গল্পভাষা অথবা উপরতলা সিনড্রোম (প্রথম অংশ)। আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১:৪০ অপরাহ্ণ, | ২৯৮৬ বার পঠিত
১.
‘রাশপ্রিন্ট’ প্রদায়ক আহমেদ সায়েম গল্প লেখার অভিজ্ঞতা ও তার ভাষিক পরিমণ্ডল নিয়ে দু’চার লাইন লেখা সম্ভব কিনা জানতে চেয়েছেন। প্রদায়ক খোলামনে নিজের পছন্দের কথা জানিয়েছেন। এতে আপত্তির কিছু নেই, তবে কারো পছন্দ বা অভিপ্রায় মেনে লিখতে বসা বিপদজনক। মনের ওপর ওটা তখন চেপে বসে। হাজার চেষ্টা করে তাড়ানো যায় না। ফরমায়েশ মেনে লিখতে বসে মনের স্ফূর্তি নষ্ট হয়। ‘সীমাবদ্ধ জল ও সীমিত সবুজে’র মাঝে সাঁতার কাটতে গিয়ে লেখার উৎসমুখ একটি পরিসরে বন্দি হয়ে পড়ে। আমি তাই চেষ্টা করি অনুরোধ এড়াতে, তবে সবসময় সম্ভব হয় না। এবার যেমন হলো না। যে-কারণে এই অবতারণিকা।
অনেকে বলতে পারেন, ‘কেন, গল্প লেখা কি পরিসরবন্দি অভিজ্ঞতা নয়? লেখকের যে বয়ানকে গল্প বলে বুঝি সেটা কি প্রথাগত ভাষাকাঠামোর প্রতিধ্বিনি করে না? গল্পে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে লেখক কি অবাধ ও নিয়ন্ত্রণহীন? যেমন খুশি তেমন সাজতে পারেন? মনে যা আসে সেটি লিখে ফেলতে ও কল্পনা করতে পারেন? এমন কোনো ইন্দ্রজাল কি তিনি রচনা করতে সক্ষম হয়েছেন যেখানে ভাষার অভিনব প্রয়োগের কারণে বাস্তবতা অবলুপ্তির সম্মুখীন হয়? সেরকম গল্প কি আদৌ লেখা সম্ভব হয়েছে যেটি শুধু ভাষার জাদু বা চমকের কারণে বাস্তবতাকে অতিক্রম করে বাস্তবাতীত হতে পেরেছে? কালের পরিসরে বিচরণ করা সত্ত্বেও কালহীন সাগরের দিকে ভেসেই চলেছে? স্থান ও কালের অমোঘ আবর্তনকে বিপর্যস্ত করার শক্তি ভাষা কি সত্যি রাখে?’
এইসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। অন্যরা হয়তো জানেন। নিজের কথা বলতে পারি, স্থান ও কালের গণ্ডি থেকে মুক্ত এক ভাষাপৃথিবীর স্বপ্ন আমি দেখি। সেখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। মনের ওপরে বাস্তবতার রাজত্ব থাকবে না। কালের নিষ্ঠুর কোনো দাবি মাথার ওপর চেপে বসবে না। অপর সত্তার চাপ ও অবরোধ,- এর কোনোটা সেখানে সইতে হবে না। আমি জানি স্বপ্নটি কখনো সত্য হবে না। জাগতিক কারণে হবে না। জগৎ ও মহাজগৎ আমায় স্ট্রাকচার বা কাঠামোর ধারণা দেয়। ভাষা সেখানে ব্যতিক্রম নয়। সে নিজে একটি কাঠামো এবং তাকে বসবাস করতে হয় অন্য কাঠামোগুলোর সঙ্গে আপস করে। এসবের ভিতরে নড়াচড়া করে ভাষার কারবারি জীবনের গল্প লেখে। এখন পর্যন্ত এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি। আগামীতে ঘটবে কি? মনে হয় না। নিজেকে আমি বহুভাবে কাঠামোর বাইরে চিন্তা করে সফল হতে পারিনি। দিনশেষে চিরচেনা গণ্ডিতে ফেরত যেতে হয়েছে। সেখানে বসে নিজের জীবন ও গল্প লেখার অভিজ্ঞতার সঙ্গে অগত্যা বোঝাপড়া সারছি।
গল্পভাষার আলোচনায় কাঠামো অশেষ গুরুত্ব রাখে। জগতে এর বহু স্বরূপ দেখি। নদী-সমুদ্র-অরণ্য কিংবা বিস্তীর্ণ সমতল দেখে এক ধরনের কাঠামোর অনুভূতি হয়। পাহাড় দেখলে আরেক ধরনের অনুভব জাগে মনে। উঁচু দালানের ছাদে দাঁড়িয়ে নিঃসীম আকাশ দেখলে অন্য অনুভূতি মনে তরঙ্গ বহায়। ছাদ থেকে মানুষ ও যানবাহনের ব্যস্ত কলরবের সাথে আকাশ দেখার অনুভূতি মিল খায় না। মানবসমাজে ব্যক্তিরূপী যে কাঠামোটি দেখতে পাই তার সাথে দল ও গোত্ররূপী কাঠামো কখনো এক হয় না। অন্যদিকে ব্যক্তি, দল ও গোত্র যখন সমাজ-কাঠামোয় নিজেকে ব্যক্ত করে তখন সেটা আলাদা হয়ে ওঠে। আবার সবকিছু একত্র করলে স্থানবাস্তব ও কালবাস্তবের চেতনা জাগে মনে। ঘটনা বা ইতিহাসের অংশে পরিণত হওয়ার অভিজ্ঞতাটি হয়। গল্প হলো এইসব অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার রসায়ন। গল্প লিখতে বসে গল্পকার আসলে কাঠামোবন্দি এক জীবনকে লেখে।
ধরায় আগমনের পর কাঠামোকে উপেক্ষা করা কারো পক্ষে সম্ভব হয় না। আমার শরীর আমায় কাঠামোর ধারণা দেয়। যে জগতে বিচরণ করি সেটি আমায় এর অনুভূতি নিতে বাধ্য করে। যার ফলে কাঠামো নামক খাঁচা থেকে মানুষের মুক্তি মিলে না। কারণ সে একটি স্থান-কালের বাসিন্দা। তার জীবন ওই পরিসর বা আয়তন দ্বারা নির্ধারিত। বহুলভাবে নিয়ন্ত্রিতও নয় কি? গল্পের ভাষা নিয়ে ভাবতে বসলে এই প্রশ্নটিকে এড়ানো যায় না।
মায়ার ধরণী লাটিমের মতো ঘুরছে। রহস্য ও রোমাঞ্চে ভরা মহাজগৎ ভেলোসিটির তালে বনবন করে চরকিনাচে লিপ্ত রয়েছে। গতির এই ঘূর্ণির মাঝে দর্শকরূপী মানুষের বসবাস। দর্শক আসলে বুঝতে পারে না গতির তালে সে নিজেও দিগম্বর হয়ে ঘুরছে। তার দেহের বায়োলজি স্থির ও অন্তিম কিছু নয়। আলোতুল্য গতির নিরিখে স্থান এবং কালের ধারণা কেমন করে বদলে যায় সেটা নিয়ে আলবার্ট আইনস্টাইন বিস্তারিত বলে গেছেন। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন আমাদের এই স্থানবাস্তব ও কালবাস্তব অটল কিছু নয়। গতির ভিন্নতা ঘটলে পরিচিত কাঠামো এক লহমায় পালটে যেতে পারে, আর কাঠামো ধসে গেলে দেহ-মনের বায়োলজি বেশক্ পালটায়।
আইনস্টাইনের এই গতিবদল সংক্রান্ত ভাষ্যে বহু দূরগামী এক চিন্তা ও কল্পনার সংকেত আছে। আইজাক আসিমভ বা স্তানিস্লভ লেমে’র গল্পভাষায় আমরা এর প্রয়োগ ও ব্যবহার দেখেছি। যদিও আমরা যাপন করি নিউটনকে এবং গল্প লিখি এই বিজ্ঞানীর ছকে দেওয়া সূত্রের জগতে বসে। আসিমভ বা লেমের গল্পগুলো কাল্পনিক। এই বাস্তবতাকে পাঠ করলেও মানুষ সেটা কখনো যাপন করেনি। যে-কারণে কল্পবিজ্ঞানের ভাষার সাথে বাস্তব জগতের ভাষার দূরত্ব রয়েছে। এরা একজন আরেকজনের দেহে প্রবেশ করে না। প্রশ্ন হলো আজকে যেটা কল্পনা আগামীতে সেটা সত্য হতেও পারে। বাস্তবতাকে বোঝা ও সংযোগের জন্য সেদিন আসিমভ বা লেমের ভাষা কি আমাদের জন্য অমোঘ হবে না? নিউটনের সূত্র-নির্ধারিত জগতে বসে প্রশ্নটি তোলার দরকার হতো না, কিন্তু আইনস্টাইনের আবির্ভাবের পর তুলতে হচ্ছে। কারণ, আমাদের বোধের জগৎ আর আগের অবস্থায় নেই, সেখানে যাপিত বাস্তবতার মাঝে অভিনব এক কল্পবাস্তবতার সম্ভাবনাকে স্বীকার করে ভাষার কাজ-কারবার চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
আমরা ভাগ্যবান, কারণ আমরা বাস করছি নিউটনের বিশ্বে। এই বিশ্বে স্থান ও কালের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য রয়েছে। প্রতিটি ক্রিয়ার সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। গ্রাভিটেশন বা মাধ্যাকর্ষণ এখানে সুষম এক আয়তক্ষেত্রে গ্রহটিকে ধরে রেখেছে, ছিটকে যেতে দিচ্ছে না। নিউটনের বিশ্বে সময় উল্মফনপ্রবণ নয়। এটি সুষম ও ধ্রুপদী। যে-কারণে এই বিশ্বে প্রাণের বিকাশ ও বিস্তারটি এমন ধ্রুপদী হতে পেরেছে। কিন্তু আলোতুল্য গতির পাল্লায় পড়লে নিউটনের ক্লাসিক্যাল স্থান-কালের কাঠামো ভেঙে পড়ে। আলোর চেয়ে দ্রুতবেগে কোনোকিছু ছুটে না। অন্তত এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানের এটাই অভিমত। এরকম গতির তালে পড়লে কাঠামোর রূপান্তর অনিবার্য হয়। চিরচেনা বাস্তবতার ধারণায় বিপর্যয় ঘটে। বোধ ও প্রকাশের জগৎটি তখন পালটে যায়।
আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণের ভাষা (E=mc2) কাঠামোকে নিমিষে পালটে দিয়ে থাকে। স্থান ও সময়ের ধারণাকে সে ব্যক্তিগত এবং আপেক্ষিক করে। মানুষের ভাষা ও অনুভূতি সেই অনুপাতে ব্যক্তিগত ও আপেক্ষিক হতে বাধ্য হয়। দেহ পালটে গেলে মন স্থির থাকে কী করে! সুতরাং ওটাও পালটায়। গতিবিজ্ঞানের নতুন তালে পড়ে মানুষের ‘ভাষাবোধ ও ভাষাপ্রকাশ’-এর জগৎ বিলকুল বদলে যায়। বাস্তবতার এই অভিনব প্রস্তাবনা আইনস্টাইনকে যুগের কাছে অমোঘ ও আবশ্যক করে তুলেছে। মহাবিশ্বের নিয়তির সঙ্গে আমাদের নিয়তিকে সরাসরি সংযুক্ত করে দিয়েছে। নিউটন ও লাইবনিজের পর তিনি হলেন তৃতীয় ব্যক্তি যাঁর হাত ধরে বিজ্ঞান কল্পনা-প্রতিভার জাদুতে ঝলমল এক ভাষাবিশ্বের মালিক বনে গেছে। এই সত্য অস্বীকার করার কোনো পথ আর খোলা নেই। বিজ্ঞানের ভাষাবিশ্বকে আমলে না নিয়ে কারো পক্ষে নতুন ভাষা ও বচনে কথা কওয়া সম্ভব নহে।
জগৎকে সকলে নিজের মতো করে বুঝতে চায়। কবি ও গাল্পিকরা এটা অধিক পরিমাণে চায়। তবে বোঝাবুঝির ভাষাটা এখন আর শুধু নিজের বুঝের তালে চলে না। অন্যরা একে কীভাবে ব্যাখ্যা করছে সেই খবর রাখা জরুরি। সেটার সাথে নিজের বুঝের বনিবনা না হলে একলা বা একঘরে হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গ্রিক দেশের বস্তুমুখী ভাবুকের দল থেকে আইনস্টাইন অব্দি আসার পথে জগৎকে বোঝার ভাষা ক্রমাগত নাটকীয় ও সংঘাতমুখর হয়েছে। নতুন যুগের গল্পে এই সংঘাতের ছাপ উমবার্তো একো পড়তে পেরেছেন। যে-কারণে তাঁর ভাষা অন্য লেখকদের সঙ্গে মিল খায় না। সমকালের খুব বেশি কথাকার তাঁকে পড়েছেন কি? রুশদিকে দেখেছি তাঁকে নিয়ে কথা বলতে। বাকিরা মোটামুটি নিশ্চুপ।
“নিটশে মানুষের হাট-বাজারে দাঁড়িয়ে চিৎকার জুড়েছিলেন, ‘তোমরা কি জানো না ঈশ্বর অনেক আগে মারা গেছেন!’ তাঁর এই বক্রোক্তির মধ্যে ‘সংলাপহীনতা’র দুঃখ লেগে ছিল। কারণ ঈশ্বর হলেন সেই বাস্তবতা যার সঙ্গে আলাপ করা যায় না। দু দণ্ড কাছে বসে গল্প-সল্প করা যায় না। যদি যেতো তাহলে জগৎ অন্যরকম এক কাঠামোয় কথা কইতো।”
উমবার্তো একো সেভাবে জনপ্রিয় ও আলোচিত হতে পারেননি। তাঁর পাঠকভাগ্য ঈর্ষণীয় হয়নি। কারণ, তিনি সময় ও বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের বোধের মনোজগৎটিকে লেখার বিষয় করেছেন। টি. এস এলিয়ট বা স্য জন পার্সের সময়-ভাবনার বাতিককে গল্পে ও আখ্যানে নতুন আঙ্গিকে প্রাসঙ্গিক করেছেন। সময়ের জটিল আবর্তকে চিন্তার অধীন করেছেন। তাঁর ভাষা চিন্তাকে বর্ণনা করে। ঘটনারা চিন্তার সঙ্গে সংলাপ সারে। বোধের জগতে বিপর্যয় ঘটার মতো হেঁয়ালি তৈরি করায়। সমকালের দ্বন্দ্ব-সংকুল জগৎকে আগামী ও অসীম এক জগতের দিকে টানে। সাধারণের পক্ষে এই কাহিনীবিহীন কাহিনীর নাগাল ধরা মুশকিল। এর ভাষা অনুবাদ করা কঠিন। একো বহু অনূদিত লেখক না। কিন্তু তিনি বিজ্ঞানীদের চিন্তা ও ভাষার জগতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমানে ছুটছেন। গল্প বলার কাঠামোকে নতুন এক ভাষা-আঙ্গিকে বদলে দিচ্ছেন। এ যুগের কাহিনী লেখকদের জন্য এটা খুব বড়ো ব্যাপার। গল্পভাষা নিয়ে ভাবতে বসে নমস্য এই লেখককে তাই মনে রাখতে হচ্ছে।
জগতে কাঠামোর রকমারি স্বরূপকে এভাবে শনাক্ত করা এবং তাদের সম্পর্ক ও স্ববিরোধিতার জায়গাটি চিনিয়ে দেয়া হচ্ছে ভাষার কাজ। এই অর্থে ভাষাকে কাঠামোর সূতিকাগার বলা যেতে পারে। ভাষার মাধ্যমে কাঠামোরা জগতে সংজ্ঞায়িত হয়। ভাষা যতোদূর আত্মপ্রকাশ করে জগৎ সেই অনুপাতে আমাদের কাছে বোধগম্য হয়ে ওঠে। বাকিটা অনুক্ত থেকে যায়। রহস্য ও অজানার শিহরন তুলে মনের মধ্যে ঘুমায়। মানুষের যে কোনো বিবরণ তাই সবসময় ভাষার অপেক্ষা করে। ভাষাকে বাদ দিয়ে গল্প হয় না আর গল্পকে ছুটি দিলে কাঠামোর বিবর্তন ও বাঁকবদলের ইতিহাসটি চিরতরে হারিয়ে যায়।
এইসব হিংটিংছট হিসাব-নিকাশের মধ্যে যে ভাষা আমায় বয়ান করার কামলা খাটছে তাকে একদা দড়ি খুলে বিচরণের ছাড়পত্র দিয়েছিলাম। মনে আশা ছিল স্থান ও কালাতীত কোনো জগতের খবর আনবে সে। লাভের লাভ অবশ্য কিসসু হয়নি। দিনশেষে চিরচেনা বাস্তবের বাইরে সে যেতে পারেনি। নতুন ও অনাস্বাদিত জগতের খবর আমার আর পাওয়া হয়নি! আমার হয়নি তবে নওম চমস্কির হলেও হতে পারে। ভাষাবিজ্ঞানের অন্যতম পুরোহিত ‘ভাষাবোধ’ ও ‘ভাষাপ্রকাশ’-এর কথা বহুদিন ধরে বলে আসছেন। অর্থাৎ কিনা আমাদের এই ১২০০ সিসি ওজনের মগজখানা ভাষার সাহায্যে যেটুকু ব্যক্ত করে সেটা হচ্ছে ‘ভাষাপ্রকাশ’। এর বিপরীতে অনেককিছু সে গোপন করে যায়। নিউরন কোষের রকমারি প্রহেলিকায় পড়ে সংকেতগুলি মগজের গহীন অতলে হারায়। হারিয়ে যাওয়া এই সংকেতসমগ্র হচ্ছে মানুষের ‘ভাষাবোধ’। কবি-লেখকরা এই ‘ভাষাবোধ’-এর নাগাল পাওয়ার আশায় মাথা কুটে মরে।
আমার ধারণা, ভাষা এক পরাধীন অস্তিত্ব। সে আসলে নিউরন কোষের দাসত্ব করে। ১২০০ সিসি ওজনধারী জটিল এক ক্যাবল নেটওয়ার্কের হয়ে রাতদিন কামলা খাটে। স্বাধীন হওয়ার জেদ অবশ্য তাকে সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরছে, কিন্তু নেপথ্যে কে যেন আঙুল তুলে তাকে শাসায়,- ‘ওহে, তুমি যেটি চাইছো সেটি সম্ভব নহে’। ভাষাকে নিয়ে লেখক আসলে নিরাকার থাকতে পছন্দ করে। অনুভূতিরা সেখানে শুধু তার জন্য শব্দ করবে। কিন্তু গতিবিজ্ঞান বাধ সাধে। ভেলোসিটি পদে-পদে ঝামেলা পাকায়। অগত্যা আকার ও আয়তনের সাথে আপস করে লেখক তার ভাষার খেলবাজি চালিয়ে যায়। ‘ভাষাবোধ’কে মগজের
অতলে কবর দিয়ে বিচিত্র শিল্পমাধ্যমে ‘ভাষাপ্রকাশ’ ঘটায়।
লেখক আসলে চাপ ও অবরোধের হাজার সামাজিকতার মাঝে নিজেকে প্রকাশের রাস্তা খোঁজে। তার মন হয়তো তাকে বলে, ‘গল্প লেখা বা কাব্য করা একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা হলেও পছন্দনীয় কোনো বিষয় নয়। লেখকের পক্ষে বাস্তবতাকে অতিক্রম করে বাস্তবাতীত হওয়া কঠিন। কালের সীমানা লঙ্ঘন করে কালাতীত হওয়া কুত্রাপি সাজে না। আকারকে বিলোপ করে নিরাকার হওয়া আসলে মুশকিল। কারণ, নিরাকারকে মানুষ সম্যক জানে না এবং নিরাকারে মানুষের কোনো বর্ণনা সম্ভবে না!’
২.
গল্পের ভাষা গতিবিজ্ঞানের বাইরে গিয়ে আজ পর্যন্ত কিছু করে উঠতে পারেনি। সৃজনশীল ভাষা সৃষ্টির প্রক্রিয়া আকার ও আয়তনের সীমায় বসে অসীম হওয়ার গান করে। দুনিয়াদারীর কেজো ভাষা সেখানে গল্পভাষায় মোড় নেয়। কোনো একটি ঘটনা হয়তো সেই ভাষা-সংকেতের বীজ বহন করে আনে। লেখকের মনের মাটিতে সেদিন অনুভূতির বৃষ্টি নামে। পৃথক শিল্পমাধ্যম হলেও কবিতা ও গল্পের মিলন-মোহনাটি মোটের ওপর একরকম। দুজনেই অনুভূতিপ্রবণ। ইমেজারি। ইন্দ্রিয় সংবেদী। হয়তো-বা আকস্মিকতা প্রিয়। গল্পের ভাষা আচমকা কোনো বিস্ফোরণ নয়, অনুভূতির এক অকল্পনীয় জাগরণ তাকে জাগায়।
প্রশ্ন তোলা যেতে পারে,- গল্পকার আসলে কে? সে যে এক সংসারী জীব এটা সবাই বুঝি। এর বাইরে অন্য কোনো পরিচয়ে তাকে সনাক্ত করা সম্ভব কি? আমার মনে হয় সংসারী হলেও লোকটি আসলে উদ্ভট। কারণ, সে এক প্রোজ্জ্বল অনুভূতির অপেক্ষায় নিজেকে সংসারে নিঃস্ব করে। গল্প হলো নিজেকে নিঃস্ব করার কাহিনী। চাতক জলের তৃষ্ণায় কাতর হয়। কবি অনুপ্রেরণার দ্বারে ভিখারি সাজে। গল্পলেখক অনুভূতির বিস্ফোরণ ঘটার অপেক্ষা করে। চকিত কোনো দৃশ্যের জন্য গেরিলার মতো ওত পেতে থাকে। দৃশ্যটি তার হৃদয় ভেদ করে ১২০০ সিসির গহীন কাঠামোয় গিয়ে ঢুকবে সেই আশায় বড়শি পেতে বসে থাকে। হতে পারে আকস্মিক এক শব্দতরঙ্গ তার মস্তিষ্ক-কোষে তখন তরঙ্গ বহায়। ঘনীভূত শব্দখণ্ড মনের গহন আঁধারে বাতিঘর হয়ে জ্বলে-নিভে। গল্প লেখার সূচনাবিন্দু বোধহয় এটুকু। তারপর …। নাওয়ের গলুইয়ে বসে লগি ঠেলা। উপসংহারের তীরে নাও ভিড়ানোর চেষ্টা। সুখেন সমাপয়েৎ!
জগতের শুরু থাকলেও পরিসমাপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলার মতো ভাষা আমাদের আয়ত্তে নেই। তবে গল্পের একটি শুরু ও পরিসমাপ্তি থাকতে হয়। বিষয়টি ছক মেনে ঘটলেও গল্পকার আসলে নিজের অভিজ্ঞতাকে বারেবারে নতুন করে লিখে। যাপিত জীবনের সুখ ও যন্ত্রণাকে সে লিখে এবং বাস্তবতার একটি ইশতেহার রূপে মানুষের কাছে এর প্রচার করে। বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন, ইশতেহার লিখলেও গল্পের ভাষা নাকি অবিরাম এক নিরাকার পরিধিতে নিজের নিমজ্জন চায়। সেখানে ডুব দিয়ে পরিচিত শব্দগুলোকে অন্য মাত্রায় বাঙময় করে তোলার নেশায় মজে। রূপক ও সংকেতে প্রাঞ্জল বা রহস্যগভীর হয়। বিখ্যাত সেই ‘ভাষাবোধ’-এর ইঙ্গিত গল্পে নাকি বারবার উঠে। সত্যি উঠে কি? প্রশ্নটি নিয়ে ভাবনার বিস্তর অবকাশ রয়েছে।
‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’,- গল্প লেখার ক্ষেত্রে এই রবীন্দ্র বচনের সার্থকতা কতোখানি জানি না। তবে এটাকে বিলোপ করার সময় এখনো আসেনি। এই ভবে আগের মতন ‘নিতান্ত সহজ সরল’ হওয়া আর সম্ভব নহে, তবে পাঠকের মনে শেষ না হওয়ার রেশ ও আক্ষেপ ছড়ানোর দিনটি তামাদি হয়নি। অতৃপ্তির রেশ ছাড়া গল্পরা বিকশিত হয় না। মানুষ অভিজ্ঞতার সাহায্যে প্রশ্ন তোলে। ভাষা সেই প্রশ্নকে বিস্তৃত ও তির্যক করে। অতৃপ্তির রেশ সঙ্গী হলে গল্প জমে বটে! সুতরাং বিজ্ঞজনকে আমি এই শর্তে কবুল করতে আগ্রহী, স্থানবাস্তবের যে পরিসরে মানুষের বসবাস আমার গল্পের ভাষা সেই পরিসর ছাপিয়ে যেন কথা বলতে পারে। যেখানে শেষ হয়েও শেষ না হওয়ার আক্ষেপকে সানন্দে উপভোগ করা যাবে। এছাড়া গল্প লিখে লাভ কি বলুন?
৩.
চিরচেনা ঘোরদোরের খোলনলচে পালটে দেয়ার অভিযানকে কবিতা তার কাজ বলে মানে। পরিচিত ভাষা সেখানে অপিরচয়ের আবেশ বয়ে আনে। চেনা গোলক বারেবারে উলটো তালে ঘোরে। কবি তাকে গালভরা ভাষায় ‘অপিরিচিতিকরণ’ বলে ডাকে। ইস্পাতের কলের ওপর খড়কে সে শব্দ করে ঝরে পড়তে দেখে। ঘরের জানালাকে উটের গ্রিবার মতো প্রসারিত বলে মনে হয়। এটা হলো শব্দের অর্থ-বিপর্যয়। ১২০০ সিসি ওজনের আশ্চর্য এক গোলকের গহীন কন্দর থেকে অজানা এক বিশ্বকে কবি বের করে আনে। চেনা দৃশ্য নিমিষে অচেনা ও নতুন হয়ে ওঠে। কবিরা এহেন কর্মে দক্ষ! কিন্তু গল্পে? কী ঘটে সেখানে? প্রশ্নটিকে বাক্সবন্দি করতেই হচ্ছে।
হাট-বাজারের ভাষা বা তার কাঠামোকে গল্পকার কীভাবে মোকাবিলা করবে সেটা নিয়ে বাতচিত এখন অব্দি চলছে। দূর ভবিষ্যতেও নিশ্চয় চলবে। অনুভূতির প্রবাহরা কেমন করে গল্পে অবারিত হয় সেটা জানার কৌতূহল কোনোদিন মিটবে না। অনেকে বলে, কবিতা হচ্ছে শব্দের কোলাহল থেকে নীরবতার গর্ভে ফিরে যাওয়া। নীরবতা, যেখান থেকে জগতের দিকে প্রথম আওয়াজটি কেউ ছুঁড়ে দিয়েছিল। কবি তাকে নতুন করে জাগাতে চায়। শব্দ নীরবতাকে যে অর্থ দিয়েছে কবি সেটা পালটে দিতে ভাষার সাথে যুদ্ধ করে। ‘অপিরিচিতিকরণ’ হলো ভাষাকে নতুন ও মোক্ষম করে তোলা। কবিতার ভাষায় কবি অবতারণা করে কল্পবাস্তবতার। গল্পের ক্ষেত্রে বিষয়টি কেমন সেটা বিবেচনা করা যেতেই পারে।
কল্পবাস্তবতাকে সমালোচকরা ‘অর্থ-বিপর্যাস’ বলে ডেকে সুখ পায়। তারা বলে কবি ছাড়া অন্যরা নাকি খুব ভালোভাবে কাজটি করতে পারে না! স্থাপত্য, চিত্রকলা ও সঙ্গীতে অবশ্য সফল ‘অর্থ-বিপর্যাস’ হরহামেশা ঘটছে। গণিত, দর্শন এবং মহাজাগতিক বিজ্ঞানের ‘বিপর্যাস’ ঘটানোর ক্ষমতা কবির কল্পনা-প্রতিভাকে অনেক সময় হার মানায়। তারা চিন্তা ও যুক্তি দিয়ে কথা বললেও অনুমান ও কল্পনার অভিনব সৌন্দর্যের কারণে সেটা প্রতীকী ও মন্ময় হয়ে ওঠে। অন্যরকম কবিতা পাঠের আস্বাদ দেয়। গণিতবিদ কার্ট গোডেল কিংবা আইনস্টাইন এই অর্থে ‘কবিদের মহারাজা’। কাটাখোট্টা গণিত আর ফিজিক্সের আড়ালে যুক্তির শক্তিকে অতলস্পর্শী চিন্তা ও কল্পনার সৌন্দর্যে রঙিন করে গেছেন। হাল জামানার বিজ্ঞানীরা বসে নেই। হকিং বা পেনরোজ থেকে শুরু করে শন ক্যারল সে-পথ ধরেই হাঁটছেন।
ক্যারল তাঁর সর্বশেষ বইয়ে মহাবিশ্বের শুরু ও পরিণতির থিয়োরিগুলো আরেকবার যাচাই করতে গিয়ে নিজের অনুমানকে ‘লজিক’ ও ‘পোয়েটিক’-এ ভাগ করে আলোচনা সেরেছেন। লজিক দিয়ে তিনি থিয়োরিগুলির শক্তিমত্তা যাচাই করেছেন। পোয়েটিক দিয়ে অনুমানগুলোকে অন্যদের কাছে বৈধ করতে চেয়েছেন। ক্যারল সুবক্তা ও সুলেখক। হলিউডের সাইন্স ফিকশন স্ক্রিপ্টের উপদেষ্টা হিসাবে তাঁর এবং ব্রায়ান গ্রিনের নাম একপ্রকার ধরাবাঁধা। সুতরাং মহাবিশ্বের মতো জটিল ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে পোয়েটিক হওয়া তাঁকে মানায় বৈকি।
সৃষ্টিতত্ত্বের গল্পে বিজ্ঞানীরা আজকাল কল্পনা-প্রতিভার বিরামহীন সায়রে নিজেকে ছেড়ে দিতে দ্বিধা করছেন না। তাদের ভাষা নতুন সব রূপক-এ ঝলমল করে প্রতিদিন। এর মধ্যে কোনটি শেষ অবধি প্রামাণিক বলে স্বীকৃত হবে বলা শক্ত। আইনস্টাইনের ‘আপেক্ষিকতা’ বুঝে আসতে ও প্রামাণিক হতে লম্বা সময় নিয়েছে। বিজ্ঞানীরা এসব নিয়ে ভাবতে চাইছেন না। ‘ছদ্মবিজ্ঞান’-এর ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি সহ্য করে নিজের যুক্তিকে অজস্র রূপক-এ মোড়কবন্দি করে হাজির করছেন। এটা হলো উৎকর্ষের সেই সীমানা যেখানে পৌঁছানোর পর কবিত্ব ছাড়া কিছু করার থাকে না। বিজ্ঞানের ভাষায় এখন তার জোয়ার চলছে।
বস্তু ও বাস্তবের কারবারিরা বাস্তবতাকে অতিক্রম করে ঢুকে যাচ্ছেন অধিবাস্তবে। এতোদিন এই ভাষা কবি ও দার্শনিকের একচেটে ছিল। ইমানুয়েল কান্টের দার্শনিক প্রস্তাবনাকে আইনস্টাইন বহুবার বিবেচনায় নিয়েছেন। এখন সে প্রবণতা স্তিমিত হওয়ার পথে। কবি ও দার্শনিকরা নানা কারণে অনেক পিছনে পড়ে গেছেন। বাস্তবতার ‘অর্থ বিপর্যাস’ বিজ্ঞানের নতুন সব অনুমান ও কল্পনার সারথী হয়েছে। সৌন্দর্য ও নবীনত্ব আসলে স্থানবাস্তবের গৎবাঁধা বিবরণের মাঝে নিহিত থাকে না, তাকে অতিক্রম করার ভাবনা ও কল্পনার মধ্য দিয়ে সে নবীন ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। কবি ও গল্পকারকে এটা আরেকবার মনে করিয়ে দেয়ার সময় হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা কেন বাস্তবতাকে অতিক্রম করে বাস্তবাতিত হয়ে উঠেন সে-প্রশ্নের জবাব রিচার্ড ফাইনম্যান দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এই সুযোগে গল্পটি বলে নিতে চাই। তাঁর এক আঁকিয়ে বন্ধু ছিলেন। একদিন তিনি তাঁকে একটি ফুল দেখিয়ে বলেন, ‘দেখো ফুলটি কী সুন্দর! আমি জানি, তোমরা বিজ্ঞানীরা একে সুন্দর থাকতে দেবে না। ফুলটিকে তুমি টুকরো-টুকরো করবে। ভিতরে কী আছে দেখার জন্য কাটাছেড়া করবে। ফুলটি তার অনাবিল সৌন্দর্য হারিয়ে নিরস ও বিরক্তিকর হয়ে উঠবে তখন। বিষয়টি সত্যি মানা যায় না।’ বন্ধুর অভিযোগ শুনে ফাইনম্যান বিড়ম্বিত বোধ করছিলেন। সেটা কাটিয়ে অভিযোগের উত্তর করলেন:-
‘দেখো বন্ধু, ফুল অবশ্যই রূপবতী। আমি তার রূপ ও সুগন্ধের কদর করি। সেইসঙ্গে ওর এই কুঁড়ি ও পাপড়ির মধ্যে আরো বেশি কিছু দেখি, তুমি যার খবর রাখো না। ওটাকে আমি শুধু ফুল বলে ভাবি না। ‘ফুলকোষ’ বলে ডাকি। কারণ ওর একটি আনবিক গঠন রয়েছে। পরমাণুরা সেখানে জটিল ও নয়নাভিরাম স্থাপনা গড়ে তুলেছে। ফুলটি সেই স্থাপনার জোরে রূপের বাহারে এতো ঝলমল করে। তুমি সেই বাহারকে তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোল আর আমি অনু-পরমাণুর জটিল খেলাটি দেখে চমকিত কৌতূহল নিয়ে ভাবি, ‘জটিল খেলাটি উদ্দেশ্যমূলক। সেটা এজন্য যে পতঙ্গরা তার পরাগায়ন ঘটাবে। তাকে বারবার নতুন করে জন্ম দেবে। হাজার বছরের সাধনায় সে এই সিদ্ধি লাভ করেছে এবং সাধনা করেই যাচ্ছে।
বন্ধু হে, নান্দনিকতা শুধু বাইরে ফোটে না, ফুলের অন্দরে এক মনোহর জগৎ চলেছে। সেখানে চাকা ঘুরছে, ধ্বজা উড়ছে। এই কর্মযজ্ঞের জোরে পুষ্পরা সুন্দরী হয়। ওই কারিগরির পাল্লায় পড়ে রূপের গরবে মরাল গ্রিবা তুলে তোমার-আমার মন ভোলায়। ওলিরা সেখানে জোটে হাজার বছরের প্রেম ও প্রয়োজনের টানে। আমি যখন ফুল হাতে নেই তখন ওর গহীন কন্দরে লুকিয়ে-থাকা সৌন্দর্যের বন্দনা করি। এটা আমাকে বাস্তবতার নতুন রূপ-দর্শন করায়। বাইরের জগৎ থেকে ভিতরের জগতে টানে। দূরাতীত ও গভীর এক বাস্তবে আমার তখন সমাধি হয়। যেখানে আমরা সবাই গতির আবর্ত ও পরাবর্তের টানে বিকশিত হচ্ছি সুন্দরের দিকে। আমাকে তুমি নিরস বলতে পারো না।’
ফাইনম্যানের বিবৃতি যথেষ্ট এটা বোঝার জন্য যে বাস্তবতার বিপর্যাস কবি একা ঘটায় না। রূপক ও প্রতীক তার একার সম্পত্তি নয়। ওটা সকল শাস্ত্রে কমবেশি চলে। সে যাকগে, প্রশ্ন হচ্ছে বাস্তবতার গহীনে সংগুপ্ত এই নীরবতাকে ভাষা দেয়ার খেলায় গল্পকে আমরা কোথায় রাখবো? তার কাঠামো কি এরকম কিছু হওয়ার জন্য লড়াই করে? নাকি কোলাহলভরা বিশ্বের নিরস বিবরণে নিজেকে নিঃশেষ করে? গল্পভাষার আলোচনায় এসব প্রশ্নকে প্রাসঙ্গিক করা দরকার।
৪.
ভাষা নিয়ে ভাবতে বা গল্প করতে বসলে কেন জানি না ঈশ্বরচিন্তা আমায় পেয়ে বসে। মনে-মনে ভাবি, ঈশ্বর যদি থাকেন তবে তিনি কোন্ ভাষায় নিজেকে ব্যক্ত করছেন! জগতের শুরুতে তিনি কি বাকরহিত ছিলেন? এবং এখনো কি তাই আছেন? নাকি নিজের সঙ্গে নিজে কথা কইছেন! নিজেকে যদি একা করে রাখেন সেক্ষেত্রে ভাষার প্রয়োজন তাঁর থাকে কি? মনে হয় না। ভাষা না থাকার অর্থ হলো ঈশ্বর না থাকা, আর ঈশ্বর না থাকা মানে নিঃসঙ্গ এক হাহাকার। এটি হলো সেই চাপ যেখানে ‘মরিবার হলো তার সাধ’ বলা ছাড়া কারো কিছু করার থাকে না!
নিটশে মানুষের হাট-বাজারে দাঁড়িয়ে চিৎকার জুড়েছিলেন, ‘তোমরা কি জানো না ঈশ্বর অনেক আগে মারা গেছেন!’ তাঁর এই বক্রোক্তির মধ্যে ‘সংলাপহীনতা’র দুঃখ লেগে ছিল। কারণ ঈশ্বর হলেন সেই বাস্তবতা যার সঙ্গে আলাপ করা যায় না। দু দণ্ড কাছে বসে গল্প-সল্প করা যায় না। যদি যেতো তাহলে জগৎ অন্যরকম এক কাঠামোয় কথা কইতো। আমাদের দুখ-সুখের গল্পেরা তখন কেমন হতো? বিষয়টি আমাকে ভাবায়। এটা নিয়ে গল্প লিখতে চাইবো কোনো একদিন। কেমন হবে সেটা জানি না তবে লেখার ইচ্ছেটা বহু পুরোনো। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে অনেকে লিখছেন। হাসি-কান্নার গল্প লেখা কোনোদিন হয়তো শেষ হবে না। আমার সেখানে অধিক কিছু যোগ করার ক্ষমতা আছে বলে মনে করি না। আমি খুব আশাবাদী মানুষ নই। তবে বাঙলা ভাষায় গল্প লেখার জগতে বৈচিত্র্য আরো বাড়ুক এই আশাবাদ ধারণ করি অন্তরে। নিজের সীমাবদ্ধ ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করতে ক্ষতি কী! খানিক ভিন্ন পথে গেলে নিটকবন্ধুরা গল্পের জাত মেরেছি বলে আশা করি মারতে উঠবেন না। আর যদি ওঠেন, তখন নতুন করে ভাববো না-হয়।
নিটশের প্রসঙ্গ উঠতে বেলা টার-এর কথা মনে পড়ে গেলো। আমার কাছে সিনেমাকে আজকাল গল্পভাষা রপ্ত করার নতুন এক জগৎ বলে মনে হয়। গল্পের অভিনব সংকেত ও প্রতীক রূপালী পর্দায় প্রায়ই ঝিলিক দিয়ে ওঠে। গত একশো বছরে বানানো সিনেমাগুলো নিয়ে দারুণ সব গল্প হতে পারে। কেউ হয়তো সেটা লিখবেন। আমার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই, নইলে দুই হাত খুলে লিখতাম। সে যাকগে, বেলা টারের কথায় ফিরি। ভদ্রলোকের নিবাস হাঙ্গেরি। প্রাক্তন সমাজতন্ত্রের দেশে বসে সিনেমা বানান। টারের সাত পর্বের কাহানী ‘স্যাটান ট্যাঙ্গো’ আর ‘তুরিনের ঘোড়া’ দেখার অভিজ্ঞতা মন থেকে পুরোপুরি বিদায় নেয়নি। ফ্রেডরিখ নিটশের জীবনে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার লেজ ধরে প্রায় আড়াই ঘণ্টার কাহানী হচ্ছে ‘তুরিনের ঘোড়া’। কাহিনীর নায়ক কিন্তু নিটশে নয়, ঘোড়ার এক কোচোয়ানকে নিয়ে বেলা টার তাঁর গল্পের জাল বোনা করেন। নিটশের সঙ্গে কোচোয়ানের সংযোগ স্রেফ আকস্মিক। যে-কারণে দার্শনিক প্রবরকে দর্শক পর্দায় দেখে না। টার একটি লিখিত বিবরণ ঝুলিয়ে দেন পর্দায়। দর্শক সেটি পাঠ করে চলে।
তুরিনে শহরের কোনো এক স্টেশনে ঘোড়ার কোচোয়ান তার অবাধ্য ঘোড়াটিকে নিয়ে নাজেহাল হচ্ছিলো। জেদি ঘোড়া আর এক পা আগাবে না বলে পণ করে বসেছে। ‘ঘোড়া না শুনে কথা’র জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ হয়ে থুম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। কোচোয়ানের চাবুক ও শাসানীতে কাজ হচ্ছে না। নিটশে এই ঘটনার আশপাশে ছিলেন। খুব সম্ভব জরুরি কোনো চিঠি ডাকবাক্সে ফেলার জন্য বের হয়েছিলেন। ঘোড়া অবাধ্য হয়েছে দেখে কোচোয়ানের মেজাজ খারাপ হতে পারে, নিটশের সেখানে মেজাজ খারাপ করা ও নাক গলানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবু খেপলেন। জেদি ঘোড়ার নাক বরাবর নিজের দুই বাহু পাকিয়ে বিদ্রূপ শুরু করে দিলেন। বাড়ির মালিক সাথে ছিল বলে রক্ষা। খ্যাপা ভাবুককে সামলে-সুমলে সেদিন ঘরে আনে।
পরের ঘটনা সারা বিশ্ব জানে। টানা দুই দিন নিজের ডিভানে নির্বাক বসা ছিলেন। কারো সঙ্গে কথা বলার মেজাজে ছিলেন না। ডিভানে বসে অবিরত বিড়বিড় করে গেছেন, ‘হায় মা! আমি কী বোকা!’ ঘটনা বলে নিটশে এরপর আরো দশ বছর জীবিত ছিলেন, কিন্তু কেউ তাঁকে কথা বলতে দেখেনি। জগতের সঙ্গে তাঁর সকল সংলাপ ওই ঘটনার পর নীরব হয়ে গিয়েছিল! এদিকে কোচোয়ান নিজের ঘোড়া নিয়ে বাড়ি ফিরতে সক্ষম হলেও পরদিন থেকে আর বেরুতে পারেনি। টারের কাহিনী সেখান থেকে শুরু হয়।
কোচোয়ান বের হতে পারেনি, কারণ, জগতের নির্জন এক প্রান্তে সে বসবাস করে। শহর থেকে দূরে এবং গ্রামের প্রান্তদেশে। বায়ুপ্রবাহ সেখানে একবার অস্থির হলে আর থামতে চায় না। একতালে শব্দ করে বইতে থাকে। পর্দায় বায়ুর অস্থির প্রবাহ আর ধুলায় আচ্ছন্ন চরাচর একটি বড়ো ঘটনা এবং বেলা টার আড়াই ঘন্টা ধরে দর্শককে সেটি দেখে যেতে বাধ্য করেন। সিনেমা শেষ হয় কিন্তু মনের মধ্যে হাওয়া ও ধূলির গর্জন যেন থামতে চায় না। কারণ, এটা শেষ হওয়ার নয়।
বায়ুপ্রবাহ ও ধূলিঝড় যেখানে চরম সেখানে কারো পক্ষে ঘরের বাইরে যাওয়া কঠিন। ঘোড়ার বুড়ো সহিস তাই সকল প্রস্তুতি নিয়েও বের হতে পারে না। সকালে সে ঘুম থেকে উঠে। জানালার ফাঁক দিয়ে বাতাসের গতিবিধি মাপে। বউ নেই। সঙ্গী বলতে মেয়ে আছে একটি। কন্যা ঘর ঝাঁট দেয়। বাপের জন্য আলু সেদ্ধ চাপায় হাড়িতে। আলুর খোসা ছড়িয়ে লবণ মাখায়। সকাল থেকে রাত অস্তক খাবার মেনু বলতে ওই এক আলু সেদ্ধ। বাপ-বেটি টেবিলে বসে একমনে আলু সেদ্ধ চিবায়। এই আহারপর্বের চাপ সহ্য করা এক পরীক্ষা বটে! বেলা টার দর্শককে সেই পরীক্ষার সম্মুখীন করান।
পেটের দায়ে বাপ বাইরে বের হতে চাইলেও মেয়ে বাইরের জগতের জন্য উতলা নয়। তার দম ফেলার ফুরসত নেই। বায়ু ও ধূলির প্রকোপ সহ্য করে মশকে পানি ভরে আনে। যন্ত্রের মতো ঘর ঝাড়ামোছা করে। আস্তাবলে গিয়ে ঘোড়ার খবর নেয়। জেদি ঘোড়াটির জন্য দানাপানির ব্যবস্থা করা দরকার। মেয়ে সেটা করে। প্রতিদিন হুড়কো লাগায় এক নিয়মে। ওদিকে বাপ ঘুম থেকে উঠে বাইরে বের হওয়ার জন্য তৈয়ার হয়। আস্তাবলের হুড়কো খুলে ঘোড়াকে তৈয়ার করে। দুজনে বের হয়ে আবার ফিরে আসে। আবার সেই হুড়কো লাগানো! কোচোয়ানের বেশ ছেড়ে মলিন ট্রাউজার্স ও শার্ট গায়ে দিয়ে গুম হয়ে বসে থাকা। তারপর…! আবারো সেই আলু সেদ্ধ ও নিদ্রা! বাপ-বেটির মধ্যে কথা-বার্তা হয় যৎসামান্য। এটাকে সংলাপ বলা যাবে না। ‘তুরিনের ঘোড়া’য় বেলা টার প্রায় নির্বাক। জীবন যেখানে ক্লান্তি ও একঘেয়েমির বোঝা টানছে সেখানে কথার প্রয়োজন চিরতরে ফুরিয়ে যায়।
সংলাপহীন পরিবেশে একজন শুধু অবিরত কথা বলে চলে। সে হচ্ছে অস্থির ও গর্জনশীল বায়ুপ্রবাহ। সাত দিন ধরে টানা বইছে, তবু থামার কোনো লক্ষণ নেই। সকাল থেকে রাত অব্দি বাপ-বেটি তাই এক ছকে ঘুরে। পড়শিরা দু’চার জন মাঝেমধ্যে উঁকি দেয় ঘরে। ঝগড়া ও স্বার্থের হিসাব-নিকাশ চলে কিছুক্ষণ। কথাবার্তা হয় বটে, তবে সেটা জীবনকে জাগিয়ে তোলার মতো পর্যাপ্ত নয়। বাপ-বেটি তাই সংলাপহীন আবর্তে বসে হাওয়া বদলের দিন গুনে। বায়ু না শোনে কথা! সে তার গতি বদল করবে না বলে মন ঠিক করে নিয়েছে। স্নায়ুর ওপর গর্জন তুলে টানা বইতে থাকে।
বায়ুর সঙ্গে প্রবল হয় ধূলিঝড়। ধূসর ধূলির তরঙ্গ এবার পানির উৎসে হামলা চালায়। অচিরে ভূখণ্ড গ্রাস করবে বোঝা যাচ্ছে। বাপ-বেটির হাতে কোনো বিকল্প থাকে না। প্রকৃতি এক অবাধ্য ঘোড়া। একবার জেদি হলে তাকে থামানো মুশকিল। সে থামবে না বুঝে বাপ-বেটি এবার ঘর ছাড়ে নতুন বসতির খোঁজে। বায়ু তখনো একতালে বইছে এবং গর্জন করছে। জীবন যেমন একঘেয়ে ছন্দে জগতের সকল কোণে সমানে বইছে! প্রাতরাশ থেকে নৈশভোজ অব্দি বৈচিত্র্যহীন তালে কলুর বলদ ঘুরছে সবখানে!
এই অনুভূতির সঙ্গে লড়াই করাটা খুব কঠিন। একটি মানুষকে পাগল করে দেয়ার জন্য এটা যথেষ্ট। নিটশে সেটা বুঝতে পেরে আর কোনো কথা না বলার সিদ্ধান্ত পাকাপাকি করেছিলেন। ঈশ্বরের সঙ্গে সংলাপের বাসনা ছিল তাঁর। সেটি সফল হয়নি। রমণী ও বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আলাপ ও চুম্বনের শখ ছিল। ওটাকে সফল করা যায়নি। নতুন চিন্তা দিয়ে জগতের তাবড় অধ্যাপক ও বুদ্ধিসেবীদের মাথা খারাপ করে দেয়ার খায়েশ হয়েছিল তাঁর, কারণ ওরা প্রথার গোলামি করছে। খায়েশটি পূরণ হয়নি। তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল পাগল ও নির্বাক হওয়ার। সেটা পূরণ হয়েছে। তিনি পাগল হলেন তুরিনে ঢোকে।
পাগল হওয়ার প্রস্তুতি সারতে নিটশে তুরিনে ঢুকেছিলেন। পাগল হয়ে জগৎকে নিজের চেতনা থেকে খারিজ করে দিলেন। ফ্রেডরিখ নিটশে ভুবনবিখ্যাত লোক। তাঁর খবর সকলে রাখে। জগতের সঙ্গে বোঝাপড়ায় তাঁকে লাগে বৈকি। কবি থেকে হিটলার কারো সেখানে বাদ পড়ার চান্স নেই। কিন্তু জেদি ঘোড়াকে সামলাতে ব্যর্থ কোচোয়ানের খবর কে আর করে! ইতিহাসের তাকে প্রয়োজন নেই, তবে বেলা টারের ছিল। হাঙ্গেরিতে বসে টার তাকে খবর করলেন তুরিনে।
বেলা টারের খবর করার ধরনটি ভারি অদ্ভুত। খবরের সবটা নিশ্চয় সত্য নয়। সেখানে মনের মাধুরী যথেষ্ট মিশেছে বোঝা যায়, তবে জীবনের গল্পটি সত্য। ‘তুরিনের ঘোড়া’ এক বিরতিহীন গল্প। কেবল সিনেপর্দায় এমন গল্প লেখা সম্ভব। বইয়ের পাতায় গল্পটি লেখা কঠিন। পাঠক দু পাতা পড়ার পর মুখ ফিরিয়ে নেবে। এমন গল্প বাংলাদেশে বসে লেখা সম্ভব কি? আমার মনে হয় সম্ভব। চর, হাওর ও উপকূলের জলবায়ুর সঙ্গে যারা যুদ্ধ করে টিকে আছে তারা এই বুড়ো কোচায়ান থেকে কোনোদিকে ভিন্ন নয়। এই গল্পটি আমাদের নিজস্ব আঙ্গিকে লেখা যেতে পারে, এবং সেটা সিনেমায় হলে বাঙলা ভাষা নতুন ঐশ্বর্য পাবে। তরুণ নির্মাতারা গল্পটি ভেবে দেখতে পারেন।
পশ্চিমে সিনেমা এখন সাহিত্যের তাবেদারি করে না। নিজের গল্প নিজে বলতে জানে। ‘নবতরঙ্গ’-এর পুরোধা জ্যা লুক গঁদার ভীষণভাবে চাইতেন সিনেমাওয়ালারা যেন নিজের গল্প নিজেরা বলতে শিখে। এতে করে সাহিত্যের নির্মম দাসত্ব তাকে করতে হবে না। সিনেমা পাবে তার নিজস্ব ভাষা ও শৈলী। গঁদারের সেই ইচ্ছা বেলা টার অনেকখানি পূরণ করে দিয়েছেন। ‘তুরিনের ঘোড়া’ নতুন এক ভাষা-আঙ্গিকে লেখা গল্প এবং সাহিত্যের কবি ও গল্পকারদের জন্য অনুকরণীয়।
ছবিটি বানানোর সময় বেলা টার ঘোষণা দিয়েছিলেন এটি তাঁর শেষ সিনেমা। এই মতে তিনি এখনো অটল আছেন কিনা জানি না, তবে ‘স্যাটান ট্যাঙ্গো’ বা ‘তুরিনের ঘোড়া’ বানানোর পর কিছু না করলে ক্ষতি নেই। নৈঃশব্দ পরিবেশনার গুণে শব্দ করে। বেলা টার সেই প্রমাণ রেখেছেন। নিরেট বাস্তবতায় বিচরণ করে বাস্তবাতীত গল্পটি লিখতে পেরেছেন। জাতীয়তাবাদের এমন মারমুখী আগ্রাসনের যুগে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠা সহজ কম্মো নয়। টার তাঁর ভাষা দিয়ে সেটা পেরেছেন বলে আমি অন্তত মানি।
সেলুলয়েডের ফিতায় গল্পটি লেখার পর বেলা টার কী বলতে পারেন সেটি অনুমানের চেষ্টা করছিলাম। মনে হলো তিনি আমার সামনে বসে বলছেন:-
“দেখো জীবন এরকম-ই। এটা ভীষণ একঘেয়ে। রুটি-রুজির তালে সকলে একছন্দে ঘুরছি। পরিবেশ বৈরী। হাওয়া প্রতিকূল। স্রষ্টা নিখোঁজ। এসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেটের দায় মেটাচ্ছে জগতের লক্ষ-কোটি কোচোয়ান। নিটশের অনেক কিছু বলার ছিল এবং তিনি সেটা বলেছেন, তবে কিছু পালটাতে পারেননি, তাই হয়তো পাগল হয়ে গেলেন। কোচোয়ানের সত্যি কি কিছু বলার আছে? একটা কথা অবশ্য সে বলতে পারে,-‘দেহ নামের চাকাটিকে যেভাবে পারো সচল রাখো, আর যদি না পারো তাহলে নিজেকে ঝুলানোর দড়ি খোঁজ। ওটা তোমার আশেপাশেই আছে। এরচেয়ে বেশি জানতে চেয়ে লাভ নেই।”
কোচোয়ানের কথা হয়তো সত্য। ‘জানতে চেয়ে লাভ নেই।’ নিটশে জানতে গিয়ে পাগল বলে নাম কিনেছেন। তাঁর চিৎকারে সংলাপহীনতার দুঃখ লেগে ছিল। হাজারো কোচোয়ানে পৃথিবীটা গিজগিজ করছে। নিজের দুর্ভোগ ও মন্দভাগ্যের জন্য তারা কাকে দোষ দেবে? কার কাছে নালিশ ঠুকবে? কার কাছে গেলে তার মনের বুঝ হালকা হবে? এমন ‘অতিমানব’ কে আছে যার নিকটে গেলে হৃদয়ের জরা ও গ্লানি ধুয়েমুছে যাবে? পৃথিবীতে কারো জন্য কিছু আর অবশিষ্ট নেই,- আত্মস্বার্থ ও আত্মগ্লানির পাঁকে ডুবে থাকা ছাড়া কিছু যেন করার নেই। এসবের বাইরে এক জগৎ থাকতে হয়, যেখানে মানুষ নিরাময় করবে নিজেকে। অন্যথায় একপেশে ও একঘেয়ে ভাষার মাচা বইতে-বইতে একদিন তার জীবন ফুরাবে। এটা অনুভব করে নিটশে হয়তো ঈশ্বরের খোঁজ-খবর করেছিলেন। অনেকে যেমন এখনো করছে! খোঁজ পেয়েছে কি? এই প্রশ্নের উত্তরে মহাকাশ এখনো নির্বাক!
অবতারগণের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র। ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের বাতচিত তাঁরা নিজে ছাড়া অন্য কেউ দেখেনি। দর্শনধারীর বিচারে তাঁদের দাবি তাই ধোপে টেকে না। মানুষ ঈশ্বরকে টিকিয়ে রেখেছে তার নিজের প্রয়োজনে। কারণ সে বিশ্বাস করে জগতে ‘শূন্য’ বলে কিছু থাকতে নেই। কাঠামো ধসে গেলে কাহিনীর যবনিকা ঘটতে পারে না। ক্ষয় ও ধসের পরে জগতের একটা গন্তব্য থাকা চাই। ঈশ্বরকে সেই গন্তব্য ধরে নিয়ে তারা পথ হাঁটছে। ধসের পর মিশে যেতে চাইছে অতলান্ত ও বাকহীন নিরাকারে।
এই মিশে যাওয়াটা হলো গল্পের ভিতরের গল্প। মানুষ নিজে এর রচয়িতা। ‘ভাষাবোধ ও ভাষাপ্রকাশ’ দিয়ে নশ্বর জগতের বিপরীতে অবিনশ্বর এক জগৎ সে কল্পনা করে নিয়েছে। সেটাকে আবার চিরচেনা জগতের আদলে সজ্জিত করেছে। এর এক পাশে অজর-অক্ষয় এক সুখের নদী বইছে, অন্য পাশে মৃত্যুহীন পাপের স্রোত বয়ে চলেছে। স্বর্গ-নরক মানুষের কল্পনা-প্রতিভা দিয়ে তৈরি। কবি কী অর্থে বলেছেন জানি না, তবে খুব বেশি ভুল বলেননি, ‘কোথায় স্বর্গ?/ কোথায় নরক?/ কে বলে তা বহুদূর?/ মানুষের মাঝেই স্বর্গ-নরক/ মানুষেতে সুরাসুর’। ভাষা দিয়ে এসব গল্প তৈরির একটাই কারণ,-নশ্বর মানুষ শূন্যতা একদম সহ্য করে না।
নিটশের ঘোষণায় তাই কোনো কাজ হয়নি। জগতের সিংহভাগ মানুষ আজো বিশ্বাস করে সংলাপহীন ঈশ্বর জগৎকে গুটিয়ে নেয়ার পর আবার মুখর হবেন কলরবে। তিনি এখন বনফুল-এর গল্পের ব্রহ্ম হয়ে বিরাজ করছেন নিরাকারে। জগতের অজস্র নালিশ শুনে ক্লান্ত ও হতশ্বাস হয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছেন। যিনি ঈশ্বর তাঁর বিচলিত হওয়া সাজে না। এরচেয়ে চোখ মুদে কিছুদিন নির্বাক থাকা ভালো। জগৎকে গুটিয়ে নেয়ার দিন তাঁর সেই ঘুম নিশ্চয় ভাঙবে। ঈশ্বরের সঙ্গে আলাপের সাধ সেদিন মানুষের মিটবে। যদিও আলাপের ভাষাটি কী হবে সেটা আজ অব্দি কেউ ঠিক করতে পেরেছে বলে জানি না!
ঈশ্বর থাকুন এবং না থাকুন, সত্যিকথা হলো জগৎ কোনো একভাবে আবিভূর্ত হয়েছে। আরো অনেক কিছুর সঙ্গে বাবা আদম ও বিবি হাওয়া সেখানে এসে জুটেছেন। দুটি মানুষ এখন কেমন করে পরস্পরকে বুঝবে? কীভাবে নিজের অনুভূতিকে অন্য জনের কাছে পৌঁছে দেবে? দেহের সংযোগ তো হলো। মনের সংযোগ ঘটবে কী করে? কেমন করে দুটি মানুষ নিজেদের কাছে বৈধ ও অর্থপূর্ণ হবে? সংযোগকে বৈধতা দেওয়ার এই তাড়না থেকে হয়তো ভাষার বিকাশ ঘটেছে।
জগৎ-সৃষ্টির কাহিনীটি সত্যি বলে মনে হয় না। বস্তুবাদী বলবে এটি কল্পনাভারাতুর সুন্দর মিথ্যা। দুখী মানুষের জন্য মর্মান্তিক সান্ত্বনা। হলেও হতে পারে। কিন্তু জগতে ভাষার প্রযোজনীয়তাকে সে বিজ্ঞাপন করে। ভাষা ছাড়া জগৎ স্তব্ধ এক শিরোনাম হতো। যেখানে স্পন্দন আছে, কোনো বাক্য নেই। বিচিত্র কোলাহল রয়েছে, একটিও সংলাপ নেই। হাওরে একলা দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষকে দেখে দর্শক শিহরণে কাঁপে। এরকম এক শিহরণভরা পৃথিবী আমাদের আশ্রয় হতো কি? জগৎ-সংসারের তালে ঘুরে যারা গল্পটল্প লিখে তাদের কাছে এসব প্রশ্ন মূল্যবান নয় জানি। গল্পকার হচ্ছে জীবনের লিপিকার। ভাবুক হওয়ার তাগিদ তাকে খোঁচায় বলে মনে হয় না। তবে জিজ্ঞাসু ও অনুসন্ধানী হওয়া ভীষণ দরকারি। এ না হলে ভাষা জাগ্রত হয় না, আর স্থান ও কালের চিরচেনা গণ্ডিতে বসে গল্পকার নামক জীবটি অসার বাক্যের উৎপাদক বলে দুর্নাম কিনে।
বাক ও সংলাপহীন নিঃসঙ্গতার ভার থেকে ভাষা মানুষকে মুক্তি দিয়েছে। জগতের সাথে সংলাপ ও সংযোগকে সুগম করেছে। সভ্যতার বিকাশ চিন্তা করলে ভাষা হলো সেই জরুরি ‘চিহ্ন’ যেটি সভ্যতাকে বর্ণনা ও সংজ্ঞায়িত করছে। ‘আমি কেন আছি, কীভাবে আছি এবং কাদের সঙ্গে আছি’- এই কৌতূহলের খোরাক কে মেটাবে? চোখের ইশারা ও দেহের মুদ্রা দিয়ে পুরোটা মিটানো সম্ভব নয়। ভাষা সেটা পারে। সে হলো জগৎকে বোঝার চাবি। নিজে সংযোগ করে ও অন্যকে সংযুক্ত হতে বাধ্য করে। এই সত্য অস্বীকার যাওয়ার উপায় কারো নাই।
ভাষার ক্ষমতা এক্ষেত্রে ঐশ্বরিক। ভাষা দিয়ে সংকেত পাঠানো যায় বলে কবিতা সম্ভব হয়। তাকে দিয়ে বিরামহীন বিবরণ পেশ করানো যায় বলে কাহিনী ও ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ইঙ্গিতকে ব্যাখ্যা করার শক্তি সে রাখে বলে আখ্যানের বিকাশ ঘটে। জগৎকে বুঝে ওঠার প্রশ্নে ভাষা হচ্ছে বাস্তবতার বাস্তবতা। একদিকে কোর্ট-কাছারির কাজ দিব্যি সারছে। অন্যদিকে শিল্প ও বিজ্ঞান তৈয়ার করছে। সে যেটুকু প্রকাশ করে সেটা হলো জগতের ইতিহাস। বোধের জগতে যেটুক তলিয়ে যায় সেটা অব্যক্ত। নিউরন কোষের ইশারা পেলে কোনো একদিন ব্যক্ত হতেও পারে। ভাষার এই ব্যক্ত ও অব্যক্তকে বুঝে উঠার উপর গল্পের নিয়তি ও ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে। কথাটি মনের মধ্যে সিলগালা করে রাখতে চাই।
…
(ক্রমশ)