পাণ্ডুলিপি থেকে । মুজিব ইরম
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ৯:০৯ পূর্বাহ্ণ, | ১৮৭৭ বার পঠিত
চম্পূকাব্য
আমাদের গ্রামে আমরা কেউই আর আমি থাকি না! বালেগ হই আর দল বেঁধে আমি থেকে আমরা হয়ে উঠি। প্রেম করি, উড়ুচিঠি লেখি, শিল্লি দিই, মক্তবঘাটে হল্লা করি। একজনের চোখের টান, বিনুনির ঢেউ, ওড়নার জ্যামিতি সবাই মিলে রাষ্ট্র করি। গোপনে গোপনে কাতর হই, তবু দলছাড়া হই না। আমরা কুসুমবাগের রুপালি পর্দায় আংশিক রঙিন বই দেখি, আর পড়শিনীকে নায়িকা করে পর্দা জুড়ে যুগল প্রেমের দ্বৈত সংগীত গাই। নাচেগানে নায়ক হয়ে উঠি। রাধানগরে বাউলি মারতে যাই। রাধানগরের দুই বোন আমাদের কাঁচা রাস্তা আলো করে বিদ্যালয়ে যায়। আমরা তাদের পায়ের নিচে হাওন মাসী কাদা হয়ে লেপটে থাকতে চাই। প্রেমিক হতে চাই। আমরা দলবেঁধে মুখস্ত করি— আতা গাছে তুতা পাখি ডালিম গাছে ফুল, এই চিঠির উত্তর দিতে হয় না যেন ভুল। আমাদের কেচমা পা কাঁপে, হাত কাঁপে, মন কাঁপে, চিঠি লেখা হয় না। তবু বাসনা করি চিঠি আসুক, জলছাপের পাতায়— তেঁতুল পাতা নড়েচড়ে, তোমার কথা মনে পড়ে! আহা, আমাদের কথা কি দুই বোনের মনে পড়ে?
.২
তোমাদের বাড়ি ফুল ফোটে। সেই নানা রঙা ফুলের গন্ধ ছুটে ছুটে আসে, আর সরল অংকে ভুল হয়, তৈলাক্ত বাঁশে বানরটি শুধু উঠে আর পিছলে যায়! ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত, পাটকে সোনালি আঁশ বলা হয়— এইসব সরল বাক্যের অনুবাদ পড়ি, আর ভুল করি। এই মন ফুলচাষি হতে চায়। করতে চায় ফুলের বাগান। যে-বাগানে তোমার নামেই নাইন-ও-ক্লক ফোটে, মোরগফুল ফোটে, গেন্ডাফুল মনে হয় তোমার নামেই শীতরোদে হয়ে ওঠে বিনাশী হলুদ। লক্টন জবার রঙ, বাহারি কচুর ফুল, জিনিয়া-ডালিয়া আর রজনী-কামিনী ফোটে তোমাদের বাড়ি। আর আমি উঁকিঝুকি মারি, আর আমি তোমার হাতের ফুলচাষ, ফুলের বাগান দেখে দেখে আসি। অপেক্ষায় থাকি, কবে যে তুমিও একদিন দেখতে আসবে এই অধমের চাষ, ডেকে উঠবে চাষি, ডেকে উঠবে মালী। এই স্বপ্নে আগলে রাখি পড়ার টেবিল। এই স্বপ্নে ডেকে উঠি নাম, তোমার সুনাম। তোমার হাতের কাজে, ফুল তোলা রুমালের ভাঁজে, মজে থাকে মন। এই মন খায়েস বাড়ায়, একদিন দিও তুমি ফুল তোলা রুমালের চিঠি— ফুল ফুটে ঝরে যায়, এই তার রীতি, মানুষ মরিয়া যায়, রেখে যায় স্মৃতি!
৩
আমাদের সহপাঠিনী শিল্পী রানী গলা সাধে, গান গায়, মনু নদী পাড়ি দিয়ে বহু পাক্ষিক বিদ্যালয়ে যায়। আমাদের রচনায় সাধু ও চলিত রীতির সংমিশ্রণ হয়। গরু চতুষ্পদী জন্তু, তাহারা খড়বিছালি খায়, মাঠে মাঠে চরিয়া বেড়ায়— সহজ রচনা লেখা জপতে জপতে ভুল করি। রাফখাতায় হাবিজাবি লেখি— ও শিল্পী রানী, তুমি সেনপাড়ায় থাকো, তুমি নদীঘাটে যাও, তুমি সন্ধ্যাগীতি গাও। লেখি আর কতো কিছু হতে চাই। হাওনের ঘাটে হতে চাই হিজলের জল। আমরা আর জুতা ছাড়া হাঁটি না, আমরা আর লুঙ্গি পরে গাউয়া থাকতে চাই না, পল্লীগীতি বাউল আর পীরমুর্শিদি শুনে খ্যাত হতে চাই না। শুনতে চাই আধুনিক ভক্তিগীতি ঠাকুরের গান। আমরা ফিল্মী স্টাইলে চুল কাটি। তোমাদের বাড়ি বাউলি মেরে আসি। ভোরের বেলা গলা সাধা শুনি। দেখি তোমার সদ্য ধোয়া মুখের আদল। তুমি জবা তোলো, ঠাকুরঘরে ভক্তি দাও, হারমোনিয়ামে ভক্তিগীতি গাও! আমরা তোমার গানে মজি, রূপে মজি, আমরা তোমার সুরের ধারায় নতজানু, নিত্য জপি নাম, তোমার হাতে সন্ধ্যা প্রদীপ, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম!
আমরা যখন রাফখাতায়, আমরা যখন বইয়ের ভিতর লেখি তোমার নাম, তুমি তখন মধ্যরাতে খুব গোপনে বর্ডার পাড়ি দাও! পড়ে থাকে খালিবাড়ি, গলা সাধা, ভোরের জিকির, ভাঙাচোরা মন। আহা ভাঙাচোরা মন!.
৪
শীত আসে আর আমাদের ভোরগুলো সংগীত হয়ে ওঠে। আমাদের রাজপথ কাঁপিয়ে বনভোজনের বাসগুলো দূরের পাহাড়ে যায়। আমাদের মাধ্যমিক মন উসকে দিয়ে বনভোজনের মাইকগুলো সুর ছিটিয়ে যায়! আমাদেরকে মাধবপুর ডাকে, শ্রীমঙ্গল ডাকে, জাফলং ডাকে। জল-পাথর-ঝর্না ও চায়ের বাগান আমাদেরকে বিবাগি বানায়। ফুজি ও কোডাক ফিল্মে ইয়াসিকা ক্যামেরায়, ও সহপাঠিনী, তোমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, অর্ধভেজা পাথরে পাথরে, জলে ভাসা ঘাসে ও কাদায় ছবি হতে প্ররোচনা দেয়। আউলা-ঝাউলা হই। আর সেই সব পাহাড়িয়া ভোরে তোমাকেই লক্ষ্য করে মাইকে মাইকে ছড়িয়ে দিতে চাই কান্না ও নিবেদনের কন্ঠ আমার!
আহা, আমরা গাউয়ালি বালকেরা কবে যে টাউনিয়া হবো, আর সহপাঠিনীদেরকে নিয়ে বনভোজনে যাবো, গাবো কন্ঠছেঁড়া গান— চিরদিনই তুমি যে আমার! আহা, আমাদের গাউয়ালি মন, বহুপাক্ষিক বিদ্যালয়ের শীত, মনের বেদনা!.
৫
আর তো চাইনি কিছু…শুধু কিছু গন্ধরাজ, কামিনী কুসুম…শুধু কিছু গেন্ডাফুল, সুবাসিত ঘুম…আর তো চাইনি কিছু…বলিনি তো…পাটিগনিতের ভাঁজে শুকনো জারুল, সে তো আমি…আধ ভাঙ্গা ঝাউপাতা, হাস্নাহেনা, রঙ্গন-বিলাস, সে তো আমি…আর যতো ভাঁজ করা পাতা, সে তো আমার হৃদয়…বলিনি তো যত্ন নিও…বলিনি তো উত্তর করিও…তাকিও গো তেরচা করে চোখ…কেঁপে যেন উঠি এই খ্যাপা আত্মভোলা…তোমার বাড়ির পাশে উড়ি আমি শিমুলের তুলা।