ট্যাক্সি ড্রাইভার । হাসান শাহরিয়ার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জুন ২০১৭, ১১:৫৩ অপরাহ্ণ, | ২২৬৯ বার পঠিত
মনে হইতেছে একটা শুকনা রুট খালি ফলো করতেছি বরাবর। কঠোর, হিসাব করা অনুভূতির। আকাশ থেইকা গড়াইয়া পড়া শিকলের মত। যেইখানে ভীড়, সেইখানে সারিবদ্ধ করার চেষ্টা। যেইখানে কেউ নাই, সেইখানে কেউ আসবে; এইরকম শব্দহীন মিছিল। একই ঘটনা শরীর পাল্টাইয়া আসে আর দাবি করে নতুন ভাষার। খুনিরে তাড়া করতেছে খুনি। নিঃসঙ্গতার সাথে জায়গা কইরা নিতেছে আরো নিঃসঙ্গতা। আপনে শেষমেষ আপনারেই খুঁজতেছেন।
আর তারপর আপনার পরিচয় হইলো ট্রাভিস বিকলের সাথে। ইনসোমনিয়ায় আক্রান্ত এক্স-মেরিন। একজন ট্যাক্সি-ড্রাইভার। একা এক ফ্ল্যাটে থাকে। সারারাত ট্যাক্সি চালায়; পারলে দিনের বেলায়ও। যেহেতু সে ঘুমাইতে পারে না। রোজগার ভাল। বারে যায়। মদ খায়। অন্য ড্রাইভার দোস্তদের সাথে আড্ডা দেয়। তারে অবশ্য বেশি কথা বলতে দেখা যায় না। নিয়মিত পর্ণ-ফিল্মের নাইট-শো দেখে। বড় পর্দার শীৎকারে তার চোখ দুইটারে ভাসতে দেখা যায়। উত্তেজনায় নাকি অবসাদে— বুঝা যায় না।
ট্রাভিস একা। আ লোন মেইট। এইটা নিজে সে ফিল করে। সাংঘাতিকভাবে ফিল করে। যখন সে ড্রাইভ করে; তখন। কারা তার প্যাসেঞ্জার? থাগস, বয়স্ক লম্পট, এলিট, পলিটিশিয়ান, ব্যর্থ স্বামী, নিঃসঙ্গ বয়স্কা, পতিতা, দালাল, মাতাল, ভদ্রলোক সবাই। যখন সে বারে গিয়া মদ খায়। আড্ডা দেয়। যখন সে পর্ণ দেখে। রাতের শহর গভীর হইতে হইতে হল্লা করতে থাকে। তুমুলআলোকস্বজ্জায় জ্বলতে থাকে বার আর হোটেলের শরীর। শহরের রাস্তা। ট্রাভিস এইসব ক্রস করে। মিটার আপ-ডাউন করতে করতে সে প্যাসেঞ্জার নিয়া এইখানে ওইখানে ছুটতে থাকে। নানান বয়স্কা পতিতাদের পাশ কাটায় ট্রাভিস; পাশ কাটায় মাতালের সারি। পাশ কাটায় উচ্ছৃংখল পোলাপাইনের অযথা মাস্তানি। তখনও ট্রাভিস একা।
এই লোনলিনেস ট্রাভিসের কাছে একটা শিকলের মত মনে হইতে থাকে একসময়। সে যেন একটা কারাগারে আটকা পইড়া গেছে। অতএব এরে ভাঙ্গা দরকার। ট্রাভিস নিজেরে মুক্তি দিতে চায়। এর বাইরে তার যে একটা অস্তিত্ব আছে; এইটা সবাইরে জানাইতে চায়। ট্রাভিস অন্ধকার থেইকা বাইর হইয়া আসতে চায়। কিন্তু কীভাবে? তার এই নিঃসঙ্গতা অবয়বহীন। এর কোন শরীর নাই। অতএব ট্রাভিসের একটা অবয়ব দরকার হইয়া পড়ে। দরকার হয় একটা শরীরের। ভীড়ের ভিতর ট্রাভিসের মনে হইতে থাকে — অনেকেই তার মত। এই শোর, এই ব্যস্ততা, এই মাতলামির ভিতর অনেক অনেক নিঃসঙ্গতা নিজেরে লুকাইয়া রাখছে যেন। ট্রাভিসের দরকার এদের সাথে কথা বলা। এদের সাথে কানেক্ট হওয়া।
কাজেই প্রেসিডেন্ট ক্যাম্পের ভলান্টিয়ার বেটসিরে ট্রাভিস ফলো করে। টিন এজার পতিতা আইরিসরে ফলো করে। বেটসি যে নিঃসঙ্গ- এইটা তারে জানায়। তারে বলে— তার চারপাশ আসলে শূন্যতায় ভরা। সে আইরিসের কাছে যায়। এই অন্ধকার থেইকা তারে বাইর হইয়া আসতে বলে। তারে বাড়ি যাইতে বলে। স্কুলে যাইতে বলে। বেটসি আইরিসের ভিতর ট্রাভিস শুনতেছিল নিজের নিঃসঙ্গতা। যে অর্থহীনতার ভিতর সে আটকা পইড়া আছে, তারাও যেন তা-ই।
এইদিকে ট্যাক্সি ড্রাইভাররে বেটসি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলো না। পলাইয়া গেল সে। ফলে ট্রাভিস আরো বেপরোয়া হইয়া উঠতে থাকে। সে অস্ত্র কিনে। একসাথে অনেক অস্ত্র। প্রেসিডেন্টরে খুন করতে যায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়। আইরিসরে উদ্ধার করতে গিয়া গ্যাং-ফাইটে হয় আহত।
এই গ্যাং-ফাইট ট্রাভিসের জীবনের একটা ঘটনা। এই রকম একটা ঝড়-ই সে আশা করতে ছিল। যেইটা তার এই নিরর্থকতার এই যান্ত্রিকতার একটা অর্থ তৈরি করবে। তারও অস্তিত্ব আছে; এইটা তারে জানাবে। নির্ঘুম ড্রাইভিং, ব্যস্ত শহরের অন্তঃসারশূন্যতা, বাঁইচা থাকার হালকা অজুহাত, বরাবর একই রাস্তা ধইরা ফের ঘরে ফিরার শাদা-কালো দুঃস্বপ্ন থেইকা তারে মুক্তি দিবে। অনেক কিছু ঠিকঠাক হইয়া যাবে; এইরকম এক পসিবিলিটি তৈরি করবে। যেমন লুকিং গ্লাসে বেটসির মুখ- বেহেস্তের অপ্সরার মত মনে হবে। তবু কোন তাড়া নাই যেন। যেহেতু আর কোন অস্বাভাবিকতা নাই। অতএব সো লং।
মুভিঃ ট্যাক্সি ড্রাইভার
ডিরেক্টরঃ মার্টিন স্করসিসে
ক্যারেকটারসঃ রবার্ট ডি নিরো, সেভিল শেফার্ড, জুডি ফস্টার
টাইম অব রিলিজঃ ১৯৭৬