প্রসঙ্গ: শামসুর রাহমানের ছড়া । এহসান হায়দার
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ নভেম্বর ২০১৬, ৭:৫৬ অপরাহ্ণ, | ৩৩৭২ বার পঠিত
অর্ধশতক পর
ভারত বিভাগের ফলে বাংলা সাহিত্যের বিকাশভূমি যখন বিভক্ত হয়, তারপর অর্ধ শতাব্দী পার হয়েছে। এই সময়ে নতুন কেন্দ্রে ঘটে যায় নব নব বিকাশ তৈরি হয় নিজস্বতা। বলা নিষ্প্রয়োজন, বিভক্ত বাংলাদেশী সাহিত্যের এই বিকাশ খুব সহজভাবে সোজাপথে চলেনি। তার কারণ, এখানে উপকরণের বস্তুগত অপ্রতুলতা যেমন ছিল তেমনি ছিল অর্থনৈতিক সচ্ছলতার আদর্শ আর তাই সাংস্কৃতিক বিকাশও ছিল বাঁধাগ্রস্থ। তবুও সাহিত্যের যেসব শাখা স্বাভাবিকরূপে একটু একটু করে প্রতিকূলতা পার হয়ে সম্ভ্রান্ত হবার পথে যাচ্ছিল তখন নানান বাঁধার দিকটাও কম ছিল না।
এরমধ্যে কোনো কোনোটা একবারেই নিজস্ব গণ্ডির চাপে পিষ্ট হয়ে পড়ে। এর প্রধানটিই ছিল শিশুসাহিত্য। নিজস্ব সংকীর্ণতা আর দাম্ভিকতা যেমন আজও সবকিছুকে পিষ্ট করে তেমন তখনও বাংলা শিশু সাহিত্যের এই হাল বিদ্যমান ছিলো। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো- বাংলা ছড়ার কোথাও কোনো স্থান হয়নি আজও। না পাঠ্য বইয়ে উল্লেখ আছে, না আছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পাঠ্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এর ক্রমবিকাশের-সূত্রধরদের নামধাম!
নামকাওয়াস্তে কিছু ছড়ার অংশ বিশেষ ওই শিশুদের জন্য বরাদ্দ করেছে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিঅব্দি। কিন্তু শিশু সাহিত্য যে একটা অন্যতম সাহিত্যঙ্গন সাহিত্যের তারও একটা ইতিহাস তো দরকার জানা। বরাবরই এ অঙ্গন অবহেলিত। এই শিশু কিশোর সাহিত্য ছড়াকে মূল সাহিত্যে কোনো মূল্যায়নই করা হয় না।
তবুও এখন বাংলা সাহিত্যের এক পরাক্রমশালী শাখা হলো ছড়া। প্রাচীন যুগ থেকে সাহিত্যের মর্যাদা না পেলেও সময়ের প্রয়োজনে সে তার যথার্থ স্থানটি দখল করে নিয়েছে। ছড়া আজ বাংলা সাহিত্যের একটি শাণিত উচ্চারণ, বলিষ্ট প্রতিনিধি। ছড়া তার ঘুম পাড়ানির যুগ অতিক্রম করেছে। ছড়া এখন মানুষের অধিকারের উচ্চারণ, স্বাধীনতার হাতিয়ার, রাজপথের শানিত শ্লোগান। ছড়ায় কঠিন বিষয় সহজ হয়। ছন্দে-তালে-মাত্রায়-বিন্যাসে ছড়া উপস্থাপিত হয় অলংকার নিয়ে। অন্যায়ের পিঠে চাবুক মারে সরাসরি। নিষ্প্রাণকে করে তেজোদ্দীপ্ত। ছড়ার ধ্বনি আমাদের ধমনী ও শিরায় জোঁয়ার-ভাঁটার সৃষ্টি করে। ছড়া কী, ছড়ার যুগ-কাল নানান ছড়ার সংজ্ঞা নিরূপন করতে গিয়ে ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ তার ‘ছড়ায় বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ছড়া বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারার নাম। প্রাচীন লোক সাহিত্যের অন্তর্মূলে তার জন্ম, লালন ও বিকাশ ঘটলেও বর্তমানে তা সাহিত্য বা ভাব প্রকাশের একটি আধুনিক রূপ।’ একই গ্রন্থে ‘ছড়া’ শব্দটির বুৎপত্তি ও আভিধানিক অর্থ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলা হয়েছে- ‘ছড়া শব্দটির বুৎপত্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মত পার্থক্য বিদ্যমান। কারো মতে শব্দটি সংস্কৃতমূল, কারো মতে দেশজ। হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় ‘ছড়া’ শব্দের বুৎপত্তি নির্ণয় করেছেন এভাবে- সং. ছটা> প্রা. ছড়া> প্রা. ম. ছিটা> ছড়া। রাজশেখর বসু, যোগেশচন্দ্র রায় প্রমুখ পন্ডিত এই মতের সমর্থক।
অপরদিকে নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে ‘ছড়া’ শব্দটি দেশজ। ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’-এ দেখা যায়, পাবনা অঞ্চলের উপ ভাষায় ছড়া শব্দটি বর্তমানেও প্রচলিত, যদিও এখানে ছড়া শব্দের অর্থ ‘শিকেলি’। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে যে ছড়া শব্দটি বর্তমান অর্থ বহন করত না, তার সাক্ষ্য রয়েছে সুকুমার সেনের মন্তব্যেও। অনেক অভিধান প্রণেতাও ‘ছড়া’ অর্থ করেছেন গ্রাম্য কবির কবিতা, ছন্দবদ্ধ উক্তি, শ্লোক পরম্পরা ইত্যাদি। স্পষ্টতই ছড়া শব্দটি ইতোপূবে যে সকল অর্থে ব্যবহৃত হতো, আমাদের বর্তমান ধারনার সঙ্গে তার পরিপূর্ণ সংগতি নেই। অন্য কথায় শব্দটির অর্থগত বিবর্তন ঘটেছে আধুনিক যুগে।
ছড়া মনের মধ্যে নির্মাণ করে আনন্দলোক। ভাব- ভাষা- ছন্দ- রস ছড়ার ক্ষেত্রে পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। একটি চিত্রে রঙের সঠিক ব্যবহার না করলে চিত্রটি নজরকাড়া হবে না। একজন সুন্দর নারী পোশাকের সাথে মানানসই অলংকার না পরলে তার সৌন্দর্য ফোটে না। এমনি ছড়াতেও তার বিষয়বস্তুর সাথে মিল রেখে ছন্দ- ভাষা- রস- উপমা- চিত্রকল্পের ব্যবহার সঠিক না হলে তাকে ছড়া বা কবিতা বলা যায় না। আর এর সঠিক ব্যবহার হলেই পাঠক কবিতা বা ছড়াটিকে গ্রহণ করে সার্থক ও রসোত্তীর্ণ লেখা হিসেবে। পাঠক তার মনের মণিকোঠায় স্থান দেয় কবিতা বা ছড়াটিকে। রস পাঠকের মনে ছড়া পাঠের অনুভূতি অনুরণিত করে দেয়। তার ভিতরে সুখের কি দুখের, বিজয় কি পরাজয়ের, আনন্দ কি বেদনার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। এরকম ছড়াই সমকালের সড়ক পেরিয়ে চিরকালীন মহাসড়কে জায়গা করে নেয়। নিরর্থক শব্দগুচ্ছ ছন্দে লিখিত হলেও পাঠক যথাযথ আনন্দ খুঁজে পান না। ননসেন্স ভার্স পাঠে হয়তো পাঠক মনের মধ্যে কিছুটা ঝংকার অনুভব করবেন কিন্তু ছড়া পাঠে তার অনুভূতির প্রতিক্রিয়া জাগাতে পারবেন না। যদিও ছড়ার প্রাণসত্তা ছন্দ, তবুও শুধু ছন্দের উপর ভর করে একটি সার্থক ছড়া রচিত হতে পারে না। রস শুধু নির্মাণ করলেই চলবে না। পরিবেশনের পাত্রও ঠিক করতে হবে। কোন ছড়ার জন্য কোন রস লাগবে তা ঠিক করে নিতে হবে ছড়াকারকেই। আমাদের দেশের ছড়াকারদের একটি বৈশিষ্ঠ্য আছে যারা নাকি ছড়া লেখেন তারা কেবলই ছড়া বা শিশুতোষ ছড়ায় জীবন পার করে দেন, অন্যদিকে যিনি বা যারা কবিতা লেখেন তাদের অনেকেরই আবার ছড়া লিখেছেন। শিশুদের জন্যে ভাবেননি এমন কবি খুব কমই আছেন বাংলা সাহিত্যে।
শামসুর রাহমান শিশু-কিশোরদের জন্যে যেমন ভেবে লিখেছেন তেমনি নিজেও ছিলেন ধবল চুলের শিশু। শিশুর মতোন মনের অধিকারী এই কবির জন্মস্থান ঢাকা শহরের মাহুতটুলির এক সরু গলির ভিতর নানার কোঠাবাড়ি। ১৯২৯ সালের ২৪ অক্টোবর বুধবার সকালে । তাঁর ডাক নাম বাচ্চু। শামসুর রাহমানরা চার ভাই ও ছয় বোন। শামসুর রাহমানের বাবা মোখলেসুর রাহমান চৌধুরীর প্রথম পক্ষের স্ত্রী তিন পুত্র রেখে মারা যান। এর পর প্রথম স্ত্রীর ছোটবোন আমেনা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। আমেনা বেগমের ১০ সন্তানের মধ্যে শামসুর রাহমান জ্যেষ্ঠ। সাহিত্যচর্চার বালাই নেই এমন এক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন তিনি ।
ছড়ারাজ্যের নীরব কথক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে হালের তরুন কবিদের মধ্যেও এই শিশু ভাবনার বা শিশু মনের খোরাক ছড়ার রস বিদ্যমান। আর তাই বাংলা কবিতার শক্তিমান কবি শামসুর রাহমানও লিখেছেন অসংখ্য ছড়া। তিনিও লিখেছেন বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের জন্যে ছড়া। কবি শামসুর রাহমানও যে শিশুর মন বুঝেছেন নিজের মনের গভীর থেকে তা তাঁর ছড়ায় ফুটে উঠেছে ভিন্ন দ্যোতনায়।
শৈশবে তাঁর দেখা প্রথম চিত্রশিল্পী বাবুবাজারের নঈম মিঞা। ছেলেবেলায় স্কুলে যাওয়ার পথে নঈম মিঞার দোকানের সামনে দাঁড়াতেন তিনি। তুলি দিয়ে কাঁচের ওপর ছবি আঁকতেন নঈম মিঞা। সেগুলো বিক্রি করতেন। নঈম মিঞার কাছে ছবি আঁকার পাঠ শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু একদিন নঈম মিঞা ছোট বালকটিকে ধমক দিয়ে বিদায় করে দিলেন। কারণ তাঁর জীবনের প্রথম শিল্পের ওস্তাদ নঈম মিঞা চাননি শিল্পের নেশায় এই শিশুর জীবনও তার মতো খুকখুক কাঁশির ও ধুকধুকে কষ্টের হয়ে উঠুক। নঈম মিঞার মতো পরবর্তী জীবনে তাঁর বাবাও চাননি তাঁর ছেলে কবি হোক। কবিতা লিখলে জীবনে বিত্তবৈভবে সফল হওয়া যায় না, তাই অভিভাবকরা কেউ কবি হতে তাঁকে উৎসাহিত করেননি।
অথচ নঈম মিঞা এবং অভিভাবকদের কাছ থেকে উৎসাহ না পাওয়ায় তাঁর সৃষ্টিশীল মন থেমে থাকে নি। সকল বাঁধাকে অতিক্রম করে তিনি হয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম কবি। আর বাংলাদেশের অন্যতম এই কবি শামসুর রাহমান। শুধু অন্যতমই নন, বরং তিনি এদেশের অনন্য, প্রধান কবি এবং প্রধান ছড়াকারও। তাঁর কবিশক্তির পাশাপাশি শিশুদের জন্যে লেখা ছড়াগুলো পাঠে অত্যন্ত অবাক করে দেয় আমাদের। সমকালে অনেকেই ছড়া লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন ঠিকই কিন্তু কবি শামসুর রাহমান সেই খ্যাতির জায়গায় নেই কারণ তিনি বাংলা ভাষাভাষি পাঠককে আগেই ধরা দিয়েছেন কবি হিসেবে। ধারনা করা যায় অনেকেই হয়তো কবির দু-একটি ছড়া শিশুদের পাঠ্য বইয়ের পাতায় দেখেছেন, কিন্তু অজানা এক ছড়ার জগত কবি শামসুর রাহমানের আছে তা নিশ্চয়ই এখনো অধিকাংশেরই অদেখাই।
তাঁর এই অচেনা-অদেখা ছড়ার জগতের একটি ছড়ায় তিনি বলেন—
ঢাকা শহর আজব শহর
এই শহরে জবর খবর—
তাক ডুমা ডুম ডুম।
এই শহরে মহা ধুমে
ডিম পেড়েছে ঘোড়া ডুমে,
তাক ডুমা ডুম ডুম।ছাঁটাই, পৃষ্ঠা১২০, ছড়াসমগ্র-শামসুর রাহমান
উপরের ছড়াটিতে কবি তাঁর প্রাণের শহর ছেলেবেলার বেড়ে শহর যে কত আজব তার বর্ণনা দিতে শুরু করেছেন। তার আপন ঢঙ্গে, এখানে রাহমান সাহেবের নিজের ঢঙ্গের কোনো বেশভূষা লক্ষ্য করা যায়নি; গিয়েছে পুরান ঢাকা বা ঢাকার যে আপন রূপ সেই ভাষার। মজার ব্যাপার হলো এই ভাষাতেই লিখেই রাজরাধী ঢাকার সত্যিকারের চেহারার বর্ণনা আরও প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে এবং এই সুর ছন্দই ছড়া পাঠকের পছন্দ।
কবি নিজের ভেতরেই লুকানো শিশুকে পরিণত বয়সে এসে যখন বের করে আনলেন তাঁর লেখার মধ্যে তখন বের হলো সব অসাধারণ শিশুর আনন্দের ছড়া। কবির মন শিশু হয়ে যাওয়া আর শিশুর জন্য লেখা সবার জন্যে হয় না। সবকবিই তা পারেন না। সাধারণভাবে কবিরা শিশুই। কিন্তু কবি শামসুর রাহমান বোধ হয় একটু বেশিই ছিলেন। আদরের নাতনীর খেলার সাথী হয়ে পাখী নিয়ে খেলেছেন, নাতনীর সাথে গল্প করতে করতে সবুজ প্রকৃতি নিয়ে মনের কোণে শঙ্কা তৈরি হয়, পাখীরা নিরাপদে থাকবে তো? এর থেকে কী এটাই মনে হয় না পরিবেশ বিপর্যয়ে একটা শ্রেণির মানুষ সবকালে ছিল আর এটাই বুঝে আবেদন করেন ছড়া লিখে।
শহরবাসী সবাই এখন
কাঁপছে শীতে ঠক ঠক
নয়না তার দাদাভাইকে
কাশতে দ্যাখে খক খক।এই শহরে বেইলি রোডে
এসেছে ভাই অনেক বক…বকেরা থাক নিরাপদে
এই শহরে গাছের ডালেওদের কেউ মেরো নাকো
বেঁধো না ভাই শক্ত জালে।শহরে বকের ঝাঁক, ছড়াসমগ্র-শামসুর রাহমান, পৃষ্ঠা১৪৮
প্রসঙ্গত, বাংলা শিশুসাহিত্যের আরও কয়েকটি ক্ষেত্রের মতো, উদ্ভট হাস্যরসের ছড়া আর কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে শামসুর রাহমান অগ্রগন্য। ইংরেজিতে যাকে ননসেন্স বলে থাকি তা শামসুর রাহমানের ছড়ায় কোথাও কোথাও দেখা গেলেও বেশিরভাগ ছড়ায় যেমন রয়েছে অর্থবোধকতা তেমনি তার সাথে রয়েছে ছন্দের অদ্ভূত দ্যোতনা। হাস্যরস তাঁর লেখা রচনাতে যেভাবে এসে ধরা দিয়েছে সার্থকরূপে তা অন্যদের মতো নয়, কখনও তা এসেছে প্রত্যক্ষভাবে কখনও আবার পরোক্ষভাবে। আর পঞ্চাশ পরবর্তী সময়ে যখন দেখি বাংলায় ছড়ার স্বাজাত্যবোধ সবে শুরু তখনও শামসুর রাহমান শিশুর জন্যে ছড়া লেখায় মনোনিবেশ করেননি। কিন্তু তিনি যখন ছড়া লেখা শুরু করেন তখন তাঁর হাতে বেরিয়ে এলো আকাশের জ্বলজ্বলে তারার মতো কী মিষ্টি মিষ্টি ছড়া। সন্ধ্যারাতে বাগানে যখন হাস্নাহেনা ফোটে আর গন্ধ বিলায় আনমনে, তেমনি রাহমান সাহেবের ছড়া ছিল ছটফটে প্রাণবন্ত। এ যেন ছেলে-বুড়ো সকলের প্রাণের কথা বলে যাচ্ছেন তিঁনি। আধুনিক বাংলা কবিতার এই প্রবাদপুরুষ এত মধুর ছড়া কখনও লিখবেন কেউ হয়তো ভাবেননি। অথচ এই কাজটিই তিঁনি করেছেন কী অসাধারণ দক্ষতায়।
কবি শামসুর রাহমান তাঁর শৈশবের সময়ে ফিরে যান হুটহাট করে আর তাই লিখে দেন চমকে যাওয়া সেই প্রিয় গ্রাম প্রিয় নরসিংদীর পাড়াতলীর স্মৃতিময় দিন নিয়ে—
মেঘনা নদী দেব পাড়ি
কলঅলা এক নায়ে
আবার আমি যাবো আমার
পাড়াতলি গাঁয়ে…ধানের গন্ধ আনবে ডেকে
আমার ছেলেবেলা—
বসবে আবার দুচোখ জুড়ে
প্রজাপতির মেলা…
শত যুগের ঘন আঁধার
গাঁয়ে আজো আছে
সেই আঁধারে মানুসগুলো
লড়াই করে বাঁচে।প্রিয় স্বাধীনতা, ছড়া সমগ্র-শামসুর রাহমান, পৃষ্ঠা১০০
শিশু-কিশোরদের বন্ধু
কবি শামসুর রাহমান শিশু-কিশোরদের জন্যে যেমন ভেবে লিখেছেন তেমনি নিজেও ছিলেন ধবল চুলের শিশু। শিশুর মতোন মনের অধিকারী এই কবির জন্মস্থান ঢাকা শহরের মাহুতটুলির এক সরু গলির ভিতর নানার কোঠাবাড়ি। ১৯২৯ সালের ২৪ অক্টোবর বুধবার সকালে । তাঁর ডাক নাম বাচ্চু। শামসুর রাহমানরা চার ভাই ও ছয় বোন। শামসুর রাহমানের বাবা মোখলেসুর রাহমান চৌধুরীর প্রথম পক্ষের স্ত্রী তিন পুত্র রেখে মারা যান। এর পর প্রথম স্ত্রীর ছোটবোন আমেনা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। আমেনা বেগমের ১০ সন্তানের মধ্যে শামসুর রাহমান জ্যেষ্ঠ। সাহিত্যচর্চার বালাই নেই এমন এক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন তিনি । পরিবারের কারো সঙ্গীত, চিত্রকলা ও সাহিত্য সম্পর্কে তেমন কোনো আগ্রহও ছিল না। তবে পুরনো ঢাকার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ কাওয়ালি ও মেরাসিনের গানের সাথে পরিচয় হয়েছিল অতি শৈশবেই। পরিবারের সব লোকজন উপলক্ষ পেলেই কাওয়ালির আয়োজন করত। তাঁর বড় ভাই খলিলুর রাহমানের স্ত্রী জাহানারা বেগম ছিলেন নবাব বাড়ির মেয়ে। উর্দু সাহিত্যে বিস্তর পড়াশোনা ছিল কবির বড় ভাবির। বড় ভাবি পাঠ করে শুনিয়ে ছিলেন বেশকিছু উর্দু গল্প ও কবিতা এবং মির্জা গালিবের গজল। তাঁর বিধবা ফুফুর ছেলে ইয়াকুব আলী খান থাকতেন কবির পরিবারের সাথেই। ইয়াকুব আলীর রূপকথা বলার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। নিজস্ব ভঙ্গি দিয়ে রূপকথাকে আরো রূপময় করে তুলতেন ইয়াকুব আলী। তাঁর পরবর্তী জীবনে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে নিয়ে লেখা প্রতীকী কবিতা ‘হাতির শুঁড়’-এ এই ইয়াকুব আলীর রূপকথার ঋণ আছে। তাঁর ছেলেবেলায় পুরনো ঢাকার মাহুতটুলিতে দালানকোঠা ও যন্ত্রচালিত গাড়ি ছিল না বললেই চলে। মাটির ঘর, ঘোড়ার গাড়ি, সহিস, বিভিন্ন দোকান, আরমানিটোলা স্কুলের পেছনের শিউলিতলা, জন্মাষ্টমীর উৎসব, মহরমের মিছিল ও তাজিয়া, দেবদেবীর ছবি, কাননবালার ছবি শৈশবে দেখা পুরানো ঢাকার এসব স্মৃতি কবির মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। ঢাকায় তখনও বিদ্যুৎ ছিল না। চারিদিকে নানান শব্দ। এই শব্দ, দূরের আকাশ, নদীর সবই কবির মনের মধ্যে ছবির মতোন বেসে বেড়ায় উঁকি দেয় আর তাইতো কবি লিখেছেন—
শব্দ সে তো জোছনা নাওয়া নদীর তীর
শব্দ সে তো সন্ধেবেলার মেলার ভিড়।
শব্দ সে তো ভর-দুপুরে শঙ্খচিল
শব্দ সে তো টলটলে ওই পদ্ম বিল।শব্দ, ছড়াসমগ্র-শামসুর রাহমান, পৃষ্ঠা১৩৭
শৈশবে কবি তাঁর শিল্পের ক্ষুধা মিটিয়েছেন সস্তা হিন্দী সিনেমা দেখে। বাবা কিছুদিন সিনেমা হলের ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জের ডায়মন্ড ও ঢাকা তাজমহল সিনেমা হলের অংশীদার। বৈমাত্রেয় মেজো ভাই আমিনুর রাহমান চৌধুরী ছিলেন তাজমহল সিনেমা হলের অপারেটর। মেজো ভাই আমিনুর রাহমান চৌধুরীর ঘরের মায়া ছিল না। উড়নচণ্ডী সেই ভাই নৌবাহিনীর চাকরি নিয়ে সমুদ্রে ও বিদেশ-বিভূঁইয়ে জীবন কাটিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথের চয়নিকা থেকে ভারত তীর্থ কবিতাটি আপনমনেই নিজের মতো আবৃত্তি করতেন কবির মেজো ভাই। আবৃত্তিকারের গভীর আন্তরিকতার কারণে কবির ছোট্ট মনে গেঁথে গিয়েছিল সেই কবিতা।
শামসুর রাহমানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ পোগজ স্কুলে। ১৯৩৬ সালে এ স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। এ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় ছোট বোন নেহারের মৃত্যুতে একটি কবিতা লেখেন তিনি। তাঁর লেখা জীবনের প্রথম এই কবিতা শুনে তাঁর মা কেঁদেছিলেন খুব।
১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর অবসরে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো পড়ে ফেলেন শামসুর রাহমান। কবির এই ছেলেবেলা-কিশোরবেলার পরিণতি স্মৃতি দেখা যায় অধিকাংশ ছড়ায়। পারিবারিক নানান ঘটনার সুবাদে পড়া হয়ে যায় বঙ্কিম ও শরৎচন্দ্রের রচনা। তখন তাঁরা থাকতেন ৩০ নং আশেক লেনে এবং ১৭ নং আশেক লেনে থাকতেন শিল্পী হামিদুর রাহমানদের পরিবার। একদিন রাস্তা থেকে শামসুর রাহমানকে ডেকে নিয়ে যান হামিদুর রাহমান। শামসুর রাহমানের চেহারা দেখে হামিদুর মনে করেছিলেন, তিনি কবিতা লেখেন। ১৭ নং আশেক লেনের বাড়িতে যাওয়া আসার সুবাদে সেইসময়ে ঢাকার প্রথমসারির শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মীদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ট পরিচয় ঘটে। হামিদুর রাহমানদের বাড়ির আড্ডার সংস্পর্শেই শামসুর রাহমানের মনে সৃষ্টির বাসনা জেগে ওঠে। হঠাৎ এক মেঘলা দিনের দুপুরে তিনি একটি কবিতা লিখে ফেলেন। সেই কবিতা পড়ে শুনালেন হামিদুর রাহমানকে। তিনি শামসুর রাহমানকে উৎসাহিত করেছিলেন খুব। চিরকালের কবি শামসুর রাহমান লিখতে শুরু করেন নিয়ম করে। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ ছড়া বা কিশোর লেখা লিখেছেন পরিণত বয়সেই। স্মৃতি কাতরতায় ভুগেছেন তিনি তা বারবার তাঁর লেখায় প্রকাশ পেয়েছে।
শিল্পী হামিদুরের উৎসাহে শামসুর রাহমান নলিনীকিশোর গুহ সম্পাদিত সেকালের বিখ্যাত সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় (ঢাকা থেকে প্রকাশিত) কবিতা লিখে পাঠান। তখন সোনার বাংলায় লিখতেন জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো প্রথিতযশা কবিরা। ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি সোনার বাংলায় শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা ছাপা হয়। সেই কবিতার নাম তারপর দে ছুট। ১৯৪৭ সালে আইএ পাশ করার পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। স্নাতক সম্মান পড়া শেষ বছর পর্যন্ত চালিয়ে গেলেও পরীক্ষায় অবতীর্ণ হননি। ১৯৫৩ সালে পাস কোর্সে স্নাতক পাশ করেন। মাস্টার্স ভর্তি হয়ে প্রথম পর্ব কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন, কিন্তু শেষ পর্বের পরীক্ষায় আর বসা হয়নি তাঁর। ১৯৫৫ সালের ৮ জুলাই লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখেই আত্মীয়া জোহরা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির পাঁচ সন্তান (তিন কন্যা ও দুই পুত্র)। তারা হলেন যথাক্রমে সুমায়রা রাহমান, ফাইয়াজুর রাহমান, ফৌজিয়া রাহমান, ওয়াহিদুর রাহমান মতিন এবং সেবা রাহমান।
১৯৫৭ সালে কর্মজীবন শুরু করেন অধুনালুপ্ত মর্নিং নিউজ-এর সহ-সম্পাদক হিসেবে। ১৯৫৮ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন রেডিও পাকিস্তান—এর ঢাকা কেন্দ্রে। পরে আবার ফিরে আসেন ঊর্ধ্বতন সহ-সম্পাদক হিসেবে মর্নিং নিউজ পত্রিকায়। মর্নিং নিউজ-এ ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে পত্রিকা জগতে নতুন আসা সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলা পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান -এ (অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক বাংলা’) যোগ দেন সহকারী সম্পাদক হিসেবে। দীর্ঘ ১৩ বছর কাজ করার পর ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি দৈনিক বাংলা এবং এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক নিযুক্ত হন। এসময় একটি মোনাজাত নামের কবিতা লেখার জন্য সরকারের রোষানলে পড়েন।
১৯৮৭ সালে স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদে ইস্তফা দেন কবি। এ সিদ্ধান্ত ছিল শামসুর রাহমানের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কেননা ঢাকায় থাকার মতো তখনো কোনো নিবাস ছিল না কবির, অর্থ উপার্জনের ছিল না কোনো বিকল্প রাস্তা। তাছাড়া তখন কবির ফুসফুসেও দেখা দিয়েছে সমস্যা। সব মিলিয়ে প্রচ- দুঃসময় কবির ব্যক্তিগত জীবনে। জাতীয় জীবনের দুঃসময়ে নিজের কথা ভুলে কবিতাকে অস্ত্র মেনে দুঃশাসন অবসানের আন্দোলন চালিয়ে গেলেন কবি। ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের প্রথম বছরে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’, দ্বিতীয় বছরে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’, তৃতীয় বছরে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ এবং চতুর্থ বছরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ লেখেন তিনি। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের অবসান ও গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা প্রত্যক্ষ করে ১৯৯১ সালে লেখেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’।
সাংবাদিকতার বাইরে তিনি প্রথম সম্পাদনা করেন লিটল ম্যাগাজিন কবিকণ্ঠ । ১৯৫৬ সালে তিনি ছিলেন এটির সম্পাদক মন্ডলীর সম্পাদক। ১৯৮৭ সালে ক্ষণজীবী অধুনা সাহিত্যপত্রের সম্পাদক ছিলেন তিনি। সাপ্তাহিক মূলধারায় ১৯৮৯ সালে প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন তিনি এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত মূলধারার সাহিত্য সহযোগী পত্রের সম্পাদক ছিলেন। পরে তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমীর সভাপতি নিযুক্ত হন।
শামসুর রাহমানের ডাক নাম বাচ্চু। নাম থেকে পৈত্রিক উপাধি ‘চৌধুরী’ বাদ দিয়েছিলেন তিনি। শামসুর রাহমান সাংবাদিকতার খাতিরে বিভিন্ন সময়ে বেশকিছু ছদ্মনাম গ্রহণ করেছেন। পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে এসব ছন্দনাম নিয়েছেন তিনি। নামগুলো হচ্ছে: সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক। একবার মাত্র কবিতার প্রয়োজনে ছদ্মনাম নিয়েছেন তিনি। পাকিস্তান সরকারের আমলে কলকাতার একটি সাহিত্য পত্রিকায় মজলুম আদিব (বিপন্ন লেখক) নামে কবিতা ছাপা হয়। তাঁর সে নামটি দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট সমালোচক আবু সায়ীদ আইয়ুব।
সক্রিয় রাজনীতি থেকে বরাবরই দূরে থাকতে চেয়েছেন শামসুর রাহমান। কিন্তু বারবারই তাঁকে আমূল নাড়িয়ে গেছে বাঙালির শোষণ-পীড়ন ও বঞ্চনার বিভিন্ন বিষয়। রাজনীতির দানব বাঙালির উপর যতবার হামলে পড়েছে ততবার তিনি অস্থির হয়ে উঠেছেন। জনগণের পক্ষে সাড়া দিয়েছেন। তাঁর এ সাড়া এসেছে অধিকাংশ সময়ই তাঁর লেখার মাধ্যমে এবং কখনো কখনো আবার সরাসরি।
তিনি লিখেন—
সারা পাড়া ঘুমিয়ে আছে
জাগবে এবার কারা?
লাল কমলের সঙ্গী যারা
তারা, তারা, তারা…আমরা আছি অন্ধকারে
আলোর নেই যে সাড়া।
অন্ধকারের কবল থেকে
মুক্ত করবে কারা?
লাল কমলের সঙ্গী যারা
তারা, তারা, তারা।লাল কমলের সঙ্গী, ছড়াসমগ্র-শামসুর রাহমান, পৃষ্ঠা৯৮
শৈশবে বাবাকে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের কৃষকপ্রজা পার্টির সঙ্গে জড়িত থাকতে দেখেছেন। পার্টির হয়ে ফজলুল হকের অনুরোধে ১৯৩৭ সালে রায়পুরা ও পাড়াতলির জনগণের প্রতি ভালোবাসার টানে নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন তাঁর বাবা। মুসলীম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী খাজা মোহাম্মদ সেলিমের কাছে হেরে যান তিনি। বাবার অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁর চেতনায়ও প্রবাহিত ছিল। শামসুর রাহমানের বিরুদ্ধে বারবার বিতর্ক তুলেছে কূপমন্ডুকরা। তারা শুধু বিতর্ক তুলেই থেমে থাকেনি। বর্বরতার চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত গিয়েছে। কবির মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছে। তাঁকে হত্যার জন্য বাসায় হামলা করেছে। এতকিছুর পরও কবি তাঁর বিশ্বাসের জায়াগায় ছিলেন অনড়। এই সময়ে লিখেন তিনি—
মোল্লাগুলো যখন-তখন
ফতোয়া জারি করে—
পাড়াগাঁয়ের দুলালিরা
দোর্রা খেয়ে মরে।দুখিনী সব মেয়েগুলো
বড় অসহায়
কী করে এই দুলালিদের
রক্ষা করা যায়?মোল্লাগুলোর জুলুমবাজি
খতম করার তরে
দেশের মানুষ সবাই মিলে
যেতে হবে ল’ড়ে।মোল্লাগুলো, ছড়াসমগ্র-শামসু রাহমান, পৃষ্ঠা৯৮
ন্যায়, যুক্তি ও প্রগতির পক্ষের সাহসী যোদ্ধা শামসুর রাহমান তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন -হাতির শুঁড় নামক কবিতা। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ্য করে লেখেন অসাধারণ কবিতা টেলেমেকাস (১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সালে)। গ্রীক পুরানের বীর ইউলিসিসের পুত্র টেলেমেকাস। পিতা দীর্ঘদিন রাজ্য ইথাকায় অনুপস্থিত। পিতার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় পুত্র টেলেমেকাসের আর্তি জড়িত সে কবিতাটি আছে নিরালোকে দিব্যরথ গ্রন্থে। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করেন। শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান-এ কর্মরত ছিলেন। পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন দৈনিক পাকিস্তান-এর হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদ হুমায়ুন, ফজল শাহাবুদ্দীন ও শামসুর রাহমান। ১৯৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইয়ুব খান। আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন। কবিও তাঁদের একজন ছিলেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ । ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান। কর্মস্থলে তাঁর চোখের সামনে ভাসতে থাকে সেই শার্ট, সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেও এ দৃশ্য ভোলা সম্ভব হয় না তাঁর পক্ষে। সন্ধ্যায় একটানে লিখে ফেলেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি।
১৯৭০ সালের ২৮ নভেম্বর ঘূর্ণিদুর্গত দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ও মৃত্যুতে কাতর কবি লেখেন— ‘আসুন আমরা আজ ও একজন জেলে’ নামক কবিতা । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’।
শামসুর রাহমানের গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তাঁর অধিকাংশ বই-ই কবিতার হলেও শিশু-কিশোরদের জন্যেও কম লিখেননি। এছাড়া বিভিন্ন ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে। লিখেছেন বিভিন্ন রকমের প্রবন্ধ। শামসুর রাহমানের শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- এলাটিং বেলাটিং (১৯৭৫), ধান ভানলে কুঁড়ো দেবো (১৯৭৭), স্মৃতির শহর (১৯৭৯), লাল ফুলকির ছড়া (১৯৯৫)। শামসুর রাহমান অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানই তাঁকে সম্মানিত করতে পেরে নিজেরা সম্মানিত বোধ করেছে। উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে: আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯১), সাংবাদিকতায় ‘জাপানের মিত্সুবিশি পদক’ (১৯৯২), ভারতের আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪)। এছাড়া ভারতের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্রদান করেছে। শামসুর রাহমানকে প্রথম বড় মাপের সংবর্ধনা প্রদান করা হয় ১৯৭৯ সালের ২৪ অক্টোবর। পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শামসুর রাহমান সংবর্ধনা পরিষদ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। কবি ও সাংবাদিক হিসেবে সম্মানিত হয়ে তিনি ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া), বার্মা (মায়ানমার), পশ্চিম জার্মানি (সাবেক), যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন।
২০০৬ সালের ১৭আগষ্ট কবি শামসুর রাহমান এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। কিন্তু তিনি তাঁর কবিতা ও অন্যান্য লেখার মধ্যে দিয়ে আমাদেরকে সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবেন সবসময়। যেমন বেঁচে থাকবেন প্রতিটি শিশু মনে, আর নয়না খুঁজবে তাঁর প্রিয় দাদাভাইকে। যে দাদাভাই তার সাথে খেলতে খেলতে লিখেছেন অসংখ্য মজার মজার ছড়া। ২০০৬ সালের ১৭ আগষ্ট মাসে শিশুদের এই প্রিয় বন্ধু মনের মানুষ কবি শামসুর রাহমান পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন, চিরবিদায় নেন সব পাঠকের কাছ থেকে। তাইতো তাঁর লেখা পন্ডশ্রম পড়ে মনে পড়ে—
এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ
কান নিয়েছে চিলে
চিলের পিছে ঘুরছি ম’রে
আমরা সবাই মিলে…সুধীসমাজ! শুনুন বলি
এই রেখেছি বাজি
যে-জন সাধের কান নিয়েছে
জান নেব তার আজই।পন্ডশ্রম, ছড়াসমগ্র-শামসুর রাহমান, পৃষ্ঠা৪৮
আশ্চর্যের বিষয়, বিশিষ্ঠতা সূচক যেসব গুণ একজন লেখকের মধ্যে থাকে তাঁর আলাদা করে শিশুসাহিত্যিক বা ছড়াকার হিসেবে কী ছিল শামসুর রাহমানের? কেন তিনি শিশুদের মনে অল্প পাঠেই জায়গা করে নিলেন? এর উত্তরই বা কী হতে পারে?
তাঁর ভাষা সরস, নিরতিশয়, আড়ম্বরহীন আর সহজ-সরল। বিষয় ব্যঞ্জনায় ভিন্ন। অনেকের থেকে তাই তাঁকে, তাঁর ছড়াকে আলাদাভাবেই অনুভব করা যায়। অনেক শিশুসাহিত্যিক আছেন যাদের আছে ভুরি ভুরি রচনা কিন্তু স্বাত্যন্ত্রে নেই কোনো ভিন্নতা এজন্যেই কবি শামসুর রাহমানের ছড়া এতো মধুর, এতো দ্যোতনার। এক্ষেত্রে শিশুর সাথে বন্ধুত্বে কবি শামসুর রাহমান যেমন নতুনত্ব দেখিয়েছেন— এমনিভাবে শিশুদের আরেক বন্ধু হুমায়ুন আজাদও তাঁর লেখায় ভিন্নতা দিয়েই জানান দেন প্রাঞ্জল এক শিশুকিশোর সাহিত্যের জগতের। মুহুর্তেই বেঁধে ফেলেন বন্ধুত্বের মায়াজালে। এখন পাঠক-ই বলতে পারবেন কবি শামসুর রাহমানের মতো এই মজার শিশুমনের মানুষটিকে কীভাবে ভুলে থাকা যায়! এত্তো যার স্বপ্ন, এত্তো যার মজার মজার লেখা কীভাবে তাঁকে মন থেকে ঠেলে দিই দূরে। তিঁনিই তো প্রিয় হয়ে থাকবেন বাংলাদেশের সব লাল কমলের দলের কাছে।