আমরা কি এই কানাগলি থেকে বেরোতে পারবো । ইরফানুর রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ এপ্রিল ২০১৬, ৯:৪৭ পূর্বাহ্ণ, | ১৮৭১ বার পঠিত
১/১১ আর বিডিআর বিদ্রোহের অভিজ্ঞতায়, আওয়ামি লিগ খুবই কর্পোরেটবান্ধব ও মিলিটারিবান্ধবে পরিণত হয়েছে। ২০১৪ থেকে সে হেফাজতে ইসলামফ্রেন্ডলিও হয়ে উঠেছে, আর, উলেমা লিগ তো উলেমা লিগ। অর্থাৎ সে ক্ষমতা সামলাচ্ছে ক্যান্টনমেন্ট আর কর্পোরেশনকে অবাধ লুটপাটের লাইসেন্স/শেয়ার দিয়ে, আর, জনতা সামলাচ্ছে ধর্মের ষাঁড় দিয়ে। তার বি টিম সি টিমও একটিভ আছে। আর্ট এন্ড কালচার সামলাচ্ছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। পাকা বামদের সামলাচ্ছে জাসদ আর ওয়ার্কার্স পার্টি। আওয়ামি লিগ আশির দশকের বিএনপি/জাপায় পরিণত হয়েছে, যেখানে বাম থেকে ডান সবার স্থান হয়, ইতিহাসের পরিহাস সম্ভবত।
এমতাবস্থায় আমার মনে হয় না ১/১১-জাতীয় আরেকটা সিভিল-মিলিটারি-কর্পোরেট শাসন জনগণের সামনে অপেক্ষা করছে।
কিন্তু কথা আছে।
জামাতকে আমরা ঘৃণা করি, বটেই, কিন্তু শত্রুকেও আন্ডারএস্টিমেট করাটা পলিটিকসের ক্ষেত্রে ভীষণ বিপজ্জনক। এতো বছর পরে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় হচ্ছে এটা ভালো, কিন্তু বাংলাদেশে গত চল্লিশ বছরে যে আর্থনীতিক ভিত্তি জামাত তৈরি করেছে এবং তার যে বৈশ্বিক যোগাযোগ আছে সেটাকে ছোট করে দ্যাখাটাও ভুল হবে। বিএনপি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু জামাতকে আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিকভাবে যতোটা কোনঠাসাই মনে হোক, এই দশাকে সাময়িকের চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারছি না।
ফাঁসির রায়ের পরে জামাত একটা হরতাল ডাকে। মাঠে নামে না। এটা তো একটা রাজনৈতিক রণকৌশলও হতে পারে। জামাতের রাজনীতি প্রতিক্রিয়াশীল, কিন্তু শত্রু হিসেবেও তাদের একটা গুণ স্বীকার করতেই হবে, আওয়ামি লিগ বিএনপির মতো কোনো পরিবার জামাতি রাজনীতি তৈরি করে নাই। তাই এই নিওলিবারালকালে সাম্রাজ্যবাদীরা যেই ধরনের লিবারাল ডেমোক্রেসি আশা করে তাদের এইসব নয়াকলোনিতে, আওয়ামি লিগ বিএনপির তুলনায়, জামাত তার বেটার ক্যান্ডিডেট। তুরস্কের জীবিত লেখকদের মধ্যে ওরহান পামুকই বিখ্যাততম, তাঁর স্নো উপন্যাসটা পড়েন প্লিজ, তুরস্কের জায়গায় জাক্সটাপজিট করে বাংলাদেশকে রেখে চিন্তা করেন আর জাস্টিস এন্ড ডেভলাপমেন্ট পার্টির জায়গায় জামাতকে। তাহলে তাত্ত্বিক অনেককিছু সাহিত্যের মাধ্যমে সহজভাবে বুঝবেন, সাহিত্যের এই একটা গুণ অনস্বীকার্য, তা অনেককিছুকেই সহজবোধ্য করে তোলে।
৯৭১এর স্মৃতি যতোদিন এই দেশের অধিকাংশ মানুষের হৃদয়ে জাগরুক থাকবে ততোদিন এককভাবে জামাতের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু জামাত তো এককভাবে চেষ্টা করবে না। বিগত ৪০ বছর সে ঘাস খায় নাই। ওদের ব্যাংক-বীমা আছে, হাসপাতাল আছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। ওদের সংবাদপত্র আছে, কিশোরপত্রিকা আছে, নিউজমিডিয়া আছে। এবং সামরিক বেসামরিক প্রশাসনে ওদের লোক আছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার এসবকে নাই করে দেয় নাই।
ধরেন কালকে সরকার জামাতকে ব্যান করে দিলো। ওরা কি করবে? নতুন নামে নিবন্ধন করে ওরা মাঠে নামবে। ধরেন ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি (আইডিপি) নামে নামলো। যুদ্ধাপরাধের কারণে জামাতকে ব্যান করে দেয়া সম্ভব। কিন্তু আইডিপিকে আপনি কোন গ্রাউণ্ডে ব্যান করবেন? আইডিপি তো ১৯৭১এ যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল না!
নতুন নামে মাঠে নামা কোনো ব্যাপারই না। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত ওদের যেই পার্টি ও গণসংগঠন আছে, জাস্ট নাম বদলে নিলেই হয়ে যাবে, লোকগুলোকে তো আর বদলে নিতে হবে না। অর্থাৎ, সেই পুরনো মদই আসবে, নতুন বোতলে।
একটা বিষয় চিন্তা করেন, জামাত শুরুতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জান দিয়ে চেষ্টা করেছে, কিন্তু অনেকদিন ধরেই আমরা দেখতে পাচ্ছি ওরা যেনো এই বিচারকে বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে। তাই হরতাল ডেকে ওরা মাঠে নামে না। কিন্তু এখানে আরেকটা বিষয়ও কাজ করতে পারে। জামাত আওয়ামি লিগ বিএনপির মতো পরিবারতান্ত্রিক না। যুদ্ধাপরাধী নেতা সবগুলারও যদি ফাঁসি হয়ে যায়, ‘৭১এর পরে জন্মানো ওদের যেই নেতৃত্ব, তারা ফ্রন্টলাইনে চলে আসবে। বিএনপির ক্ষেত্রে এটা অসম্ভব, কারণ কালকে খালেদা জিয়া আর তারেক জিয়া দুজনই কোনো কারণে একসাথে এক্সপায়ার করলে, ছয় মাসের মধ্যে বিএনপি ভেঙে পড়বে। কিন্তু জামাতের ক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্ব তৈরি আছে, অনেকদিন ধরেই যাদেরকে তৈরি করা হয়েছে, সম্ভাব্য সকল পরিস্থিতির জন্য।
আরেকটা সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর পলিটিকাল সাইকোলজি আমি কিছুটা বুঝি। বিশেষত আওয়ামি লিগের। এরা আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা মাথায় অগ্রসর হয়, ষাট বছরের বিপুল রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কারণেই। ২০১৪র নির্বাচন প্রহসন ছিলো সেটা সবাই জানে। কিন্তু এই প্রহসনের বীজ আওয়ামি লিগ বপন করেছিলো ২০১১তে, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। আওয়ামি লিগ খুব ভালো করে জানে যেভাবে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে তাতে ২০১৯ পর্যন্ত সে নির্বাচনহীনভাবে অগ্রসর হতে পারবে না, তাই, সিসি ইলেকশন থেকে ইউপি ইলেকশন করে সে দ্রুত একটা ন্যাশনাল ইলেকশনের প্রিপারেশন নিচ্ছে। কিন্তু বিএনপির মেরুদণ্ড পুরোপুরি ভেঙে দেয়ার পর তার তো লোকদ্যাখাতে হলেও একটা অপোজিশন লাগবে, ২০১৪কে বারবার রিপিট করা তো, সম্ভব না!
জাপা পোষা অপোজিশন হিসেবে কোনো কাজেরই না। সেইক্ষেত্রে সামনে আমরা কিছু ঘটনা দেখতে পাবো। ঘটনাগুলো সম্ভবত এভাবে ঘটবেঃ
বামপন্থী কয়েকটি দল একটা ইলেকটোরাল এলায়ান্স করবে। জামাত নিষিদ্ধ হলে আইডিপি আকারে হাজির হবে। আওয়ামি লিগের কাছ থেকে প্রচুর সুবিধা পাওয়ার পরও যেসব কর্পোরেশন আর ক্যান্টনমেন্টের যেসব কর্তার আওয়ামি লিগের প্রতি প্রেম তৈরি হয় নাই তাঁর সিভিল সোসাইটির কিছু ফ্যাকশনের সাথে মিলে একটা পার্টি ফর্ম করতে পারে।
অথবা তারা ইতোমধ্যেই অস্বিত্বশীল আওয়ামি লিগের বাইরে থাকা কোনো পার্টি বা গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হয়ে যেতে পারে।
সেই ইলেকশনে আবার আওয়ামি লিগ জিততে পারে। নাও জিততে পারে। ইলেকশনকে কেন্দ্র করে একটা ঝড় উঠতে পারে।
এই ধরনের ঝড়ে বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসে না। এমনকি সিভিল-মিলিটারি-কর্পোরেটরাও না। ক্ষমতায় আসে ইসলামিস্টরা। আইএস না, ইরাক-লিবিয়া-সিরিয়া মডেল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিছু ঐতিহাসিক-সামাজিক কারণে কাজ করবে না, এখানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রথম পছন্দ হবে মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো “গণতান্ত্রিক” ইসলামিস্টরা। ইরানের মতো একটা সিচুয়েশন তৈরি হতে পারে। বা মিশরের মতো। আর তেমন ইসলামিস্ট এই দেশে একটাই আছে, জামাত, নতুন নাম আইডিপি নিয়ে আসলেও।
আমরা খুব ভয়াবহ একটা সিচুয়েশনে দাঁড়িয়ে আছি। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানেও অন্ধকার, আবার, যেই ভবিষ্যৎ আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে সেখানেও অন্ধকার। তবু আমি একজন অসংশোধনীয়রূপে আশাবাদী মানুষ হওয়ায় এই পরিস্থিতিতেও হতাশ হতে চাচ্ছি না। জনগণের ভেতরে কিছু ইতিবাচক শক্তি আসলেই আছে। এটা তৈরি হচ্ছে সুন্দরবন ধবংসের বিরুদ্ধে, চুনারুঘাটে চা-শ্রমিকদের ধান্য জমি দখল করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে, অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে, ধর্ষক-নিপীড়কের বিরুদ্ধে কিন্তু কোনো পলিটিকাল প্ল্যাটফর্ম না পাওয়া মানুষজনের মধ্যে। এরা ছড়িয়েছিটিয়ে আছেন, মূলত জাতীয় কমিটির আন্দোলনেই এরা সবচেয়ে বেশি, বিশেষত যারা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। লিবারাল সেন্সে না, গণতান্ত্রিক শব্দটা যদি ব্যবহার করি এথেনিয়ান সেন্সে, তাহলে এই মুহূর্তে দেশে আসলেই গণতন্ত্র দরকার। কিন্তু সেটা ওপর থেকে নাজিল হবে না। নিওকলোনিতে ওপর থেকে ন্যাটোর বোমা নাজিল হয়। অথবা চুক্তি-প্রকল্পের দলিল। সেটা লড়াকুদেরকে নিচ থেকে গড়ে তুলতে হবে। এবং আমার মনে হচ্ছে আমরা সেটা পারবো। জনগণের শুভবুদ্ধির ওপর আমার অপরিসীম আস্থা আছে, আমরা হারবো না, হারতে হারতে শেষ পর্যন্ত ঠিকই জিতে যাবো!