মার্কসবাদ এবং নারী । ইরফানুর রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জানুয়ারি ২০১৪, ৫:২৩ পূর্বাহ্ণ, | ২৮২৭ বার পঠিত
১
কারখানায় পণ্য উৎপাদনে প্রধান ভূমিকা আসলে কার? শ্রমিকের।
কারখানার এবং পণ্যের মালিকানা হাতে থাকে কার? পুঁজিপতির।
জমিতে ফসল উৎপাদনে প্রধান ভূমিকা আসলে কার? কৃষকের।
জমির এবং ফসলের মালিকানা হাতে থাকে কার? ভূস্বামীর।
সংসারে সন্তান উৎপাদনে প্রধান ভূমিকা থাকে কার? নারীর।
সংসার এবং সন্তানের মালিকানা (বিয়ে এবং পিতৃপরিচয়) হাতে থাকে কার? পুরুষের।
পুঁজি মানে কিন্তু ‘বিনিয়োজিত অর্থ’ না আসলে, পুঁজি একটা সম্পর্ক, যে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে একদল মানুষ শ্রমিক এবং আরেকদল মানুষ মালিক হয়ে ওঠে। এবং মালিককে যে ‘পুঁজিপতি’ বলা হয়ে থাকে, এতে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় ‘পতি’ শব্দটা দখলদারিত্ব-মালিকানার সাথে সম্পর্কিত, পুঁজি নামক সম্পর্কে যে পতির অবস্থানে থাকে। আবার জমির দখলদার-মালিককে যে ‘ভূস্বামী’ বলা হয়, এর অর্থটাও সোজা, ভূমি/জমিকে নারী আর ভূমির/জমির দখলদার-মালিককে পুরুষ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই ভূমির/জমির দখলদার-মালিককে ‘ভূস্বামী’ করে তুলেছে।
উল্লিখিত তুলনা থেকে এটাই জলের মতো পরিষ্কার, পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় শ্রমিক-কৃষক-নারী শোষিতের অবস্থানে থাকে, পুঁজিপতি-ভূমিমালিক-পুরুষ থাকে শোষকের অবস্থানে।
অবশ্যই বিশ্ব পুঁজিবাদের বয়স মাত্র পাঁচশ বছর, এবং এর মেলা আগে থেকেই এই শোষণমূলক সম্পর্কসমূহের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে, পিতৃতন্ত্রের একেবারে সূচনা থেকেই সৃষ্ট এইসব সম্পর্ক। কিন্তু পুঁজিবাদ বিশ্ব ব্যবস্থা হয়ে উঠে এই সম্পর্কসমূহ আরো জোরদার করেছে। আবার, দ্বান্দ্বিকভাবেই, এই শোষণমূলক সম্পর্কসমূহের বিরুদ্ধে (পুঁজিপতি, ভূস্বামী, এবং পুরুষের বিরুদ্ধে ‘ব্যক্তিগতভাবে’ নয়) বিবেকবান এবং ‘দূরদৃষ্টিসম্পন্ন’ নারী-পুরুষের বিভিন্ন মাত্রায় সংগঠিত লড়াই বিশ্ব পুঁজিবাদকে এর পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
কমিউনিস্টরা কারখানা, জমি বা সংসার ‘নেই’ করে দিতে চায় না, পণ্য-ফসল-সন্তান উৎপাদন ‘নেই’ করে দিতেও চায় না, তাঁরা চায় কারখানা-জমি-সংসারের ওপর থেকে পুঁজিপতি-ভূস্বামী-পুরুষের দখলদারিত্ব-মালিকানা যেটা শ্রমিক-কৃষক-নারীকে শোষণ করার ব্যাসিসে টিকে আছে সেটার উচ্ছেদ ঘটাতে। কারখানা-জমি-সংসারের ও পণ্য-ফসল-সন্তানের ওপর সব মানুষের সাধারণ মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে। কারণ সাধারণ মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার মানেই হচ্ছে মালিকানারই অবসান ঘটানো, যেমন বাতাসের ওপর সব মানুষের সাধারণ মালিকানা আছে বলেই কেউ নিজেকে বাতাসের মালিক দাবি করে না, কিন্তু তাঁর অর্থ নিশ্চয়ই এই না যে বাতাসের মালিক না থাকার কারণে মানুষের নিঃশ্বাস নেওয়া আটকে আছে!
২
নারীর সংকট শুধুমাত্র মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যাবে না। পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় সব শ্রেণীর নারীই নিজ এবং অন্য শ্রেণীর পুরুষদের দ্বারা বিভিন্ন ধরণের শোষণ-নিপীড়ণ-নির্যাতনের ভিকটিম হন। এর কারণ হচ্ছে, নারীকে বন্দী করার পিতৃতন্ত্র বিকশিত হয়েছে প্রায় আট দশ হাজার বছর ধরে, পুঁজিবাদ তো সেদিনের।
এমনকি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের মতো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে, যদিও নারী নির্যাতনের মাত্রা সমসাময়িক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের তুলনায় বেশ কম ছিলো, তবুও সেখানে ‘সাংস্কৃতিকভাবে’ পিতৃতান্ত্রিক বিধি-বিশ্বাস ব্যাপকভাবেই টিকে ছিলো। কাগজে-কলমে নারী-পুরুষের সমান মানবিক মর্যাদা স্বীকার করে নিলেও বাস্তবে যে নারীরা বহু ক্ষেত্রে বঞ্চিত ছিলেন- তার ভালো বর্ণনা পাওয়া যাবে কেইট মিলেটের সেক্সুয়াল পলিটিকস বইটায়। এর কারণ পিতৃতন্ত্রের তুলনায় অপেক্ষাকৃত নবীন পুঁজিবাদকে, ‘রাজনৈতিকভাবে’ পরাজিত করা তুলনামূলকভাবে সহজ হলেও, এর সাংস্কৃতিক মতাদর্শকে-যা পিতৃতন্ত্রের ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক মতাদর্শকে ধরে রেখেছে-পরাজিত করা অনেক কঠিন।
আবার নব্বইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘পতন’ এবং আশির দশক থেকেই চীনের পুঁজিবাদের পথে ফেরত যাওয়ার সম সময়ই যে নিও লিবারেল আইডোলজি পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার নয়া লেবাসে পরিণত হয়েছে, নারীকে বিভ্রান্ত করার জন্য তার বর্তমান প্রয়াস হচ্ছে ‘এনজিও নারীবাদ’, যা মানুষের ওপর মানুষের সব ধরণের শোষণ-নিপীড়ণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করা নারীবাদের এক চরম বিকৃত রূপ। এই ‘এনজিও নারীবাদ’ এমন একটা ধারণা তৈরি করে, যেনো উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর নারীরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেলেই ও চাকুরিতে পুরুষদের সমান বেতন পেলেই নারী পুরুষের সমান মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে, শ্রমিকশ্রেণীর নারীদের ওপর-এবং উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর নারীদের ওপরও- যে অজস্র পিতৃতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী শোষণ-নিপীড়ণ-নির্যাতন কায়েম থাকে এটা আড়াল করার জন্যই আসলে পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার এজেন্ট হিসেবে কাজ করে এই ‘এনজিও নারীবাদ।’ অবশ্য এনজিও জিনিশটাই তো তৈরি করা হয়েছে দান-সদকার মাধ্যমে মেহনতি মানুষের শোষিত হওয়ার আসল কারণ যে পুঁজিবাদ, তা থেকে তাঁদের দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়ার জন্য, পুঁজিবাদকে একটা ‘মানবিক’ মুখোশ পরিয়ে টিকিয়ে রাখার জন্য। তাই, ‘এনজিও নারীবাদ’-ও যে নারীকে বিভ্রান্ত করবে পুঁজিবাদের স্বার্থে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। রেসিজমের সবচেয়ে বড়ো ভিকটিম এই দুনিয়াতে নারীরাই, আবার, এটা সেই ‘এনজিও নারীবাদের’ কৃপা যে আমরা বিভিন্ন হোয়াইটেনিং ক্রিমের কোম্পানিকে ‘নারী দিবস’ পালন করতে দেখি। অথচ, সত্যিকারের নারীবাদ সেই শুরু থেকেই এন্টি-রেসিস্ট, হোয়াইটেনিং ক্রিমের সাথে নারীর মুক্তির সম্পর্ক নেই। এই ‘এনজিও নারীবাদের’ ভণ্ডামি থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
৩
ধর্ষণ-যৌন নিপীড়ণই সম্ভবত মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের জঘন্যতম অন্যায়। কিন্তু ধর্ষণ-যৌন নিপীড়ণের জন্য কি ধর্ষক-যৌন নিপীড়করা ‘ব্যক্তিগতভাবে’ দায়ী? না।
ধর্ষণ-যৌন নিপীড়ণ পিতৃতান্ত্রিক পুঁজিবাদী মতাদর্শের সবচেয়ে হিংস্র প্রকাশ। পিতৃতন্ত্র পুঁজিবাদ নারীকে ঐতিহাসিককে ‘অন্য’ করে তুলেছে। ধর্ষণ-যৌন নিপীড়ণ নিঃসন্দেহে যৌনঅপরাধ, কিন্তু ধর্ষণ-যৌন নিপীড়ণের জন্য পুরুষের যৌনআকাঙ্খা অপরাধী না, ‘যৌন লালসা’ মেটাতে কেউ ধর্ষণ করে না। নারী পুরুষ সব মানুষেরই যৌন লালসা থাকে, মানুষ মূলত সেই লালসা ভালবাসার মাধ্যমে মেটায়, কারণ সেটাই মানবিক। ধর্ষণ-যৌন নিপীড়ণের কারণ নিয়ে এ-যাবৎ যতো রিসার্চ হয়েছে, অধিকাংশই এটা দেখিয়েছে, ধর্ষক-যৌন নিপীড়করা ধর্ষিতা-নিপীড়িতাকে কোনো-না-কোনো কারণে ঘৃণা করতো বলেই ধর্ষণ-যৌন নিপীড়ণ করেছে। এটা জরুরী না যে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়ণ করার আগ প্রকাশ্যে সেই ঘৃণার প্রকাশ ঘটাবে ধর্ষক বা যৌন নিপীড়ক। এরকম বহুত ঘটনা আছে যেখানে ধর্ষক-যৌন নিপীড়ক ভিকটিমের সাথে অমানবিক অপরাধটি করার আগে ভিকটিমের সাথে ‘বন্ধুত্বমূলক’ সম্পর্কে থাকার অভিনয় করে। এতে তার অপরাধটি করতে বেশ সুবিধা হয়।
‘চুপ’ থাকাটা, ধর্ষণ-যৌন নিপীড়ণের সমাধান না, সহায়ক। নারী যতো বেশি সমাজ-পরিবারের ভয়ে ‘চুপ’ থাকবেন, ধর্ষক-যৌন নিপীড়ক ততো বেশি উৎসাহিত হবে তাদের হিংস্রতায়। আবার ‘পুরুষ মাত্রই খারাপ’ বা ‘মেয়েদের জন্য ছেলেদের সাথে মেশা ঠিক না’, এই ধরণের শস্তা কথাবার্তার একটা বিপদ আছে, আপাতদৃষ্টিতে এসব কথাকে নারীবান্ধব মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব কথাবার্তা পুরুষকে ‘ব্যক্তিগতভাবে’ ডেমোনাইজ করে পিতৃতন্ত্র-পুঁজিবাদকে আড়াল করতে চায় এবং এভাবে শেষাবধি নারীর সাথেই শত্রুতা করে। পুরুষ বা নারী হওয়ায় হাত নেই আমাদের, জৈবিক পুরুষত্বের সাথেও নারীর কোনো শত্রুতা নাই, শত্রুতা আছে সেই ব্যবস্থার সাথে যা পুরুষকে অমানুষ আর নারীকে কামসামগ্রীতে পরিণত করে। আর সেই ব্যবস্থার সাথে পুরুষেরও শত্রুতা থাকা উচিত। অন্তত সেইসব পুরুষের, যারা শুধুমাত্র পুরুষ হয়ে থাকতে চান না, যারা মানুষ হিসেবে নিজেদের বিকশিত করতে চান। মার্কসবাদ নারী ও পুরুষের শোষণমুক্তির লড়াইয়ে অনেকটাই আলো দেখাতে পারে। তবে তার জন্য মার্কসবাদের সৃষ্টিশীল সম্প্রসারণ জরুরী, বাস্তব লড়াইয়ের সাথে সংযোগ যাতে অবিচ্ছিন্ন থাকে, নইলে মানুষের সাথে হৃদয়গত সম্পর্ক তৈরি করার আকাঙ্খাটা আকাঙ্খাই থেকে যাবে!