লন্ডন ১৯৭১ ও অদেখা আলোকচিত্রালেখ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ আগস্ট ২০১৬, ১১:২৫ অপরাহ্ণ, | ২৪০৬ বার পঠিত
মাহি রহমান : ‘লন্ডন ১৯৭১ : ভিনদেশে বাঙালির আগুনঝরা দিনের গল্প’ শিরোনামে একটা আলোকচিত্র-প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠিতব্য প্রদর্শনীর উদ্বোধনী দিন ধার্য হয়েছে ১৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার। ঢাকায় শিল্পকলা অ্যাকাডেমি বিল্ডিঙের জাতীয় চিত্রশালা পাঁচ-নম্বর গ্যালারিতে এই বিরলদৃশ্য ফোটোগ্রাফমালার সমাহারে এক্সিবিশনটা ১৮ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত চলবে। গ্যালারি ঘুরে একাত্তরের গরিমাকালের এক অ-উন্মোচিত অধ্যায় দেখার জন্য প্রদর্শনীর আয়োজক-তরফ থেকে দেশের সর্বসাধারণের প্রতি বিশেষ আহ্বান রাখা হয়েছে।
এই প্রদর্শনী আয়োজনের উদ্যোগ এবং সমুদয় আর্থিক ও প্রাযুক্তিক ব্যবস্থাপনায় ‘প্রোজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’ দায়িত্ব পালন করছে। এর অনুষ্ঠানমালায় আলোকচিত্রপ্রদর্শন ছাড়াও রয়েছে আমন্ত্রিত গুণীজনদের আলোচনা, বিলেতে সেই-কালপর্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কেন্দ্রী লড়াইয়ের সঙ্গে তৎপর ব্যক্তিবর্গের স্মৃতিচারণা, রয়েছে অনুষ্ঠানে অভ্যাগত দর্শক ও অতিথিদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ব্যবস্থা।
আলোকচিত্রালেখ্য প্রদর্শনী আয়োজনের সমন্বয়কারী ও মুখ্য উদ্যোক্তা উজ্জ্বল দাশ গোটা আয়োজনের উদ্দেশ্য ও পটপ্রেক্ষা সম্পর্কে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বহু অজানা ইতিহাসের সাক্ষী লন্ডন। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাক-প্রস্তুতিপর্ব থেকেই বিলেতপ্রবাসী মুক্তিকামী বাঙালিরা সরব ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন দীর্ঘ নয়মাস বিলেতের প্রতিটি শহরে তাঁরা জোরালো দাবি তুলেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে।
দূর পরবাসে থেকেও বহু মুক্তিকামী মানুষ আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে কাঁপিয়েছিলেন বিলেতের রাজপথ। শুধু বাঙালিই নন, তখনকার ব্রিটেনে বসবাসরত বহু জাতির মুক্তিকামী ও মানবতাবাদী মানুষ সমস্বরে সমর্থন জানিয়েছিলেন, সোচ্চার হয়েছিলেন, অভ্যুদয়কামী একটি জনগোষ্ঠীর পক্ষে। সেই ইতিহাসের অনেকটাই আজও উদ্ঘাটনের অপেক্ষায়। ‘প্রোজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’ অবগুণ্ঠনের অন্তরাল থেকে সেই কীর্তিগরিমার পরিচ্ছেদগুলো ক্রমশ তুলে ধরতে সচেষ্ট। প্রচেষ্টার প্রথম নিবেদন হিশেবেই তিনদিনব্যাপী এই আলোকচিত্রপ্রদর্শনী। ভিনদেশে আগুনঝরা দিনের অনন্য দলিল সেইসব আলোকচিত্রমালা। আমাদের বিশ্বাস, সকলের সহযোগিতায় উদ্যোগটি দেশে-বিদেশে নতুন প্রজন্মকে জানতে দেবে ভিনদেশে বাঙালির গৌরবগাথা। আয়োজকদের পরিকল্পনায় রয়েছে এই প্রদর্শনীটিকে দেশের বিভাগীয় নগরীগুলোতে পুনরায়োজনের; এবং সেই লক্ষ্যে বছরব্যাপী ধারাবাহিক পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের, ঢাকা-অনুষ্ঠান সমাপনের পরে এবং দেশের মুক্তিযুদ্ধসংবেদনপূর্ণ তরুণ ও অন্যান্য মহলের ইতিবাচক সাড়া প্রাপ্তির সাপেক্ষে ‘প্রোজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’ অদেখা আলোকচিত্রে এই ইতিহাসখননের অভিযানযাত্রা অব্যাহত রাখতে চায়, জানালেন মুখ্য সমন্বয়ক উজ্জ্বল দাশ।
প্রতিদিনের প্রদর্শনী শুরু হবে বেলা ০৩টায়, দিনকার্যক্রম শেষ হবে রোজ রাত ০৮টায়। প্রথম দিনের আলঙ্কারিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে বিকেল ০৪.৩০টায়। এই অধিবেশনে উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াও রয়েছে গ্যালারি প্রদক্ষিণ এবং অতিথিবর্গের অভিভাষণ। উদ্বোধক হিশেবে থাকছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রী ও সংসদ-সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী ও সংসদ-সদস্য আবুল মাল আবদুল মুহিত, বিশেষ অতিথি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ-সদস্য শাহরিয়ার আলম; উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিষয়নির্দিষ্ট মুখ্য আলোচক থাকছেন মহিউদ্দিন আহমদ, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব, যিনি ১৯৭১ সালে লন্ডনে স্থাপিত বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশনের দ্বিতীয় সচিব হিশেবে ভূমিকা পালন করেছেন; আলোচক হিশেবে আরও রয়েছেন ডা. নুজহাত চৌধুরী, শহিদসন্তান, সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। উদ্বোধনবৈঠকীর পাশাপাশি চিত্রপ্রদর্শশালা সাধারণ সর্বজনের জন্য উন্মুক্ত রইবে বলে আয়োজক-তরফ থেকে জানা গিয়েছে।
এই স্থিরচিত্রপ্রদর্শনীর বিশেষত্ব কি, জিজ্ঞাসার উত্তরে উদ্যোগ-সমন্বয়ক উজ্জ্বল দাশ বলেন, এখানে যে-সমস্ত ছবি প্রদর্শনকামরায় যাচ্ছে, সেগুলো প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হচ্ছে। এর আগে এই ছবিগুলো কোথাও প্রদর্শিত তো হয়ইনি, কেউ খোঁজও জানত না আলোকচিত্রগুলোর অস্তিত্ব বিষয়ে। এছাড়া আলোকচিত্রগুলো সমস্তই ব্রিটেনের লন্ডন শহরের অনুষঙ্গবহ। এইটা প্রদর্শনীর দ্বিতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশেষত্ব। সর্বজনজ্ঞাত ইতিহাস হিশেবে এতদিন শুধু লন্ডনের কিছু জনসমাবেশ আর প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ছবিই দেখে এসেছি আমরা; এই প্রদর্শনীতে সেসবের বাইরেকার প্রচুর নথি ও দালিলিক প্রমাণের আলোকচিত্রসম্ভার জায়গা পাচ্ছে। এগুলোর সংগ্রহসূত্র ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাসভাষ্যও ছবির পাশাপাশি লিপিচিত্রিত থাকছে।
এই প্রদর্শনীর পরিকল্পনা ও সার্বিক তোড়জোড় শুরু হবার পর থেকে একটানা পাঁচ-বছর লেগেছে কেবল ছবি খুঁজে পেতে, জানালেন উদ্যোক্তাপক্ষীয় মুখ্য সমন্বয়ক। সংগ্রাহক ও সংরক্ষকদের দোরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছানোর বিস্তর আয়াসসাধ্য অভিযানের এক-পর্যায়ে ব্যক্তিক ও প্রতিষ্ঠানপর্যায়িক সহযোগিতা পাওয়া গিয়েছে যেমন, তেমনি হ্যাপাও পোহাতে হয়েছে বেশ; প্রচুর আলোকচিত্র ক্রয় করতে হয়েছে নগদ অর্থমূল্যে, যেমন সম্প্রদান করেছেন অনেকেই নিজেদের পারিবারিক দেরাজ থেকে মূল্যবান নথি কিংবা আলোকচিত্রটি, কেউ কেউ সংরক্ষিত ছবি কি নথি হস্তান্তর করতে রাজি হয়েছেন অবিকৃত-অবিকলভাবে সেটি ফেরতদানের হলফনামায় সই করিয়ে নিয়ে; এই প্রসঙ্গে আলাপের এক-পর্যায়ে উজ্জ্বল দাশ ‘প্রোজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’ তরফ থেকে প্রদর্শনীতে আলোকচিত্র প্রদানে সম্মতিজ্ঞাপনকারী প্রত্যেককে অবদায়ক/কন্ট্রিবিউটর হিশেবে উল্লেখ করে বলেন, দিনশেষে হ্যাপা আর হাঙ্গামাগুলো সমস্তই সুখের মনে হচ্ছে যখন স্বপ্নপ্রকল্পটি দিবালোকে সবার সামনে এনে নিবেদন করা সম্ভব হচ্ছে একটি প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। এই গোটা কাজটা কারো পক্ষে একা বাস্তবায়ন করা দুঃসাধ্য, ‘প্রোজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’ অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী ও নেপথ্য অবদায়কের সামবায়িক একটি সৃজন, প্রোজেক্ট-চেয়ারম্যান ফজলুল কবীর তুহিন ছাড়াও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষসংশ্লিষ্ট অবদায়ক সকলের সম্মিলিত প্রয়াসের ফসল এই প্রদর্শনী, জানালেন উদ্যোক্তা।
ঢাকার সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা অ্যাকাডেমির জাতীয় চিত্রশালার পাঁচ-নম্বর গ্যালারিতে অনুষ্ঠিতব্য প্রদর্শনীটি এ-মাসের ১৮ থেকে ২০ তিনদিন পর্যন্ত চলবে। প্রতিদিন প্রদর্শনীর দ্বারোন্মোচন বেলা ৩ ঘটিকায়। এই প্রোজেক্টের আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে লিঙ্ক কিংবা ফেবু এই দুই লিঙ্ক ধরে এগোনো যেতে পারে।