কামিল নরভিদের কবিতা । ভাষান্তর : অনন্ত উজ্জ্বল
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০১৭, ৯:৪৭ পূর্বাহ্ণ, | ১৮৫২ বার পঠিত
পোল্যান্ডের কবি কামিল নরভিদের কবিতা
ভূমিকা : আঠারো শতকের শেষদিকে ইউরোপে দেখা দেয়া সংবেদনশীলতা আর সেই থেকে ‘মানুষের সভ্যতা’র রোমান্টিক হয়ে ওঠা। যাকে বিশ শতকের শিল্পকলা এড়িয়ে যেতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। রোমান্টিসিজমকে ইউরোপীয় চৈতন্যের সংকট বলা হলেও এর অভিনবত্ব একবাক্যে মেনে নেয়া যায়। মানবচেতনায় এর প্রভাব— বিস্তারের নিরিখে ভাঙন ধরিয়ে দেয় পৃথিবীর প্রচলিত মেরুদণ্ডে, চিন্তাধারায়। যা ছিলো যুক্তি, যা ছিলো বিশ্বাস, ছিলো সে যুক্তির সাহায্যেই বোঝা মহাজগৎ; আর রোমান্টিকেরা এই বিশ্বাসেই ফাটল ধরিয়ে দেন।
কামিল নরভিদ তার কবিতালোকে এই ধারাতেই সৃষ্টি করেন অভিনব কবিতা। বলা হয় যে, প্রকৃত পোলিশ কবিতার সূচনাই তার হাতে। আগে আর সবখানের মতো পোলিশ কবিতাও ছিলো সাধারণত ছন্দবদ্ধ গদ্যে, যা রচিত হতো প্রথাগত যুক্তি, নিয়মকানুন, সুষমা মেনে; তিনি এসব বাদ দেন, সৃষ্টি করেন নতুন আদর্শ, জোর দেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, কল্পনাপ্রতিভা, স্বতঃস্ফূর্ততা ও আবেগের ওপর। কবিতা লেখার বিধিবদ্ধ নিয়মগুলো ভেঙে ফেলেন।
নরভিদের কবিতায় আরিস্ততলীয় অনুকরণবাদ নেই; তার কবিতা অভিজ্ঞতার আয়না নয়, বরং অভিজ্ঞতার উপর ফেলা প্রদীপের আলো।
পূর্বের প্রথা মেনে সুরুচিকর সুশৃঙ্খল পদ্য বানানো ছেড়ে তিনি তার কবিতায় ছড়িয়ে দেন মৌলিক প্রতিভার অবারিত সৃষ্টিশীলতা; আগের পরিশীলিত সৌন্দর্যকে লণ্ডভণ্ড করে ঘটান আবেগের তীব্র গতিশীল উৎসারণ। এর ফলে পোলিশ সাহিত্য-ইতিহাসে জন্ম ঘটে ‘নব্যপোল্যান্ড’ বিপ্লব। মৌলিকত্ব তার কাছে ছিল উদ্ভিদ-স্বভাবের মতো, যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্ম নেয় প্রতিভার মূলে। এটা জন্মে, তৈরি হয় না। তাই তিনি জোর দেন মৌলিকত্ব আর প্রতিভার ওপর। নরভিদ বিশ্বাস করতেন, প্রতিভা জাদুকর, স্থপতি নয়; স্থপতির মতো সে নানা কৌশলে কাঠামো নির্মাণ করে না, সে সৃষ্টি করে জাদুকরের মতো অদৃশ্য উপায়ে। কবিতার পুরোনো আদর্শগুলো ছেড়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, কল্পনাপ্রতিভা, মৌলিকত্ব, আবেগ-অনুভূতি, অনুপ্রেরণার ওপর জোর দিয়ে সূচনা করেন কবিতার নতুন সময়; সৃষ্টি করেন এমন সব কবিতা, যা আগে পোল্যান্ডে কখনো ছিলো না এবং যার প্লাবনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পোলিশ সাহিত্য।
নরভিদের কবিতায় অষ্টাদশ শতকের রোমান্টিকতার প্রভাব অবশ্যই আছে, কিন্তু তিনি সেখানেই তার যাত্রাকে থামিয়ে দেননি। এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন কবি হিসেবে তিনি সময়কে যেমন রোমান্টিকতার ছোঁয়ায় এঁকেছেন, তেমনি তিনি একই সঙ্গে তার ভেতরের অনুভূতিকে স্বকীয় উপায়ে বিনির্মাণ দেখিয়েছেন। তার মতে, শুধু ক্লাসিসিজম বা নব্য-ক্লাসিসিজমের বিরোধিতাই রোমান্টিকতা নয়, এর থেকে আরও জরুরি অনুষঙ্গ হলো মূলত ব্যক্তিক অনুভব। তার কবিতায় দুর্বোধ্যতা ও অবচেতনা দুটি প্রধান প্রবণতা। তাই তার রোমান্টিকতার সাথে প্রচলিত রোমান্টিকতার একটা ব্যবধান থেকেই গেছে। অথচ এই রোমান্টিকতাকে সমসাময়িক কবিরা যেমন বোঝেননি, তেমনি বোঝেননি তার পরবর্তী আধুনিককালের পোলিশ কবিরাও, কামিল নরভিদের কবিতা অনাদৃত থেকে গেছে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, মৌলিকত্ব, কল্পনাপ্রতিভা, স্বতঃস্ফূর্ততা, আবেগানুভূতি ও আরও অজস্র ব্যাপার যেমন ব্যাপক, গভীর, তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতায়, এর আগে তা আর কোনো পোলিশ কবির কবিতায় আমরা পাই না। তীব্রতায় তিনি অদ্বিতীয়, শেলির থেকেও অনেক বেশি তীব্র। বিলেতের পাঁচ রোমান্টিক ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, শেলি, কিটস ও বায়রন মিলে যা করে গেছেন, পোলিশ সাহিত্যে কামিল নরভিদ একলা করেছেন তার চেয়ে বেশি।
ভূমিকা – তানভীর রাতুল – সম্পাদক, লাস্ট বেঞ্চ।
শুঁয়োপোকা
লন্ডনের পিচ্ছিল ফুটপাত যেন সাদা কুয়াশায় ভরা
চাঁদের কক্ষপথ
তোমার পাশ দিয়ে অনেকেই যাচ্ছে,
কিন্তু, বাস্তবে তোমার বিষণ্নতাকে সহজেই আলাদা করা যায়।
২
তার কপাল কি কণ্টকাকীর্ণ নাকি ধুলোময়?
সে কথা বুঝতে ব্যর্থ বোধের সীমানা;
স্বর্গের বিস্ময় কি মৃদুভাবে কিছু বলে
তার ঠোঁটের ওপর …? নাকি সে এক দূরাচারী ফেনা …!
৩
তুমি হয়তো বলবে সে কাদার মধ্যে পড়ে থাকা ধর্মগ্রন্থ
অথবা নৃত্যরত পবিত্র মূর্তি,
কেউ কি হাত বাড়ায় তার দিকে, সেই দিনগুলোর দিকে
এখন তার মূল্য নিয়ে ভাববার কোনো সময় নেই! …
৪
নৈরাশ্য এবং অর্থ — এই দুটো শব্দ—
তার চোখের ওপর ঝলকে যায়।
নিরাশা কোথা থেকে আসে? … তাকে গোপনে আঁকড়ে ধরে;
সে কোথায় চলে যায়? … নিঃসন্দেহে তার গন্তব্য শূন্যতায়।
৫
মানবতা সে তো মুখরা রমণীর মতো
আজকের জন্য সে কাঁদে আর উপহাসে উড়িয়ে দেয়;
—ইতিহাস কী? … সে শুধু: “রক্ত চেনে! …”
সমাজ কী? … সে শুধু: “অর্থ চেনে! …”
আমার গান [২]
এই পৃথিবী— যেখান থেকে সামান্য জীবিকা সংগ্রহ হয়
তার গভীর থেকে উঠে আসে বিস্ময়ভরা অনুভূতি
স্বর্গের উপহারের জন্য …
আমি স্মৃতিকাতর, প্রভু! …
এই পৃথিবী— যেখানে হয় অসাধারণ ভাওতাবাজি
ইচ্ছে করে নাশপাতি গাছে বকের বাসা নষ্ট করা,
যদিও সে আমাদের অনেক উপকারে আসে …
আমি স্মৃতিকাতর, প্রভু! …
এই পৃথিবী— যেখানে আমরা একে অপরে মহৎ
প্রাচীন খ্রিস্ট-প্রথার মতো:
“খ্রিস্টের মহিমা কীর্তন করা হোক!”
আমি গৃহকাতর, প্রভু! …
আমি এখনো অপেক্ষায় আছি অন্য কিছুর, নিষ্পাপ কিছুর,
আমি দীর্ঘদিনের জন্য নয়, তবু আমি জানি কোথায় খুঁজবো
আমার গৃহ …
আমি গৃহকাতর, প্রভু! …
কষ্টের জন্য না এবং চিন্তার জন্য না
তার সব কিছুর জন্য হ্যাঁ মানে হ্যাঁ— আর না মানে না
তার ধূসর ছায়া ছাড়া…
আমি গৃহকাতর, প্রভু!…
আমি অপেক্ষায় আছি বহু দূরের; সেই স্থানের
যেখানে কেউ না কেউ আমাকে ভালোবাসে!
এটা এমনই, যদিও আমার বন্ধুত্ব
কখনোই এসে চলে যাবে না! …
আমি স্মৃতিকাতর, প্রভু! …