পাণ্ডুলিপি থেকে । তমাল রায়
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ৯:৩৪ পূর্বাহ্ণ, | ১৬৭৩ বার পঠিত
সিনেমা সিনেমা
আলো জ্বলেছিল, অথবা জ্বলেইনি। কখনো এমন হয়। সন্ধ্যে নামছে ইত্যঅবসরে। আকাশে একটা একটা করে জ্বলে উঠছে অপ্রয়োজনীয় তারা। পাখিদের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে কী যেন বলছিল মাধবী। সেই ১৯৬৮ তে সে ছিল কুড়ি। সে বছরই রিলিজ করল চারুলতা। শ্যাম মন্ডলের রাসমঞ্চে এলেন তিনি। ঘটি হাতা ব্লাউজ, চোখে ইয়া বড় রোদ চশমা, মুখে হাসি। খুব নামডাক তখন তার। পুঁটিরাণী দেখেছিল আগুন, বৃষ্টি অথবা অন্য কিছু… পুঁটিরাণী নাম বদলে হলো মাধবী। সাজুগুজু, পমেটম, কাজল, রোদচশমা। সে তো ভরা বর্ষার সময়! নদী ফুঁসছে, প্লাবন। আর যা হয়! এক ঢ্যাঙাকে দেখে তারও ভালো লাগল, ঢ্যাঙারও। মাধবী নামের সাথে ঢ্যাঙাদের এক অদ্ভুত যোগ। তিনকুলে তেমন কেউ ছিল না, এক দূর সম্পর্কের পিসি ছাড়া। তিনিই চার হাত এক করে দিলেন। ঢ্যাঙার সিনেমা ভালো লাগত, সিনেমার নায়ক, নায়িকা, মদ খাওয়া, মাতলামি সব। কিন্তু মাধবীর তা ভালো নাও লাগতে পারে! ক’দিনের মধ্যেই চড়াই কাকের বসা বন্ধ হলো টালির ঘরের ছাদে।
ততদিনে মাধবী নির্মাণ করেছে— ‘যে ভালোবাসে, ব্যথা বোঝে’, কুরুশ দিয়ে বুনেছে, কাপড়ে, সেও তো নির্মাণই! বাঁধিয়ে আনলো ঢ্যাঙা। ফোটোফ্রেম জড়িয়ে খুব কাঁদল, হ্যাঁ পেটে টনিক ছিল ভরপুর, সকাল গেল সন্ধে তখন হব। উঠে মাল ভ্যানিস।
ঘরফেরতা পাখিদের কিচিরমিচির শুনলে খুব রাগ হয় হয়তো তার। ‘ঘরে ফেরা’ শুনলে খুব হাসি পায়। ‘ঘর’ শুনলেও! হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে, চোখ যায় মাটিতে শুয়ে তারাদের দিকে, আরো দু’চারটে অপ্রয়োজনীয় ফুটে উঠছে একে একে। চোখ লাল হয়। গলার সুর ফুলে ওঠে। ‘তারা’ বলে আবার খিলখিলায়। আসলে ফোকলা দাঁতের হাসিটা দেখা যায়, শব্দ কি কানে আসে?
ঢ্যাঙা চলে গেলে উদয় হলো এক বেঁটের। এ না’কি দূর সম্পর্কের মামাশ্বশুর! রসিক মানুষ। কলাটা মূলোটা রেশমি চুড়ি, সিল্কি শাড়ি, পেটিকোট সব আনে। সেও তো মানুষ। লোভ হয়। খুব লোভ। সে সময় চারুলতা রিলিজ করেছে। ভূপতির অনুপস্থিতি ও অমলের উপস্থিতি, দুটিই প্রাসঙ্গিক খুব। চোখ ছোট করে সে ফেরিওয়ালাদের দেখে। লোভ বিক্রি করছে। পেছন থেকে অমল ঠেলে, আর তার পৃথিবী দুলে ওঠে। অমল মানে ইয়ে ওই… দুধ ফুসলোয়, মামাশ্বশুরও। চারুদের বেরোনো হয় না। হঠাৎ কী যেন হয়! হাইফেন বড়, ফুঁপিয়ে কান্না। আর ভূপতি, সরি ঢ্যাঙার জন্য মন কেমন। চেষ্টা তো কম করেনি! একে বলা, তাকে বলা, শেষে ‘বাবা তারকনাথ’ সাতের দশকের শেষে, নিউতরুণ সিনেমা হলে। —তুমি কি পাথর না’কি প্রাণ দাও প্রমাণ, আজ তোমার পরীক্ষা, ভগবান…
১৩ বছর পর ও গেছিল তারকেশ্বর, হেঁটেই। পা ফেটে রক্ত পড়েছে অনেক। শিবের মাথায় জল ঢেলেছে। আসেনি, আসে না যে…
সন্ধ্যের এ অশান্ত অবসরে সে এসেছিল সন্ধে দিতে, প্রদীপ জ্বালতে। এ সময়েই তো… আলো জ্বেলে অপেক্ষা, ঠিক ৫১ বছর… কানে শোনে না, মুখ দিয়ে কথাও নেই। ফোকলা দাঁত দিয়ে থুতু বেরিয়ে আসে। আজ একটু বেশিই অস্থির। পাখিদের দুষেছে, তারাদেরও। বুকের কাছে এক হাতে জড়িয়ে রেখেছে — ‘যে ভালোবাসে, ব্যথা বোঝে’। চোখেরও তো বয়স হলো অনেক। আকাশটা কেমন সিনেমার পর্দার মতো। আরও এক অপ্রয়োজনীয় তারা ফুটলো সিনেমার পর্দায়। বুকে ব্যথা, তাই মাটিতে শুয়েই এখন সে হাসছে। চিনতে পেরেছে ঠিক। এ নিশ্চিত ঢ্যাঙাটা। বিড়বিড় করে কী বলছে।
এ বড় সুখের রাত। এখানে রাতই সব, আলো না নিভলে আবার সিনেমা হয় না’কি! এতবড় আকাশটা জুড়ে যেন শুটিং চলছে ধুম ধাড়াক্কা। ঢ্যাঙাটা ক্যামেরায় এক চোখ রেখে, দেখে নিচ্ছে সব, এবার— এ-ক-শ-ন-ন-ন…
পুঁটিরাণী চোখে বড় রোদচশমা, ঘটিহাতা ব্লাউজ পড়ে এগোলো শট দিতে…
অপেক্ষা শেষ। আকাশে অপ্রয়োজনীয় আর একটি তারা ফুটছে। সিনেমায় যেমন হয় আর কী! ক্যামেরা এখন ফ্রেম করছে ওই কুরুশনির্মাণ— ‘যে ভালোবাসে, ব্যথা বোঝে’… জুমিং… ফ্রেম আউট আপাতত।
কাল সকালে একাধিক ক্যামেরা ফ্রেম করবে এই দৃশ্য। ৫৩ বছর… কী টানটান স্টোরিলাইন হবে!
.
অভিষেক
তারপর তিনি বললেন ঐ উজ্জ্বল অথচ অনাড়ম্বর প্রস্তরখন্ডে গব্য ঘৃত মাখাতে। কল্যাণীর চক্ষু মুদ্রিত।সে তার সমস্ত ভক্তি উজাড় করে ঘৃত মাখাতে শুরু করল দক্ষিণ হস্ত দিয়ে। তার বন্ধ চোখের ওপারে তখন সবুজ বনানী, কল্যাণী দৌড়চ্ছে ক্ষিপ্র হরিণীর ন্যায়। হৃৎকম্প দ্রুত। দূরে কোথাও একটা ডোডো পাখি ডাকছে। পাখিটাকে খুঁজে বার করতেই হবে। দৌড় আর দৌড়, কার যেন হাত ধরেছিল সে, সে কোথায় এখন?
তিনি বললেন আলোক বিচ্ছুরিত ঐ প্রস্তরখণ্ড কে মধু সহযোগে আবৃত করতে। বাম হস্ত দ্বারা দক্ষিণ হস্তকে স্পর্শ করে নিষ্ঠাভরে মধু দ্বারা মার্জনা করতে লাগলো। তার মুদ্রিত চক্ষু বেয়ে নেমে আসছে অশ্রু। বন্ধ চোখের ওপারে তখন বৃষ্টি পড়ছে অঝোর। জলে জল মিশলে কখনো অগ্নুৎপাত হয়! সে জলজ জীবনে বড় আবিল আর্দ্রতা। আর আগুন একই সাথে। জল বাড়ছিল। বাড়তে বাড়তে গলা অবধি। সে জলে নৌকো ভাসলো। তর তর করে বয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ প্রবল তুফান। পাল ছিঁড়লো,কান্ডারি কই? পালিয়েছে? তবু যাত্রা। হোক এলোমেলো, তবু সে উদভ্রান্ত যাপনের বর্ণ ছিল গাঢ় লাল।
তিনি বললেন এবার পুস্প দ্বারা আবৃত কর। কল্যাণী সহস্র বর্ণময় পুস্পে আবৃত করলো প্রস্তর খন্ড।মুদ্রিত চক্ষুর ওপারে তখন কত ফুলেল প্রান্তর। মালিকা গাঁথার বিষয়ে কল্যাণীর ছিল প্রভূত আগ্রহ। তীব্রতা ছিল তবু তার বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য তাকে শিখিয়েছিল সংযম। পুস্পবনে কি করে যেন প্রবেশ করেছিল দুষ্ট-দংশক কীট।যদিচ এ রঙ্গমঞ্চে কীট ও ছিল ক্রীড়ার অংশ বিশেষ। দংশন কখনো ঋদ্ধতাও দেয়,তবু তা বড় পীড়াদায়ক। কল্যাণী বিভ্রান্ত হয়নি। স্থির, ও নিস্তরঙ্গতায় প্রবেশ করছিলো ধীরে ধীরে।নির্জন এ দংশিত ফুলেল যাপনের বর্ণ ছিল বিষবৎ নীল অথচ প্রিয়।
তিনি বললেন— এবার দুগ্ধ, ধারাস্নানে যেন ছেদহীন হয়। চক্ষু উন্মীলন করলেন কল্যাণী। এ প্রকৌশলে চক্ষু উন্মোচনই দস্তুর। তার অন্তর্চক্ষু ছিল অস্থির সকালের ন্যায়। ন্যাশপাতি বর্ণের সকাল। সে সকালে ছিল গোল্লাছুট, লাফান দড়ি, কুমির ডাঙা, লুকোচুরি।সেখানে পর্বত ছিল, ছিল আরোহণ, প্রতিটি আরোহণ ছিল আর্তিময়, বেদনাবিধুর।ছিল খাদ,যা ভয়াল, অথচ প্রিয়।পর্বত যা কিনা পতনকেও তো নির্দিষ্ট করেই। পিচ্ছিল অথবা রুক্ষ এ অভীষ্ট ইচ্ছার সকাল ছিল পুরু হলুদ।
এবার মুক্তি। মোহ হতে। মাধুর্য হতে। শর্করা দিয়ে মার্জনা করুন। কল্যাণী ঘৃত, মধু, দধি মুক্ত করতে দুগ্ধ সহযোগে স্নান শেষে শর্করা দ্বারা মার্জনা করতে শুরু করলেন। মোহ মুক্ত হও,কলুষতা মুক্ত হও। চক্ষু আবার মুদ্রিত। দুপুরের রোদ, সকালের অস্থিরতা, বিকেলের অবাঞ্চিত তরণী বহমানতা এখন সন্ধ্যের স্নিগ্ধতায় প্রবেশিত। এখন রাত। অথচ এ নিস্কম্প স্নিগ্ধ যাপন শুধু শ্বেত বর্ণময়। যা কিছু বাহ্যিক অথচ আবরণ এ সময় উন্মোচনের।লজ্জ্বাহীন হও। বাম, দক্ষিণ, অগ্র বা পশ্চাৎ এর দিকে দৃকপাত নিবৃত কর। এ এক আদিম,পবিত্র অন্তর উদ্ভাসনের কাল। পক্ককেশ পিতা,দন্তহীন মাতা,অজাত সন্তান রইল এ দৃশ্যের গোপন সাক্ষী। না সেই সব উদভ্রান্তকারী, চটুল ক্রীড়ামোদী ফেলে আসা সাথীদের এ দৃশ্যে আগমন নিষিদ্ধ।
কল্যাণীর কর্ণে এখন অপ্রবেশিত পাখির কুজন,নদীর বহমানতা অপ্রবেশিত, পর্বতের উত্থান অথবা পতন এ দৃশ্যে আসীন নয়।
—কল্যাণী?
স্থির নয়নে কল্যাণী তাকালেন। তাঁর নির্দেশে সে ঐ প্রস্তর খন্ডে স্থাপন করলো বিল্বপত্র।
কল্যাণী সান্যাল। বয়স ৩৮। এবর্টেড, মিউচুউয়ালি সেপারেটেড এক প্রস্তরখন্ড কে অভিষিক্ত করলেন। অভিষেক হল রুদ্র, প্রবল এবং পুরুষের— এই ধর্ষণ মুখর, তিমিরময় মৃত্যু উপত্যকায়।