ভীমপলশ্রী । তমাল রায়
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০১৭, ২:২৭ পূর্বাহ্ণ, | ২০৫৫ বার পঠিত
প্রিয় রাই, যেভাবে সকাল আসে,বুনো হাঁসের ডানায়,আর ধীরে ধীরে জেগে উঠছে আর একটা দিন,সেভাবেই…আমিও। চাইলেই কি আর হয়ে ওঠা যায়?.বুড়ো শিউলি গাছটা যেদিন কাটতে এলো রশিদ চাচা। আমি অনেক বার বাঁধা দিতে চেয়েছিলাম। মা’তো ওই গাছটাকে অবলম্বন করেই কতগুলো দিন…তখনও শীত আসতো শহরে,পরিযায়ী পাখিদল এসে বসত সাঁতরাগাছির ঝিলে,গরমে আমপোড়া সরবৎ কি করে যেন প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে.. বর্তমানের ধারাপাতে এগুলো নিছকই বাতিল শব্দ। যেমন অপেক্ষা। অপেক্ষার রঙে টুপ টুপ দেয় ডুব,ডুব যে দেয়নি,সে জানলোই না প্রিয় রাই,যেভাবে সকাল আসে,বুনো হাঁসের ডানায়,আর ধীরে ধীরে জেগে উঠছে আর একটা দিন,সেভাবেই…আমিও। চাইলেই কি আর হয়ে ওঠা যায়?. বছর অপেক্ষা করেছিলেন পাক্কা। ছোট পিসির গায়ের রঙ ছিলো পাকা আমের মত,গরমের তাত লাগলে পুরো গোলাপখাস। তো আমাদের তেমন কিছুই ছিল না। যেমন থাকেনা মেনি বেড়ালের,সকালের চড়ুইটার,অথবা কুমুদ মাসিরও।
মেনি বেড়াল
সেই যেবার খুব বৃষ্টি হল,নদীর জল উঠোন ডিঙিয়ে চৌকাঠ পেরিয়ে উঠোন ভাসালো-আমরা ঘর থেকেই কাগজের নৌকো ভাসাই জমা জলে,সেবারেই শিউলি গাছের বেদীটার ওপরেই ভিজে সপসপে মেনিকে খুঁজে পায় কুমুদ মাসী। কুমুদ কোনো কাজের মাসীর নাম হয়না কখনোই। তবু কাজই করতেন তিনি আমাদের বাড়িতে। কাজ মানে প্রায় সবই। ঘর মোছা বাসন ধোয়া কাপড় কাচা মায় রান্নাও। মা যে থেকে থেকেই অসুস্থ। কুমুদ মাসী বৃষ্টি মাথায় করে আসতে গিয়ে খুঁজে পায় মেনিকে। মেনিও আমাদের একজন হয়ে যায়,অল্প কদিনেই। যাদের কিছু নেই,এভাবেই তাদের সাথে জুড়ে যায় অনুষঙ্গরা। ও বুঝে ফেলে এটা মাতৃমুখী সংসার। তাই মার পায়ে পায়ে ঘুরলেই ও পেয়ে যাবে সব। কুমুদ মাসী কপট রাগ দেখিয়ে বলেছিল,মানুষ এমন জানতান দিদি,এতো দেখি কুকুর নেমক হারাম হয়ে গেছে। সমাজটার আর কিছু রইল নে’কো।
সকালের চড়ুইটা
ভীমপলশ্রী কি আমি জানতাম না। সকাল তেমন সকল হয়ে ওঠার আগেই কে যেন গান ধরতো,একতলা বাড়িটার পেছনের ঘর থেকে। মা বলেছিল এটা ভীমপলশ্রী। আমি রাগ চিনিনা। মাকে চিনি। মা বললে পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে। তো যেভাবে সকাল আসে,মৃদু আলো যেভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে…তখনই চড়ুইটা এসে হাজির হত মাথার কাছে,সে কি বলতে চাইতো? জানিনা। কেবল জানি,বাবা বলতো চড়ুই জীবন,আলো আর আঁধার চিনতেই চিনতেই হুস করে,মিলিয়ে যাওয়া। বাবা সেভাবেই মিলিয়ে গেছিলেন এক সকালে। বাসন কোসন তোরঙ্গ আলমারি সব পড়ে রইল,বাবা হাঁটা দিলো কোন অনির্দিষ্টের দিকে। আমরা তখন ভীমপলশ্রী আর চড়ুই এর মধ্যে একটু সকাল খুঁজছি হাতড়ে হাতড়ে। পাইনা কিছুতেই। ভীমপলশ্রী একটা রাগ। চড়ুই একটা পাখি। চড়ুই রাগ সম্বল করে বাবা চলে গেল। যাবার আগেরদিন মার সাথে কি জানি কারণে,বাবার কথা কাটাকাটি,রাগ চড়ুই।
কুমুদ মাসী
কুমুদ মাসী আমাদের কেউ ছিল না। আমরাও তার। জানলা দিয়ে কালবোশেখি ঢুকে পড়লে,সে কেবল দৌড়ে জানলা দিতে যেত। ঝড়ে তার প্রবল ভয়। থাকত দক্ষিণের সুন্দরবনের কোথায় যেন দেশের বাড়ি ছিল তার। আর এক সাইক্লোন কেড়ে নিয়েছিল তার সব। সাইক্লোন কি’না,জানিনা। ঝড় তো কম বয়েনি আমাদের ওপর,বাবা গেল,মার খুব অসুখ। কুমুদমাসীই সব করে। কেন যে করে জানিনাও। মা তাকে আর দুচোক্ষে সহ্য করতে পারেনা। মার ধারণা,কুমুদের জন্যই বাবা চলে গেল। তেমন কিছুই হয়নি। বাবার পা টিপছিলো বসে কুমুদ মাসী। বাবার হাত না’কি তখন এলানো আর সে এলানো হাত তখন না”কি ছুঁয়েছে কি করে কুমুদের আঁচল। তেমন মেয়েছেলের আঁচল ছুঁলে না’কি খুব অমঙ্গল। কুমুদকে মা খুব বকেছিল। বাবার তাতে মুখ ভার। পরে অনিবার্য কথা কাটাকাটি। বাবা চলে গেল। যেমন যায় ভালো মানুষরা। কুমুদ কিন্তু রয়ে গেল,যেভাবে এসব পুরনো বাড়িতে থাকে কিছু অবেলার অন্ধকার। মুখ তোলো হাঁড়ি। মা সারাক্ষণ বলছে কি’রে তুই যাসনা কেন পোড়ামুখি,যা। কুমুদ ও গেল। তবে মাকে পুড়িয়ে আসার পর।
আগুনের সর্বনাম
আমি ইস্কুল গেলে বাড়িটা না’কি গোমড়া মুখেই বসে থাকত। মা তেমন বলতেন।মা চলে গেলে বাড়িটাই রইল। প্রাণ টান নেই। মেনী নেই। চড়ুই নেই। কুমুদ মাসী নেই। আমি আছি। আমার খুব ইচ্ছে ছিল যোদ্ধা হবার। পরাক্রমশালী হয়ে ওঠার। এই যে বাবার এত কষ্ট ছিল,সারা দিনের শেষে ফিরলে সারা মুখে এত ঘাম,মোছাতে চেয়েছি পারিনি। মার এত ব্যথা সারা শরীর জুড়ে,রাখতে পারিনি হাত ব্যথায়। বলতে পারিনি- মা,এই তো আমি। মুখ তোলো,হাসো। শুনেছিলাম আমাদের না’কি পুব বাংলায় অনেক জমি জিরেত,পুকুর মাছ,বাগান… শূন্য ঘরে বসে শ্যাডো প্র্যাকটিস করি। খেলা ঘরের হাতি ছুঁড়ে ভাঙি। বাঘ সিংহর লেজ ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলি দূরে। লোকে পাগল ভাবে। সে ভাবুক। কে না পাগল। আর আগুন জ্বেলে নিজেকে সেঁকি। ওই যে কুমুদ মাসী বলত,দিদি তোমার ছেলে না’কি মেয়ে,আগুনে এত ভয়? হাত টাত পোড়াই। হাতের লোম,চোখের পাতা। কই ভয় লাগছে না’তো আর। মাথাটা কেবল ফাঁকা। তাতে মেরি গো রাউন্ড। সে নাগর দোলায় বাবা,মা,মেনী,চড়ুই,কুমুদ মাসী। আমি হাততালি দিই। ধুনি জেলে বসি,সামনে বাবা,মার ছবি। কোথাও তো পৌঁছয় মানুষ। কোথায়?
প্রিয় রাই, যেভাবে সকাল আসে,
প্রিয় রাই,যেভাবে সকাল আসে,বুনো হাঁসের ডানায়,আর ধীরে ধীরে জেগে উঠছে আর একটা দিন,সেভাবেই…আমিও। চাইলেই কি আর হয়ে ওঠা যায়? এই রিহ্যাব সেন্টারের প্রতিটা গাছের বাকলে লিখে রেখেছি তোমার নাম। তাকাও দেখ ওই দূরের গাছের গুঁড়িতে নির্জনে ডেকে চলেছে মেনী। কাছে যেই গেছি কি জল আর জল! রাই তুমি হাত ধরবে? কাগজের নৌকোগুলোও যে কোথায় গেল,অবশ্য কাগজের নৌকোয় বুঝি এত বড় ধেড়ে ছেলে ওঠে,মেনীটা ভিজেই চলেছে এক নাগাড়ে…কুমুদ মাসীটাই যে কোথায় গেল,কে জানে,এতক্ষণ ধরে পেছনের গাছটার তলায় ঠায় বাসন কোসনের শব্দ শুনছিলাম। কুমুদ মাসী মার সাথে গল্প করতে করতে বাসন মাজছে। এই বাবা ঢুকছে ঘামতে ঘামতে,এবার চেয়ারে বসবে। আর তখনই মা পাট ভাঙা শাড়ি পড়ে সন্ধ্যে দিতে আসবে। মা,বাবা,কুমুদ মাসীদের আর দেখতে পাচ্ছিনা। কোথায় যে গেল! সন্ধ্যে না সকাল তাও ঠিক ঠাহর করতে পারিনা। রাই,তুমি তো আছ,এটা কি সকাল? এবার চড়ুই আসবে? মুখ তুলে জিজ্ঞেস করবে,কেমন আছ? কিন্তু আমি কেমন আছি তো জানিনা,তুমি জানো রাই? আমার সকাল থেকে রাত,রাত থেকে সকাল কেবল একটা তুমি বিছিয়ে আছো,বাকি সব ধোঁয়াশা রাই। হয়ত তুমি আছো বলেই গাছ থেকে গাছের দূরত্ব। সকাল এখানে তেমন কিছুই নয়,স্রেফ একটা সময়। রাতও তাই। আর আমি প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছি গাছ গুলোকে উলটে দিতে। মানে ঝাঁকড়া পাতাওলা মাথাগুলো নীচে,আর গুঁড়ি ঊর্দ্ধমুখী।
বাতাস নেই যে। বড় শ্বাসকষ্ট ওদেরও। প্রিয় রাই ওই দেখ সবাই কেমন হাসছে আমায় দেখে। ‘স্মাইলস টু গো বিফোর আই স্কিপ’ প্রিয় রাই সর্বনামগুলো বড় হবার সাথে সাথেই কি করে যেন হারিয়ে যায়। তুই থেকে তুমির দূরত্বে রাই,ভীমপলশ্রী গাও একবার। আমি অপেক্ষা করে আছি,চেয়ে দ্যাখো এ আমি আজও সারা শরীরে আগুন নিয়ে তোমার অপেক্ষায় আজও। যদি একটু বৃষ্টি,অথবা সেই শিউলি গাছটা ফিরে আসে,অথবা তুমি। ভোরের আনাচে কানাচে ফুল কুড়াতে গিয়ে মাথা ঠুকে গেলে,তুমি বলেছিলে,আরও দুবার। আমি রাই রাই রাই— বলছি। একটা কি সুর তৈরি হল? রাগ? রাগ ভীমপলশ্রী,যাকে সকালের সর্বনামে আমি অপেক্ষা বলেই চিনেছিলাম!