অভিমান ও বেদনার চিরকালীন পদাবলী । এহসান হায়দার
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ অক্টোবর ২০১৬, ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ, | ২১৯৪ বার পঠিত
এক
‘আমি বহুদিন একা একা প্রশ্ন করে দেখেছি নিজেকে’ ভালবেসেছি যে আঙুল, সে হাতের কররেখার সাথে কোনদিন কোন সম্পর্ক ছিল কী আমার। যদি না থাকে তবে কোন ছোঁয়ায় আমি এতো বিহ্বল নিজেরই বিস্তার ধরে রাখি জ্যোৎস্নায়। ‘পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্না ভেজা চোখ’ নিঃসঙ্গতার একাকীত্ব নিয়ে কখনো কি একাত্ব হতে পেরেছে পৃথিবীর। কখনো কী ক্ষুধার অভিমান অবলীলায় খাদ্যের জোগানদাতা হয়ে বলতে পেরেছে এই নাও গোলাপের পাপড়ির মতন ভাত আর পৃথিবী থেকে অনাহারকে চলে যেতে বলো। অথবা সবিতার কথাই ধরো না দুঃসময় দেখে দেখে আগুনের চেয়ে দাহ্য সে আজ কিন্তু কি উত্তেজনা ছিল, ছিল স্পর্শকাতরতা ‘ও বড় পক্ষপাতী, জীবনের দিকে ওর পক্ষপাত চিরদিন’ অথচ সুসময়ের অপেক্ষায় দুঃখরা কালো হয়ে গেল আর ‘আমাদের জীবনের অর্ধেক সময় তো আমরা/ সঙ্গমে আর সন্তান উৎপাদনে শেষ করে দিলাম’এখন শশ্রুষার ভাষা ভুলে ধ্বংস চাই, ধ্বংস চাই বলে— ক্রমাগত বাড়ছে রিরংসা আর ঘৃণা অথচ শান্তির শর্তে আমরা কি না বিসর্জন দিয়েছিলাম; আজ আর কারোরই সে তালা দেওয়া আলোর কথা মনে নেই। শুধু ‘সেলাই কলের সুঁতোর মতোন কত হাত/ রক্ত নামিয়ে দিচ্ছি ভাগ্য বুননে!’ অথবা সেই সব শঠতা আর খল জীবনের কথা মনে করে নেওয়া যাক স্বপ্নের বোঝা কাঁধে তুলে দিয়ে যারা জীবনকে বেঁচে দিল মাঝ রাস্তায় আর রক্তাক্ত স্বপ্নের দমবন্ধ চিৎকারে মানুষের হৃদয় কেঁপে ওঠার বদলে সুবিধাবাদের বীজ উগড়ে উঠল। অনুভূতি ও পণ্য হয়ে উঠলো। প্রত্যেকে প্রত্যেককে বেঁচতে-কিনতে শুরু করল, যন্ত্রণার ছবিগুলো অনাচারের স্মৃতিগুলো একই ভাষায় কথা বলতে থাকলো যা আগেও বলেছিল শত্রুদের ইতিহাস। কোন কিছুই যেন বদলায়নি শুধু ঠিকানা বদল হল আর পরিচয়ের আবর্তে অভিযোগ মুখ লুকিয়ে টেপরেকর্ডারের মতন হারিয়ে গেল, প্রতিবেশী হয়ে উঠল সন্দেহপ্রবণ আর জীবন হয়ে গেল নিরাপত্তাহীন ‘নইলে মানুষের দরোজায় টোকা দিলে কেন আজ দরোজা খোলে না?’ কী নিদারুণ এক পৃথিবী আমাদের সামনে এসে টান মেরে খুলে দিলে এমন একটা কবাট যেখানে যাওয়ার জন্য কোনদিন প্রস্তুত ছিল না মানুষের ইতিহাসের। তবু সে প্রবল আকাক্সক্ষায় ঢুকে পড়ল সেই অস্পষ্ট ঘোলাটে আলোর রঙবাহারী মুখরতায়। কত কত রীতিনীতি শৃঙ্খলা সংঘ যোগ হল পৃথিবীতে মানুষের স্নায়ুতে জাগলো না জ্ঞান আর মাধুর্যের প্রকৃত আলো। কেননা সংঘের সংঘাতেই পুনরায় নেমে এল যুদ্ধের তা-ব আর আগুনের শোণিত শোষনে পুড়ে গেল স্বপ্ন প্রেম ভালবাসা আর যা কিছু একই সঙ্গে ব্যক্তিক ও সামষ্টিক। ছারখার হয়ে গেল সাইকেল দিন তৃষ্ণার্ত ঘৃণা ক্লান্তিহীন সুবিস্তৃত শূণ্যতার জন্ম দিল তাই আর মানুষের গন্তব্য বলে কিছুর অবশিষ্ট থাকল না, থাকল না সুস্থিতি নিয়ে ঘরে ফেরার সম্ভাবনা। ‘বেদনার বিষবাষ্পে জর্জরিত এখন চতুর্দিকে খাঁ খাঁ খল।’ রক্তপাত, গুপ্তহত্যা জ্বলছে, শহর জ্বলছে হৃদয়, জ্বলছে রাজনীতি, জ্বলছে মানুষের তীব্র অধঃপতন। ঠিক তখন তখনই ‘কার কাছে বয়ে নিয়ে যাবো এই কুয়াশা অস্তির শিলা রক্তের আগুন?’ ঠিক এমনই অনুযোগের গভীর থেকে গভীরতর স্তরে যে ভালোবাসার শ্রভ্রতা লুকিয়ে থাকে যে আকাক্সক্ষা, যে উৎসাহ, যে উচ্ছ্বলতা, যে অভিমান-অনুযোগ, সে গহীনের বিবর্ণ কবি হলেন আবুল হাসান। যাকে পাঠ করলে ঠিক যেন শিল্পের সাথে মানুষের যে প্রথাগত মূল্যবোধ ও ধারণার একঘেয়ে পরিচয়, সেই পরিচয়ে ঠিক বিপরীত না হলেও কিছুটা ছন্দহীন কিছুটা ঠোঁটকাটা কিছুটা অনাদর কিছুটা তাচ্ছিল্য কিছুটা রঙহীন কিছুটা আদি তমসার গন্ধ নাকে তীব্র নয় আবার ক্ষীণও নয়-এমন একটা ঘ্রাণ, যা ঘ্রাণ সম্পর্কে যে তথ্যগত পরিচয় তার চেয়েও অধিক কিছু যাকে ঠিক মুহূর্তে বিশ্লেষিত করে নেয়া যাচ্ছে না কিন্তু সঙ্গেই থেকে যাচ্ছে এমন অনুভূতিগুলোর সামনে এনে দাঁড় করায়। কেউ কেউ সামগ্রিকতার ভাষ্য দিয়ে নিজের কথা বলে আবার কেউ একান্ত ব্যক্তি ভাষ্যের মধ্যে দিয়ে সামষ্টিক ভাষার প্রতিছায়া রূপে প্রকাশিত হয়। আবুল হাসান দ্বিতীয় প্রকৃতির ভাষ্যকার। খুবই ব্যক্তিক একজন কবি। যে তার প্রাত্যহিক জীবনযাপনের উপাদান অনুসঙ্গ এবং অনুভূতির মধ্য দিয়ে সমষ্টির সংকট প্রেম বেদনা অভিমান হতাশাকে বুঝে নেয়। এবং যে স্বাভাবিক ও সাবলিলভাবে নিজের প্রত্যহ অভিজ্ঞতার আকর্ষণ-বিকর্ষণ ও বিচ্ছিন্নতার সাথে সাধারণ ভঙ্গিতে কথা বলেন তা তার সময়সাময়িক কবিদের মধ্যে খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। আবুল হাসান শিল্প বিষয়ক প্রথাগত আধিপত্যবাদি ধারণাগুলোর বাইরে থেকেই সে কথাগুলো অনেক সচেতনভাবেই উচ্চারণ করেন। তার শিল্প ধারণা খুবই শিল্পহীন একটা শিল্প তৈরি করেছিল। যেখানে অলঙ্করণের প্রতি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে যে মোহহীনতা এবং স্পষ্টভাষীতা এই দু’টি কারণই যথেষ্ট ছিল- তার সময়ে তার প্রতি সকলকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে দিতে। এখানটাতেই কবি হিসেবে আবুল হাসানের সতন্ত্রতা। এই নিজস্বতা কবির স্বতঃস্ফূর্ত ঐশ্বর্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। শিল্প, শিল্পরূপ, শিল্পের নানা ভঙ্গি, নানান কাঠমোর একটা আগ্রাসন সব সময়ই বর্তমান থাকে। নিজের অনুভবের ভাষায় কথা বলে যাওয়াটা খুব সহজ নয়। কিন্তু সেই সব কিছুকে অগ্রাহ্য করতে সেই পারে নিজস্বতার স্বরকে ভাষায় পরিণত করতে, যার মধ্যে অনুভবের পূর্ণতা আছে, আছে অনন্ত তৃষ্ণার শিশুতোষ বিস্ময়। অনুভবের সেই ভূমিতে দাঁড়িয়ে গেলে আর কোন অবলম্বনেরই প্রয়োজন পড়ে না। আবুল হাসানেরও পড়েনি। ‘এবার আমার ঝরাপাতার শস্য হবার দিন এসেছে,/ শস্য কুড়োই, শস্যমাতা।’
দুই
‘কেন তুমি আমার সবকিছুর সঞ্চয়ে নির্মিত হয়েছো এইভাবে?’ কি এমন ছিলো অস্থিরতা, ‘পাখির ভিতর শাদা পালকের গুচ্ছ গুচ্ছ গভীর জগতে/ একটু একটু/ জন্ম নিয়েছে তোমার গ্রীবা, তোমার গ্রন্থিল বাহু’যদি জখম করে চলে যাবে, চলে যাবে তৃষ্ণার্ত চাতকের মতন ছুঁড়ে ফেলে। ‘কেন? কেন? কেন?’ অর্পন করেছিলে চোখের নীল মমতা। যে বেদনাকে ভিতরে লালন করেছি তার কোন মৃত্যু নেই। অন্ধকারের দিকে হেঁটে যেতে যেতে রৌদ্রের ভয় ঘুনপোকার মতন সব খেয়ে নিয়েছে। কোথাও কোন সূর্যলতা নেই ‘ গোলাপ নিজেই কেন এত কীট’। বেদনার বর্শা হাতে রোজ শিকারী মানুষেরা আসে জীবনের সবুজ গহীন রহস্যের ছায়াগুলি বিদ্ধ করে এতো কালো রক্ত হৃদয়ের স্বচ্ছতম মমতার কোঠর থেকে ছিটকে বেড়িয়ে আসে। বৃক্ষহীন তীর্যক এই সূর্যের নিচে আজ আর কোথাও তুচ্ছ বলে কোন কিছুরই মূল্যও যেনো নেই। মানুষ নিজেরই অজান্তে নিজেকেই ক্রমশ করেছে মূল্যহীন। এ কোন অন্ধকারে গভীর তলিয়ে যাচ্ছি অতল। নিমজ্জিত জীর্ণতায় কি এতো সুখ। মানুষের শুভ্রতাকে শান্তিকে নিঃশেষ করে কোন সুন্দর তুমি ফুটতে চাইছো হে পৃথিবী। ‘কাকে তুমি তমসায় তীব্র করো, তুচ্ছ করো, কাকে রাখো, কাকে ফেলে দাও,/ উচ্ছিষ্ট ভাতের মতো। কুকুরের মতো।’ এমনই অজস্র প্রশ্ন আর প্রশ্নের আপাতঃ উত্তরের মধ্যে ঢুকে গিয়ে আরো গভীর প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন আবুল হাসান। আর সেই প্রশ্নের কাছে কবির যা প্রার্থনা তা আমাদের হৃদয়ে সংক্রমিত হয়। আমরাও ভাষা ও ভাবনার সমাধান সন্ধানে নেমে পড়ি। কিন্তু কি বিষ্ময় এবং একঘেয়ে এক জীবনের বৃত্তে আমরা এখনও ঘুরছি আর ঘুরছি ঘূণির্র রূপ ছন্দের বদল হয়, পদ্ধতি পাল্টায়, ছুরির ধারে কাটতে কাটতে কাঁটারাইফেলের সামনে এসে উপস্থিত হই সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচতে ঘরের মধ্যে তালা দিয়ে ঢুকে পড়ি আর দরজা ভেঙ্গে অকৎসাই কারা কখন ঢুকে পড়ে ভয়। উৎকন্ঠা, হতাশা, নিরাপত্তহীনতা অর্থনীতি রাজনীতি কোন কিছুরই যেনো কোন মানবিক বদল নেই। সবখানেই শুধু হিংসা বিদ্বেষ সন্দেহ ক্রোধ নৈরাশ্য লালশা আরো কত কত মনস্তত্ব প্রতিনিয়তই হামলে পড়ছে, আঘাত করছে, হত্যা করছে, গুড়িয়ে দিচ্ছে আর আমরা হতবাক বিহ্বল নির্বিকার তাকিয়ে ক্ষুধার দিকে, শিশুর দিকে, আগামীকালের উদ্ভট একটা সুস্থিতির দিকে উত্তেজনাহীন নিঃসঙ্গ বেঁচে থাকার এক ক্ষয়িষ্ণু যুদ্ধের নিরুপায় সৈনিক হেঁটে চলছি এমন একটা অন্ধকারের দিকে যাকে আলো বলেই স্বীকৃতি দেওয়াটাই আমাদের কর্তব্য বলে ধরে নিয়েছি। এইসব টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়েই তো আবুল হাসন আমাদের সামনে আরো স্পষ্ট ও সেই অন্ধ জাগরণের পাথরগুলির মতন হৃদয়ে জেগে বসেন। কোন ভাবে যাকে সরিয়ে ফেলা যাচ্ছে না, কোনভাবেই তাকে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না কোনভাবেই তাকে কল্পনা বিলাসী কোন ভাষ্যকারের মতন হঠাৎই ভুলে যাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের সকল অনুভব পরিস্থিতির হতাশা ভালোবাসার ভালোবাসাহীনতার রুগ্নতার হীনমন্যতার সাথে তিনি যেনো অখন্ডভাবে জড়িয়ে আছেন, জড়িয়ে আছেন দীর্ঘশ্বাসের মতন এ কথা নিশ্চিয়ই আবুল হাসানের কবিতার পাঠক মাত্র-ই অনুভব করে থাকেন। তাহলে মূল্যায়ন কী হবে, আবুল হাসানের কবিতার?
সত্যের আসলে আলাদা কোন মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে না, সত্য এতোটাই উজ্জ্বল এবং বাস্তব যে তাকে শুধু অনুভব করা যায়, যাপন করা যায়, আর্তি নিয়ে, কান্না নিয়ে, সেই একই হতাশা নিয়ে নিঃশ্বাসের সাথে জীবনকে ভাগ করতে নিয়ে, যা কবিকেও বিচলতি করেছে ভাবিয়েছে এবং তার ভাবনার তরঙ্গ ঢেউয়ের দোলা এখনও আমাদের বাস্তবতার সাথে নিবিড় ভাবে সম্পর্কযুক্ত রয়েছে। এই অনুভবের সম্পর্কই আবুল হাসানের পাঠে আমাদের বারে বারে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। নিয়ে যায় সেই স্বচ্ছ আলোর দিকে যেখানে রোদের বহু রঙিণ আলোয় ও তাপে আমাদের প্রতিদিনকার জীবন গতিময়। আবুল হাসান তার ভাষাকে এমন ভাবে আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেন যাকে স্পর্শ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। হৃদয়ে গহীনাঞ্চলের যে ডাক তার সাড়া না দিয়ে কি চুপ থাকা সম্ভব হয়, হয় না। হাসানের সচেতন স্বজ্ঞান, আমাদের মরীচা পড়া অনুভবের দরজার কবাটে, এমন স্বশব্দ আছড়ে পড়ে যে সকল শঙ্কা ও সংঘর্ষের সমূহ সম্ভাবনা থাকা স্বত্ত্বেও আমরা সেই চেতনার কবাট খুলে সূর্যের মুখোমুখি হই। যাকে বহুকাল ধরেই এড়িয়ে গেছি, দৃষ্টিকে বাধ্য করেছি সেখানে না পড়তে। এমনই সব সংক্রিয় অনুভব প্রবাহ হাসানের কবিতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তার সাথে যে কোন সময়ের পাঠকই একটা অন্তর্গত সম্পর্কের টান অনুভব করে। সেই টান আর গোপনে বারুদের বীজ বুনে দেওয়ার যে সূক্ষ্ম সচেতন শৈল্পিক কৌশল আবুল হাসান রপ্ত করেছিলেন তা প্রকৃত শিল্পীর পক্ষে সম্ভব। যে অন্তর্নিহিত বোধের ¯ফুরণের মধ্যে দিয়ে শব্দালোর বিশাল শস্য ভান্ডার হাসান অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সঞ্চয় করেছিলেন এখনও আমরা শিল্পের আহার সংগ্রহে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হই। অথবা বলা যেতে পারে স্পষ্ট ভাষায় নিজের কথাটা নিজেকে বলা যখনই অনিবার্য হয়ে উঠবে আবুল হাসান তখনই প্রাসঙ্গিক ভাবে আমাদের গন্তব্য হবেন। এটাই তো আবুল হাসান ও তার কবিতার অভিযান। যে অভিযানের লক্ষ্য পথে যে শান্তি-শুভ্রতার কথা তিনি আজন্ম ভেবেছেন লিখেছেন তার সাথে আমাদের কোন বিচ্ছেদ ঘটেনি। কেননা আমরাও সেই একই শুভ্র শান্তির জন্য দীর্ঘকাল ধরে অপেক্ষায় বসে আছি। অথচ সে আসে না। সে প্রতারণা করে। সে ষড়যন্ত্রের স্বরে চেচিয়ে ওঠে, খুবলে ধরে, তাই সব বিচ্ছিন্নতাকে ছিন্ন করে হৃদয়ের হোমানল জ্বালিয়ে প্রতিটি প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে সেই একই কথা বলে উঠবার সময় এখনও একটু বদলায়নি ‘রক্তমাখা দুঃখের সমাজ কিছুটা বদলাতে হবে…’ কবির অভিজ্ঞতা অনুভব ও শিল্পী হিসেবে যে সামাজিক দায়বদ্ধতা আবুল হাসান কোথাও একটুও ছাড় দেননি। বরং বলা যায় তার যে তাচ্ছিল্যের ভাষা, কৌতুকের ভাষা, ঘৃণার যে বহিঃপ্রকাশ, ক্ষোভের যে তীর্যক রূপ তার ভেতর একটা অদ্ভূত কাব্যিক ব্যঞ্জণ রয়েছে। অনেক সরাসরি অনেক স্পষ্ট ভাষায় সেগুলি প্রকাশ করার তার যে নিজস্বতা তা একজন মানবিক সমাজ সচেতন কবির পক্ষেই সম্ভব। তিনি কোন নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে দিয়ে নিজের সচেতন কবিত্বের প্রকাশ করেননি। তিনি এক নির্মল শান্তি প্রার্থনা করেছেন শুধু। যে শান্তি কেবল মানুষের প্রাণের সম্মিলনেই সম্ভব। কেননা সকল প্রাণের একটা স্বাভাবিক সম্মিলন তৈরি না হলে কোন মানবিক কাঠামোই তার সুনির্মিত অভিষ্টের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। দায়িত্ববোধের গভীর প্রয়োজনীয়তার অবস্থান থেকে তিনি তার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কবিতাকে। আমরা খেয়াল করলেই দেখতে পাবো হাসান এমন একটা সময়ের কবি যখন এই ভূখন্ডের এক নতুন দিক চিহ্নিত হয়ে গেছে। লড়াই সংগ্রাম এবং পাওয়া-না পাওয়ার তীব্র সংঘর্ষে মধ্যে দিয়ে নতুন একটি জটিল সমাজ কাঠামো গড়ে উঠছে। সেখানে প্রাণ আছে, প্রতারণা আছে, ক্ষোভ আছে, অনুতাপ আছে, বিচ্ছিন্নতা আছে, বিশৃঙ্খলা আছে কিন্তু সব কিছুর পরও একটা স্বপ্ন একটা সুগভীর উদ্দীপনা আছে যে স্বপ্নের সেই আকাঙ্খিত মুহূর্তগুলিকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে হলে প্রবল উৎসাহে স্বপ্নকে গড়েপীঠে নিতে হবে। আর এই নির্মাণের সময় কোন অবহেলা উদাসীনতা অবক্ষয় মোটেও কাম্য নয়। কিন্তু সব কিছুই তো একেবারে নিখুঁত ভাবে হয় না। অথচ হওয়ার যে সম্ভাবনা সে সম্ভাবনাকে যারা ভূলুন্ঠিত করে, বিলম্বিত করে তাদের দিকে তীর্যক দৃষ্টি রাখতে হয়, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের নেতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয় নিরলসভাবে। এ কথা আবুল হাসান খুব ভালভাবেই অনুভব করতেন। তাই তার অবস্থান থেকে যতোটুকু সক্রিয়ভাবে এই সাংস্কৃতিক রূপান্তরের জন্য প্রাণ ও স্বজ্ঞানের সঞ্চালন করা সম্ভব সে কাজ যে তিনি নির্ভুলভাবে করেছেন তা আবুল হাসানের কবিতা পাঠ করতে থাকলে আমরা নিবিড়ভাবেই দেখতে পাবো। শিল্পের অনুভবের মধ্যে দিয়ে যতো দ্রুত মানুষের হৃদয়কে নাড়িয়ে দেওয়া যায় আর কোন মাধ্যম নেই যা দিয়ে মানুষের অন্তর্গত মনস্তত্বের দরজায় টোকা দেওয়া যায়। তিনি সেই ধীর অথচ সবচেয়ে জরুরি সংগ্রামটাই নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। কারণ তিনি গভীর ভাবে বিশ্বাস করতেন ‘শিল্প তো নিরাশ্রয় করেনা, কাউকে দুঃখ দেয়না’।
তিন
হঠাৎ যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়, ঘুম ভেঙ্গে যায় কামুক ভীষণ, কোন আঁধারের ঠোঁটে চেপে রাখবে তুমি ধরে তারে। রক্তে আগুন নৃত্য করে ক্ষুধার জ্বালা, সমুদ্র কি বনভূমি উথাল-পাথাল স্রোতস্বিনী জীবন তোমার শিশুর মতন হেসে উঠে। কোন আকাশের আঙুল চেপে আলোর ভিতর ‘সূর্য ঘেরা সকল দেয়াল ভেঙ্গে তুমি কোথায় যে যাও…’ ক্লান্ত মানুষ, ক্ষান্ত মানুষ কসাইখানার অন্ধকারে নিঃশ্বাসের ঐ ছুরির নিচে কে তুমি আজ ভালবেসে এগিয়ে যাও যখন ‘অসুস্থতা, অসুস্থতা আর ক্ষত সারা দেশ জুড়ে হাহাকার’। তখন কোন অংহকারে তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো কস্তুরী চোখের কুৎসিত আহ্বানে। ছিলাম তো হৃদয়ের গহীনে স্পর্শ ‘তোমার সরল হাতে একটু সরল স্পর্শ’ কিন্তু কোন খেয়ালে ‘লোভের ঘৃণা বলি’ আমি আবোধ বোধের অন্ধ চোখে দেখতে পাইনি ‘শস্যগুচ্ছ’। এ অপরাধ যন্ত্রণা দেয় বুকের ঘরে হাঁপর চালায়। এখন যখন দু’চোখ খোলা বুঝতে পারি কি হারিয়ে শস্যবীজের খুন করেছি ‘আজ তাই নুয়ে বলিঃ/ আমাকে শেখাও ঋতু, শেখাও মৌসুম!’ আমাকে শিখিয়ে দাও অরণ্য উত্তেজনা তুমুল গাঢ়। ‘বুকের মধ্যে কিসের একটা কঠিন দুঃখ রুক্ষ দুপুর শাসন করে’ ধরি তারে, পাশে বসি আবার দেখি হঠাৎই সে উধাও কোথায়। অবহেলা অনাদরে সময় কাটে ‘লক্ষ্যবিহীন’। ভালবাসার জন্য এতো স্বচ্ছলতা চাইবে তুমি বুঝিনি তো! তবু আমি ‘খড়কুটো শালুকের ফুল… অনড় শামুক’। তোমার দিকেই ধীর গতিতে এগিয়ে যাই এগিয়ে আসি অবিনাশী। এই তো এক জগৎ যেখানে সরলতা আর শুভ্রতায় সব ব্যাথা উৎসাহ হয়ে নতুন উপেক্ষার সামনে এসে হাজির হয়। মানুষের নিজস্ব গহীনাঞ্চলের যে ভাষা তার একটা আশ্চর্য ছন্দ আছে আবুল হাসান যখন প্রেমের কথা ভালবাসাহীনতার কথা না পাওয়ার কথা বুঝতে না পারা অবোধ যন্ত্রণার কথাগুলি আকাক্সক্ষাগুলির অভিলাষগুলির কথা ঝুর ঝুর ঝরে যাওয়া স্বপ্নগুলির কথা অনর্গল বলতে থাকেন তখন কী এক ছন্দ সৌন্দর্য্য এসে আমাদেরও ঘিরে ধরে আমরা আচ্ছন্ন হই অলীক এক মাদকতায় বুদ হয়ে যে যারা অনুভবের ওই সকলের সম্পর্কে সাথে আবারো জড়িয়ে পড়ি। এখানেই তো একজন কবির পূর্ণতা। তার পাঠের মধ্যে দিয়ে পাঠক নিজের গহীন ঢুকে পড়ে সেই সবগুলি অনুভবের হাতে ধরে যা তারই নিজস্ব বলে সে জেনেছে বুঝেছে অনুভব করেছে অথচ এই কথাগুলিই অদ্ভূত ভাবে কেউ তাকে এসে বলে গেছে। আমরা বিহ্বল হবো কান্নায় ভেঙ্গে পড়বো তুচ্ছতার সাথে দেখা হয়ে যাবে কখনো মাঝরাতে অথবা ঝরাপাতা দেখলেই বিড়বিড় করে শব্দ করে উঠবো। হাসানের কবিতার এই সক্ষমতা আরো বহুকাল ধরে আমাদের হৃদয়ের ভাষা হয়ে বার বার- পুনঃবার ফিরে আসবে।