‘সমাধিফলক’ (অকালপ্রয়াত কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার স্মরণে)
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ, | ২৫৫৭ বার পঠিত
“সমাধিফলক”
(কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার-এর স্মরণে)
নির্ধারণ করি সব। একটি গাছ যেমন নির্ধারিত হয় ভবিষ্যতে, বীজ ও ফলের নির্ধারণে লেখে কচি কিশলয়।
নির্ধারণ করি না সব। যতো নাম-সর্বনাম, বিশেষ্য বা বিশেষণ, যারা লেখে মানুষ মহান। যতো বচন-প্রলাপ, যারা উক্তি করে মানুষ মহান। যতো যুক্তি-তক্কো-গপ্পো, যারা ঘোষিত করে মানুষ মহান। তাদের মতো নির্ধারণ করি না আমার এ ভবিষ্যৎ।
নির্ধারণ করি সব। নিশিডাক। বিড়ালের গলার আওয়াজ। কিন ব্রিজে হঠাৎ ব্যস্ত পায়চারি। ঘন কুয়াশায় সংগোপন দেবদূত আর চমকে ওঠা যুগল কৃষক যেভাবে নির্ধারণ করে নিজেকে, তাদের মতো নির্ধারিত হই ভবিষ্যতে।
…
এক বেওয়ারিশ লাশের দিকে নির্ধারিত ছিল আমার এ ভবিষ্যৎ। অচিন ফলের বাগানে রক্তলোভাতুর কিশোর জননীর ঘুমক্লান্ত মুখের দিকে নির্ধারিত হবে বলে পচে উঠেছিলো একদিন। কুণ্ডুলী পাকানো মৃত অজগরে সুপক্ক মাংসের ঘ্রাণ পেয়ে পচেে উঠে ফল বাগান। ফলবাগানে শায়িত জননীর লাশের দিকে মুখ করে আমিও অবেলায় পেকে উঠি। বিড়ালের রক্ত লোভাতুর চোখে কবেকার স্তব্ধ পাখির মাংস ও মৃত মদিরার মতো সুপক্ক যবের ঘ্রাণ নিয়ে জেগে আছে এই ফলবাগান। বেওয়ারিশ মাটির দিকে মৃত হরিয়ালের ঝাঁক সিংহ ও শাবকের গল্প করে। অশান্ত জলের সাগরে রুপালি ইলিশ আর মৃতপ্রায় জাহাজির ঝাঁক দেখে মনে পড়ে বেওয়ারিশ মাটির দিকে নির্ধারিত হতে চাইনি কখনো! ফলবাগানে শায়িত কিশোর দেখে মনে পড়ে মাংসলোভাতুর ঈগলের রাজকীয় সিংহাসনের দিকে মুখ করে থাকে মানুষের নির্ধারণ!
…
কিন্তু কে সেই শিশু, যে প্রথম কলরব তুলেছিল? কে সেই নিশি পাওয়া কিশোর, যে প্রথম আওয়াজ ছুঁড়েছিল? কে সেই অচিন অবধূত, যে তার হাত কাঁধে রেখে বলেছিল, – “যদিও নির্ধারিত সব, তবু নির্ধারণ করো নিজেকে আবার…!”
এইসব ভ্রম ও প্রহেলিকা, সোনার কবরী খসা ভোর অথবা গোধূলি আর জনকের দৃষ্টিভেদী চোখে শ্রাবণের ঢল দেখে জানতে চেয়ো না কেন নির্ধারিত করে দিতে চাই সব। জানতে চেয়ো না কে সেই আওয়াজ, যা ক্লান্ত লাটিমের মতো নির্ধারিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়েছিল একদিন…অক্লান্ত চাষার মতো দীর্ঘ এক রাত্রির দিকে, অবগুণ্ঠনে আবিল দিনের পায়চারির দিকে, রাতের বারবণিতা ও জ্যোতিষীর দিকে, বন্ধু ও বণিকের মিলনসন্ধানী প্রতারণার দিকে, জনক ও জননীর মৃতপ্রায় মুখের দিকে, আর রমণীর নাতিশীতোষ্ণ লাস্যের দিকে!
কিন্তু কে সেই শিশু, যে প্রথম কলরব তুলেছিল? কে সেই নিশি পাওয়া কিশোর, যে প্রথম আওয়াজ ছুঁড়েছিল? কে সেই অচিন অবধূত, যে তার হাত কাঁধে রেখে বলেছিল,- “যদিও নির্ধারিত সব, তবু নির্ধারণ করো নিজেকে আবার…!”
কে সে, যে আওয়াজ তোলে একদিন, ওহে রাত্রিচর, বিড়ালে পাওয়া রাতের পতঙ্গ, এইবার নির্ধারণ করো নিজেকে, নির্ধারিত হও ভবিষ্যতে! টুঁটি চেপে তাকে বলেছি বারবার, ওহে রাত্রিচর অশ্রান্ত পাবক, বলো আমায়, আমারি মাংস-শোণিতে বলো, “কে লিখে আয়ু?” কে সেই হুমকিদূত, রাতের ডাকাত, যে তার জিভ নাড়ায় কার্নিশে? বলো কে সেই নির্ধারক, যে গান গায় আমারি উঠানে?
আহ! আমার মৃত্যু, এইবার বলো কে সেই নির্ধারক, যে ভুল করে আমারি দরোজায় কড়া নাড়ে একদিন? তারচেয়ে এই ভালো ছিল…নিশিডাক, বেড়ালের আর্ত কলরবে নির্ঘুম রাত্রি জাগরণ! হায় আমার জন্ম! আমি ভুলে গিয়েছি নির্ধারণের ইতিহাস যে লেখে সে কোনো সর্বনাম নয়, আমির ভিতর হতে জাগে সে রাত্রিচর!
…
সাদা কাফনের মাংসে ঢুকে বুঝে গেছি, কী সহজ সবকিছু! রেহেলে রাখা কোরান শরিফ, কবিতার অক্ষম কাটাকুটি, জনকের বিলুপ্তপ্রায় স্থবির আঁখিপট, সাতফুট নদীর অতলে জননীর অক্লান্ত ঘূর্ণন…এইসব ভুল বোঝাবুঝি…যা হতে পারতো একান্ত আমার। এখন কী সহজ সবকিছু, কী সহজে নির্ধারণ করি রাত্রিচর…
সাদা রং মাংসের কাফনে!
***এই এপিটাফটি অকালপ্রয়াত কবি কিশোর ইবনে দিলওয়ার-এর সমাধিফলক-এর জন্য রচিত ও রাশপ্রিন্টের পক্ষ থেকে একান্ত তাকে স্মরণ করে উৎসর্গিত। আজ হঠাৎ তোমাকে খুব মনে পড়ছে কবি। যেখানে থাকো ভালো থেকো।