গল্পভাষা অথবা উপরতলা সিনড্রোম (শেষ অংশ) আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ, | ৩৩১৩ বার পঠিত
…
৫.
প্রতিটি শিল্পমাধ্যমের নিজস্ব এক ভাষা-ব্যবস্থাপনা থাকে। বিষয় ও শৈলীর কারিগরি সেই ব্যবস্থাপনার অংশ। জাগতিক অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা ও বর্ণনার তাগিদ গল্প, কবিতা ও আখ্যানের শিল্পমাধ্যমকে পরস্পর থেকে আলাদা করেছে। তাদের মাঝে যথেষ্ট মিলমিশ থাকলেও দিন শেষে স্বতন্ত্র থাকতে ভালোবাসে। মিলন-মোহনায় সমবেত হওয়ার ক্ষণেও পরস্পর থেকে আলাদা হওয়ার বাসনা ভোলে না। কবিতার ভাষা তাই মিলনের তুমুল মুহূর্তে গল্পের ভাষা থেকে নিজেকে পৃথক করে নেয়। আখ্যানের ভাষা গল্পের ভাষাকে চুম্বনে বিবশ করে অন্য পথ ধরে। এইসব বৈপরীত্য ও দ্বিচারিতার মাঝে প্রতিটি শিল্পমাধ্যমের ভাষারা জেগে থাকে। মানুষের সাথে সংলাপ করে। বিচিত্র ধ্যানের লহরীতে পাঠকের চেতনায় প্রাণবন্ত হয়। শিল্প হলো ভাষা দিয়ে ভাষাকে পৃথক করার যুদ্ধ। যে-কারণে পরস্পরের মাঝে অনুপ্রবেশ ঘটা সত্ত্বেও মাধ্যমগুলো একলীন হয় না। আঙ্গিক ও শৈলী দিয়ে নিজের প্রকাশভঙ্গিকে তারা পৃথক করে নেয়। উত্তর-আধুনিক ভাবনার সঙ্গে এই ধারণাটি সাংঘর্ষিক, কিন্তু এখন অব্দি এটা সত্য। গল্পে ভাষা নিয়ে আলোচনার সময় এই পার্থক্যটি টুকে রাখা চাই।
শিল্পের ইতিহাসে একে অন্যকে প্রভাতি করার রেওয়াজ নতুন কিছু নয়। বহুদিন ধরে এটা চলছে। গল্পকারের ভাষা-কৌশলে কবির ভাষা-কৌশল অবিরত ছাপ ফেলে। কবির শরীরে গল্পকারের ছায়া বহনের অনুভূতি অহরহ জাগে। এতোকিছুর পরেও এরা দুজনে এক বিন্দুতে মিশে না। তারা সম্পর্ক করে কিন্তু একদেহে লীন হয় না। আখ্যান-রচয়িতার নিজেকে খুটিনাটিতে বিস্তৃত করার ক্ষমতা দেখে গল্পকার অনেক সময় লোভী হয়ে ওঠে। রবীন্দ্র-সংজ্ঞার পরোয়া না করে গল্প ও আখ্যানের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে দম হারায়। বিব্রত লেখক সেটাকে ‘বড়ো গল্প’ বলে ঢেরা কাটে। আবার ভাষা প্রয়োগে মিতব্যয়ী গল্পকারকে দেখে আখ্যান-রচয়িতা তার পায়ের ছাপ অনুসরণ করে। কিছুদূর গিয়ে ‘দুচ্ছাই’ বলে বড়ো ও ছোটর মাঝখানে এসে থমকে যায়। বিব্রত রচয়িতা এটাকে ‘উপন্যাসিকা’ বলে চালানোর চেষ্টা করে।
সাহিত্যের এসব কাঠামো সত্যি আজব! কিন্তু কিছু করার নেই। এগুলো ভাঙার জন্য অনেক তত্ত্ব জন্ম নিলেও স্বয়ং লেখকরা সেটি মানতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তারা আসলে মিলন চায় না, বিরহে স্বস্তি খুঁজে পায়। শিল্পমাধ্যমের এই স্বাতন্ত্র্যবোধকে এক লহমায় উঠিয়ে দেয়া মুশকিল। ‘চিহ্ন’, ‘রচনা’, কিংবা ‘মুক্তক্রীড়া’ শিরোনামে ঢেরা কেটে দিলে ব্যবধানটি উঠে যায় না। কোথায় যেন স্বাতন্ত্র্য লেগে থাকে। গল্প লেখার সময় বিষয়টি খেয়াল রাখা প্রয়োজন হতে পারে।
রঁলা বার্থ অবশ্য ব্যক্তি লেখককে তার রচনা থেকে ঊহ্য করে দিতে চেয়েছিলেন। লেখা এক সামষ্টিক ও সমবায়ী ক্রীড়া। ব্যক্তিপ্রতিভা সেখানে গৌণ বিষয়। ব্যক্তি মানে হচ্ছে সমবায়, যারা একটি লেখাকে পাঠ করে এবং পাঠের মধ্য দিয়ে সেখানে নতুন কিছু সংযোজন করে। লেখালেখি এক চলমান ‘উইকিপিডিয়া’। লেখার প্রতিটি বাক্য ও শব্দগুচ্ছের মাঝখানে ‘এডিট’ নামের বাটনটি রাখা আছে। ইচ্ছে করলে যে কেউ নিজেকে সেখানে সংযুক্ত করতে পারে। সে চাইলে শব্দ ও বাক্যের অর্থ পালটে দিতে পারে, আবার ওই শব্দ বা বাক্যের রেশ ধরে নতুন অর্থ সেখানে সংযুক্ত করতে পারে। কাজটি কে করছে সেটা মুখ্য নয়, কীভাবে করা হচ্ছে সেটা হলো বিবেচ্য বিষয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ‘মহাভারত’ ও ‘রামায়ণ’-এর আশ্চর্য গল্পভাষা এভাবে গড়ে উঠেছিল। সুতরাং এ-যুগে হতে বাধা কোথায়?
বার্থের ভাবনাটি অভিনব হলেও যুগের অনুমোদন পায়নি সেভাবে। বস্তুবিশ্ব এখন স্বকীয়তার জয়গানে নিজের সীমানা ঠিক করে নিয়েছে। লাউয়ের বীজ থেকে শুরু করে ব্যক্তির দেহ-মন পেটেন্ট ও কপিরাইটে নাটাইবন্দি। জঙ্গল ছেড়ে নগরে উঠার রাস্তায় মানুষের আচরণ ও সমাবেশের ভাষা কেমন হবে সেটা নির্ধারিত হয়ে গেছে। সমাজ সেটা ঠিক করে দিয়েছে। সুতরাং রঁলা বার্থকে নিজের নামে ও পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ‘নামহীন’ লেখার পক্ষে ওকালতি করে যেতে হয়। তিনি পেটেন্টেড ও কপিরাইটেড অবস্থায় মুক্তক্রীড়ার কথা লিখে যেতে বাধ্য হন। গল্পের ভাষা সেই বাস্তবতাকে স্বীকার করে আয়তনহীন অতলে নিমজ্জনের স্বপ্ন দেখে। এটা হলো গল্প ও কবিতা লেখার বড়ো ট্রাজেডি।
আমার কাছে গল্প লেখা একটি লজ্জাস্কর কাজ। কারণ এটা আমাকে নগ্ন করে দেয়। এটা হলো ‘আমি কী বলতে চাই ও কী চাইছি না’ তার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে এই অধম ভাষার তুচ্ছ এক ক্রীতদাস মাত্র। ভাষা নিয়ে গড়ে উঠা বহুবিধ ‘রাজনীতি’র ক্রীতদাস আমি। মুরব্বিরা আমার সীমানা ঠিক করে দিয়েছেন। এর বাইরে যেতে চাইলে ‘নির্বাসন’। এতে অবশ্য আপত্তির কিছু নেই। ‘পরাধীন’ হয়ে থাকার চেয়ে ‘নির্বাসন’ উত্তম বিকল্প হতে পারে। এটা মানুষকে আবার মুক্ত ও আরণ্যিক করবে। সাইবেরিয়ার বরফে দস্তয়েভস্কির উপকার ছাড়া অপকার হয়নি। রাসকলনিকভ হওয়ার দুরূহ যাতনা থেকে মুক্তি লভেছেন। তাঁর মৃগীরোগের বাতিক সম্ভবত সেরে গিয়েছিল। সাইবেরিয়ার অঢেল ও হিংস্র তুষারে ঈশ্বরের সঙ্গে মোলাকাত আপনা থেকে ঘটে। বারবার মূর্চ্ছা গিয়ে তাঁকে ডাকতে হয় না। কাজেই ‘নির্বাসন’-এ ভয়ের কিছু নেই। লেখকের ভাষাকে সে স্বাধীন করে। গল্পের ভাষা খুঁজে পায় অতলান্তে নিমজ্জিত হওয়ার সুখ ও আবেশ।
সমস্যা হলো যুগটা কার্বন ও এসিড সন্ত্রাসে ভরে গেছে। জঙ্গি ও গণতন্ত্র-এর স্ববিরোধী সন্ত্রাসে কে কোথায় এন্তেকাল ফরমায় তার ঠিকুজি নেই। হাইওয়ে ও মাল্টিপ্লেক্সের কলরবে এক ইঞ্চি ভূমি নির্জন বা অবশিষ্ট নেই আর। নিজেকে ‘নির্বাসিত’ করার জায়গা পেলে তবে না ‘নির্বাসন’ হবে। সাইবেরিয়া ও আমাজনের গহীনে ঢুকে সুগন্ধী সাবানে ফেনায়িত হওয়ার শখ মেটানো এখন আর কোনো ব্যাপার নয়। গ্যাস, তেল ও কয়লা খাদকের দল পৃথিবীর গহীনঘোর বনে অনেক আগে থেকে পৌঁছে গেছে। সেলফোন, স্যাটেলাইট কিংবা গুগল মানচিত্রের প্রসঙ্গ নাই-বা তুললাম।
এতোসব ভজঘটের মধ্যে ‘নির্বাসন’ নেওয়ার পরে মনে হবে ‘নির্বাসিত’ না হলে ভালো ছিল। এই মনোবেদনার ফটোগ্রাফ কেউ-না-কেউ ঠিক তুলে নেবে এবং ছড়িয়ে দেবে অন্তর্জালে। কাজেই ‘নির্বাসন’-এর ধামকিকে বিশেষ পরোয়া না করলেও চলতো, যদি পৃথিবীটা জেলখানায় ভরে না যেতো। মানুষের সমাজে বাস করে এবং নিজে মানুষ হয়ে সেই মানুষের কারাগারে বন্দি হওয়া মর্মান্তিক ব্যাপার বটে! সুতরাং আপসনামায় খত দিয়ে এবং কাঠামোর রকমারি ভালো-মন্দের সাথে বোঝাপড়া সেরে নতুন কথাটি কইতে হবে। গল্পভাষার জগতে ভ্রমণের ক্ষণে বিষয়টি নতুন করে আবার উপলব্ধি করছি।
৬.
ভ্রমণের ক্ষণে স্মরণ করি জনৈক বন্ধুকে লেখা মনোলগের বিচ্ছিন্ন কিছু টুকরো। সেই কবে কথাচ্ছলে তাকে লিখেছিলাম, ‘জগতের একটি শুরু থাকলেও সমাপ্তিটা রহস্যের কুহকে ঢাকা। কিন্তু আমরা যারা এর অংশীদার তারা কোনো-না-কোনোভাবে পরিণতির দিকে ধাইছি। আমাদের জীবনের গল্প সমাপ্তিহীন নয়। গল্পের ভাষা সেখানে ব্যতিক্রম হতে যাবে কোন দুঃখে?’ জিজ্ঞাসাটি মনে হচ্ছে তার যৌক্তিকতা হারিয়ে ফেলেনি।
আমাদের বলা ও না বলা কাহিনীর জগতে শুরু এবং পরিণতির বিকল্প কিছু কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি। মধ্যবর্তী এই স্পেসের মধ্যে গল্পভাষার জাগরণ ঘটে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, মানুষের ব্যবহৃত অন্য ভাষা-আঙ্গিকের সাথে গল্পে ব্যবহৃত ভাষা-আঙ্গিকের বিরোধ বা বিরহ নেই। সকলে অভিজ্ঞতাকে বহন ও ব্যবহার করে যাচ্ছেন। অনুভূতির কথা শুরুতে লিখেছি। গল্প লেখার আদিম রসদ অনুভূতির কাছে গচ্ছিত থাকে। সেইসঙ্গে এটা আবার ভাবছি, চিন্তার সুতলি পাকিয়ে কি গল্প লেখা যায় না! একো লিখছেন। বোরহেস অকাতরে লিখে গেছেন। নিজের মুখকে মুখোশের আড়ালে ঢেকে সফলভাবে লিখে গেছেন। জেলখানায় ‘নির্বাসন’ তাঁর জন্য প্রযোজ্য হতে পারতো। ভাষার হেঁয়ালি ও শব্দ-ধাঁধার চালাকি তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। গল্প লেখায় বিপজ্জনক হতে চাইলে চালাক হওয়া চাই। নতুবা ব্যান খাওয়ার প্যাঁচ এড়ানো মুশকিল।
বোরহেস চালাক ও ধুরন্ধর লোক ছিলেন। আকার ও আয়তনের মায়াময় বাস্তবতাকে নিরাকার এক মনোলোকে ডুবিয়ে রাখায় মুরুব্বিরা তাঁকে অশ্লীল ও বিপজ্জনক বলে চিনতে পারেনি। যেটা মার্কুইস দ্য সাদ’কে অনায়াসে পেরেছিল এবং আরো বহু নামকে এখনো পারছে। আমার সামান্য পাঠজ্ঞানে এটুক বুঝেছি বোরহেস বিপজ্জনক লোক। ভাষা ও ভাবনার হেঁয়ালি দিয়ে অনেক কিছু অকাতরে কচুকাটা করে গেছে। সবচেয়ে বেশি কেটেছে মায়াময় এই বাস্তবতাকে, যাকে নিয়ে ভাষার জাবর কাটতে জগতের সিংহভাগ লেখক নিজের কলমকে নিঃস্ব করে যাচ্ছে। বোরহেস সম্ভবত তাঁদের চোখের কাঁটা। দুর্বোধ্য এক প্রহেলিকার খেতাব এরা তাঁকে অগ্রিম দিয়ে রেখেছে। আসলে বোরহেস বা জয়েসের মতো লেখক হলেন ভাষাবোধের এমন এক উৎস-বিন্দু যেখানে পৌঁছানোর পর ভাষা নিজেকে প্রশ্ন করে, ‘আমি কে?’ উত্তরটি বলাবাহুল্য নিরুত্তর-এ গিয়ে নিঃশেষ হয়।
বোরহেস নিয়ে জাবর কাটতে গিয়ে বাংলাদেশের বড়ো একজন লেখকের করা একটি মন্তব্যের কথা মনে পড়ে গেলো। কোনো এক আলাপচারিতার ফাঁকে মন্তব্যটি তিনি করেছিলেন। কার সঙ্গে সেটি এখন স্মরণ হচ্ছে না, তবে মন্তব্যের সারনির্যাস মনের মাঝে গেঁথে গিয়েছিল। এতোদিন পরেও মগজে বুজকুড়ি তুলছে। সে যাহোক, আলাপচারিতায় বোরহেসকে তিনি ‘উপরতলার’ লেখক হিসাবে দেগে দিয়েছিলেন এটা পরিষ্কার মনে আছে। সমীহ করে নয় অবশ্য,- তাচ্ছিল্য করে। শব্দটি ব্যবহারের সময় লেখকের ভাষা ও ভাবনার জগতের প্রতি তাঁর উষ্মা ভালোই প্রকাশ পেয়েছিল।
লাতিন আমেরিকার লেখককুল অবশ্য বোরহেসকে আক্ষরিক অর্থে ‘উপরতলার’ লেখক বলে মানেন। তাঁদের কাছে তিনি হলেন ‘লেখকদের লেখক’ এবং এই খেতাবটি অনেকদিন ধরে জারি আছে। বিমূর্ত চিন্তা ও তর্ক উসকে দেয়ার ক্ষমতার কারণে নয়, জটিল ও বিমূর্ত চিন্তাকে শিল্পে ভাষা দিতে পেরেছেন বলে লাতিন ভাষাবিশ্বে বোরহেস গুরুত্বপূর্ণ। জাদুবাস্তবতার নারকীয় ধাঁধা আদপে সেখান থেকে শুরু হয়েছে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বা কাফকারা যদি মার্কেজদের উসকানিদাতা হয়ে থাকেন, বোরহেস বোধহয় তাঁদের থেকে আরেকটু বেশি করে গেছেন। ভাষা দিয়ে অনুভূতির খেল্ কীভাবে খেলতে হয় সেই বিদ্যা অন্ধ এই লোকটির কাছ থেকে অনেকে শিখেছেন। মন্তব্যটি করার সময় আমাদের শ্রদ্ধেয় লেখক সম্ভবত খেলবিদ্যার কথাটি ভুল মেরে বসেছিলেন।
বোরহেসের ধাঁধা ও প্রহেলিকাভরা গল্পভাষার ভিতরে এক সজাগ দর্শনবিন্দু সক্রিয় থাকে, যেখান থেকে জীবনের অর্থ ও অনর্থ নিয়ে কুতর্কটি শুরু করা যায়। তাঁর ধাঁধায় ভরা ভাষার মারপ্যাঁচের মধ্যে সাহিত্য ও দর্শনের সীমারেখাটি অবলুপ্ত হয় এবং অনুভূতিকে অতিক্রম করে চিন্তা-আশ্রয়ী এক ভাষার জাগরণ ঘটে। গল্পে সক্রেটিয় কায়দায় প্রশ্নের কুকুর ছেড়ে দেয়া যায় কিংবা ‘সক্রাটিক’ পদ্ধতিতে এখানেও বাতচিত ও তদন্ত করা সম্ভব, বিনয়ের সঙ্গে বলতে হয় হর্হে লুই বোরহেস তাঁর নামের প্রতি সুবিচার করে ভয়ংকর সেই কাজটি সম্ভব করে গেছেন। এটা তাঁকে বিপদে ফেলেছে বহুবার। নোবেলের শিকে কপালে জোটেনি। উপরন্তু নাৎসি কাজ-কারবারের পক্ষে গলা তুলেছেন ওই কুতর্কের দোষে। এসব অর্থে প্রলেতারিয় ভাষার ঠিকাদারদের কাছে তিনি ‘উপরতলার’ লোক বটে!
ভাষাশিল্পে উপরতলা ও নিচতলার লড়াই আজকের নয়। শকাব্দ অতিক্রম করে ওটা এখনো চলছে। আগামীতে থামবে বলে মনে হয় না। তবে বুর্জোয়া বা বেশি শিক্ষিত লোকের ভাষা দিয়ে জনগণের কাজ চালানো যাবে না, এমনটা ভাবার দিন শেষ হওয়া প্রয়োজন। জীবন শ্রেণীভেদের তারে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, সুতরাং শিল্পের ভাষায় শ্রেণীভেদ থাকবে। এটা নিয়ে বেহুদা লেকচার পেড়ে লাভ নেই। লোকসাহিত্যের ভাষা এবং শৈলী বাদ দিলে মাটির পৃথিবীতে কোন শিল্পের ভাষা অকৃত্রিম হতে পেরেছে? বোরহেস লিখুন আর বঙ্গদেশের কোনো লেখক সেটা লিখুন, সকলেই তো যে যার শ্রেণী ও বর্গের মাপে বানানো ভুষিমাল। এই সত্য অস্বীকারের কোনো পথ খোলা আছে কি?
এ কথা বিদিত জনে-জনে, জেমস জয়েস বা বোরহেস ‘উপরতলার’ ভাষা নিয়ে যথেষ্ট কেরদানি করতে পেরেছেন, কারণ উনাদের ভোক্তারা অধিক বিদ্বান ছিলেন এবং এখনো আছেন। চিন দেশে ‘Finnegans Wake’ সাকুল্যে আট হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। তাতেই জয়েস বেস্ট সেলার! তাঁকে নিয়ে পুঁজির কারিগর বেইজিংয়ের রাজপথে বিলবোর্ড ছাপতে দ্বিধা করেনি। এটা হলো ক্লাস ও ক্যাটিগরির নতুন কনট্রাস্ট। যেখানে মুড়ি-মুড়কি একদরে বিকোবে না বলে ঠিক করা আছে। জয়েস কোনো থ্রিলার লেখক না। তাঁর বই মুড়ির মতো বিকোবে না। এর ক্লাস আলাদা। ক্যাটিগরি অন্যরকম হওয়া চাই। বিপনন সেই ছক মেনে ঘটবে।
শুধু সাহিত্যে নয়, সবখানে একই ব্যাপার। ফিলিপিনো লাভ ডায়াজ বা ধমনীতে তিউনিসীয় রক্ত বহন করে ফরাসি হওয়া আব্দেললতিফ’কে খুব বেশি দর্শক জানে বলে মনে হয় না। গঁদার, তারকোভস্কি বা লারস ভন ট্রায়ার কখনো বাম্পার হিট হবে না। ‘পেরনম কারনেম’, ‘উইক এন্ড’, ‘মিরর’ কিংবা ‘ডগভিল’ ও ‘নিম্ফোমেনিয়া’ গল্পগুলো নিয়ে চলচ্চিত্র উৎসবে চিরকাল ঘুরপাক খাবে। লগ্নি সেখান থেকে উঠবে। অসম্ভব শিল্পসফল ভাষা তৈয়ার করার পরেও ক্লাস কনট্রাস্টের কারণে এই শিল্পীরা আমজনতার হৃদয় পাবে না। শ্রেণীর বর্গীকরণের খেলায় সবকিছু যখন ছকে ঘুরতে থাকে তখন ‘নিচতলা’র লোকেরা ‘উপরতলার’ নাগাল পায় না। অন্যদিকে ‘উপরতলা’ কখনো ‘নিচতলা’য় নামে না। বোরহেসের দুর্ভাগ্য, তাঁর চিন্তা করার ক্ষমতা ও নতুন ছকে খেলা করার সাধ্য তাঁকে ‘উপরতলা’য় বন্দি করে দিয়েছে। চাইলেও সেখান থেকে তাঁকে টেনে নামানো সম্ভব নয়।
কনট্রাস্ট নেই কোনখানে! বাঙালি পাঠকের শ্রদ্ধা ও সমীহে সিক্ত লেখক এই বঙ্গদেশে মধ্যবিত্ত নাগরিকের চশমা পড়ে ভাষার দোকান খুলেছেন। তাঁর ভোক্তারা নিমতিতা মধ্যবিত্ত বলে জানি, বোরহেসের সঙ্গে তফাত কেবল এটুকু। এর বাইরে ‘সব হারিয়ে নিঃস্ব’ বলে বিদিত সর্বহারাদের বিরাট এক দঙ্গল রয়েছে। এদের নিয়ে তিনি তাঁর গল্পের কাজ-কারবার সেরে থাকেন। এই বেচারামের দল না চিনে বোরহেস না বোঝে তাঁকে। হুমায়ূনও ঠিকঠাক বোঝে বলে একিন হয় না। তারা বুঝবে যখন তাদের শ্রেণীবদল ঘটবে ‘উপরতলার’ দিকে। তখন হয়তো মুখে পাইপ ঠেসে বোরহেস বা তাঁকে পড়লেও পড়তে পারে!
উপরে উঠতে জগতে কে না চায়! ফুকো এটা বুঝেছেন বলে ক্ষমতার ইতিহাসটি মোক্ষম সময়ে লিখে রেখে গেছেন। সহজ করে নয় অবশ্য, জটিল ও তির্যক করে। বেচারামের দল ওটা একজীবনে বুঝবে না। কারণ, সে এই ভাষার ‘আলোকায়ন’ থেকে বহুদূরে বসে বংশী বাজায়। টেকো মাথার ফুকোর সঙ্গে তার জানাশোনার সৌভাগ্য ইহজন্মে হওয়ার নয়। নগর-আশ্রয়ী শিল্পের ভাষা বিপ্লব করে নিচের দিকে নামানো যায় না। লেনিন ও মাওবাদি সমাজতন্ত্রের ঢক্কানিনাদ সে প্রমাণ জগতের কাছে রেখে গেছে।
এই ফাঁকে একদা চেক ও অধুনা মার্কিনী মিলোস ফোরম্যানের ‘ফায়ারম্যান বল’ পাঠককে একবার দেখতে অনুরোধ করি। ছবিটি ফোরম্যানের নির্বাসনের অন্যতম কারণ ছিল বলে শুনেছি। ঢক্কানিনাদ ও সাম্যকে ম্যানেজ করতে গিয়ে নিজেরা মিসম্যানেজড বা নাকাল হওয়ার হাস্যরসে ভরপুর গল্পে ফোরমেন সাম্যবাদের ঠিকাদারদের দুই গালে ঠাস করে চড় কষিয়েছেন। প্রকৃতি যেখানে সাম্যবাদি নয়, সভ্যতা সাম্য ও সমতায় ভরপুর হবে ক্যামনে!,- এই বিস্ময় নরাধমের মাথা দিয়ে আজ অব্দি ঢোকে না। সভ্যতা ‘সাম্য ও সমতা’য় সয়লাব হলেও নিচে না নেমে উপরে উঠবে এবং শ্রেণীর কাঠামোয় নিজেকে পুনরায় থাক্বন্দি করে নেবে। এটুক বোঝার জন্য হাবেরমাস হওয়া লাগে না। আপনা দিমাগ যথেষ্ট।
এই তো ব্রিটিশরাজকে দাবিয়ে মার্কিনীরা দিব্যি উপরে উঠে গেলো! কাল হয়তো ওদের দাবিয়ে দিয়ে চিনা ও ভারতীয়রা উঠবে। সাম্রাজ্যবাদের এই খেলাটি অপছন্দের হলেও মেনে নিতে হবে। আমি যে লিখছি সেই ‘আমি’টি আসলে কে? শ্যাওলাপড়া একটি শ্রেণীর ভাষা ও অভিজ্ঞতার দাস ছাড়া অন্য কিছু কি? আমার পক্ষে হাজার চেষ্টা করলেও বারোয়ারি জনগণের ভাষায় লিখন সম্ভব নহে। রক্তে নিজের বেড়ে উঠার প্রতিচ্ছবি প্রতিটি মানুষ বহন করে। গল্পের ভাষা তার এই অভিজ্ঞতার বাইরে যাবে কেমন করে!
যে লেখকটি শিক্ষিত ও ভদ্রলোক বলে নাম কিনেছে সে আরও শিক্ষিত ও ভদ্রলোক হতে চাইবে। বিদ্বান হতে চাওয়ার খায়েশটি হয়তো বহন করবে মনে। এর অর্থ এই নয় ‘নিচতলা’র মানুষকে নিয়ে সে লিখতে পারবে না। অবশ্যই লিখবে। হাজারবার লিখবে। নিচ, মধ্য ও উপর সব নিয়ে সে লিখবে, যতোখানি তার সাধ ও সাধ্যে কুলায়। কিন্তু যেটা লিখছে সেটা তার অভিজ্ঞতার আতশকাচ দিয়ে মেপে তবেই লিখতে হবে। সেখানে অনেক সুখকর শব্দরাজি নিশ্চয় থাকবে, এবং এটাও কবুল করছি, এতোসব শাব্দিক কসরতের মাঝে ফাঁকি ও মেকি কিন্তু এড়ানো যাবে না। এ যুগের গল্পকার সেটা মনে রেখে অগ্রসর হলে ভাষার কিছু উপকার হয়।
৭.
ভাবছি চেষ্টা তো কম হলো না। মানিক থেকে ওয়ালিউল্লাহ এবং আরো অনেকে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেন! অনেকে সেই চেষ্টা এখনো জারি রেখেছেন। সম্যক পারলেন কি? তাঁদের ভাষার পাঠক তো শেষ অব্দি ওই গোত্র ও শ্রেণীর তবিলদারি করা মানুষজন ছাড়া অন্য কেহ নহে। বাংলার অধ্যাপক কিংবা সরকারি সচিব অথবা পত্রিকার মান্যবর সাহিত্য সম্পাদক চোখে চশমা এঁটে তারাশংকর পড়ে বুঝবার চেষ্টা করছে ‘গ্রাম কেমন করে ভাঙে’,- জন্মের পর থেকে দৃশ্যটি দেখতে-দেখতে চোখে পচে গেছে, আর দেখার ধৈর্য নেই।
হাংরিরা একদা ফাটিয়ে দিতে চেয়েছিল। শেষমেষ নিজেরা ফেটে এবং ফেঁসে গেলেন। এখন তাঁদের দিন কাটে পুরোনো বিপ্লবের স্মৃতি মৈথুন করে আর ‘স্বমেহন’ ও ‘পায়ুকাম’-এর গদ্য লিখে। লাভ নাই গোলাম হোসেন। ফ্রান্সে বসে ওই কম্মোটি মার্কুইস দ্য সাদে দুশো বছর আগে সেরে ফেলেছে। রঙ্গরস থেকে দর্শন-ভাবনা সবকিছু সুলভ ওখানে। আর ইতালিতে বসে পিয়েরো পাওলো পাসোলিনি সেই সত্তুরের দশকে সাদে’র গল্পকে নতুন করে নির্মাণ ও নির্ধারণ করে গেছে। ‘সালো, ১২০ দিনের পায়ুকাম’ নামের সেলুলয়েড ভাষ্যটি সমকামী ও বামপন্থী পাসোলিনির নিজস্ব ঘরানায় তৈরি এক গল্প এবং দর্শকের কাছে কুখ্যাত বলে স্বীকৃত।
মুসোলিনির ইতালি ও তার স্বৈরাচারের নন্দনতত্ত্বকে এতোটা ইতর ও নির্লজ্জ করে আর কেউ দেখাতে পেরেছে বলে জানি না। পরাবাস্তবে নিমজ্জিত বুনুয়েল ‘বুর্জোয়াদের বিচক্ষণ তাবিজ’ বানিয়েছিলেন ফ্রান্সে বসে। রঙ্গ-ব্যঙ্গ সেখানে অঢেল মিলে। তাঁর কাহানী উপভোগ্য। পাসোলিনির ক্ষেত্রে ‘উপভোগ্য’ শব্দটি খাটে না। এমনকি প্রিয় ফেলিনির পক্ষে এ-ধরনের গল্প ফাঁদা অচিন্ত্যনীয় বিষয়। তাঁর ‘আমারকর্ড’ অসম্ভব উপভোগ্য এক খাদ্য। এ পর্যন্ত কতোবার দেখেছি সেটা এই মুহূর্তে সঠিক মনে করতে পারছি না। কিন্তু জাতভাই পাসোলিনির সাথে তাঁর দূরত্ব বহুত্! দুজনের জগৎ আলাদা। ফেলিনি ও পাসোলিনি আসলে দুই আলাদা মেরুর সম্রাট এবং দুজনেই ইতালিয়দের হৃদয় হরণ করেছিলেন।
১২০ দিনের পায়ুকামের গল্পটি সপরিবারে বসে মহা সমারোহে দেখার জিনিস নয়। আপনার স্নায়ু সাংঘাতিক মজবুত না হলে এর ধারেকাছে না ঘেষাটা ভালো। অধম অনেক কষ্টে বমি আটকেছে এবং একবার দেখার পর দ্বিতীয়বার দেখার সাহস পায়নি। রিচার্ড ডকিন্সকে স্বীকার করলে বলতে হয় ‘ওয়াক্ এ্যাফেক্ট’ আমাদের জিনের অবদান। এসব নিয়ে যাঁরা কাজ করেন এমন একজন তাঁকে নিউইয়র্কের ব্যস্ত সড়কপথের ধার ঘেষে তৈরি পাবলিক টয়লেটে ভবঘুরে ও ছন্নছাড়া লোকজনের কিছু কাজ-কারবার দেখিয়েছিলেন। কারবারগুলো সিসি ক্যামেরায় তোলা। শরীরে ড্রাগ পুশ করা এবং মল-মূত্র ত্যাগের দৃশ্যগুলো ডকিন্সের সহ্য হয়নি। বমন-ইচ্ছা কষ্ট করে আটকেছিলেন। পাসোলিনি সিনেপর্দায় ‘ওয়াক্ এ্যাফেক্ট’-এর বিভীষিকা লিখে রেখে গেছেন। পুরো গল্পটি বলার রুচি ও সাহস আমার নেই। একটি দৃশ্যের কিছু কাটপিস শুধু উল্লেখ করছি:
১. বেঠকখানায় সমবেত অতিথিদের সামনে বসে মলত্যাগ; ২. ডিনার টেবিলে নগ্ন ও সুদেহী যুবক-যুবতীদের দিয়ে কড়াইভর্তি মলভাণ্ড পরিবেশন। এদের বন্দি করা হয়েছে যৌনসুখের উপায়গুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সারবার জন্য; ৩. মলের সুগন্ধে উন্মনা অতিথিরা মল ভক্ষণ করে যৌন-পিপাসায় উতলা হয়ে পড়ে; এবং মলভক্ষণ শেষে শুরু হয় নির্বিচার পায়ুকাম…
ছবির নারকীয় ভিজ্যুয়াল এ্যাফেক্টের কিয়দংশ উল্লেখ করলাম। সারা পর্দা জুড়ে ‘ওয়াক্ এ্যাফেক্ট’-এর এরকম অগণিত দৃশ্য ও সংলাপ উল্লেখ করা সম্ভব নয়। রজার এবার্ট থেকে শুরু করে কেউ সাহস করেনি বলে জানি। প্রিয় পাঠক, আপনার শিশ্ন দাঁড় করাবার আশায় এটি দেখতে বসবেন না। এতে বিপরীত ফল হবে। হয়তো জীবনে প্রথমবার আপনার মনে হবে নিজের শিশ্নটি আপনি আর খুঁজে পাচ্ছেন না। অধিক সংবেদনশীল হলে আপনার ‘ওটা’ জীবনে আর না দাঁড়াতে পারে। মার্কুইস দ্য সাদে সাহিত্যের ভাষায় এই বিবমিষার সূত্রপাত করেছিলেন আর পাসোলিনি সিনেপর্দায় ভৌতিক ছবির আঙ্গিকে সেটাকে বলতে গেলে ফিনিশিং দিয়ে গেছেন।
অন্তর্জাল থেকে ছবিটি নামানোর সময় মন্তব্য বিভাগে দর্শকের গালমন্দ ও আফসোসভরা আক্ষেপ আমি অবশ্য উপভোগ করেছি। কারণ, এটা পাসোলিনির জাত চিনিয়ে দেয়। এই লোক সাহিত্য গুলে খেয়েছে। তাঁর হাতে গ্রিক ট্রাজেডি সিনেপর্দায় নতুন ভাষা লাভ করেছিল। ‘বাইবেল’-এর গল্প তাঁর চাইতে বিশ্বস্ত করে অন্য কেউ বলতে পারেনি বলে অনেকে এখনো বিশ্বাস করে। আপনি কট্টর অবিশ্বাসী হয়ে থাকলে পাসোলিনির ‘বাইবেল ভাষ্য’টি দেখে ক্ষণিকের জন্য হলেও বিশ্বাসে ফেরত যেতে চাইবেন। ‘আরব্য রজনী’, ‘ডেকামেরন’ ও ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’-এর গল্পরা তাঁর হাতে অন্য মাত্রা পেয়েছিল। এবং এই লোকটি সিনেপর্দায় ১২০ দিনের পায়ুকাম লিখে দর্শককে বমি করতে বাধ্য করছে। তাঁর ভক্তদের জন্য বিষয়টি মেনে নেয়া সহজ নয় বৈকি।
পাসোলিনি রক্তেমাংসে রোমান স্বেচ্ছাচারের প্রতীক। রোমানরা যৌনতার ব্যাপারে অবাধ ও উচ্ছৃংখল ছিল। সমকাম থেকে উভকাম
কোনোকিছুর কমতি ছিল না সেখানে। ফূর্তি ও উল্লাসের সঙ্গে শরীরকে সম্ভোগ করেছে মানুষ। আজকে পৃথিবীতে বসে পুরোনো যুগের এসব গল্পকে অশ্লীল বা পর্নোগ্রাফি মনে হবে। সে যুগে ওটা যৌনতার রীতি ছিল। ভারতবর্ষে ছিল। গ্রিস, মিশর বা রোমেও ওটা সমানে চলেছে। ফেলিনি তাঁর ‘স্যাটাইরিকন’-এ সেটা দেখিয়েছেন। পাসোলিনি দেখালেন ক্লাসিক সাহিত্যের গল্পগুলিকে নতুন ভাষায় চিত্রায়ন করে। চিত্রায়নের উদ্দেশ্য অবশ্য রাজনৈতিক ছিল। আধুনিক শিল্পের ভাষা ও নান্দনিকতাকে এগুলো প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করে।
পাসোলিনির ভাষা সমাজের ঠিকাদারদের কাছে এই বার্তাটি বারবার পৌঁছে দিতে চেয়েছে:-
তোমরা মানুষের মনকে শুধু শেকলবন্দি করোনি, তার দেহকে চাপিয়ে দেয়া টাবুর অধীন করেছো এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে ধর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছো। শরীর টাবুর খাঁচায় বন্দি হলে মন চিরতরে নিজেকে হারায়। সে হয়ে ওঠে শ্রেণী-বর্গ ও পুঁজির তাবেদার। পাসোলিনি থেকে টিনটো ব্রাস, ইতালির সকল নির্মাতা এসবের বিরুদ্ধে গল্প লিখেছে সিনেপর্দায়। পঞ্চাশ থেকে আশির দশক অব্দি ইতালি কেন বিশ্ব-চলচ্চিত্রের ভাষাকে দাপটের সঙ্গে শাসন করেছে (হলিউড সেখানে বাদ যায়নি) তার জবাব এইসব গাল্পিকদের না দেখলে সম্যক বুঝে উঠা যায় না।
পাসোলিনির ১২০ দিনের পায়ুকাম-এর মতো ভয়ংকর ইশতেহার লিখতে হলে বুকের পাটা লাগে। চলচ্চিত্রের গল্পে ‘ডিসটার্বিং মুভি’ বলে একটি কথা আছে। এ-ধরনের ছবি কম বানানো হয়নি। হলিউড সহ সারা বিশ্বে ওটা হরদম তৈয়ার হয়। মিশেল হানেকের অস্তিত্ব-বিদারক কাহিনী ‘ফানি গেমস’ বা ‘সেভেন কন্টিনেন্ট’ কম ‘ডিসটার্বিং’ নয়। এক্ষেত্রে সর্বশেষ সংযোজন ‘অ্যা সার্বিয়ান সিনেমা’ নামের ছবিটি। পৃথিবীর সিংহভাগ দেশ ও চলচ্চিত্র উৎসব-এ ছবিটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট স্নায়ুর ওপর সন্ত্রাস ঘটায়। পরিচালককে ছবিটি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তাঁর উত্তরটি মোটামুটি এরকম ছিল:
‘যুগোস্লাভিয়াকে ভেঙে তিন টুকরো করা হয়েছে। বলকানরা গৃহযুদ্ধের বীভিষিকা দেখতে পেয়েছে। এখন দেখছে শাসকরা কতো অভিনব পন্থায় নিজের ‘ধর্ষকামী’ হওয়ার সুখ মিটিয়ে নিচ্ছে। এসব বীভিষিকার কাছে আমার গল্পটি নাবালক মাত্র। পারলে আরো ভয়ংকর কিছু তৈরি করা উচিত, যেন জনগণ বুঝতে পারে এই দেশে ‘নিষ্পাপ’ বলে কিছুর অস্তিত্ব আর নেই। সুন্দর বলে কিছু নেই। সব শেষ করে দেয়া হয়েছে। জীবন এখন কুৎসিত ও মৃত। ওরা মৃতকে ধর্ষণ করছে। সার্বিয়ার গল্পে আমি সেটা বলবার চেষ্টা করেছি মাত্র।’
‘‘অ্যা সার্বিয়ান সিনেমা’র গল্পটি আসলেই কুৎসিত। ছবির স্রষ্টাকে মনোবিকারগ্রস্ত মনে হতে পারে, এবং এটি সত্যি ‘ডিসটার্বিং’।
পাসোলিনির জাত সেখানে আলাদা। ‘ডিসটার্বিং মুভি’ বানানোর খায়েশ থেকে এই লোক কাহিনী ফাঁদে না। প্রথা ও টাবু’কে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সে সিনেমা বানায়। ‘সার্বিয়ান সিনেমা’য় সেটা কতোখানি ছিল সেটা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন ও তর্কের অবকাশ রয়েছে। সামজিক চুক্তি’র ছকে গড়া সমাজ ‘স্বমেহন’ ও ‘মর্ষকাম’-এ লিপ্ত হয়েছে। কিছুই আসলে পালটায়নি সেভাবে, দেহটি শুধু বন্দি হয়েছে কারাগারে। শিল্পের নন্দনতত্ত্বে মুসোলিনিরা ভর করেছে, ওদেরকে তাড়ানো যায়নি। সবকিছু এভাবে চলতে দিলে কখনো তাড়ানো যাবে না। ‘স্বমেহন’ ও ‘পায়ুকাম’-এর গল্প শুধু লিখে যেতে হবে। ধনী-গরিব বলে কথা নেই। সারা বিশ্বের জন্য এটা প্রযোজ্য। মাদকাসক্ত ও উচ্ছৃংখল বামবাদী পাসোলিনি চোখে আঙুল দিয়ে মুরুব্বিদের সেটা দেখিয়ে গেছে।
৮.
বঙ্গীয় অঞ্চলে হাংরিরা এই ঘটনাটি ঘটাতে চেয়েছিল। নিজেকে ‘কৃষ্টি দোগলা’ বা ‘সংস্কৃতির জারজ পোলা’ বলে আধুনিকতাকে তাঁরা একহাত নিতে চেয়েছিলেন। শেষরক্ষা হয়নি। উলটো চটি গল্প লিখে আর রবীন্দ্রনাথকে গালমন্দ করে ‘সংস্কৃতির জারজ পোলা’ হওয়ার সুখ নিচ্ছেন। পাসোলিনি বা সাদের চেয়ে উত্তম ‘স্বমেহন’ ও ‘পায়ুকাম’-এর গল্প লিখতে চাইলে আগে রসময় গুপ্ত থেকে নিজেকে আলাদা করা শিখতে হবে। রসময়ে নির্জলা সেক্স আছে, সবকিছু দাঁড়িয়ে যায়, কিন্তু সেই নির্বেদ ও তাচ্ছিল্যের বিস্তার ঘটে না যেটা দিয়ে লেখক সমাজকে নাড়িয়ে দিতে পারে। গল্পভাষায় এটাও গুরুত্ব রাখে। হাংরিরা সেই বোধ অনেক আগে হারিয়েছেন।
সুবিমলকে নিয়ে ভরসা ছিল। ‘হারান মাঝির বিধবা বউয়ের মড়া অথবা সোনার গান্ধি মূর্তি’ কিংবা ‘রঙ যখন সতর্কীকরণের চিহ্ন হয়ে ওঠে’র মতো প্রথা-পরিপন্থী ভাষা এই লোকের হাত দিয়ে বেরিয়েছে। তাঁর নিরীক্ষাগুলো বহু কারণে প্রাসঙ্গিক ছিল। কিন্তু ‘কাঠ খায় আংড়া হাগে’র গল্প লেখার দিন থেকে সুবিমল ট্র্যাকলেস। রসময় থেকে নিজেকে আর আলাদা করতে পারছেন না অথবা আলাদা হতে চাইছেন না। কেন সেটা জানি না! অপর্ণা সেনকে বঙ্গীয় সমাজের ‘সফিসটিকেটেড’ রমণীর অধরা প্রতীক ধরে নিয়ে বহুভাবে তাঁকে অ্যাটাক করেছেন। ‘সতীত্ব কি রাখবো অপর্ণা’ পর্যন্ত সেটা মন্দ ছিল না। এখন আর সেই ধার সুবিমলের নেই!
ব্যক্তিজীবনে লোকটি আপসহীন সৎ। গরিবির ছাপ সর্ব অঙ্গে অথচ উচ্চাঙ্গের শিল্পভাষায় তাঁর অবাধ যাতায়াত। বঙ্গদেশে এটি সুলভ ঘটনা নয়। গরিব লেখকের নোলা এখানে বাখ, বেথোভেন বা মোজার্টকে হজম করতে পারে না। জয়েস বা গঁদার শুনলে শত হস্ত দূরে থাকে। পারলে এসবকে ‘আঁতলামি’ বলে বিদ্রূপ করে নিজেকে ‘রেনিগেড’ ও মাটির মানুষ বলে প্রমাণ করতে চায়। এটি হলো গরিব ও সর্বহারা হয়ে শিক্ষিত লোকের ভাষায় কথা কওয়ার বিপদ। মন নানাকারণে সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। জগতের আনন্দযজ্ঞে নিজেকে আর শরিক করাতে পারে না। বাঙলা ভাষা এরকম লেখকে আজকাল গিজগিজ করে। ক্লাস কনট্রাস্টের এটি এক কুফল বটে!
সুবিমলের এসব বাতিক ছিল না। হাইক্লাস আর্টের রস বুঝতে ও সেখানে শরিক হতে তাঁর কোনো অসুবিধে হয়নি। গঁদার থেকে ফুকো, বেথোভেন থেকে ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী, জেমস জয়েস থেকে কমলকুমার বা অমিয়ভূষণ, অথবা ঋত্বিক,- এঁরা সবাই তাঁকে চুম্বকশালাকার মতো টেনেছে। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আপত্তি থাকলেও হাংরিদের মতো তাচ্ছিল্য নেই, বরং বিবেচনা ও ক্ষেত্রবিশেষে ভালোবাসা আছে। সত্যজিৎ নিয়ে তাঁর কথাবার্তা বিতর্কিত মনে হতে পারে, তবে ফেলনা নয়। ভাবার অবকাশ সেখানে যথেষ্ট রয়েছে। গরিব স্কুল মাস্টার নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে এসবের আস্বাদ প্রাণভরে নিয়েছে। যে-কারণে তাঁর ভাষাভঙ্গি নিরীক্ষামূলক ও প্রতিবাদী হতে পেরেছিল।
বঙ্গদেশে নিরীক্ষার যুগ অস্তগামী। এই লেখকটি সেখানে ব্যতিক্রম ছিলেন। কিন্তু সুবিমল আর আগের মতো নির্মল নেই। একলা লড়াই করার হতাশা তাঁকে সম্ভবত ক্লান্ত করে তুলেছে। রসময়ের দিকে টানছে। সাহিত্য-শিল্পের ঠিকাদারদের কাছে লোকটি নিজেকে বিক্রি করেনি। আবার না-করে খুব যে লাভ হয়েছে সেটাও বলা যাচ্ছে না। তাঁর প্রথাবিরোধী ভাষা ও আঙ্গিক বোঝার মতো লোকের আকাল এখানে শেষ হওয়ার নয়। সেটা চলছে এবং তাঁকে একটু-একটু করে পিষে মারছে।
একলা ও একঘরে হয়ে যাওয়ার এই মর্মজ্বালা বড়ো ভয়ানক। সেটাই হয়তো তাঁকে চটি-সাম্রাজ্যের দিকে টানছে। শিশ্নকে আতংকিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার মিশনটি ‘হস্তমৈথুন’-এর সুখে পাঠককে বিভোর করার যুদ্ধে নেমেছে। প্রতিষ্ঠানের ডিসকোর্স আসলে সাংঘাতিক। তার নন্দনতত্ত্বকে মোকাবিলা করার মতো অস্ত্রশস্ত্র বেশিদিন মজুদ রাখা যায় না। প্রকৃতি অসমান। পৃথিবীকে গোল দেখালেও সেটি পুরোপুরি গোলাকার নয়,- বর্তুলের মতো চাপা ও ফোলা। সমাজের পরিধি এর ব্যতিক্রম নয়। একে বদলানোর লড়াইটি তাই অসমান এবং ক্লান্তিকর। লেখকদের কথাটি স্মরণ রাখা হয়তো প্রয়োজন।
কদম্বতলে বসে যে বংশী বাজায় কিংবা রিকশার প্যাডেল মারে তার পক্ষে এসব কাহানীর নাগাল পাওয়া মুশকিল। নাগরিকের ভাষা সম্পূর্ণ নাগরিক না হলে বোঝা কি যায়? লেখাপড়া জানা লোকের ভাষা সে ছাড়া কে আর বোঝে! যাক, আবার বোরহেসে ফেরত যাই। লোকটি এক কাঠি বেয়াড়া। শুধু লেখাপড়া জানা লোকেদের পরোয়া না করে আরেকটু অধিক জানাশোনাদের খবর করেছে। তাঁর মনোজগৎ হয়তো অধিক জানাশোনাদের জগতে বিচরণ করতে স্বচ্ছন্দ ছিল। এটা না করে জনতার দাবি মেনে সহজ করে লিখতে পারতেন। বড়ো প্রতিভার পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব। সেটা করলে মেকি ও ভানে ভরা এক ভাষা পেতো পাঠক। গল্প হয়তো সেখানে থাকতো, কিন্তু গল্পের মজ্জা ভেদ করে যে প্রশ্ন ও বিতণ্ডার আওয়াজ উঠছে, একালের ভাষাবিশ্ব সেটা থেকে নিশ্চয় বঞ্চিত হতো। বঙ্গদেশে এই হলো কালচার। পাবলিক না পুছলে নিজেকে ‘সহজ’ ও ‘ছকবাঁধা’ ভাষা ও শৈলীতে বদলে নাও। বদলানোর এই খেলায় এ পর্যন্ত কতোজন শহীদ হলেন সেই তালিকাটি বোধহয় তৈরি করার সময় এসেছে।
রাশপ্রিন্ট প্রদায়ক ক্ষমা করবেন। ভাষা নিয়ে লিখতে গিয়ে বাংলাদেশের একজন সম্মানিত লেখকের নাবালক মন্তব্যের ঘোরপ্যাঁচে আমি অধম আটকে গেলাম। চেষ্টা করেও বের হতে পারছি না। কারণ তাঁর বলার ভঙ্গিটি আমাদের আর্ট-কালচারের জগৎকে চিনিয়ে দিচ্ছে। কতো সহজে আমরা অন্যকে নির্ধারণ করে ফেলি! তাই এই প্যাঁচাল ধরে ভাষার অবক্ষয় ও ধসের কাছে পৌঁছাতে চাই। এই গোলার্ধে বসে আমাদের শ্রদ্ধেয় লেখকটি যে আঙ্গিকে গল্প লেখেন সেই আঙ্গিক দিয়ে অন্য গোলার্ধের একজন লেখককে অবলীলায় নির্ধারণ করে দিলেন! তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও ‘ভাষাবোধ’ আরেকজনের ওপর চাপিয়ে দিলেন! আলাপচারিতায় তিনি বোঝাতে চাইলেন বোরহেসের গল্পে ভাষার মারপ্যাঁচ ছাড়া বিশেষ কিছু নেই এবং এর পুরোটাই মাথার উপর দিয়ে যায়।
নির্ধারণের সময় তাঁর এটা মনে থাকলো না যে ‘মাথার উপর দিয়ে যাওয়ার’ বিষয়টি আপেক্ষিক হতে পারে। কোনটা কার মাথার উপর দিয়ে যাবে সেটা বোঝা জগতে সহজ কম্মো নয়। সংসারে এমন পাঠকের অভাব নেই যাদের কাছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো বিরলপ্রজ লেখকের ভাষা-শৈলী ‘মাথার উপর দিয়ে যায়’, অথচ হুমায়ূন আহমেদের’টা যায় না। আবার বিপরীত দিক রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদকে তরতর করে পড়ে উঠা সত্ত্বেও কারো মনে হতেই পারে, ‘পড়লাম ঠিক-ই। মাগার কিছু তো বুঝবার পারলাম না!’
দেশের বড়ো কোনো লেখক যখন নাবালক মন্তব্য করেন তখন দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। তাঁর এই মন্তব্য অবশ্য একটা জিনিস চিনিয়ে দিচ্ছে,- চিন্তার সুতলি পাকিয়ে লেখাটা বঙ্গদেশের জলবায়ুর সাথে একদম খাপ খায় না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এক জীবন দর্শনশাস্ত্র পড়ালেও দার্শনিকের মনোজগৎ থেকে শিক্ষকরা দূরে থাকতে ভালোবাসেন। বোরহেসের অপরাধ এই যে তিনি কোনো দার্শনিক না হয়ে লেখক হতে চেয়েছেন এবং সীমালঙ্ঘন করে গল্পের ভাষায় ‘কুতর্কের দোকান’ খুলেছিলেন।
এই দেশে দুই ধারার লেখককুলের ভাত ও জাত আছে। এখানে বসে যারা ‘প্রলেতারিয়’ ভাষায় সবক দিতে পারেন এবং যারা মধ্যবিত্তের অনুভূতি নিয়ে সওদা করতে পারেন তাদের কোনো চিন্তা নেই। এর বাহিরে বাকিদের ভাত ও জাত কোনোটা নেই। লোকনাথ ভট্টাচার্য মহাশয়ের এই দ্যাশে টিকে থাকা মুশকিল। লোকটি দীর্ঘদিন প্যারিসে ছিল এবং চিন্তা দিয়া ভাষারে সুতলি পাকানোর বাতিক আছিল।
এইটা আরো প্রমাণ করে আমাদের ভাষার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ এই লেখক আশ্চর্য ভালো গল্প লিখলেও আশ্চর্য ভালো পাঠক নাও হতে পারেন, কারণ, ভাষা ও শৈলীকে তিনি নিজের মাপে কেটে নিয়েছেন। কেটে নেয়া দোষের না যদি যুক্তি ও ব্যাখ্যা পাকাপোক্ত হয়। বোরহেসের গল্পভাষার বিচারে তাঁর যুক্তি পোক্ত ছিল কিনা সে বিবেচনার ভার পাঠকের হাতে রইলো। এই অধম এর পক্ষে না।
…