আবু হেনা চৌধুরী প্রয়াণের একদশক : স্মরণে ও শ্রদ্ধায়োজনে সিলেট নগরী
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ অক্টোবর ২০১৬, ১২:৩৯ অপরাহ্ণ, | ১৮৮১ বার পঠিত
মাহি রহমান : বিগত প্রায় চারদশকের সিলেটে সমাজরূপান্তর এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-শিক্ষাক্ষেত্রিক পটনির্মাণ ও পর্বান্তরের সক্রিয় লড়াকু হিশেবে আবু হেনা চৌধুরী কৃত্যগুণেই গ্রাহ্য ও সর্বমহলে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত। ২৪ অক্টোবর ২০১৬ দশম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের মধ্য দিয়ে নগরীর সর্বসাধারণের নিকট বরেণ্য এই ব্যক্তিকে স্মরণ করলেন এবং শ্রদ্ধা জানালেন তাঁর গুণানুরাগী বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ। সোমবার দিনসূচনা থেকে দিনাবসান অব্দি আবু হেনা স্মারক বিভিন্ন সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবার খবর পাওয়া গেছে। আয়োজক তরফ থেকে প্রেরিত সংবাদবিজ্ঞপ্তি এবং প্রতিবেদক কর্তৃক অনুষ্ঠান দলিলায়নের সূত্র থেকে এই প্রতিবেদন প্রণীত।
সোমবার দিনব্যাপী আবু হেনা চৌধুরী মৃত্যুবার্ষিকী পালনের সাম্বৎসরিক আয়োজন হিশেবে একদিকে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি সিলেট জেলা শাখা আয়োজন করে শ্রদ্ধার্ঘ্য তর্পণ ও স্মরণের প্রভাতী জমায়েত, অন্যদিকে ন্যাশন্যাল্ ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট এনডিএফ সিলেট জেলা শাখা আয়োজন করে একটি পৃথক গণজমায়েত স্মরণানুষ্ঠান।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি সিলেট জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক আবু হেনা চৌধুরী বৃহত্তর সিলেটে শিক্ষক সমিতি পত্তনির গোড়া থেকে এই শিক্ষক-ও-শিক্ষাকল্যাণমূলক সংগঠনের বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন যা জাতীয় পরিসরেও প্রশংসিত হয়েছে। কেবল সাংগঠনিক সক্রিয়তাই নয়, আবু হেনা চৌধুরী শিক্ষকপ্রশিক্ষণ কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় এবং স্বতঃস্ফূর্ত প্রবণতা থেকে একের পর এক শিক্ষকনির্মিতির কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে নিভৃতে। জেলা শিক্ষক সমিতির শুরুয়াতের সময় থেকে অসংগঠিত ও অপেক্ষাকৃত তরুণ শিক্ষকদের মধ্যে নেতৃত্বগুণের স্ফুরণ ত্বরান্বিতকরণে আবু হেনা চৌধুরীর অবদান অকুণ্ঠ স্বীকার করেন তাঁর হাতে কর্মদীক্ষাপ্রাপ্ত তৎকালীন তরুণ শিক্ষকদের অনেকেই। স্মৃতিরোমন্থনকালে এই কথাগুলো অনুরণিত হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষকনেতাদের বক্তব্যে।
সকালবেলায় সিলেটের হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর দরগা প্রাঙ্গণ সংলগ্ন কবরস্থানে মরহুমের সমাধিতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি সিলেট জেলা শাখার পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি সিলেট জেলা শাখার সভাপতি এ.এইচ.এম. ইসরাইল আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মো. শমসের আলী সহ শিক্ষক সমিতির জেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারী, শিক্ষার্থী এবং মরহুম আবু হেনার অনুরাগী বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবীবৃন্দ। প্রয়াত আবু হেনা চৌধুরীর পরিবারবর্গের পক্ষে সহোদর জিয়াউর রহমান শিপার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অপরাহ্নের দিকে এনডিএফ আয়োজিত স্মরণসভা ও জনসমাবেশে নগরীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার চত্বরে আবু হেনা চৌধুরীর রাজনৈতিক সক্রিয়তার দিনগুলোর বর্ণনা করেন তাঁর সাংগঠনিক বন্ধুনেতৃবৃন্দ। বক্তারা ষাটের দশক থেকে আশির দশকের শেষাবধি আবু হেনা চৌধুরীর তৃণমূলমন্থিত গণসম্পৃক্ততা ও অনন্য সাংগঠনিক তৎপরতার কৌশল সমেত বিভিন্ন অধ্যায়ের চকিতচিত্র তুলে ধরেন। অত্যন্ত অন্তরালপ্রিয় অথচ দৃপ্ত নির্ঘোষ নীতির চরিত্র ছিলেন আবু হেনা; তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও অনাপোস দৃঢ়চেতা মানসিকতা তাঁকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির বাংলাদেশে মূলধারা রাজনীতি থেকে শেষদিকটায় নিস্পৃহ করে রেখেছিল বলেও বক্তাদের কেউ কেউ মতপ্রকাশ করেন। এনডিএফ নেতৃবৃন্দের মধ্যে শ্যামল কুমার ভৌমিক, অ্যাডভোকেট কুমার চন্দ্র রায় প্রমুখ ছাড়াও সংগঠনের প্রতিনিধিগণ্য নেতা-কর্মীরা উন্মুক্ত স্মরণসমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
উল্লেখ্য, মরহুম আবু হেনা চৌধুরী সিলেটের মেহনতি জনতার অধিকারভিত্তিক রাজনীতির পক্ষে একজন অগ্রগণ্য নেতা। আজীবন কাটিয়েছেন তিনি সাধারণ মানুষের মতো লড়াকু ও আপোসহীন। অত্যন্ত সৎ ও সমাজহিতৈষী সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন সর্বমহলে গৃহীত। পেশাগত জীবনে তিনি শিক্ষকতা করে গেছেন গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য, তবু রাজনীতি থেকে অর্থোপার্জন করেননি একটি কপর্দকও। অন্তিমের দশকে আবু হেনার রাজনীতিবিদ পরিচয়ের চেয়ে আদর্শ শিক্ষকপ্রতিমূর্তির পরিচিতি গড়ে উঠেছিল এবং বিস্তার পেয়েছিল গোটা বিভাগীয় তল্লাটে। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী দি এইডেড হাইস্কুল ছাড়াও অন্যান্য কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্রমোন্নয়নে আবু হেনা চৌধুরীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। দি এইডেড হাইস্কুলে শিক্ষকতায় জীবনের অধিকাংশ কাল অতিবাহিত করলেও স্কলার্সহোম বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগ প্রতিষ্ঠাকরণে শেষ বছরগুলোয় তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন। ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে মরহুম আবু হেনার অসংখ্য গুণগ্রাহী শিক্ষার্থী-শিষ্য ও অভিভাবক দেশের ভিতরে এবং বাইরে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছেন।
মরহুম আবু হেনা স্মরণে জেলা শিক্ষক সমিতি এবং ন্যাশন্যাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের কর্মসূচি পালন ছাড়াও শ্রমিক সংগঠনগুলোর বেশকিছু অনুষ্ঠানের সংবাদ পাওয়া গেছে। এছাড়া ‘আবু হেনা সুহৃদ সংঘ’ তাদের নিয়মিত কর্মসূচির আওতায় এই দৃষ্টান্তস্বরূপ মহান ব্যক্তির কর্মময় জীবন পুনরীক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছে। সুহৃদ সংঘের উদ্যোগে একটি স্মৃতিগ্রন্থ প্রকাশের কাজ সম্পন্ন হয়েছে আবু হেনা চৌধুরী প্রয়াণের দশকপূরণলগ্নে। আগামী নভেম্বরের মধ্যভাগে একটি অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আবু হেনা স্মারক এই গ্রন্থটি পাঠকনাগালে আনা হতে চলেছে বলে প্রকাশকসূত্রে জানা গেছে।