লেনার্ড কোহেন ওয়ান ডোজেন ইন বাংলা । জাহেদ আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:০৬ পূর্বাহ্ণ, | ২৪৯১ বার পঠিত
কোমান্দান্তে এর্নেস্তো গেবারা যে-বছর খুন হলেন লড়াইরত অবস্থায় বোলিভিয়ার জঙ্গলে, খুন হলেন তাদেরই হাতে আজকে যারা দুনিয়া চালাচ্ছে এবং নির্মম পরিহাসের ন্যায় যারা গেবারাকেও কমোডিটি বানিয়েছে তাদের একচেটে ন্যাংটাবাজার অর্থনীতিতে, সেই বছরেই নিজের গান নিয়া হাজির হলেন লেনার্ড কোহেন। সন উনিশশো সাতষট্টি, ‘দি স্যংস্ অফ লেনার্ড কোহেন’ সেই অ্যালবামের নাম।
সময়টা টালমাটাল। গোটা ষাটের দশক জুড়েই পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষেরা চারিদিকে সোচ্চার হচ্ছিল। পশ্চিমে, এবং অবশ্যই পুবেও। পুরনো ক্যুকোন্ ভেঙে বেরিয়ে আসছিল নতুন দিশার দিগন্ত। জন্মাচ্ছিল নতুন নতুন ন্যাশনস্টেইট। সর্বত্র চিন্তায়-চেতনায় স্ট্যাটাস্-ক্যু অপসারণের জোর তৎপরতা চারিদিক থেকে পাচ্ছিল পালে হাওয়া এবং এঞ্জিনে ফ্যুয়েল্। দুনিয়ার যুদ্ধবণিকেরা তাদের ফন্দিফিকির সমেত এক্সপোজড হচ্ছিল দিকে দিকে। দমনপীড়নের মরিয়া চেষ্টা চালু ছিল যদিও বল্গাহারা। সারাটা দুনিয়া জুড়ে রাজনীতিতে, সাহিত্যে, সিনেমায় এবং বিশেষভাবেই সংগীতে একেকটা ঝাঁকুনি দিচ্ছিল সময়ের সেই সংক্রাম।
সময়ের অভিঘাত পড়ছিল শিল্পকলায়, সেই সময়ে, একইভাবে শিল্পকলার ছাপ পড়ছিল সময়ের উপর। সংগীতে এই সময়ের ডক্যুমেন্টেশন্ সবচেয়ে ভালো লক্ষ করা যাবে। সেই সময়কার পপ্যুলার মিউজিকে। সেই সময়কার রক্-ন্-রল্ মিউজিকে। এবং সময়টাকে আন্দোলিত করে তুলতে সংগীতের প্রায়-একচ্ছত্র ভূমিকাও। পশ্চিমে এই সময়ের রক্ মিউজিক লক্ষণীয়। প্রথমদিককার ববি ডিলান প্রমুখ পথিকৃৎদের ফোক্-রক্ অচিরে পুষ্পে-পল্লবে সুশোভিত হয়ে হাজারদুয়ারি রকমিউজিকের মুক্ত-প্রসারিত রূপ পরিগ্রহ করে। লেনার্ড কোহেন সেই ষাটেরই প্রান্তে এসে ক্যারাভ্যানে নিজেকে জুড়ে নিলেন।
গোড়ার ববি ডিলানের পরোক্ষ অনুপ্রেরণায় লেনার্ড শুরু করেছিলেন গানগাওয়া। তারপর গড়িয়েছে ঢের পাথর ও নুড়ি শীর্ষপর্বত থেকে রুক্ষ্ম-ঊষর পৃথিবীর নিচু-উঁচু পথে পথে। লেনার্ড বাঁক নিয়েছেন, ডিলানও; তবে দুইজনের বাঁকবদল লক্ষণীয় দুইভাবে; একজন কমিটেড থেকেছেন শিল্পকলা আর মানুষনিসর্গসভ্যতার প্রতি, অন্যজন তথা ডিলান যতটা কন্ট্রোভার্শাল্ ছিলেন ততটা কমিটেড থাকতে পেরেছেন বলা যাবে না। পাঁচদশকের পরিক্রম শেষে লেনার্ডের কাজ নিয়া আলাপের যে-কোনো উসিলায় এই কথাগুটিকয় প্রারম্ভিকা আকারেই গৃহীত হবার প্রস্তাব রাখতে পারে।
অনুবাদ নয়, নিচে লেনার্ডের একডজন গানের একটা বাংলা অভিজ্ঞতা হাজির করা হলো। পদ্যাভিজ্ঞতা বলা ভালো। কোহেনের লিরিক্স শুনে কিংবা রিটেন্ টেক্সট সামনে রেখে এগুলো পড়লে বেদনায় আর্ত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। কারণ মূলের থোড়াই এখানে প্রেজেন্টেড, সেই দুশ্চেষ্টাও করা হয় নাই বটে। এগুলো বরং তর্জমায় প্রতিসরিত হতে হতে একেকটা বাংলা-কাব্যপ্রথানুগত অভিজ্ঞতাই হয়েছে। এর প্রত্যেকটাই ভিন্ন ভিন্ন হাতে যেয়ে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা আকারেই হাজির হতে পারে।
লেনার্ডের সংগীতমঞ্চে আবির্ভাবসময়টা ষাটের একদম উপান্ত। ওই বছরে এমনকিছু ঘটনা প্রায় গায়ে-গা-ঘেঁষে ঘটছে যা পরবর্তীকালের দুনিয়ায় ব্যাপক প্রভাব রাখবে। এইদিকটায়, আমাদের ভূখণ্ডেও, এই ঝড়ো সময় আছড়ে পড়ছে দিগদিগন্তরে। এবং এমনকি সংগীতেও। গণসংগীত তথা আইপিটিএ এবং অন্যান্য বহু সংগীতানুষঙ্গ গড়ে উঠেছে, এতদঞ্চলে, পুষ্ট হয়েছে এবং অবধারিত অবদান রেখেছে এই আশ্চর্য সময়টাতেই। সিক্সটিজের ন্যায় ইম্প্যাক্টবিস্তারী কালপর্ব, সংগীতে বলি কিংবা রাজনীতিতে এবং প্রথানুগত সমাজরূপান্তরে, পরবর্তী দীর্ঘ ছয়-সাড়েছয় দশকে এখন অব্দি এর সঙ্গে তুলনীয় নজির দেখা যায় নাই। ছিল সময়টা আক্ষরিক অর্থে তা-ই যেইটেকে আমরা আশ্চর্য ও উজ্জ্বল যুগসন্ধিদশক বলতে পারি। প্রতীচ্যে, প্রাচ্যে, সর্বত্র।
ওই বছরে, উনিশশো সাতষট্টি সনে, লেনার্ড কোহেন মঞ্চে এলেন গলায় নিজের গান নিয়ে। একদিকে বব ডিলান এবং অন্যদিকে বিটলস্ তখন তুঙ্গে। তেমনি রলিংস্টোন্স ইত্যাদি গানদল সহস্রধারায় নিজেদের উদ্গীরণ ঘটাতেছে। এরই মধ্যে একদশকের উপরে হয়ে গেছে তখন ডিলান ইংরেজি প্যপমিউজিকটাকে এমন এক বৌদ্ধিক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যা আস্ত দুনিয়ায় ভিন্নকৌণিক গানের দিগন্ত প্রসারে এখনও ভূমিকা রাখছে। লেনার্ড সংগীতজীবী হিশেবে আত্মপ্রকাশের আগে একদশকে ক্যানাডার কবি ও উপন্যাসপ্রণেতা মহলে বেশ পরিচয়প্রতিষ্ঠা হাসিল করে ফেলেছেন। নিউপোর্ট জ্যাজ্ ফেস্টের সাম্বৎসরিক আয়োজনের উনিশশো সাতষট্টি আসরে লেনার্ড নাম লেখালেন গানজীবী হিশেবে, লেনার্ড তখন বছর-তেত্রিশের যুবক, এবং অব্যবহিত পরেই কোলাম্বিয়া থেকে রিলিজ্ হলো কোহেনের পয়লা অ্যালবাম।
শুরু থেকেই ডিলানের প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এসেছেন কোহেন নানান জায়গায় গান গাইবার সূচনাদিনগুলোতে নেপথ্য পথদিশারী হিশেবে। এমনকি নিজের কবিতাবইতেও ববি ডিলানের ঝড়ো ভূমিকা স্মরণে রাখঢাক করেননি মিডিয়োকারদের মতো। যদিও কোহেন শুরু থেকেই স্বতন্ত্র। কবিতায় এবং গানে উভয়ত। ববির গানে যেটুকু ওভারটোন এসেছে, লেনার্ডে একেবারেই তা নাই বললেই চলে। অনেক বেশি মিতবাক, অন্তরালধর্মী, ভিতরের-দিকে-গুটোনো অন্তর্মুখো স্বভাবের কোহেন। অনেক বেশি স্থিতধী। যেমন কণ্ঠে, তেমনি লিরিকে, এবং গায়নশৈলীতেও। অনেক গ্রন্থিল, নবপৌরাণিক, ঘনসংবদ্ধ পঙক্তি তার গানকথাভাগের বৈশিষ্ট্য। প্রথানুবর্তী রিলিজিয়নের রেফ্রেন্সেস্, পুরাণের আখ্যান ও চরিত্রের পরোক্ষ উল্লেখ, সবকিছু ছাপিয়ে সমকালের দুর্বিপাক ও ঝড়ঝঞ্ঝা তার গানের শরীরে দাগ রেখে যায় এক অবাক-করা আন্ডারটোন আর বাকবিভূতির ভিতর দিয়ে। লেনার্ডের গানপ্রতিমা আদৌ রক্-ন্-রল্ আদলের সঙ্গেও অবশেষে মেলানো যায় না। লেনন-ম্যাকার্টনিদের বিটলস্ বা বব ডিলানের নামে যে-যুগ জনসাধারণ্যে খ্যাত, কোহেন সে-যুগের এক সার্বভৌম স্বতন্ত্র দ্বীপ।
সত্তরের দশকে লেনার্ডের গান হয়ে উঠছে আরও স্বরাট, অনুচ্চস্বরের যদিও, স্বগতোক্তিরই মতো। মুখ্যত প্রেমের গানই, কিন্তু রোম্যান্তিক ভাবালুতা নাই সেই প্রেমপ্রকাশক বাকপ্রতিমায়। সেভেন্টিজে এসে একদশক আগেকার মশহুর প্রতিবাদী কৌশল ও সংগীতশৈলী বিকলনের শিকার হয়ে উঠছে সর্বত্র। হতাশা আর হামবড়া ভাবসাবে ছেয়ে যেতেছে পশ্চিমের গানজগৎ। বণিকদের খপ্পরে যাচ্ছে ক্রমশ সবকিছু। শোভিনিস্ট আর্ট এবং আর্টিস্টে মঞ্চ ও ময়দান সয়লাব। ববি স্ট্রিটরেভোল্যুশন্ পর্বটা সাঙ্গ করে তখন ম্যালিব্যুতে প্রমোদপ্রাসাদে বিলাসী জীবনের আয়েশ উপভোগ করছেন; পরে ফিরবেন ঝলমলা ঝালরওয়ালা লেবাসে ডিস্কোড্যান্সারের সুরতে এবং নিজেকে স্রেফ একজন এন্টার্টেইনার হিশেবে ঘোষণা করবেন, শুরু হবে ধর্মকর্মের রহস্যভরা বাকোয়াসিও, যদিও বুদ্ধিদীপ্তির স্যংরাইটার ডিলান নবদীপ্তিই ছড়িয়েছেন এরপরেও। শুধু কন্ট্রোভার্শাল ডিলান উত্তরোত্তর স্ববিরোধীই রয়ে গেছেন বরাবরের মতো। তবু দূরযাত্রার গানকারিগরেরা আঙুলে-গণনীয় হলেও সত্তরে এবং আশিতে নিজেদের কাজটাকে নুইয়ে ফেলেননি; পিঙ্কফ্লয়েড গানদলটার উল্লেখ এখানে অনিবার্য, কোহেন যেমন সমস্ত ডামাডোলের শেষে অবধারিত উল্লেখনীয়।
সম্ভবত কোহেনযুগ নিয়া বাংলায় একটা নাতিদীর্ঘ উপাখ্যান প্রণয়নে একদিন বসবার আঞ্জাম এইবার করা যায়। বিদায় নিলেন লেনার্ড কোহেন। বিরাশি বছরে এসে গ্যুডবাই জানালেন। বিদায়কালে রেখে গেলেন চোদ্দটি স্টুডিয়োঅ্যালবাম, যে-অ্যালবামগুলোর মাধ্যমে ‘স্যুজ্যান্’ বা ‘সো ল্যং ম্যারিয়্যান’ আর ‘ফেইমাস্ ব্লু রেইনকোট’ থেকে শুরু করে ‘সিস্টার্স অফ মার্সি’ কিংবা ‘অ্যাভাল্যাঞ্চ’ বা ‘হালেল্যুইয়্যা’ গানগুলো শ্রোতাগোচরে এসেছে বিগত পাঁচটি দশকের পরম্পরায়।
সিঙ্গার, স্যংরাইটার এবং মিউজিক কম্পোজার হিশেবে লেনার্ড কোহেন সংগীতশ্রোতার সপ্রেম সমীহ কুড়িয়েছেন জীবনের অন্তিম বছর পর্যন্ত। শুরু হয়েছিল ‘স্যংস্ অফ লেনার্ড কোহেন’ অ্যালবাম দিয়ে, ১৯৬৭ সনে, এরপর একে একে ‘স্যংস্ ফ্রম্ অ্যা রুম্’ এবং ‘স্যংস্ অফ ল্যভ অ্যান্ড হেইট’ অ্যালবামগুলো মুক্তি পায় ষাটের দশকসীমার পরিসরেই। ডিলান তখন তুঙ্গস্পর্শী মিউজিশিয়্যান্ হিশেবে স্টেজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। এরই ভিতরে ক্যানাডিয়ান এই শিল্পীর আবির্ভাব মিউজিকের বিশ্বমঞ্চে।
লেনার্ড কোহেন ১৯৩৪ সনে ক্যানাডার ক্যুয়েবেকে জন্মগ্রহণ করেন। বব ডিলানের চেয়ে বয়সে বছর-ছয়েকের বড়, জন লেননের চেয়ে বছর-পাঁচেকের, একটু বেশি বয়সেই শুরু করেন গানের ক্যারিয়ার। যদিও সম্পূর্ণ পৃথক কোহেনের গানের সাউন্ডস্কেইপ, অভাবিত জটিল বুনটসম্পন্ন তার লিরিকের কথাভাগ, তবু ববি ডি-র পরোক্ষ অনুপ্রেরণায় তিনি গিটার আঁকড়ে গাইতে বেরিয়েছিলেন উত্তাল সেই গানের দশকে, এই স্বীকারোক্তিটি কোহেন বিভিন্ন সময়ে করেছেন। মৃত্যুর দিন-পনেরো আগেও ববি-র নোবেল অর্জনের খবরে নিজের আনন্দ প্রকাশ করে এবং ডিলানকে সম্মান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।
সম্ভবত কোহেন বিরল সৌভাগ্যের এক শিল্পী যিনি মিউজিকের বিনোদনজীবিতার বাইরে থেকেও শ্রোতাদের প্রেম ও শ্রদ্ধা আদায় করে গেছেন জীবনের শেষ দিন তক। বিরল তিনি আরও একটা দিক থেকে, সেইটে এ-ই যে, বিরাশিতে এসেও যিনি নিজের নতুন গান গেয়ে বিদায় নিয়েছেন সবাইকে প্রেম জানিয়ে এবং সবার টুপিমুক্ত শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা কুড়িয়ে।
কোহেনের শুরু হয়েছিল কবিতাবই প্রকাশের মাধ্যমে। কবিতাবই বেরিয়েছে এর পরেও অবশ্য। উপন্যাস বেরিয়েছে। লেনার্ডের কবিতা ও উপন্যাস ক্যানাডার পাঠকের প্রেম পেয়েছে, সর্বোচ্চ সম্মানের পুরস্কারগুলোও লভেছে লেনার্ডের অক্ষরমাধ্যমে মুদ্রিত সাহিত্যকর্ম। কোহেনের গানের টেক্সট প্রত্যেকটাই কবিতা। ডিলানের গানে যে ব্যাপক প্রগলভতা পাওয়া যায়, সেসবের একদম উল্টো কোহেনগান। বেশিরভাগ সময়ে একটা গানকে অ্যাপ্রিশিয়েট করতে যেয়ে যেমন কথার বার্তা হিশেবে আমরা বলে থাকি যে গানটা কবিতা হয়েছে, লেনার্ডের গানের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তা না আদৌ। কবিতা করতে যেয়ে গানের দাবি অগ্রাহ্য করেননি তিনি, কিংবা গান করতে যেয়ে কবিতাগুণের সঙ্গেও কোহেনকে আপোস করতে হয়নি, মিতকথনের এবং ইঙ্গিতের-জাল-বিছানো অন্তরালবৈশিষ্ট্যের বৈভব বহন করছে লেনার্ড কোহেনের আজীবনের প্রত্যেকটা লাইন প্রত্যেকটা গানসংকলন।
অক্টোবরেই রিলিজ হলো কোহেনের ফোর্টিন্থ অ্যালবাম ‘য়্যু ওয়ান্ট ইট ডার্কার’, নভেম্বরেই চলে গেলেন শিল্পী। বিরাশি বছর বয়সে এই প্রস্থান নিয়ে বিশ্বজোড়া তার শ্রোতা ও সংগীতসমুজদারদের আক্ষেপ থাকলেও কোহেন নিজে কিন্তু কথাবার্তায় হৃষ্টচিত্তে সমাপনী কর্তব্য সমাধা করছিলেন অনেক দিন ধরেই। ২০১৪ সনে ‘পপ্যুলার প্রোব্লেমস’ অ্যালবাম রিলিজের পরে বেশকিছু জায়গায় ইন্টার্ভিয়্যু দিতে যেয়ে নিজের কর্তব্য সম্পন্ন হয়েছে বলছিলেন। ২০১৬ সনের অক্টোবরে শেষ অ্যালবাম মুক্তির লগ্নে তো বলেই ফেললেন, “আই অ্যাম্ রেডি টু ডাই। আই হোপ ইট’স্ নট টুয়্যু আনকমফোর্টেবল। দ্যাট’স্ অ্যাবাউট ইট ফর মি।” ঠিক পরেই অবশ্য অন্যত্র দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবার অভীপ্সাও প্রকাশ করেছেন, বলেছেন যে ওই মৃত্যুপ্রস্তুতির কথাগুলো ‘একটু বাড়িয়েই বলা হয়ে গেছে’, বলেছেন, “আই হ্যাভ অলোয়েজ্ বিন্ ইন্টু সেল্ফ-ড্রামাটাইজেশন।” কথাগুলো বলছিলেন তিনি মৃত্যুর কিছুকাল আগে, এবং বলছিলেন, “আই ইন্টেন্ড টু লিভ ফরেভার।”
বিদায় নিলেন লেনার্ড কোহেন। বিংশ শতকে আবির্ভূত অসামান্য প্রতিভাধর এই শিল্পীর জীবনাবসান হলো গত ৭ অক্টোবর, সন ২০১৬, যদিও অফিশিয়্যালি ডিক্লেয়ার করা হয়েছে মৃত্যুর দিন-তিনেক বাদে লেনার্ডতনয় অ্যাডাম কোহেনের বরাত দিয়ে। অ্যাডাম কোহেন ‘য়্যু ওয়ান্ট ইট ডার্কার’ অ্যালবামেরও প্রোডিউস্যর। লেনার্ড কোহেনের ফেসবুক পেইজে অ্যাডামের ঘোষণা থেকেই বিশ্ববাসী জানতে পারে যে লেনার্ড লস্-অ্যাঞ্জেলেসে তার নিজ বাসভূমে শেষ নিঃশ্বাসটি নিয়েছেন পরম শান্তিতে।
এই নিবন্ধিকা ড্রাফ্ট্ করার সময় লেনার্ডের অন্তিম অ্যালবামের গানগুলো ঘুরে দেখতে যেয়ে মনে পড়ছিল অকালপ্রয়াত সঞ্জীব চৌধুরীর জীবদ্দশায় রিলিজড শেষ অ্যালবাম। সম্ভবত ‘জোছনাবিহার’ সেই অ্যালবামের নাম। দুইটা অ্যালবামই শিল্পীদ্বয়ের মৃত্যুর মাসদিন আগে রিলিজড; দুই শিল্পীই নিজেদের শেষ সংকলনে মৃত্যুমুখরিত। সঞ্জীব একটু রোম্যান্টিসাইজড মৃত্যুপ্রসঙ্গে, একটু অভিমানী; কিন্তু কোহেন অনেক বেশি প্রিপেয়ার্ড, সম্পূর্ণ প্রস্তুত; অবশ্য পরিণত বয়সেই প্রস্থান তার; এবং মৃত্যু প্রসঙ্গটা নানান অনুষঙ্গ ধরে লেনার্ডের গানে আগাগোড়া আছে দেখা যায়, শেষ অ্যালবাম ‘য়্যু ওয়ান্ট ইট ডার্কার’ পর্যায়ে এসে সেই বৃত্ত সর্বাঙ্গপূর্ণ হয়েছে, যেমন দেখা যায় রবীন্দ্রনাথে; প্রেম এবং মৃত্যু, ঈশ্বর এবং নিরীশ্বর, ঐহিকতা আর পারলৌকিক প্রত্যয়ের এক অবিনাশী বিনির্মাণ রবীন্দ্রনাথেরই ন্যায় লেনার্ডের গানে সুলভ সবসময়। এইসব নিয়া আলাপে ফের প্রবৃত্ত হওয়া যাবে হয়তো কোনোদিন। তখন অশীতিপর বয়সে এসে এই বাগগেয়কারের মঞ্চপরিবেশনা ইউটিউবে দেখাশোনার অনুভূতি কিছু প্রকাশ করা যায় কি না চেষ্টা থাকবে।
এবং এই ইন্ট্রোডাক্টোরি নিবন্ধে লেনার্ডপ্রাসঙ্গিক একটা রচনা পাঠের স্মৃতি স্বীকার করা যাক। সম্ভবত রচনাটা বাংলায় এখন পর্যন্ত অপ্রতিহত এবং সম্ভবত সর্বপ্রথম কোহেনবিষয়ক লিখিত রচনা; বাংলা ভাষায়। ‘আলখাল্লা’ নামে একটা বইয়ের শেষ রচনা ‘কহেন কবি কোহেন’, বইটার এবং সুবিস্তৃত রচনাটার লেখক কবীর সুমন। বইটা ভারতের ‘সপ্তর্ষি প্রকাশন’ থেকে ছেপে বেরোনো, ২০০১ সনে, যদিও প্রথম প্রকাশ ১৯৯৭ সনে; এরও আগে এইটা ভারতীয় সাময়িকী ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কোহেন নামটার সঙ্গে এই নিবন্ধকারের করমর্দন তখন এবং এই রচনারই মধ্যস্থতায়। এরপরে একটাই স্মৃতি আছে বাংলায়; সেই স্মৃতি অবশ্য বাংলাদেশের একটি লিটলম্যাগদৌত্যে লভিত। ‘মাঞ্জাসুতা’ নামে এক পত্রিকায় লেনার্ডের গোটাপাঁচেক গানের অনুবাদ গ্রথিত হয়েছিল তরুণ কোনো কবির হাতে; সেই পত্রিকা কিংবা সেই বই কোনোটাই আজ আর সংগ্রহে নাই, কিন্তু মনে আছে যে পত্রিকাটা ঢাকার মিরপুর সাড়ে-এগারো থেকে ২০০৩/’০৪ নাগাদ প্রকাশিত; তখনও বর্তমান নিবন্ধকারের জানা ছিল না যে সাড়ে-এগারো ভগ্নাংশসূচক একটা অ্যারিয়া ঢাকার মিরপুরে সত্যি সত্যি বিরাজে; এই কারণে হয়তো, উয়্যিয়ার্ড মনে হওয়ায়, পত্রিকাতথ্য মনে আছে আজও। কোহেনের মৃত্যুর পরে বাংলাদেশী নিউজপেপারগুলোতে উইকিচোথা কাটিং-পেস্টিং ফিচার ছাপাতে দেখা গেছে, যেখানে নেই ফিচার-কন্ট্রিবিউটরের নিজস্ব বোঝাপড়াটুকু। কবীর সুমনের বইটার পিডিএফ অবশ্য পাওয়া যায়। এবং ইউটিউবে পাওয়া যায় লেনার্ড কোহেনের সমস্ত গানের অডিয়ো এবং ভিডিয়ো, এমপিথ্রি ইত্যাদি নানান ফর্ম্যাটে, সুলভ হরেক প্রকারের ভার্শনও।
অনুবাদ নয়, নিচে লেনার্ডের একডজন গানের একটা বাংলা অভিজ্ঞতা হাজির করা হলো। পদ্যাভিজ্ঞতা বলা ভালো। কোহেনের লিরিক্স শুনে কিংবা রিটেন্ টেক্সট সামনে রেখে এগুলো পড়লে বেদনায় আর্ত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। কারণ মূলের থোড়াই এখানে প্রেজেন্টেড, সেই দুশ্চেষ্টাও করা হয় নাই বটে। এগুলো বরং তর্জমায় প্রতিসরিত হতে হতে একেকটা বাংলা-কাব্যপ্রথানুগত অভিজ্ঞতাই হয়েছে। এর প্রত্যেকটাই ভিন্ন ভিন্ন হাতে যেয়ে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা আকারেই হাজির হতে পারে। সেই ভিন্নাভিজ্ঞতা আস্বাদনের ব্যাপারটা মাথায় রেখে এগুলোর পাঠকমাত্রেই ভিন্ন কোণ ও তল থেকে ভ্যারিয়েশন্ নিয়া আসতে অনুবাদোদ্যোগী হবেন আশা করা যায়।
লেনার্ড কোহেন ।। ১২টা গান ।। ভূমিকাভাষ্য ও তর্জমা : জাহেদ আহমদ
লালাবাই
ঘুমাও সোনা ঘুমাও
দিন হলো অবসান
গাছের পাতারা গায়
ঘুমপাড়ানিয়া গান
তোমার জখমি দিল্
জিগাই না কেন ম্লান
উজাগর রজনীতে
গাইছি ঘুমের গান
শিয়রে নেভাই দীপ
এই নাও ঘুমটিপ
ইন্দুরে খায় বিস্কুট
বিড়ালেও পায় ভাগ
খেয়েদেয়ে দুইজনে
প্রকাশিছে অনুরাগ
তোমার জখমি দিল্
জিগাই না কেন ম্লান
উজাগর রজনীতে
গাইছি ঘুমের গান
শিয়রে নেভাই দীপ
এই নাও ঘুমটিপ
ঘুমাও জানু ঘুমাও
ভোর হয়ে এল বলে
বাতাসে গাছের শাখা
খুনসুটি করে চলে
তোমার জখমি দিল্
জিগাই না কেন ম্লান
উজাগর রজনীতে
গাইছি ঘুমের গান
শিয়রে নেভাই দীপ
এই নাও ঘুমটিপ
মাই ও মাই
একনিঃশ্বাসে বেসে গেছি ভালো তোমারে
একদম অনায়াসে বেসে গেছি ভালো
রহিলে না আরও কিছুক্ষণ ভবপারে
দেবদারু হায় হাসিঝর্ণার আলো
কত কতদিন ডাকিয়া দিয়াছি রিকশা
জানতে চাইনি কোথা যাও কোন দেশে
একটুকু যদি দেখাতাম হৃদিদশা
হায় দেবদারু বুঝে নিত পরিশেষে
ছেলেছোকরার প্রণয়ের ইশারায়
নিত্য তোমার উচ্ছ্বল দিনগুলো
বলতে পারিনি কী ভীষণ যাতনায়
দেবদারু অয়ি হৃদিশিমুলের তুলো
একনিঃশ্বাসে বেসে গেছি ভালো তোমারে
একদম অনায়াসে বেসে গেছি ভালো
রহিলে না আরও কিছুক্ষণ ভবপারে
দেবদারু অয়ি হাসিঝর্ণার আলো
উইন্টার লেডি
ভবঘুরে মেয়ে একটু জিরায়া যাও
রজনীর মতো এখানে তাঁবু খাটাও
দুজনার মাঝে স্টেশনের হৈচৈ
দেখছি তোমাকে যদিও অচেনা হই
ছিলাম সঙ্গী হিম বরফের পুৎলার
যুদ্ধ করেছি দীর্ঘ দিবস ও রজনী
নিরেট আবেগে শত্রু করেছি সংহার
অঝোর রাত্রে বেজেছে বেদম বরফের খঞ্জনি
শীতমানবীর চুল ছিল বেণী-দোলা
আয়েশী নিদ্রাপ্রাক্কালে শুধু খোলা
তার চুলে বোনা মিহি মখমলতাঁত
কুয়াশার ধোঁয়া মাখানো এবং কবোষ্ণ সুপ্রভাত
চুপচাপ কেন রয়েছ দাঁড়ায়ে মেয়ে
একাকী নিঝুম রেলগুমটির ফটকে?
এ ভ্রমণ তুমি নিজেই নিয়েছ চেয়ে
স্বেচ্ছায় নেমে এসেছ বৈরী সড়কে
ভবঘুরে মেয়ে একটু জিরায়া যাও
রজনীর মতো এখানে তাঁবু খাটাও
দুজনার মাঝে স্টেশনের হৈচৈ
নিশ্চয় আমি তোমার প্রেমিক নই
বার্ড অন্ দ্য ওয়্যার
রাস্তাকিনারে কারেন্টতারে যেমন করিয়া পাখি
কিংবা মাতাল স্খলিত গলায় চিল্লায় হাঁকডাকি
শৃঙ্খলভাঙা স্বাধীন জীবন লভিবারে এই লড়াই
যেমতি কীটের চলাফেরা তার সীমায়িত অঞ্চলে
যেমন গ্রন্থে বর্ণিত রাজা বাঁচে পাঠকের বলে
তেমনি করিয়া আমি চিরদিন তোমারে দেখিয়া যাই।
নির্দয় আমি হতে পারব না তোমার ব্যাপারে প্রিয়
তোমার হৃদয়হীনতা আমার নিকটে মার্জনীয়।
দুনিয়ার সেরা মিথ্যুক আমি হতে পারি হয়তোবা
তোমার সঙ্গে একবর্ণও নয় মিথ্যের প্রভা।
যেমন করিয়া প্রসূতির পেটে ভ্রূণোত্তীর্ণ শিশু
নতুন-গজানো শিঙের তেজে যেমতি অবলা পশু
তেমনি আমিও ছিন্ন করেছি যা-কিছু নাগালহীন
খোদার কসম প্রিয়তমা শোনো সুরের দোহাই বলি
জীবনে বেজায় ভুল করে এথা এসেছি তোমার গলি
দীনে যদি করো দয়া জানেমন শুধরাবো প্রতিদিন।
দেখিয়াছি এক নুলো ভিখিরির কাঠের পায়ের জোর
বলেছে আমাকে, “তুমি তো মির্জা আজীবন ভরপুর।”
দেখেছি আরেক মধুরা মানবী সেগুনকাঠের দরোজায়
চিৎকারস্বরে বলিছে আমারে, “কান্দিলে দুধ পায়।”
রাস্তাকিনারে কারেন্টতারে যেমন করিয়া পাখি
কিংবা মাতাল স্খলিত গলায় চিল্লায় হাঁকডাকি
শৃঙ্খলভাঙা স্বাধীন জীবন লভিবারে এই লড়াই …
সো লং ম্যারিয়্যান্
জানালায় আসো সোনামন আসো ঝর্ণার দিবালোকে
মেলে দাও দুইহাত বিস্তৃত পড়ব হাতের রেখা
আগের জন্মে বেদেজীবী ছিনু হস্তরেখায় ঝুঁকে
হেরিয়া তোমারে হইলাম প্রিয় জনতার ভিড়ে একা
তারপর থেকে ম্যারিয়্যান্ এসে ডেকে নিয়ে গেলে আমারে
তোমার হৃদয়বাড়িতে বেড়াই চিরসুখী প্রীতিবাহারে
বেসেছি তোমারে ভালো ম্যারিয়্যান্ চিরজনমের তরে
বেদনা ভুলিতে যেয়ে ঠেকিয়াছি নিরনুভূতির চরে
গেছি দ্যাখো ভুলে প্রেমে মশগুল আল্লানবিরও নাম
নতিজা হিশেবে ফেরেশতাদের অভিশাপ লভিলাম
আফসোস নাই জেনো ম্যারিয়্যান্ তোমারে বেসেছি ভালো
শতজনমের পুণ্য আমার পরাপার্থিবা আলো
অরুণ বরুণ তরুণবেলায় আমরা মিলেছি দোঁহে
ঘন ও গভীর কাঁটানটেঝোপে চিরসবুজের মোহে
ঠেস দিয়া তুমি ছিলে ঠায় বসে খাম্বার মতো আমারে
দেহলীন দোঁহে কেলি করে গেছি সান্ধ্য অন্ধকারে
খেদ নাই মনে জেনো ম্যারিয়্যান্ লভেছি তোমার প্রেম
গতজনমেও তোমার লাগিয়া রাজ্যি ছেড়েছিলেম
তোমার প্রেরিত পত্রে লিখেছ চিরদিনই তুমি আমার
পাশে আছো তবু কেন মনে হয় মিছে এই ভবসংসার?
দ্যাখো ম্যারিয়্যান্ দাঁড়িয়েছি এসে চিলেকোঠাকার্নিশে
যেতে নাহি দ্যায় আমারে তবুও তোমারই প্রণয়বিষে
যেতে নাহি চাই তবু কেন হায় ছেড়ে যেতে হয় তোমারে
ম্যারিয়্যান্ শোনো ধরে রাখো মোরে আদরের সংসারে
এক্ষণে নয় কিচ্ছুটি চাই লিলুয়া আদর তোমার
পড়ে আছি আমি হিম খোলা ছাদে দলামোচা এক জোকার
ছেড়ে গেছ তুমি চিরায়ত ঘোর সন্দেহবশে আমারে
একশতবার ফিরে আসি ভালো তোমারেই বাসিবারে
ম্যারিয়্যান্ শোনো ঝুলনসখা হে আমরা অমর সঙ্গী
ঈশ্বর-আল্লা জানেন আমাদের প্রেমের সকল ভঙ্গি
বিস্তর দিন পেরিয়েও তুমি প্রথম দিনের মতো
সুন্দর তব অঙ্গদখানি হৃদয় সমুন্নত
উঠেছি পাহাড়ে লাফ দেবো বলে নিম্নে উতলা সাগর
কোথা হতে মেঘ দিয়ে গেল মুছে ব্যথাবেদনার আখর
ম্যারিয়্যান্ এসো ‘নবসংসার পাতি গে আবার চলো’
ঝগড়া-আদরে হাসি-কান্নায় নিরবধি টলোমলো
হেই, দ্যাট্’স্ নো ওয়ে টু স্যে গ্যুডবাই
এই তো সদ্য ঘুমভাঙা ভোরে খেয়েছি তোমারে চুমু
চুলের গোছায় ছাওয়া বালিশের ঠোঁটদুটো ঘুমু-ঘুমু
পয়লা তো নই আমাদেরও আগে প্রেম করিয়াছে অনেকে
গঞ্জে ও গাঁয়ে নগরান্তরে কাঁদিয়াছে প্রেমে ঠেকে
এই তো সময় প্রিয়তমা আসো করি প্রেম দোঁহে পুনরায়
বলো না বিদায় বিধুর বালিকা যেতে নাহি দিব তোমায়
পেয়েছি জীবনে তোমারে তাই তো খুঁজি না কাউরে আর
তোমার সঙ্গে হেঁটে বেড়ালেও ওঠে নৃত্যের ঝঙ্কার
তুমি চলে গেলে প্রেমহারা আমি ফিরে এলে ফের চনমন
সাগরের তীরে আসে-যায় যথা বালু ও স্রোতের স্পন্দন
কথা বলে কালক্ষেপণ করো না আমার দুচোখে প্রেম পায়
বিদায় চেয়ো না ভালোবাসিবার মাঝখানে এই ঘণ্টায়
এই তো সদ্য ঘুমভাঙা ভোরে খেয়েছি তোমারে চুমু
চুলের গোছায় ছাওয়া বালিশের ঠোঁটদুটো ঘুমু-ঘুমু
পয়লা তো নই আমাদেরও আগে প্রেম করিয়াছে অনেকে
গঞ্জে ও গাঁয়ে নগরান্তরে কাঁদিয়াছে প্রেমে ঠেকে
কথা বলে কালক্ষেপণ করো না আমার দুচোখে প্রেম পায়
বলো না বিদায় বিধুর বালিকা যেতে নাহি দিব তোমায়
এভ্রিবাডি নৌজ্
সকলেই জানে পাশাখেলোয়াড়ই শুদ্ধ
তুড়ির আওয়াজে সকলেই দোল খায়
সকলেই জানে শেষ হয়ে গেছে যুদ্ধ
ভালো লোকগুলো অকালে অক্কা পায়
সকলেই জানে এই লড়াইয়ের ফল
কোটিপতি যাবে শিখরে এবং গরিবেরা রসাতল
চলছে এই-তো দুনিয়াটা আগুপিছু
সকলেই জানে সকলের সবকিছু
সকলেই জানে জাহাজের তলা ফুটো
সকলেই জানে ঝুট বলিতেছে কাপ্তান
সকলেই ঠিক অসহায় খড়কুটো
শোকে মূর্ছিত সকলেই যেন স্বজনখোয়ানো প্রাণ
সকলেই রাখে পরিপাটি তার পকেট
সকলেই চায় বাকশোভরতি চকোলেট
এবং সঙ্গে একটি গোলাপ প্রত্যেকে মাথাপিছু
সকলেই জানে সকলের সবকিছু
সকলেই জানে বাসো তুমি ভালো আমারেই
সকলেই জানে সত্যিই ভালোবাসা
সকলেই জানে কানু বিনে কোনো রাধা নেই
ভিন্ন রতির রাতশেষে কাছে আসা
সকলেই জানে সতর্ক তুমি বরাবর
অনেকে এসেছে এবং গিয়েছে সকাতর
তোমার জীবনে গোপনীয় বহু ক্ষণ
সকলেরই থাকে এহেন অনেক নগ্ন ও নির্জন
সকলেই জানে এন্তার উঁচুনিচু
চলছে এভাবে দুনিয়াটা আগুপিছু
সকলেই জানে সকলের সবকিছু
সকলেই জানে এখনই অথবা জিন্দিগিতেও নয়
সকলেই জানে এর দায়ভার আমার অথবা তোমার
সকলেই জানে তুমি চিরজীবী চিরমৃত্যুঞ্জয়
একটা-দুইটা বাক্য রচিয়া কালের ঘোড়সওয়ার
সকলেই জানে যত মোটাসোটা ফালতু প্রতিশ্রুতি
লেসফিতাওলা লোকটা খুঁটিছে একমনে তার পুঁতি
তোমার জামায় খচিতে কিংবা সাজাতে তোমার কেশ
সকলেই জানে এই বিনিসুতো সত্যটা শেষমেশ
সকলেই জানে মড়ক আসিছে ধেয়ে
সকলেই জানে কেয়ামত ধাবমান
সকলেই জানে নাঙ্গা আদম ও হাওয়ায়
প্রাগিতিহাসেরই বিজুলি-উজলা গান
সকলেই জানে এইখানে আর পাপ বলে কিছু নাই
কিন্তু তোমারই শিয়রে একটা পাপঘড়ি পেয়ে যাই
সেই ঘড়িপাঠে এইটুকু যায় বোঝা
কার কতটুকু প্রকাশ্য দিবালোকের মতন সোজা
সকলেই জানে আছো তুমি যাঁতাকলে
সকলেই জানে এসেছ কতটা ক্লেশে
এতদূরে এই নিধর্ম জঙ্গলে
এসেছ কতটা ধার্মিক ফাঁদে ফেঁসে
সকলেই জানে আসিছে সে চুপিসারে
এই-না গায়েবি হৃদয়েরে দেখিবারে
একটি নিমেষ যদি তারে দেখা যায়
সকলেই জানে দোলাচল তার দেখা-আর-অদেখায়
সকলেই জানে এন্তার উঁচুনিচু
চলছে এভাবে দুনিয়াটা আগুপিছু
সকলেই জানে সকলের সবকিছু
জানে সকলেই বিস্তর উঁচুনিচু
চলছে এই-তো দুনিয়াটা আগুপিছু
সকলেই জানে সকলের সবকিছু
সকলেই জানে সকলের সবকিছু
আ’য়াম ইয়োর ম্যান
যদি চাও প্রণয়নিষ্ঠ প্রেমিক
চাহিবামাত্র পাবে এই বান্দারে
যদি চাও প্রণয়কৃত্য খানিক ভিন্নতর
অচেনা মুখোশ পরে নেব আন্ধারে
যদি চাও সঙ্গীটি চিরনির্ভর
ধরো হাত এসো এক্ষুণি অতিসত্বর
ক্রোধ প্রশমনে পদদলিবারে প্রয়োজন যদি হয়
দাঁড়িয়ে রয়েছি এই-তো তোমার সমুখেই নির্ভয়
আমিই পুরুষ তোমার
যদি চাও মুষ্টিযোদ্ধা ডাকাবুকো এক বক্সার
সোজা খাড়াইব প্রতিযোগিতার মঞ্চে
যদি চাও রোগসারানিয়া আস্থাযোগ্য ডক্টার
চোখতল্লাশি চালাব তোমার অতল দেহপ্রপঞ্চে
যদি চাও শকটচালক সুলভ চলনসই
বিলম্ব নয় আরোহণে একটুও
অথবা চাইছ সন্ধ্যাভ্রমণে কেবলই সঙ্গী হই
নিশ্চয় জেনো তোমাতেই নিয়োজিত
আমিই নাগর তোমার
দ্যাখো ঝলসানো ওই পূর্ণিমাচাঁদ রুটির মাফিক গোল
গলায় আমার চেপে আছে দ্যাখো গোলামির শৃঙ্খল
ঘুমাইতে যেতে চাইছে না দ্যাখো শরীরের জন্তুটা
ব্যাপক কথার না-রাখা ব্যথায় হৃদয় আমার টোটা
এ-জগতে হায় ফেরানো যায় না নারী আর নদীটিরে
একপায়ে ঠাঁয় দাঁড়ায়ে কিংবা হাঁটু গেঁড়ে অনুনয়ে
কেঁদেও পারেনি ফিরাইতে কভু অহল্যা প্রেয়সীরে
একটি পুরুষও সফল হয়নি বিরাগধস্ত প্রণয়িনীমন জয়ে
দ্যাখো সোনা আমি তোমার লাগিয়া হামাগুড়ি দিবো ভূঁয়ে
লুটাইয়া র’ব তোমারই চরণকমলে
এবং গাহিব হাহাজারিগীতি তোমার নামটি লয়ে
নেড়িকুত্তাটা কাঁদে যেইধারা ভাদ্দুরে কুয়োতলে
এবং বসাইব থাবা তোমার হৃদয়পিণ্ডে
এবং তোমার পদতল চেটে কুড়াব লোকের নিন্দে
এবং বলিব পুনঃপুনঃ ওগো দয়া দাও দয়াময়ী
পুরুষ বলো বা নাগর যা-হোক আমিই তোমার প্রণয়ী
পথে যেতে যেতে নিঁদ যদি নামে তোমার দু-চোখে ঝেঁপে
পেতে দেবো কাঁধ ঘুমাবার তরে একান্ত সংক্ষেপে
যেতে চাও যদি বিজন সড়কে একা একা গান গেয়ে
একনিমেষেই অদৃশ্য হব তোমার ইশারা পেয়ে
শিশুর জননী হইবারে যদি কোনোদিন সাধ হয়
খানিকটা যদি নদীর হাওয়ায় কাটাইতে চাও সন্ধ্যা
আমিই তোমার শিশুটির হব জনকের পরিচয়
সাক্ষী সুরমা সাক্ষী তিতাস করতোয়া মহানন্দা
যদি চাও কভু প্রণয়নিষ্ঠ প্রেমিক
চাহিবামাত্র পাবে এই বান্দারে
যদি চাও ওগো প্রণয়কৃত্য খানিক ভিন্নতর
অচেনা মুখোশ পরে নেব আন্ধারে
স্যুজ্যান
স্যুজ্যান তোমারে নিয়া যাবে তার বাড়িটিতে সমাদরে
যেখানে নদীর নৌকোধ্বনি ও দৃশ্যের জানালায়
মুখোমুখি বসে পাশাপাশি শুয়ে রজনী পোহাবে ভোরে
এবং জানিবে মেয়েটা খানিক ক্ষ্যাপা বাউলিনীপ্রায়
কিন্তু তোমারে করিবে দিওয়ানা ক্ষ্যাপামি দিয়াই তার
আদরে আদরে রাত্রিচাদরে রাখিবে তোমারে ঢেকে
খাওয়াবে কমলালেবুর পুষ্টি পিঠেপুলিসম্ভার
নিজহাতে চা-ও বানায়ে খাওয়াবে চৈনিক ঘ্রাণ রেখে
এবং যখনই কথাটা পাড়তে ছুঁতে যাবে তার থুতনি
কিছুই তোমার দিবার মতন নাই তারে বিনিময়ে
অধরে-ওষ্ঠে অঙ্গুলি চেপে ধরিবে সে খঞ্জনি
ইশারায় শুধু বলিবে তুমিই প্রেমিক নিঃসংশয়ে
পাড়ি দিতে চাও বহুদূর পথ তুমি তার হাত ধরে
যেখানেই নিয়া যায় সে তোমারে সেখানেই যাবে তুমি
নিশ্চয় তার আস্থা লভিলে বাহিরে ও অন্দরে
দেহের দারুণ দাবিদাওয়াগুলো খুঁজে নেবে মনোভূমি
কোনকালে সেই সাতসাগরের নাবিক দয়াল যিসাস্
পয়দলে তিনি পেরিয়েছিলেন উতরোল ভবসিন্ধু
বহুকাল তার কেটেছে একাকী খিড়কিতে চেপে শ্বাস
উপকূলে এক কাঠের কুটিরে দেখিয়া দূরের বিন্দু
এবং যখনই জেনেছেন তিনি এ-কথা সুনিশ্চিত
জলে ডুবন্ত মানুষেরা শুধু দেখিবারে পাবে তারে
বলেছেন তিনি মৃদু ঘোষণায় “নাবিকী জীবনই বিহিত
হতে পারে এই বিপন্নতায় ভুবনের পারাবারে”
কিন্তু উনি তো নিজেই ছিলেন বেদনার সন্তান
কণ্টকে বেঁধা আর্ত পরান উর্ধ্বারোহণের আগে
বেজায় তাহার স্বজনবিরহ অসহ অসম্মান
ডুবেছেন তিনি অন্তিমে একা মানুষের অনুরাগে
তারই সনে তুমি অনেকেরই ন্যায় দিতে চাও ভব পাড়ি
তিনি দয়াময় যেখানে নেবেন যেতে রাজি সেইখানে
সংশয় ঝেড়ে রহিবে মগন প্রভুপ্রেমে ভোলা আনাড়ি
তিনিও তোমারে ভেবেছ নিকটে ডাকিবেন সখাজ্ঞানে
এইবেলা দ্যাখো স্যুজ্যানের হাতে জুটেছে তোমার আশ্রয়
নিয়া যায় দ্যাখো শুশ্রূষা দিতে তোমারে নদীর কিনার
পরিধানে তার পশমিনা শাল বর্ণিল জামা বাঙময়
নির্বাণ নয় আছে পরিত্রাণ কাছাকাছি গেলে তার
প্রখর রৌদ্র রহি রহি ঝরে মধুবিন্দুর মতন
প্রশস্ত নীল জলরাশিতটে দাঁড়ানো নারীর গায়ে
দ্যাখো তোমারে সে দেখায়ে দিতেছে যা-কিছু সুদর্শন
গুচ্ছের যত ফুলপাতা আর জঞ্জাল সরায়ে
দ্যাখো শৈবালে সাহসী মানুষগুলো
সকালবেলায় দ্যাখো শিশুদের ঝাঁক
সকলেই তারা জীবন্ত ঝলোমলো
সব্বাই দ্যাখো সংহত চারুবাক
ওই দ্যাখা যায় স্যুজ্যান দাঁড়ানো দু-হাতে আয়না ধরে
যেখানেই নিয়া যায় সে তোমারে সেখানেই যাও তুমি
নিশ্চয় তার আস্থা লভিলে বাহিরে ও অন্দরে
দেহের দারুণ দাবিদাওয়াগুলো খুঁজে নেবে মনোভূমি
টিচার্স
দেখা হয়েছিল মহিলার সনে বহু বহুকাল আগে
কেশ ছিল তার ঘনঘোরতর গাঢ় রজনীর কালো
শুধায়েছি তারে সে কী হৃদয়ের নামজাদা শিক্ষক?
নরম গলায় “না না আমি নই” বলেছে মোমের আলো
অনেক দূরের সমুদ্রপারে দেখেছি আরেক মেয়ে
সোনা নয় যেন সোনার চেয়েও সোনালি তাহার চুল
তুমি কী গো কোনো মশহুর গুরু অন্তরের ইশকুলে?
“হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তা-ই, কিন্তু তোমার ভেবে থাকো যদি ভুল”
হয়েছিল দেখা আরেক লোকের সঙ্গে সেদিন সহসা
মানসিক ভারসাম্য হরণ হয়ে গেছে তার কবেই
“আমারেই অনুসরণ করো হে পেতে যদি চাও পরিত্রাণ”
বলিতে বলিতে চলিলেন তিনি হেঁটে হেঁটে পেছনেই
কিছুদূরে যেয়ে ঢুকলাম এক আরোগ্যনিকেতনে
যেখানে কেহই নীরোগ নয়কো রোগীও কেহই নয়
রাত্তিরে যবে সেবিকারা যায় যার যার নীড়ে ফিরে
দেখি যে আমারও দুই-পা ক্লান্ত শরীর অবসাদময়
রাত শেষ হলো দোর খুলে এল ভোর
মধ্যদিনের দুপুর আসিয়া দাঁড়ায় আগুনস্পৃষ্ট
ভোজনটেবিলে খেতে বসে এ কী ঈশ্বর
চামচের পাশে গুচ্ছের ছুরি চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট!
কতিপয় মেয়ে রোদের লেবাসে কাছে আসে এ-সময়
টেবিলের পাশে দেখে যায় ছেঁড়া নাড়িভুঁড়ি ঘুরে ঘুরে
জিগাই তাদেরে তোমরা কেউ কী হৃদয়ের অধ্যাপিকা?
“আমরা শেখাই হৃদয়বিহনে বাঁচিবারে দেহজোরে”
একদিন ভোরে জেগে দেখি আমি একা
আরোগ্যালয় উধাও এবং সেবিকারা কেউ নাই
নিশ্চয় তবে সদাপ্রভুকোল লভিলাম অবশেষে?
“হ্যাঁ হ্যাঁ বাপু তুমি নিছক একটা হাড্ডির টুকরাই!”
দিবারাতি আমি হাড়ের হরষে চেটে-চুষে-গিলে খাই
যাহা পাতে পাই তাহা সাবড়াই এঁটোজুটো সবটাই
রাজ্যির এই খাবারদাবারে ব্যয়ভার ঢের নিশ্চয়?
ঘৃণাভরে হেন প্রশ্নোত্তর ধামাচাপা দিতে হয়
ঘেন্নায় ছাওয়া আলোয়-আঁধারে ঘেন্নাযাপন করি
ঘৃণিত গগনে ঘেন্নাধুলায় ঘৃণাই উঁচিয়ে ধরি
জীবনের কোনো ধূসর অধ্যায়ে পেয়েছিনু সুবচন
যদিও আমার ছিল দরকার ভীষণ আলিঙ্গন
অনেক সোহাগ জুটেছে আমার সোমত্ত বহু রমণীর
জড়িয়ে-জাপ্টে ধরেছে অনেক শৌর্যবীর্য বীর
এবেলা ভাবছি হৃদয়ে আমার স্খলন ঘটেছে বুঝি?
“নহে নহে প্রিয়, যদি পারো ফের খাটাও প্রেমের পুঁজি”
ছিলাম আমি তো দশাসই বেশ দেখতেশুনতে ভালো
মুখস্থ ছিল বহু কবিতার গানের সুরের আলো
এই গান দিয়া আমি কী তোমারে করতে পেরেছি প্রীত?
“ভুয়া বাতচিতে বেসুরা গানটা আজানুলম্বিত”
বলো তবে আমি কহিব কথাটা কার দিকে মুখ করে?
কে বলো তাহলে নেবে টুকে এই কথাগুলো অক্ষরে?
তোমরা কী কেউ পড়তে শেখাবে হৃদয়ের স্বরলিপি?
“শিখাইতে পারি হৃদয়শিশিতে কেমনে লাগাবে ছিপি”
ক্ষ্যামা দ্যাও মোরে এবারের ন্যায় হৃদয়ের অধ্যয়নে
হেন অসাধ্য মন্ত্র সাধনে সহে না যাতনা মনে
এই কথা শুনে হেসে ওঠে তারা সকলে সমস্বরে
“এটুকুতে তুমি হৃদয় গুটায়ে নিতেছ কী চিরতরে?
এইটুকুতেই হৃদিশিক্ষায় ইস্তফা দিয়ে দিলে?
এটুকুতেই কী হৃদয়পঠনে অবসর নিয়ে নিলে? …
হিয়্যার ইট ইজ্
এই তো তোমার মুকুট
তোমার অঙ্গুরি-সিলছাপ্পা
লালসা এবং প্রেমভালোবাসা
দুনিয়াবি যত ধাপ্পা
নাও ধরো এই রথের চাকা
গাড়ির দারুণ গতি
দৃষ্টি তোমার মগ্ন যেহেতু
ভুষি জিনিশেরই প্রতি
বাঁচিয়া থাকুক সবাই
কিংবা যাক মরে দুমদাম
তোমায় বলছি প্রিয়, শোনো
এ-যাত্রা চললাম
ধরো দেখি পানপাত্র
ধরো সুরায় মাতাল ঋতু
প্রণয় তোমার এইসবেতেই
চিরদিন অবিরত
ওই তো অসুখবিসুখ
তোমার শয্যা ও লোটাকম্বল
প্রেমে আর কামে পর্যুদস্ত
নরনারী টলোমল
সব্বাই রয় বেঁচে
এবং প্রত্যেকে মরে যায়
কান পেতে শোনো প্রিয়
বলছি নিচুস্বরে এই বিদায়
হাতে নাও এই রাত্রি
নিশিরাত বাঁকা চাঁদ
তোমারও ঘনায় মৃত্যু
তোমার পুত্র শানায় কাঁধ
ওই দ্যাখো ভোর হয়
দ্যাখো মরণের নাই দেরি
মৃত্যু তোমার-আমার
দ্যাখো কন্যার চোখে হেরি
সক্কলে বেঁচে থাক
অথবা যাক মরে যাক সবে
ডেকে ডেকে বলে যাইছি
বিদায় এবারের মতো ভবে
এবং এই যে এত্ত হন্তদন্ত
পরক্ষণে তুমি উধাও
পশ্চাতে পড়ে প্রেমভালোবাসা
মনপবনের নাও
ওই তো গোরের মাটি
তোমার শববহনের খাটিয়া
ওই তো তোমার প্রণয়
নিচ্ছ চিরতরে সমঝিয়া
প্রত্যেকে থাক বেঁচে
মরুক যার যার কায়দায়
গাইছি তোমায় নিশানা করেই
বিদায়, চিরবিদায় …
ল্যিয়িভিং দ্য ট্যেইবল্
উঠিয়া যাইছি জুয়ার আসর ছেড়ে
খেলা থেকে এবে গুটায়ে নিতেছি তাস
অচেনা লাগছে এবং বেজায় হেঁড়ে
এই গাণ্ডুরা বন্ধু তোমার উতরোল বারোমাস
বাসিয়াছিলাম তোমারে হয়তো ভালো
দূরজনমের তুমি ছিলে ডাকনাম
হয়তো তুমিই ছিলে সেই সূর্যালো
হয়তো তোমারে রেখাবাঁকা আঁকলাম
উকিল নিয়োগ করছ হুদাই তুমি
বিশেষ কিছুই নাই মম অভিযোগ
বলছি না যাও আমারই দুয়ার নমি’
কিংবা চাই না হুদা প্রতিশোধভোগ
ঘুচেছে আমার প্রেমিকার দরকার
ঘুমিয়ে পড়েছে প্রেমের পশুটা বেশ
প্রণয়িনীদ্বারে ঠুকিব না মাথা আর
আগুনশিখাটা নিভে যাক শেষমেশ
কারোর জন্য পোড়ে না কারোর প্রাণ
কারোরই তো নাই কৃতজ্ঞতার লেশ
হারছি কিংবা জিতছি একেক দান
রইছে না কোনো সম্পর্কের রেশ
খর্চা করছি যা-কিছু জমেছে সঞ্চয়
প্রেম নয় জেনো সত্তায় স্মৃতি শুধু
ভবিষ্যতের ভিত্তি স্মৃতিই হয়
নিধুয়া পাথারে স্মৃতিই যষ্টিমধু
দরকার নাই যুক্তির প্রতিপাদন
হয়েছি যা-কিছু হয়ে গেছি যা-ই-হোক
ওজর আপত্তি অজুহাত সাতকাহন
ঘেঁটে ঘেঁটে ঢের ঘোলা এ মর্ত্যলোক
ক্ষমা চাইছি না বিদায়ী দু-হাত নেড়ে
এই সংসার রোরুদ্যমানা রাত্রি ও প্রাতঃরাশ
উঠিয়া যাইছি জুয়ার আসর ছেড়ে
খেলা থেকে দ্যাখো গুটায়ে নিতেছি তাস
জুয়ার আসর ছেড়ে এই চললাম
গুটায়ে এনেছি জীবনমনস্কাম
সংগৃহীত ফোটোগ্রাফ অবলম্বনে ব্যানার বানিয়ে দিয়েছেন গ্র্যাফিক আর্টিস্ট উসমান গনি