কথাবুদ্ধ’র পঞ্চবিন্যাস । কালের লিখন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ মার্চ ২০১৭, ১১:২১ অপরাহ্ণ, | ২৫৮৮ বার পঠিত
বাংলা কাব্যসাহিত্য নানাবিধ কাব্যকলায় পরিপূর্ণ। প্রেম, প্রকৃতি, মানুষ, ভালোবাসা বা দৈনন্দিন জীবনাচার নিয়ে প্রচুর কবিতা লেখা হয়েছে। প্রতিনিয়ত হচ্ছে নানারকম কথার আবাদ। সাধারণ কাব্যে যেভাবে পূর্ণ হচ্ছে বাংলাকাব্যের ভাণ্ডার সেভাবে দর্শন কাব্যের জন্ম হচ্ছে না। যদিও প্রতিটি সুশুদ্ধ কবিতাই একটি দর্শন উপস্থাপন করে, তবুও পরিপক্ব দর্শনের আলোকে লেখা কাব্যের সংখ্যা এখনো অপ্রতুল। রবিশঙ্কর মৈত্রীর কথাবুদ্ধ একটি দর্শন কাব্য। দর্শন হচ্ছে প্রজ্ঞার অনুসন্ধান, দর্শন হচ্ছে জীবনের কর্ষিত জ্ঞানের আলো। দর্শন বোধের বিস্তার করে, দর্শন জন্ম দেয় প্রতিরোধের শক্তি, দর্শনে বর্ষিত হয় অনন্তকালের নিগূঢ় ভক্তি। কথাবুদ্ধ কথায় কথায় শুদ্ধতার গান শোনায়, কথাবুদ্ধ মিশে আছে যাপিত জীবনের আনাগোনায়।
কথাবুদ্ধের কথার জগতে খুঁজে পেয়েছি অনেক অজানা কথা, অনেক ভাবনা জাগানিয়া কথার পুনর্বিন্যাস আর সুগভীর দর্শনে কর্ষিত চেতনালব্ধ জীবনের কথালাপ, কথাবুদ্ধে মগ্ন হয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম বলেই কিছু কথা লিখতে চাই, এই চাওয়া থেকেই কথাবুদ্ধের পাঠালোচনা। আমি পড়তে ভালোবাসি, বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাই আর চোখের সাথে হয় শব্দের সখ্য, এই মুখ্য প্রেমেরটানে শব্দজাত ভাবনারা এসে বাসাবাঁধে অনুভূত মননে। আমার ভালোবাসা শব্দজমি খননে।
কথাবুদ্ধ প্রসঙ্গে বইয়ের শুরুতে দার্শনিক’কবি রবিশঙ্কর মৈত্রী বলছেন— ‘লেখার জন্য আমি তাড়িত হই, প্রাণিত হই, আমি আমার একান্ত উপলব্ধিগুলো লিখি। উপদেশমূলক শব্দ বাণী লিখে আকাশমানুষ হবার বাসনা আমার নেই। জ্ঞান অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধি একীভূত হলেই মানুষ বোধ লাভ করে। আমি বোধলাভের চেষ্টা করি— কিন্তু এই তিনটিকে একসঙ্গে মনের মধ্যে কিছুতেই বসাতে পারি না। সাফল্যের ঘোড়দৌড়ভীত সন্ন্যাসী আমি। প্রচলিত সামাজিক উৎকর্ষবিমুখ আমি।’
এই প্রচলিত সামাজিক উৎকর্ষবিমুখ, সাফল্যের ঘোড়দৌড়ভীত এক সন্ন্যাসী কবির রচিত দর্শনকাব্য কথাবুদ্ধ। পাঁচটি অধ্যায়ে লেখাগুলো বিন্যস্ত করা হয়েছে, যথাক্রমে— ১। প্রেমময় তুমি এবং কবিতা, ২। শূন্যমাঝে যে বাঁশি বাজে, ৩। আমার ধর্ম আমার ঈশ্বর, ৪। রাষ্ট্র তোমার দেশপ্রেম আমার, ৫। সহজ মানুষ ও দিব্যজ্ঞান। পাঁচটি অধ্যায় দেখে পঞ্চবিন্যাস মনে পড়ে যায়। যেহেতু কথাবুদ্ধ দর্শনকাব্য তাই পাঁচটি অধ্যায় এখানে নেহাতই পাঁচ ভাবতে নারাজ আমি। এই পাঁচের মধ্যে ভিন্ন ব্যঞ্জনা লোকায়িত আছে। এই পাঁচ পঞ্চতত্ত্ব। এই পাঁচ পঞ্চভূত (১.আগুন, ২.জল, ৩.মাটি, ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যু), পঞ্চধাম ( ১। শক্তি, ২। জ্যোতি, ৩। স্থিতি, ৪। গতি, ৫। প্রকৃতি) বা আরও অন্যান্য দেহতত্ত্বীয় ও জীবনতত্ত্বীয় ঘনিষ্ঠতায় ব্যাপৃত। এই পাঁচ ছুঁয়ে যেতে পারে পঞ্চধাতু, পঞ্চনখ, পঞ্চনতি, পঞ্চনদ, পঞ্চনাশ’কেও!
আমরা কথাবুদ্ধের শুরুর অধ্যায় ‘প্রেমময় তুমি এবং কবিতা’য় যাবো প্রাজ্ঞ মন নিয়ে বিজ্ঞতার মশালতলে। দেখবো প্রেমময় মাধুর্যে কথাবুদ্ধ কোন কথার আবাদ করেছে। প্রেম কি? কথাবুদ্ধ বলছে— ‘যেতে যেতে পথ শেষ হয়ে যায়, যাওয়া শেষ হয় না। ঘাট বসে থাকে, নৌকা ওপারে। পার হলেই নতুন পথ— এই অপার হয়ে বসে থাকার নামই প্রেম।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ১৩)
প্রেম কি? আত্মদর্শন বলে— একে অপরের প্রতি ভালোবাসা বা কোন কাংখিত জিনিসের দর্শন লাভ করাকেই প্রেম বলে। প্রেম জীবনের জয়গান মানবের আরাধ্য, প্রেম স্বপ্নের মোহ’শ্লোগান, প্রেম বিশ্বশান্তির প্রতীক।
প্রেম মূলত দুই প্রকার ১.ঐশী প্রেম ও ২.বৈশ্বিক প্রেম। লালন সাঁইজির ভাষায় নিহেতু প্রেম আর হেতু প্রেম। ১.ঐশী প্রেম (নিহেতু প্রেম)— সাধারণত স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা, সাঁই, পারের কাণ্ডারি, উপাস্য ও ঈশ্বর প্রেমকে ঐশী প্রেম বলে। ২.বৈশ্বিক প্রেম (হেতু প্রেম)— বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বিষয়বস্তুর প্রতি ভালোবাসাকে বৈশ্বিক প্রেম বলে। বৈশ্বিক প্রেম আবার ৫ প্রকার। ১. সখ্যপ্রেম ২. শান্তপ্রেম ৩. দাস্যপ্রেম ৪. বাৎসল্যপ্রেম ৫. মধুরপ্রেম।
সাধুশাস্ত্র বলছে— প্রেম হচ্ছে প্রজ্ঞার অনুসন্ধান। কথাবুদ্ধও বলছে সেই প্রজ্ঞার সন্ধানে অপার হয়ে বসে থাকাই প্রেম। প্রথম অধ্যায়ে ষোলটি দর্শনকাব্য যুক্ত হয়েছে, এই ষোল সংখ্যাটিও দেহতত্ত্বীয় একটা মূলক। এই ষোল’র ষোলকলা থেকে আরও একটি দর্শনকলা আমরা পড়তে পারি। যেখানে প্রেমের অপরিহার্য অংশ ভালোবাসার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। কথাবুদ্ধ বলছে— ‘পাখি উড়বার শক্তি হারালে জড় হয়ে যায়; মানুষ ভালোবাসা হারালে প্রাচীন দালান, ভাঙা জানালা, আর বন্ধ কপাট ছাড়া অন্য কিছুই নয়।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ১৬)
২
কথাবুদ্ধের দ্বিতীয় অধ্যায় ‘শূন্যমাঝে যে বাঁশি বাজে’। এ অধ্যায়ের শুরুতেই কথাবুদ্ধ বলছে- ‘কামকেও কলা করে লিখে দিলে কবিতা হয়ে যায়। খামখোলা গোপন চিঠিতে যদি বৃত্তান্তকামই বিশদে থাকে, শরীরে তাপমাত্রা বারে শুধু, কোনো উৎস থেকে একফোঁটা কবিতাও ঝরে পড়ে না। জাতির মগজে যখন কাম আর নাম ঢুকে যায় তখন মোমের আলোর পরশে লীলাই বাড়তে থাকে।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ১৯)
কাম মানুষের ছয়রিপুর একটি। কামকে কামজ আখ্যার উর্ধে নিয়ে যাওয়াই অটল সাধনা। এই সাধনায় যে দার্শনিক পরিশুদ্ধ তার কাছেই নতজানু প্রজ্ঞাঋদ্ধ ভাবনারা। এই ভাবনার মশালতলে দাঁড়িয়ে আলোকিত হবার প্রত্যয়ে দেখি কথাবুদ্ধ বলছে— ‘আমরা জন্মগ্রহণ করি, মৃত্যুবরণ করি না।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ২১) সাধারণ একটি কথার মধ্যে কী অসাধারণ দর্শন! মানুষমাত্রই জন্মকে গ্রহণ করে কিন্তু মৃত্যুকে বরণ করে না। এই চিরন্তন সত্য উচ্চারণের কাছে ম্লান হয়ে যায় ‘মৃত্যুবরণ’ শব্দটি। কোথাও দূরে দাঁড়িয়ে মৃত্যু কী জানায় নীরব ভ্রুকুটি?
কথাবুদ্ধ বলছেন— ‘বেঁচে থাকাই মৌলিক, মরে যাওয়াটা লৌকিক’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ২১) কিংবা কথাবুদ্ধ যখন বলছেন—
‘যে বৃক্ষের বক্ষ বিদীর্ণ করে লিখছি
নিজের নাম সাকিন
সেই বৃক্ষই আমাকে দাহ করবে একদিন।বিদীর্ণ নাম, বক্ষ, বৃক্ষ, ভস্ম
কিছুই থাকবে না জানি,
তবু আমি নিয়তিনিষ্ঠ,
নিত্য নিরন্তর আমি এক খোদাই কারিগর।’
(কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ২১)
এই কাব্য পাঠের পর অনুভূতিশীল পাঠক হিসেবে কেঁপেওঠে মর্মমূল! শুরু, শেষ ও স্থিতির এক নির্মোহ চিত্রায়ন এই দর্শনকাব্য। সহসা মনে হয় এরকম ভাবনা যার মধ্যে জন্মে সে সত্যিই শব্দমানুষ, আকাশমানুষ নয়। শূন্যমাঝে আসলে কোন বাঁশি বাজে? এই যে কথাবুদ্ধ বলছে— ‘শূন্যমাঝে যে বাঁশি বাজে’ কী সেই বাঁশির সুর? কে বাজায় সেই বাঁশি? কে শোনে সেই বাঁশির প্রেমজ’প্রলাপ? এরকম নানাবিধ প্রশ্ন যখন মনে জন্মে তখন কথাবুদ্ধ বলছেন— ‘ছড়ালেই জড়াতে হয়, জড়ালেই দাঁড়াতে হয়, দাঁড়ালেই গন্তব্য দূরে সরে যায়’। (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ২৬)
গন্তব্যের টানে মন্তব্যের ডানা মেলে ধরবার আগেই কথাবুদ্ধ আবার বলছেন—
‘পা মিলিয়ে যেতে যেতে
গন্তব্য ভিন্ন হয়ে যায়
কারো চলা থেমে যায়
আমি থাকি আনন্দযাত্রায়
যেতে যেতে
নতুন নতুন গল্প রচিত হয়
আমাদের যাওয়া ফুরিয়ে যায়
গল্প ফুরোয় না।’
(কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ২৭)
এই যে গহীন শূন্যতায় চলাচল ফুরিয়ে যাওয়া, তারপরেও গল্প ফুরোয় না। শূন্যতার মাঝেও বাজে এক জীবনগল্পের বাঁশি, যে বাঁশির সুর মায়াময় অবিনাশী। যে গল্পবাঁশির সুরে ভোরের রোদহাসে বোধসূর্যের আঁচে; যে বোধের স্পর্শে পরিশুদ্ধ মানুষ ভালোবাসায় বাঁচে। সেই ভালোবাসার সাবলীল মাধুর্য যখন আমাদের ধ্যাননিষ্ঠ করে, ধ্যানীর ন্যায় যখন আমরা শূন্যতার বাঁশির সুর শুনতে যাই, তখনই কথাবুদ্ধ উচ্চারণ করে—
‘গমন করলেই ভ্রমণ হয় না
এপার থেকে ওপারে গেলেই
পার হওয়া যায় না।
ফুলে বসলেই আহরণ হয় না মধু,
কথাসুধা শ্রবণ করলেই পুণ্য হয় না।
স্নান করলেই দেহশুদ্ধি হয় না।
নিষ্ঠা না এলে বনে বসেও ধ্যান হয় না।’
(কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ২৮)
‘গমন করলেই ভ্রমণ হয় না’ এই আপ্তবাক্য ভাবতে ভাবতে চলুন এবার কথাবুদ্ধের কাছে জানি সুখ আর অসুখ নিয়ে এক অমিয়দর্শন— ‘যে খুশিতে একজনের সুখ হয়, সেই খুশিতে দশজনের অসুখ হয়। যে খুশিতে দশজনের সুখ হয়, সেই খুশিতে একজনেরও অসুখ হয় না।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৩০)
আপেক্ষিক সুখের এরকম দর্শনপ্রেক্ষিত উপস্থাপনা বেশ করে নাড়া দিয়ে যায় চেতনার প্রবাহে। নতুন করে ভাবতে ইচ্ছে করে সমুদয় ভাবনা। ভাবনার দরজায় টোকা দিয়ে কথাবুদ্ধ আবার বলেন—
‘আমি ফকিরকে
লালন করি;
বাদশাহর আদেশ
পালন করি না।’
(কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৩১)
কথাবুদ্ধ’র দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষকাব্যের আগের দর্শনকাব্যটিতে পাই—
‘নিজের ইচ্ছায় আসিনি,
স্বেচ্ছায় ফেরার অধিকারও
আমার নেই।’
(কথাবুদ্ধ—পৃষ্ঠা ৩১)
এরপর সত্যিই শূন্যমাঝে যে বাঁশি বাজে, সেই বাঁশির সুর শোনার প্রতীক্ষা ছাড়া, সেই শেষ’ডাকের বিচ্ছেদগীত কণ্ঠস্থ করা ছাড়া আর কিছু তালাশ করতে মন সায় দেয় না। কথাবুদ্ধের এই অধ্যায়টি পরমনিষ্ঠায় পরমশূন্যতায় শূন্যবাঁশিরসুরে বুঁদ হয়ে থাকার মতোই।
৩
কথাবুদ্ধের তৃতীয় অধ্যায়— ‘আমার ধর্ম আমার ঈশ্বর’। কথাবুদ্ধের ধর্ম ও ঈশ্বর ভাবনায় ডুব দেওয়ার আগে আমরা একটু ধর্ম ও ঈশ্বর নিয়ে ভাবতে পারি। মহাবিশ্বে এখন পর্যন্ত জীবন ধারনের উপযোগী একমাত্র গ্রহ আমাদের এই পৃথিবী। যদিও বিজ্ঞান প্রমান করেছে এই মহাবিশ্বে জীবন ধারনের উপযোগী আরও গ্রহ আছে এবং এর ব্যাপক অনুসন্ধান এখনো অব্যাহত।
মানবপ্রজাতি বেঁচে থাকা আর টিকে থাকার দূর্বার আকর্ষণে প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছে উন্নতির শিখরে। পৃথিবীর অসংখ্য প্রাণীকূলের মাঝে মানুষ নিজের প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, আর ইন্দ্রিয়(প্রযুক্তি) গুনে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হয়েছে। মানুষ আধিপত্য করছে সমস্ত সৃষ্টি জগতের উপর। এত চমৎকার বায়ুমণ্ডলের এই পৃথিবীর প্রতি মানুষের অপরিসীম ভালোবাসা, মানুষ প্রাণভরে উপভোগ করে সৃষ্টির সৌন্দর্য আর অপার মহিমা। মানুষ ফুলের ঘ্রাণ নেয়, পাখির ডাক শুনে, মানুষ রাতজেগে আকাশের তারা গুনে। মানুষ সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখে আর ভাবে এতো অনুপম সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা কে? মানুষ মাত্রই চিন্তা করে আমার সৃষ্টিকর্তা কে? আমার ঈশ্বর কে? আমার অধীশ্বর কে? এমন কোনো মানুষ নেই যার মনে এই প্রশ্ন উদয় হয়নি, সৃষ্টিকর্তার সন্ধানে মানুষের যাত্রা এখনো অব্যাহত, সৃষ্টিকর্তার সন্ধানে তৈরি হয়েছে অসংখ্য সম্প্রদায়, ভিন্নভিন্ন গোষ্ঠী আর জাতি, জন্ম নিয়েছে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক মতবাদ, এসব মতবাদকে আমরা ধর্ম বলে থাকি। যেমন— ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম। এক জরিপে দেখা যায় পৃথিবীতে ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় তিনহাজার ধর্মীয় মতবাদ আছে, আমাদের এই ছোট বাংলাদেশেও প্রায় শ’খানেক সাম্প্রদায়িক মতবাদ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রত্যেক ধর্মেই একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, প্রত্যক ধর্মীয়মত তাদের মতো করে সৃষ্টিকর্তার সন্ধান দিয়েছে। মুসলিমদের মতে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, হিন্দুদের মতে স্রষ্টা ভগবান, খ্রিষ্টানের স্রষ্টা গড, বিজ্ঞানীদের মতে সৃষ্টিকর্তা শক্তি, আত্মতাত্ত্বিকদের মতে সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন সাঁই, দার্শনিকদের মতে সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতি।
প্রত্যেকেই নিজনিজ হাড়িতে চমৎকার ব্যঞ্জন রান্না করেছে। প্রত্যেকেই তারতার মতো নিজের সৃষ্টিকর্তার সপক্ষে দালিলিক প্রমাণ আর যুক্তি উপস্থাপন করছে, তাহলে এই অসংখ্য সৃষ্টিকর্তার ভিড়ে আমি আমার প্রকৃত সৃষ্টিকর্তাকে কিভাবে কোথায় খুঁজে পাবো? খুব ছোট মানবজীবন, দেখতে দেখতেই ফুরিয়ে যায়, একটা কচ্ছপ ২০০ থেকে ৩০০ বছর বাঁচে সেখানে মানুষের গড় আয়ু ১০০ বছরেরও নিচে, অসংখ্য প্রশ্ন মনের মাঝে নিয়ে, উত্তর না জেনে, আত্মবিশ্বাসহীনতায় কেটে যায় ক্ষণিকের এই মানবজীবন। মরার আগে আমরা জানতেও পারিনা আমাদের এই পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্য, আমাদের মানবকর্ম কি, আমাদের প্রকৃত ধর্ম কি? অসংখ্য প্রশ্নের ভেড়াজালে অনুসন্ধানী মনে, জ্ঞান দিয়ে বিচার করে একটা বিশ্বাস আঁকড়ে ধরা উচিৎ। একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষের যুগে সময় এসেছে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার সন্ধান করার, জেনে’বোঝে সৃষ্টিকর্তার সাধন’ভজন পরম আনন্দের।
সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ স্রষ্টার সন্ধান করে এসেছে, ভাবুক কবিমন আর মহান সাধকরা তাদের গানে ও বাণীতে বলে গেছেন সৃষ্টিকর্তার কথা— প্রকাশ করেছেন সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে নানারকম আত্মজিজ্ঞাসা। আসুন আমরা কথাবুদ্ধে ধর্ম ও ঈশ্বরের সন্ধান করি।
কথাবুদ্ধ বলছেন— “ধর্ম হল জীবনবিধান। সময়ের সঙ্গে শাসন আসন আবাসন বদলায়, বদলে যায় যান ও বাহন। জীবনবিধানও বদলে যায়, কিন্তু নতুন বিধানগুলো ধর্মে যুক্ত হয় না বলে অসংখ্য মানুষ ঈশ্বরবিমুখ হয়ে পড়ে। ঈশ্বরবিমুখ হয়ে পড়লেই সাধারণের অভিযোগবিদ্ধ হতে হয়; মানুষবিমুখ হয়ে পড়লে সামান্য বদনামও গাঁয়ে লাগে না।” (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৩৬)
এইযে ঈশ্বরবিমুখতার বদনাম আর মানুষবিমুখতায় বদনামহীনতার সংস্কৃতি। এইযে ধর্মের বর্ম ভেদকরে মানবিকতার উজ্জীবন না হওয়া, এই দুঃখজনক সত্য মেনে নিয়েই কথাবুদ্ধ আবার বলেন— “ধর্ম যখন কর্মে থাকে না, মর্মে থাকে না, তখন তাকে সমাজবিধানে রাখতেই হয়। ধর্ম যখন রাষ্ট্রে থাকে না, তখন তাকে সংবিধানে না রাখলেই নয়।” (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৩৫)
আমার ধর্ম আমার ঈশ্বর অধ্যায়ে দার্শনিক’কবি রবিশঙ্কর মৈত্রী কথাবুদ্ধ’র বয়ানে নির্মোহবোধে বলছেন এক স্বতন্ত্র ঈশ্বর ভাবনার কথা, একটু গভীরে ভাবলেই যে ভাবনা হয়ে ওঠে সার্বজনীন সত্য। কথাবুদ্ধ বলছেন— ”ধর্মকে আমরা প্রথমত জন্মগতভাবে গ্রহণ করি, পরে মজ্জাগতভাবে ধর্মে স্থির হই অথবা ধর্ম বর্জন করি। যে-সব দেশে রাজনীতিকরা ব্যর্থ, নীতিহীন— সে-সব দেশে তাঁরা রাজনীতি বাদ দিয়ে ধর্মকেই হাতিয়ার করে মানুষের প্রতিনিধি হবার অপচেষ্টা করেন। বাণিজ্যিক পৃথিবীতে ভালোবাসা স্নেহ শ্রদ্ধা আদর্শ সুখ আনন্দ পুণ্য ইহলোক পরলোক সবই আজ ক্রয় বিক্রয় যোগ্য— আর এইসব বাণিজ্যের চতুর প্রেরণা আসে মূলত ধর্ম ও রাজনীতি থেকেই।” (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৩৫)
ঈশ্বরের ভাষা নিয়ে কথাবুদ্ধ বলছেন— ”মাতৃভাষাই আমার ধর্মীয় ভাষা। আমি যদি ঈশ্বরে বিশ্বাসী হই, তবে আমি জানি- ঈশ্বর ভাষাহীনের ভাষাও বোঝেন। ঈশ্বরের কাছে আমার প্রার্থনার ভাষাও তাই আমারই মাতৃভাষা। যিনি লেখেন, ভালোবাসার কথা বলেন, যিনি জীবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন তিনিই ঈশ্বরের প্রতিনিধি। প্রকৃত লেখকের ঈশ্বর এক ও অভিন্ন; লেখকের ধর্ম ঈশ্বরের কর্তব্যধর্ম। লেখকের লেখার ভাষা ব্যক্তিগত এবং আঞ্চলিক; কিন্তু তাঁর অন্তরের ভাষা ঈশ্বরের ভাষা। যারা ঈশ্বরের নামে জাতি ও ধর্মভেদ তৈরি করে তারাই মূলত শয়তানের প্রতিনিধি। খালি চোখে ঈশ্বর আর শয়তানের প্রতিনিধিকে একই মনে হয়। আদর্শ এবং বিবেকবুদ্ধি দিয়েই ঈশ্বরের খোদ প্রতিনিধিকে চিনে নিতে হয়।” (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৩৮)
ধর্মের গুণ নিয়ে কথাবুদ্ধ বলছেন— ”বেশিরভাগ মানুষই ধর্মভীরু এবং ভণ্ড, ধর্মবিশ্বাসী নয়। বিশ্বাস থেকে যারা নামাজ রোজা পূজা করে তারা প্রতিটি জীবের প্রতি দয়া করে। দয়াই তো প্রকৃত ধর্মের সবচেয়ে বড়ো গুণ।” (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৪৪)
ধর্মের ব্যপ্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োগ ছাড়াও, ঈশ্বর ভাবনা, ঈশ্বরের ভাষা, ধর্মের গুণ, এরকম নানাবিধ দর্শন ওঠে এসেছে কথাবুদ্ধে। আমার ধর্ম আমার ঈশ্বর এর পরিধি ছাপিয়ে কথাবুদ্ধ অবিশ্বাসীদের নিয়ে বলছেন— ”যদি ভাবি, নাস্তিকের কোনোকিছুই আমি নেব না— আমার সকল নিত্যকর্ম প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। যদি ভাবি, ইহুদি আর খ্রিস্টানদের কিছুই আমি ব্যবহার করব না— আমাকে কঞ্চি কেটে কলম বানিয়ে পাতা পুড়িয়ে কালি বানিয়ে তালপাতায় লিখতে হবে। যদি ভাবি, মুসলমানের কিছুই নেব না— আমার ইতিহাস খণ্ডিত হয়ে যাবে, হারিয়ে ফেলব আরব্যরজনীর আশ্চর্য গল্প এবং মরুভূমির উটজাহাজ এবং উত্তপ্ত বালিময় পৃথিবীর উপরে সজ্জিত অন্তহীন জায়নামাজ। যদি ভাবি, হিন্দুরা খুব খারাপ, ওদেরকে ঘৃণা করি আমি- সভ্যতা আর সংস্কৃতিকেই অস্বীকার করা হবে। আমি মানুষ— সকল ধর্ম কর্মের ভক্তিযুক্ত মানুষ আমার সাধনা। আমি যদি নাস্তিকের দান-অবদানকে গ্রহণ করি তবে আমি তাকেও বিশ্বাস করি। কারো অবিশ্বাসকেও গ্রহণ করে আমরা নিশ্বাস নিতে বাধ্য হই।” (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৪৫)
এইযে সকল মতবাদ আকণ্ঠ পান করে, জীবন ও মানুষের গান করে, মানবতার পক্ষে তান ধরে, কথাবুদ্ধের কথালাপ, দর্শনের নির্মোহ সাবলীল কর্ষণ। এই কর্ষণ আমাদের বোধে চেতনা বর্ষণ করে। আমরা নিজের চারপাশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখি, মনেহয় আমারও পাখা আছে, মুক্তির পাখায় আমি জীবনের গল্প আঁকি।
কথাবুদ্ধ ধর্মের স্থিতি নিয়ে বলছেন— ”পাত না থাকলে কারো কোনো জাতই থাকে না। কর্ম না থাকলেও অলসের ধর্ম থাকে।” (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৪৬)
আমার ধর্ম আমার ঈশ্বর অধ্যায়ের দর্শনকাব্যেগুলোতে ওঠে এসেছে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ধর্ম-অধর্ম, মুক্তি-শক্তি, ভজন-পুজন, ঈশ্বর-মানুষ ও প্রকৃতিসত্যের কারুকার্যময় চেতনার চাষ। একটি কথাবুদ্ধে এই অধ্যায়ের সমাপ্তি করছি— ”যে ধর্ম চর্চা করে, ঈশ্বরে বিশ্বাস আর ভক্তিই তার শক্তি; যে সংস্কৃতি চর্চা করে মানুষের সঙ্গে যুক্ত হওয়াই তার লক্ষ্যমুক্তি।” (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৪৬)
৪
কথাবুদ্ধরের চতুর্থ অধ্যায় ‘রাষ্ট্র তোমার দেশপ্রেম আমার’। অধ্যায়ের শিরোনামেই দৃঢ়তা, রাষ্ট্র তোমার বা তোমাদের, দেশপ্রেম একান্ত আমার। আমরা কথাবুদ্ধ’র চোখে রাষ্ট্র কেমন সেটা জানার আগে এই অধ্যায়ের শুরুর কাব্যটি পড়বো— ‘প্রতিবাদই সবচেয়ে বড়ো মতবাদ।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৫৫) চমকে ওঠার মতো নির্জলা নির্মল মতবাদ। জগতে প্রতিবাদের চেয়ে বড়ো মতবাদ হয় না।
কথাবুদ্ধ বলছেন— ‘ধর্ম, রাজনীতি, রাষ্ট্র, সীমান্ত- এসবই এখন নিরীহ গরিব মানুষকে পশুর মতো আটকে রেখে শোষণ নির্যাতনের অপকৌশল মাত্র। নিরীহ গরিব মানুষের কাছে রাষ্ট্র খোঁয়াড়ের চেয়ে বেশি কিছু নয়।
একটাই পৃথিবী, একটাই দেশ— কিছু মাংসভুক প্রাণীর ভয়ে আমরা একেকটি খোঁয়াড়কেই নিরাপদ রাষ্ট্রজ্ঞান করি।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৫৫)
কথাবুদ্ধ যখন বলে— ‘দুই ভাইয়ের হাঁড়ি বাড়ি জমি ভাগ হয়ে গেলে চুলা আর আগুন ছাড়া কিছুই বাড়ে না।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৫৫) তখন ব্যক্তিচেতনায় যেমন কষ্ট লাগে, মনেহয় তবুও ভাগ হয়, হতেই থাকে। তেমনি এই ভাগ হতে পারে দেশভাগের রূপকতাও।
দেশকে নিয়ে যারা ব্যবসা করে ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধি করে তাদের নিয়ে কথাবুদ্ধ বলছেন— ‘বেশ নিয়ে যে ব্যবসা করে সে বেশ্যা। দেশ নিয়ে যে ব্যবসা করে সে দেশ্যা। দেশ্যার চেয়ে বেশ্যাই ভালো। বেশ আবেশ দিয়ে সুখ দিয়ে পয়সা নেয় বেশ্যা, সে পরিস্থিতির শিকার। দেশকে ধর্ষণ করে হত্যা করে গা-ঢাকা দেয় দেশ্যা, এ তার চারিত্রিক বিকার।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৫৯)
দেশের উন্নয়ন নিয়ে কথাবুদ্ধ বলছেন— ‘গরিবের রান্নায় খুন্তি কড়াইয়ের আওয়াজটা বাড়তেই থাকে। বড়োলোকের রান্না হয় নীরবে, তারা হাপুস হুপুস করেও খায় না, খেয়েটেয়ে ঢেঁকুরও তোলে না। দরিদ্র দেশের উন্নয়নও হয় বাজনা বাজিয়ে, ধনী দেশের উন্নয়ন হয় নীরবে, পর্দা ঢেকে।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৬২)
রাষ্ট্র তোমার দেশপ্রেম আমার অধ্যায়ে ওঠে এসেছে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিকের দেশ রাষ্ট্র ও জনগণ ভাবনা। নানা বিষয়ের উপরে দর্শনঋদ্ধ কথা ওঠে এসেছে এই অধ্যায়ে, নেতার স্বরূপ নিয়ে একটি কথাবুদ্ধ পড়ে আমরা এই অধ্যায় সমাপ্ত করবো। কথাবুদ্ধ বলছেন ‘উচ্চতর নেতা মানেই ক্রেতা, তাঁরা মানুষের প্রেম ক্রয় করে। নিম্নস্তরের নেতা মানেই বিক্রেতা, তাঁরা সন্ত্রাস আর ক্ষমতা বিক্রয় করে বেড়ায়।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৬২)
৫
কথাবুদ্ধের পঞ্চম ও শেষ অধ্যায়— ‘সহজমানুষ ও দিব্যজ্ঞান’। সহজমানুষ শব্দটি কানে এলেই মনে পড়ে মহাত্মা লালন সাঁইজির বাণী— ‘সহজমানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে। পাবিরে অমূল্যনিধি বর্তমানে।’ কী অনুপম কথা, তুমি দিব্যজ্ঞানে যদি সহজমানুষ ভজন করতে পারো, তবে বর্তমানেই অমূল্যনিধির দেখা পাবে। কথাবুদ্ধেও যখন সেই সহজমানুষ আর দিব্যজ্ঞানের কথা পাই তখন ভাবুক মন আনন্দে নেচেওঠে ঋদ্ধদর্শন লাভের আশায়। আমরা কথাবুদ্ধের দৃষ্টিতে সহজমানুষ ও দিব্যজ্ঞান জানার আগে সহজ করে জেনে নিতে পারি, সহজমানুষ কি? দিব্যজ্ঞান কি ও কাকে বলে?
লালন সাঁইজির বাণীতে নানারকম মানুষের সন্ধান পাওয়া পায়, যেমন— ভাবেরমানুষ, প্রেমেরমানুষ, অটলমানুষ, মানুষনিধি, অচিনমানুষ, সহজমানুষ, রঙেরমানুষ, এতসব মানুষের ভিড়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দিব্যজ্ঞানে খুঁজে নেওয়াই সাধকের অন্যতম সাধনা, কেননা সহজমানুষের সন্ধান না পেলে কিছুতেই সহজসাধন হবে না। সহজমানুষ হচ্ছে— সরল লোক, সরল মানুষ, সাধু স্বভাববিশিষ্ট লোক। ভাষা’অভিধান বলছে- মনেরমানুষ, ভাবেরমানুষ, প্রেমেরমানুষ, তরলমানুষ। প্রপক বলছে— আদিমানুষ, মানুষ, মহামানুষ ও মনেরমানুষ এই চারপ্রকার মানুষের সর্বশেষ মানুষ।
আত্মদর্শনে সহজমানুষ হচ্ছে নিজের স্বরূপ উন্মোচন করা। পদার্থের তিনটি অবস্থা— কঠিন তরল ও বায়বীয়। মানুষ একটি পদার্থ বিধায় মানুষেরও তিনটি অবস্থা। মানুষের মধ্যে তরল আকারে যে মানুষ বাস করে তাকেই সহজমানুষ বলে। সহজমানুষের সংজ্ঞা— মাতৃজঠরে সর্বজীবের ভ্রূণ লালনকারী অমৃতরসকে পালনকর্তা বা রূপকার্থে সহজমানুষ বলা হয়।
সেই সহজ মানুষের সন্ধান পাওয়ার জন্য চাই দিব্যজ্ঞান। দিব্যজ্ঞান অলৌকিক কিছু নয়। লালন সাঁইজি সহজ করে বলেছেন— ‘আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে দিব্যজ্ঞানী সে হয়েছে’। অর্থাৎ যে মানুষ আত্মতত্ত্ব জানবে, সেইই দিব্যজ্ঞানী হবে। দিব্যজ্ঞান লাভের একমাত্র পন্থা হচ্ছে আত্মতত্ত্ব জানা বা নিজেকে জানা।
দিব্যজ্ঞান হচ্ছে— পরাজ্ঞান, পরমজ্ঞান, ভেদবিদ্যা, আত্মতত্ত্বজ্ঞান, আধ্যাত্মিকজ্ঞান, আত্মপরিচয়মূলক জ্ঞান, অতীন্দ্রিয় বিষয়বস্তু সম্পর্কীয় জ্ঞান, যে জ্ঞানের ফলে অতীত ও ভবিষ্যৎ বিষয়াদি জানা যায়। সত্য উপলব্ধি, যে উপলব্ধির ফলে বিষয়বস্তুর মধ্যে সত্য ও মিথ্যার প্রভেদ পরিলক্ষিত হয়। দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন মানুষকে বলা হয়— দিব্যজ্ঞানী, মরমী, পরাজ্ঞানী, পরমজ্ঞানী, আত্মতত্ত্বজ্ঞানী, আধ্যাত্মিকজ্ঞানী, অলৌকিকজ্ঞানী, অতীন্দ্রিয় বিষয়বস্তু সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞানী, আধ্যাত্মিকজ্ঞানের অধিকারী, আধ্যাত্মিকজ্ঞানপ্রাপ্ত সুবিজ্ঞ সাধু বা সন্ন্যাসী।
এইযে সহজমানুষের সন্ধান করে দিব্যজ্ঞান আহরণের বিষয়টি, এইব্যাপারে কথাবুদ্ধ বলছেন— ‘চারা থেকে বৃক্ষ না-হওয়া পর্যন্ত বেড়া লাগে; ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত যেতেও আদর্শের পাহারা লাগে।’ (কথাবুদ্ধ- পৃষ্ঠা ৬৭)
কথাবুদ্ধের এই আদর্শের পাহারা একজন সহজমানুষের পাহারা, একজন দিব্যজ্ঞানীর পাহারা। যে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হবে একেকটি মানবজীবন। মানুষের জন্ম নিয়ে কথাবুদ্ধ বলছেন— ‘যৌন নিয়ন্ত্রিত হলেই জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পাখির ঠোঁট থেকে ইটের কোটরে পড়া বীজ অঙ্কুরিত হলেও তা বৃক্ষ হয়ে ওঠে না। কাম চরিতার্থ হলেই মানুষের জন্ম হয় না। মানুষ জন্ম দিতে হলে আগে মৌন হতে হয়। মৌন না হয়ে আমরা যা চাই তাই গৌণ হয়ে যায়।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৭০)
মৌন না হলেই আমরা গৌণ হয়ে যাই। এই মৌন মানুষের একটি স্বরূপ এসেছে কথাবুদ্ধে— ‘যারা মন থেকে কিছু দেয়, তারা প্রীতি আর স্বীকৃতি ছাড়া কিচ্ছু চায় না’। (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৭৩)
দিব্যজ্ঞানী কথাবুদ্ধ এই অধ্যায়ে বলেছেন দর্শনের অন্তর্নিহিত কিছু দর্শনের কথা। প্রতিভা নিয়ে কথাবুদ্ধ বলছেন—’প্রতিভার জাত লাগে না, পাত লাগে। প্রতিপালন লালন ছাড়া সকল প্রতিভাই কুসুমে বিনষ্ট হয়ে যায়।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৭২)
মানুষের বোধবুদ্ধি নিয়ে দিব্যজ্ঞানী কথাবুদ্ধ বলছেন— ‘বন্যার আভাস পেলে পিপীলিকা অস্থির চঞ্চল হয়ে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু মানুষ মহা মড়কের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অস্থির উন্মাদনার কারণই বুঝতে পারে না।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৭৮)
অহংকার নিয়ে কথাবুদ্ধের বাণী— ‘অহংকে আকার দিলেই অহংকার। অহংকে যে সুকৌশলে নিজের কাছেই আড়াল দিয়ে রাখে তাকেই আমরা সভ্য ভদ্র মার্জিত মানুষ বলে সমীহ করি।’ (কথাবুদ্ধ— পৃষ্ঠা ৭৫)
‘সহজমানুষ ও দিব্যজ্ঞান’ অধ্যায়ে দার্শনিক’কবি দিব্যজ্ঞানী রবিশঙ্কর মৈত্রী তার দর্শনলব্ধ চেতনায় তুলে ধরেছেন, জীবনজিজ্ঞাসা, আত্মজিজ্ঞাসা, মানুষের করণকার্য সাধন’ভজন, চেতনার পুনর্বিন্যাসসহ নানাবিধ বিষয়ে প্রাজ্ঞমতবাদ। কথাবুদ্ধ শুধুই কথার আবাদ নয়, কথাবুদ্ধ ব্যাথার নিরাময়ও করে, হতাশ’কে উজ্জীবিত করে, তৃষ্ণার্ত’কে জ্ঞানজল দেয়, বলহীন’কে দেয় নতুন মনোবল। কথাবুদ্ধ বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে একজন জীবনঘনিষ্ঠ মগ্ন দার্শনিকের বোধের উন্মোচন। যে বোধের রোদে আলোকিত হতে পারে জ্ঞানতৃষ্ণ কোটিকোটি মানুষের মন।