বিদায় নিলেন লেনার্ড কোহেন
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ নভেম্বর ২০১৬, ৩:৩৯ অপরাহ্ণ, | ১৮০১ বার পঠিত
মাহি রহমান : বিদায় নিলেন লেনার্ড কোহেন। বিরাশি বছরে এসে গ্যুডবাই জানালেন। বিদায়কালে রেখে গেলেন ১৪টি স্টুডিয়োঅ্যালবাম, যে-অ্যালবামগুলোর মাধ্যমে ‘স্যুজ্যান্’ বা ‘সো ল্যং ম্যারিয়্যান’ আর ‘ফেইমাস্ ব্লু রেইনকোট’ থেকে শুরু করে ‘সিস্টার্স অফ মার্সি’ কিংবা ‘অ্যাভাল্যাঞ্চ’ বা ‘হালেল্যুইয়্যা’ গানগুলো শ্রোতাগোচরে এসেছে বিগত পাঁচটি দশকের পরম্পরায়।
সিঙ্গার, স্যংরাইটার এবং মিউজিক কম্পোজার হিশেবে লেনার্ড কোহেন সংগীতশ্রোতার সপ্রেম সমীহ কুড়িয়েছেন জীবনের অন্তিম বছর পর্যন্ত। শুরু হয়েছিল ‘স্যংস্ অফ লেনার্ড কোহেন’ অ্যালবাম দিয়ে, ১৯৬৭ সনে, এরপর একে একে ‘স্যংস্ ফ্রম্ অ্যা রুম্’ এবং ‘সংস্ অফ ল্যভ অ্যান্ড হেইট’ অ্যালবামগুলো মুক্তি পায় ষাটের দশকসীমার পরিসরেই। ডিলান তখন তুঙ্গস্পর্শী মিউজিশিয়্যান্ হিশেবে স্টেজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। এরই ভিতরে ক্যানাডিয়ান এই শিল্পীর আবির্ভাব মিউজিকের বিশ্বমঞ্চে।
লেনার্ড কোহেন ১৯৩৪ সনে ক্যানাডার ক্যুয়েবেকে জন্মগ্রহণ করেন। বব ডিলানের চেয়ে বয়সে বছর-ছয়েকের বড়, জন লেননের চেয়ে বছর-পাঁচেকের, একটু বেশি বয়সেই শুরু করেন গানের ক্যারিয়ার। যদিও সম্পূর্ণ পৃথক কোহেনের গানের সাউন্ডস্কেইপ, অভাবিত জটিল বুনটসম্পন্ন তার লিরিকের কথাভাগ, তবু ববি ডি-র পরোক্ষ অনুপ্রেরণায় তিনি গিটার আঁকড়ে গাইতে বেরিয়েছিলেন উত্তাল সেই গানের দশকে, এই স্বীকারোক্তিটি কোহেন বিভিন্ন সময়ে করেছেন। মৃত্যুর দিন-পনেরো আগেও ববি-র নোবেল অর্জনের খবরে নিজের আনন্দ প্রকাশ করে এবং ডিলানকে সম্মান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।
সম্ভবত কোহেন বিরল সৌভাগ্যের এক শিল্পী যিনি মিউজিকের বিনোদনজীবিতার বাইরে থেকেও শ্রোতাদের প্রেম ও শ্রদ্ধা আদায় করে গেছেন জীবনের শেষ দিন তক। বিরল তিনি আরও একটা দিক থেকে, সেইটে এ-ই যে, বিরাশিতে এসেও যিনি নিজের নতুন গান গেয়ে বিদায় নিয়েছেন সবাইকে প্রেম জানিয়ে এবং সবার টুপিমুক্ত শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা কুড়িয়ে।
কোহেনের শুরু হয়েছিল কবিতাবই প্রকাশের মাধ্যমে। কবিতাবই বেরিয়েছে এর পরেও অবশ্য। উপন্যাস বেরিয়েছে। লেনার্ডের কবিতা ও উপন্যাস ক্যানাডার পাঠকের প্রেম পেয়েছে, সর্বোচ্চ সম্মানের পুরস্কারগুলোও লভেছে লেনার্ডের অক্ষরমাধ্যমে মুদ্রিত সাহিত্যকর্ম। কোহেনের গানের টেক্সট প্রত্যেকটাই কবিতা। ডিলানের গানে যে ব্যাপক প্রগলভতা পাওয়া যায়, বেশিরভাগ সময়ে একটা গানকে অ্যাপ্রিশিয়েট করতে যেয়ে যেমন কথার বার্তা হিশেবে আমরা বলে থাকি যে গানটা কবিতা হয়েছে, সেসবের একদম উল্টো কোহেনগান। কবিতা করতে যেয়ে গানের দাবি অগ্রাহ্য করেননি তিনি, কিংবা গান করতে যেয়ে কবিতাগুণের সঙ্গেও আপোস করতে হয়নি, মিতকথনের এবং ইঙ্গিতের-জাল-বিছানো অন্তরালবৈশিষ্ট্যের বৈভব বহন করছে লেনার্ড কোহেনের আজীবনের প্রত্যেকটা লাইন প্রত্যেকটা গানসংকলন।
অক্টোবরেই রিলিজ হলো কোহেনের ফোর্টিন্থ অ্যালবাম ‘য়্যু ওয়ান্ট ইট ডার্কার’, নভেম্বরেই চলে গেলেন শিল্পী। বিরাশি বছর বয়সে এই প্রস্থান নিয়ে বিশ্বজোড়া তার শ্রোতা ও সংগীতসমুজদারদের আক্ষেপ থাকলেও কোহেন নিজে কিন্তু কথাবার্তায় হৃষ্টচিত্তে সমাপনী কর্তব্য সমাধা করছিলেন অনেক দিন ধরেই। ২০১৪ সনে ‘পপ্যুলার প্রোব্লেমস’ অ্যালবাম রিলিজের পরে বেশকিছু জায়গায় ইন্টার্ভিয়্যু দিতে যেয়ে নিজের কর্তব্য সম্পন্ন হয়েছে বলছিলেন। ২০১৬ সনের অক্টোবরে শেষ অ্যালবাম মুক্তির লগ্নে তো বলেই ফেললেন, “আই অ্যাম্ রেডি টু ডাই। আই হোপ ইট’স্ নট টুয়্যু আনকমফোর্টেবল। দ্যাট’স্ অ্যাবাউট ইট ফর মি।” ঠিক পরেই অবশ্য অন্যত্র দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবার অভীপ্সাও প্রকাশ করেছেন, বলেছেন যে ওই মৃত্যুপ্রস্তুতির কথাগুলো ‘একটু বাড়িয়েই বলা হয়ে গেছে’, বলেছেন, “আই হ্যাভ অলোয়েজ্ বিন্ ইন্টু সেল্ফ-ড্রামাটাইজেশন।” কথাগুলো বলছিলেন তিনি মাত্র গত মাসেই, এবং বলছিলেন, “আই ইন্টেন্ড টু লিভ ফরেভার।”
বিদায় নিলেন লেনার্ড কোহেন। বিংশ শতকে আবির্ভূত অসামান্য প্রতিভার এই শিল্পীর জীবনাবসান হলো গত ৭ অক্টোবর, যদিও অফিশিয়্যালি ডিক্লেয়ার করা হয়েছে মৃত্যুর দিন-তিনেক বাদে লেনার্ডতনয় অ্যাডাম কোহেনের বরাত দিয়ে। অ্যাডাম কোহেন ‘য়্যু ওয়ান্ট ইট ডার্কার’ অ্যালবামেরও প্রোডিউস্যর। লেনার্ড কোহেনের ফেসবুক পেইজে অ্যাডামের ঘোষণা থেকেই বিশ্ববাসী জানতে পারে যে লেনার্ড লস্-অ্যাঞ্জেলেসে তার নিজ বাসভূমে শেষ নিঃশ্বাসটি নিয়েছেন পরম শান্তিতে। লস্-অ্যাঞ্জেলেসেই শিগগির স্মরণসভার আয়োজনও করা হবে বলে জানানো হয়েছে লেনার্ডের পরিবার তরফ থেকে।
বিশ্বের প্রায় সমস্ত প্রভাবশালী মিডিয়ায় লেনার্ড কোহেনের মৃত্যুসংবাদে শুক্রবার ছেয়ে ছিল। ‘দ্য রোলিংস্টোন্স’ সহ অন্যান্য সংগীতপত্রিকাগুলোর অনলাইন ভার্শনে লেনার্ডস্মারক নিবন্ধ-প্রবন্ধ ও অবিচ্যুয়্যারি দিয়ে শিল্পীর প্রস্থান সম্মান জানানো হচ্ছে। এই রিপোর্ট প্রণয়ন পর্যন্ত বাংলাদেশের ওয়েবপোর্টালগুলোতেও কোহেনের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।