নিহিত সুন্দরতা । জাকির জাফরান
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ জুলাই ২০১৬, ১০:৪১ অপরাহ্ণ, | ১৯৪০ বার পঠিত
মূল : পাওলো কোয়েলহো ।। প্রকাশিতব্য Manuscript Found In Accra বইয়ের বঙ্গানুবাদ থেকে নির্বাচিত পরিচ্ছেদ ।। তর্জমা : জাকির জাফরান
মানুষ সবসময় বলে : ‘ভিতরের সৌন্দর্যই আসল, বাইরের সৌন্দর্য কিছু না।’
তবে এটা ঠিক নয়।
যদি তা-ই হতো, তবে ফুল কেন মৌমাছিদের আকৃষ্ট করতে এত শক্তি ব্যয় করে? আর সূর্যের মুখোমুখি হলে কেনই-বা বৃষ্টিবিন্দু নিজেদেরকে রংধনুতে রূপান্তর করে? কারণ প্রকৃতি সৌন্দর্য কামনা করে, আর প্রকৃতি তখনই সন্তুষ্ট হয় যখন সৌন্দর্য বিকশিত হতে পারে। বস্তুগত সৌন্দর্য হলো অন্তর্গত সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ, এবং এটা আমাদের চোখ থেকে প্রবাহিত আলোর মধ্যেই নিজেকে প্রকাশ করে। এটা কোনও বিষয় নয় যদি কোনও ব্যক্তি কুৎসিত পোশাক পরে কিংবা আমাদের রুচিবোধের সঙ্গে এটা যদি না-যায়, কিংবা সে যদি অন্যকে আকৃষ্ট করবার তোয়াক্কা না-করে। চোখ আত্মার আয়নাস্বরূপ, যা গোপনস্বভাবী সবকিছুকে প্রতিফলিত করে; আর, আয়নার মতোই, তারা তাদের গভীরে তাকিয়ে-থাকা মানুষটিকেও প্রতিফলিত করে। কারো চোখের দিকে তাকিয়ে-থাকা মানুষটির আত্মা যদি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়, তাহলে সে শুধু তার কদর্যতাই দেখতে পাবে।
‘আমি সুন্দর নই। এজন্যই ভালোবাসা আমার দরোজায় করাঘাত করেনি।’ প্রকৃতপক্ষে, ভালোবাসা করাঘাত করেছিল, কিন্তু তারা যখন দরোজা খুলেছিল, ভালোবাসাকে স্বাগত জানানোর জন্য তারা তখন প্রস্তুত ছিল না।
***
সকল সৃষ্টিতেই সৌন্দর্য নিহিত থাকে। কিন্তু বিপজ্জনক কথাটি হলো এ-ই, আমরা মানুষেরা প্রায়ই স্বর্গীয় শক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকি। অন্যরা কী ভাবে তাতে আমরা প্রভাবিত হই। আমরা আমাদের নিজস্ব সৌন্দর্যকে অস্বীকার করি কারণ অন্যরা হয়তো এটাকে স্বীকৃতি দেবে না। নিজেরা যেমন আছি তেমনি গ্রহণ করার পরিবর্তে আমরা আমাদের চারপাশে যা দেখি তা অনুকরণ করার চেষ্টা করি। অন্যরা যা সুন্দর ভাবে আমরা তা-ই হতে চেষ্টা করি, এবং একটু একটু করে আমাদের আত্মা বিবর্ণ হয়, আমাদের জীবনশক্তি দুর্বল হয়, এবং পৃথিবীকে সুন্দরতম স্থানে পরিণত করার যে সুপ্ত শক্তি আমাদের ছিল তা আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়।
আমরা ভুলে যাই যে দুনিয়াটা তা-ই যেভাবে আমরা একে কল্পনা করি।
আমরা চন্দ্রালোক হওয়ার কথা ভুলে যাই, পক্ষান্তরে চন্দ্রালোক প্রতিফলনকারী ডোবার জলে পরিণত হই। আগামীকাল এই জল সূর্যের আলোয় উবে যাবে। একদিন কেউ হয়তো বলেছিল : ‘তুমি দেখতে অসুন্দর’, কিংবা ‘সে খুব সুন্দরী’। ঐ সামান্য তিনটি শব্দ দিয়েই তারা আমাদের সমস্ত আত্মবিশ্বাস চুরি করে ফেলল।
আর আমরাও অসুন্দর ও তিক্ত-বিরক্ত হয়ে যাই।
***
সেই মুহূর্তে আমরা তথাকথিত ‘প্রজ্ঞা’ থেকে প্রশান্তি পেতে পারি। এই ‘প্রজ্ঞা’ হলো জীবনের রহস্যময়তাকে মর্যাদা দেয়ার বদলে বিশ্বকে সংজ্ঞায়িত করতে ইচ্ছুক কিছু লোকের দ্ধারা স্তূপিকৃত কিছু ধারণা। এই ‘প্রজ্ঞা’ হলো আচরণের আদর্শ মান নির্ধারণের লক্ষ্যে কিছু অপ্রয়োজনীয় বিধিবিধান ও পরিমাপের সমষ্টি।
সেই মিথ্যে প্রজ্ঞা অনুসারে, আমাদের সৌন্দর্যসন্ধানী হওয়া উচিত নয়, কারণ এটা কৃত্রিম ও ক্ষণস্থায়ী।
সেটা সঠিক নয়। এই সূর্যের নিচে যা-কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে, পাখি থেকে শুরু করে পর্বতমালা, পুষ্প-পল্লব থেকে নদ-নদী, সবাই সৃষ্টিজগতের অলৌকিকতাকে প্রকাশ করে।
আমরা যদি অন্য লোককে আমাদের স্বকীয়তা নিরূপণের সুযোগদানের লোভটা সংবরণ করতে পারি, তাহলে পর্যায়ক্রমে আমরা সূর্যকে আমাদের আত্মার ভিতরে প্রজ্জ্বলিত হতে দিতে সক্ষম হবো।
ভালোবাসা উপেক্ষা করে চলে যায় আর বলে : ‘আগে তো তোমাকে কখনও দেখিনি!’
আর আমাদের আত্মা জবাব দেয় : ‘আরও মনোযোগ দাও, আমি এখানেই। তোমার চোখ থেকে ধুলো সরাতে কিছু মৃদুমন্দ হাওয়া লেগেছিল, কিন্তু এখন যেহেতু তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ, আমাকে আর ছেড়ে যেও না, কারণ আমরা সকলেই সুন্দরের পূজারী।’
একরূপতায় সৌন্দর্য থাকে না, থাকে ভিন্নতায়। লম্বা গ্রীবা ছাড়া কে একটি জিরাফকে কল্পনা করতে পারে, কিংবা মেরুদণ্ড ছাড়া একটি ক্যাক্টাস্? পর্বতচূড়ার অসমতাই একে চিত্তাকর্ষক করে তোলে। আমরা যদি এগুলোকে একই রকম করতে চেষ্টা করি, তাহলে এগুলো আর আমাদের মন কাড়বে না।
অপূর্ণ জিনিসই আমাদেরকে অবাক ও আকর্ষণ করে।
আমরা যখন চিরহরিৎ বৃক্ষের দিকে তাকাই, আমরা এটা ভাবি না : ‘শাখা-প্রশাখাগুলো একই দৈর্ঘ্যের হওয়া উচিত।’ আমরা ভাবি : ‘কত শক্ত এটি!’
আমরা যখন একটি সাপ দেখি, আমরা কখনোই বলি না : ‘সে মাটিতে ক্রলিং করছে, যখন আমি মাথা সোজা করে হাঁটছি।’ আমরা ভাবি : ‘সে ছোট্ট হতে পারে, কিন্তু তার ত্বক রঙিন, তার চলা আভিজাত্যময়, আর সে আমার চেয়ে অনেক শক্তিশালী।’
যখন উট মরুভূমি অতিক্রম করে এবং আমাদেরকে আমাদের গন্তব্যে নিয়ে যায়, তখন আমরা কখনোই বলি না : ‘সে তো হলো কুঁজো আর তার দাঁতগুলো কুৎসিত।’ আমরা ভাবি : ‘সে তার আনুগত্য ও সাহায্যের জন্য আমার ভালোবাসা দাবি করে এবং তাকে ছাড়া আমি কখনোই বিশ্বটাকে ভ্রমণ করতে পারতাম না।’
সূর্যাস্ত সর্বদাই অনেক বেশি মনোরম যখন তা আঁকাবাঁকা আকৃতির মেঘে ঢাকা থাকে। কারণ শুধু তখনই তা বহু ধরনের রং প্রতিফলিত করতে পারে যা থেকে স্বপ্ন ও কবিতার সৃষ্টি হয়।
করুণা তাদের জন্য যারা ভাবে : ‘আমি সুন্দর নই। এজন্যই ভালোবাসা আমার দরোজায় করাঘাত করেনি।’ প্রকৃতপক্ষে, ভালোবাসা করাঘাত করেছিল, কিন্তু তারা যখন দরোজা খুলেছিল, ভালোবাসাকে স্বাগত জানানোর জন্য তারা তখন প্রস্তুত ছিল না।
প্রথমে নিজেদেরকে আকর্ষণীয় করতে তারা খুব ব্যতিব্যস্ত ছিল, যদিও প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের মতো সুন্দর ছিল।
ভালোবাসা যখন আসল কিছু খুঁজছিল তারা তখন অন্যদেরকে অনুকরণ করার চেষ্টা করছিল।
বাহির থেকে আসা জিনিসটাকে তারা প্রতিফলিত করার চেষ্টা করছিল, অথচ এটা ভুলে গিয়েছিল যে উজ্জ্বলতম আলো আসে ভিতর থেকে।