গেরি জে. বাস । অনুবাদ- নিখিল নীল
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ ডিসেম্বর ২০১৩, ৪:৩৯ পূর্বাহ্ণ, | ২১৯৭ বার পঠিত
নিক্সন ও কিসিঞ্জারের বিস্মৃত লজ্জা
লেখাটি সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৩-এর নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছে। লেখার অনেককিছুর সাথে আমাদের সুনিশ্চিত দ্বিমত থাকতে পারে। আমারও আছে। অনুবাদ করে দিলাম। পড়ার জন্য। মন্তব্যের জন্য।
বাংলাদেশে অস্থিরতা চলছে। সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ, দেশের সুপ্রিম কোর্ট, ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের জন্য কাদের মোল্লার, একজন গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় রাজনৈতিক নেতা, ফাঁসির আদেশ প্রদান করেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে, অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করলে, হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে তার ফাঁসির দাবীতে প্রতিবাদ করে। এর পর থেকে আজ পর্যন্ত, একশর বেশি মানুষ প্রতিবাদ ও পাল্টা-প্রতিবাদে নিহত হয়েছে।
আমেরিকানদের কাছে এটা গুরুত্বহীন শোনাতে পারে, কিন্তু আজকের এ-অস্থিরতার সাথে আমেরিকার সম্পৃক্ততা আছে। বাংলাদেশের কিছু সমস্যার বীজ তার বিষাদময় ৭১-এ নিহিত যখন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরী কিসিঞ্জার জোর সমর্থন দিয়েছিলেন খুনি ও ঘাতকদের। ১৯৪৭ সালের ভারতবিভাগের পর থেকে, বিভক্ত ভূ-খ- নিয়ে, পাকিস্তান একক মুসলিম জাতি হিসেবে জন্ম নেয়: পশ্চিম পাকিস্তান(আজকের পাকিস্তান) পূর্ব-পাকিস্তান(আজকের বাংলাদেশ) থেকে, ভারত-ভূখণ্ড দ্বারা প্রায় ১০০০ মাইল দূরে ছিল।পাকিস্তানিরা মজা করত এই বলে যে তাদের দ্বি-খণ্ডিত দেশ একত্র হয়েছিল ইসলাম ও পাকিস্তান আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স দ্বারা।
যদি কিসিঞ্জার থেকে ক্ষমা প্রত্যাশা করা খুব বেশি কিছু হয়ে যায়, আমেরিকানদের অন্তত মনে রাখা উচিত তাঁদের দেশ ও নিক্সন সেই ভয়ানক দিনগুলোতে কী করেছিল।
১৯৭০ পর্যন্ত এই আশ্চর্য টিকে ছিল, তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা জাতীয় নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করে। পাকিস্তানের মিলিটারি শাসক নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় পেয়ে যায়। মার্চের ২৫ তারিখ, ১৯৭১ সালে, পাকিস্তানি আর্মি বিদ্রোহী পূর্বাঞ্চলে এক ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এই রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে, সি.আই,এ ও সরকারি রাখঢাকের সূত্রমতে ২ লাখ মানুষ মারা যায়(বাংলাদেশ সরকারের সংখ্যা এর চেয়ে ঢের বেশি, ত্রিশ লাখের মত)। প্রায় ১ কোটি শরণার্থী সীমানা উতরে ভারতে পাড়ি জমায়, অনেকেই মারা যায় জীর্ণ শরণার্থী শিবিরে।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক অডিও দলিল মতে, নিক্সন ও কিসিঞ্জার পাকিস্তানি জেনারেলদের হত্যাযজ্ঞে পুরো সমর্থন দিয়ে যান। উপেক্ষিত এই ভয়ানক বর্বরতা স্নায়ুযুদ্ধের এক নির্মম অন্ধকার অধ্যায়। হ্যাঁ, কোনো দেশের পক্ষেই, এমন কী আমেরিকার পক্ষেও, পৃথিবীর সবজায়গার গণহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, কিন্তু আমেরিকা ছিল সহযোগী, উষ্ণ সম্পর্কের সূত্র ধরে আমেরিকার অস্ত্র ও সামরিক সহায়তায় পাকিস্তান নিজের মানুষের বিরুদ্ধেই তা ব্যবহার করে। নিক্সন ও কিসিঞ্জার পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে থামানোর কোনো চেষ্টাই করেননি। মার্চের ২৫ তারিখের ক্র্যাকডাউনের আগে, তাঁরা সচেতনভাবেই পাকিস্তানি জেনারেলদের হত্যাযজ্ঞে কোনো হুশিয়ারি বা সতর্কবাণী দেননি । তাঁরা নির্বাচনের ফলাফলকে শ্রদ্ধা দেখানোর জন্য কোনো চাপও দেননি, এমন কী তারা ক্ষমতা-অংশীদারিত্বের কোনো পরামর্শও পাকিস্তানি জান্তাদের দেননি। কোনো হুশিয়ারি দেননি, কোনো নিষেধাজ্ঞা দেননি যা যুদ্ধের ভয়াবহতা কিংবা পাকিস্তানিদের নৃশংসতাকে কমাতে পারত। এমন কী হত্যাকাণ্ড শুরুর পর সহযোগিতা বন্দের সতর্কতাও দেননি। কেবল যে তারা বাস্তবতা দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিলেন তা নয়, চীনের সাথে ভাল সম্পর্কের জন্য, বা ভারতের সোভিয়েত-মুখিনতার জন্য।
হোয়াইট হাউস অডিও তাঁদের বিক্ষুদ্ধতা প্রকাশ করেছে, নিক্সনের স্বভাব-নোংরামিকেও তা ছাড়িয়ে গেছে। ওভাল অফিসে, নিক্সন কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন, ভারতে একটা “দুর্ভিক্ষ” দরকার, কিসিঞ্জার তাচ্ছিল্য/বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন মৃতপ্রায় বাঙালির তরে। আর্চার কে. ব্লাডের বিশদ রিপোর্টিংয়ের পরেও, তাঁরা বাঙালির সাহায্যের জন্য কিছুই করেননি। তখনও তাঁদের হৃদয় বিগলিত হয়নি, এমন কী যখন কেনেথ বি. কেটিং, যিনি ভারতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ছিলেন, ওভাল অফিসে তর্কযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন একটি বাঙালি হিন্দু সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে গণহত্যার বিষয়কে উপস্থাপনর জন্য। আর্চার ব্লাডের গণহত্যাবিরোধী সংবাদ প্রেরণের পরে, নিক্সন ও কিসিঞ্জার তাঁকে পূর্ব-পাকিস্তানের নির্ধারিত পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য বাধ্য করেন, কিসিঞ্জার ব্লাডকে নির্বোধ বলে ভৎর্সণা করেন, আর নিক্সন কেটিঙকে প্রতারক বলে আখ্যা দেন।
ভারত গোপনে পূর্বপাকিস্তানকে যুদ্ধে সাহায্য করে, এবং সহিংসতা শেষ হয়ে আসে যখন ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, এবং ভারতের সামরিক বাহিনী দ্রুতই এক স্বাধীন বাংলাদেশ নিশ্চিত করে। অর্থনৈতিক উন্নতি ও রাজনৈতিক প্রগতি সবসময়ই বাংলাদেশে কঠিন ছিল। কিন্তু, বাংলাদেশের অবস্থা বিপর্যয়ের পরে আরো কঠিন হয়ে যায়: প্রাণহানি, ভঙ্গুর অবকাঠামো ও চরমপন্থা রাজনীতি।
বাংলাদেশ, তার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সত্ত্বেও, এক সন্ত্রস্ত দেশ। আব্দুল কাদের মোল্লার, ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি কোলাবরেশন ও নির্মমতার জন্য যার বিচার হয়েছে, নিয়তির ওপরই অস্থিরতা আংশিক কেন্দ্রীভূত। এই ট্রাইব্যুনাল খুব জনপ্রিয়, কিন্তু আদালত প্রায়ই তার আদর্শ মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছে। এ-বিচার ফাঁদে ফেলেছে বৃহৎ ইসলামি রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের যারা শেখ হাসিনার মূল প্রতিপক্ষের সাথে জোটভুক্ত। বাংলাদেশের এই সাংঘর্ষিক রাজনীতির সমাধান বাংলাদেশের মানুষের ওপরই নির্ভর করছে, নিক্সন ও কিসিঞ্জারের দুর্ভোগ-উদাসীনতা মেনেই।
যদি কিসিঞ্জার থেকে ক্ষমা প্রত্যাশা করা খুব বেশি কিছু হয়ে যায়, আমেরিকানদের অন্তত মনে রাখা উচিত তাঁদের দেশ ও নিক্সন সেই ভয়ানক দিনগুলোতে কী করেছিল।