আমাদের দীর্ঘস্বাসগুলো । বদরুন নাহার
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২২, ২:২৭ পূর্বাহ্ণ, | ৫১০ বার পঠিত
আমার যখন বুদ্ধি হলো তখন দেখি, আমাদের মা বিধবা! আমরা বলতে মূলত আমি, ছোটপা আর সেজপা। কিন্তু আমাদের আরও বোন ছিল। বড়পা আর মেঝপা, ভায়ের কথা পড়ে বলছি। বড়পা আর মেঝপার আমার জন্মের আগেই বিয়ে হয়ে গেলে, আমার কেমন ওদেরকে আমরা মনে হয় না। আর ভাই তো ম্যালা বড়, আলাদা উঠোন। যেন এক প্রতিবেশী। ঘর-সংসার কত কী তার! মফস্বলে আমাদের পাঠকাঠির বেড়ায় ঘেরা বাড়ি। সেমিপাকা ঘরের ভেতর থেকে বড় হতে হতে প্রথম আবিষ্কার করলাম বৃষ্টির শব্দ সব সময় একরকম হয় না। এই যদি আষাঢ়ের ইলশেগুঁড়ির একটানা চিঁচিঁ শব্দে একসময় কান ধরে আসে। আর যদি বৈশাখের হঠাৎ বৃষ্টি নামে তো বড়ো বড়ো ফোঁটা, তবলার বোল তোলার মতো একটু একটু করে বেড়ে এইটি লয় তৈরি করে। আমাদের আমগুলোকে ফাটিয়ে যে-শিলাবৃষ্টি হয়, তা তো একেবারে কাজী নজরুল। যেন সৃষ্টিসুখের উল্লাস। আমি অবশ্য জানি এইসব আমার আবিষ্কার-টাবিস্কার কিছুই না। ছোটপা ভালো বলতে পারতো। ওর মতে, আমি একটা গল্পিস। খালি গালগপ্প বানাই।
কথা একেবারে মিথ্যে নয়। ওই আমাদের সেজপা, কেমন মিস হ্যাঁর মতো! সবকিছু পরে পরে বোঝে, তাই ছোটপা দুঃখ পেয়ে আমার বদনাম করে। কারণ প্রায় রাতেই সেজপা স্বপ্ন দেখত! সকালে সেই স্বপ্নের শ্রোতা তো আমি আর ওই। ছোটপা স্বপ্ন দেখতো না। ও কেবল সেজপার স্বপ্নটাকে সাথে সাথে বিশ্লেষণ করে বলে দিত কেন এই স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু আমি, সেজপার স্বপ্নের কথা শুনতে শুনতে মনেমনে একটা স্বপ্ন বানিয়ে ফেলতাম! কেন জানি ছেলেবেলা থেকেই আমি ভাবতে পারতাম, অনেক দূর পর্যন্ত! তাই ওরা পাত্তা দিত না। পুচকি, যা নকলবাগিশ কোথাকার। সেজপা মেট্রিক দিবে, ছোটপা সবে নাইনে। কিন্তু ও বুদ্ধিতে পাকা বলে আমাকে মানতে চাইতো না। সেজপা মানত, সেজপা অবাক হয়ে বলতো, দ্যাখ, তুশিটার কত বুদ্ধি! আমাদের টরটরে বুড়িটা। ক্লাস থ্রিতে পড়লে কি কেউ বুড়ি হয়? কিন্ত সেজপার কথায় রাগতে পারতাম না। এত আদর মেখে মিষ্টি করে বুড়ি বলে ডাকতো! অথচ এখন আমার আর কথা বলতে ভালো লাগে না। কেবল একা একা ভাবি, আমাদের সেই বেড়াডাঙ্গার বাসার কথা। উঠোনের জলপাই গাছ। বোনদের সঙ্গে বেড়ে ওঠা।
হঠাৎ করেই বৃদ্ধ লোকটি বলে ওঠে, বাংলাদেশ?
আমি কোন উত্তর দেই না। যেন শুনতেই পাইনি, পাশ কেটে বেড়িয়ে যাই। তাতে লোকটার বেশি ভাবান্তর হয়না। সে লেকের পার ঘেঁষে সামনে এগিয়ে যায়, নতুন কোনো তামাটে জাতির খোঁজে। গত ছয়মাসে এই লোকটিকে না হলেও দশ থেকে পনেরো বার দেখেছি এই আমেরিকার প্রবাস জীবনে। হিলসাইডের সব প্রবাসী বাঙালিই তাঁকে চেনে। লোকটির নাম দিয়েছে বাংলাদেশ বুড়ো। কাউকে পেলেই একটাই প্রশ্ন, বাংলাদেশ? তারপরই কাঙ্খিত দেশি মানুষের বাংলা কথা শুনে শুরু হয়ে যাবে লালের মোড়ের চা দোকানের মতো আড্ডা। যেন সোজনবাদিয়ার ঘাট!
এই কর্ণেল টিলি পার্কে বয়স্ক বাঙালিদের হাঁটাচলা, বসে থাকা কিংবা বাচ্চাকে পার্কে ছেড়ে পাহারা দেওয়ার বাহানায় দেশের স্কুলের পাশে মহিলা মহফিল! গালগপ্পের একচারণ ভূমি। প্রথম প্রথম এখনটাতে আমারও ভালোলাগতো, ঘরের পাশে এমন পার্কের গাছগুলো, ছোট লেকের হাঁসগুলো, ফাঁকা বেঞ্চিতে একা বসে থাকার মায়ায় ছুটে আসতাম। আমার বেজমেন্টের আবাসের মধ্যে থেকে দমবন্ধ হয়ে এলে, আমিও ছুটে আসতাম এই পার্কে। তবে কথা বলতে নয়, আমার ওই কবরখানা থেকে মুক্ত বাতাস নিতে। ঘর থেকে তো মাত্র পঞ্চাশ কদম দূরুত্বে পার্ক। সিঙ্গেল হাউজের বেজমেন্টের সাবলেট বাসিন্দার আমি। যেন নিজেই আমার কবর খুঁড়তে চাই, তাই শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে নিউইয়ার্কের এই কবরের চলে এসেছি। তাই কেউ হাভাতের মতো বাংলাদেশ…বাংলাদেশ বলে চিহ্নিত করে, খায়েস মিটিয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলতে চাইলে, আমি সহ্য করতে পারি না। প্রায় আশির কাছাকাছি বয়সের লোকটির মুখভর্তি চাপ দাঁড়ি, স্নিগ্ধ এক উজ্জ্বল চেহারা। আমার স্মৃতিতে থাকা বাবার ছবিটির সঙ্গে খুব মিল! তবুও আমি আনমনে হবার ভাব ধরি, তার ভাঙা ইংরেজি প্রশ্নের উত্তর দিতে গদগদ হয়ে উঠি না। আমি চুপ থাকলে, সে আমাকে ঘাঁটায় না। এগিয়ে যায়। এদেশে অন্তত সবার এই পরিমিতি বোধ তৈরী হয়ে যায়। আমার বেঁটে উচ্চতা, উজ্জ্বল তামাটে গায়ের রঙ আর ছোট ববকাট চুলে অনেকের মনে একটু দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। আমি সেটাকে ভাঙাতে যাই না। কেমন মনেমনে অনবরত বাংলায় ভেবে যাই। আমার বলতে ইচ্ছে করে না। কেননা আগেই আমার বলার ইচ্ছেটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। সব ইচ্ছেটিচ্ছে মরে যাচ্ছে যেন! এই লেখা, এই আমার মতবাদটাকে আমার স্বাধীন মতামতটাকেই কেউ মেনে নিতে পারল না। কেন এমন লিখছি? আমার সব হুমকিপ্রাপ্ত দিন। আমার লেখক বন্ধুকে মেরে ফেলায় প্রতিবাদী হলে, যারা আমাকে গৃহবন্ধি করল। আমি কি কোনোদিন কারো ইচ্ছেই লিখব, লিখব না। একি আমার অভিমান? নাকি ক্ষোভ? আমার বন্ধুর অসাম্প্রদায়িক ভাষাকে নির্দ্বিধায় খুন করেছিল যারা, আমার প্রতিবাদের ভাষাকে আইনের যত ধারার খপ্পরে ফেলে বাকবন্দি করেছে যারা। তাদের প্রতি ক্ষোভ, নাকি নিজের অসহায়ত্ব? নাকি দুঃখ? বেদনা, আপোষকামী হবার অক্ষমতা। আমার প্রতিজ্ঞার স্মৃতিরা কেঁদে ফেরে নিউয়ার্কের ফুটপাতে। আমি মেট্রোরেলে চেপে চলে যাই বর্ণবাদীতায় খ্যাত, অস্তিত্বের প্রতিহিংসার পরশপাথর হারলেমে। এটা নাকি কৃষ্ণাঙ্গদের রাজধানী! আমার কি? আমি এগিয়ে যাই মাউন্ট মরিস পার্ককে পেরিয়ে ওয়ান টোয়েন্টি ফিফথ স্ট্রিট, তারও এক কোণায় গোলাপের পাপড়ির মতো হেসে থাকা অক্ষর, ডানকিন ডোনাণ্ট! আমার কর্মক্ষেত্র।
বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মী, আজ খুব সকালে গ্যাপের সাদা শার্টের ওপর চকোলেট রঙের এ্যাপ্রোন চাপিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি ডানকিন ডোনাণ্টের কাউন্টারের পেছনে, সুউচ্চ স্টিলের র্যাকের সামনে। গোল্ফস পড়া হাতে থরে থরে সাজিয়ে রাখি ডোনাণ্ট, মানকিন, হ্যাশব্রাউন, হ্যামবার্গার। বরফ কুচি দিয়ে তৈরি করি কফি লাতে, হুয়াইট চকোলেট স্মুদি কিংবা চলে যাই বাসকিন রবিন্সের ডিপ ফ্রিজের কাছে। ঘষেমেজে সাফ করি কাউন্টারে পরে থাকা আইসক্রিমের আঠালো রস। ক্যাশ কাউন্টারের ডেস্কটপে হাত রাখার অধিকার এখনও হয়নি। আমার রাইটিং কি-বোর্ডটি ফেলে এসেছি। ফাঁকে ফাঁকে মব করি কফি হাউজের মেঝে। আমার আপস কার সঙ্গে? বুঝি না কিছুই। অফটাইমে খেতে পাই ডোনান্ট কিংবা স্যান্ডউইচ। একবার একটা করকরে ভাজা আলুর তৈরী হ্যাশব্রাউন খাব বলে হাতে নিতেই, ডাইভওয়েতে সার্ফ করা সুলতানা নামের মেয়েটি দৌড়ে আসে, আপা, করেন কি? করেন কি?
আবাক চোখে চেয়ে থাকি। মেয়েটি সহানুভূতিশীল, এই শপে আছে দু’বছর ধরে। বলে, হ্যাশব্রাউন কারখানা থেকে প্রসেসড হয়ে আসে। হ্যাম-ট্যামের সঙ্গে মিশে যায়। তাই আমরা খাই না।
আমি ওর অনুভূতিতে আঘাত দিতে চাই না। হ্যাশব্রাউন রেখে একটা চিজ স্যান্ডউইচ চিবুতে থাকি। ও নিশ্চিত হয়ে সুনিপুন হাতে শুকরের লাল মাংস পুড়িয়ে হ্যামর্বাগার তৈরি করে, অপেক্ষারত কাস্টমারের জন্য। আমাদের অনুভূতিগুলো বড় অদ্ভুত, কখন যে কিসে আঘাত খায়, তা কে জানে! আমার অনুভূতিগুলো মরে যাচ্ছে। আমার কি দায়, এই সুদূর আমেরিকায় বাংলাদেশী বলে গলে পড়ার? বাংলাদেশ বুড়োর নিঃসঙ্গ সময়ে বাংলা কথায় ভরিয়ে তোলার। আমি তো বাংলাই বলতাম, লিখতাম। কিন্তু ওরা বলে আপনি কেন লিখেছেন, আমাদের গ্রামে মালোপাড়া নাই?
না, আমি কথা বলব না। খুব বুকের বাষ্প জমে ওঠে, দমবন্ধ হয়ে এলেও বুড়োকে বলব না। চাচা, ভালো আছেন? দেশ ছেড়েছেন কতদিন?
লোকটি আমাকে ঘাঁটায় না, কিন্তু মনেমনে আমি নিজেকেই ঘাঁটাতে থাকি। হাইল্যান্ডে হাঁটতে হাঁটতে, কাস্টমারের কফির ঢাকনা শক্ত করে বসিয়ে দিতে দিতে। প্রবাসজীবনে আমার ডায়াসপোরা মনকে আরও কতভাবে ঢেকে রাখা যায়। আমার বেজমেন্টের কবরে শুয়ে শুয়ে ইঁদুরের হেঁটে চলার শব্দ পাই। রক্তচোষা ছারপোকার কামড়ে ঘুমহীন রাতে আমি কেবল ভাবতেই থাকি।
আমার পথের অলিতেগলিতে ওতপেতে ছিল অজ্ঞাত ঘাতক। আমার বন্ধুর লাশ পড়ে থাকে ছাপাখানার গোড়দৌড়ে (*শব্দটি সম্ভবত দোড়গোড়ায় হবে।) । না, যারা আমাকে ভুল ভেবে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে অনর্গল, সদ্য মেক্সিকো থেকে আসা চাকুরীপ্রার্থী আপন ভেবে স্প্যানিশ ভাষায় বলে প্রয়োজনীতার কথা। তাদেরকে আমি কেবল থামিয়ে দিই। বলি, আম নট স্প্যানিশ। ডু ইউ নো ইংলিশ? আম ফ্রম বাংলাদেশ।
ওরা নিশ্চিত এবং হতাশ হয়ে ফিরে যায়। আমি কেবল নিশ্চিত করি না বাংলাদেশ বুড়োকে। আমি কেবল নিশ্চিত করি না জ্যাকসন হাইটের বাংলা হোটেলের লোকদেরকে। আমি নিজেই তো আজ নিশ্চিত নই! মাসখানিক গৃহবন্দি থেকে কর্তৃপক্ষ যখন আমার হাতে এই আমেরিকার ভিসা তুলে দিলো, গাড়িতে করে প্লেনে তুলে দিলো। বলল, আপনার সুরক্ষার জন্যই আপনাকে দেশের বাইরে পাঠাচ্ছি।
আজ আর আমার কি দায়, বাঙালি বলে মমতায় জড়িয়ে ধরার! অথচ মাঝেমাঝে আমার বড্ডো বিচ্ছিরি মনে হয় ওদের সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব। হারলেমের পালাবদল, ওইখানেই জব কিছু খালি থাকে। খারাপ লাগে ওদের পার্কে ধেড়ে ধূসর কাঠবিড়ালি দেখতে। আমাদের বেড়াডাঙ্গার বাড়িতে একটা নারকেল গাছের ফোঁকলে থাকতো ছোট্ট, হলুদ ডোরাকাটা খয়েরি কাঠবেড়ালি। দেখলেই আদোর করে কোলে তুলে নিতে চাইতাম। আহা, আমার সোনালী চড়ু–ই। ছোটআপার জ্ঞান যতই থাকুক, সুন্দর করে, সাহিত্য করে, চিঠি লিখতে পারতো না। এ প্লাস বি হোলস্কয়ার…, ভালো বুঝতো। সেজপা ছিল ঘুমকাতুরে। বড়পাকে লেখা চিঠিটা অঙ্ক খাতার মধ্যে রেখেই ঘুমিয়ে যেত। মাঝরাতে সেই চিঠি চুরি করে টুকলি করতো ছোটপা। আমি দেখে ফেলেছি। বলে দিতেই, কানমলা খেতাম। ছোটপা এখন ডাক্তারি করছে। আর সেজপা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বাংলা শিখেয়েই যাচ্ছে। ছোটপার এখনও আমার উপর রাগ, কাম্পিউটার সায়ন্সে পড়ে কি দরকার অত গল্প লেখার। তোকে কে বলেছে বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতিবাদ করতে। আমি দেশ ছাড়তে চাইনি। সত্যি করে বলছি। বাসার ভেতরের বোনেরা ঝগড়ার তোড়ে ইংরেজি গালিতে মেতে উঠলে, আমার বৃদ্ধ মা ছড়া কটতেন, আমার পেটে হয়ে রে বাছা। কোথায় শিখলে পার্সি ভাষা। মা নেই কিন্তু তাঁর ছড়াগুলোতো আছে, আমার কানের কাছে মা যেন মাঝে মাঝেই ফিসফিস করে বলে, নিজের টাকা হবে বলে পরকে যে দ্যাও ফাঁকি। পশুর সমান আত্মা তাহার, মানুষ বলে নাকি? আমি মানুষ হতে চেয়েছিলাম। পশুর মতো মারতে বা মারতে চাইনি। অথচ একে কি বলে বেঁচে থাকা! সারাদিন খালি কফির কাপপূর্ণ করে অন্যের তৃষ্ণা মেটানো। বড়ো ক্লান্ত আমি। নিউয়ার্কের ঝকঝকে পরিস্কার আকাশ দেখে চোখ পোড়ে, আমার তুলট মেঘ, আমার ধুলট মেঘের আশায়।
ফিফথ স্ট্রিট এন ট্রেন ছেড়ে উঠে পড়ি এফ ট্রেনে সুরঙ্গের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যায় গন্তব্যে। মেট্রো থেকে নেমে গোথিক ড্রাইভ হয়ে হাইল্যাণ্ডে হাঁটতে হাঁটতে হিলসাইডে যাই, ঘরে ফেরার টানে। সারাদিনের ধকল, উঁচু-নিচু পথ বেয়ে নেমে যেতে যেতে আমি পার্কের মুখে চলে আসি। থিক হয়ে আসা লেকের পানি ছেড়ে, কাঠের গুড়িতে ঝিম ধরে বসে থাকা রাজহাঁস জোড়া, মানুষে ভয় নেই তাদের! ঠায় বসে থাকে। এখন আর আমার বলার বা লিখার কিছু নেই। এই দেশে সাদা-কালোর দন্দ্ব, তাতে আমার কি? আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমার তো আর তেমন করে মতপ্রকাশই ঘটবে না। ইংরেজিটা আমার অতটা দখলেই নেই যে অনুভূতি-টনুভূতি জানিয়ে ট্রাম্পের রোষানলে পড়ব। ইংরেজিটা আমার মায়ের শেখানো বুলিই নয়, এর ভেতরের স্বাদগন্ধ আমি বুঝি না।
হঠাৎ দেখি দু’জন বাঙ্গালী নারী আমাকে ফিরে ফিরে দেখছে। আমি বরাবরের মতো দেখতে চাই না। তাদের চাহনিতে ছিল চেনা চেনা ভঙ্গি, কোন বাঙালি ভেবেই। কিন্তু যেন নিশ্চিত নয়, আমার ভাষা বাংলা! আমি দ্রুত পেরিয়ে যেতে চাই, কিন্তু ক্লান্তি আর হাইল্যান্ডে পথচলার শ্রান্তিতে মুখ ফসকে বেড়িয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। ও…হ্, স্পষ্ট কোনো শব্দ নয়। কেবল একটা ধ্বনি মাত্র। তবুও কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়েও থেমে গেল একজন মাঝ বয়সী নারী, দুই হাত তার হুইলচেয়ারের পেছনে। চেয়ারে বসা বৃদ্ধ মা। নারীটি চকিতে ডেকে বসে—আপনি বাঙালি?
আমার দমবন্ধ করা নীরবতা, একটা দীর্ঘশ্বাস! তাতে কি বোঝা যায় এই শ্বাসে জমে ছিল পদ্মা-মেঘনা-যমুনার হু হু করা বাতাস। মানুষ কেন এমন করে গন্ধ খুঁজে ফেরে। একটা দীর্ঘশ্বাসও কি বোঝে এখন তা বাংলার বাতাস সমেত ধ্বনি! আমার কতদিনের নীরবতা ভেঙে পড়ে, বেরিয়ে আসে, হ্যাঁ।
হুইল চেয়ারে বসা নারীটির বয়স ৮২ হবে। দাঁতহীন মুখের চোয়াল বাতাসে বারি খায়। বলে, থাকো কই?
—ওই চ্যাপিং কোর্ড।
—আপনি?
—হাওয়াপাড়া।
—হাওয়াপাড়া?
এবার মাঝবয়সি নারীটি বলেন, সিলেটের হাওয়াপাড়ায় আমাদের বাড়ি আছে। মা ভাবেন সেখানেই থাকে।
—বৃদ্ধ মা আবার বলে, হাওয়াপাড়া, চিনো না?
—হুম চিনি। সে তো বহুদূর!
আমাদের চোখ ঝাপসা করে গুঁড়োগুঁড়ো তুষারপাত হতে থাকে। বহু আগেই জেনেছিলাম, তুষারপাতে বৃষ্টির মতো কোনো শব্দ থাকে না। কেবল নীরবে ঝড়ে পড়ে। আর ক্রমশ আমাদের র্দীঘশ্বাসগুলোকে ঢেকে দিয়ে যায়। ক্রমশ নীরবতা ঢেকে দিয়ে যায় সফেদ বরফ।