পাণ্ডুলিপি থেকে । সুমন সাজ্জাদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১০:২৪ অপরাহ্ণ, | ১৮৮২ বার পঠিত
কাতুলুস
চড়ুই
ছোট্ট চড়ুই— গভীর আনন্দ তুমি আমার প্রিয়ার,
যাকে সে জড়িয়ে রাখে বুকের ভেতর, কখনো সে
ছড়িয়ে দেয় খুঁটিনাটি খুনসুটি, খোঁচা দেয় আঙুলের
কোমল ডগা, পাখিটি বাড়িয়ে দেয় তার তীক্ষ্ন ঠোঁটের
প্রত্যাঘাত, আমার এই প্রোজ্জ্বল প্রেম হয়তো তেমনই
চায় অথবা চায় অন্য কিছু — সহজ দুষ্টুমি, চায় তার
ব্যথা থেকে ক্ষণিক নিষ্কৃতি, উত্তাল আবেগের শান্তিময়
মুহূর্ত। আমিও তো খেলতে পারতাম তোমারই মতন,
যেমন সে খেলে তোমার সঙ্গে, আর হালকা করতে
পারতাম আমার অসুখী মনের বেদনাভার। ভাবতেই
কম্পিত হই — গল্পের সেই তুখোড় মেয়েটির মতো,
যে কিনা সোনালি আপেলের প্রলোভনে ভেসে গিয়ে
হারিয়ে ফেলেছিল তার কুমারী পোশাক।
.
চড়ুইয়ের মৃত্যু
ভেনাস, কিউপিড অথবা যাদের হৃদয় আজ পরিশুদ্ধ,
চলো তবে শুরু করি শোকার্ত বিলাপ। চড়ুইটি মরে গেছে,
যে ছিল আমার প্রিয়ার সহায়, আহা চড়ুই, গভীর আনন্দ
তুমি আমার প্রিয়ার, প্রিয়তম যেন তার চোখের চেয়েও;
কেননা তার কাছে সে ছিল মধুর এক হৃদয়-সহচর,
মেয়েরা যেমন থাকে মায়ের কাছে। কখনো সে যায়নি
ছেড়ে তার আলিঙ্গন, ছিল কতো ছুটোছুটি-লুটোপুটি আর
মিটিমিটি তাকিয়ে থাকা — তার সখীর দিকে। এখন সে
চলে গেছে অন্ধকার পথে, যেখান থেকে কোনোদিন আর
কোনো ফিরে আসা নেই। শয়তান ছড়িয়ে দিয়েছে অপচ্ছায়া—
অর্কুস, খাদক তুমি সকল সুন্দরের! ছিনিয়ে নিয়েছো তুমি
সুন্দর পাখিটিকে! কী বিশাল দানবিক অপরাধ! আহা রে
ছোট্ট চড়ুই! তোমার মৃত্যুতে আমার প্রিয়ার মায়াবী চোখ,
দ্যাখো লাল, গড়িয়ে পড়ছে টলোমলো অশ্রুবিন্দু।
.
কায়েলিউসের প্রতি
কায়েলিউস, তুমি কি চিনতে লেসবিয়াকে,
আমাদের লেসবিয়া, আমার লেসবিয়া—
তুচ্ছ করে সব পরিবার পরিজন,
কাতুলুস যাকে ভালোবাসত নিজেরও অধিক,
এখন তাকে পাওয়া যায় চৌরাস্তায় আর
অন্ধ গলিতে — মহান রেমুসের বংশধরদের
তৃপ্ত করতে আর যৌনাঙ্গের খোসা ছাড়াতে।
.
ভার্জিল
ইকলগস
মেষপালক করাইডন ভালোবাসত প্রভুর প্রেমিক
সুদর্শন এলেক্সিসকে; কিন্তুবাসনা ছিল তার নিষ্ফল।
দিনের পর দিন একা একা হাঁটত সে বিচের অরণ্যে,
ছায়ায় ছায়ায়। বুনো অরণ্য আর পর্বতেরা শুনত তার
ব্যর্থ অনুযোগ : নিষ্ঠুর আলেক্সি, দয়া করো!
অবজ্ঞা করছ আমার গানকে? বেদনায় মরব আমি?
গাভীরা খুঁজছে ছায়াময় স্থান, বনগোলাপের আড়ালে
শুয়ে আছে গিরগিটি, এমন দিনে চাষাদের জন্য
থেসটাইলিশ গুঁড়ো করছে তীব্র তিক্ত লতা-গুল্ম ও
রশুন। কিন্তু কী পুরস্কার আমি পাই, এই গরমে
যখন তোমার পায়ের ছাপ দেখি? দ্রাক্ষালতায় আমি
পাই ঝিঁঝিঁর শব্দ।
অ্যামারিলিস যদিও বিরক্ত করে আর ঠোঁট ফোলাতে
অভ্যস্ত, তবু তার ক্রোধ এই শূন্যতার চেয়ে ভালো
নয়? মেনাক্লেস — মূলত কালো, কিন্তু বেশ মনোহর,
সুন্দর চুলের সেই ছেলেটি — পাত্তা দিও না বেশি
মুখের রঙ আর গড়নকে। ঝরে পড়ে সাদা প্রিভিট,
হায়াসিন্থ, যদিও কালো, কুড়িয়ে নেয় সকলে।
‘আমাকে অবজ্ঞা করে আমার ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞেস
করবে না তুমি। জেনে রাখো, তুষারসাদা দুধ আর
গবাদি পশুর দঙ্গল নিয়ে আমি বেশ ধনীই আছি,
পাহাড়চূড়ার ওই হাজার ভেড়ার দল আমার,
গ্রীষ্ম কালে বয়ে যায় সতেজ আর খাঁটি দুধের
নহর। সমতল যখন জমাট বরফ, আমি তখন
গান গেয়ে আমার পশুদের ডাকি— যেমন থিবান
এম্ফিওন মুগ্ধ করেছিল এ্যাটিক পাহাড়কে।
আমি অতো কুৎসিত নই মোটেও; বাতাসবিহীন
সমুদ্র যেদিন খুব শান্ত হয়েছিল সেদিন দেখেছিলাম
আমার মুখ। আয়না যদি কখনো মিথ্যে না বলে থাকে,
তাহলে দাফনিসকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
‘আহা, যদি তুমি আমার সঙ্গে থাকতে! তাহলে
দু’জনে মিলেমিশে থাকতাম আমার ভাঙা কুঁড়েঘরে,
সরু লাঠি হাতে দু’জনে দৌড়াতাম শাবকদের
পেছন পেছন, নিঃশব্দ পায়ে পৌঁছে যেতাম হরিণশিশুর
কাছে, তুমি হয়ে উঠতে প্যানের প্রতিদ্বন্দ্বী : তোমাকে
শেখাবো কী করে গাইতে হয় গান, আমাদের প্যান,
মেষপালকের বন্ধু, প্রথম যে শিখিয়েছিল মোম দিয়ে
রীডগুলি জোড়া দেবার কৌশল, সে পাহারা দেবে
আমাদের ভেড়াগুলোকে, যাতে করে তোমার মিষ্টি
সুর বয়ে যেতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। (আমিন্তাস
এই বিদ্যা শিখতে গিয়ে মরে যেতে পরত)। যদি
তুমি আসো, বয়ে আনব সাত সুরের হেমলক বাঁশি—
যা আমাকে দিয়েছিল দামোয়েতাস, বলেছিল, ‘এখন
তুমিই সেই দ্বিতীয় ব্যক্তি, যার কাছে বাঁশিটা আছে।’—
তুমি তা বাজাতে পারো। (হিংসুক আমিন্তাস তার
মাথা খেয়ে ফেলল)।
দুটি হরিণশাবক আছে, এই তো কয়েক দিন হলো
উপত্যকার খাদ থেকে যাদের আমি বাঁচিয়েছি, আমার
এক দুধেল ভেড়ী প্রতিদিন দুবেলা যাদের দুধ খাওয়ায়।
ওদের শরীরে ডোরাকাটা দাগ। যদি তুমি পছন্দ করো
ওগুলো তোমার। থেসটাইলিশ যদিও চাইছে, হয়তো
ওই পাবে যেহেতু তোমার কাছে আমার সকল উপহার
নিতান্ত তুচ্ছ। এসো, তুমি সোনা, লিলিতে ভরা ডালা
হাতে নিম্ফরা তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছে, আর দ্যাখো,
শাখাভরা ফুল নিয়ে এসেছে নায়াদ, ধূসর ভায়োলেট
আর পপির সাথে মিশিয়ে দেয়া হলুদ নার্সিসাস ফুলের
ঘ্রাণ, মৌরী লতা, বুনো দারুচিনি আর গুল্মের মিষ্টি
গন্ধ, হায়াসিন্থ আর হলুদ মেরিগোল্ডে আঁকা হয়েছে
একটি উজ্জ্বল ছবি। আমি কুড়িয়ে আনব ধুলোমাখা
ঝরে পড়া পিচ, তুলে আনব সুস্বাদু বাদাম, এ্যামারিলস
যা পছন্দ করে। তুলে নেবো মোমের মতো কোমল
আলুবোখারা (এজন্য গাছটিও বেশ সম্মানিত বোধ
করবে), তারপর মিষ্টি ঘ্রাণের জন্য লরেলে মিশিয়ে
দেবো কিছুটা মার্টল।
বেচারা করাইডন, তুমি একটা গেঁয়ো চাষা, আলেক্সিস
তোমার সব উপহারকে কোনো পাত্তাই দেয়না, যদি সে
দিত, তবে তো জিতেই যেতেন আইওল্লাস। কী সব
ভাবছিলাম আমি? দখিনা বাতাসকে আমার ফুলগুলোর
ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দিতে, অথবা বুনো শুয়রকে মাড়িয়ে
যেতে আমার একদা-স্বচ্ছ জলের ঝরনা? অপদার্থ, দৌঁড়াচ্ছো
কেন? অজর অমর দেবতারা বাস করেন এই বনে, আর
প্যারিস পালিত ভেড়ার দঙ্গল, পাল্লাস তার সৌধকে
রক্ষা করুন, এই বন যাকে আমি মহামূল্য সম্পদ
জ্ঞান করি। সিংহী শিকার করে নেকড়েকে, সে আবার
শিকার করে পশুশাবকদের, শাবকরা ধাবিত হয় ফুলে
ফুলে ছেয়ে ওঠা গুল্মের দিকে, বন্য প্রেমের টানে
সকলেই মেনে চলে যার যার আনন্দের আদেশ।
দেখো বলদেরা বাড়ির দিকে টেনে চলছে হাল—
যখন ডুবন্ত সূর্যের নিচে ছায়াগুলো দীর্ঘ হতে থাকে।
এমনকি এখনো ভালোবাসা আমাকে কাতর করে
তুলছে। হায়রে করাইডন, কী এক পাগলামি তুমি
মনের ভেতর পুষছ! পাতাময় এলমের ছায়ায় বসে
সারাদিন তুমি কাটিয়েছো অবসর, ফেলে রেখেছো
আধেক ছাটাই করা আঙুলগাছ। কাজে নেমে পড়ো
এখন, বেতগুলোক বুনতে বসো, অথবা যা কিছু
দরকারী, তা-ই করো; যদি এলেক্সি তোমাকে ফিরিয়ে
দেয়, তুমি খুঁজে নেবে অন্য কাউকে, যে তোমার গান শুনতে চায়।
.
হোরেস
থালিয়ারকুসের প্রতি
ওদিকে তাকাও, কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে সরাক্তি পর্বত,
গভীর বরফে ঢাকা কেমন সাদা, এই অরণ্য বইতে
পারছে না তার ভার, দেখো, কেমন চকচক করছে
সমস্ত বন আর নদীরা সব স্থির, নিশ্চল।
বন্ধু থালিয়ারকুস, চলো এই ঠাণ্ডাকে গলিয়ে ফেলি,
উনুনে ছড়িয়ে দিই কাঠের গুঁড়ি,
তোমার উদার হাতে সাবাইন বোতল থেকে
ঢেলে দাও চার বছরের পুরনো মদ।
তোমার সকল দুঃশ্চিন্তাকে সঁপে দাও প্রভুদের হাতে;
তারাই তো বশে আনতে পারেন বন্য সমুদ্রের সাথে
যুদ্ধরত বাতাসকে। মুহূর্তেই নিস্তবদ্ধতা নেমে আসে
সাইপ্রেস আর প্রাচীন অ্যাশের অরণ্যে।
এ-কথা জিজ্ঞেস করো না— কেমন হবে আগামীকাল—
মনে করো সেটুকুই লাভ, যেটুকু ভাগ্য তোমাকে দেবে
আগামী দিনে। এখনো তরুণ তুমি, ভালোবাসাকে
তুচ্ছ ভেবো না, যাও আনন্দ করো, নাচো।
কেননা এখনো তোমার সবুজ যৌবনে স্পর্শ করেনি
নিষ্ঠুর সাদা চুল। আরো একবার উদ্যান তোমার তারুণ্যকে,
টানুক। আরও একটু শূন্য হতে দাও, বিরান হয়ে উঠুক,
তাদের জন্যে এই তো সময় অন্ধকারে ফিসফাস গুঞ্জনের।
এই তো সময়— লুকনো আঁধার থেকে মেয়েটির
খিলখিল হাসি, ছেলেটি জড়িয়ে নেবে তার আঙটি
অথবা কঙ্কন, মেয়েটির কি যে চেষ্টা ছাড়িয়ে নেবার,
অতঃপর ছেলেটিকে তার খেলনা নিয়ে মত্ত হতে দাও।
.
প্রপেরতিয়াস
এলিজি
নসেসের নিঃশেষিত মেয়েটির মতো— শূন্য সৈকতে
অধোমুখে শুয়ে থাকা, যখন পাড়ি দিলেন থেসেউস;
অথবা এন্ড্রোমিডার মতো, যখন সে শুয়েছিল প্রথম নিদ্রায়,
অতঃপর মুক্ত হয়েছিল নির্দয় পাথর থেকে; অথবা থ্রাসিয়ান
বাক্কাস-ভক্তের মতো অবসন্ন, তৃণময় নদীখাতে লুটিয়ে
পড়ার আগ পর্যন্ত যে নেচেছিল অনিঃশেষ; তেমনি
শয্যায় শান্তির নিশ্বাসে ঘুমিয়ে আছে সিন্থিয়া।
মাতাল পায়ে দুলেদুলে টলোমলো এই আমি সেখানে
পৌঁছেছি দেরিতে, আলো হাতে দাঁড়িয়ে ওই ক্রীতদাস
বালক। পা টিপে টিপে আমি তার শয্যার কাছে গেলাম,
(যদিও মাতাল আমি, তবু পুরোপুরি হারিয়ে ফেলি নি
মগজের ধার), কামনা ও সুরা এই দুই প্রবল দেবতা
আমাকে উষ্ণ করে তুললেন, এবং আমাকে নির্দেশ দিলেন,
আলতো করে তাকে বাহুতে তুলে নিতে, হাত নাড়াতে,
চুমু খেতে, তারপর তার দুর্গের দখল নিতে। কিন্তু আমি
চাই নি তার শান্তিভঙ্গ করতে; কেননা আমি তো জানি
কেমন বুনো সে হতে পারে। আমি আঠার মতো ঠাঁয়
দাঁড়িয়ে থাকলাম, একদৃষ্টিতে চোখ রাখলাম— যেমন
আইও’র উদ্ভট শিঙের দিকে তাকিয়েছিলেন আরগুস।
এক সময়, সিন্থিয়া, আমার ললাট থেকে খুলে নিলাম
পাতার মুকুট, পরিয়ে দিলাম তোমার মাথায়, তোমার
খোলা চুলে আঙুল পেঁচিয়ে খেললাম কিছু ক্ষণ, দিলাম
কিছু আপেল, যেগুলো তোমার কোল থেকে গড়িয়ে
পড়ছিল বারবার। কখনো যখন তুমি শ্বাস ফেলছিলে,
অথবা নড়ছিলে, চমকে উঠছিলাম আমি, বোকার মতো
ভাবছিলাম অদ্ভূত আর ভয়ানকস্বপ্ন দেখছিলে তুমি,
যেন কেউ জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তোমাকে।
তোমার জানলার পাশে উঠে এলো চাঁদ, ছড়িয়ে দিলো
তার দীর্ঘায়িত আলো, মিহিন রশ্মিতে খুলে দিল
তোমার চোখের পাতা, সিন্থিয়া কনুইয়ে ভর দিয়ে বলল :
‘শেষ পর্যন্ত তুমি তাহলে আমার কাছে এলে, মুখের
ওপর দরোজা বন্ধ করে তাড়িয়ে দিয়েছে কোনো মেয়ে?
কোথায় তুমি নষ্ট করে এলে সারা রাত, পরিশ্রান্ত হলে?
যা হতে পারত একান্ত আমার? ফিরে এলে রাত্রিশেষের
নিভু নিভু তারায় আলোয়। নিষ্ঠুর তুমি! আমি চাই তোমারও
আসুক এমন রাত, যেমন যন্ত্রণায় আমাকে কাটাতে হয় একা একা!
নিজেকে জাগিয়ে রাখতে কিছুক্ষণ কাপড় বুনলাম, তারপর
ক্লান্ত হয়ে বাজালাম বীণা, গাইলাম কিছুক্ষণ, অভিযোগ
করলাম নিজের কাছেই, আমাকে ছেড়ে গেছো তুমি, সময়
কাটাচ্ছো অন্য কাউকে ভালোবেসে, উড়ে এলো শান্তির ঘুম,
সমাপ্তি ঘটল আমার অশ্রুর, অবসান হলো আমার ব্যথাতুর ভাবনার।’
.
তিবুল্লুস
এলিজি : ১
অন্যেরা ভরে উঠুক সোনালি স্বর্ণে, বিঘায় বিঘায়
জমে উঠুক আবাদী জমি, পাড়াপড়শিরা সব মাতুক
বিবাদে, যুদ্ধের শিঙায় ভাঙুক তাদের ঘুম, কেবল
আমার দারিদ্র্য আমাকে দিক আলসেমিতে ভরা
একটি জীবন, আর আগুনে উজ্জ্বল থাক বাড়ির উনুন।
উঠোনের পাশে পুঁতে দেব কচি কচি আঙুরলতা আর
বড় কিছু ফলের গাছ। আশা করি, সৌভাগ্য আমাকে
যাবে না ছেড়ে; ফলের সম্ভারে ভরে উঠবে ডালি।
তীব্র নতুন মদে টইটম্বুর হয়ে উঠবে সুরার ভা-।
ফুল দেবো পরিত্যাক্ত গাছের গুড়িতে, চৌরাস্তায়
দাঁড়ানো প্রাচীন পাথরে, কেননা শস্যদেবতার থানে
প্রতি বছর আমি আমার নৈবেদ্য দেই প্রথম শস্য।
শোনো হে সোনালি চুলের সেরেস, তোমার মন্দিরে
যেন ঝোলাতে পারি মুকুট। বাগানরক্ষক প্রিয়াপুস,
তোমার বিরাট আঁকশি দিয়ে তাড়িয়ে দাও পাখিদের,
আর তুমি লারেস— গরিব অথচ, একদা যে ছিল
উর্বরতার দেবতা, আমার জন্য বয়ে আনো উপহার।
সেই কবে, একদিন অগুনতি ষাঁড়ের কল্যাণে বলি
দেয়া হতো ছোট্ট বাছুর, আর এখন অনুর্বর মাটির
জন্য দেয়া হয় ছোট্ট একটি ভেড়া। তোমার জন্যেও
লারেস, যূপকাষ্ঠে শায়িত হবে একটি ভেড়া। পাড়ার
ছেলেরা সব চিৎকার করে তোমাকে বলবে, ‘ও লারেস,
আমাদের জন্য নিয়ে এসো প্রচুর শস্য আর ভালো মদ।
কিন্তু আমার জন্য, অল্প নিয়েই আমি তৃপ্ত, প্রয়োজন নেই
দূরত্বে যাবার, জলের স্রোতের পাশে গাছের ছায়ায়
উত্তাপ ছড়াবে যখন ডগস্টার, তখন তা এড়িয়ে যাবো
আমি, লজ্জা পাব না নিড়ানি দিতে, অলস গরুকে ঠেলা
গুঁতা দিতে, অথবা বিব্রত হব না ফেলে যাওয়া ভেড়ার
বাচ্চাকে কোলে করে বাড়ি ফিরতে। চোর আর নেকড়েরা
ছেড়ে দাও আমার পশুর পাল। অন্য কোনো পশুর
দঙ্গল থেকে খুঁজে নাও তোমাদের আহার। আমার
যা কিছু সম্বল তার সবটা যাবে প্রতি বছরেরর নৈবেদ্য
জোগাতে, পালসের জন্য ছড়াতে হবে দুধের ফোঁটা।
আমার পাশে থাকো প্রভু, ছেড়ে যেও না আমার উপহার,
সরে যেও না মাটির পাত্র থেকে। সেই প্রাচীন সময়ে
নিছক কাদায় কৃষকেরা বানাত এইসব মাটির বাসন।
আমি চাই না আমার পিতার সম্পদ, কিংবা চাই না
সেই পুরাকালে শস্য থেকে যেমন পেতেন তারা মুনাফা;
অল্প শস্যেই আমার চলবে, এই তো অধিক, যদি আমি
সাদাসিধা আসনে আরামে গা মেলে দিই; আহা কি
মধুর বউকে বুকে নিয়ে শুয়ে শুয়ে বাতাসের শব্দ শুনতে;
আহা কি আনন্দ, শীতের বাতাসে ঝরে পড়া বৃষ্টির শব্দে
ঘুমাতে। এই তো আমি চাই। অন্যেরা ধনী হোক যে
যার ইচ্ছেমতো। যদি তারা বয়ে আনে তুমুল ঝঞ্ঝা আর
বিক্ষুব্ধ সমুদ্র, আনুক। শিগগিরই ধ্বংস হোক পৃথিবীর
স্বর্ণ ও পান্না, তবু আমার বিদায়ে না কাঁদুক কোনো নারী।
মেসেল্লা, তোমার জন্যে জলেস্থলে যুদ্ধ করা আর
পুরস্কারে ঘর ভরিয়ে তোলা ঠিকই আছে, আমিও আটকে
গেছি, বাধা পড়েছি সুন্দরী নারীর রূপের শেকলে। বসে
আছি তার পাহারাদারের মতো; ডেলিয়া, আমার কাছে
কিছুই নয়, এক উদ্ধত গৌরব; যতোদিন আমি আছি তোমার
পাশাপাশি, লোকেরা যতোই বলুক অকর্মণ্য, উদাসীন।
যখন আমার দুয়ারে কড়া নাড়বে মৃত্যু, তখন তোমার
মুখের দিকে তাকাতে দাও, যখন শিথিল হয়ে উঠবে
আমার বাহু, আমাকে জড়িয়ে নাও শক্ত করে। চিতায়
শোয়াতে দেখে, ডেলিয়া, তুমি তখন কাঁদবে। কান্না
জড়ানো ঠোঁটে চুমু খাবে। তোমার হৃদয় নয় ইস্পাতকঠিন,
অমন কোমল হৃদয়ে নেই কঠিন পাথর। আমার সৎকারে
কে আসবে শুকনো চোখে! ডেলিয়া, আমার আত্মার জন্য
কিছুটা করুণা করো, আলগা করে দাও তোমার ঝকড়া
চুল, আঁচড়ে তুলো না ভরে তোমার ওই কোমল গাল।
চলো তবে নিয়তির ইচ্ছেয় মেতে উঠি প্রেমে, কেননা
অচিরেই আমাদের সম্মুখে দাঁড়াবে এসে অন্ধকারে ঢাকা
মৃত্যু। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে বৃদ্ধ বয়স। তখন
তো শোভন নয়, ভালোবাসা সঙ্গম কামনামদির কথা,
যখন আমাদের চুল একেবারে সাদা। ভেনাসের সঙ্গে
মুসাবিদার এখনই সময়, যখন নির্লজ্জের মতো ভেঙে
ফেলতে পারি বন্ধ দরোজা, মত্ত হতে পারি প্রেমোন্মত্ত
ঝগড়ায়। এক্ষেত্রে আমিই সেনাপতি, আমিই যোদ্ধা।
সরে যাও পতাকা, দূরে যাও তূর্যনিনাদ, লোভীদের জন্য
বয়ে আনো ক্ষত, আমার শস্য নিয়ে আমি নিরাপদে আছি,
উপেক্ষা করেছি ক্ষুধা, উপেক্ষা করেছি সম্পদের বিপুল স্তূপ।