব্যান্ডের গায়নধারা আমার পছন্দ না যদিও, অনেক ভালো গান ও বাজনাবাদন আছে এদের। যে-গানটা মনে করতে চাইছিলাম, সেইটার কয়েকটা লাইন এমন : “শেষ চিঠি — কেন এমন চিঠি হয় / শেষ কথা — কেন এমন কথা হয় / ক্ষমা কোরো — ক্ষমা কোরো আমায়” … ইত্যাদি। কী করুণ এর সুরবিস্তার! সকরুণ ভায়োলিন সেইসঙ্গে বেদনাশুদ্ধ করেছে সুরটাকে, না-পাওয়াজনিত নীল বর্ণে বিধুর হয়ে আছে পুরো গানটা, গানের আবহটা, শেষ-হয়ে-যাওয়ার রেশ অনেকক্ষণ ক্রিয়া করতে থাকে শ্রোতার সারাউন্ডিঙস্ জুড়ে। এহেন ক্রমঃফুরনোর অনুভূতি গান ও কবিতার শরীর-আত্মা-অস্তিত্ব ভরে রেখেছে বাংলায়, ইংরিজিতে, নিশ্চয় দুনিয়ার সমস্ত ভাষায়। ব্যাপারটা ভাবুন একবার, হুটহাট রাগারাগি করে বা বড়-ধরনের বোঝাপড়া শেষে একটা সম্পর্কের অবসান ঘটা, মনে করুন প্রেমসম্পর্ক বা নিখাদ বন্ধুত্ব, আর পরিস্থিতি মেনে নিয়ে প্রেম সত্ত্বেও বন্ধুত্ব অটুট সত্ত্বেও সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলা, দুইটার দুঃখ কি এক? ধরুন যে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় একজন দুম করে মরে গেল, আর আরেকজন চোখের সামনে চিকিৎসকের জবাব দেবার পর মৃত্যুশয্যায়, দুইটার অভিঘাত ও রেশ তো অভিন্ন নয়। জীবনের নিয়ম মেনে জীবন বার্ধক্যে শেষ হওয়া, ভাবতেই বিষাদে ছেয়ে যায় হৃদি ও অলকানন্দা-মাতামুহুরীর জল। যেমন এই বৃষ্টির দিন ফুরায়ে আসিছে ধীরে। দেখছি, বিষাদে ও নস্ট্যালজিয়ায়। শেষ বৃষ্টি — কেন এমন বৃষ্টি হয়! এমন রোদনভারাতুরা! তাহলে উপায়? এমন বিষাদ হইতে বাঁচিবার পথ? সেই গানেই, উদ্ধার সেই সুরেই, জীবনের উজ্জ্বল উদ্ধার গানে ও কবিতায়। একটা গাই। অঞ্জনের গান। ‘শেষ বলে কিছু নেই’ শীর্ষক, সম্ভবত অঞ্জনের অভিষেক-অ্যালবাম ‘শুনতে কি চাও তুমি’-তে শুনে গেছি দিনের-পর-দিন, ‘পুরনো গিটার’ অথবা, আজি হইতে বছর-বিশ আগের এক ধূসর-ধূসরতর দূরের জীবনে। ইন্ট্রো-লাইনগুলো এমন : “যখন মনের ভেতর সূর্যটা হঠাৎ ডুবে যায় / যখন আশা-ভরসা সব রাস্তা হারায় / যখন ভরদুপুরে পথের ধারে একলা করে ভয় / যখন বাসের ভিড়ে গলার ভেতর কান্না চাপতে হয় / জেনো তোমার মতোই আমি হাতড়ে বেড়াই / জেনো তোমার মতোই আমারও বন্ধু একটা চাই। // যেমন মাঝদরিয়ার নৌকো ফিরে আসে কিনারায় / ওরে মানুষ যখন আছে তখন হাতও জুটে যায় / শেষ বলে কিছু নেই … শেষ বলে কিছু নেই / শেষ যেখানে — জেনো শুরু সেখানেই।” নিশ্চয়ই। ঋতুনিয়মেই বৃষ্টিদিন ফুরিয়ে আসবে, কেননা শীতেই তো সত্যিকারের ফুর্তি জগতের। শীতেই শীর্ষছোঁয়া ভালোবাসাবাসি, ফুলফোটা, কমলালেবুর সুবাস টিলার ভিতর দিয়া যাওয়া নারীসিঁথির ন্যায় দীর্ঘ বনাচ্ছন্ন পথগুলো ব্যেপে। শীতেই চা-বাগান জেল্লা ধরে বেশি, শীতেই বাইপাসরোডের দুইধার থেকে কর্তিত ধানের ঘ্রাণ ও গেরস্তবাড়ির শুকোতে-দেয়া শস্যসৌরভ ছড়ায় দিগ্বিদিক। শীত হলো বাঁচার ঋতু, অন্তত বাংলায়, শীত লা-জওয়াব। শীতের উত্তর নাই, দক্ষিণ নাই, শীতের নাই প্রাচ্য-প্রতীচী, শীত সর্বময় দিগন্তাধিকারী। শীত এলে উইম্পি কিডের ডায়রি থাকবে না ঠিকই, কিন্তু শুরু হবে নতুন সুরের নতুন অ্যারেঞ্জমেন্টের অর্কেস্ট্রেশন, শীত সর্বকালে রে-অফ-হোপ উইম্পি কিডের নিকট। গোটা বাংলায় শীতের কিরণ, দৃশ্য, গন্ধ প্রভৃতির ইন্দ্রিয়ভারাতুরতা অপরিসীম। শীতেই সুরের জন্ম, সম্ভবত, নতুন দিনপত্রী শীতঋতুর মুখাপেক্ষী। শীতনিশিদিনলিপির সম্ভাব্য নাম নোটেশন্স ফ্রম অর্ফিয়ুস, অথবা কাছাকাছি কিছু। শোনো ওই কান পেতে, শোনা যায়, শিশিরের সুর। ওই শোনো টুপ টুপ … টুপ টুপ … উইন্টার টিউন … শোনো অট্যম স্যন্যাটা … আলতো পাতার গায়ে দ্যাখো কুসুমিত শীতপ্রসাধন … ওই আসে ঘাসফড়িঙের পাৎলা পাখনায় চেপে উত্তরায়নের দিন …
জাল নিয়া যাচ্ছে যে-লোকটা হেলেদুলে বেশ দুলকি চালে হেঁটে, সড়ক-সন্নিকট খাল ও জলাগুলো মন্থর থেমে থেমে দেখছে নিরিখ করে যে নামা যায় কি না, মাছের নড়ন চোখে পড়ে কি না, তারপর অনতি-ঢালু বেয়ে ব্যাকফুটে ফের উঠে আসছে রাস্তায়। ফের হাঁটা। ধান-কেটে-নেয়া নাবাল জমিনের পানে নজর প্রসারিয়া দেখছে। বেশ প্রশস্ত পরিসর পাওয়া যাবে জাল ঠেলে নেবার মতন। মুশকিল হলো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, বেগ যখন-তখন বেড়ে যেতে পারে, বেগবান বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রঝিকুনিও হতে পারে শুরু। তখন কাছেপিঠে শেল্টার পাওয়া যাবে না সহসা। খাল পারায়ে অদূর জমিনে যাবার এ হলো অসুবিধার দিক। সুবিধা হলো যে বেশ গুঁড়োমাছ পাওয়া যাবে। ব্যাপ্ত ও বড় পরিসর জুড়ে হেঁটেচলে-বেড়ানো মাছের সোয়াদ আলাদা। আবার এহেন শখের মাছশিকারী, সিজনশেষের বৃষ্টিদিনে একটা কাহিনি-বলার-মতো ব্যাপার স্মৃতিধৃত রাখবার জন্য জাল-কাঁধে বেরোনো, শহরতলির জমিনে নেমে মৃগেল-বোয়াল তুমি ডিজার্ভ করতে পারো না নিশ্চয়ই, কিন্তু বছরভর গল্প বলার মতো শখের মাছশিকার তো জালবাহক যদি বৃষ্টিতে দুই-চাইর চক্কর ঘুরাণ্টি দেয় তাতেও হয়, বেশ বলবার মতন হয় যে গেল-বছর শুক্কুরবার দুনিয়া-আন্ধাইর-করা বারিষার মইধ্যে গেছিলাম মাছ ধরতে। এরপর শুরু হলো ইয়া-মাবুদ বৃষ্টি আর বৃষ্টি, নদীর পার দিয়া বহুদ্দুর গেছলাম, কিন্তু ঝড়বৃষ্টিসিগ্ন্যাল বেগতিক দেখে শেষে … ফেরার পথ ধরব এমন সময় দেখি কি, বনুয়া গাছের ঝোপ আর কচুজঙ্গলের ভিতর কেমন যেন নড়নচড়ন … একটু আগাইয়া গেলাম, যে দেখি জিনিশটা কি। ইয়াল্লা! দেখি কি …
খালি তো আর জাল দিয়াই মাছ ধরে না লোকে, কিংবা জালেরও তো রয়েছে বহুবিধ রকমসকম প্রকারভেদ, এবং রয়েছে মাছশিকারের বিচিত্র তরিকা, মাছ-ধরার নানা কায়দাকানুন ও যন্ত্রপাতি। কিন্তু কমন কয়েকটা মাছশিকারকৌশল ও কমন কিছু যন্ত্রপাতি স্থাননিরপেক্ষভাবে দেখা যাবে জেলায় জেলায় এমনকি দেশ-দেশান্তরে ব্যবহৃত হতে। দেশের বাইরে কে কেমন করে মাছ-মাংশ ধরে, সেই হিসাব নেই না, সেসব অত নির্ণয় ন-জানি। সিলেট অঞ্চলে যেসব তরিকায় মাছ ধরা হয়, মোটের ওপর অন্যান্য অঞ্চলেও তা-ই। কিন্তু না, ট্রাইব্যাল কম্যুনিটির মধ্যে মাছশিকারের যন্ত্রপাতি ও শিকারকৌশল ও কুশলতা আলাদা। পাত্র জনগোষ্ঠী, সিলেটেই এরা আবহমান বসবাস করে আসছেন, এদের মাছ-ধরা আমি দীর্ঘদিন প্রত্যক্ষ করেছি। এদের শিকারযন্ত্র, কব্জিক্ষিপ্রতা, মাছ-ধরাকালীন তাদের একাগ্রতা, পায়ের প্লেইসমেন্ট, চোখের নিশানা ও নজরদারি, সর্বোপরি এই কাজে তাদের সুচারু দক্ষতা ইত্যাদি বিচারে মেইনস্ট্রিম মাছশিকারীদের চেয়ে এরা আলাদা। তেমনি মনিপুরী কম্যুনিটির জনগোষ্ঠীর রয়েছে এ-বাবতে ভিন্নতা। তাদের মাছ-ধরা ডিটেইলে দেখি নাই বটে, একবার শুধু কমলগঞ্জ-ভানুগাছ অঞ্চলে পথচলতি দৃষ্টি দিয়েছিলাম ছড়াপানিতে খেয়াজাল দিয়া মাছশিকাররত গুটিকয় অনতিবালকের তৎপরতায়, এটুকু খুব-একটা কাজের দেখা বলা যাবে না। তাদের ট্র্যাডিশন্যাল ফিশিং-সরঞ্জামগুলো খুঁটিয়ে-খুঁটিয়েই দেখেছিলাম বছর-দুই আগে এক কাল্চারাল এক্সপোজার ফেয়ার ইভেন্টে। প্রচুর সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ যন্ত্রপাতি তাদের, দেখে এবং কথা বলে মনে হয়েছিল এরাও মাছশিকারদক্ষ জনগোষ্ঠী। যদিও মাছভক্ষণশৌখিন বলে মনে হয় নাই তাদেরে, যতটা শুঁটকিপ্রিয় মনে হয়েছে, অ্যানিওয়ে। এত অল্প জানা নিয়া কথা বলার সমূহ বিপদ সম্পর্কে আন্দাজ করতে পারি, কাজেই প্রসঙ্গান্তর করি। খাগড়াছড়ি গিয়েছিলাম অর্ধযুগ পূর্বে, একহপ্তাকাল অবস্থান করার সুবাদে সেখানকার বুনো ও বিশেষ জাতের একপ্রকার কাঁঠাল খেয়েছিলাম, দুর্ধর্ষ সুন্দর ও স্ট্রং ও শার্প ঝালবিশিষ্ট তেজালো সবুজ কাঁচামরিচ জিহ্বাগ্রে এখনও লেগে আছে, সেইসঙ্গে আরও কতিপয় বিশিষ্ট তরল-কঠিন-বাষ্পীয় আহারদ্রব্য অপ্রাসঙ্গিক বিধায় এ-যাত্রা উল্লেখ হইতে বিরত রওয়া যাইল, এবং দেখেছিলাম মাছ-ধরার অনেক দৃশ্য। দুই-পাহাড়ের ঢালু দিয়া বয়ে-যাওয়া জায়গাগুলোতে জলনালা, স্বচ্ছ জলাশয় বিদেশী সিনেমার ন্যায়, এবং ফিশিং। ডিফ্রেন্ট মনে হয়েছিল। সুদৃশ্য।
গল্পে গল্পে বেলা পড়ে এল। লো ঠাকুরঝি, জলকে চল! কাত্তিমাসের দুপুর গড়াতে-না-গড়াতেই হাত্তির গতরের ছায়ায় ঢেকে যায় চরাচর। হিম হাওয়া গায়ে একটুখানি শিহরণও বুঝি জাগাইতে চায়। কী-এক প্রতীক্ষায় কাতর দুপুরগুলো এই দিনভর কার্তিকের দেশে। এই নবান্নভোলা বাংলায়। এই বিল-হাওরের জলে টানলাগা সময়ে, এই জলশুখা গ্রামনালা আর প্রোষিতভর্তৃকা নারীর ন্যায় রতিবিরহিত নদীদের দেশে। শীতের প্রতীক্ষা? ঋতুরাণী শীতের লাগিয়া এই ইন্তিজার, নাকি অন্য কারোর অন্য কিছুর জন্যে? ম্যেরা পিয়া ঘার আয়া ও-লালজি — বৃষ্টিবিদায়ক্ষণে শীতবোধনপ্রাক্কালে এই গান কোথাও কি বাজিয়া যায় রহি রহি? পিয়া বাসান্তি শীতের তরে এই নিগূঢ় নদীবৃষ্টিনিরের দেশে হেন অপেক্ষাতুরা থাকা — ঠাকুরঝি, সহে না যাতনা, দিবসগণনার ন্যায় মিহি কেরানিগিরি ন-পোষায় আর। ওদিকে দ্যাখো, পড়ে আসে বেলা ওই, নদীঘাটে ছিপ নিয়া লাইন ধরে বসে যাবে সিটিবাজানিয়া হারামজাদা ছোকরাদের দল। ও লো কলঙ্কিনী রাধা — মায়ের তটস্থ গলা শোনা যায় — আজ আর জলে যেয়ে ফ্যাসাদ বাড়াইয়া কাজ নাই বাপু, ওই দেখবি গিয়া যে কদমডালে বসিয়া আছে কানু হারামজাদা। আর বর্ষাকালে এদেশে রাধাটিজিং নিয়া দারোগাবাবুর কাছে নালিশ চলে না, বাদলিবৃষ্টির দিনে কানুদের একাধটু খোঁচাখুঁচি টেইকেন্-ফর-গ্র্যান্টেড মনে করেন ধর্ষণকত্তা দারোগা। আমাদের আদালত-পঞ্চায়েতগুলো তো অতিশয় হারামজাদাদের আখড়া। ঠাকুরঝি লো, চ, বেলাবেলি নিয়া আসি ঠিলা ভরে পানি। ম্যেরা পিয়া আভি-তাক ঘার নেহি আয়া, ঠাকুরঝি, আস্তে চল্, পায়ের তলায় নরম যেন ঠেকল কী — ঝিনুকের কাপ্না নাকি মৃত শামুকের খোল? জল চলে গেছে পাতালে, রেখে গেছে মায়া তার মাঠে মাঠে ছড়ায়ে। উড়িয়া যায় রে চখুয়া পঙ্খী / পইড়া থাকে ছায়া / কোন পরানে বৈদেশ রইলা / ভুলি’ দেশের মায়া / রে বন্ধু, আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি। শীতের দিনরাতগুলো গভীর-গভীরতর ক্রন্দনের, মধুর-মধুরতর কুয়াশাবিভ্রমের, গাছের পাতায় শিমের মাচায় শিশিরের মিঠে ফিসফিসানির। তবে এই হেমন্তকালীন হাওয়াবাতাসের দিনে দ্যাখো বর্ষার স্মৃতি মুছিয়া যায় নাই পুরোপুরি। দ্যাখো গর্তখন্দবহুল ধানকাটা-পানিনামা মাটিগন্ধা মাঠ জুড়ে সদ্যগত বর্ষাদিনের নৌকাচিহ্ন, লগি ও বৈঠার গোত্তার দাগ সারাটা মাঠময়, দ্যাখো খড়ের গোড়ালিগুলো চোখা মাথা বের করে আছে এখানে-ওখানে সর্বত্র। দ্যাখো চুরটের দুমড়ানো প্যাকেট, কোল্ডড্রিঙ্কসের ক্যান্, মাঝে মাঝে এটা-ওটা আরও কত টিনের কৌটা কাচের বোয়েম। ভাঙা কাচ, ভাঙা ঝিনুক, ভাঙা শামুক। মাঝে একটা জায়গায় কেউ দ্যাখো কোনকালে পেতে রেখেছিল জাল, তুলে নিয়ে গেছে জাল ও জলের ফসল খালুই ভরে চাঙারি বোঝাই করে এন্তার মাছ, তবু তার কাঠাম তুলে নেয় নাই। তিনকোণা স্থাপনা পড়ে আছে, দেখা যায়, একটু দূরে দূরে। এখন তো বাইম ধরছে তারা। বাইম মাছের কাণ্ডকারখানা আজব কিসিমের। মাটির অতলে যেয়ে সেঁধিয়ে থাকতে জানে তারা। একদম শুকনো খটখটা মাটি কোদাল দিয়ে খুঁড়ে তলদেশ থেকে টেনে বের করছে সাপের ন্যায় ঝিলমিলে সুন্দর বাইম মাছ, এই দৃশ্য আসন্ন শীতের মিঠা মাঠের ব্যাপ্ত রোদ্দুরে দ্যাখো ঝিল্কিয়ে উঠছে। এইসব জল, এইসব জাল, এইসব মাছধরা বাংলার কবিতায় এসেছে কি ঠাকুরঝি? জানিনে তো কবিতার কিচ্ছুটি। কিন্তু যদ্দুর নয়ান মেলিয়া দেখিতে পাই, তাতে মনে হয়েছে যে সেভাবে ব্যাপারটা আসে নাই কবিতায়। কিন্তু কথাসাহিত্যে এসেছে বটে। তা-ও তো খুব স্ট্রং কিছু বলা যাবে না। যা আমরা আপন নয়নে হেরিয়াছি, তার কমই তো সাহিত্যে এসেছে। পদ্মানদীর মাঝির কথা বলছ? অথবা মল্লবর্মণের তিতাস? বটে ঠিকই। কিন্তু মাছেভাতে বাঙালির প্রবাদধন্য দেশে এইসব টুকিটাকি দৃশ্যকল্পের দুইয়েকটা আখ্যান তো খুব ফর্মিডেবল বলতে মন সায় দেয় না ঠাকুরঝি। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে একজনের লেখা পড়েছিলাম দশ-পনেরো বছর বা তারও অধিক কাল পূর্বে। পেয়েছিলাম একদম আঁশটে গন্ধওয়ালা মাছধরাধরির রাত্রিদিনের সিনসিনারি। ইমদাদুল হক মিলনের কথা বলছিলাম গো! ছিঃ ছিঃ, ঠাকুরঝি, নাক সিঁটকায়ো না লো! অল্প বয়সে কত কী করেছি ইয়ত্তা নাই তার। কোনটা পাপ আর কোনটা পুণ্যি তা বুঝায়ে দেবার জন্যি তোমার দাদা তো তখন ছিল না আমাগের বগলে। ভাগ্যিস ছিল না। তাতে অনেক মর্কত-জহরত-হীরেচুনিপান্না সম্ভোগ করেছি গো, মাইরি বলছি, সোয়াদ পাই দেহ জুড়ে আজও সেসবের। মিলনের কয়েকটা আখ্যান আজও ভুলি নাই। একটা সাংঘাতিক উপন্যাস ধারাবাহিক পড়তাম তখন জনকণ্ঠ পত্রিকার শুক্রবাসরীয় পৃষ্ঠায়। কেবল এই উপন্যাস অনেকদিন খুঁজেছি পরে, ব্যাটে-বলে পাইনি বাজারে, সংগ্রহে রাখতে চেয়েছিলাম। উপন্যাসটার নাম, মনে আছে, অধিবাস। নিবারণ নামের একটা ক্যারেক্টার, পেশায় নাপিত সে, মিলনের অনেক গল্পে এসেছে ঘুরেফিরে। সেই নিবারণের গল্পেও মাছধরার দৃশ্য পেয়েছি অনবদ্য কয়েকটা। তারপর নূরজাহান। এই উপন্যাসটার পয়লা বালামে কেবল শীতঋতু ধরা হয়েছে। মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুরের শীত, খেজুরগাছ ও রস-সংগ্রহণ, ও অন্যান্য। এমন শীত বাংলা সাহিত্যে এর আগে, এর পরে এখন পর্যন্ত, আসে নাই আর। জিভে টের পাওয়া যায় শীতের মধুতুখা, গায়ে শীতের আঁচ, পড়তে পড়তে চোখের সামনে বিশাল স্ক্রিনে সিনেমাস্কোপিক উইন্টার দেখা যায়। খেজুরের রসের ঝাঁঝ জিহ্বাগ্রে টের পাবে তুমি পড়তে পড়তে। এখন তুমি তো বলবা নরেন মিত্তিরের রস গল্পের কথা। তা, সেইটাও ভালো, রস তো ভালো গল্প, নূরজাহান পড়ে তুমিও বলবে এমনিভাবে যে রসও খারাপ গল্প না। আল্লার কিরা, ঠাকুরঝি, বাড়িয়ে তো বলছিইনে এমনকি একটুও মিছে কইছিনে। কিন্তু মাছধরা কাকে বলে, বাংলার বর্ষাকাল কি জিনিশ, দেখতে চাইলে সেকেন্ড পার্ট নূরজাহান পড়ে দেখো গে। দ্বিতীয় খণ্ডে এসে মিলন খেই হারিয়েছেন মনে হয় মাঝে মাঝে। এর একটা কারণ মনে হয় যে লেখকের মনে হয়েছিল এই চান্সে একটা ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ বা একটা ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস্’ লেইখা ফালানো যাউক। ফলে দুনিয়ার ক্যারেক্টার দিয়া ভরাইয়া রাখছেন নূরজাহান লাস্ট পার্ট, ফার্স্ট পার্টের কম্পেক্টনেস এবং ইউনিটি অফ আর্ট গিয়েছে ব্যাহত হয়ে। অ্যানিওয়ে। ঠাকুরঝি, এইসব তো আমরা ভালো বুঝি না। তবে বর্ষাকাল এসেছে সেখানে একদম বাপ-কা-ব্যাটা বাংলার মতন। এসেছে মাছধরা। সমরেশ বসুতেও মাছধরা আছে। একটা দারুণ দৃশ্য আছে ওয়ালীউল্লাহ-র লালসালুতে। তেমনি দেখেছি শামসুদ্দীন আবুল কালামের উপন্যাসেও। শওকত ওসমানেও পড়েছি কিছুটা। তা, এমন তো বঙ্গজন্মা সমস্ত কথাসাহিত্যিক একবার-দুইবার বর্ষা ট্রাই করেছেন তাদিগের মুদ্দতে। কিন্তু কবিতায়? সেইভাবে এসেছে কি? বর্ষায় তো টৈটুম্বুর বাংলা কবিতা, নাকিকান্নাভরা স্যাঁতসেঁতে বর্ষাই বেশি, স্মার্ট রেইনি সিজনও প্রভূত পরিমাণে জায়গা ধরে রেখেছে হাজার বছরের সত্যিমিথ্যা গালগল্পভরা বাংলা কবিতায়। কিন্তু মাছধরা নাই। তার মানে কি এ-ই যে মাছধরা থাকতেই হবে কবিতায়? ছিঃ ছিঃ, ঠাকুরঝি, সিধা বাতচিতের বাঁকা মানে কোরো না বাছা। আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি কি না, তাই বলছিলাম। অধুনা বার্গার-বার্বিকিউপ্রিয় যদিও। কবিতায় মাছধরা খানিকটা পেয়েছি বটে মোহাম্মদ রফিকে। কিন্তু খুব-যে পড়া হয়েছে, খুব-যে টেনেছে, তা নয়। সেইটা আলাদা বাত।
তবুও কবিতায় বৃষ্টির ছড়াছড়ি, বাংলায়, বৃষ্টিতে বেঙ্গল বুঝি মিসমার হয়ে যায়। একেবারে স্যাঁতসেঁতে ন্যাতানো পঙক্তিবৃষ্টিই বেশি যদিও, দুইপারেই, সোমত্ত পঙক্তিও কম নয় নেহায়েত। সমস্তটুকুই না-হলেও মনে হয় সেসবের অধিকাংশ স্যুপার্ফিশিয়্যাল; রোম্যান্তিকতাকীর্ণ সুজলা-সুফলা বারিপাতের বর্ণনা; হালে, একেবারেই রিসেন্ট ফেনোমেনা, একটা চালাক-চালাক লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা। নাগরিকতা? হ্যাঁ, আবার অত সোজা না ব্যাপারটা; খালি কিচিরমিচির দিয়া তো পাখি হয় না, চিকেনছানার আওয়াজটাও ওই কিচিরমিচিরই। কিন্তু, তুমি জিজ্ঞাসিবা, কবিতায় বৃষ্টি না-থাকলেই কী এমন ক্ষতি রে বিন্দিয়া? না, কান্দে না, আমি ঠিক ওইটাই মিন্ করি নাই। বৃষ্টি ভীষণভাবেই আছে, কেবল কতিপয় ইমেইজ্যারিতে এবং খোদ বৃষ্টিশব্দোচ্চারের পৌনপুনিকতায়। বৃষ্টিসিজনে রেইনফ্যলিং ছাড়াও শতেক অনুষঙ্গ-প্রসঙ্গ রয়েছে যেসব কি-না বাংলাকাব্যে এখনও গরহাজির। দৈনন্দিনতাকীর্ণ বর্ষাকাল বাংলা সাহিত্যপরিসরে সেভাবে এল কই? কিন্তু কবিতায় রেইনসাইনের আনাগোনা, বাংলা বাদলিবৃষ্টির কবিতারূপায়ণ, আপাতত পাশ কাটায়ে যাবার জোর চেষ্টা আছে এই নিবন্ধে। কেননা কাব্যে একটা-কোনো বস্তু/ঘটনা/প্রাণের প্রবেশ ও উদ্ভাস চাইলেই ঘটানো যায় কি না, তা বটে এক মাথা-ঘামানোর-জোখা ব্যাপার। একটা সাক্ষাৎকারে সিলভিয়া প্লাথ এই ব্যাপারটা আলোয় এনেছিলেন; বলেছিলেন যে, কবিতায় নিত্যনৈমিত্তিক বহু জরুরি জিনিশই তো নিয়া আসা যায় না, বাদ দিয়ে যেতে হয় অনিচ্ছে সত্ত্বেও বহুকিছু; — উদাহরণ দিতে যেয়ে সিলভিয়া বলেছিলেন যে, একটা উপন্যাসে রোজকার তুচ্ছাতিতুচ্ছ অথচ প্রিয় জিনিশপত্তর — যেমন টুথব্রাশটা বা প্যেট-অ্যানিম্যালটা — আনা যায় যেভাবে, একটা কবিতায় একজন কবি তার প্রিয় পোষাবিলাইটাকে সেভাবে আনতে পারেন না। পারেন না, মানে, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কবিতালিখনের কিছু অনির্দেশ্য কনভেনশনের কারণেই কবির পক্ষে পারা সম্ভব হয় না। আজকাল অবশ্য কবিতাধারণা প্লাথের সময় থেকে বেশ-খানিকটা আগায়েছে, সেইভাবে এক্সক্লুশন্ প্রোসেসে এখন কবিতা আপনি না-লিখেও পারেন। তবে রেইনি সিজনের হাজারবছরি বাংলায় সিলভিয়া প্লাথের কথাটা আক্ষরিকার্থে নেয়াটা কাজের কথা হবে না মনে হয়। দিনরাত রেইনপাত হচ্ছে যে-দেশে, রেইনি রিচুয়্যালগুলো লুপ্ত হয়ে যায়নি যেখান থেকে, এবং কবিসাহিত্যিকেরাও দিব্যি লিখে চলেছেন যেখানে লাইনের পরে লাইন এবং জমাতেছেন মেঘের পরে মেঘ তথা আঁধার করিয়া আনিতেছেন রবীন্দ্রনাথসম, সেখানে মেঘবাদলির বহুবিধ অন্যান্য অনুষঙ্গ যথা মাছধরা আসবে না কেন, প্রশ্ন বলুন বা খটকাটা আপাতত এ-ই। ইন-শর্ট, অফ কোর্স, সংক্ষেপে এটুকু।
কবিতা বাদ দেই। চিত্রকলা ছাড়া আর কোথায় এসেছে মেঘমেঘালির অন্যান্য দৈত্যদানো? গল্পে এসেছে? হ্যাঁ, বেশ; উপন্যাসে? এসেছে কিছুটা। নাটকে? এইটা আবার কী জিনিশ? রাজধানীতে পেঁয়াজু-পপকর্নবিলাসী স্ট্রিটসাইডের ঘুঁপচি মঞ্চে যে-ব্যাপারটা মাঝেমইধ্যে হয় সেইটা? নাকি বিকেলের সিনে মর্নিংলাইটের জেল্লা মাখানো মহাশৈল্পিক টিভিফিকশন বলিয়া গালভরা নামডাকের যেই জিনিশটা স্পন্সর্ড হয়, সেইটা? থাক বাপু, গোলমেলে লাগতিছে। সিনেমায় এসেছে? একরত্তি ঋত্বিক-রায় বাদ দাও; বলো কমার্শিয়্যাল্ বিগার পিকচারটা আদতে কেমন। গানের সিনে নায়কনায়িকার সিক্ত নখরামির স্বার্থেই বৃষ্টি আসে এফডিসিতে। এর বাইরে, প্যারাল্যাল ম্যুভিম্যুভমেন্টে, বিকল্পধারায় বৃষ্টিবাদলির কি বিত্তান্ত? ওই বৃষ্টি ঝরিতিছে, ইট ইজ্ রেইনিং ক্যাটস্ অ্যান্ড ডগস্, এর বাইরে মোরশেদ-মোকাম্মেল-মাসুদ কারো মধ্যে কোথাও কি নিজের ছেলেবেলায় দেখা বারিপাতপারিপার্শ্বিক সহস্র অনুষঙ্গের পুঙ্খ খুঁজে পেয়েছ কখনো? শুধুই বৃষ্টিপাত হয়, জিয়োগ্র্যাফিব্যুকের মুখস্থ বৃষ্টিপাত পর্দায়, কিন্তু বরিষনের আগে-পরে মাছধরা বা ভারী-বৃষ্টিপাত-ডিউরিং মিষ্টি বদমায়েশি কি বৃষ্টিদুপুরের পুকুরে লাইক্রীড়া পাওয়া যায় হাজার বছরের যৌথ প্রযোজনার বাংলা ছায়াছবিকিনারায়? কিংবা গানে? গীতবিতানের রোম্যান্টিসাইজড বাতায়নাভিজাত্য ব্যতিরেকে বাংলা গানে রেইনি সিজনের মোটিফগুলো কই? বিপুলা বারিঝরন্ত ধরণী, তার কতটুকুই-বা জানেন আপনে? আজ্ঞে, তা বটে, তা বটে।
লেট আস্ গ্য দ্যেন, য়্যু অ্যান্ড আই / হোয়েন দ্য ইভনিং ইজ্ স্প্রেড আউট অ্যাগেইন্সট দ্য স্কাই … ঠিক আছে? লেখোনাকো বরং নিজেই তুমি … জীবনানন্দ কোথাকার! … সমারূঢ়তা রাখো। বলিলাম ম্লান হেসে, দ্যাখো বাপু, রেইনি সিজনে এহেন অমলের ন্যায় ব্যাল্কোনিগ্রিলের খোপ থেকে চেয়ে চেয়ে উল্টাসিধা বহুকিছুই দেখা যায়, সেসব অন্ধের ঐরাবতদর্শনেরই নামান্তর। তবে একবার যদি বের হতে পারো, মোড়ের দোকানটা অব্দি যেতে পারো কোনোমতে, দেখবে ফলদোকানির পসরায় কেমন খুশিঝিলিক, দেখবে রোডডিভাইডারের পাশে ভেড়াগুলো ভেজা লোম নিয়া আরও সন্তসম বুজুর্গ হয়েছে কেমন, পলিথিন পিঠে প্যাঁচিয়ে রিকশাচালকেরা দেবদূতের মতো ধ্যানাচ্ছন্ন বৃষ্টিতে রিকশা বাইছে কেমন সৎ ও সাবলীল … মনে হয়, ‘নির্বাণ … নির্বাণ …’ বলে ডেকে-যাওয়া মেঘদল ব্যান্ডের কাচপোকাপাখিটাকে এই বৃষ্টিস্ট্রিটেই দেখতে পাওয়া যায়। ট্যাগোরানুবর্তনটা খানিক ঢিলা দাও এইবার, আল্লার দোহাই, ডিঙাখানা ঘাটে লাগাও যদি বৃষ্টিপানশালায় নিতান্ত গলা ভিজাইবার ইচ্ছা থাকে। হ্যাপি বৃষ্টিডে এভার।