হিরণ্ময় । জাহেদ আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জুন ২০১৬, ১:০৩ পূর্বাহ্ণ, | ৩৭৮১ বার পঠিত
হিরণ মিত্র আঁকেন দারুণ চিত্রচলচ্ছবি। এত দ্রুতচালিত কলমের বা চিকন তুলির বা মোটা ব্রাশের শাদামাটা একেকটা টানে কথা বলে ওঠে তাঁর আঁকার বিষয় ও অঙ্কিত ছবিগুলো, কথা কলকলিয়ে নয় বরং রয়েসয়ে-রসেবশে, ব্যাপারটা তারিয়ে-তারিয়ে দেখার এবং ছবিচিত্রাসক্ত বন্ধুদেরকে ডেকে ডেকে দেখাবার মতো অভিজ্ঞতা। আমি দেখি, হিরণ্ময় জগতের বিভা, আর অবাক সবিস্ময় তাকিয়ে থাকি।
হিরণ মিত্র, যতদূর জানি, অপ্রাতিষ্ঠানিক মনমেজাজের চিত্রশিল্পী। তিনি, খুব সম্ভব, মনে হয়, চিত্রকলাগৃহে পাঠ নিয়েছেন যতটা-না নিজের অঙ্কনগরজে তারচেয়ে বেশি কিছু-একটা সার্টিফিকেট নেবার দায়ে, — যেন সমাজে আঁকিয়ে হিশেবে একটা গ্রাসাচ্ছাদন জোটানো যায়। এইটুকু পড়াশোনা না-করলেও হিরণ মিত্র, আমার ধারণা, হিরণ মিত্রই হতেন। শুধু হিরণ নয়, যে-কোনো জাত শিল্পীর সম্পর্কে আমার এই ধারণা বারবার বলবৎ রহে। এইটা, এই কথাটা, হাইপোথেটিক্যাল্ হয়ে গেল। অপ্রমাণিত তথ্য। তবে হিরণ মিত্তিরের আঁকাজোখার সঙ্গে চেনাজানা আছে যাদের, তারা অন্তত এইটুকুতে ভুল ধরবেন না যে তাঁর মন ও মেজাজ বহুলার্থেই অপ্রাতিষ্ঠানিক। কোনো পূর্বপ্রচল পরম্পরা বা কোনো ঐতিহ্যানুগত অঙ্কনপথের বাঁকে সেভাবে দেখা যায় না তাঁকে। একটা-কোনো ঘরানায়, একটা-কোনো বড় বা ছোট ঘরে, সেঁধানো যায় না তাঁকে। এটাও তো লক্ষ না-করে পারা যায় না যে হিরণের সমবয়সী শিল্পীরা যেখানে পেটমোটা আর্ট-কালেক্টরদের আলিশান হাভেলির পোর্চে-পোর্টিকোতে কফিকাপ হাতে হে-হে-হে-হে সকালসন্ধ্যা কচলান, হিরণ সেখানে আজও কতিপয় লিটলম্যাগাজিনের আখড়ায় স্বচ্ছন্দ সময় কাটান পত্রিকা-অন্তপ্রাণ তরুণ ও তুখোড় মাঝবয়সী শিল্পশাণিত গরিব লেখকদের মেধাবী আব্দার মেটাতে যেয়ে পাতার পর পাতা এঁকে এবং অলঙ্কার গড়ে। সেহেতু, বলাই যায়, খুব-একটা ভুল বলিনি হিরণ মিত্র সমস্ত ধরনের প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিকতা তথা প্রতিষ্ঠানমানসিকতার উজানে যেয়ে দাঁড়ান তাঁর ক্যানভাসে কিংবা উবু হন স্কেচবুকে। এ-প্রসঙ্গে পরে আবার আসব, যদি না ভুলে যাই, এক্ষণে এমনি-এমনি একটু পরিচিতি — হিরণ মিত্রের সম্পর্কে দু-তিন লাইনের বেশি তথ্য উইকিতে খুঁজেও পাবেন না আপনি, নির্দিষ্ট কয়েক ছোটপত্রিকার বিশেষ সংখ্যা ছাড়া — সিরিয়াস-কিছু-নয় এমন ভঙ্গিতে একটা ইনফর্ম্যাল্ কিন্তু উষ্ণ করমর্দন সেরে নেয়া যাক প্যারাগ্রাফান্তরে যাবার এই ফাঁকে।
শিল্পী হিরণ মিত্র ভূভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের কলকাতা শহরে থাকেন ও চব্বিশঘণ্টা আঁকাআঁকি করেন, বছরের এমাথা-ওমাথা বিদেশটিদেশেও যান অথবা গিয়েছেন বেশ ক-বার প্রদর্শনীতে নিজের পসরা নিয়ে কিংবা অন্য নানাবিধ আমন্ত্রণে। এছাড়া টেলিভিশনের কিছু অনুষ্ঠানে হিরণ মিত্রকে পেইন্টার-পার্ফোর্মার হিশেবে দেখা গিয়েছে। এহ্-হে! দেখা যাচ্ছে, বেশ তো কদরণীয় শিল্পী উনি, কিন্তু নামনিশানা দেখি নাই যে এর আগে কোথাও! উস্তাদ, অফ যান, শুঁটকিসুরুয়ার সমুজদারি দিয়া আপনে তেষট্টি বছর কোপ্তাকালিয়া সাবড়ায়া গেছেন, অখন অফ দেন নাইলে ধরা খাইবেন। ওই, উস্তাদের মুখ থাইকা মাইক আইনা আমারে দে, পরিচয়টা সারি আগে। এই পর্যায়ে — (এ-এ-এ আমতা-আমতায়) — কই ছিলাম যেন? হ্যাঁ, হিরণ মিত্র। জন্ম ১৯৪৫ ঈসায়িতে। মেদিনীপুরের খড়গপুর অঞ্চলে। একেবারেই কিশোর বয়সে, বছর চৌদ্দ হবে তখন, খড়গপুর গ্রামবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন নগর কলকাতার পানে অঙ্কনবিদ্যায় একটু ভালো তালিম নেবার মানসে। এসে একসময় ভর্তিও হয়ে যান সরকার বাহাদুরের বানানো কলকাতা আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্ট কলেজে। এই তো, সোজা সংক্ষেপ, হয়ে গেলেন শিল্পী। কিন্তু উস্তাদ, আপনি জিগাইবেন, বিদেশের ডিগ্রি নাই? অ্যানাটোমিতে এমবিবিএস বা এফআরসিএস বা মেডিসিনের/সার্জারির অন্য যে-কোনো শাখায় শিক্ষাদীক্ষা, সাপোজ্ মনে করো তোমার ওই, কি বলে, ইউকে রয়্যাল্ কোনো কলেজ্ বা ধরো ফ্রম ফিলাডেলফিয়ার কোনো সেন্টার অফ এক্সিলেন্স থেকে? উস্তাদ, কি কমু, আপনেরে নিয়া আর পারি না। কাজ দেইখা কইবার লাগছি মিয়া, পেয়ার-স্যে, ডিগ্রিফিগ্রি দেইখা না। তাছাড়া আমি জানি না, জানতে চাইও না, জানবার দরকারও মনে করি না। খামোশ!
এইটা আলবৎ ট্রু যে, অ্যানাটোমি নখাগ্রে রপ্ত না-করে কেউ শিল্পী হতে পেরেছে শোনা যায় নাই। শিল্পীচিত্রীদেরে ক্যানভাসের সামনে খাড়াতে হয় চাকু হাতে চেঁছে রঙ নামানো বা রঙের পোচ চড়ানোর গরজে, যেমন শল্যচিকিৎসকদেরে দেখবেন সিজ্যর-ফোর্সেপ্ হাতে নিয়া মানুষ কাটাছেঁড়ার থিয়েটারে। এ-ও দেখেছি যে, খুব ভালো অ্যানাটোমি দখলে নিয়েও শিল্প পয়দানোর বেলায় একের-পর-এক কলার মোচা পয়দা করে গেছেন কেউ কেউ। কলার মোচা বাংলার ঘরে ঘরে জাস্তি খানার আদর পায়, পেয়ে আসছে আবহমান, আমারও জবর প্রিয়। কথা ঘুরে যাচ্ছে, এবার ফেরাও মোরে। এই হিরণ মিত্রের খাতার একটা ছেঁড়া পাতা দেখেও কয়ে দেয়া যায় যে এই শিল্পী অ্যানাটোমি গুলে খেয়ে বড় হয়েছে। এক্ষণে যা কহা কর্তব্য, তা হয় এ-ই যে, অ্যানাটোমি জিনিশটা কাব্যের ছন্দের মতো। ওই দুই জিনিশ — অ্যানাটোমি বা অঙ্গসংস্থানবিদ্যা এবং প্রোসোডি বা রেটোরিক্ — যুগপৎ একনম্বরের মিত্র ও একনম্বরের শত্রু যথাক্রমে চিত্রীর ও কবির। বলতে হয়, দেখলেই বোঝা যায়, হিরণ অ্যানাটোমির প্রেমে মজনু হননি। হিরণের কাজে আপনি দেখবেন সংহত গতির, মানে স্পিডের, শাণিত নৃত্যমুদ্রা। শক্তিশালী বিমূর্ত কলাচারিত্র্যে হিরণের কাজগুলো মুখর অথচ মৌন। চুপচাপ, ক্ষুদিরামের মতো উজ্জ্বল সুন্দর, লুটেরা বাপের ফটরফটর-ইংরিজি-ফুটানি-মারা পোলা না। আচ্ছা। আমি নিজেই বুঝতে পারছি, এগুলো খুব ট্র্যাশ কথাবাত্রা। তাছাড়া হিরণের মতো শিল্পীকে এইসব কথায় দৃশ্যায়িত করা যায়ও না।
অ্যাবস্ট্র্যাকশন্ তো গোপাল ভাঁড়ের চান্দিছোলা টিকিচিত্রেও হালে দেখা যায়, স্পিডও কোনো রসগোল্লা না আজকালকার ২৫০ সিসি মোটরবাইকের মেইনস্ট্রিম বঙ্গে। কিন্তু হিরণের স্পিড, হিরণের বিমূর্ততা, আর্টকালচার কা কসম, বিলকুল আলাহিদা। মাত্তর এক-দেড় টানে — কলমের/পেন্সিলের, ছোটতুলির/মোটাব্রাশের — স্রেফ ঘোলাটে-ধূসর বা শাদা-সাধারণ খাতাপাতায় হিরণ আগুন ধরিয়ে দেন। শরীরের বিভঙ্গিল ক্রিয়াকাণ্ড ফুটিয়ে তুলতে জানেন তিনি কলমের নিবটারে একটু ঝুঁকিয়ে পৃষ্ঠাগাত্রে একঝটকা চাপ মেরে — আজব! মনে হয়েছে আমার, গত বিশবছর ধরে প্রধানত পশ্চিমবঙ্গীয় কয়েক লিটলম্যাগে তাঁর কাজ দেখতে দেখতে, হিরণচিত্ররচনাগুলো ভোক্তার কাছে একটা আলাদা তাৎপর্য ও মর্তবার নজর লাভ করে। বেঙ্গলের আর্টক্রিটিক্ বা পেইন্টিংপণ্ডিত যারা রেগ্যুলার গ্যালারিরিভিয়্যু রচেন এবং পত্রিকায় প্রকাশেন, তারা আলবৎ হিরণের কাজকর্ম একচক্কর দেখিয়াই কয়ে দিতে পারবেন নিশ্চয়ই যে এভাবে বা ওভাবে ওই অমুক বা তমুক বক্রতা/সারল্য/মোচড় চিত্রকলায় এনেছেন তিনি! কিংবা, ব্লা ব্লা, পারেন নাই কিচ্ছুটি। নিতান্ত আমার মনগড়া ভাবনা, তাই ভুল হবে মিস্ নাই, অতএব দেখোয়াড়ের দেখা চাই।
নৃত্যমুদ্রার কথা বলছিলাম একটু আগে। হিরণচিত্র উপভোগের/আস্বাদনের একটা চাবিশব্দ হতে পারে এটি। নৃত্যমুদ্রা। নাচের কোরিয়োগ্র্যাফি থেকে দুইহাতে নিয়েছেন হিরণ। এইভাবে সম্ভবত বাংলার কোনো শিল্পীই নাচ থেকে এত নেননি আগে। নিয়েছেন এবং ফিরিয়ে দিয়েছেন উদার-দরাজ প্রভূতভাবে, প্রভুর মতন সদাশয় ও দয়ালু ভঙ্গিতে, সেহেতু কর্জ শোধের প্রশ্নোত্থাপন অবান্তর। মূলত লোকনৃত্য, ফোক্ ড্যান্স, সেইসঙ্গে ক্যালিগ্র্যাফির কৌশল যুক্ত করে একটা আঙ্গিক তৈরি করে নিয়েছেন নিজের জন্য, চিত্রপ্রকরণগত নতুনতা এনেছেন। অভিনব। মানুষের, দেহাতি মানুষ ভর করেই বস্তুত, নিত্যপুরাণ তাঁর শিল্পের উপজীব্য। কঠিন কঠিন শব্দ এসে যাচ্ছে দেখুন, সর্বনাশ, গণ্ডমূর্খামো ধরা পড়ে যায় বুঝি! কিন্তু কথা কিছু অবশিষ্ট এখনো, তো, বলি জারা ধিরে-স্যে। হ্যাঁ, সেইটাই, ধীরে এগোই।
দীর্ঘদিন আদিবাসী-বাউল-হরিজনদের জনপদের সঙ্গে সংস্রব, দিনানুদৈনিকের খুঁটিনাটি বিষ-অম্ল-মধু, তাঁর কাজে আটপৌরে জনজীবনধারা পায় মিথের মর্যাদা। তাঁর কাজ কথা বলতে চায় সময় ও বাস্তবের আলোআঁধারগ্রস্ত কুহক নিয়ে, যেন মনে হয়, তিনি চিত্রকলাকে একটা যাপনকৌশল বৈ ভিন্ন কিছু মনে করেন না। আমার মনে হয়েছে এগুলো, নানান সময়ে, কিছু কথা তাঁর অটোবায়োগ্র্যাফিক্যাল্ স্কেচধর্মী ছোট ছোট ও ছবিবিম্বিত রচনাগুলো থেকেও জানতে পেরেছি যা মাঝে মাঝে ছাপা হয় ইতিউতি কিছু ছোটপত্রিকায়।
হিরণের সিগ্নেচারমার্ক কি বা কোথায়, তাঁর ফিঙ্গারপ্রিন্ট কিসের থেকে বোঝা যায়, কিংবা তাঁর আইপ্রিন্ট কোথায় কোন পয়েন্টে যেয়ে ঠিকঠাক শনাক্ত করা যায়, এগুলো জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অবশ্যই। জগতের সমস্ত জরুরি-ও-জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন পঠিত বলিয়া গণ্য হইলেই বাঁচিয়া যাইতাম। যা-ই-হোক, অন্তত তাঁর ব্যবহৃত কমন্ টেক্নিকগুলোর কথা তো বলিতব্য। স্তরে স্তরে ওয়াশের ব্যবহার করেন খুব, মনে হয়, স্প্রে দেখি প্রিয় খুব তাঁর যখনই রঙিন বড় ক্যানভাসে দাঁড়ান, বোল্ড ব্রাশের স্ট্রোক্ তো আছেই, হিন্দুস্তানী মার্গীয় সংগীতের বিরাট বড় উস্তাদও মঞ্চ থেকে নেমে কুর্নিশ করবেন ব্রাশ-চালনরত হিরণকে, অ্যাক্রিলিকের এক-রকম বিশেষ ব্যবহার হিরণচিত্রে লক্ষণীয় যা ঐতিহ্যপ্রথানুগতের বাইরে। এইসব দিয়া মোটামুটি হিরণ মিত্র সম্পর্কে একটা চাপান-উতোর অনুষ্ঠান কয়েক পর্ব চালানো যায় এবং স্পন্সর পটানোও না-মুমকিন নয়, কিন্তু হিরণরেখার একটা ঝিলিক কিংবা হিরণ মিত্রাঙ্কিত ছোট ছোট পলকা ডট একটাও চোখের জিভে চেখে দেখা হয় না তাতে। তাহলে কি করা? আমারে জিগান কিল্লাই!
হিরণ মিত্তিরের ছবি আমি দেখে চলেছি দেড়যুগেরও বেশি কাল ধরে, মূলত ‘অনুষ্টুপ’ ও ‘জারি বোবাযুদ্ধ’ প্রভৃতি পত্রিকায়। শেষোক্ত পত্রিকায় তিনি প্রাণপ্রাচুর্য নিয়া হাজির থাকেন প্রত্যেকটি সংখ্যায়। পাতায় পাতায় ব্রাশের এত দ্রুত ও নিরাভরণ ব্যবহার! পাতায় পাতায় কত্থক আর ছৌ-কাবুকি! পাতায় পাতায় এত গতি! পাতায় পাতায় এত তীব্র ও অনুভূতিশীল জ্যান্ত লিপ্ত-তৎপর ছবি একেকটা! সবই স্কেচখাতা থেকে তুলে এনে সরাসরি ছেপে দেয়া, দেখে তা-ই মনে হয়। এই দুই পত্রিকার প্রায় সমস্ত সংখ্যায় হিরণ একক ও অসামান্যভাবে উপস্থিত থাকেন। এছাড়া তাঁর ছবি দেখি পপুলার-ধারার-বাইরের কিছু নির্বাচিত লেখকের বইয়ের প্রচ্ছদে। যেমন অরিন্দম চক্রবর্তী, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখের বইয়ের মুখ মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। এছাড়া রাহুল পুরকায়স্থ, মৃদুল দাশগুপ্ত প্রমুখের গত কয়েক বছরের বেরোনো বইগুলোতে হিরণহাত লেগেছে বলে সেগুলো স্বাদেগন্ধে বেড়ে হয়েছে; মাইরি বলচি মাসিমা! আরে, মেসোমশাই, বিশ্বেস হয় না? বাংলা অফট্র্যাক্ বইগুলো আর অফবিট্ প্রকাশনালয়গুলোর সঙ্গে হিরণের সংশ্লিষ্টতা আমরা লক্ষ করব সবসময়। এবং, ভুলিয়া যাবার নয় সেই ঘোড়াগুলোকে, সেই গৌতম চ্যাটার্জি আর তার দলবলটিকে, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ সম্পাদিত বাংলা গানের সংকলনগুলোর কাভারআর্ট এবং ইনলে কার্ড ডিজাইনে হিরণের জাদু ভুলিবার মতো নয়। কেবল গৌতম নয়, দলের প্রত্যেকটা ঘোড়ার সঙ্গেই হিরণ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো, হিরণ জড়িয়েমুড়িয়ে রেখেছেন নিজেকে সুরের জগতেরই মানুষদের সঙ্গে; দীপক মজুমদার আর গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের প্রভাবে বোহেমিয়ান্ বীজ বয়ে বেড়িয়েছেন বাউলের এক ঠেক থেকে আরেক ঠেকে, গৌরক্ষ্যাপা থেকে শুরু করে পবন দাস বাউল প্রমুখ অসংখ্য গানসঙ্গীর অন্তরঙ্গ ছবি এঁকে গেছেন একেবারে নৃত্যমুদ্রা আর তাদের দ্রব্যমৌতাত সমেতই!
হিরণ মিত্র অনেক স্টলোয়ার্ট কবি ও লেখকদিগের পছন্দের চিত্রী। নিজেও গদ্য লেখেন হিরণ অত্যন্ত ধীঋদ্ধ ও চিত্রোপম ধরনে। লেখায় এবং ছবিতে, রেখায় এবং অক্ষরের জড়োয়ায়, হিরণের বইগুলো হয়ে ওঠে লেখাছবি/ছবিলেখার অনুপম আলেখ্য। অবনীন্দ্রনাথ যেমন সমানতালে লেখায়-আঁকায় ছিলেন অনবদ্য ও সক্রিয়, উল্লেখ করতে হবে যেমন প্রকাশ কর্মকারের কথাও, অথবা রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন লিখতেন নিজের ছবির চারিধারে স্কেচখাতা ব্যেপে বিস্তর কথাবার্তা। আমাদের কামরুল হাসান মনে পড়বে, পটুয়া নামে তিনি দিনলিপি লিখেছেন অনেকদিন একনাগাড়ে, ‘খেরো খাতা’ নামে সেসব লেখা আমরা পড়েছি দৈনিকীর ধারাবাহিক উপসম্পাদকীয় কলামের প্রবাহে এবং হয়েছে গ্রন্থাবদ্ধও। অথবা কাইয়ুম চৌধুরী জীবনের শেষদিকে এসে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন দেখতে পাই, চিত্রীর চিত্রবীক্ষণিক চোখের নিশানার খানিক অন্তরঙ্গ ও অন্যকৌণিক পরিচয় আমরা লাভ করে উঠি শিল্পীদিগের এইসব লেখাকাজ থেকে। এইটা আলবৎ নতুন নয়, এমন অনেক অঙ্কনশিল্পীর সাক্ষাৎ আমরা পেয়েছি যারা অক্ষরেও সমান সিদ্ধহস্ত পরিচয় রেখে গেছেন। মিকেলঅ্যাঞ্জেলোর কবিতা বাংলায় অনূদিত হয়ে বেরিয়েছে, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির লেখাও পড়েছি আমরা বাংলায়। আত্মজীবনী তো অনেকেই লিখে থাকেন, আমরা বলছি আত্মজীবনীর বাইরে যেসব লেখাপত্র গ্রন্থায়িত/গ্রন্থাদৃত হয়ে থাকে সেসব নিয়ে। সেই হিসাব মোতাবেক বাংলাদেশে জীবিত পেইন্টারদের মধ্যে একজন লেখক মুর্তজা বশীর। যদিও অনেকেই লিখেছেন আত্মজীবনী ও অন্যান্য উপলক্ষ্যের বই, বলা বাহুল্য, শিল্পী আমিনুল ইসলাম যেমন লিখেছেন বাংলাদেশের চিত্রশিল্প আন্দোলনের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসালেখ্য; যদিও বইটা আদৌ পূর্ণাঙ্গ নয় বলেই মনে হয়, এবং বইয়ের ভেতরকার পঞ্চাশ বছরের স্মৃতিও অল্পবিস্তর আপত্তিবিস্তারী এবং মনে হয় স্বেচ্ছাচয়িত ও খণ্ডিত। ছবিআঁকিয়েদের লেখালেখির মর্যাদা আলাদাভাবেই বিচার্য; অবশ্যই।
হিরণ মিত্র গদ্যশিল্পী হিশেবেও গুরুত্বপূর্ণ। ছবিলেখকের অনেক লেখার সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি লিটলম্যাগের কল্যাণে। বেশকিছু রচনা একমলাটে বেঁধেছেঁদে বইও বেরিয়েছে। এর মধ্যে একটা বইয়ের নাম হলো ‘মুখ-মুখর’, আরেকটা ‘আমার ছবি-লেখা’। আরও বই সংকলিত হয়েছে হিরণের লেখাপত্তর নিয়ে। মূলত বইগুলো উৎকৃষ্ট গদ্যকাজ হলেও ছবিলেখকের আঁককৌশলের বহু খোঁচখাঁচ জানা যায় এইসব রচনার ইতিউতি। কিন্তু হিরণের গদ্য কি পাতে তোলার মতো সত্যিই? চিত্রী হিশেবে একটা রেয়াতি ডিগ্নিটি লভিছেন না তো উনি? ইতিউতি কিছু উদাহরণ দুই বইয়ের ভিতর থেকে এনে এই নিবন্ধে হেথা-হোথা রাখার চেষ্টা রয়েছে নিবন্ধকারের। অন্যদিকে, অন্যভাবে, হিরণের গদ্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে ‘ধূসর আতাগাছ’ ও ‘নরখাদক’ প্রভৃতি গদ্যের রূপকার এবং প্রধানত কবি উৎপলকুমার বসু মহাশয়ের একখানি খুদেকায় রিভিয়্যুয়ের কয়েকটা বাক্য হস্তে লয়ে। হিরণের একখানা বই যথা ‘আমার ছবিলেখা’ আলোচনা করতে যেয়ে উৎপল বলছেন, “দৈবাৎ এমন বই হাতে আসে। ছবি ও গদ্যের এক আশ্চর্য সমন্বয়। অথবা বলতে পারি স্কেচ ও কবিতার। অথবা মানুষের কথা বলার এবং তার হাতের কৌশলে সৃষ্ট শিল্পকর্মের জড়াজড়ি অস্তিত্বের এক বিস্ময়কর নিদর্শন। এমন একটি বই তৈরি করেছেন হিরণ মিত্র। বাংলা ভাষায়। এই শতাব্দী-শেষের ক্লান্ত সময়ে। যখন আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছি যে আর আমাদের নিজস্ব বলে কিছু থাকল না। না কবিতা। না ছবি-আঁকা। না আত্ম-আবিষ্কার। আমরা যখন হতে চলেছি ভোটার লিস্টের মানুষ, রেশন কার্ডের নরনারী, আইডেনটিটি কার্ড বহনকারী মানবক মাত্র। তখন যেন ধরিত্রী ফুঁড়ে উঠে এল এই বই — চিত্রময়, শাখাপ্রশাখা সমেত, মাটির গন্ধমাখা, বালির প্রলেপে চিহ্নিত, সমুদ্রফেনার মতো ধাবমান এক আশ্চর্য স্মৃতিকথা।” উৎপলকুমারের বুকরিভিয়্যুটা পাওয়া যায় ‘এক যে ছিল বই’ শীর্ষক রচনায় এবং রচনাটা পাওয়া যায় ‘গদ্য সংগ্রহ ১’ গ্রন্থের ১৩৪ থেকে ১৩৭ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত পৃষ্ঠায়। [গদ্য সংগ্রহ ১, উৎপলকুমার বসু, নান্দীমুখ সংসদ, কলকাতা, ২০০৫]
তা, কেমন সেই গদ্যনমুনা? ‘আমার ছবিলেখা’ থেকে দেখা যাক পরপর কয়েকটা; — ১. একটা বারান্দার মেঝে এঁকে তুলছেন হিরণ কেমন করে, দেখা যাক; — “বড় বড় বুনো গাছ সবুজ পাতায় ঐ মেঝে ভরিয়ে দেয়। যে-মেঝে একসময় ভাই-ফোঁটায়, কনে-দেখায়, আচারে অনুষ্ঠানে, ফুলে ফরাসে রঙিন হয়ে উঠত, গ্রীষ্মের দুরন্ত দুপুরে শীতল রাখত শরীর, তাতে আমাদের খেলনা গড়িয়ে যেত। … ঐ টানা বারান্দায় বাবা, বড়দা, মা একের পর এক চিরনিদ্রায় শায়িত থেকেছে। ধূপ ও ফুলের গন্ধ মেঝের গভীরে প্রবেশ করেছে! … এক সময় দেখলাম বাড়ির সব ভেঙে গেছে। আছে ঐ টানা বারান্দা একা।” আরেকটা জায়গায় যেয়ে ফ্যামিলি-অর্গ্যানাইজড পুজোআচ্চার বিবরণ পাচ্ছি ভীষণ জীবন্ত; — ২. “গোল চালা। তার উপর শূলের মতো ছুঁচলো কাঠের গজাল। ওখানে বসবেন শিব। সব সাজানো শেষে, মেজদা চালায় উঠে শিবকে বসিয়ে আসবেন। কিছু রাংতার কল্কা যাবে ভেঙে। শিব নির্বিকার। কানে টগর ফুল, হাতে কল্কে, জটাজুট, প্রসন্ন মুখে সব ঝামেলা ছাড়িয়ে শিব বসবেন উপরে। আবার ভাসানের সময়, কারও কোলে উঠে, বাচ্চা ছেলের মতো, মা দুর্গার সঙ্গে চলবেন কাছাকাছি কোনো জলার দিকে। ওখানে ডুব দিতে হবে। তবেই শান্তি। … বেল-আঠার গন্ধে, শিউলির রূপে, বৃদ্ধ পোটোর গুনগুনানি গানে, শরতের রাত্রি আমার সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে গেল।” মিত্তির মশাইয়ের হাতযশ কোথায়, সিদ্ধিদাতা তিনি কোথাকার, বোঝা যাচ্ছে তো? গদ্যের চিত্ররূপময়তা, পিক্টোরিয়্যাল্ কোয়ালিটি অফ প্রোজ্ ওয়ার্ক্স বোঝার জন্যে এরচেয়ে বেশি উদাহরণ দরকার হয় না। আর যদি হয়ও, তখন গোটা বইটাই পঠিতব্য।
ও আচ্ছা, আরও দুটো মুগ্ধতার কথা বলা হয় নাই, কিন্তু সময় শেষও হয়ে এল — ঘুম হইতে উপাসনা উত্তম, চিত্রালোচনা নয়। একটা হলো, হিরণের পোর্ট্রেট আর দুইটা হলো হিরণের কাগজ-কেটে-কেটে-বানানো কোলাজ্। থাক আজ। শুধু বলি, প্রথমটাতে তিনি সত্যজিৎ, আই মিন মিস্টার রয়, আমাদের মানিকদা তথা রায়চৌধুরী ফ্যামিলির বাহাদুরকে কিস্তি-মাত করেছেন বহু আগেই। মিস্টার রয় ইজ্ গ্রেইট, এক্ষেত্রে, এতে সন্দেহ অল্পই, কিন্তু অত্যন্ত পলিশড এবং ওয়েল্-ক্র্যাফটেড অর্থে গ্রেইটনেস্; রায়ের এহেন পলিশনেস্ পজিটিভ-নিগ্যাটিভ উভয় কনোটেশন্ থেকেই দেখতে পারি। কিন্তু সত্যজিতের, সত্যজিৎ রায়ের, অভাবিত অর্থেই বিচিত্র কল্পনাসৃজনের নজির পাওয়া যায় তার বানানো ম্যুভিনিচয়ের পোস্টারডিজাইন্ এবং ‘সন্দেশ’ পত্রিকা ইত্যাদিতে তার ইলাস্ট্রেশন্ এবং সর্বোপরি অতুলনীয় তার লোগো-লেটারিং প্রভৃতি সৃজনযজ্ঞে। সত্যজিৎ রায়ের অঙ্কিত প্রতিকৃতিসমগ্র নিয়া আনন্দ পাব্লিশার্স থেকে একটা দুই-খণ্ডের বই বাজারে পাওয়া যায়, যেইটা বাংলায় অনির্বচনীয় বললে বেশি বলা হয় না নিশ্চয়। কিংবা আমাদের দেশে একটা কার্টুনেস্ক স্টাইলে পোর্ট্রেট এঁকে ডেইলি নিউজপেপারে ম্যাসিভ প্যপুলার হয়েছেন বলা যায় শিশির ভট্টাচার্য, উনার একটা কাগুজে অ্যান্থোলোজি বাজারে বেরিয়েছিল স্বনির্বাচিত প্রতিকৃতিগুচ্ছ নিয়া; মাসুক হেলালের আঁকা সাধারণ পথচলতি মানুষের মুখাবয়ব নিয়াও সম্প্রতি বিউটিফ্যুল্ বই হয়েছে একটা, বাজারে পাওয়া যায়। এসবের সঙ্গে হিরণ মিত্রের প্রতিকৃতিচর্যা আদল-ও-অঙ্কনকৌশলেও মনে হয় আলাদাই। হিরণ প্রায় ক্যারিক্যাচারের ঢঙে, ক্যারিক্যাচার নয় তাই বলে, ক্যারিক্যাচারের চেয়েও কম রেখা লগ্নি করে, এঁকে ওঠেন মুখাবয়বগুলো। অথচ ছবিভোক্তার কাছে সেই মুখের বৈশিষ্ট্যগুলো, হয়তো অঙ্কনশিল্পীর অভিপ্রেত বৈশিষ্ট্য ওগুলো, মূর্ত হয় এবং মজা-মশকরার বদলে সেই আঁকা ভোক্তাকে ভাবায়; বেশিরভাগ শিল্পীর হাতে ফলন্ত/প্রসবিত প্রতিকৃতি যেখানে ফোটোগ্রাফের পশ্চাদ্ধাবন করে এবং ফোটোগ্রাফের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার মধ্যেই সিদ্ধ হতে চায়, হিরণের প্রতিকৃতি ভিন্নতা দেখায় ঠিক এইখানে। জ্যাপ্নিজ্ স্টাইলে, পিক্যাসো অরিয়েন্টেড কিউবিস্ট ফর্মে, বেশকিছু প্রতিকৃতির দেখা পাওয়া যায় হিরণের ‘মুখ-মুখর’ বইটাতে, যেগুলো প্রতিকৃতিচিত্রী/চিত্রশিক্ষার্থী/শিক্ষানবিশের কাছে খেয়াল করার মতো নবনৈপুণ্যখচিত। কত অল্প রেখায়, এক-দুইটা আলতো ফুটকি-ফোঁটায়, একটু বক্রতায় কি নিরলঙ্কৃত সরলরেখায় অ্যাকশনগুলো রিফ্লেক্টেড হয় হিরণের আঁকপাতায়! মিত্র রাফ, একটামাত্র লাইনই কাফি, রাফকাট। পলিশনেস্ একদম নেই। রামকিঙ্করের স্কাল্পচার যেমন। কোলাজগুলো, তাঁর, যেন জাপানি অরিগ্যামি শিল্পের আবছা আদল। এ-ই তো।
মূলত সুরের জগতের অধিবাসীদের মুখরেখাগুলো ‘মুখ-মুখর’ বইয়ের পৃষ্ঠাধারায় ধৃত রয়েছে। এছাড়া ছায়াছবিভুবন, বিজ্ঞাপনজগৎ, মঞ্চনাট্যকলাকুশলী ইত্যাদি বিচিত্র গোষ্ঠীপেশার মুখ হিরণ মিত্র এঁকে তুলেছেন বইটিতে। এঁকেছেন, কিন্তু একদিনে নয়, একের পর এক বছর ধরে এঁকে তোলা আবয়বিক সংগ্রহ এই বই। কীভাবে এই বইটি হয়ে উঠেছে, এর হয়ে ওঠার ইতিহাস, গোড়ার কয়েকটি পৃষ্ঠায় হিরণ সংক্ষেপে বলেও নিয়েছেন। যেমন, “তাদের চলমান দেখেছি কথায়, গানে, হাঁটার ফাঁকে ফাঁকে রেখাছায়া, প্রতিবিম্ব ফেলেছে সাদা কাগজে। কোনও আলোকচিত্র অথবা অন্যকিছুর সাহায্য ছাড়াই মুখাবয়ব মুখর দেখেছি তাদের অন্যমনস্কতায়। সাধারণত ব্যক্তির অজান্তেই রচিত এই সব মূর্তি তাদের অগোচরেই থেকে যেতে ভালোবাসে। আবার অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো মৃতদের ছবি আঁকার জন্য আলোকচিত্রই ছিল শেষ ভরসা। কখনও একে প্রকাশ করার বাসনা ছিল না। বহু সহস্র খ্যাত-অখ্যাত মানুষজন এমন রেখাবন্দি, রঙবন্দি — আমাকে রাতবিরেতে সঙ্গ দেয়, কথা বলে, উসকানি দেয়। আমার ‘অপর’ এরা। এরা সবাই যে আমাকে চেনে, এমন নয়। আমিও যে চিনি তাও নয়। তবুও লেখায়, রেখায় যা বলা গেল, তার থেকে না-বলা রয়ে গেল অনেক বেশি।” কিংবা ঠিক পরের অনুচ্ছেদে এইসমস্ত মুখাকৃতি অঙ্কনের এক গূঢ় সূত্রই যেন হিরণ প্রকাশ করতে চেয়েছেন, প্রকাশ করছেন এইভাবে, “ছোটবয়সে তড়িৎরেখায় ধরা মূর্তি, সেই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে গিয়ে বুঝতে যেতাম তাদের মুখাবয়বের সঙ্গে তাদের বসার ধরন, শরীরের গড়ন, অঙ্গগুলি কেমন মুখচ্ছবি হয়ে থাকছে। শরীরের যে-কোনও অংশ দেখলেই চেনা হয়ে যায় মানুষটিকে। এ অভ্যাস রয়ে গেল। পরিশীলিত হলো। আরও অভ্যাসে।” হ্যাঁ, সেইটাই, এ-অভ্যেস একদিনে হবার নয়, এই বীক্ষণ এই দৃষ্টি, অবলোকনের এই বিশিষ্টতা চাইলেই হয়ে যায় না। প্র্যাক্টিস্ লাগে। প্র্যাক্টিস্ রক্তে মিশে যেতে হয়। প্র্যাক্টিস্ ভাবনালগ্ন হতে হয়। প্র্যাক্টিসের লগে লগে ভাবতেও হয়। নিশানা ঠিক করে রেখে সেয়ানা ভাবা নয়, নির্নিশানা ভাবনা জানতে হয়। ভাবা প্র্যাক্টিস্ করতে হয়। সেই যে, “ভাবো। ভাবা প্র্যাক্টিস্ করো।” — বলেছিলেন ঘটক মশাই, ঋত্বিককুমার, কথা সেইটাই। হিরণের একেক রেখার আভাসে খেলা করে যেন অন্তর্গত রক্তেরই বিস্ময়। বিপন্ন করে আমাদেরে, দর্শক-ভোক্তাদেরে, করে অপার বিস্ময়াপন্ন।
সবাই সমানভাবে প্রশংসা করেছেন হিরণের এই বিপুল মুখরেখামালার, তা নয়। ক্রিটিক করেছেন এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। সেইসব ক্রিটিকের ধরন খানিকটা চকিতে দেখতে পাওয়া যায় হিরণের রেখার সঙ্গে যোজিত লেখামালার ক্বচিৎ-কখনো দুয়েক বাক্যে। যেমন, “অদক্ষ অপটু রেখা তার নিজের মতো, বয়ে চলা অনিশ্চিত জীবনের মতো। ততটাই অনিশ্চিত থেকেছে। কোনও এক কলাসমালোচক একবার উল্লেখ করেছিলেন আমার কাজে মেরুদণ্ডহীনতার কথা। মানে এগুলোর ভিতরের শিরদাঁড়া উপলব্ধ হয় না, যা ছাড়া কোনও রচনাই রচনা নয়। এগুলো হয়তো তেমনই। মানুষ নির্মিত হয় অস্থি দিয়ে। প্রলেপিত হয় শিরা, উপশিরা, পেশিতে। তার উপরে চামড়া, তার রঙ, লোমকূপ, তারও উপরে রেখা; রেখা দিয়ে ঘেরা আকৃতি। আমার কথা এদের সঙ্গেই চলে। হঠাৎ রেখা দেখতে পাই।” কিন্তু অবলোকন মাত্রই কি অঙ্কন করে ফেলা যায়? না, আরও খড়কুটো দরকার হয়। যেমন অনুকূল পরিবেশ কিংবা আঁকার মানস ও শরীরী প্রেরণা। ব্যাপারটা হিরণ বুঝিয়েই বলছেন, সবিস্তারে, “রেখা কী করে দেখতে পাই, আর দেখতে পাই না, তা নিয়ে অনেক মজার ঘটনা আছে। তার মধ্যে একটা, সুপ্রসিদ্ধ বহু পুরস্কারপ্রাপ্ত সুধীজন, এক লেখক, একটা আসরে হঠাৎ পাশে বসে অনুরোধ করলেন একটা মুখচ্ছবি এঁকে দেওয়ার। সামনে গোল হয়ে বসেছিল অনেক তরুণ-তরুণী, সমবয়সী ছেলেমেয়ে। যেই তারা এমন কথা শুনল, হুমড়ি খেয়ে আমার কাগজ-কলমের দিকে ধেয়ে এল। অমনি রেখা গেল পালিয়ে। আমি অসহায়। ভদ্রলোক অসম্ভব আহত হয়ে রেগে অনুষ্ঠানের বাকি সময় বাইরে গাছের তলায় বসে আধো অন্ধকারে মশার কামড় খেয়ে গেলেন। হয়তো সেদিন আমাকে অমন অনুরোধ না করলে এঁকে ফেলতে পারতাম কোনো ছবি।” হিরণ মিত্রের কাগজ-কলম-পেন্সিলের মনটাকে এইভাবে আমরা খোলাসা দেখতে পাই ‘মুখ-মুখর’ বইয়ের পৃষ্ঠস্রোতে ভেসে যেতে যেতে। এই প্রাসঙ্গিক আরেকটি হিরণকথামৃত শোনা যাক, “সচেতনে যা আসে না অচেতনে তা দেখা হয়ে যায়। কাউকে হয়তো কথা বলতে বলতে অনেকক্ষণ ধরে দেখছি, দেখছি তার রেখা, সে হঠাৎ উঠে চলে গেল, রেখে গেল কয়েক টুকরো রেখা।” ভাবুন ব্যাপারটা! মানুষ চলিয়া যায় রেখে তার স্মৃতি, পাখি উড়ে উড়ে যায় ফেলে ফেলে পালকের ছায়া … এই চিরায়ত জনশ্রুতিগুলোই হিরণের অঙ্কনকৌশলের বরাতে ফের একবার মনে পড়ে যায় আমাদের। গড়ে ওঠে নতুন কথামৃত, হিরণ মিত্রের সুবাদে, দেখাদেখি শেষ হলে থাকে পড়ে এক-দুইটুকরো রেখা। “কোনো মেয়ে বা ছেলে সুন্দর শরীর নিয়ে এলিয়ে গল্প করছে, সঙ্গে বাহারি পোশাক, হঠাৎ জাদুবলে সমস্ত পোশাক অদৃশ্য হয়ে গেল, আমি টুকে রাখলাম সেই নগ্ন সৌন্দর্য। সে তেমনি রইল, জানল না কিছু। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, মানে দোষারোপ, কিন্তু যৌনতা কখন কোন ডানা মেলে, কোনটা ব্যক্তিগত, এসবের বাইরে ছবি বলেও তো কিছু আছে! পুরো শরীরটাই তো মুখ। ছবি।” কিন্তু শুধুই কি মুখ? মন নাই কুসুমের? উত্তর উড়ছে হাওয়ায়, ‘মুখ-মুখর’ জুড়ে, পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়।
এই নিবন্ধে কেবলই হিরণের পোর্ট্রেট নিয়া আলাপ সঞ্চালিত হচ্ছে। এর একটা সংগত কারণ রয়েছে। একটা না, দুইটা কারণ রয়েছে নিবন্ধের আলাপচারণ পোর্ট্রেট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখার পেছনে। এক হচ্ছে যে, এই রেখাচিত্রিত মুখাবয়বগুলোর বাইরে হিরণের অজস্র গ্রন্থালংকরণ ছাড়া ক্যানভাসের চিত্রকর্ম দেখার সুযোগ নিবন্ধকারের খুব-একটা হয়নি। নিছক কয়েকটা কাজের ইনসেট ফোটোগ্রাফ সাইজের ছাপানো পত্রিকান্তরে দেখাশোনা, তা-ও অত্যন্ত অল্প, রাজ্য চারুকলা পর্ষদের বার্ষিকীপৃষ্ঠায় ‘সাউন্ড’ সিরিজের কিছু কাজের ছোট্ট নমুনা দেখা বা উইকিতে বেশকিছু খুঁজে-পাওয়া ক্যানভাসের স্পেসিমেন্। সেগুলো খুব ইম্প্রেসিভ মনে হয়েছে এমন নয়। দেখার ত্রুটির জন্যই ইম্প্রেস্ করেনি কাজগুলো, হতেই পারে, খুবই ন্যায়সংগত কথাটা। আরেকটা কারণ নিতান্তই নিবন্ধকারের ব্যক্তিগত। ঘটনাটা হচ্ছে, একটা চালু চিন্তা আছে এমন যে ক্যানভাসে মোটা টাকার রঙ-বার্নিশ-তুলি-প্যালেট খর্চা না-করে শিল্পীর বড়ত্ব/শিল্পীত্ব প্রমাণ করা যায় না; ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি রকমের ভুল বলে মনে হয়েছে সবসময়। এই ভুলটা সবার আগে করতে দেখা যায় খোদ চিত্রীদেরেই। কিন্তু বড়ত্ব/শিল্পীত্ব প্রমাণের জন্য শিল্পীর খেরোখাতাটাই কাফি হতে পারে। এহেন নজির রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে দেখানো যায়, রামকিঙ্করের খাতার পাতায় আঁকিবুকিগুলো, কিংবা বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের লাইন-ড্রয়িংগুলো। ধরা যাক বাংলাদেশের পটুয়া কামরুল হাসান বা কাইয়ুম চৌধুরী; এই দুইজনের তেলে-জলে ক্যানভাসে আঁকাআঁকির চেয়ে একইঞ্চিও কম মর্তবার নয় তাদের পেনে-পেন্সিলে কাগজে রেখায়নগুলো। উপরন্তু, কাইয়ুম চৌধুরীকে ক্যানভাসের কাজকর্মের জন্য নয়, অজস্র অলঙ্করণগুলোর জন্যই শিল্পকলার শীর্ষজন বলে মনে হয়। কাজেই ব্যয়সাপেক্ষ মোটাগাট্টা ক্যানভাস বানিয়ে এঁকে না-গেলে মহাকালের শিল্পামোদী ভিয়্যুয়ারদের ইম্প্রেস্ করা যাবে না, ধারণাটা ডাহা ভুল। যদি বীজ থাকে ভেতরে শিল্পের, আর তা যদি দানা বাঁধে ঠিকঠাক, তাহলে সেইটা তার নিজের উপযুক্ত জমিজিরেত খুঁজে নেবেই। কিন্তু আগে থেকে ল্যান্ডপ্রোপার্টি কিনে রেখে এরপরে জমিশোভা একটা-কিছু রোপণ, চুটিয়ে ক্যানভাসে কের্দানি দেখানো, শিল্পকলার নামে হেন অনুশীলনীই ইতিহাসে বেশি। হিরণ মিত্রের মতো চিত্রীরা এইখানেই গতের অনুগত নন প্রমাণিত হয়।
কেমন আঁকেন হিরণ তার হাতের কাছের কিংবা বাড়ির পাশের আর্শিনগরের পড়শিপ্রিয় মুখগুলোকে? এর নজির পাওয়া যাবে বইবিহারের শুরু থেকেই, ‘মুখ-মুখর’ বইয়ের কথা পাড়া হচ্ছে বলা বাহুল্য, কিংবা পাওয়া যাবে ‘জারি বোবাযুদ্ধ’ পত্রিকার গত দুই দশকের পাতায় পাতায় এবং প্রচ্ছদে ও পুটে। “এই প্রকাশ লালা আর তাপসের প্ররোচনায়, আশকারায়, আবিষ্কারে এমনভাবে ঘটে গেল। প্রথমে কয়েকটি জারি বোবাযুদ্ধে প্রকাশ পায়। দিনের পর দিন, যেমন প্রজাপতিফাঁদ নিয়ে শিকারী ঘোরে তেমনি ঘুরেছি; কলমফাঁদ, তুলিফাঁদ নিয়ে।” এই কথাগুলো হিরণ বলে রেখেছেন বইয়ের প্রবেশতোরণে। এখানে যে-দুইজন ব্যক্তির ঋণ শিল্পী স্বীকার করছেন, তারা হলেন যথাক্রমে প্রচেতা ঘোষ ও তাপস ঘোষ; দোঁহে মিলে বোবাযুদ্ধ জারি রেখেছেন পঁচিশ বছর ধরে। এই পত্রিকাটায় একটু অফবিটের লেখকদের সসম্মান উপস্থিতি চিরদিন। অমিয়ভূষণ মজুমদার, দেবেশ রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুবিমল মিশ্র প্রমুখ পত্রিকাটায় নিয়মিত লিখেছেন। এইখানেই হিরণ মিত্র অদ্ভুত সমস্ত ছবি এঁকেছেন পাতার পর পাতায় পৃষ্ঠালঙ্করণের সুবাদে। এইখানেই এঁকেছেন প্রতিকৃতি বহু দেশি-বিদেশি লেখক ও সিনেমাকারের। নিজে লিখেছেন অননুকরণীয় সমস্ত গদ্য, প্রসাদগুণসম্পন্ন ও চিত্রপ্রাঞ্জল। সর্বশেষ সংখ্যাটাতেও হিরণ মিত্রের আঁকায়-লেখায় ‘জারি বোবাযুদ্ধ’ সমৃদ্ধ। তুলনা করছি না যদিও, মনে পড়ছে বলেই বলা, বাংলাদেশের ছোটকাগজগুলোর মধ্যে এক ‘দ্রষ্টব্য’ পত্রিকাপাতায় শাহীনুর রহমান নিয়মিতভাবে একই সৃজনোদ্যমে এঁকে গেছেন বহুদিন দুর্দান্ত সব চিত্রাক্ষর।
“আমি তখনও, এখনও যেমন, যেখানেই থাকি কয়েকটি আঁকার সরঞ্জাম ও কাগজপত্র জুগিয়ে রাখতাম। কখন কী রেখা ভেসে ওঠে, কখন কে ধরা পড়ে। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের নানা সংগ্রহ আজ ফিরে দেখাচ্ছে তাদের। ছবিগুলো যত দূরেই যাক, স্মৃতি সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে।” এই কথাগুলো ‘মুখ-মুখর’ বইয়ের ১৮৮ পৃষ্ঠা থেকে টোকা গেল। বইটা ‘ছাতিম বুকস্’ কর্তৃক ছাপা হয়ে বেরিয়েছে ২০১২ সনে। একটানা সাড়ে-চারশ পৃষ্ঠার বই। একপৃষ্ঠা লেখা, একপৃষ্ঠা আঁকা। পাতাগুলো বুকসাইজ্ পাতার চেয়ে প্রস্থে দ্বিগুণ। ফলে লেখা-আঁকার ঘিঞ্জি সহাবস্থান নয়, নিঃশ্বাসের-প্রশ্বাসের মুক্ত পরিসর রয়েছে বইয়ের শরীর জুড়ে বিস্তর ও অপরিমেয়। “বইটির বিষয় মুখ বা পোর্ট্রেট হলেও, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মুখ ঘিরে কথা। এ-কথা সে-কথা নয়। কথা অল্প, তিরের ফলার মতো বিঁধে আছে শরীরে। নন্দন চত্বরে ঘোরাঘুরির ফাঁকে এক নবীন চিত্রকর আমায় শুধোয়, আপনার একটা পোর্ট্রেট করব? একশ টাকা লাগবে। আমার কাজের সামান্য তাড়া ছিল, এড়াতে যাই, সে আবারো শুধোয়, আপনি কি বুঝতে পারছেন এই পোর্ট্রেট কথাটার মানে? মানে পোর্ট্রেট কাকে বলে? আমি কথা না বাড়িয়ে সামনে হাঁটা দিই। আজও ওটা বোঝা হলো না।” ফার্স্ট ফ্ল্যাপে এই স্বীকারোক্তি দিয়ে রেখেছেন হিরণ মিত্র। শুধু এইখানেই তো নয়, আস্ত বইটাই এক সমাত্মজৈবনিকতার আকর। নিজেকে এতটা আড়ালে রেখে, একেবারে নিজেরে গুটিয়ে, এত মধুরতর নিজেরই জীবনের গল্প বলে যাওয়া! টেক্নিকটা আসলেই শিক্ষণীয়। হয়তোবা যারা আঁকিয়ে, এবং যারা লিখিয়ে, এই বইভ্রমণের পরে তারা খানিক হলেও নবসৃজনী ইশারা পাবেন।
প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে প্রায় দেড়শ’ মতন; দুই-তিনজনের ক্ষেত্রে একাধিক প্রতিকৃতি গৃহীত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গল্পেরই টানে। যেমন ঋত্বিককুমার ঘটক প্রমুখ। যদিও অত্যন্ত কঠোর হস্তে নির্বাচিত হয়েছে বইটিতে ধৃত পোর্ট্রেটগুলো, নইলে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং জীবনানন্দ দাশের পোর্ট্রেটসিরিজ্ দেখেছি হিরণ এঁকেছেন পত্রিকান্তরে, মন্দ হয় নাই সার্বিক প্রেজেন্টেশন। গ্রন্থধৃত হলো না যে-পোর্ট্রেটসম্ভার হিরণের, সেগুলো নিয়ে সমানায়তনের আরেকখানা ঢাউস কলেবরের বই হবে এতে সন্দেহ নাই। কিন্তু ‘মুখ-মুখর’ বইটাতেই হিরণ মিত্রের পোর্ট্রেটকলার ম্যাজর কৌশলগুলো ধরা রয়েছে। একেবারে আবক্ষ প্রতিকৃতি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে একরেখায় লতানো প্রতিকৃতি, আপাদমস্তক প্রতিকৃতিও রয়েছে। একটি নৃত্যভঙ্গিমায় একজন নৃত্যয়িত্রী গৃহীত হয়েছে যেমন, তেমনি মঞ্চনির্দেশকের বিশেষ অঙ্গভঙ্গি দিয়েই ফুটিয়ে তোলানো ওই বিশেষ ব্যক্তিটি, গঞ্জিকায়-দম-দেয়া বাউলের বুদ্বুদভাসানো মুখ প্রভৃতি বিচিত্র প্রকারে হিরণ পোর্ট্রেটস্টাডি করেছেন। কালচারাল আইকন হিশেবে যে-মুখগুলো পরিচিত, সেগুলো দেখার এবং দেখে চেনার একটা আলাদা আহ্লাদ আছে। কিন্তু পরিচিত নয় যে-অবয়বগুলো, শিল্পীর ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ মুখগুলো, ভোক্তা সাধারণ সেইসব অবয়বের বিশেষ রেখাবলি থেকে কেমন করে ইশারা পাচ্ছে, মিলিয়ে নিচ্ছে নিজের বাস্তবের সঙ্গে সেই অচেনা আবয়বিক বাস্তব, ব্যাপারগুলো ভারি ইন্ট্রেস্টিং। হিরণ তার আঁকা দিয়ে এই ইন্ট্রেস্টের জায়গাটায় সার্ভ করেন। সংক্ষেপে একটা ব্যাপার উল্লেখ করে সেরেই এ-যাত্রা ক্ষান্ত হব প্রসঙ্গত। ঘটনাটা হচ্ছে, পোর্ট্রেট রচনায় অ্যাবস্ট্রাকশনের ব্যবহার। হিরণের অসংখ্য পোর্ট্রেটে এই জিনিশটা আমরা লক্ষ করব। সোজাসাপ্টা যার যা চেহারা, যা গোঁফ যা দাড়ি, টায়েটায়ে হিরণ কখনোই তা আঁকেন না। আঁকলে হয় বেশি আঁকেন অথবা কমিয়ে। এবং বিস্ময়করভাবে কিচ্ছুটি না-এঁকে সমস্তটাই এঁকে ফেলেন। বিপন্নতার মুখোমুখি হিরণ হামেশাই করেন তার শিল্পভোক্তাদেরে। এমনই এক বিশিষ্ট অথচ বিপন্ন ভোক্তার জবানি রেকর্ডার থেকে প্লে করা যাক এইখানে; লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের আনএডিটেড ডায়েরি প্রকাশিত হয়েছিল সন্দীপনমৃত্যুর বছর-খানেক পরে, ২০০৬/০৭ নাগাদ, ‘প্রতিভাস’ থেকে; সেই ডায়েরির একটা পাতায়, এন্ট্রির ডেইট অনুযায়ী মৃত্যুর মাত্র পক্ষকাল পূর্বে, সন্দীপন লিখছেন, “বাড়িতে ফুল সাইজ আয়না নেই। এসব অভিনেতাদের লাগে এতদিন ভেবেছি, আজ স্নানের আগে ন্যুড হয়ে নিজেকে একবার দেখতে ইচ্ছে করল। নগ্ন ইচ্ছে। বাড়িতে তেমন নগ্ন আয়না নেই ভাবছি — বের হয়ে এসে মনে পড়ল নগ্ন দেখার সেটা আছে যেটা হিরণের আঁকা লেখকের ন্যুড মলাট (অদ্রীশের সম্পাদিত বই, আমার বিষয়ে)। দেখলাম তারপর ওর আঁকা আমার পোর্ট্রেটগুলো দেখার নেশা লেগে গেল। এ ছবিতে কেবল আমি না আমার চোদ্দপুরুষ আছে। কোনো কোনো শিল্পী জন্মান যাদের জন্য মডেলরা হয়ে ওঠে। যেমন আমি। হিরণ এঁকেছে, আঁকতে, দেখতে পেরেছে বলেই আমি সন্দীপন হয়ে উঠেছি। ওগুলো কোনো লেখকের পোর্ট্রেট নয়। সাহিত্যের বাবা-মা-হারা অনাথের ঘাড় ঘোরানো — এ বয়সে আর কেউ দত্তক নেবে না। শুধু হিরণ দেখে ফেলল বলে ওরকম কিছু মুখ-ভ্যাঙচানি সমাজের জন্য রয়ে গেল। আমি বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আয়না ছাড়াই নিজেকে দেখি আর ভাবি আবার কবে দেখা হবে।” কাজেই, হিরণের পোর্ট্রেট, সন্দীপনের ভাষায়, ‘সমাজের জন্য’ রয়ে-যাওয়া ‘মুখ-ভ্যাঙচানি’, রিভিয়্যু-অ্যাক্লেইম্ হিশেবে এর চেয়ে ভালো কথা আর কি হতে পারে?
অ্যাবস্ট্রাকশনের কথাটা খানিক আগে তোলা হয়েছিল। পোর্ট্রেটে অ্যাবস্ট্রাকশন। নজির হিশেবে ‘মুখ-মুখর’ বই থেকে এন্তার প্লেটে তোলা গেলেও সম্ভবত শীর্ষের নজির একটাই, সেইটা জগদীশচন্দ্র বসুর পোর্ট্রেট। অথবা যোগেশ দত্ত। মঞ্চের আলোনির্দেশক তাপস সেনের একটা আশ্চর্য উদ্বাহু অবয়বের পোর্ট্রেট প্রসঙ্গত উল্লেখ্য। অন্যান্য সাংস্কৃতিক বিগ্রহ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে এমন কয়েকজনের ছবি এত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে এঁকেছেন হিরণ, তুলনা হয় না। আর সেগুলো দেখেই সেই বইয়ের বর্ণনায় চেনা ব্যক্তিটিকে নতুনভাবে সত্যায়িত করে ওঠা যায় যেন। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখের মুখাবয়ব এই কাতারেই পড়ে। কিংবা রামকিঙ্কর বেইজের পাথর কেটে-চেঁছে বানানো ছবি, হিরণ যদিও মুখটা ব্রাশের কয়েক টানে এঁকেছেন সহসা শাদাপাতায়। কিংবা কমলকুমার মজুমদারের রসবন্ত মুখাবয়ব কি ভোলার মতো? শঙ্খ ঘোষের স্বল্পরেখ মুখ, দেবেশ রায়, কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের মুখাকৃতি, কিংবা সুরের ঝর্ণাধারায় স্নাত শুভা মুদ্গলের মুখ অনন্য অসাধারণ বলতে একবিন্দু দ্বৈধও নাই।
হিরণের বিচিত্র মুখধারণের অভিযান শেষ হচ্ছে, এই ‘মুখ-মুখর’ গ্রন্থাধারে, একজোড়া আশ্চর্য মুখের পরপর সংস্থাপনের মধ্য দিয়ে। সেই মুখদ্বয় হিরণের যথাক্রমে জনক ও জননী। বিচিত্র মুখভঙ্গি ও অঙ্কনশৈলীর দেড়শতাধিক পোর্ট্রেটের মধ্যে এই দুই পোর্ট্রেট একদমই পৃথক। চট করে ধরা যায় না এদের পৃথকতা প্রথমেই, কিন্তু পৃথক তারা আর-দেড়শ’ থেকে। নিবন্ধকারের বিবেচনায় এই পৃথকত্ব একটা জায়গায় নির্দিষ্টভাবেই বীক্ষণযোগ্য; দুটো পোর্ট্রেটের কোনোটাতেই পরিধিরেখা নাই। হিরণ কোনো চৌহদ্দিসীমা দাগিয়া বাবা-মায়ের মুখ আঁকেন নাই। পিতামাতা হি পরমন্তপ! জনক-জননী নিঃসীম ব্যাপ্ত রহেন সন্তানাদির আবিশ্বসংসারে। এই পোর্ট্রেটদ্বয় ভোক্তাদের নয়নে এবং মনে ও মননে এই বারতাই পাঠায় প্রতিবার।
সাড়ে-চারশ পৃষ্ঠা ব্যাপ্তির বই। শেষের পাক্কা দেড়শ’ পৃষ্ঠা আত্মপ্রতিকৃতির বিভঙ্গিল বিচিত্রিতা। আর এই দীর্ঘ অটোবায়োগ্র্যাফিক্ জার্নিটা আদৌ মনোটোনাস্ নয়, ঠিক উল্টো, অর্থাৎ উপভোগ্য ও মনোরম। শুরু হচ্ছে এ-আত্মভ্রমণযাত্রা এভাবে, “যেদিন থেকে বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের ছবি দেখতে শুরু করেছি, সেদিন থেকেই দেখছি শিল্পীরা আত্মপ্রতিকৃতি আঁকছেন। আমি খুব ছোট বয়সেই ছবি আঁকায় ঢুকে পড়ি। যতটা আমার জ্ঞানে আছে, মনে হয় দু’বছর বয়সেই। আর প্রায় অকারণেই এবং স্বপ্ন-ভাবনায় নিজেকে শিল্পী ভাবতে শুরু করি। বড়রা বা বন্ধুরা নিশ্চয় হাসত, আমার তাতে ভ্রূক্ষেপ ছিল না। … তাই … নিজেকে আঁকতে শুরু করি। অনেক না হলেও বিভিন্ন বয়সে এঁকেছি। নিয়ম করে নয়, যখন মন চেয়েছে তখনই। স্নানঘরে একা থাকতে থাকতে আয়নায় নিজেকে দেখে কিছু মনে হলো। আঁকতে থাকলাম। এমনিই। মাঝরাতে অসুস্থ হয়ে নিজেকে এঁকে রাখতে মন চায়। এরই কিছু নিদর্শন রইল।” এবং এরপর থেকে একটানা দেড়শ’ পৃষ্ঠায় সেই ‘নিদর্শন’ আমরা দেখিয়া যাই। কিছু অত্যন্ত মকশো পর্যায়ের, অল্প বয়সের, কিছু উদ্দাম বল্গাহারা বাউল যৌবনের, সেল্ফন্যুড আছে যেমন, আছে নবপরিণীত শিল্পী ও তার ধর্মপত্নীর যুগল পোর্ট্রেট, এবং আছে বিভিন্ন বয়সের পরতে পরতে নিজেকে খুলে দেখার প্রয়াস। কমবেশ পঁয়তাল্লিশ বছরের তফাতে এসে সেইসব ছবিচেষ্টা আজকের জনসমক্ষে হেন মুখ-মুখরিত। সঙ্গে এক-দুই লিখনখোঁচে একেক অজানা অধ্যায়, “একটা সময় বালিকাগজে বা হাল্কা খয়েরি কাগজে কালি দিয়ে অনেক কাজ করতাম। কালি, শুকনো তুলির আঁচড়, ঘন খয়েরি রঙের টান, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কালো কালিতে চুবিয়ে রেখা, চিত্রিত নকশার মতো ছবিচর্চা চলত। আসলে গাছ, তার ডালপালা আর মানুষজন সবাইকেই রেখায় দেখতে পেতাম সেই বয়সে। অন্ধকারে বেঁকিয়ে ওঠা গাছ আর কোমর বেঁকে দাঁড়িয়ে থাকা সাঁওতাল রমণীতে পার্থক্য পেতাম না; গাছের ডালপালার মতো হাত-পা ছড়ানো। বহু বছর পরে শান্তিনিকেতনে রামকিঙ্করের ভাস্কর্য দেখতে গিয়ে তাকে পুনরাবিষ্কার করি। ছোটকালের স্মৃতি ফিরে আসে। নিজের আত্মপ্রতিকৃতি করতে গিয়েও বুঝতে গেছি মুখের উঁচু হাড়, গালের রেখা কেমন নেমে আসে বেঁকে যায়। চোখ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে।” এই-সমস্ত উদ্ভাসন ‘মুখ-মুখর’ বইয়ের বাঁকে বাঁকে দেখতে পাওয়া যায়। শিল্পীর আঁকার অভ্যাস, মোহর ও মুদ্রা, শৈল্পিক বিবর্তনেতিহাস এইভাবেই খুঁজে পাওয়া যায়। হিরণের চিত্রীস্বভাবের অন্তর্লীন কিছু সুলুকসন্ধান ‘মুখ-মুখর’ বইয়ের ছোট-ছোট স্ফটিকস্পষ্ট অনুচ্ছেদগুলো ধরে রেখেছে। এখানেই পাই হিরণের সেকাল-একাল ও স্বভাবকালের প্রবণতা সম্পর্কে নিবিড়ভাবে জানার সুযোগ। তরুণ বয়সে এক অল্পব্যায়ী নগরাবাসে দীর্ঘ জীবনযাপনের স্মৃতি হিরণ ধরেছেন এইভাবে, “ছবি আঁকতাম তখনও অজস্র। কাগজ জোগাড় করতে না পারলে খবরের কাগজ, চিনা কালি, কাঠকয়লা, প্যাস্টেল, রঙিন কালি দিয়ে নিজের বহু প্রতিকৃতি, নগ্ন বা পোশাকে। বড় একটা আয়না ব্যবহার করতাম পায়ের কাছে রেখে। … অনেক পিচ-লাগানো ক্রাফট-পেপার — বেশ মোটা মতন — ব্যবহার করতাম। বড় রোলে পাওয়া যেত। এই প্রেরণাটা এসেছিল নিখিল বিশ্বাসের কাছ থেকে। ওঁর একটা প্রদর্শনী দেখেছিলাম ওই কাগজে, আর্টিস্ট হাউসে। বিশাল বিশাল কাজ, কালো তেল রঙে করা। ঘোড়া, ষাঁড়, মানুষ, ক্লাউন — সেইসব ছবি আজ কোথায় তা জানি না। আমার প্রায় সমস্ত কাজেই ছাতা পড়ে যায়। তেলরঙে করতাম। তবুও রাখা যায়নি। আমাদের নিজেদের প্রমাণ করতে করতে প্রৌঢ়তা চলে আসে, ক্ষমতা চলে যায়। চোখের দৃষ্টি কমে যায়। যখন আয়োজন হয় রঙ তুলি ক্যানভাসের, তখন তার ব্যবহার করার আর শক্তি থাকে না।” আশ্চর্য সত্যোচ্চারণ নয় শেষের কথাগুলো? সকলের জন্য সমানভাবে সত্য নয়? নিশ্চয়, তা-ই তো মনে হয়। এমনই একটা কথা বলেছিলেন উস্তাদ আলি আকবর খাঁ, রাগরাগিণী সমুদয় আয়ত্ত করার ব্যাপারে এক প্রশ্নের উত্তরে, একটা সাক্ষাৎকারে। বলেছিলেন, স্বর জানলে সংগীত জানা যায়। আমাদের সাতটা স্বর আছে, একেকটা স্বর আয়ত্তে আনতে ১২ বছর সময় লাগে। তাহলে সাতটা স্বর ঠিকমতো বুঝতে বুঝতে তো জীবন কেটে যাবে। আর বুঝলেও কি শরীরে জোর থাকবে তখন! [সূত্র / গানের হৃদয়, জয় গোস্বামী, প্রতিভাস ২০১২, পৃষ্ঠা ৭৩] দুশ্চিন্তার কিছু নাই, হিরণ প্রোক্ত প্রসঙ্গের অনুচ্ছেদান্তে বলছেন, “তবে আজও ক্ষমতা ও সামর্থ্য দুটোই বর্তমান, সমস্ত জগৎটাকেই ফিরে দেখবার চেষ্টায় আমি ব্রতী; …” কাজেই, হিরণ্ময় বিভা আমাদের আরও অনেক দেখা বাকি। নিবন্ধের নটেশাক হয়তো অচিরে জেবে মুড়িয়ে নিতে হবে।
এই বছর-দুই আগে, ২০১৪ জানুয়ারিতে, ‘জারি বোবাযুদ্ধ’ বইমেলা সংখ্যায় হিরণ মিত্রের কলমে-তুলিতে লেখায়-রেখায় ট্র্যাভেল্যগ্ ‘অন্তরালে বেনারস’ প্রকাশের পাশাপাশি কিছু সম্পাদকীয় মন্তব্য করা হয়েছে, যেখানে হিরণ মিত্র সম্পর্কে একটা সামান্য অথচ শ্রদ্ধাপূর্ণ অবলোকন/বিবেচন পাওয়া যায়। সেখান থেকে একটা ছোট্ট অবলোকন এইখানে সেঁটে নেয়া যাক, “সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গে মাইনোরিটি কালচারের চর্চা নিয়ে সেরকম কোনো সমৃদ্ধ আলোচনা হয়নি। হলে হিরণ মিত্রকে তাঁর সামগ্রিকতায় জানার একটা সুযোগ হতো আমাদের। হিরণদা একজন বড় শিল্পী — দেশে-বিদেশে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়, ‘হারবার্ট’ চলচ্চিত্রের শিল্পনির্দেশনা তাঁর … নাটকে স্বনামে তাঁর প্রথম মঞ্চস্থাপত্য চেতনা-র ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত্’-এ। অবিলম্বে তিনি হয়ে দাঁড়ালেন বাংলা থিয়েটারের মঞ্চশিল্পী হিশেবে খালেদ চৌধুরী-পরবর্তী উল্লেখযোগ্য নাম। … তিনি অংশ নিয়েছেন ইনস্টলেশন আর্টের প্রদর্শনীতে — গানের সঙ্গে ছবি আঁকায়। কিন্তু কোন টানে মাইনোরিটি কালচারের এবম্বিধ বহুমুখী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন হিরণ? এই প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার জন্যই যেন একটি নিজস্ব মাধ্যম তৈরি করে নিতে হয় হিরণদাকে যেখানে গানের সুরের মতো তাঁর আঁকা ছবি সম্পূর্ণতা দিতে থাকে গানের লিরিক্স তথা তাঁর লেখা গদ্যকে। কখনো-বা তাঁর গদ্য ফ্রেমের মতো পরিসীমা দেয় তাঁর ছবিকে। তাঁর এই জঁর-এর শিল্পকর্মগুলিকে অন্য অভিধার অভাবে আমরা আঁকি-বুকি বলে ছাপি। … একেকটা টার্ম বা শব্দবন্ধ একেকজন শিল্পীর ভুবনে প্রবেশে সহায়তা করে — হিরণদার ক্ষেত্রে সেটি হলো ‘অনিশ্চিত’। এত বছর ধরে এবং এতগুলি মাধ্যমে কাজ করার পরেও হিরণদা নিজেকে অনিশ্চিত রাখতে পেরেছেন। সংখ্যালঘু সংস্কৃতি অমোঘ পরিণতি বা অনুমিত পরিণতিকে প্রত্যাখ্যান করে। যার পরিণতি আঁচ করা যাচ্ছে না, মাইনোরিটি কালচারের প্রশ্রয় সেই অনিশ্চয়তায়। হিরণদা তাই আমাদের লোক।” কথাগুলো বলা হয়েছে সেই পত্রিকায়, যেই পত্রিকাটি বিজ্ঞাপনবিহীন ছাপা হয় একটিমাত্র স্লোগ্যান্ নিয়ে — ‘পণ্যসাহিত্য বিরোধিতার অন্যতম কাগজ’ — এবং যেই পত্রিকার সঙ্গে একটানা দুইদশকের গাঁটছড়া হিরণ মিত্রের। কাজেই, ঠিক ফেলনা তো নয় বিবেচনাবাক্যগুলো, কেউ অবশ্য মনেও করতে পারে ফেলনা; তা পারে বৈকি, নিশ্চয় পারে, বিধ্বংসী বিচিত্র রগড়ে ভেসে যায় আমাদের দিনগত নভোনৌকোগুলো! ভবসিন্ধু ভয়ানক উতরোল ভাবলে উতরোল, প্রশান্ত ভাবলে প্রশান্ত, কালস্রোতে ভেসে যাক ধন-মান-যৌবন তথা শাজাহান স্বয়ং।
যশের তোয়াক্কা না-করে এঁকে গেলেন, যাচ্ছেন আজও, যশও কম নয় তাই বলে। মেধার মণ্ডলে, শিল্পের সরহদ্দিতে, যশ তাঁর। জীবদ্দশাতেই। অবাক হতে হয় তাঁর দম দেখে, শিল্পলিপ্ততার দম, বল্গা না-হারানোর তাকত্। অনুক্ষণ কায়মনবাক্যে চাই হিরণ্ময় বিভায় বিম্বিত হোক আমাদের এই চিরপ্রণম্য পৃথিবী। হিরণের আঁকার হাতটা যদি পেতাম! দ্যাটস্ অল্ ফ্রম্ মি, এইযাত্রা আপাতত, বিদায়!
বি.দ্র. / রচনাটা ড্রাফটকালীন মূলত ‘মুখ-মুখর’ বইটা সাহায্যে লেগেছে বেশি। বইটার প্রকাশক ছাতিম বুকস্, ২০১২ জানুয়ারিতে এইটা পার্ক স্ট্রিট কলকাতা থেকে বেরিয়েছে, এর প্রচ্ছদ ও গ্রন্থসজ্জা খোদ গ্রন্থকার তথা হিরণ মিত্রের, ইন্ডিয়ান টাকায় হাদিয়া পাঁচশ পঞ্চাশ অর্থাৎ বাংলাদেশে এগারোশ’ টাকা মেরেকেটে। এই নিবন্ধের প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য বইটা আলফ্রেড আমিন, কবি ও নিবন্ধকারের বন্ধু, অনেক লম্বা কালের কড়ারে পরহস্তে রেখে দেবার সম্মতি দিয়েছেন; এই সুযোগে দেনা-অনাদায়ী-হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা আমিন সমীপেষু। অন্যান্য গুটিকয় কিতাবাদি যা-ই ঋণের আওতায় পড়ে, সেসবের নাম যথাস্থানে দেগে আসা হয়েছে নিবন্ধগতরে। এটুকুই নিবেদন।