তরঙ্গায়িত প্রেম । বদরুন নাহার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০১৭, ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ, | ১৯৫৪ বার পঠিত
হ্যালো … হ্যালো … কিউবি … কিউবি …। ধুর, নেটওয়ার্ক খারাপ …
আসিফের কথা দিব্যি শুনতে পাচ্ছে শাকিলা, অথচ ও চিৎকার করেই যাচ্ছে। নেটওয়ার্কের সমস্যা হয়, তা ঠিক, কিন্তু কিউবি মানে কি? গত পড়শুই তো ওকে ফোন নম্বর দিলাম, ওকি সেভ করেনি? কি সব কিউবি কিউবি বলছে! শাকিলা কিছুতেই বুঝতে পারছে না, বিষয়টা কি ঘটল! নেটওয়ার্ক খারাপ থাকলে অনেক সময় একপক্ষ কথা শুনতে পায় না। কিন্তু কথা না শুনলেও তো আসিফ জানে এটা ওর নম্বর, তবুও ও কেন কিউবি কিউবি বলে চিৎকার করে যাচ্ছিল? ফোনের এই বিভ্রান্তির পর শাকিলার হঠাৎ প্রচ- হাসিই পেল, আসিফ-এর ফোনের জন্য এখনও সে উতলা!
সে ছিল শাকিলা প্রথম প্রেম। আহা, কী দুরন্ত সেই দিন! সজ্জন কান্দা থেকে বেড়াডাঙ্গা বা লালের মোড় থেকে চৌরঙ্গী। প্রতিটা মোড়ে মোড়ে স্মৃতি জমে আছে। বেড়ে ওঠা শহর, স্কুলের গেট কিংবা কলেজের সাদা ড্রেস সব কিছু যেন আজ মায়ায় মোড়ানো। নীল রঙ আজও শাকিলার পছন্দ। স্কুল ড্রেসে ভাঁজ করা সাদা স্কার্ভ, সুতি সেই স্কার্ভের কড়া মাড় দিয়ে আয়রণ করতে করতে কেমন হাসপাতালের সিসষ্টারদের মাথার স্কার্ভটির মতো হয়ে যেত! কোন কোন মেয়ে অবশ্য মাড় ছাড়া ত্যানা ত্যানা স্কার্ভ পড়ত। শাকিলার তা ভালো লাগত না। বুকের উপর সদ্য মাথা তুলে জেগে ওঠা টিলায় সে অগোছালো ভাঁজ পড়ে থাকা, মোটেও সুন্দর নয়। টিপটপ করে ড্রেস পড়া, এমন কি পায়ের সাদা কেড্সে সাপ্তাহন্তে ধূয়ে নীচে চকের প্রলেপ এঁকে শনিবার স্কুলে যেত সে। এই নীল সাদার মধ্যে হলুদ তামাটে রঙের শাকিলাকে দেখে জেলা শহরের ছেলেদের স্কুল ফাঁকির প্রবণতা বাড়ে। কেউ কেউ নিজেকে সামলাতে না পেড়ে গার্লস স্কুলের পাশের মার্কেটে দিন কাটায়। সেই শাকিলা! আজ পঁয়তাল্লিশ বয়সের পরিপূর্ণ নারী। স্কুলের চাকুরী সামলে, ছেলের পড়াশোনার তদারকী করে, স্বামীর ভালোবাসায় আচ্ছন্ন থেকেও কেমন বাল্য প্রেমের স্মৃতিতে ডুবে যায়!
সাপ্তহ খানিক হলো সে বাবার বাড়ি এসেছে। হঠাৎ করেই বাবার হার্ট এটাক। প্রথম দফার ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে সময় লাগছে। তাই শাকিলা ছুটি নিয়ে এসেছে, বাবা-মাকে খানিকটা সময় দেবে। গত পড়শু মায়ের কিছু কেনা কাটা করতে নিউমার্কেট গিয়ে হঠাৎ দেখা হলো আসিফের সঙ্গে। প্রায় তিরিশ বছর পর! প্রথমে তো শাকিলা চিনতেই পারছিল না। কিন্তু লোকটির বারবার তাকানো দেখে, কেন যানি চিনি একটা সূত্র চোখে ধরা পড়েছিল। শেষ মূহুর্তে পাশ কাটিয়ে যাবার সময়, মনেপড়ে। শাকিলা সহসা বলে উঠে, আসিফ নাহ্?
লোকটি ঘুরে দাঁড়ায়, এবং শাকিলাকে চমকে দিয়ে বলে — তুমি তো এখনও অনেক সুন্দর!
অবাক লাগে শাকিলার, তারমানে ও চিনতে পেড়েছিল! আর পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করেছে! বিস্ময়টা সামলে নিয়ে বলে — তুমি কিন্তু অনেক বদলে গেছ! চেনায় যাচ্ছিল না। এমন মুখভর্তি দাড়ি, কাবুলি পোশাক?
আসিফ লাজুক হেসে বলে — সব আল্লাহর ইচ্ছা। তোমার স্বামীটিও কিন্তু বেশ সুন্দর।
—তুমি মাসুদকে দেখেছো?
—গত বছরই। তুমি ঈদে এসেছিলে, ওই রিক্সায় তোমার পাশে ছিল। তোমার কি ওই একটিই মেয়ে?
— হ্যাঁ। তোমার?
— আলহামদুল্লিহ্, আল্লাহ্র রহমতে তিন মেয়ে।
—তুমি কবে থেকে এত হুজুর হয়ে গ্যালা?
আসিফ খানিকটা লজ্জা পায় — সব আল্লাহর ইচ্ছা, তার পথে চলার চেষ্টা করছি।
শাকিলার সেই আসিফের চেহারা ভেসে ওঠে, একটা মিঠুন চক্রবত্তির মতো স্টাইল করা ছেলে। ওই আমলে ওর একটা মোটর সাইকেল ছিল। শহরের রেমিওদের দৌড়ে যে কারণে সে খানিকটা এগিয়েই ছিল। কিন্তু আজও সে কেবল শাকিলার মুখায়বের সৌন্দের্য্যরে প্রকাশই করল মাত্র! শাকিলার তো কেমন চেনা মমতার মতো লাগছিল, যেন সেই লুকিয়ে রাখা পুতুলের বাক্স। সেই তালপাতার ছাউনি দেওয়া ঘরের রান্নাবাটির গন্ধে, আমি যেমন আছি তেমন রব বউ হবো নারে! কে বলেছে ওতটুকু বয়সে বউ হবার কথা। কি সব স্বপ্নে তখন ভবিষ্যত নেমে আসতো!
আসিফের কথায় ভাবনা ছিন্ন হয়।
— কয়দিন থাকবা?
—এই তো আর দিন দশেক আছি।
— তোমার ফোন নম্বরটা দাও।
ফোন নম্বর বিনিময় করে ফেরার পথে শাকিলার মন কেমন করে। স্মৃতির দরজা হাট করে খুলে যায়। এত বছর পর কি অবলীলায় তারা ফোন নম্বর বিনিময় করল! অথচ সেই সময়, সেই ক্লাশ সেভেনে। একটা ফোনের জন্য শাকিলার জীবনে কত ঝড় বয়েগিয়েছিল। সারা শহরময় সে কাহিনী অমর প্রেমের প্রথম খন্ডে প্রকাশ পায়।
না, নিজেকে আরও স্থির করতে হবে। কোথায় সেই কন্ঠ তার, পাগলা হাওয়ার পাগল দিনে..। শাকিলার ভেতরটা হু হু করে ওঠে। এখন আর গান গাওয়া হয় না। মেয়েটা সারাদিন পড়াশোনায় মুখ গুঁজে থাকে, গানটান শোনেও না। সব কিছু শাকিলার বিরক্ত লাগে, চারপাশের সবাই যেন অদ্ভুত। এইসব ভাবনায় বা তার কেন আসে? মেজাজ খিটখেটে থাকে। কেন এমন করে সে? একি সন্ধিক্ষণ? বয়সের হাওয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দিলো…
তখন কোন একটা ভেপঁসা গরমের সময়। সম্ভবত জুন মাস, বৃহস্পতিবার। হাফ স্কুল ছিল। ফেরার পথে আসিফ একটা কাগজে ফোন নম্বর ধরিয়ে দিয়েছিল। সবে প্রেমের শুরু, তাই শুক্রবারের ছুটিটাকে অনেক দীর্ঘ মনে হয়েছিল তাদের! ঠিক করে, ফোনে কথা বলে পুষিয়ে নেবে সময়।
মফস্বলের দুপুর মানেই বাড়ি সুদ্ধ লোকজনের ভাত-ঘুম। এর মধ্যে এই কাঁঠাল পাকা গরম। সবাই ঘুমালেও শাকিলার কিছুতেই ঘুম নেই। ফোন নম্বরটা এতক্ষণে তার মুখস্থ হয়ে গেছে। সে সারা বাড়িতে চক্কর দেয়। মা খোলা ঘরের বারান্দায় মেঝেতে পাটি পেতে ঘুম, মার পাশে শান্তও ঘুমাচ্ছে। দাদীর ঘরে জরিনা আর দাদী সব ঘুমে কাঁদা। ড্রইং-রূমে বাবা নাক ডাকচ্ছে। শাকিলা ড্রইং রূমে পা টিপে টিপে ঢুকে, সাইট টেবিলে রাখা ফোনের পাশে বসে থাকে। বাবা একটু নড়ে উঠলেই চমকে যায়। অবস্থাটা যেন সংকাটাপন্ন, রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জরী?
অনেকক্ষণ ধরে বাবাকে পর্যবেক্ষণ করে শাকিলা। গভীর ঘুম, এমন নিঃশ্বাসের পতন ঘটিয়ে বাবা কত অসাহয়ের মতো ঘুমায়! আগে খেয়াল করেনি। তবে কোন সহানুভূতির চেয়ে সত্য যা মনে হয়, এঘুম চট করে ভাঙ্গবার নয়। তাই সে ডায়াল টোনে বাঁজতেই, রিং-এ হাত ঘুরিয়ে একে একে নম্বর টানে । রিং বাজচ্ছে, কতক্ষণ! ধরছে না কেন? নিঃশ্বাস বন্ধ হবার যোগার। অবশেষে ওপাশ থেকে, সাড়া এলো।
—হ্যালো?
—জ্বী এটা কি আসিফদের বাসা?
—আমি আমি… (ঢোক গিলে বলে) — আমরা এক স্যারের কাছে পড়ি।
কি এক শ্বাসরূদ্ধ কর অবস্থার মধ্যে পড়ে যায় শাকিলা। কথার পিঠে কথা সাজাতে তার খুব সময় লাগে না, একের পর এক মিথ্যা কথা বলে যায়। অবলিলায় আসিফের মাকে সহজেই বোঝাতে পেড়েছে যে একই স্যারের কাছে তারা ব্যাচে পড়াশোনা করে। স্যারের নোটের জন্যই এই ফোন। কিন্তু এদিকে বাবা জেগে যাবার ভয়। বুকের মধ্যে তো কাপুনি থাকেই। এযেন থর থর প্রথমও পরশ কুমারী! ফোনটা রেখেই দৌড়ে বেড়িয়ে আসে। নিজের বিছানায় শুয়ে কাঁপতে থাকে, যাক্ ফোন নম্বরটা ঠিক আছে। আসিফের মায়ের কথার ধরণ-ধারণ নিয়ে ভাবতে ভাবতে হয়ত ঘুমিয়েই গিয়েছিলো শাকিলা, তখন বাবার ভারী কন্ঠে জেগে ওঠে,
—তোমার ফোন আসচ্ছে,
হঠাৎ ভাঙ্গা ঘুমে, দরদর করে ঘামচ্ছে সে। কিছু বুঝতে পারে না, বাবাকে এমনি একটু বেশী ভয় পায়। স্থানীয় থানার দারোগা বলে শুধু এলাকাবাসীই না, বাড়ির সবাই ইয়াসিন সাহেবকে সমীহ করে চলে। শাকিলার মাথা কাজ করে না, বলে— আমার ফোন?
—হুম। একটা ছেলে, কি যেন নাম
শাকিলার হঠাৎ কি হয়, একটি ছেলে শোনার সাথে সাথে সে বুঝে যায়। নামের আর প্রয়োজন নেই। সে কোন দিকে না তাকিয়ে দৌড়ে যায় ড্রইং রুমে চলে যায়, তুলে রাখা ফোন ধরেই সে-কি উত্তেজনা। মুহূর্তে ভুলে যায় সব কিছু! বাবার ওমন রাগী মূর্তি যে দরজায় দাঁড়িয়ে, সেটাও চোখে পড়ে না শাকিলার। বাগবাকুম পায়রা, মাথায় দিয়ে টায়রা! কত্তক্ষণ? বাবা এসে রিজিভারটা কেড়ে নিতেই নিজের ভুল বুঝতে পারে সে। ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে। থানার দারগা বাবুর চোর পেটানোর লাঠিটা উঠে এসেছে হাতে। শাকিলার হাড্ডি মাংস আলাদা করতে ব্যস্ত তা। পাড়া মাথায় করা হুল্লোর শুরু হয়। তপ্ত জুনের বিকেলবেলা। ভাত ঘুম ভেঙ্গে মা এসে শাকিলার উপর উবু হয়ে শরীর পেতে না দিলে, দারোগা বাবু সেদিন নতুন কবর রচনা করতেন। ভাবতে ভাবতে শাকিলার অজান্তে গা এখনও কেঁপে ওঠে। ওঘর থেকে বাবার কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে, রোগে আজ বাবা কত র্শীণ হয়ে গেছে। সেই তেজ শরীর বা মন, আজ কোথাও হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। হার্টে রিং পড়াতে হবে কদিন বাদেই।
জীবনে সেই মৃত্যুসম যন্ত্রনাও শাকিলাকে প্রেম বিমুখ করতে পারেনি। বছর দুই শহর ছেড়ে অন্য শহরের কাটাতে হয়েছে তার। নির্বাসন। রাজশাহী শহরে মায়ের ছোটবোনের বাসায়। সেই সময় আসিফের প্রতি তীব্রটা মরে যায়। বাবাকে আসিফ বলেছিল— আপনার মেয়েই তো আমাকে ফোন করেছে। ওই বয়সে শাকিলা সে অপমান সর্য্য করতে পারিনি, আসিফের উপর ভীষণ রাগ জমেছিল। তবুও এতদিন বাদে সে সব অতীত যেন। আসিফকে ফোন করতে কোন দ্বিধা লাগল না। আসিফের সঙ্গে দেখা হবার ঘটনা মামুনকেও বলল শাকিলা। তার বর্তমান চেহারা আর অতীতের কথা বলতে বলতে দু’জনে বেশ খানিকটা হাসি-ঠাট্টাও করেছে কাল। মামুন বলল— চল্লিশ পেরুলে শুধু পুরুষ নয় নারীও প্রেম জাগে শাকিলা বেগম। দেখো বাবার অসুখের ওজুহাতে স্বামীকে ফাঁকি দিও না।
সেই নির্বাসিত জীবনের উপলব্ধিও শাকিলার জীবনের এক অধ্যায় হয়ে আছে। নতুন ভালো লাগার জায়গা, বিষয় আর মানুষ এসে জীবনে ভির করেছিল সে সময়। সামনে আনন্দ খুঁজে পথ চলতে জানে সে। সারাটা জীবনই তো সে ভালোবাসার সন্ধানে কাটালো! আহা, জীবন!
শাকিলা আসলে কি? নারী না নদী? একবার প্রশ্ন করেছিল সহপাঠি হায়দার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্ত্বরে বসে বাংলা সাহিত্যের কূলপাল রবিঠাকুরের মেঝ বৌঠানের সেই খুঁনসুটি নিয়েই কথা হচ্ছিল। তখন হায়দার শাকিলার দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে প্রশ্নটি তুলেছিল। কিন্তু তার কোন উত্তর দেয়নি শাকিলা। তার অপেক্ষা ছিল মাসুদের জন্য সকল প্রশ্ন আর উত্তরমালার সমবেত উপস্থিতি কেবল মাসুদই ঘটাতে পারতো। সেই ছেলেবেলায় প্রেম করার অপরাধে খালার বাসায় নির্বাসিত হওয়া শাকিলা আর ছোট নেই। নির্বাসন কাল পেড়িয়ে এখন সে জ্ঞান আহরণে যেন সূদুর চীন! এখানে দারোগা ইয়াসিন আলীর লাঠি নেই, তাই মাসুদই সই। যোগ্য বক্তা সে, সাহিত্যের নাড়ি নক্ষত্রের হিসাব তার মতো কেউ রাখেনা। ফলে তার প্রতিটি কথাতেই থাকে সুমধুর শব্দের খেলা, শাকিলা সহসা প্রেম ফিরে পায়। যেন আসিফ নয় সে আসলে সারাজীবন মাসুদকেই খুঁজে বেড়িয়েছে!
তারপর বিয়ে, সংসার। মাসুদের সঙ্গে অম্ল-মধু। শীলার জন্ম, চাকুরী সবকিছু কেমন নির্ধারিত। একই গতীতে চলতে চলতে শাকিলা যেন স্থির, পদ্মপুকুর। সবাই দেখে, প্রসংশা করে। কিন্তু সে নিজেই জানে না এমন স্থিরতা আসলেই কাম্য কিনা? মাঝে মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। অজানা, নতুন কিছু। নতুন তরঙ্গে ভেসে যাবার সাধ! আবার নিজেই কেমন গুটিয়ে যায়, শীলার টিফিন বাটি সাজাতে। মাসুদের সঙ্গে নতুন ঝগড়ার ইস্যু হয়ত খুবই সামান্য বিষয়। বাজার থেকে গুড়ো মসলা আনতে ভুলে যাওয়া, এমন কোন অপরাধ নয়। তবুও শাকিলার মনে হয় সংসারটা কেবল তার একার দায়! মাসুদ উদাসিন, কলেজ থেকে ফিরে সে রাইটিং টেবিলে নতুন কবিতা লেখে। শাকিলার ভীষণ কষ্ট হয়, সেখানে যে নারীর বর্ননায় মাসুদ স্বপ্নবোনে, তা কোন কালেই শাকিলার বর্ণনা নয়। একটা পদ্মপুকুর হয়ে যাওয়া শাকিলা, রাতময় অক্ষরের শরীরের কেবল নিজের ছায়ায় খুঁজে ফেরে! মাসুদ জানায়, আমি তো সে দিব্যি দেইনি, যে কেবল তোমাকেই হতে হবে আমার কবিতা। আমি কলমকে মুক্ত করে দিয়েছি।
সে কথা শাকিলাও জানে, স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে পড়াতে কী উদার আর বিস্তৃত ব্যাখ্যায় মহৎ করে তোলে টেক্সবুকের পৃষ্ঠা। অথচ ঘরে ফিরে সে সব ভুলে যায়! মাসুদ আজও পথে হারিয়েছে ষোল শিকের নতুন ছাতা। তা নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি নাকি অতিসাধারণ গৃহিনীদের মতো! ছোট গন্ডীর কাজ। শাকিলাকে মানায় না। এই যে শাকিলাকে মানায় না, তারমানে মাসুদ তাকে উঁচু কোনো দাড়িপাল্লায় মাপে, তা ভেবে দেখার সময় কোথায় শাকিলার? -আপা কি রান্না করমু? সহসা মেয়েটির উপর ক্ষিপ্ত হয়ে মাসুদের দেওয়া উঁচু আসন ছেড়ে নিজেকে নামিয়ে আনে সে, রাগের কন্ঠে বলে ফেলে — আমার মাথা।
না, নিজেকে আরও স্থির করতে হবে। কোথায় সেই কন্ঠ তার, পাগলা হাওয়ার পাগল দিনে..। শাকিলার ভেতরটা হু হু করে ওঠে। এখন আর গান গাওয়া হয় না। মেয়েটা সারাদিন পড়াশোনায় মুখ গুঁজে থাকে, গানটান শোনেও না। সব কিছু শাকিলার বিরক্ত লাগে, চারপাশের সবাই যেন অদ্ভুত। এইসব ভাবনায় বা তার কেন আসে? মেজাজ খিটখেটে থাকে। কেন এমন করে সে? একি সন্ধিক্ষণ? বয়সের হাওয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দিলো? এভাবে? মোবাইলটা হাতেই ছিল, আর মনের ভেতরের এত এত ভাবনায় ডুবে তা সে খানিক ভুলেও গিয়েছিল। চমকে উঠে রিংটোন বাজতেই। আসিফের ম্যাসেজ,
—হাই, শাকিলা, আমি আসিফ।
— তখন ফোনে কি হয়েছিল?
— না, মানে তুমি হুট করে ফোন দিলা। আমার বউ খুব খেয়াল করে। ও ছিল তো..
সহসা শাকিলা একটা বিষ্ময়কর ইমো সিলেক্ট করে পাটায়— তাই নাকি?
—হ্যাঁ, তুমি এক কাজ করো। তুমি আমাকে সবসময় এসএমএস করো, আমিই কল করব। তুমি লিখবা ‘স্যার বিল রেডি’।
—মানে কি!
— তাইলে আমার বৌ কোন সন্দেহ করবে না, আমি এসএমএস পাওয়ার পর সুযোগমতো ফোন করব।
—তো কি বিল রেডি লিখলেই বুঝে ফেলবা, আমি কথা বলতে চায়?
—হুম। তোমার নম্বরটা আমার মোবাইলে কিউবি ইন্টারনেট নামে সেভ করা আছে।
সহসা শাকিলার পুকুর যেন অবারিত হাসির দমকে ভেসে যায়। নিজেকে সে নিজেই প্রশ্ন করে, নারী না নদী?
নদী … নদী …।