কাগজের ক্যাম্প । হাসান শাহরিয়ার
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২২, ১২:৩২ পূর্বাহ্ণ, | ৫২০ বার পঠিত
এই রিফিউজি ক্যাম্পের একটা নাম আছে। আমার লিখতে ইচ্ছা করতেছে না। উদ্বাস্তুদের মুখহীন চেহারার মত তাদের বসতিও নামহীন হইয়া থাক। শহর থেইকা এই বসতি দেখা যায় না। শুধু দুইটা পাহাড় দেখা যায়। খাড়া, বধির আর অন্ধ। স্থির, মৌন আর পাথর যেন। যেন সাফা আর মারওয়া। তৃষ্ণাকাতর শিশুর চোখ ধইরা গড়াইয়া পড়তেছে নিঃসঙ্গতার বিষাদ। দুই পাহাড়ের মাঝখানে এই উদ্বাস্তু শিবির। রাষ্ট্রহীন মানুষের বিলাপ-বাগান। যার সবখানে কাগজের ফুল, কাগজের ঘাস। যার সবটা হইলো কাগজের নিয়তি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমিও কি একটা কাগজের আত্মা লইয়া ঘুরি? আমি এই শহরের এক উদাস যাযাবর। শিকল আমার পায়ের মালা। আমি এমন এক আধুনিক যারে শর্ত দিয়া ভালবাসার চুক্তি করতে হইতেছে।
মোটেও ভাবি নাই রিফিউজি ক্যাম্পে আইসা রেহানার লগে দেখা হইবো আমার। কেন দেখা হইলো? আমি ক্ষমতাহীন এক সামাজিক মানুষ। মুখোশ ছাড়া আর কিছুই আড়াল করতে শিখি নাই। রেহানা কি আমার চোখ দেখতেছে? যদিও এই চোখ তারে শুধু মিথ্যা বলবে। আমি হাসলাম। রেহানাও হাসলো। রেহানার চোখ আগের মত টলটলে। যেন মুহূর্তেই মাটিতে পইড়া যাবে। বুকটা আমার ব্যথা কইরা উঠলো। মাটিতে পড়ার আগে, চোখ দুইটা ধইরা ফেলতে পারবো?
—আহ রেহানা খাতুন! এই উদ্বাস্তু খেয়ালের ভিতর কার হিসাবে ধরাশায়ী তুমি?
—হাসান শাহরিয়ার! আমার ঝাঁকড়া চুলের বিষাদ। কার টানে এইখানে তুমি?
—কে টানবে, রেহানা খাতুন? তুমি?
—চিন্তাও করবা না!
—ইশ! ঘরহারা, আত্মমর্যাদাহীন ছোটখাটো সংখ্যা-মানুষ ছাড়া তোমার এই কাগজের ক্যাম্প আর কারে কারে টাইনা আনতে পারে, বলবা আমারে?
—তুমি এইসব হারাইলা কবে?
—এক সন্ধ্যায়। অর্ধেক কাটা এক টিলার কিনারে।
—কী হইছিল?
—বৃষ্টি।
খুব ভাল লাগতেছে রেহানারে দেখতে। কমলা রঙয়ের শাড়ি পইড়া উদ্বাস্তু ক্যাম্পে হাসপাতালের বাইরে একটা ডেস্কে বইসা ছিল সে। হাসপাতাল বলতে পাশাপাশি কয়েকটা তাঁবু। দুয়েকজন ডাক্তার দেখলাম ব্যস্তমতো বাইর হইতেছে। ফের তাঁবুর ভিতর যাইতেছে। নার্স আছে বেশ কয়েকজন। শাদা শাড়ি পড়া। লাল একটা বাড়তি কাপড় বুকে মোড়ানো। একটা লোগোও দেখা যাইতেছে ওই কাপড়ে। দাতা সংস্থার। রেহানার গলায় আইডি ঝুলানো। তার মুখে ক্লান্তি নাই। শরীরেও বোধ হয়।
এক মনে কীসব হিসাব করতেছিল। যেই কাঠের চেয়ারে বইসা ছিল, সেইটা গাঢ় আয়রন রংয়ের। ছোট একটা মেয়ে দেখা গেল। লাল জামা পড়া। খানিক পর পর আইসা রেহানারে এইটা ওইটা দিয়া যাইতেছে। দূরে আরেকটা তাঁবু দেখলাম। গোডাউন হয়ত। রেহানা কি এই উদ্বাস্তু শিবিরের মেডিকেল অফিসার? আমি জিজ্ঞাস করলাম, বাচ্চা মেয়েটার নাম কী?
—আমি তুলি ডাকি।
—তোমার এসিস্ট্যান্ট?
—না। এরা সারাদিন বিভিন্ন কাজ করে। আশেপাশে থাকে। এদের জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকে।
—তুমি কী করো এইখানে, রেহানা?
রেহানা হাইসা দিলো। বললো—এই হাসপাতাল দেখতেছ মানে এইসব তাঁবু? এইখানে মেডিকেলের যত চালান আসে, সব রেকর্ড করি আমি।
তার বেণী দেখতাম। দেখতাম তার টলটলে দুইটা চোখ। যেন মুহূর্তে মাটিতে পইড়া যাবে। ক্যাম্প থেইকা যত দূরে সইরা যাইতেছিলাম, তত বেশি স্মৃতির ভিতর আমি আরো মিইশা যাইতে লাগলাম। যেন রেহানার ঘর ছাইড়া কোথাও যাইতেছি না আর। যেন ওর মুখের কাছে যাইয়া বলতেছি, আহ রেহানা! সাবধান। এই দেখো আমার দুই হাত। ওই চোখ দুইটা মাটিতে পড়ার আগেই ধইরা ফেলবো আমি…
রেহানা হইলো আমার এক খালার মেয়ে। খালা—খুব বেশি কাছের না। নানার বাড়ির উত্তর দিকে ওদের বাড়ি। ওই বাড়িতে বেলি ফুল ফুটতো। আমরা থাকতাম শহরে। বছর দুই-তিনে একবার দেখা হইতো আমাদের। তখন আমরা পুতুল খেলার বয়স পার করতেছিলাম।
আমার এক বন্ধু ক্যাম্পের সিকিউরিটি অফিসার। আসার আগে তারে ম্যানেজ করতে হইলো। দেখতেছি রেহানা তার নতুন সংসার নিয়া এইখানে কাজ করতেছে বেশ। নতুন সংসার মানে তার প্রেমিক জাহান যারে বিয়ে কইরা ক্যাম্পে থাকতেছে সে। তার পুরান সংসার ছিল। বর ছিল। নাম জামান। জামান আর রেহানার দুইটা মেয়ে ছিল। পরী আর দিশা। এইসব অনেক আগের কথা। পরী আর দিশা—তাদের মায়ের এই ছাইড়া যাওয়াটা মাইনা নিছে এতদিনে। তারা তাদের দাদির সাথে থাকে। নতুন মা আসছে তাদের সংসারে। তারা পড়ালেখায় ভাল। এই বছর পরীর স্কুল-রেজাল্ট হইছে অসাধারণ। ওদের সাথে আমার দেখা হইছিল কিছুদিন আগে। পরীর চোখ দুইটা রেহানার মতো। টলটলে। যেন মুহূর্তে মাটিতে পইড়া যাবে।
রেহানা আমারে পুরা ক্যাম্প ঘুরাইয়া দেখাইতে চাইলো। আমি রাজি হইলাম না। বললাম,
—ভাঙাচোরা মানুষ দেখি না আমি।
—তুমি কারে দেখো?
—মাঝেমধ্যে নিজেরে দেখি।
রেহানা হাইসা দিলো। বলল,
—তাইলে এইখানে আসছো কেন?
—তোমারে দেখতে। অবশ্য আমি ভাবি নাই, তোমারে রিয়েলি দেখবো এইখানে।
—আমার খবর কে দিছে তোমারে?
—দিছে তোমার এক ভাই।
—ও। আমারে কেমন দেখলা, হাসান শাহরিয়ার?
—ভাল।
বিকালের গ্লাস খালি হইয়া আসতেছিল। সন্ধ্যার পর পর শেষ বাস এই শিবির ছাইড়া যাবে। আমি সময়টারে থামাইয়া দিতে চাইলাম। রেহানারে আর কী জিজ্ঞাস করবো? দিশার কথা ওর মনে পড়ে? পরীর কথা? কীভাবে ও ওদের ছাইড়া থাকতে পারতেছে এইখানে? জামান ভাইরে চিনি। মাটির মানুষ। তার থেইকা রেহানারে কে বেশি ভালবাসতে পারে? যত্নে রাখতে পারে? রেহানার দায়িত্ব নিতে পারে? অন্যভাবেও ভাইবা দেখছি আমি। হয়তো সম্পর্কের অন্য হিসাব আছে। আমি বুঝি না যেইটা।
—তোমার হাজব্যান্ড কই, রেহানা?
—জাহান বন্দরে গেছে। আজ একটা খাবারের চালান আসবে। ও চালানের হিসাব নিবে।
—তাইলে তোমরা দুইজন এইখানে ভাল আছো?
—ভাল থাকা মানে কি শাহরিয়ার?
—জানি না। মনে হয়, স্বপ্ন বানাইতে পারা হইলো ভাল থাকতে পারা। টুলস… ম্যাটেরিয়ালস… সব হাতের কাছে থাকবে। তোমার ইচ্ছা হইলো, এইখানে টোকা দিবা। ইচ্ছা হইলো ওইখানে।
—তুমি কোথায় কোথায় টোকা দিয়া বেড়াইতেছ?
—আমার হাত নাই। মাথা আছে। এইখানে ওইখানে ঠোকাই মাঝেমধ্যে।
হাসলো রেহানা। বললো— বেকার ঘুরতেছ তুমি?
—হুম। পাঁচ ছয়টা ট্রাক আছে। জকিগঞ্জ কাস্টমসে ঠিকাদারির লাইসেন্স আছে। যদিও এইসব আমার ছোট ভাই দেখে।
—তোমারে ঘর থেইকা বাইর কইরা দেয় নাই?
—কেন? আমি চড়ুই পাখি। এক ঠোঁট আহার নিয়া ছুইটা আসি কেবল৷
—ভাল।
আমাদের কথা কোনদিন ফুরাবে না। রেহানারে আরো কাছ থেইকা দেখলাম। কীটসের কবিতার গহিন সুন্দর বিষণ্ণতা হইলো রেহানা। অথচ এই সুন্দর আমারে শুধু ভিখু হইতে বলতেছিল বারবার। রেহানা যেন বিলি ফ্রঁসে। ক্রসফায়ারে খুন হওয়ার সময় যার জন্য আর্তনাদ করতেছিল জন ডিলিঙ্গার —বাই বাই ব্ল্যাকবার্ড! ভাবতেছিলাম, মানুষ কীসে বাস্তুহারা হয়? মানুষের ঘর কোথায়? আমি ফের উদ্বাস্তু শিবিরের দিকে তাকাইলাম। তারপর শহরের দিকে। কোথাও ঘর পাইলাম না। পাইলাম না আশ্রয়। আমি নিজের দিকে তাকাইলাম এইবার।
সন্ধ্যা নাইমা আসতেছিল। পাহাড়ের মাথায় আস্তে আস্তে লুকাইতে থাকা সূর্যটা আরো রক্তাক্ত হইয়া উঠতেছিল। ওর সব লাল রঙ রেহানার মুখে মাখামাখি হইতেছিল সকাতরে। আমি চোখ ফিরাইয়া নিলাম। রেহানার দুইটা বেণী ছিল। চিকন চিকন। বেণী দুইটারে খুব ভালবাসতো সে। সব কথায় তার মাথা দুইলা উঠতো। বেণীগুলা নড়তো। ছোটবেলায় ওর বাড়ি থেইকা ফিইরা আসার সময় রাস্তা পর্যন্ত আসতো সে। বেণী দুলাইতে দুলাইতে। আমি অনেকবার পিছনে ফিইরা তাকাইতাম। তার বেণী দেখতাম। দেখতাম তার টলটলে দুইটা চোখ। যেন মুহূর্তে মাটিতে পইড়া যাবে। ক্যাম্প থেইকা যত দূরে সইরা যাইতেছিলাম, তত বেশি স্মৃতির ভিতর আমি আরো মিইশা যাইতে লাগলাম। যেন রেহানার ঘর ছাইড়া কোথাও যাইতেছি না আর। যেন ওর মুখের কাছে যাইয়া বলতেছি, আহ রেহানা! সাবধান। এই দেখো আমার দুই হাত। ওই চোখ দুইটা মাটিতে পড়ার আগেই ধইরা ফেলবো আমি…