অলৌকিকতা গিয়েছে, ইস্টিমার নিয়েই কালের নৃত্য । নিখিল নীল
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ আগস্ট ২০১৬, ৭:৩৫ পূর্বাহ্ণ, | ২০১৭ বার পঠিত
দুঃখের কারণ আছে অনেক। তাঁর মৃত্যুর পরে বছরের পর বছর গত হচ্ছে কিন্তু কিছু প্রথাবিরোধী ও প্রগতিশীল মানুষের হৃদয়ে ভালোলাগার অবস্থানটুকু ছাড়া তাঁকে নিয়ে কোনো মাতামাতি নেই। রাষ্ট্রযন্ত্র করবে না, চারিত্রিক কারণেই। শিল্প-সাহিত্যের ধ্বজধারীরা কোথায়? সস্তা-রুচির বৃত্তে এরও বিচরণ; তাই নিভৃতে কাটে তাঁর মৃত্যুর বার্ষিকীগুলো। একই ব্যবস্থার ভিতরে সব অঙ্গই আসলে ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে চলে। কবিতার জায়গাও ব্যতিক্রম নয়। নির্দিষ্ট কয়েক ব্যক্তি ও কিছু মিডিয়ার নজরে না পড়লে — নির্দিষ্টভাবে বললে — কবির পরিচিতি পাওয়াটা এক অসাধ্য কাজ। অথচ শিল্পের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে কবিতাকে যাঁরা বুকে ‘পাখির-মায়ের-মতো’ প্রেম নিয়ে ভালোবেসেছেন, বিশেষত বাংলাদেশের কবিতায়, তাঁদের মধ্যে হুমায়ুন আজাদ অনন্যতম।
কবিতায় হুমায়ুন আজাদের অবদানের বিষয়টি বিতর্কসাপেক্ষ হতেই পারে। যেখানে অসৎ কবিরা মাতিয়ে রাখছেন পাঠকদের এবং বিভ্রান্ত করছেন তরুণ কবিদের কিংবা পাঠকদের সেখানে কবিতাকে কবিতার মতো করে বুঝতে পেরে তাকে ভালোবাসাটাও অনেক গুরুত্ব বহন করে। আর এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটিতে হুমাযুন আজাদ হয়তো অদ্বিতীয়ই ছিলেন। অদ্বিতীয়? কারণ, এত পরিচিতিসূচক অভিধার মাঝেও, তিনি কবি উপাধিটিই সর্বাগ্রে ব্যবহার করতেন। তাছাড়া, বাংলা কবিতাকে তিনি এতটাই নির্মোহ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন যে, তাঁর সম্পাদিত ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’ বইটি (উৎসর্গের নামগুলো ও কবিতাচয়ন তার প্রমাণ) তার অর্থবহ দলিল। প্রমাণ আরো আছে। কবিতার প্রতি হুমায়ুন আজাদের প্রেমের প্রবলতা ছাড়াও, প্রাজ্ঞ কবি ছিলেন বলেই, কিছু অসাধারণ প্রবন্ধ লিখেছেন কবিতা নিয়ে, এবং এ-নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি উপন্যাস লেখার কৃতিত্বও তিনি দেখিয়েছেন। সে-উপন্যাসের সার্থকতার বিষয়টি প্রাসঙ্গিকভাবেই এ-আলোচনার বাইরে। এছাড়াও, কুসংস্কার ও তমসাচ্ছন্ন চিন্তার ওপর আঘাত-হানা হিসেবে পরিচিত বই আমার অবিশ্বাস-এও তিনি বেশিরভাগ অংশ ব্যয় করেছেন কবিতার জন্য। কবির জন্য। কবিতা তাঁর স্বভাবে, চিন্তায় এতটাই আঁকড়ে ছিল যে তিনি দ্বর্থ্যহীনভাবে বলেছেন : জীবনের অনেককিছু খরচ করেও একটি ‘অবসরের গান’ লেখা চাইলেই সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন জীবনানন্দীয় প্রতিভা।
সততা ও আন্তরিকতার অভাব ছিল না বিধায় তিনিই ভেঙেছেন তাঁর পথ, বয়স বাড়ার সাথে সাথে রঙ পরিবর্তনের বদলে আরো শাণিত হয়েছেন, আরো বেশি সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর কবিতার বৌদ্ধিক চেতনা। আর প্রতিভা যেহেতু সর্বকালেই দণ্ডনীয় অপরাধ, তাঁর দণ্ডও হয়তো, তাই, তাঁর প্রতিভাকেই প্রমাণ করে!
১.
পাণ্ডিত্যকে সৌন্দর্যবোধে মিশিয়ে কাব্যভাবনা ও কবিতায় প্রকাশের অসাধারণ কাজ হুমায়ুন আজাদ করেছেন। কবিতাপ্রীতি বিষয়ক ব্যক্তি-জাত বিশ্লেষণে না গিয়েও তাঁর কবিতা-বিষয়ক কিছু প্রবন্ধকে নিয়ে আসা যেত আলোচনায়। উৎসুক পাঠক তাঁর প্রবন্ধের বইগুলো থেকে সেগুলো সংগ্রহে নিতে পারেন, তুলনায় যেতে পারেন বাংলাদেশের সব প্রতিষ্ঠিত কবিদের সাথেও। এ-বিষয় আলোচ্য করে এ-লেখাটিকে অযথা বাড়াতে চাচ্ছি না। হুমায়ুন আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ আলোচনা এ-লেখার মূল উদ্দেশ্য।
১৯৭৩ সালে বের হয় হুমায়ুন আজাদের প্রথম কবিতার বই, অলৌকিক ইস্টিমার, তাঁর ২৬ বছর বয়সে। ১৯৯৮ সালে(দেখুন হুআ-এর শ্রেষ্ঠ কবিতা) এসেও কবিতাকে তিনি বলেছেন, ঝিনুকের জ্যোতির্ময় ব্যাধি; “ঝিনুক যেমন তার ব্যাধিকে রূপান্তরিত করে মুক্তোয়, কবিতাও মহাজাগতিক নিরর্থকতাকে জ্যোতির্ময় মুক্তোয় রূপান্তরিত করার রসায়ন।” উৎসর্গস্তবকের শেষ দু’টি লাইন এমন, “আমি অনেক পাপ করেছি তোমার কাছে পরম প্রিয় / তুমি আমায় ক্ষমা করো ক্ষমার আগে শাস্তি দিয়ো।” প্রেয়সী কবিতার কাছেই ক্ষমা চাইছেন যেন কবি! মনে করিয়ে দেয়, কবিতা থেকে মনোযোগ বারবার সরে গিয়েছিল হুমায়ুন আজাদের, পবিত্র ব্যাধির সুখ সরিয়ে সামাজিক ব্যাধির স্থূল মাতামাতিতে হুমায়ুন আজাদ ব্যয় করেছেন অফুরান সময। পাপেরই সমতুল্য কবিতার সাথে এমন অসৎ আচরণ! এই সততাটুকুই কবিতা চায় প্রথমত ও প্রধানত কবির কাছ থেকে।
হুমায়ুন আজাদের কবিতার ভুবন স্থূল হয়েছে; অনুভূতির প্রেক্ষিতে নয়, হয়তো নয় বিষয়ের প্রেক্ষিতেও। স্থূল হয়েছে, প্রকাশে। আমার বিবেচনায়। অপরিমিতি অথবা অন্যভাবে বললে স্থূল প্রকাশ সব শিল্পেই বর্জনীয়। কবিতায় অবশ্যই। তবু, আধুনিকতার সাথে, অন্তত বিষয়ের ব্যাকরণ আলোচনায়, হুমায়ুন আজাদ সার্থকভাবেই সফল। শিশিরের মতো কোমলতায় ছুঁয়ে যায় তাঁর অনেক কবিতা। পতনোন্মুখ সমাজে আগত সন্তানের কাছে প্রশ্ন করেছেন হুমায়ুন আজাদ। লিখেছেন ‘আমার সন্তান’ শিরোনামে একটি অনবদ্য কবিতা, “তুমি কি আসবে ওগো স্নিগ্ধ দিব্য প্রসন্ন সন্তান / পতনকে লক্ষ্য ক’রে / মায়ের সুখদ পেট ছেড়ে / এই ক্লিষ্ট হিংস্র পরবাসে?” … শুরুটা ছিল এমন —
আমার সন্তান যাবে অধঃপাতে, চন্দ্রালোক নীল বন
তাকে কভু মোহিত করবে না। কেবল হোঁচট খাবে —
‘আমার কন্যার জন্য প্রার্থনা’ কবিতায় তিনি যান্ত্রিক সময়ের নীল রক্তকেও অনুরূপ অনুপম প্রশ্ন ছুঁড়েছেন, কন্যাকে প্রতীক বানিয়ে —
হে আমার বন্ধ্যা কন্যা, অন্য কোনো হাত / তোমাকে কি তুলে নেবে/ মধ্যরাতে ভাসমান উৎসবস্রোত থেকে? / শেখাবে কান্নার অর্থ? বোঝাবে গভীর স্বরে / রোদনের চেয়ে সুখ নেই লবণাক্ত সবুজ মাটিতে?
পুরো বইটিতে এ-রকম ভালোলাগা কবিতা অনেক। কিছু কবিতা রহস্যময়ভাবে দোলা দিয়ে যায়। রহস্যময়। কারণ প্রথম পাঠে কিছু কবিতাকে তেমন গুরূত্ব দিতে ইচ্ছে করে না। যেমন জীবনানন্দের কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে করণীয়কে তুলে ধরতে হয়, যেমন বলেছিলেন কালের পুতুল-এ বুদ্ধদেব বসু। এ-রকম কিছু পাওয়া যায় হুমায়ুন আজাদ পাঠ করলে। তাঁর শেষ দিকের কবিতায় তো বিষয়টি অনেক প্রকট। এমনকি অতি যতিচিহ্নের ব্যবহারের বিষয়টিও। তাই পড়তে হয় ধীরে ধীরে, ভাবতে হয় আরো ধীরে, গভীরে যেয়ে। গভীরতর হয়ে। ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ বই থেকে ‘রোদনের স্মৃতি’, ‘বেহালা’ — এ-রকম কবিতা নিয়ে আসা যায় উদাহরণ হিসেবে।
তোমাকে চোখের মধ্যে রেখে কাঁদি, আমার দু-চোখে তুমি / তুমি একাকিনী সবুজ পল্লব, কাঁপছো বাতাসে শাদা হিমে / ভিজছো অক্টোবরের সন্ধ্যায় কুয়াশার ক্রিমে।
এ-রকম করে, কবিতার চরণ — কাঠামো — কিংবা পুরো কবিতা — সবকিছুই — কবিতার হয়ে ওঠে শেষ পর্যন্ত। এমনকি যেসব কবিতাতে রহস্য বলে কিছুই নেই, পড়লে মনে হবে মোটা দাগে লিখিত হয়েছে ভাবনাগুলো, সেগুলোও হয়ে ওঠে একান্তভাবে কবিতার। বিতর্কসাপেক্ষ যদিও, কবিতায় আন্তরিকতা এভাবে প্রচ্ছন্ন রয়ে গেছে তার শরীর জুড়ে। যেভাবে ‘বনলতা সেন’ কোনো নির্দিষ্ট শারীরিক অবয়বের প্রেমিকা না-হয়ে হয়ে ওঠেন স্থান ও কালোত্তীর্ণ কোনো প্রেমের, কিংবা কবিতাই প্রেমিকা, সে-রকম। তবে হ্যাঁ, বলাই বাহুল্য, সে-রকম করে হুমায়ুন আজাদ পরিস্ফুটিত হতে পারেননি। বাংলাদেশে কারা পেরেছেন শুনি? যারা পেরেছেন বলে হাতে তালি পাচ্ছেন তারা তো চটকদার কবি। কবিতার ভেতরে কেউ চমক দিচ্ছেন। কেউ রাজনীতির স্লোগ্যান বানিয়ে ফেলছেন কবিতাকে। কেউ বন্দনার। কেউ প্রার্থনার। কেউ বিবৃতির আর কেউ কেউ প্রতিক্রিয়াশীলতার! এভাবে কবিতা হয় না। ডব্লিউ. এইচ. অডেনের মেমোরেবল স্পিচ-ও এখন আর কবিতা নয়; পাঠের তৃপ্তির জন্য তা সুযোগ্য হতে পারে, ‘বিশুদ্ধ’ কবিতার জন্য নয়।
অবিশুদ্ধতা হুমায়ুন আজাদের ভিতরেও প্রকট হয়েছে। তাঁর প্রথম বই অলৌকিক ইস্টিমার-ও কোনো ব্যতিক্রম নয়। তবু এ-অবিশুদ্ধতা প্রধান হয়ে ওঠেনি, অন্তত অলৌকিক ইস্টিমার-এ। ‘আমার ছাত্র ও তার প্রেমিকার জন্য এলেজি’, ‘এ-সভা প্রস্তাব করছে’, এবং কিছুটা হলেও ‘ব্লাডব্যাংক’, এসব কবিতাকে প্রথম পাঠেই বাতিল করে দিতে ইচ্ছে করে। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো তাঁর সম্পাদিত ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’-তে তিনি যেসব কবিতা নিয়েছেন সেখানেও এমন কবিতা এসেছে যা শিল্পের চেয়ে সমকালগ্রস্তই বেশি। বললে ভুল হবে না, তাঁর অনেক সৃষ্টিশীলতাই তাঁর পাণ্ডিত্য ও বৈরী সাম্প্রতিকতার সাথে সংঘর্ষ তৈরি করেছে, এসব বৈরিতা ডিঙিয়ে সেখানে বিশুদ্ধতা প্রধান হয়ে উঠেছে কদাচিৎ। আর তাই, তাঁর কবিতাও, তাঁর থেকে বক্তব্য নিয়েই বলতে হচ্ছে, সমকালের দাবি মিটিয়েছে, আর এর সীমাবদ্ধতা হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য এ-কবিতা বেশি কিছু সঞ্চয় রাখতে পারেনি। না-হলে উপমাউৎপ্রেক্ষারূপকের এমন চমৎকার অনুধাবন ও বিশ্লেষণ জেনেও তিনি কেন অন্তত জীবনানন্দের ‘উপমাই কবিত্ব’, — এটাকেও উপমান করে তুলতে পারেননি! এসব উপেক্ষা করে যেগুলো লিখেছেন সেগুলো আমার দৃষ্টিতে সফল কবিতা।
“আমার জ্যোৎস্নারোদ / আবার তোমরা মুকুলিত হও সব গাছের পাতায়” অথবা শুরুতেই “চোখের মতন সেই ইস্টিমার / নীল নক্ষত্র থেকে ছুটে আসছে গাঢ় বেগে” (অলৌকিক ইস্টিমার) — অবাক হই কীভাবে এমন ইন্দ্রিয়বোধ বদলে যায় এসে কিছু কবিতায়। সেগুলো আমার আর পড়তে যেয়ে ভালো লাগে না। মনে হচ্ছে কোনো বিলবোর্ড পড়ছি — “আমাকে মাতাল করে ছেড়ে দিতে পারো তুমি গলির ভিতরে, / সমস্ত সড়কে তুমি জ্বালতে পারো লাল সিগনাল” ( তোমার ক্ষমতা) … । ইন্দ্রিয়প্রগাঢ়তার অনবদ্য ব্যবহার জানা সত্ত্বেও হুমায়ুন আজাদ কেন কবিতাকে সমাজের শরীরের ক্ষতবিক্ষত স্থূলতার বিজ্ঞপ্তি করে তুললেন তা বোঝা কঠিন। তা অবশ্য হয় : এমনকি স্বল্পমাত্রায় জীবননান্দে দেখেছি এমন, তাঁর প্রথম দিকের কবিতায়, যদিও সেগুলো তাঁর শিল্পচেতনাকে শাসন করতে পারেনি; শামসুর রাহমানেও এসেছে অনেকবার, যদিও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন এগুলোর কারণেই! শামসুর রাহমানের অনেক ভালো কবিতাই মানুষ পড়েনি, যেসব কবিতা তাঁকে ত্রিশ-পরবর্তী বাংলা কবিতায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। হুমায়ুন আজাদ নিজেও অবশ্য সেটা জানেন। তাই শামসুর রাহমানকে গুরুত্ব দিয়েছেন, লিখেছেন আস্ত একটি বই, ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’ নামে, শামসুর রাহমানের ওপরে। হুমায়ুন আজাদ নিজেই বলেছেন যে সমকালীনদের নিয়ে আলোচনা ও মাতামাতির অনেক অসুবিধা আছে। এই কারণে বুদ্ধদেব বসুর কবি পরিচয়টাই আমরা ভুলে যাই। আমি মনে করি, হুমায়ুন আজাদের ক্ষেত্রেও, আংশিক হলেও, সে-অসুবিধার প্রভাব পড়েছে।
২.
বিহারীলাল-মধুসূদনের কবিতার হাত বাংলা কবিতায় নতুন পথ তৈরি করেছিল। বাংলা কবিতায় নতুন যুগের সূচনা করেছেন দুজনেই। রবীন্দ্রনাথ, সংক্ষেপে বললে, বিপ্লব এনেছেন কবিতায়। আধুনিকতার প্রথম সার্থক পথ অন্য অনেককিছুর মতো কবিতায়ও তিনিই রচেছেন। তিরিশের কবিরা গুরুত্বপূর্ণ বাঁক এনেছেন; রবীন্দ্রবলয় থেকে বের হয়ে কবিতায় এনেছেন তাঁরা নতুন পথ। সেটাও যুগান্তকারী, রবীন্দ্রাতিক্রম সহজসাধ্য কাজ ছিল না। সেই কঠিন কাজে তাঁরা মেধার পরিচয় দিয়েছেন; সে-যুগের বা সেসবের বলয়েই চলছে বাংলা কবিতার বর্তমান ধারা। এসব বাঁকবদল কবিতায় যে নতুন মাত্রা যুক্ত করে কেবল তা নয়, কবিতাকে তার যথার্থ পথ চেনাতেও ভূমিকা রাখে। যদিও এইসব বাঁকগঠনপ্রণালিকে কালের মানুষ দুর্বিনীত ভেবেছে, এমনকি বিরোধিতা ভেবে তাঁদের সমালোচনায় মুখর হয়েছে সমকাল।
বলাই বাহুল্য, নতুনত্বের অভিজ্ঞতালব্ধ অনবদ্যতা ছাড়া কবিতার পথ সুকোমল পরশ দিতে পারে না ভাবীকালের পাঠকদের। কবিতায় পরিবর্তনের এ-পথকে স্বাগত দৃষ্টিতে দেখাটাই বাঞ্ছনীয়। তাই হুমায়ুন আজাদ থেকে ধার নিয়েই বলছি, “রবীন্দ্রনাথের উপমা যেখানে আপন শোভায় সমগ্র উদ্যানকে শোভাময় করে তোলে, সেখানে জীবনানন্দীয় উপমা আপন শোভাকেই উদ্যানের আকর্ষণ করে তোলে।” এসব বলয় ভাঙুক, — মৌলিক কবিতাপ্রেমীরা সেটাই চাইবেন। সে-পথ দূরে অনেক। অনেক দূরের পথ। বাংলাদেশের কবিতা চরে আটকে পড়ে আছে। অকবিতাকে কবিতার স্বীকৃতি প্রদানে সিদ্ধহস্তের পরিচয় দিচ্ছে দৈনিকগুলো। ছোট কাগজগুলোও লেখকদের দল তৈরি করে বৃত্তবন্দি কবিতার চর্চা করে। পারলে অনেকেই নিজেদের মলত্যাগের অভিজ্ঞতাকেও ছাপার অক্ষরে বন্দি করে কবিতা জন্মাতে চাচ্ছেন। যা-ই হোক, দর্শকনন্দিতের নিক্তি দিয়ে কবিতা কিংবা কোনো শিল্পেরই যাচাই চলে না। কিন্তু কবিতায় আধুনিকতা থেকে রসদ নিয়ে অনেকে আধুনিকতার দর্শনকে সংকীর্ণ করে তুলে কবিতার রাজ্যে ঠিকই টিকে আছেন দাপটে। অথচ কথা ছিল উল্টো। কারণ কোনো শিল্পেই, কবিতাতে অপরিহার্যভাবে, পিছনে হেঁটে সৃষ্টি করতে পারে না কিছুই, এমনকি অনুসরণীয় পূর্বপুরুষ বা অগ্রজদের ধারণ করার মধ্যেও মৌলিক সৃষ্টির সার্থকতার বীজ নিহিত থাকে না। সৃষ্টিতে তাঁদেরকে অতিক্রমের মধ্যেই স্রষ্টা যুগান্তকারী হয়ে ওঠেন। জীবনানন্দ না-হলে তো পাশ্চাত্য-কবলিত কবি হিসেবেই পরিচিত হয়ে থাকতেন। তিনি কবিতার অভিযাত্রায় কতটুকু চৈতন্যমগ্ন ছিলেন তা স্পষ্টতই বোঝা যায় তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত উপমা ও রূপকের মোহনীয় চিত্রকল্পীয় উপস্থাপন দেখে। কবিতাকে মহিমান্বিত করতে গেলে তাই তাৎক্ষণিকতা, বর্ণনা, দৈনন্দিনতা ও বাচালতা পরিহার করতে হয়।
যা-ই হোক। ফিরি যেদিকে ছিল আলোচনার গতিমুখ। হুমায়ুন আজাদের মূল্যায়ন কিরূপ হওয়া যথার্থ হবে? কবিতার পথের কারুকলা যে হুমায়ুন আজাদ ধারণ করতে পেরেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হুমায়ুন আজাদ সমাজ-সংসারের তোয়াক্কা করেননি। পৃথিবীর কোনো মৌলিক শিল্পই সেটা করে না। সমাজ মানুষের জন্য কষ্টদায়ক হলে, কবির জন্য সেটা যন্ত্রণার। কোনো সমাজব্যবস্থাই আসলে পারবে না কবিকে শান্তি দিতে। এসবের তোয়াক্কা শিল্পী করেন না। হুমায়ুন আজাদ করেননি। কিন্তু এসবের সাথে আবার শিল্পকে মিলিয়ে ফেললেও কবিতা হয় না, যেটা হুমায়ুন আজাদ করেছেন। ‘তোয়াক্কা করি না” বলে গলাফাটানোর কাজটা কবির নয়। তোয়াক্কা করতে চাননি বলে হুমায়ুন আজাদকে মূল্যবান করে তোলা যায়, কিন্তু সেটা হবে আলাদা মূল্যায়ন। যেহেতু এসব ব্যাধিকে বেদ করে তুলেছেন কবিতায় তাই তাঁর সেসব সৃষ্টিকে আর মূল্যবান ভাবা যায় না। সেটা সুস্পষ্ট হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। যেমন অনেক বিরতি দিয়ে দিয়ে লিখেছেন কবিতা, মনোযোগ দিয়েছেন অন্য কাজে। বলা যায়, কবিতাকে ঠকিয়েছেন তিনি। ঠকিয়েছেন নিজেকেও, অনেকদিক থেকেই।
অলৌকিক ইস্টিমার-এর কবি শেষে পরিণত হতে যেতে যেতে লিখেছেন ‘আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে’। সেটাও ভালো কবিতা। গীতিময়। অনুভূতির প্রকাশে তবু কেমন নগ্নতার কারণে শিল্পোত্তীর্ণ বলতে পারি না এটিকে। দুর্বল কবিতা বলছি না, তবু তাঁর কবিতাকে তিনি নিজেই যদি বিশ্লেষণের কাঁচিতে কাটতে যেতেন তিনি নিজেই দেখতেন ওগুলো বাতিল হয়ে যাচ্ছে, শিল্পমানে। যেমন অনেককে তিনি নিজেই বাতিল করে দিয়েছেন এমন অভিযোগে। হুমায়ুন আজাদীয় ট্রাজেডি বলা যায় একে।
অলৌকিক ইস্টিমার আসে সব রাতে
সব বৃষ্টি ভর করে
নদী জোৎস্না ফুলদানী বেয়ে
যারা এসে নামছে জেটিতে তারা আমার গভীর আত্মীয়।
তিরিশ-দশকীয় কবিতা থেকেও ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ আমার কাছে অসাধারণ ঠেকেছে। কেন? ইস্টিমার শব্দটিতেই এর প্রকাশ আছে। বিশ্বকে আঁচলে নেয়ার, আঞ্চলিক করে তোলার প্রকাশ। জীবনানন্দ ছাড়া যা তিরিশের কবিতার ভিতরে খুব অনুপস্থিত। আর কবিতাটি হয়ে উঠেছে জীবনের গান, যা স্থান নিয়েছে, ডিঙিয়েছে কাল। এ-গানের সাথে আলিঙ্গনে উন্মুখ কবি। কবির কাছে চোখের মতন সেই ইস্টিমার তাকে ঘুমের ভিতর থেকে জাগিয়ে তুলেছে। তিনি লিখছেন, ইস্টিমারের যাত্রীর “কারো চুলে রাখবো আঙুল / কারো গাল টিপে দিবো/ কাউকে বলবো তুমি কেমন রয়েছো এতদিন।” যেন মহাকালের যাত্রার যান উপস্থাপন করেছেন কবি। ‘স্টেজ’ কবিতায়ও চমৎকার নৃত্য দেখতে পাই। জীবনের। তারপর? — হয়তো একটু বেশিই বলা হবে, হুমাযূন আজাদের ভাবনা পরিণত হয়েছে আর ইন্দ্রিয় হারিয়েছে খেই।
সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে আমি যেন ভয় পেয়ে যাই এই ভেবে যে ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ হুমায়ুন আজাদ যদি শেষদিকে এসে লিখতেন হয়তো অলৌকিক শব্দটি তিনি কেটে বাদ দিতেন, তাঁর ‘চেতনা’ বাদ দিত এমন আধ্যাত্মিক শব্দশব। সেটা হয়তো-বা কম গুরুত্বের নয়! গুরুতর বিষয় হলো, শব্দের এমন রক্ষণশীলতা নিয়েও কবিতা অনন্য হয়ে উঠতে পারে কবিতার সঠিক নৃত্যের ভিতরে শব্দকে নিয়ে যেতে পারলে। তাই দুঃখ করেই বলতে হয়, হুমায়ুন আজাদ থেকে অলৌকিকতা গিয়েছে, প্রত্যাশিত; ইন্দ্রিয়বোধ যেটা ছিল — প্রবল — সেটা যায়ইনি কেবল, স্থূল হয়েছে, অপ্রত্যাশিতভাবে, যা খুবই দুঃখজনক।
তবু — বিষাক্ত জীবনের বিষাদময়তার প্রকাশ যেমনই ঘটুক — তিরিশের পরে কবিতাকে সামনে নিয়ে যাওয়ার মতো প্রতিভা বাংলাদেশে হুমায়ুন আজাদের ছিল সেটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আমি এও মনে করি, বাংলাদেশের কবিতায় এমন কাব্যিক ব্যক্তিত্বের অভাব অনেক প্রকট। সম্ভাবনা তাঁর ছিল কবিতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। সে-পরিচয় তাঁর কবিতাভাবনায় পেয়েছি আমরা। তাঁর প্রবন্ধে পড়েছি গভীর সৌন্দর্যবোধ; তাঁর কবিতায়ও পেয়েছি এমন মোহনীয় বিস্তার।
যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানের যোগাযোগে এ-লেখাটা শেষ হবে। তাঁর শেষ কবিতার বইয়ের — পেরোনোর কিছু নেই — উৎসর্গপাতায় অনবদ্য একটি কবিতা আছে। নিচের সে-গীতিময় আলেখ্যে কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। শিল্পের স্থায়িত্ব নিশ্চিত হয়ে যায় গভীরভাবে। নিচে সে-কবিতার কিছু অংশ তুলে দিলাম, এ-প্রবন্ধ যারা পড়ছেন তাদের জন্য :
মনে মনে কথা বলি, একা — লতা, পাতা, শুকনো ঘাস, ধুলোশূন্য, নিরর্থক, —
মহৎ বা স্মরণীয় নয়; দেখি সুন্দর, জলছবি, ভুলে-যাওয়া বাল্যস্বপ্নদের মুখ,
তাদের বালকস্বর বাজে ঘুমে; কুয়াশায় আজো এক স্বপ্নাহত নিঃসঙ্গ বালক
জবার অরুণ দেখে, জাহাজের বাঁশি শোনে, ঘাসের শিশিরে দেখে টলোমলো সুখ।
. . .
বন্ধুরা এখন বৃদ্ধ, হৃদরোগী, আমিও তো, অনেকেই মৃত, ব্যর্থ ও অত্যন্ত সফল,
এখনো আমাকে ঘিরে কলকল করে সুন্দর শূন্যতা, আর জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ের ঢল।
পলায়ন জীবন নয়, শিল্পও নয়। র্যাঁবো পালিয়েছিলেন সমাজ থেকে, শিল্পেও আর মুক্তি খোঁজেননি; গঁগাও পালিয়েছিলেন, শিল্পে মুক্তি পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথেও একই সত্য; জীবনানন্দে কেবল সত্য নয়, এটাই জীবন। হুমায়ুন আজাদও পালাননি, পালানোর ইচ্ছেও ছিল না তাঁর। মাঝে মাঝে একটু বেশিই সমাজতান্ত্রিক বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, সৃষ্টিতেও এর প্রকাশ ঘটে গিয়েছে। তবু আমি মনে করি, সেগুলো থেকে আলাদা করে তাঁকে দেখার সুযোগ আছে, তখন বাংলা কবিতায় কেবল তাঁকে অনবদ্যই দেখায় না, তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের কবিতা আলোচনাই অসম্পূর্ণ থাকে। তবু বলে রাখা ভালো, এ-জানাতেই শেষ হয় না। আমরা জানি, শিল্প-সাহিত্যের মূল্যায়ন নিয়ে, বিশেষত কবিতার, পুতুলের নৃত্যই দেখায় সম-বা-সমাগত-কাল। যতই মেনে নিই যে “পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে,” তবু, , মহাকালে সংশয় প্রকাশের ধৃষ্টতা আমার নেই!