চিরহরিৎ চিৎকারের গ্র্যাম্যাটোলোজি । জাহেদ আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ মার্চ ২০১৬, ১২:৪৮ পূর্বাহ্ণ, | ১২২৪৬ বার পঠিত
‘দি টেম্পেস্ট’ নামে একটা ড্রামা আছে স্ট্র্যাটফোর্ড-আপঅন্-অ্যাভন্ অঞ্চলের পালাকার শেইক্সপিয়্যরের, লোকমুখে শোনা, ড্রামাটা ভারি মনোহর। স্মরণীয় সেই যাত্রাপালায় আছে একটা ক্যারেক্টার, নাম তার ক্যালিব্যান্; অবাধ্য-অবিনীত ও দুর্মুখ এই বিদ্রোহী ভৃত্য ক্যালিব্যান্ ছাড়াও রয়েছে অ্যারিয়েল্ নামের এক অনুগত ও সুবোধ-সুশীল-সুভদ্র মনিববান্ধব নফর গোলাম, রয়েছেন উভয় ভৃত্যের অভিন্ন প্রভু প্রস্পেরো এবং মহানুভব্য মনিবতনয়া লাস্য-লকলকানো মধুভাষ-ঝরানো তন্বী মির্যান্ডা। আমাদের আগ্রহকেন্দ্রে, এই আখ্যায়িকায়, ক্যালিব্যান্ হলেও অন্যদের সংক্ষিপ্ত পরিমাপজোখ লইব প্রসঙ্গত। উল্লেখ্য যে এই ডিসক্লেইমারের অব্যাবহিত পরেই প্রিমিয়ার হতে যাচ্ছে যে-চলাখ্যানচিত্তিরের, ক্যালিব্যান্ সেইখানে এসেনশিয়্যালিই হিরোর রোলে কাস্ট হয়েছে দেখতে পাবো। যদিও উইলিয়্যম্ শেইক্সপিয়্যরের পালাখ্যানভাগে ক্যালিব্যান্ সর্ববিচারে অ্যান্ট্যাগ্যনিস্ট ভূমিকায় পার্টরত। প্রসঙ্গত উল্লেখ কর্তব্য, অমিয়ভূষণ মজুমদার ‘সাতিশয় হারামজাদা’ শব্দজোড়াবদ্ধ দুর্ধর্ষ অভিব্যক্তিটা আমাদেরে এরই মধ্যে হ্যান্ডওভার করে ফেলেছেন, ক্যালিব্যানের সঙ্গে করমর্দনের আগেই, বলা বাহুল্য বকুনিটা সাধু খাঁ বা মধু খাঁ বা আরও অনেকের জন্য প্রযোজ্য হলেও মহাত্যাঁদড় ক্যালিব্যানের জন্য কোনোভাবেই নয়। নিরুল্লেখ্য দুঃখের মধ্যে এ-ই যে উইলিয়্যম্ শেইক্সপিয়্যর ও অমিয়ভূষণ মজুমদার উভয়েই বিদেহী ইদানীং।
অধর্ম হবে যদি নির্বিকারচিত্তে চেপে যাই যে ক্যালিব্যানকে প্রোট্যাগ্যনিস্ট বানিয়ে হাজির করার কৃতিত্ব এই আখ্যায়িকারই প্রথম নয়, এর আগেও যুগে-যুগে ক্যালিব্যান্ পূজ্য প্রধান চরিত্র হয়েছে বিস্তর জায়গায়, অ্যাইমে সেজ্যায়্যার কৃত কালো ক্যালিব্যানের কথা আমাদের মনে পড়বে নিশ্চয়। এখন, প্রশ্ন, অত্র আখ্যানে ক্যালিব্যানকীর্তন দরকার হচ্ছে কেন? উত্তর ক্রমশ প্রকাশ্য। সহজ ও সংক্ষিপ্ত উত্তর হয়তো করা যায় এইভাবে যে, রেগ্যুলার না-হোক কালেভদ্রে আপনার যদি মিউজিকফিউজিক্ শোনার বদহ্যাবিট থাকে তবে জানবেন যে ক্যালিব্যানের ভাষারাজ্যের বাসিন্দা আপনি, ঠিক আছে? জ্যাজ্ শোনেন আপনি, ব্লুজ্ শোনেন, রক্ শোনেন বা ফোক্, এইগুলা আসলে ক্যালিব্যানের রাগরক্তাপ্লুত কণ্ঠস্বর, জানবেন যে আপনি ইনডিড ক্যালিব্যান্ সোসাইটির লাইফমেম্বার্শিপ্ সাবস্ক্রাইব্ করেছেন।
সংক্ষেপে প্রকাশ থাকুক সর্বাবগত গল্পটা আরেকবার এইখানে যে ক্যালিব্যানের ইনভেডর মনিব শাদাচামড়াধন্য প্রস্পেরো অবাধ্য-দুর্বিনীত মুখপোড়া চাকরটারে হাজার শিক্ষাদীক্ষা স্ট্র্যাটেজি-স্কিম্ দিয়াও বশ মানাতে ব্যর্থ হচ্ছে বারংবার। পোষ মানানো যাচ্ছে না পাগলা সার্ভেন্টের পয়দাটাকে। একটাকে অবশ্য পদানত ও বশ্য করতে বেগ পোয়াতে হয়নি। মিচকি মিনমিনে অ্যারিয়েল প্রভুর হয়েই শিঙেয় ফোঁক দিয়া যায় দিবারাত। মধুর মধুর সদাপ্রভু-সম্মাননার শাদা ধবধবা গান গায় অ্যারিয়েল। প্রভুর ঘুমপাড়ানি হিন্দুস্তানী ক্ল্যাসিক্যাল্ তথা শাস্ত্রীয় বন্দিশ অ্যারিয়েলের গলায় খেলে ভালো। কমবখত ক্যালিব্যান্ হারামজাদারে নিয়া বালামুসিবতে জেরবার ভদ্দরলোক প্রস্পেরো আর তার এনলাইটেন্ড তনয়া কুমারী মির্যান্ডা। ব্যাটা খালি খিস্তি করে আর বেসুরা বেয়াদবির হার্ডরক্ গায়। এত সংগীতের সোহবত আর উন্নত বিশ্বসাহিত্যের তালিম দিবার পরেও প্রস্পেরো ক্যালিব্যানের কাছ থেকে রেজাল্ট পায় জিরো। প্রস্পেরো প্রভুপরাক্রমে ক্যালিব্যানের ক্রোধের সামনে খাড়াইতেই পারে না। অ্যারিয়েলের সামনে সে আইল্যান্ডের লর্ড হিশেবে যেটুকু গণ্যমান্যতা পায়, ক্যালিব্যানের সামনে এসে সেইটা ফানুশের ন্যায় ফুট্টুশ হয়ে যায়, ক্যালিব্যান্ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না মাতৃদ্বীপ-অক্যুপাই-করা ডেভেল্যপড সিভিলাইজেশনের শাদা বাটপার ভদ্রসদ্র-সদাচারশুভ্র প্রস্পেরোকে। অ্যাক্ট ওয়ানের সেকেন্ড সিনে ক্যালিব্যানের প্রতি প্রভু প্রস্পেরোর ক্রোধবর্ষণ শুনতে পাই, প্রস্পেরো বলে : “ব্যাটা ডাকাইতের বাইচ্চা ডাকাইত! অসভ্য কোথাকার! জন্তুজানোয়ারের মতো গোঙানো ছাড়া বাক্যালাপ করতেও মুরদ ছিল না তোর ফোঁটা পরিমাণে, রে বেয়াদব কাঁহিকা, এত শব্দ আর বাক্য সবক দিলাম তোরে, লেসন্ দিলাম ভাষা আর গ্র্যাম্যারের, শাস্তর পড়তে শিখাইলাম, শিখলি সবই কিন্তু ঠাকুর চিনলি না, ব্যাটা বান্দরের পো, অকৃতজ্ঞের আণ্ডা ক্যালিব্যান্!” উত্তরে ক্যালিব্যান্ বলে, রক্-ন্-রল্ সুরে হেঁড়ে চেল্লানোর ঢঙে : “ল্যাঙ্গুয়েজ্ হিগাইসুইন আপনে আমারে মেহেরবানি করে, হুজুরের দয়ার ধান্দার তারিফ করি, ভালোই তো, এইবার কোমর বাইন্ধা গাইল্লাইমু আপনেরে, প্রভুমুখোশ খুইল্লা দিমু দুনিয়ার সামনে, হাটে হাঁড়ি ভাঙমুই ভাঙমু, ‘ধন্যবাদ ভালো দিয়া গেলেন’ বইলা ক্যালিব্যানসংগীতে প্রভুভণ্ডামি পিছন দিয়া হান্দাইমু আপনেগোর।” … ইত্যাদি। দ্বিতীয় দৃশ্য, প্রোক্ত গল্পভাগে, প্রথমাঙ্ক। হুবহু বলা হয় নাই কথাগুলো, বলা বাহুল্য, ষোড়শ শতকের কথাবার্তা ক্যালিব্যানভক্ত কোনো রকারের পক্ষে এদ্দিন মনে রাখাটাও বটে এক পুষ্টিহৃষ্ট ঘটনার ব্যাপার।
অবশ্য ঘটনা এইগুলা না। ক্যালিব্যানের মাহাত্ম্য বুঝতে চাইলে একটা আনলার্ন প্রোসেসের ভিতর দিয়া যাইতে হবে আমাদিগেরে, সেইটা শাস্ত্রীয় মরশুমে কেমন করে কোন মুখে প্রোপোজ্ করি আপনারে? “প্রভু-ভৃত্য সম্পর্কের সীমানার অন্যপারে বিয়ন্ড ন্যুড অ্যান্ড ইভল্ বাস করে এই ফালতু পাতাগুলোর প্রোট্যাগ্যনিস্ট। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ এবং অ্যাকাডেমিক্ ডিসকোর্সের নাগাল ও নজরদারি অতিক্রম করে এক অন্যমাত্রিক ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে সে তাকায়, লক্ষ করে এবং পর্যবেক্ষণ করে আমাদের শেয়ার্ড আধুনিক, আধুনিক-উত্তর এবং আধুনিক-ইতর সমাজ, সমাজশাস্ত্র ও তাদের সমজদার লিলিপুটগুলিকে।” হ্যাঁ, ক্যালিব্যানের শরণ বিনা আমরা অভীষ্টে যেতে পারব না, কানু বিনা গীত নাই যেমন, এই নিবন্ধিকায় এবং অন্যত্র সবখানে, ক্যালিব্যানের কর্কশ অমধুর সংগীত তল্লাশিয়া যাইবই জীবনভর আমরা। তা, আমি কি তবে ক্যালিব্যানের পোষা পাণ্ডা? না মশাই, তা আর হতে পারলাম কই, আমিও তো অ্যারিয়েলের ন্যায় হাত-কচলানি জীবনই যাপন করিয়া যাইছি হে! একটু পা চালিয়ে, ভাই!
অফ গ্র্যাম্যাটোলোজি, অফ মিউজিকোলোজি
স্ক্রিপ্টের টাইমস্প্যান্ মোটামুটি এইটিজের মাঝমাঠ থেকে একটানা নাইন্টিজের শেষমাথা পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। পরেও অবশ্য আছে, যেমন আগেও, এইভাবে আগুপিছু গল্প বোনা যাবে। এ সেল্যুলয়েড ধরতে চেয়েছে দি গ্রিন্ ডেল্টা বাংলাদেশের অন্তরঙ্গ ছবি, কিয়দংশ রঙিন, কিয়দংশ সফেদকৃষ্ণ হলেও সম্পূর্ণ ঝড়ো, ওয়াইল্ড অ্যান্ড উইন্ডি হিস্ট্রি অফ পোস্ট-কলোনিয়্যাল্ বেঙ্গল্ মিউজিক্ রেজিম্। অবশ্য পুরো পোস্ট-কলোনিয়্যাল্ বলবার মতো বুকের পাঁটা আমাদের এখনও অনার্জিত রইলেও বুকের ছত্রিশইঞ্চি সিনা আমরা টানাইয়া হাঁটার হ্যাবিটটা হারাতে চাই না। আখেরে এইটা কাজে দেবে। অ্যানিওয়ে, যে-কথা বলছিলাম। সেই-সময়টায় আমরা জ্যাক্ ডেরিড্যা পড়ছিলাম। অনুষঙ্গের ন্যায় লিওতার, রলাঁ বার্থ, স্যস্যুর প্রমুখ। প্রধানত ভুলেভালে-ভরা ঠাণ্ডারক্ত টুইঙ্কল্-টুইঙ্কল্ লিটলম্যাগগুলোতে। উত্তরাধুনিক বলব, না আধুনিকোত্তর; বিনির্মাণ, না অ-বিনির্মাণ … এইসব নিয়া আখাম্বা আন্দু তক্কো। বটে সেসব ছিল সুখাতিশয্যভরা কাঁপাকাঁপা আধকাপ চায়ে-ডোবা কালজয়ী দিনদুপুরসন্ধ্যামাঝরাত একেকটা! গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভ্যাক্, অফেরা সেই বিনয়ের চাকা, আর তার সেই ‘দে লা গ্রামাতোলোজিয়া’ ট্র্যান্সল্যাশনের প্রিফেইস্। ডেফিনিশন্, রিডিফাইনিং, নিগেশন, সেমিয়োলোজি, ডিটারমিনেশন্, ওভারডিটারমিনেশন্ অফ মিমিক্রি … এইসবে ভরা ছিল সুরমাগাঙের সোমত্ত সলিলা শারীরিকতা। আরও অনেকানেক অথার-প্রিফেইসারদের বইয়ের ব্লার্ব মুখস্থ করতে করতে একটু-একটু অজিত চৌধুরী, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় চেখে দেখছিলাম। ‘মার্জিন্ অফ মার্জিন্ : প্রোফাইল্ অফ অ্যান্ আনরিপেন্ট্যান্ট পোস্ট-কলোনিয়্যাল্ কোলাবোরেটর’ স্মর্তব্য। অথবা মায়েস্ত্রো চৌধুরীরই বাংলা ম্যাগনামোপ্যাস্ ‘এক নির্লজ্জা দাসীর গল্প’। ভুলেই বসেছিলাম যে সেইসব ডগম্যাটিক্ অ্যাকাডেমিয়্যাবাদ্যিবাজনার তলায় ক্যালিব্যানের রক্তচক্ষু কোকিলচিৎকার সংগুপ্ত। সবকিছুর কেন্দ্রে যে-ব্যাপারটা, ভাষা, আমরা তার খোঁজপাত্তা চালাচ্ছিলাম প্রস্পেরোর প্রেস্ক্রাইবড ওয়েতে। সেই-সময় আকস্মিকভাবে একটা আওয়াজ আমাদের কানে এসে পশে : ‘ভাষাই ধর্ম ভাষাই দেশ’; শোনামাত্র চমকেছিলাম বা সম্যক বুঝেছিলাম তা নয়, কিন্তু শুনেছিলাম, ক্যালিব্যানের রক্তার্তনাদ : “শোনো শোনো ওই ওঠে রব / সকল মাতৃভাষাতে / একটি চিঠি হচ্ছে বিলি / ভাষাই ধর্ম ভাষাই দেশ / … যার যার ধর্ম তার তার কাছে / যার যার ভাষা তার তার দেশ।” ঘটনাটা হাইব্রু বঙ্গীয় কবিতাসাহিত্যে নয়, এমনধারা ক্যালিব্যানকাণ্ড, ঘটেছিল বাংলা গানে। এখন ভাবলে গায়ে কাঁটা দ্যায়, কী আশ্চর্য! অবশ্য অবাক হবার কিছু নাই, কেননা বাংলার ফিলোসোফি চিরকাল গানের লজিকেই গাঁথা হয়েছে; হেগেল-দেকার্ত বা হাইডেগারে-ডেরিড্যায় বাংলার ভাণ্ড ভরে না। আর তাই, ইন্ সার্চ অফ ক্যালিব্যান্, দি নিউ বাংলাদেশী মিউজিকের খোঁজে, এ-জন্মে না যদি পারি তো পরজনমে এসে রাধাভাবে বেরোতেই হবে। বেরোতে হবে হাইকলার অ্যাকাডেমিক্ বাংলা ক্ল্যাসিক্যাল্ ও সেমিক্ল্যাসিক্যাল্ সংগীতের ঘাড়েগর্দানে শেকলের দাগটাকে একটা আলতো পয়েন্টার পেন্ দিয়া সামনে এনে দেখাইতে। “এই রচনা তাই ক্রীতদাস-ক্রীতদাসীদের গল্প যারা বেঁচে থাকে ক্রল্ করে কেননা তারা ভালোবাসে জীবন এবং ভালোবাসা। আবার তারাই তো টুয়েন্টিনাইন্ তাসের দেশের গোলাম যে শাসন করে সাহেব এবং বিবিদের। আবার যেহেতু মৃত্যু জীবনেরই অংশবিশেষ এক নিরবচ্ছিন্ন শেষহীন সঙ্গম, গোলাম ভালোবেসেছিল মৃত্যুকেও। তারই মৃত্যুবিষয়ক লিপিগুলিতে লেখা ছিল কেমন করে ভেঙে পড়বে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং পেন্টাগন্। হোয়াইট হাউসেও আছড়ে পড়েছিল বিমান — তখনও কেউ সংকেত পায়নি।” ইন্ সার্চ অফ ক্যালিব্যান্, হতে পারত এই নিবন্ধিকার নাম; হয়নি, যেমন হতে পারত ‘দে লা বাংলা ব্যান্ডম্যুজিকোলোজিয়া’, তা-ও হয়নি; কিংবা আরও অনির্দেশ্য অসংখ্য রচনাশীর্ষ সম্ভাবিত হয়েছিল, হবে একদিন সেইসব সম্ভাবনারও আনইম্যাজিন্যারি ইমপ্লিমেন্টেশন্; রচনার নামকরণ নিয়া ভালো বলতে পারবেন উম্বের্তো একো, গোলাপের নামরহস্য নিয়া যার লাম্-সাম্ একটা আইডিয়া আছে। এইখানে নেইমিং-সার্থকতা আমাদের মাথাব্যথা নয়, এইখানে আমরা কায়মনোসংযোগে শুনতে সচেষ্ট ক্যালিব্যানের গনগনে গান আর তার আনসাং জীবনকাহিনি। “জীবন যখন ডাইনোসরের মতো জীবনকেই মারতে উদ্যত, একমাত্র মৃত্যুবিষয়ক গবেষণা এবং ভালোবাসার সংগীতই বাঁচাবে জীবনকে যা একমাত্র এই গোলামই নির্মাণ করতে পারে কেননা সে জীবনের ক্রীতদাস নয়, সময়ের বাহক মাত্র।” অথবা তা-ও নয়, এইখানে ফের একবার আমরা দেখে নিতে চাইছি সেই হতভাগ্য বোকাহাবা বাহাদুর শাহ জাফর নামখ্যাত সংগীতপ্রিয় সম্রাটের মুখ, স্বীয় রাজপাটে বেখেয়াল এই শাস্ত্রীয় সংগীতাসক্ত বদনসিবের জন্য অন্তিমে দু-গজ কবরের জমিনও স্বদেশে মেলে নাই বরাদ্দ, লোক্যাল্ লাইভ অ্যান্ড লাইফফ্যুল্ প্রত্যহকার জ্যান্ত সংগীতে অবজ্ঞাভ্যস্ত আমাদিগেরও তদ্রুপ উপহাস্য দশা হতে চলেছে কি না, আজ এই হিন্দুস্তানী বন্দিশে বেহুঁশ সময়ে এতদ্বিষয়ে বেহুদা ভাবনা চলে না।
বাদশাহি, ভিখিরিগিরি
এক দেশে ছিলেন এক গায়ক। খুবই প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি গোটা রাজ্যির লাত্থিগোত্তা-খাওয়া মানুষের। বিশেষত শোণিত-টগবগানো তরুণদিগের নিকট উনি ছিলেন সাক্ষাৎ ত্রাতা। আর তার গানগুলো গস্পেলের মতন হয়ে উঠেছিল ক্রমে, এবং গানের উলটপালট সুর ও বাদ্যিবাজনা, বিশেষত শহর ও শহরতলি জনপদের মূক ও বধির কাঁচা-সবুজ অপুষ্টিক্লিষ্ট সুরাভাবে-শীর্ণ তরুণদিগেরে সেইসব মাতোয়ালা গান বলারিষ্ট যুগিয়েছিল একদা। আয়ুর্বেদিক বলারিষ্ট অপেক্ষা স্ট্রং ছিল সেইটা। বাংলায় যাকে বলে রেস্কিয়্যুয়ার, উনি ছিলেন অনেকটা তা-ই সেইসব ভুখানাঙা রাগ-রঙানো তরুণদিগের কাছে, ছিলেন উজ্জ্বলতর উদ্ধারকর্মী। ছিলেন গতানুগত ভদ্র-ভেজা-ন্যাতা গানের গোয়ালে সুসমাচার বহনকারী। কিন্তু কপাল উহাদের মন্দ তাতে সন্দেহ কী — ইয়াং বাংলাদেশী ভূখণ্ড-জাতীয়তাবাদীদের মন্দ নসিবের কথা বলছি — তিনি ত্যাজিলেন তার উঠতি দিনের উস্কানিদাতা বোকা-হাবা পুঁচকেগুলিরে, গেলেন চলে রাজপাট ছেড়ে একদিন দুঃখের রাত্রি-পোহানো অন্ধকারে। গেলেন চলে ভারতীয় জন্তা পার্টির দেশে, গেলেন চলে নরেন্দ্রমোদী-কা মুলুক-ম্যে, যেয়ে তিনি পরিশেষে রহিলেন তথায় খোশহাল। স্বদেশে ফেরেন, মধ্যে মধ্যে, বিদেশীর ন্যায়। বিন্দাস্!
একটা গানদল ছিল তার। পরে আরেকটা গড়েন, অথবা আগেরটা নাম পাল্টে একই লাইনাপ নিয়া গাইতে থাকেন বাংলা দাপিয়ে, সমস্তই অতীত আজ। ঘটনা বটে, সেইসব দিন, সেই গান গাওয়া আর মাতোয়ালা তেপান্তর-ছাপায়ে-যাওয়া তার দুর্ধর্ষ গলার আওয়াজের সুরগুলো। সবই আজ অতীত, পাস্ট ইজ্ পাস্ট, সমস্তই সুদূর। তিনিও নীহারিকা আজি। ইন্ডিয়ার আকাশে তিনি নীহারিকা আজিকালি। ‘মিট মিট মিট মিট ছোট্ট তারা / বিস্ময়ে ভাবি আমি তোমরা কারা / ওই দূর বহুদূর আকাশটাতে / ঝিকিমিকি তারা হয়ে ঝুলছ তাতে।’ … ট্যুইঙ্কল্ ট্যুইঙ্কল্ লিটল্ স্টার / হাও আই ওয়ান্ডার হোয়াট য়্যু আর / আপ্ অ্যাবাভ দ্য ওয়ার্ল্ড সো হাই / লাইক্ অ্যা ডায়্মান্ড ইন্ দ্য স্কাই। …
নিজের রাজপাট থুয়ে তিনি পরের জায়গা পরের জমিনে যেয়ে রসুন বুনছেন। মন্দ হচ্ছে ব্যবসা বা আবাদ, তা বলছিনে। ব্যবসা ভালোই। প্রীতমের কন্ট্রাক্টোরি বিজনেসে কামলা খাটার কাজ। মন্দ না। ভারতের গানদলে গলাবাজি করে পেটে একটু উন্নত ব্র্যান্ডের জলপানি পড়ছে, এইটা ফাও হইলেও বেসিক্ ইনকামের থেকে এর ভ্যাল্যু কোনো-অংশে কম বলছিনে, একটু বেশি রোজগারপাতি হইলে তো অব্জেকশন্ জানাইবার কোনো রিজন্ দেখতে পাইনে। হোক-না তা রাজার স্তর হইতে নেমে কামলা খাটার কামকম্ম, পয়সায় সকলি ভোলায়, এমনকি রাজকর্ম হইতে দূরে রহিবার মর্মযাতনাও। রুজিরোজগারের বাড়তি ব্যবস্থা কার-না কাম্য, বলেন? ফলে আয়-ইনকাম্ বাড়াইবার আশে, সেইভিংস্ অ্যাকাউন্ট মোটাতাজাকরণের গরজে, এই দেশের কত-না রাজাকেও যুক্তরাজ্যেরাষ্ট্রে যেয়ে স্ট্রিটবেগার হইতে হয়! এহেন ঘটনা আমরা হামেশা দেখি।
বক্ষ্যমাণ রাজপাট প্রথমে মশহুর ছিল ফিলিংস নামে, একসময় এই নাম পাল্টিয়ে রাখা হয় নগরবাউল । বছর-কয়েক হলো এই রাজপাট প্রায় লুপ্ত, অথবা গঙ্গাজলে বিলীন, হাওড়া ব্রিজের ধার দিয়া আপনি যদি হাওয়া খাইতে যান কোনোদিন, জুহু বিচে ব্যাকপ্যাক্ কাঁধে ট্যুরিস্ট-টহলরত, তো খুঁজে দেখতে পারেন। পাবেন কি পাবেন না, তা আগেভাগে বলে দেয়া যাচ্ছে না। যা-হোক, রাজ্যের লোক সেই রাজপাটের প্রত্যেকটা পার্ষদকে চিনত। ড্রামার, কিবোর্ডিস্ট, গিটারিস্ট, পার্কাশোনিস্ট প্রত্যেককে। একেকটা অ্যালবাম লোকে ইস্তেহারের ন্যায় জ্ঞান করত। বলা বাহুল্য, অরুণ-বরুণ তরুণ লোকেদের কথাই বিবেচিত হচ্ছে এখানে। সেই রাজ্যে বুড়াহাবড়াদের ট্রেসপাসিং প্রোহিবিটেড ছিল। বুড়াদের ইনহিবিশন্ নিয়া আমাদের এই নিবন্ধিকা ভাবিত নয় একটুও। সমস্তই অতীত এখন, অব্লিভিয়নের বিবরে সেঁধোনো গোল্ডেন্ সেই দিনগুলো।
জনতা এক্সপ্রেস্, নওগাঁ টু নভোনৌকা
আর কী ভীষণ সমস্ত গান! দুই-তিনটা মাত্র বলতে এখানে এই নিবন্ধ অবতরণ করতে চাইছে এখন। তবে এইটাও কবুলতি হিশেবে এইখানে মেনশন্ করা থাক যে জেমসের গানবাজনারাজ্য গড়ে উঠেছে দুই শতকের সন্ধিক্ষণে, একের-পর-এক ব্যাকরণভাঙা গানের পরাক্রম ভর করে, একটামাত্র বৈঠকে সেই কালাপাহাড়ি কীর্তিমত্ততার গল্প ফুরাবার নয়। সেই ১৯৮৫ সালটাকে জেমসের অভিষেকবর্ষ ধরে এগোলে এই ২০১৫ সালে তার গানকৃতি তিরিশ বছর পূর্ণ করেছে। এই তিন দশকে জেমসও তো একঠাঁয় দাঁড়ায়ে নেই। তিনি নিজের ট্র্যাকে থেকেও মোড় নিয়েছেন, কয়েকটা বাঁকে পেয়েছেন সফলতা এবং কয়েকটায় বিফলও হয়েছেন, তবু গতি তার স্থবির হয় নাই। তিনটি ডিকেডে জেমসের পথরেখা ঠাহর করে এগোনো যায় আলাপটা, আবার অত সুশৃঙ্খল সুসংবদ্ধ কথানুষ্ঠানের ধার না-ধেরে জেমসেরই স্টাইলে কেয়ার্লেস্লি গিটারধুনে এলোমেলোমি ছিটিয়ে এগোনো যায়। যেভাবেই হোক, ‘ছন্নছাড়া দুঃখের ভোরে’ বা ‘একচিলতে রোদের ভিড়ে’, পত্রলেখা ব্যাহত না-হয় যেন। ‘পথে এবার নামো সখি’, স্মৃতি আর শ্রুতি নির্ভর করে এই পথচলা, ফিলিংস আর নগরবাউলের সঙ্গে একবার চেষ্টা করে দেখা যাক গুছিয়ে তোলা যায় কি না আত্মজীবনের আংশিক ড্রাফ্ট। ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ হয়ে থাকলেও ক্ষতি অল্প, যখন যা মুখে বা মনে যোগায় তা-ই যাক টুকানো, পথেই তো সুর লভ্য কথা লভ্য, ‘পথ বেঁধে দেবে বন্ধনহীন গ্রন্থি’ …
দি বাংলা সামুরাই
প্রোফেশন্যাল্ কিলার নিয়া বাংলায় কেউ গান গেয়েছিল কোনোদিন? অথবা ভাবতে পেরেছিল যে পেশাদার খুনি নিয়াও হইতে পারে গান বাংলায়? জেমস পেরেছিলেন। ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। মঞ্চনামেই মশহুর বাংলায়, অল্পবিস্তর ভূভারতে। এখন ঊনপঞ্চাশ-পঞ্চাশ বা বড়জোর একান্ন, বর্ন নাইন্টিন-সিক্সটিফোর, ব্রট-আপ এবং মিউজিক ক্যারিয়ার দুঃখিনী বাংলাদেশে। কে আর মনে রাখে এইসব হুদা কামের ইনফোর্মেশন্? হোয়াটেভার। ‘জেল থেকে বলছি’ — হিউজ্ হিট এইটা — অ্যালবামে এ-গানটা পাওয়া যাবে। এমনিতে কেউ বলতেই পারেন যে, বাংলা গানে, যেমন ধরো গণসংগীতে বা প্রোটেস্ট মিউজিকে, একটা কাউন্টারপার্ট দুষ্কৃতিকারী পোর্ট্রেইড তো হয়েছে দেখতে পাবো সবসময়। সেইটা আপনি ঠিকই বলবেন। তবে এই কিলিং অ্যাজেন্ট আর জেমসের আলোচ্য গানের কিলার সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই জিনিশ, দুই ভিন্ন চরিত্র। সংক্ষেপে এক-দুই লাইনে একটু বলি।
শিল্পী যখন মধ্যভাগী, মানে মধ্যবিত্ত বলয়ের লোক, তখন তিনি তো অন্ত্যজের হয়ে একটা এনিমি দাঁড় করান তার গানে, একটা প্রতিপক্ষ, এইটা আমরা হামেশা লক্ষ করব। সবসময় সেই প্রতিপক্ষ হয় ঘৃণ্য ও অবধারিতভাবেই ঘৃণিত। জেমসের এই গানটার উপজীব্য খোদ খুনপেশাজীবী। কিলার, অ্যাসাসিন্, খুন করা যার প্রোফেশন্, টার্গেট-অব্জেক্ট তথা মানুষ মিহি কায়দায় নিকেশ করা যার স্কিল্ এবং এই স্কিল্ বেচেই নির্বাহ করে সে তার জীবনব্যয়ভার। ইংরেজিতে এমন গান দুইয়েকটা আপনি নিশ্চয় শুনেছেন। বাংলায় জেমসের আগে এমন হয়নি, ছিল না আগে এই নজির। কোনো ঘৃণা নয়, ধিক্কার নয়, নিপাত যাবার চিৎকার নয়, নির্মোহ মমতায় এঁকে তোলা হয়েছে কথায় ও সুরে গানের অভীষ্ট চরিত্রটাকে। এইটি লিখেছেন লতিফুল ইসলাম শিবলী, গানের শিরোনাম ‘পেশাদার খুনী’, সুর ও সংগীত করেছেন জেমস তথা তার তৎকালীন ব্যান্ড ফিলিংস । গানটার লিরিক্স থেকে একাংশ চয়ন করা যায় : “আঁধারের বুক চিরে আততায়ী / অশুভ ছায়ার মতো নেমে আসে / জনপদে / নেই অভিব্যক্তি চোখে-মুখে / রক্ত-হিম-করা সাহস বুকে / জেগে আছে / হাজার লোকের ভিড়ে সে / অতি সাধারণ এক ব্যক্তি / জেগে থাকে / শীত-শীত নিষ্পাপ চোখটা / পেশাদার খুনি সেই লোকটা — / পেশাদার খুনিটা” … তারপরের স্তবকে এক-জায়গায় যেয়ে পাচ্ছি : “অমানুষিক বিভীষিকা / খবরের পাতা জুড়ে … শীতল চোখের ওই কপাল-পোড়া / নিষ্পাপ চোখের ওই কপাল-পোড়া / সর্বনাশা সেই খুনীটা ” … ইত্যাদি। লিরিকের ওজন খুব-যে অ্যাপ্রিশিয়েট করবার, তা নয়। বরং দুইয়েকটা জায়গায় একদম ক্ষ্যাত্, যেমন, “শীতল চোখের ওই কপাল-পোড়া / নিষ্পাপ চোখের ওই কপাল-পোড়া ” — এই জায়গাটা, এই ‘কপাল-পোড়া’ এক্সপ্রেশনটা ফাউল্ বললেও হয়। কিন্তু ঘটনা তো মিছা না। অ্যানিওয়ে। বাংলাদেশের গানে এমন জোড়াতালি তো হরদম হয়েই এসেছে। বেশ একটা লাইন পাবার পরক্ষণেই ক্ষ্যাত্ একগোছা লাইন। টোটাল মিলিয়েই আমরা গানটা সয়ে যাই। জেমসের এই গানটা অবশ্য সেসব বিবেচনায় বেশ ভালো মার্কস্ পেয়ে উৎরে যায়। একটা লাইন তো অভাবিত মনে হয় : “শীত-শীত নিষ্পাপ চোখটা / পেশাদার খুনী সেই লোকটা” — এইটা তো স্ট্রং পয়েন্ট একটা। ভাবা যায়! তা-ও বাংলাদেশের বাংলা গানে!
‘শীত-শীত নিষ্পাপ চোখটা’ — পেশাদার খুনীর পরিচায়ক চিহ্ন হিশেবে এই তিলক তো অনবদ্য। শীত-শীত চোখ। ঘটনাটা সংক্ষেপে এইটুকু। সংগীতযোজনা আর গিটারবাজনা — সেই সময়কার জেমস তো অনেক র’, অনেক আনপলিশড এফেক্ট, অনেক বেশি প্রিমিটিভ অ্যাপ্রোচ, গলাটাও তখন আজকের মতো অত ভরাট হয়ে ওঠে নাই, চিলিং, তীক্ষ্ণ শিসের ন্যায় চিরে চিরে যাওয়া স্বর, গিটারবাদন তো উদ্দাম আদিম বমন-বিবিক্তি-উগরানো, ফলে এই সবকিছু মিলিয়ে একটা পেশাদার খুনীর মনোবেদনা ভালো ফুটেছিল গানের আবহটায়।
এর অনেক বাদে, প্রায় দেড় যুগ উজিয়ে এসে, একটি সিনেমা দেখে এই গানটার স্মৃতি মনে পড়ে গেছিল। ২০১০ সালের অ্যামেরিক্যান্ ম্যুভি এইটা। জর্জ ক্লুনি ‘দি অ্যামেরিক্যান্’ নামে সেই সিনেমাটায় কী বিস্ময়কর একটা ব্যাপার-যে করেছিলেন! ক্লুনি ছিলেন একজন গানস্মিথ এবং কন্ট্র্যাক্ট কিলার, সোজা বাংলায় নিজে সে অস্ত্র বানায়ে নিতে পারদর্শী নিজের কাজটা নিখুঁত ও সুচারু সমাধার লক্ষ্যে, রেপ্যুটেড ভাড়াটে খুনী। প্রোফেশন্যাল্ কিলারের ভূমিকায় ক্লুনিকে সেই সিনেমায় নিঃশব্দে একদম সন্ত-সমাহিত ধ্যানে কাজ করে যেতে দেখা যায়। যেমন করে একজন কবিতা লেখে ধ্যানস্থ শ্রম লগ্নি করে, যেমন করে সুরমগ্ন থাকে একজন গানশিল্পী কি চিত্রকর যেমন থাকে রঙরেখাব্যাকুল, খুনীও তেমনি নিজের কাজে শতভাগ ব্যাপৃত। ছবিটায় ঠিক তা-ই দেখানো হয়েছিল, যদ্দুর মনে পড়ে। একজন ভাড়াটে খুনী সিনেম্যাটিক্ উত্তেজ-উত্তাপহীনভাবে পুরো সিনেমা জুড়ে তার প্রস্তুতি নিয়ে চলে, দর্শক হিশেবে আমরাও সঙ্গী থাকি তার, এমন অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। কিন্তু খুনীকে কোনোভাবেই মহিমান্বিত করার চেষ্টা ম্যুভিনির্মাতার মধ্যে ছিল না স্বীকার্য। অথচ আবেগের কোথাও কোনো-একটা তন্ত্রীতে ব্যাপারটা ঘা দিয়া গিয়াছিল বৈকি। অনেক আগে যেমন ঘা দিয়া গিয়াছিল জেমসের ‘পেশাদার খুনী’ গানটা। তা, জেমস তো এখন ‘আলবিদা’, ‘ভিগি ভিগি’, ‘রিশ্তে’, ‘বেবাসি’, ‘চল্ চলে’ … এইগুলা গাইছেন। চাঙ্গা ব্যবসা। ভালো হোক। জগজ্জোড়া নামধাম বাড়ুক।
অন্য যেই গানটার কথা বলব ভেবেছিলাম, তা আর না-বলি এখানে। একটা লাইনের বেশি মনেও করতে পারছি না গানটার লাইনঘাট। মেমোরিকার্ড অকেজো হইবার দ্বারপ্রান্তে প্রায়। ডিসগাস্টিং। “ভাবনার ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে / স্বপ্নের রাজপথে / কোথাও কেউ নেই শুধু / একজন ট্রাফিক্ প্যুলিস্ / গ্রিন্ সিগ্ন্যাল্ তুলে দাঁড়িয়ে / দাঁড়িয়ে আছে” … এইটাও ওই ‘জেল থেকে বলছি’ অ্যালবামেরই গান। মনে পড়ছে না লিরিক্স এর বেশি কিছুতেই। কিন্তু লিরিক্স ভুলিয়া যাওয়া আজকাল আর বড় কোনো মুসিবত হিশেবে গণ্য হয় না। আপনি ইন্টার্নেটলকড দুনিয়ায় নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসরত, খড়ের গাদায় হারানো সুঁইটাও খুঁজে বের করে দেয় এই ইন্টার্নেটসান্ত্রী, অন্তত জনশ্রুতি তা-ই বলে। এবং যা হারায়, যার খোঁজ ইন্টার্নেটসান্ত্রীসিপাই দিতে পারে না, তার অস্তিত্বই স্বীকার করতে চায় না এই গুগলব্লাইন্ড জেনারেশনের ক্রিয়েটিভ ডোমেইনের লোকলস্কর। এইটা আরেক মুসিবত। তবে জেমসের গানসন্ধানজনিত মুসিবতের সুরাহা সহজেই করে নেয়া যায় নেটের সুবাদে। এবং নানামাত্রিক সজ্জায় গানগুলো অ্যাভেইল্ করতে পারেন আপনি, লিরিক্সের সঙ্গে গিটারকর্ড রিডিং তো পাবেনই, ভিশ্যুয়্যাল্ বিভিন্ন প্রেজেন্টেশনেও ওদের হাজিরা পাবেন। কপি অ্যান্ড পেইস্ট করে নেয়া যাক গোটা গানটা : “ভাবনার ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে / স্বপ্নের রাজপথে / কোথাও কেউ নেই / শুধু একজন ট্র্যাফিক্ প্যুলিস্ / গ্রিন্ সিগ্ন্যাল্ তুলে দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে আছে / তুমি আসবে ফিরে এই রূপসী নগরে / ভাবনার ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে / # অপ্সরী কে তুমি মানসপটে এসেছ / ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়ে মনপ্রান্তরে ডেকেছ / অবাক হয়ে আছি দৃষ্টি মেলে / শিশিরচাদর বুকে জড়িয়ে নিয়ে / ক্লান্তিটুকু মুছে দেবে তুমি / ভাবনার ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে / # পথচারী এই আমি বড় একা দাঁড়িয়ে / তন্দ্রা হারিয়ে গেছে দূর বন্দরে পালিয়ে / নূপুর পায়ে তুমি আসবে যখন / নীরব রাতের ঘুম ভাঙবে তখন / একটুখানি কাছে থেকো তুমি / # ভাবনার ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে …”
এখানে লক্ষ করা যাবে যে এই গানটা পাঠকৃতি হিশেবে নেহায়েতই দুর্বল একটা বাণীগুচ্ছ। দুর্বল ছবি, চিত্রকল্প অগোছালো ভুলভ্রান্তিকীর্ণ, ভুল ও অসচেতন নবিশের অন্ত্যমিলকলঙ্কিত। অভিযোগ সত্য সর্বৈব, সবই ঠিক আছে। ব্যান্ডগানে এই কিসিমের লিরিক্স প্রধানত ও প্রচুর পরিমাণে দেখা যাবে, একবার নয় দুইবার নয় ফিরেফিরে বারেবারে এই নিরক্ত কথার লিরিক এসেছে ব্যান্ডগানে, এই কিসিমের বিচ্যুতিতে ভরা গানের বাণী। কিন্তু স্ট্রং ওয়ার্ডিং ব্যান্ডগানে একেবারেই অ্যাবসেন্ট বলাটাও অসত্য। খোদ জেমসের গানগুলো বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে যে জেমস গোড়ার সময়টা বাদেই লিরিকে কবিতাব্যঞ্জনা ধারণে ব্যাপক যত্নশীল। গোটা ক্যারিয়ার জুড়ে যে-কয়টি নিজস্ব কম্পোজিশনের গান জেমস গলায় তুলেছেন, সব-কয়টিতেই কবিতাপ্রাধান্য লক্ষণীয়। অন্য সুরকার-সংগীতায়োজকদের গান গাইবার ক্ষেত্রেও প্রধানত নিজের গড়ে-তোলা আদলে যথাসম্ভব সুশ্রাব্য পদপঙক্তির লিরিক্স চয়নে মনযোগী থেকেছেন। মিক্সড অ্যালবামগুলোতে এই পরিচয়ের জেমসকে দেখতে পাবো আমরা। আপাতত উদাহরণ চয়ন থেকে দূরে রইতে হচ্ছে, এই কিস্তি নিরুদাহরণ শুধু অন্তরজ্বালা জ্ঞাপনে ব্যস্ত রহি, কেউ উদাহরণব্যগ্র হলে নিজদায়িত্বে এক্সাম্পল্ ঢুঁড়ে নেবেন। তথাস্তু!
তবে এখানে যে-কথাটা পাড়ব বলে ‘ভাবনার ল্যাম্পপোস্ট’ গানটা হাতে নিয়েছিলাম, সেইটা আর কালবিলম্ব না-করে এইবার বলি। লিরিক্সের ভেতর কথার বিন্যাস দিয়া গান হতেই হবে এমন তো কোনো শর্ত কোথাও নাই। সিম্পল্ এবং ল্যাবগ্যাবে বাণীর এই গানটা শুনে এরপর বলতে হবে কোথায় এর দাঁড়ানো এবং কোথায় এর পতন। জেমসের জাদুটা এইখানেই, রেন্ডিশনের সময়, ইন্-জেনারেল্ গানে তো বটেই বিশেষভাবে জেমসের গানে কথা ও অন্যান্য সমস্ত কুরিকারিও গৌণ হয়ে যায় জেমসশীলিত অভিনব গায়নের কাছে। এখন ইউটিউবে একবার শুনে নেয়া যাইত যদি আলোচ্য অথবা অন্য-কোনো দুর্বলদেহ কথাবয়বিক গান, স্বয়ং জেমসের সুরসৃজিত ও সংগীতযোজিত রচনা হলে ভালো, তখন এ-বক্তব্য গ্রহণে বা খারিজকরণে সুবিধে হতো। তবে এইটাও কবুল করি যে ইউটিউবে গানটান শোনা বারবার বাফারিং ইত্যাদির কারণে তেমন যুৎ লাগে না। টাইমও তো শর্ট, দুনিয়ায়, অ্যানিওয়ে।
হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার
একদিকে ছিল “কত যে সাগর-নদী পেরিয়ে এলাম আমি / কত যে পথ হলাম পার / তোমার মতো এত অপরূপ সুন্দর / কাউকে তো দেখিনিকো আর / প্রিয়তমা, মনে রেখো / অনুপমা, মনে রেখো” অথবা “মায়াবী মায়াবী নয়ন দুটি / কোঁকড়া কোঁকড়া চুল / রে বন্ধুর কোঁকড়া কোঁকড়া চুল” অথবা “দেখেছি প্রথমবার / দু-চোখে প্রেমের জোয়ার / কতদিন আশায় ছিলাম / তুমি যে হবে আমার” প্রভৃতি গান, পথেঘাটে-প্রান্তরে-টিস্টলে-টংঘরে এই গান বাজিত দিবারাতি, অন্যদিকে “লেগেছে বাঙালির ঘরে ঘরে এ কী মাতনদোলা / লেগেছে সুরেরই তালে-তালে হৃদয়ে মাতনদোলা / বছর ঘুরে এল আরেক প্রভাত নিয়ে / ফিরে এল সুরেরই মঞ্জরি / পলাশ-শিমুল গাছে লেগেছে আগুন / এ বুঝি বৈশাখ এলেই শুনি / মেলায় যাই রে, মেলায় যাই রে / বাসন্তী রঙ শাড়ি পরে ললনারা হেঁটে যায়” কিংবা “কালো মাইয়া কালো বইলা কইরো না যে হেলা / ওরে শাদা মুখে নাই রে যাহা কালোতে যে আছে তাহা” বা “ধুপছায়া গোধূলিবেলায় / তুমি কাছে এসো” অথবা “এ এমন পরিচয় / অনুমতি প্রার্থনা, সবিনয় নিবেদন / কিছুই যে লাগে না” বা “ইচ্ছে করে যাই চলে যাই অচিনপুর / যেখানে দুঃখ নেই কষ্ট নেই / ঝলমল করে আলো রোদ্দুর” প্রভৃতি গান দিনমান। মুর্গির ডিম-ফোটা ভোর হইতে মহিষের শিঙের মতন রজনী বিভোর বাজিয়া যাইত এই গান এই সুর।
প্রথমোক্ত দিকের গানগুলো দিগন্তরেই বাজিত, লোকেও শুনত এবং প্রচুর কাটতি ছিল এইসব গানসম্বলিত ক্যাসেটের, তবে তখনকার আমাদের বয়সীদের অন্তরে বিশেষ বাজিত না ব্যাপারটা। গাইতাম এইসব গান আমরাও, উঠতি বয়সী জ্ঞাতিসৌত্রিক নারীকূলে সেসবের বড়সড় ডিম্যান্ড ছিল তখন, অতএব শুদ্ধ নাসিকান্যাকা গলায় তাদেরে প্রীতকরণকল্পে এসব আর্ট আমরা তখন অভিনিবেশে রপ্ত করছিলাম। কিন্তু প্রাণের সঙ্গে এদের প্লাগসংযোগ হয়ে উঠছিল না ঠিকঠাক। ওই বয়সে প্রেমের মতন ছিল আমাদের গানপ্রাপ্তি। যারে চাইতাম হৃদিমন সঁপিয়া, চাইতাম শরীর শিহরিয়া, তারে নিকটে পেতাম বছরের এ-মাথা ও-মাথা, ঈদে কিংবা পূজাপাবনে। এইরকমই ছিল তখন। ব্যান্ডের একেকটা অ্যালবাম বেরোত দুই-তিন বছর অন্তরান্তর। ফিডব্যাকের একটা বেরোল যদি, তো ওই একটা নিয়াই বছর-পাঁচ পার, তেমনি রেনেসাঁর, তেমনি সোলসের, মাইলসের, ওয়ারফেজের। ওই নিয়া আমাদের খেদ ছিল না কোনো। এক অ্যালবামে তেরোবছর পার করতে একটুও বোরিং লাগত না। তখন কি আমরা জানতাম যে এমন দিনও আসবে যখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় গান আপ্লোড হবে!
এইভাবেই ছিল, চলছিল অবিকল ওইভাবেই তখন, আমাদের গানের দিন, আমাদের গানবেলা। ডালপালা উথলিয়া সহসা হাওয়াঝাঁকানো সুর এল বনদেশ বিদারিয়া। আসলে সুর বললে কম বলা হয়। এল ওঙ্কার, ওমধ্বনি, এল আওয়াজ। সুর শুনেছে বাংলা গানশ্রোতা আগেও অনেক, শুনেছে অনেক স্বর্ণাভ কথার কাকলি, বাংলা গানে একে একে অনেক মায়েস্ত্রো এসেছেন, সক্কলেই তারা ধনী করে গেছেন আমাদিগেরে কমিবেশি, ঋণী করে গেছেন। অনস্বীকার্য সবাই, সবই, সমস্তই। কিন্তু বাংলা গানে ব্রহ্মনাদ এই প্রথম। বাংলা গানে ওঙ্কারউদ্ভূত ধ্বনি এই প্রথম। বাংলা গানের কুজন-কলরবের বাইরে বেরোনো এই প্রথম। বাংলা গান বলতে গেলে এই প্রথম বেরোলো ঝুলন ও মিঠে কানাকানির বাইরে। এ শুধুই হৃদিবিদীর্ণা আওয়াজ নয়, এ আওয়াজ দেহদহনেরও; অনেক হৃদয় লভ্য সংগীতের জগতে, ভূবাংলায়, কিন্তু শরীর ও হৃদয় মিলিয়েমিশিয়ে যে-একটা ভাঙনের আওয়াজ, তোলপাড়লীলা, বাংলা গানে জেমসের এবং মোটমাট বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতসৃজনের এইখানেই নবত্ব। ক্বলবের পুকার শোনা যায় ফিরে ফিরে জেমসের গানে। এ হয় সিনায় সিনায় টান লাগাবার গান। এ বাংলা মহাপ্রাণ ধ্বনির জজবা। এ যৌবরাজিক জোশ। এ হলো ‘অন্তরে অন্তরে প্রান্তরে নিশিরাতে’ প্রেম ধরে আনার অভিযান। না, প্রেম তো কতজনেই ধরেছে জীবনভর। এ হলো শব্দবৈভবের বিস্তার। বাংলা শব্দৈশ্বর্য। বাংলা আওয়াজ। বাংলা আওয়াজের বন-গিরি-উপত্যকা উত্তাল-করা শ্বাস ও ধমনীর ম্যাজিক। মন্ত্রগুপ্তির আওয়াজ এ। কে এ? — সেই যে, পেপসিবিজ্ঞাপনে, ‘হেই! জেইমস!’ — হ্যাঁ, ফারুক মাহফুজ আনাম, জেমস।
উপরোক্ত কথাগুলো, উপরোক্ত বিজ্ঞাপনকথিকা, সমগ্র বঙ্গ তথা বাংলার পাহাড় ও সমতল ও হিমবাহ ও তুন্দ্রাঞ্চল সর্বস্থলের জন্য প্রযোজ্য। বঙ্গে এমন ঘটে নাই পূর্বে। এই আওয়াজ বঙ্গ শোনে নাই বিফোর জেমস। বড়ে-গোলাম আলি? তিনি কি বাংলার আওয়াজ? ফেসবুকিশ্ তর্ক জুড়িও না ওস্তাদ। আক্কেলদাঁত তোমার যেমন আছে তেমনি আছে এই শর্ম্মারও। বলেছি যা, বলেছি, তা আর ফেরায়ে নেবার নয়কো। গঙ্গা-যমুনা-পদ্মা-ভগিরথী ইত্যাদি যত নদীতীর আছে এবং সেইসব নদীতীরে আছে যত বঙ্গভূমি, হিংসে করো না খানুম, সর্বত্র সবখানে যেয়ে এই আওয়াজ পশিল প্রথম। পশিল জেমসের কণ্ঠস্ফূরিত হয়ে। এপার-ওপার দ্বিপার বাংলার বাইরে যদি কোনো অপার অগাধ বাংলা থাকে, এমনকি আটলান্টিকের দুই তীরবর্তী যদি কোনো গোপন বঙ্গ থাকে, পেন্টাগনের ভেতর থাকে যদি কোনো ওপেন বাংলা, বা অ্যাফ্রিকায়, ল্যাতিনো ল্যান্ডে, মেহিকোয়, এস্পানিওল ল্যাঙ্গুয়েজখণ্ডে থেকে থাকে যদি কোনো বাংলাঞ্চল, সকলের তরে এই আওয়াজ সমভাবে প্রেরিত। সর্বত্র উপরোক্ত কথাগুলো, উপরোক্ত রিয়েল-লাইফ প্রোমো, প্রযোজ্য হবে।
এল আওয়াজ ভূলোক-দ্যুলোক দুলিয়ে, বনদেশ ও লোকালয় ফুঁড়ে, হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার একটা। গাইলেন জেমস : ‘হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার / নাচে-গানে মন মাতিয়ে সবার / চারিদিকে দর্শক করে থৈ থৈ / নাচ দেখে গান শোনে করে হৈ চৈ’ … গাইলেন তিনি, গেয়ে উঠলেন : ‘হৈ বেদের মেয়ে জোছনা … বেদের মেয়ে জোছনা …।’ গানটা আমরা কি ঠিক গাইলাম? না, গানটা আমরা ঠিক গাইলাম না। গানটা এইবার ঠিক করিয়া গাই, আসুন, চেষ্টা করা যাক : ‘(আ) হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার / (আ) নাচে-গানে মন মাতিয়ে সবার / (আ) চারিদিকে দর্শক করে থৈ থৈ / (আ) নাচ দেখে গান শোনে করে হৈ চৈ … (হৈ) বেদের মেয়ে জোছনা … বেদের মেয়ে জোছনা …।’ হ্যাঁ, এইবার বেশ হলো বলা যায়। বিকৃত সুরে জেমসের গান গাইবেন আপনি আর আমরা আদাব-নমস্কার দিব আপনেরে? বহোৎ খুব, ঔর এক মেহেরবানি কিজিয়ে … এহেন মজলিশি আদবে তেলাইব আপনেরে? নেভার, কাভি নেহি। এইটা কি রবিঠাকুরের গলাচাপা-দাঁতকিড়িমিড়ি গান পেয়েছেন? নজরুলের হামদ-নাত্-শ্যামাগান এইটা? বাংলার সংস্কৃতিপিৎলাঘুঘু সোনার চান্দুদের এত সাধের ময়না সাংস্কৃতিক নমস্তসৈ-নমঃ-নমাঃ কাণ্ডকারখানাকারবারে, বেচারাদের এতদিনকার ডায়মন্ড-প্ল্যাটিনাম্ ও গোল্ডের বিজনেসে ধস নামিয়ে দিতে, শিরে সংক্রান্তির তরে জেমসের গোকুলে আবির্ভাব ও বাড়বর্ধন। অ্যান্ড ইট ওয়্যজ্ অ্যা গ্র্যান্ড সাক্সেস্! হি মেইড ইট প্লেফুলি! হি মেইড ইট জাস্ট লাইক্ ভিনি-ভিডি-ভিসি! বিন্দাস্!
‘(আ) হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার / (আ) নাচে-গানে মন মাতিয়ে সবার / (আ) চারিদিকে দর্শক করে থৈ থৈ / (আ) নাচ দেখে গান শোনে করে হৈ চৈ … (হৈ) বেদের মেয়ে জোছনা … বেদের মেয়ে জোছনা’ — গাওয়ার সময় এই-যে ব্র্যাকেটে উচ্চারিত ‘আ’, ব্যাপারখানা কি? এতই জরুরি এইটা গান গাইবার বেলায়? জ্বি, জনাব, জরুরি। জেমসের গানের বেলায় এইটা, ‘আ’, আধো-উচ্চারের এই নিরুপম অনর্থ-অথচ-অবধারিত স্পষ্টোচ্চার জরুর ও অত্যাবশ্যকীয় অংশ। অনেক ইউনিক্নেসের প্রবর্তন হয়েছে এই লোকটার বরাত দিয়া বাংলা গানে, এর মধ্যে এইধারা ‘আ’ ম্যানারিজম্ একটা আনডিনায়েবল্ সংযোজন। জেমসের গান গাইতে গেলে এই নির্ব্যাকরণ নোক্তাগুলো অবশ্যমান্য। নইলে দেখা যাবে যে জেমসের গান আপনি গাইছেন ঠিকই, গলার শিরা আর গিটারের রগ ছিঁড়ে একাকার ভাসায়ে দিচ্ছেন ডোভারলেইন্ মিউজিক কনফারেন্সের খালনালা, হালজমানার ক্রেইজ উস্তাদ রশিদ খাঁ সাহিবের তারিফও হয়তো জুটিয়ে ফেলছেন বরাতজোরে, এতকিছু ছেঁড়াছেঁড়ির পরেও জানবেন যে আপনে গানে জেমসের একেকটা সাউন্ডএফেক্টের সিকিআধুলিও ধরতে ব্যর্থ হচ্ছেন। মনে রাখবেন, জেমসের গান গেয়ে কাশ্মীরি শাল-আলোয়ান পরিধেয়বস্ত্রাচ্ছাদিত খুশবুদার উস্তাদজির কদরদারি পাওয়া/না-পাওয়ায় কিচ্ছু যায় আসে না আপনার। জেমসের গান গেয়ে লক্ষ রাখতে হবে চিলেকোঠার সেপাইগুলোর দিকে, এদের এক্সপ্রেশন্ এদের রিয়্যাকশন্ কি হচ্ছে না-হচ্ছে সেইদিকে, এরাই বলে দেবে এদের যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকরত শরীর দিয়া আপনার গাওয়া ভালো হচ্ছে নাকি মন্দ। নগদ সক্রিয় হতে হবে আপনাকে এই গান গাওয়ার সময়, এই গান শোনার সময়, এই গান সমস্ত জড়সড়-জবুথবু অক্রিয়তার ঘেঁটি ভেঙে দেয়। এই গান গেয়ে আপনে অন্যেরে জাগাবেন কি, নিজেই তো জাগতে পারবেন না, এই গান জাগাজাগি-ঘুমডাকানির নিমিত্তে নির্মিত হয় নাই। ইহা নির্মিত হয়েছে আপনার বারোটা বাজাইতে। আপনারে ডুবাইতে। “আমি ভাসব যে-জলে তোমায় ভাসাব সে-জলে।” হ্যাঁ মেসোমশাই! ওর গান শ্যামের বাঁশিও না যে আপনার ঘুম কেড়ে নেবে, লেনিনগ্রাদের রেভোল্যুশনও না যে আপনারে খালি ‘বদলে যাও বদলে দাও’-ধরনের ভুয়া বলদগিরির জিগির শোনাবে, এ গান আপনি যা ও যতটুকু ঠিক ঠিক তা ও ততটুকুই। ঘৃণার উদয় হইল আপনার মনে, কোনো কারণে, মনে করেন, এই গান তখন ডেকে বলবে আপনায়, আয়, ঘৃণা উগরে দেই গিটারের ছয়টা তারের সবটুকু ইল্যাস্টিসিটির সাধ্যাতীত সীমানায় যেয়ে। প্রেমে পেয়েছে আপনেরে? এই গান তখন প্ররোচনা দিতেছে দেখুন : “অন্তরে মাঠে ঘাটে প্রান্তরে নিশিরাতে চলো সবে প্রেম ধরে আনি।” ক্যারিয়ার নিয়া টেনশনে? এই গান বলছে হেঁকে ডেকে-ডেকে : “ছোটাও রেসের ঘোড়া / হারজিত পরে হবে / (ও) দ্যাখো জগৎ জোড়া ময়দান আছে / দে দৌড়।” ‘অসম্ভবের যুগে জন্ম নিয়ে সম্ভাবনার কথা বলছি’ — যদিও বলেছে এ-গান আপনাকে একটা জায়গায় — এবং বলেছে যে সে নবজীবনের কথা বলছে — কিন্তু কি সেই সম্ভাবনা আর কি-ইবা নবজীবন সেই? সিনেমার সেই গানটা শোনেন নাই? শচীনকত্তার মিউজিক ডিরেকশনে সেই-যে শামশাদ বেগাম গাইছেন কবে থেকে, ‘বাহার’ সিনেমায়, একটাবার আবার গাই সহস্র-এক রজনীদিবস গাইবার পরেও : “দুনিয়া কা মাযা লে লো, দুনিয়া তুমহারি হ্যায় / দুনিয়া কো লাথ মারো, দুনিয়া সালাম করে / মুড় মুড় সালাম করে, ঝুক ঝুক সালাম করে , বিক বিক সালাম করে / কাভি নমস্তে জি তো কাভি রাম রাম করে / দুনিয়া কি বাপ হো তুম দুনিয়া তুমহারি হ্যায় / দুনিয়া-স্যে ডরো গে তো দুনিয়া দাবায়েগি, আঁখে দিখায়েগি, রব জমায়েগি, হাসি উড়ায়েগি / চেইন না লেনে দেগি, জান জ্বালায়েগি / টান ক্যে সিনা চলো, টান ক্যে সিনা চলো দুনিয়া তুমহারি হ্যায়, ইয়ে দুনিয়া তুমহারি হ্যায়” — জেমসের গানে এই জীবনস্পর্ধার ডাক পাবেন আপনে, পাবেন এইভাবে বাঁচন-সম্ভাবনার কুমন্ত্রণা।
তা, ‘আ’ নিয়া বলছিলাম আমরা, জেমসের ‘আ’। আপাত অনাবশ্যক মনে হলেও অনাবশ্যক এ নয়। জেমসের গানে এ একটা আলাদা ক্যারেক্টার হয়ে উঠেছে শেষমেশ। শুধু ‘আ’ নয়, এই-ধরনের অজস্র অনর্থ ধ্বনিচিহ্ন জেমস কর্তৃক বাংলা গানে ইন্ট্রোডিউসড হয়েছে। এইধরনের মাম্ব্লিং। এইটা হামিং নয়, ব্যাকভ্যোক্যালিং নয়, এইটা পার্ট অফ দি মিউজিক হয়ে উঠেছে জেমসের গানে, নেসেসারিলি দি মিউজিক করে তুলেছেন এইধারা সাউন্ডগুলোকে জেমস। উদাহরণ চান? মাফ কিজিয়ে জেনাব! উদাহরণ দেই না। মাগনা লেখায় উদাহরণ-দৃষ্টান্ত দিয়া পোষায় না। দিতে পারি, অন্য কোনোদিন, আপনেরা গ্রহণে সক্ষম হলে। “ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?” — মজুমদার বিনয় একফাঁকে হেঁকে গেল। দুই-তিনটে এক্সাম্পল্ দেই দেখি। ‘পি রাপ্পাপ পি রা রারা রা রাপ্পা’ — ‘পূর্ণিমানৃত্য, হে সন্ধ্যা, শুভ সন্ধ্যা!’ আরেকটা গানে যেমন : ‘ডা রা রা, ডা রা রা, ডা রা রা রা রা রা’ — ‘ভালোবাসার যৌথখামার।’ এক্সাম্পল্ অধিক দেই না আর। এতই অজস্র এই জিনিশ যে এ নিয়া আলাদা ভাববার মতন মানুষও দুনিয়ায় নিশ্চয় আছেন। ঘৃণা-আক্রোশ-বিবমিষা-ভালোবাসা-আসক্তি-বিচ্ছিন্নতা-অ্যালিয়েনেশন্-অনিকেতবোধ সবকিছু মিলিয়ে এই মিনিংলেসনেস বুঝি বিয়ন্ড মিনিং কিছু-একটা এক্সপ্রেস্ করতে চায় আমাদের সামনে।
এর কিছুকাল পরে, বেশ কিছুকাল পরে, একটা ‘আ’ পাবো আমরা আবহমান বাংলা গানে, সেইটা আততায়ী এক ‘আ’, সেইটা অতিকায় অর্থদ্যোতনাবাহক এক ‘আ’। সেই ‘আ’ আমাদের দিকে ছুঁড়ে মেরেছেন, ছুঁড়ে রেখেছেন মেরে মেস্মেরাইজ করে আমাদিগেরে চিরতরে, কফিল আহমেদ। ঘটনার বিবরণ হেথা না-প্রকাশ থাক। শুধু কফিল কর্তৃক নিক্ষিপ্ত ব্রহ্মাস্ত্রের একাংশ উল্লেখ করা যাইতেই পারে। “বাংলার আকাশে উড়ে-যাওয়া জেটজঙ্গীর দিকে / ছুঁড়ে মারছি আ / দাউদাউ করা সারাটা দুপুরে বস্তিতে পোড়া আ / কসাইখানার বাছুরের ডাক শেষডাক যত আ / বাগানের চারাগাছেরে ডেকে ডেকে বলি / ডেকে ডেকে বলি রাস্তায় নেমে আ।” মাত্র উল্লিখিত ‘আ’ আরেক জাতের, এবং অর্থপ্রদানেও যথেষ্ট তৎপর এবং মনে হয় এ যেন বহুস্বর একটা ডাক। হোক পরে এ নিয়া আলাদা সন্দর্ভ। শুধু কফিলের ‘আ’ প্রসঙ্গে একটা ভালো বয়ান ফারুক ওয়াসিফের জবানে পেশ করা যাক : “আ মানুষের মৌলিক স্বর, বাংলা ভাষার মৌলিক স্বরবর্ণ। এই আ-ই এখন অস্ত্র। আ-তে আহ্বান, আ-তে আক্রোশ, আ-তে আশা, আ আমাদের মরণচিৎকার, আ আমাদের পাল্টা যুদ্ধের আনন্দ। আ ভূমিষ্ঠ শিশুর প্রথম ডাক, সমগ্র অস্তিত্ব নিয়ে বাঁচতে চাওয়ার নাম আ, শেষ নিঃশ্বাসের সাথে যে ধ্বনিটি ছেড়ে চলে যায় তা-ও আ । ব্রহ্মার ধ্বনি ওঁ, পার্থিব মানুষের আছে এই এক জীবনসমান আ ।” (ঘাড়ভাঙা ঘোড়ার দাঁড়ান, পাখভাঙা পাখির উড়াল — কফিল আহমেদের গানের একটি বিচারমূলক আলোচনা; ফারুক ওয়াসিফ, লাল জীপের ডায়েরী, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)। এই ‘আ’ বাংলা গানে দ্বিতীয় কোথাও সুলভ? মনে হয় না। ‘পাখির চোখে দারুণ শক্তি গরুর চোখে মায়া’ অ্যালবাম ও তৎপরবর্তী কফিলের বাঁধা আরও-আরও সংগীতমালা বাংলা সাহিত্যে একটা আলাদা জায়গা পাবার হকদার। জেমসের যেমন ব্যান্ডব্যানারে অ্যালবামগুলোর মধ্যে ‘স্টেশন রোড’, ‘জেল থেকে বলছি’, ‘নগরবাউল’, ‘লেইস ফিতা লেইস’, ‘দুষ্টু ছেলের দল’ শীর্ষক মোটমাট পাঁচটা ছাড়াও সোলো সংকলন যথা ‘অনন্যা’, ‘পালাবে কোথায়’, ‘দুঃখিনী দুঃখ কোরো না’, ‘ঠিক আছে বন্ধু’, ‘আমি তোমাদেরই লোক’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘তুফান’ এবং যদিও ২০০৮ সালে বেরিয়েছে অ্যালবামটা যা বাংলায় এ-পর্যন্ত সর্বশেষ রিলিজ্-পাওয়া জেমসের এককভাবে-গাওয়া অ্যালবাম ‘কালযমুনা’।
ব্যথাঘুড়ি, ভিনবাড়ি, ভিন্ন গগন
হ্যাঁ, এইবার মনে পড়েছে, একটা গান ছিল ‘নগরবাউল’ অ্যালবামে, সেই গানে “একা একা কাঁদবে নীরবে নীরবে / উড়াবে ব্যথার ঘুড়ি অন্য আকাশে” … ইত্যাদি দুর্বিষহ সব লাইনঘাটের মিলিয়াছিল দেখা, আর ছিল জেমসের ওই-সময়কার নীলাভ নিঃসীম গলা। ওই জেমস ক্রমে ফেইডেড হয়ে গেলেন, জন্মালেন অন্য জেমস যার ভুবন জয়ের অভিযান সুবিদিত, তবে আমি ওই জেমসকে মিস্ করি খুব, ওই ‘প্রিয় আকাশী’ তথা ‘পালাবে কোথায়’ পর্যায়ের জেমস, ওই ‘গ্রিনরুমের বাতি নিভে গেছে’ পর্যায়ের জেমস, ওই ‘তবে বন্ধু নৌকা ভেড়াও’ কণ্ঠের জেমস। … পরবর্তীকালীন জেমসের ফ্লেভারও অবশ্য মন্দ বলছি না, খানিকটা রিজার্ভেশন্ যদিও রয়েছে, অ্যানিওয়ে। দেখুন, খালি মনে-পড়াপড়ি, কত-কী করার আছে বাকি, সবকিছু থুয়ে ফেলে খালি স্মৃতিপ্রীতি, ডিসগাস্টিং নয়? অ্যানিওয়ে অ্যাগেইন্। তবে, একটু আগে-যে বলা হলো ‘নগরবাউল’ অ্যালবামে ছিল গানটা, মানে কি এ-ই যে এখন সেখানে নেই? ক্রিয়াপদ লক্ষ করতে বলছিলাম। হ্যাঁ, এইটা ঠিকই আছে যে এই গানটা ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের অ্যালবামশিরোনাম ‘নগরবাউল’-এর অন্তর্ভূত। তখনও ‘নগরবাউল’ ব্যান্ড হিশেবে পদার্পণ করে নাই। ‘ফিলিংস’ দিয়া বাংলা ডেল্টায় নবদ্বীপের দোলা জাগায়েছিলেন রসকষরিক্তা বাংলাগানের শ্রীচৈতন্য জেমস। ‘হুমায়রা’ গানটা ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডব্যানারেই রিলিজ্ পেয়েছিল ‘নগরবাউল’ অ্যালবামে। এখন এইটা পাওয়া যায় মহাকালে। এখন, তোমায় প্রশ্ন করে যদি নীল ধ্রুবতারা, মহাকালের প্রাপ্তিস্থান কোথায়? এরও উত্তর খুঁজবার ন্যায় এবং খুঁজে বের করবার ন্যায় রিসার্চার বাংলায় বিরল নয়। কিন্তু উত্তরে যারা মৌন থাকেন, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, তাদের জন্যে এই সিজনের বিশেষ উপহার জেমসের গান। হুমায়রা, নিঃশ্বাস চুরি হয়ে গেছে …
সেইটাই। নিঃশ্বাস এবং অন্যান্য জৈবনিক লক্ষণগুলো জেমসের একেকটা গানের ঘায়ে দেড়-দশকেরও অধিক কালব্যাপী চিনে নিচ্ছিলাম আমরা নতুন করে। এরপর এক-সময় জেমস মিক্সড-অ্যালবাম আর সোলো ক্যারিয়ারে এতটাই বিভোর হয়ে যেতে থাকেন, রম্যপত্রিকার কাভারস্টোরি আর ফোটোসেশনে এক্সপোজারও ওই-সময়টায় এতই বেড়ে যায় জেমসের, গুরুশিষ্য কথাচরণামৃত বিতরণধর্মী ইন্টার্ভিয়্যু প্রদানে এতই হিড়িক পড়ে যায় যে ব্যান্ড রক্তাল্পতায় ধুঁকতে থাকে এবং সোলো এক্সক্লুড করে ব্যান্ডব্যানারে পাঁচটা অ্যালবামই মাত্র ঝোলাব্যাগে দেখতে পাই দিনশেষে। এরপরও অবদান অব্যাহত থাকে অবশ্য, অন্য নমুনায়, ওই প্রিমিটিভ জেমস ধীরে ধীরে অস্তমিত হতে থাকেন। মুক্তাঙ্গন ও প্রেক্ষাকক্ষ কন্সার্টগুলোতে জেমসের ম্যাজিক্ অবশ্য অনেক বিবেচনায় ইম্প্যাক্টবিস্তারী হয়ে উঠতে থাকে উত্তরোত্তর। তবু মনে হয়, তিরিশ বছরের রগড়ারগড়ি শেষে এসে এখন মনে হয়, মিউজিশিয়্যান্ জেমসের মৃত্যু হয় পার্ফোর্মার জেমসের কাছে। একটু এক্সেসিভলিই আর্লি স্টেজে। এইসব নিয়া বিলাপ করি না। যা হয়েছে, যেটুকু হয়েছে, এনাফ হয়েছে।
সেজন্যেই মনে হয়, রকার্টিস্টদেরে বেশিদিন বাঁচতে নেই, বা বাঁচলেও হাইড-আউটে চলে যাওয়া ভালো ডিলানের ন্যায়, যেসব রকার অল্প আয়ু পেয়েছেন তাদের প্রতি প্রেম অটুট আমার দেখতে পাই, ঠিক এমনই একজন ফেব্রিট রক্-পার্ফোর্মার কুর্ট ক্যুবেইন্। রকার বেশিদিন উমর পেয়ে গেলে বেহায়া কবি হবার আশঙ্কা সাংঘাতিক জোরালো। কবিরা বাঁচবে বিরাশি বছর, ন্যূনতম, তদুর্ধ্ব হইলে তোফা, বিরানব্বই ইজ্ ওয়েল্, ফেয়ার এনাফ, কবিদের স্বপ্ন অবশ্য বাইশ শতাব্দীব্যাপী লেলিহান ন্যাকামো ও বদমায়েশি, এহেন খোয়াবের আদুরে নাম মহাকাল ইত্যাদি। কিন্তু রকার যদি তিরিশোর্ধ্ব দশকসীমায় মরিয়া না-যায় ফিজিক্যালি, তাইলে সে কবিদের চেয়েও অধিক বদবু অঙ্গনে স্প্রে করবে এইটা প্রায় মেনেই নিতে হয়। ইন ট্রু সেন্স বেশিদিন রকার থাকা, বেশিদিন কবি থাকা, বেশিদিন বিপ্লবী থাকা, বাস্তবে অলমোস্ট নামুনকিন্।
তো, হুমায়রা আমাদের নিঃশ্বাস চুরি করে নিতে এসেছিল, সুসংবাদ এইটা। তারপর কতশত নির্জনাব্দ অতিক্রান্ত হলো, সুরমাগাঙের ভরভরন্ত যৌবন হলো নিস্তেজিত, হুমায়রার সঙ্গে তুলনীয় সুসংবাদ তো শুনি না। খামাখা এই এতগুলো বর্ষহপ্তামাস ধরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি-দিচ্ছি, অনিচ্ছায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, নিঃশ্বাস দেয়া-নেয়া কাজটাও হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা স্ট্যাটাস্-ক্যু। অতিকায় বিগ-ফ্যাট স্ট্যাটাস্-ক্যু। সহে না যাতনাজান্তব স্থিতাবস্থা হেন। ঘুচুক আর্টকালচার নিয়া ইন্ডাস্ট্রির ঘেরাটোপ। বাংলা গানে, বাংলা গদ্যে, বাংলা আখ্যানে-গল্পে, বাংলা কবিতায়, বাংলা সিনেমায়, বাংলা ব্যবসাবাণিজ্যে ঘেরাটোপ ঘুচুক। জয় হো, নতুন দিনের জেমস, নতুন দিনের হুমায়রা, নতুন দিনের আমাদের সব্বার।
ডাকাতিয়া আকাশী স্মৃতিগাথা
“প্রিয় আকাশী / গতকাল ঠিক দুপুরে তোমার চিঠি পেয়েছি / ঠিকানা লেখোনি / ঠিকানা পেলে কোথায় তা লেখোনি।” — কী ডাকাতিয়া সেই দিনদুপুরগুলো আমার, তোমার, আমাদের সবার! কত কত ধূসর ধূসরতর বছরের ওপার! অবিলম্বে বন্ধ করো হে এই নিঠুরা গান গাওয়া, মাঘনিশীথের পেঁচা আমার হে মরার কোকিল, কেন হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে যাওয়া! … আচ্ছা, ভালো কথা, নামটা কী ঠিক বলছি আমরা? মানে, লিরিসিস্ট লতিফুল ইসলাম শিবলী? নিশ্চিত হতে পারছি না, কিৎনা উমর গুজরি গিয়া মাঝখান দিয়া, কেন মনে হচ্ছে যেন লতিফুল ইসলাম শিবলী হবে নামটা। আর তথ্যপরিসংখ্যান নিয়া নিঃসন্দেহ হওয়া আজ আর কঠিন কিছু তো নয়। একক্লিকেই কেল্লাজয়। ইউটিউবে পাওয়া যায় না আনাজপত্তর অল্পই দুনিয়ায়।
জেমসের সবচেয়ে ভালো লিরিকগুলো মনে হয় বেশিরভাগ শিবলী আর দেহলভীর লেখা, যেমন আইয়ুব বাচ্চুর লিরিক্যাল স্ট্রেংথের দিক থেকে বেস্ট স্যংগুলো শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখা, যদ্দুর মনে পড়ে স্মৃতি হাতড়ে। জেমসের জন্যও গান লিখেছেন জঙ্গী, যদ্দুর মনে পড়ে, সোলসের জন্যও, নাসিম আলী খানের গাওয়া “চায়ের কাপে পরিচয় তোমার সাথে / পথে দেখা হলো আবার / সানকিতে হাত রেখে কিশোর ছেলে / ডাক দেয় সাথী হবার” গানটা জঙ্গীর লেখা। পার্থর গলায় “কেন এই নিঃসঙ্গতা, কেন এই মৌনতা / আমাকে ঘিরে” — এই গানটাও জঙ্গীর লেখা কি না, আজ আর মনে পড়ছে না দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু না, মনে পড়েছে, ‘নিঃসঙ্গতা’ গানটার গীতিকার কবীর বকুল, কোনো-এক স্মৃতিনিবন্ধিকায় পার্থ বড়ুয়া বলেছেন নিজেই। গীতিকারনাম মনে রেখে গান শোনার অভ্যাস আর্লি দিনগুলো থেকেই তো ছিল, সুমন-অঞ্জনদের কারণে স্যংরাইটার নোটিস্ করে বাংলাগান শোনাটা আমাদের চালু হয়েছিল বন্ধুবৃত্তে। এইসব নিয়া আমাদের সবারই যার যার জায়গা থেকে একটু-একটু কাজ করা দরকার মনে হয়। বাংলাগান নিয়া কথা বলতে গেলেই যে স্বর্ণযুগ-স্বর্ণযুগ জপমন্তর করা হয়, এইটার একটা কাউন্টার তৈয়ার করার বালি-সুরকি-ইট-সিমেন্ট মনে হয় আমাদের কালে মেঘেবৃষ্টিতে ক্ষয় হচ্ছে। অচিরে এই নিয়া আগাইয়া আসবেন অনেকেই, আমার সাধারণ পরিবহন কাণ্ডজ্ঞান এইরকমই সিগন্যাল্ দেয় আজকাল।
জেমসের এই ‘প্রিয় আকাশী’ গানটা নিয়া আমাদের স্মৃতি তো প্রচুর। যেদিন বাজারে অ্যালবামটা এল, সেইদিন অথবা সেই সপ্তাহেই তিরিশটাকা নগদ চুকিয়ে ক্যাসেটখানা খরিদ করে ঘরে তুলি। তদ্দিনে জেমস একটু-একটু কল্কে পেতে শুরু করেছেন ব্যান্ডশ্রোতা তারুণ্যবলয়ে, ‘স্টেশন রোড’ বা তারও আগের ‘অনন্যা’ শোনা হয়ে গেছে আমাদের এবং আমরা মুখে মুখে ফেরি করে বেড়াচ্ছি বিস্ময়কর গলার ও গায়কীর এক বাংলা গায়কের নাম, ততদিনে অবশ্য দুনিয়ার ব্ল্যুজ্ মিউজিক ও মিউজিশিয়্যান্ সম্পর্কে একটুআধটু শুনছি-জানছি, বিজ্ঞাপন করে চলেছি ক্লাসমেট-বন্ধু ও বন্ধুতুতো বন্ধুদের কাছে।
কেবল গোল বাঁধল ঘরের ভেতর তা তো নয়, স্টেরিয়ো ক্যাসেটপ্লেয়ারে জেমসের গান লো-ভল্যুমে শোনার বঞ্চনাকর বেদনা যে কী তীব্র তা আমার বয়সী ভুক্তভোগীদের স্মৃতিকথায় দেখা পাওয়া যাইতে পারে, এমনকি বন্ধুদের মধ্যে বেশিরভাগেরই জেমস বিষয়ে জড়তা কাটাতে বা বলা যায় জেমসের ব্যাপারে আমার বন্ধুদের এনওসি তথা নো-অব্জেকশন-সার্টিফিকেট পেতে ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’ পর্যন্ত পথ পাড়ি দিতে হয়। কিংবা আরেকটু আগে থেকে, ‘জেল থেকে বলছি’ অ্যালবামে এসে, জেমসক্রেজ শুরু হব-হব করছে ইন-ফ্যাক্ট। ঘরের ভেতর ‘ফিডব্যাক’ যথেষ্ট জোরে বেশ ভল্যুম্ দিয়া বাজানো যাইত, মজার ব্যাপার যে আমাদের আম্মা মাকসুদকে খুব পছন্দ করতেন, ‘সোলস’ তো বোন-কাজিন সবাই দিবারাত্র শুনত, কিছুদিন অবশ্য ‘অবস্কিউর’-এর কদর করেছিল তারা, আর চাইম-নোভা-সিম্ফনি-নর্দার্নস্টার-ডিজিটাল-ড্রিমল্যান্ড-মাইলস — এইসব ব্যান্ড খুব শোনা হতো ঘরে ঘরে। ‘এলআরবি’ অবশ্য শুনতাম আমরা পোলাপানরা, ‘মাধবী’ গানটা তো খুব দরদ দিয়া গাইতামও, তবে বোনমহলে এলআরবি বা আইয়ুব বাচ্চু পাত্তা পাইতে পাইতে ‘কষ্ট’ পর্যন্ত পথ পার হইতে হয়েছিল। ‘আর্ক’ অনেক পরের ঘটনা। ‘রেনেসাঁ’ ঘরভরতি মেহমানদের মধ্যে বাজাইলেও বড়চাচা বা আর-কেউ বিশেষ আপত্তি করতেন না, ‘ওয়ারফেজ’ অবশ্য শুনতে হইত ঘরের সকলের গালিগালাজ সয়ে। কিন্তু বাবনা গাইলে আমার বোনেরা শুনত, কমল গাইলেই বকাবাদ্য শুরু করত তারা।
আমি যেই সময়টার কথা বলছি সেইটা নব্বইয়ের গোড়ার দিককার বছরগুলো, যখন সত্যিকারের ব্যান্ডবাতাস ছিল বাংলাদেশের বাংলাগানে, এমনকি অচিরে-হাস্যপাত্র-হয়ে-ওঠা ‘প্রমিথিউজ’ অথবা ব্যান্ডটার ভোক্যাল্ বিপ্লবও তখন অনেক ভালো লিরিকের গান করত, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ও নিহত শহিদ ডাক্তার মিলনকে নিয়া লেখা তাদের একটা গান — “ওগো মা তুমি কেঁদো না / মিলনের রক্তে আমি / হঠিয়েছি স্বৈরাচারী / উড়িয়েছি স্বাধীনতার পতাকা” — বা নূর হোসেন উপজীব্য করে লেখা গান, বা তাদের প্রেমের গানগুলো যেমন উন্নত বাণীর ছিল, তেমনি জনপ্রিয়ও হয়েছিল। তবে, অ্যানিওয়ে, পণ্যের একটা ক্যারেক্টার তো পচনশীলতা। তা, যা বলছিলাম, ‘প্রিয় আকাশী’ গানসম্বলিত অ্যালবামের খাপে জেমসের গায়ে একটা ঢোলা স্যুয়েটার ছিল, উলেন্ স্যুয়েটার, মনে পড়ে। সেই সময়টায় কোনো পত্রিকায় ব্যান্ডসিঙ্গারের বা ব্যান্ডগানদলের স্টোরি কাভারেজের চল শুরু হয় নাই, আমরা হা-হুতাশ করতাম শালার পত্রিকাগুলো কবে-যে মানুষ হবে হেন মর্মে। সেই সময়টায় জেমস ঢোলা টি-শার্ট পরতেন, অথবা ক্যাজুয়্যাল্ যে-কোনো জামা, পাঞ্জাবি পরা শুরু হবে অনেক পরে ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’ পর্যায় থেকে। এরপর একসময় শুরু হয় জেমসম্যানিয়া। বাংলা গানে জেমসঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ খুব, মনে হয় আমার, নানা কারণেই। কিংবা মাকসুদঘটনা বাদ যাবে কেন, ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ পর্যায়ের ‘ফিডব্যাক’ তো অসম্ভব সিগ্নিফিক্যান্ট আমার কাছে, কিংবা আউটসাইড ফিডব্যাক মাকসুদের ‘(অ)প্রাপ্তবয়স্কের জন্য নিষিদ্ধ’ আনপ্যারাল্যাল্ তো আজও, অথবা আমার কাছে বিশেষ মূল্যবহ মাকসুদের ‘ওগো ভালোবাসা’ অ্যালবামের গদ্যস্পন্দী লিরিক্যাল্ ইন্টেন্সিটির গানগুলো। “আবার শুরু হলো বলে / এ যে আগুনে জল ঢালার পালা / এত ভয়! এত ভয়! এত ভয় — জানা ছিল না তো / প্রিয়তমা!” ভাবা যায়, এমন লাইন, বাংলা গানে! একটু চেষ্টা করলে সেইসব দুর্ধর্ষ কথাচিত্রগুলো মনে পড়ানো যাবে না তা নয়, কিন্তু পুরনো সেই দিনের ক্যাসেটকাভারগুলো কোলে লইয়া কথা বলতে পারলে বেশ হতো, সেই চেষ্টা একসময় করা যাবে ইন্-ফিউচার।
সেই ফিউচার না-আসা অব্দি, প্রিয় আকাশী, লেট্’স্ প্রে অ্যান্ড্ হোপ্ দ্যাট, উত্তরোত্তর বাংলাদেশী বাংলাগানের কথাসুরছায়াছবির দেহ ও দ্যোতনাগত এনরিচমেন্ট। দোয়া করি, হে বাংলাগান, ‘বাইজেন্টাইন্ সম্রাজ্ঞীর মতো / তোমাকে ঘিরে থাক / পৃথিবীর সমস্ত সুখ’ … আর, ‘তুমি অনিন্দ্য সুন্দরী হয়ে ওঠো’, পরমেশ্বরী হে প্রিয় বাংলাগান, ‘সুন্দর … তুমি ভালো থেকো …
লুটপাট, চৌচির, দিশাহারা, ভ্যাবাচ্যাকা বাংলা গানশ্রোতা
“তর্জনী উঁচিয়ে জ্বেলে দেবো সবুজ আগুন / তুমি নজরবন্দী হয়ে যাবে / তুমি ঘুমহারা হয়ে যাবে / নিশাচর বাতাসে উড়ে যাবে ভালোবাসা / প্রান্তরে-মাঠে-ঘাটে তুমি সব বিকিয়ে দেবে / — এই চোখে তাকিও না, তুমি লুটপাট হয়ে যাবে / এই চোখে তাকিও না, তুমি চৌচির হয়ে যাবে” — বাপ রে বাপ! গায়ে কাঁটা দেয় আজিও এই বৃদ্ধ-না-কালে … সেই জেমস … বাংলাগানের গ্রামার একচিৎকারে গোল্লায় উড়িয়ে দেয়ার এক ঐশী জিসাস্ আমাদের তরুণদিনের। … লুটপাট। … বেবাক লুটপাট। … চৌচির … অতন্দ্র … নজরবন্দী … । চিৎকারটাকে এমন বাগে এনে খেলানো, এমনকি হামিং-মাম্বলিং-ডুডলিং ব্যাপারটাকেও অবধারিত-অবিচ্ছেদ্য গানের অর্থবোধক ভাষা করে তোলা, ড্রামস্ আর গিটার যুগলবন্দী দিয়া উগরানো অনাস্থা আর ঘৃণা … ইত্যাদি … এইসমস্তই জেমসের অবদান টুয়ার্ডস্ হাজার বছরের বাংলা গান। জেমসের গানের কথা উঠাইলেই একসময় পিচ্চি পিচ্চি পণ্ডিতেরা বলতেন বিড়বিড়িয়ে ওয়েস্টার্ন, বলতেন ব্লুজ্, বলতেন এরিক্ ক্ল্যাপ্টন্, বলতেন মার্ক নফ্লার বা আরও অমুক-তমুক, ডায়ার স্ট্রেটস্, ব্লা ব্লা, ভাবখানা এমন যেন সবই ছিল অনাদি-অনন্ত, ঘুরায়ে-ফেরায়ে বলতে চাইতেন, এ আর এমন নতুন কি বাপু, ড্যুড, দিজ্ থিংস তো বহু আগে থেকেই ছ্যালো পৈচ্চিমে, ইত্যাদি। ভীষণ রিয়্যাক্ট করতাম অবভিয়াসলি, পিচ্চি পণ্ডিতদের পুংটা বাতচিত শুনিয়া, সেইসময়। এবং বলতামও, মনে মনে, ব্যাটা, অ্যামেরিকা আছিল তো অ্যামেরিকাতেই, কিংবা ভারতের জায়গায় ভারত, তাই বলে কলম্বাসের নাম ও অবদান, ভাস্কো-দা-গামার নাম ও অবদান তো খর্ব হয়ে যায় না রে! বেদেই ছিল সমস্ত, পুরাণ-কোরান-গস্পেলেই নিহিত অনাগত সত্যাসত্য, তোমার পুরোতগিরি পৃথ্বীধামে কেন তবে এখনোব্দি বিরাজে? এরা, এই পিচ্চি পণ্ডিতেরা — আমাদের বেড়ে-ওঠার সময়ে এদের যন্ত্রণায় আকাশ-বাতাস সীসার চেয়েও অধিক ভারী ছিল বটে — এরা না-শুনেছে পশ্চিম, না-শুনেছে পুব অথবা উত্তর-দক্ষিণ। যদি শুনত, তবে এহেন পণ্ডিতি এদের পেটের ভেতরেই হান্দাইয়া থাকত, কথায় কথায় “এ আর এমন কী, এ তো পূর্বে থেকেই পৈচ্চিমে ছ্যালো/ছিল” টাইপের ভুয়া আলাপে এত সময়ক্ষেপণ হইত না … তাছাড়া তথাকথিত আবহমান বাংলাগান যারা মনুষ্যচক্ষে একবার হলেও অবলোকন করেছেন জীবনে, সেইসব অবলোকিতেশ্বর জানেন, দুই-তিনজন পশ্চিমদৈশিক মিউজিশিয়্যানের বা এক-দুইটা গানবাজনাধারার নামোচ্চারণ করলেই জেমসের জারিজুরি ফাঁস হইয়া যায় না। আউল-বাউল-লালনের দেশে অ্যালাইভ লিসেনার যারা তারা জেমসের গান গলায় ও মাথায় তুলে নেবে না তো কি পিরালি ব্রাহ্মণের গান নেবে? পিরালি ব্রাহ্মণের গানও ভালো, তবে জগতের যাবতীয় ভালো দিয়া বিরাশি প্রহরের জন্য সংকীর্তন বসাইলে সেইটা সাফোকেশনের কারণ হইয়া দাঁড়ায় বৈকি। বিকাশ রুদ্ধ হয় শিল্প ও সুরের। যেখানেই বিকাশ রুদ্ধ হয়, সেখানেই সূত্রপাত ঘটে অভাবিত ও নতুন বিকাশের। জেমসের গান ও গায়নভঙ্গি কেবল পশ্চিমমুখো হইয়া বিচারিবার সুযোগ নাই। চিবিয়ে চিবিয়ে গান গাওয়ার এই বিত্তে-ও-চিত্তে মধ্যম রুচিশাসনের দেশে জেমস উদ্দাম ও উদাত্ত বক্ষে গান গাওয়াটাকে ফেরায়েছেন, প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন অন্যধারা সাহসের, সুরে সত্যিকারের অ্যানার্কি ঘটিয়েছেন। বুক দিয়া গান গাওয়ার এই ব্যাপারটা আরও অন্য দ্যোতনায় এসেছে এরপরে একজনের মধ্য দিয়ে, কবি তিনি, বাংলার ম্যাটাডোর, তিনি কফিল আহমেদ। সকলেই না-হোক, কেউ কেউ জানেন হয়তো, কফিলের কন্ট্রিবিউশন্ সম্পর্কে এখন অবগত হচ্ছেন অনেকেই তো। হোয়াটেভার। জঙ্গুলে ও জলবেষ্টিত বাংলাগ্রামের বাউল ঘরানা বা পল্লিগানধারার গাইয়েদের রাতভর দেহাতি মানুষের উজাগর উৎকর্ণ শ্রবণমনোযোগের সামনে গাওয়া গানের আসরে যে-একটা গায়নভঙ্গিমা, সুরের শাসনের তোয়াক্কা না-করে স্বরলিপি ভেঙে-গুঁড়িয়ে কেবল গানের ভাবের প্রতি সমর্পণ ও শ্রদ্ধা রেখে গেয়ে যাওয়া, আহ্লাদী পুতুপুতু সসম্ভ্রম গাওয়ার বদলে যেখানে শরীরের শক্তি নিয়োগ করে গাওয়া ফ্যাক্টর একটা, এইসব নজর করে দেখলে জেমসের গাওয়ার পরম্পরাটা ভালো বোঝা যাবে। এইসব মনে হওয়াটা আলটপকানো মনে-হওয়া না। বাংলা গানের গরিমাটাকে সেলিব্রেইট করার সুযোগ জেমস আমাদেরে দিয়েছেন। শুরুর কয়েক বছরের মধ্যেই জেমস তার ধারার চূড়া দেখিয়েছেন, চূড়া ছুঁয়েছেন, অবস্থান করেছেন লং টাইম্ চূড়ায়, এরপরের ইতিহাস তো জনসমক্ষে। সে-যা-হোক, মুম্বইকুসুম হইয়া-ওঠা জেমসের জন্য রেস্ট-ইন্-পিস্ দোয়া খায়ের করা ছাড়া আমাদের তো করার নাই তেমন কিছু। উনি তো আজকাল আর আমাদিগের মাঝে নাই, হিন্দি গানের পাখি হইয়া উড়িয়া উড়িয়া গাহিতে আছেন পয়সাভাসা হিন্দি রাস্তার ভিড়ে, হিন্দি আকাশে, হিন্দি বিল্ডিঙের রুফটপ কার্নিশে, হিন্দি প্রীতমসুরে, হিন্দি পানির নিচে, মেট্রোরোডে হিন্দি ইয়ার-বকশি লইয়া হিন্দি নিশীথঘন রাত্তিরে, হিন্দি প্রেক্ষাগৃহে, হিন্দি বিএমডব্লিউ চড়িয়া মর্দ গিটারকর্ম করিতেছেন বলিউডবনে, লেজার রশ্মিবিকিরিত ওয়াইনসেলারের ডিলাক্স হলরুমে বসে এই ‘আজিজ বোর্ডিং’-ওয়াইল্ড প্যুওর দেশটার স্মৃতি রোমন্থন করা নিশ্চয় তার প্রিয় প্যাস্টাইম্ এখন! উনার ভালো হউক। গরিবের ঘরের ‘মোহিনী’ হস্পিট্যালিটি উনার মুখে এখন হয়তো রুচিবেক না আর, তবু, অধিকন্তু, উনার নিকট ঋণী ও কৃতজ্ঞ আমরা বাংলা গানশ্রোতারা। বাংলা গান ঠিকই একটা পথ করে নেবে, নিচ্ছেও তো, ‘মেঘদল’ বা ‘শিরোনামহীন’ প্রভৃতি দলের ভাবগতিক তো পথের দিশা দেখাইছেই। দিশা দেখায়ে চলেছেন সদলবলে কি একেলা একেলা আরও আরও অনেকেই। কিংবা অর্ণব, স্টার্টিং সময়ের ‘ব্ল্যাক’, ‘আর্টসেল্’, অধুনা ‘জলের গান’ প্রভৃতি। চরৈবেতি।
বিদঘুটে বিকেল, মহাসড়কবর্তী মৃদু কালভার্ট, গলাখোলা গানের রজনী
বিদঘুটে বিকেল। সত্যিই কি বিদঘুটে? তো কি মিথ্যা নাকি? বিদঘুটে বিকেল বললাম, অতএব বিদঘুটে নিশ্চয়, ফের জিগানো কেন! না, মানে, আল্লার দুনিয়ায় বিকেল কখনো বিদঘুটে হয় কি না, জানতে চাওয়া আর-কি। বিকেল স্বয়ং বিদঘুটে, না বিকেলগ্রাহক জনৈক ব্যক্তির মনমেজাজ বিদঘুটে, এইটা একটা ক্যাল্কুলেশন্ করার ব্যাপার আছে তো। ধুর! বললাম বিদঘুটে বিকেল, আবার ভ্যারভ্যার করে! অ্যানিওয়ে। মনে হয় একজন মনোব্যামোবিশেষজ্ঞ দেখানোটা …; — মানে আপনি আমারে পাগল সাব্যস্ত করতে চাইছেন? — না মানে, ছি ছি, ঠিক তা না, তারপরও ওই ইয়ে আর-কি … বলা তো যায় না, সাবধানের মার নাই, বুঝলেন না? — আচ্ছা ঠিকাছে, বুচ্ছি, আপনাকে অত আমতা-আমতা করা লাগবে না নে। এই দুনিয়াটা তো পাগলের একটা কারখানা। — কে বলেছে? রেফ্রেন্সটা আগায়ে দিতেন যদি …; — ধুর মিয়া! খালি রেফ্রেন্স খোঁজ করে! ছাব্বিশ খণ্ড খুঁজে দেখেন গে যান, আর আমারে পারলে ঠেকান, নিশ্চয়ই ব্যাটা বলেছে কোথাও যে এই দুনিয়া পাগলেরই পীঠস্থান। কষ্টমষ্ট করে একটু জোড়াতালি দিয়া ব্যাপারটা আদৌ বুঝে নেয়া যাবে না তা তো না : আমরা ব্যাকেতেই পাগল আমাদের এই পাগলগারদে … ইত্যাদি দিয়া খানিক বুঝে নেয়া যায়ই তো। দুনিয়া ধারণাটাই তো চেতনার রঙ দিয়া বানানো জিনিশ। কে বলেছে? আবার জিগায়! বিরক্ত করে মারল লোকটা। আমি আছি কেন তয়, সব যদি অমুক-তমুক কয়! একবার রাঙা করব, তো সবুজ পরক্ষণে, তোমার কানের সোনা থেকে কানের লতি এমনকি চিবুকের ঘর্মস্ফটিক, সমস্ত রঙ বদলে দেবো, চুনিপান্না আজকাল তো জিঞ্জিরাতেও হয়, ঠিক আছে? সেইটাই। সামঝা? কাজেই আমারই চেতনার রঙে বিকেলটা বিদঘুটে। রেফ্রেন্স দেই না। আমি নিশিদিবা মারিংকাটিং করি। সবই তো আমার, ইয়্যে সারি জাহাঁ, সব আমাদের জন্য, আমাদেরই বানানো। দুনিয়া আমার। আমিও তো দুনিয়ার বাইরেকার কেউ না। আমি আবার কার রেফ্রেন্স দিমু? তোমারই চেতনার রঙে আমি নির্মিত হই, মিলিয়ে যাই ফের গোধূলির ধূসর অসীমে। এ-ই তো লীলা।
আজকে অবশ্য বিদঘুটে বরবাদি বিকেল একটা। আস্ত রবীন্দ্রনাথ কোথাকার! খালি চুনিপান্নাহীরাজহরত মারায় কথায় কথায়। দ্যায়ার ইজ নাথিং রকিং, নাথিং শকিং, নাথিং স্টিম্যুলেইটিং। নো হোয়াট? খালি প্রভাব, বুঝলা? আরে বাবা, আজকের লেখায় থাকতে হবে ডিভ্যাস্টেইটিং এলিমেন্টস্। বুঝলা না? থাকতে হবে সেক্স, লাইজ্ অ্যান্ড ভিডিওটেইপ্ … বিদঘুটে বিকেল দিয়া হবে না। সানি লিওনি হইলে তো অতীব উমদা হয় ব্যাপারখানা। খানিকটা দেশাত্মবোধ হইল, উপমহাদেশাত্মবোধও হইল, ফের বজায় রইল থোড়া-সা আন্তর্জাতিকতা। আজকালকার লেখা নাকি লেখাবাচ্য হবে না এইসব উপকরণাদি বিনা। লাগবে হেথা আরও কত-কিছুই-না আপিলা-চাপিলা! লাগবে রগরগে টোয়েন্টিফোরাওয়ার্স ডটকম, লাগবে লেলিহান রতিরক্তমত্ততা, লাগবে জঙ্গরঙ্গ-রণসফলতা … কান্না তো নাই, কান্না তো দুনিয়ায় বিরাজে না, আর চুনিপান্নাব্যবসায়ীদের কবর দাও উত্তরের ঘাসহীন ন্যাড়া গোপাটের কোণে। অ্যানিওয়ে … বিদঘুটে … বেঁচে-থাকার এইখানেই মজাটা যে, যত বিদঘুটেই হোক বিকেল, স্মৃতিচারণার অযোগ্য নয় তা।
তারপর বিকেল তো ফুরলো যথাসময়ে। ফুরলো কি বিদঘুটেপনা? একটি বিকেল শেষ হলো যেই, কবীর সুমনের গানের ন্যায়, একটি তারা উঠল কি ফুটিয়া? তা জানি না, নোটিস্ করি নাই। কিন্তু সন্ধে তো হলো, ফুটিল কি না-ফুটিল ‘প্রথম তারা’, সাঁঝের গাঢ় মায়া ম্লান-করে-দেয়া ‘তার দু-খানি নয়নতারা’ ফুটেছিল নাকি ফোটে নাই তা নিরিখ করে দেখি নাই। কিন্তু গলা ফুঁড়ে ফেটে বেরিয়েছিল গান, বহু বহু দিবসরজনী বিদায় নেবার বাদে এই বিদঘুটে-বিকেল-ভোলানো ঘনান্ধকার সন্ধ্যা-পারানো রাত্রি পৌনে আটটায়, উদাত্ত অম্লান বাংলাদেশের পুরাতনী চিরতরুণ ব্যান্ডগান। “ঈশ্বরের মতো / ভবঘুরে স্বপ্নগুলো / রাতের অরণ্যে / ভোজসভায় / উৎসবে মাতে” … “সহসাই নেমে পড়ে / অরণ্যের গভীরতা / ঘুম টুটে যায় / চোখের সবুজ রাতে / চিরহরিৎ … চিরহরিৎ … চিরহরিৎ” — ঈশ্বর হে! সেই আদিমকালের জেমসের গলায় নিঝুম অ্যামাজ্যনজঙ্গলের মহাবৃক্ষবাকল-ফেটে-বেরোনো চিরহরিৎ চিৎকার … অকৃত্রিম অতিকায় জেমসের সেই মেস্মেরাইজিং ব্ল্যাকম্যাজিক্ … মহাসড়কের ওপর দিয়া যাওয়া-আসা ভারতীয় কয়লা-আমদানীকারক গর্জনশীলা ট্রাক, সচকিত হেডলাইটের আলো ও পরক্ষণিক অন্ধকার, ছিনতাইকারীর-পরোয়া-না-করা গানোন্মত্ততা, ধানক্ষেত-পেছনে-রাখা আলতো কালভার্ট … বিদঘুটে বিকেলের পরবর্তী বিন্দাস্ সন্ধেবেলা। ফাহিম ইনান ওয়্যজ্ দি লিড্ ভোক্যাল্। যদিও ফাহিম ইজ্ ফ্যাসিনেইটেড উইথ বাচ্চু সিন্স হিজ্ আর্লি ডেইজ্, বাচ্চুর পাশাপাশি মাকসুদ, জেমস ও ওয়ারফেজ হলো, অর্থহীনের সুমনও খানিকটা। বা হাল্কা চালে একটু শচীন কত্তাও হলো, শচীন দেব বর্মণ ইজ অ্যান অ্যাক্ট অফ গড, অ্যানিওয়ে। “সেই হাওয়া / হামলে পড়ল আজ” … চন্দ্রবিন্দু হলো না বলে কি কিঞ্চিৎ মনখারাপ রইল? “শুধু স্নানের জলে লিখেছি ডাকনাম / উঁহু না সোনা, একা বোকা থাকব না” … আহা! রাতের তারাগুলো সব তো ওই দিনের আলোর গভীর নাভির ভিতর ঢুকে বসে আছে সেই কবে থেকে। সেহেতু বোধ’য় তারা-টারা দেখা যায় নাই মৃদু সন্ধ্যালোকিত মহাসড়কপারের কুহকিনী কালভার্টে।
মেমোরিচারণকারী মানুষজন অতএব স্টুপিড — বিলক্ষণ বোকা, লায়াবিলিটিজ্ ফর ম্যানকাইন্ড, নট দি ফিটেস্ট ফর সার্ভাইব্যল্ — করিলাম ম্লান হেসে হজম। কম্প্যুটারের সঙ্গে মহারসগোলক মনুষ্য প্রজাতির প্রধান পার্থক্য কি — এই জিজ্ঞাসায় বেদম আলোচনা হলো। কম্প্যুটার নিজের মেমোরি নিজে ডিলিট্ করিবারে অক্ষম, মানুষ তা পারে, নিজের স্মৃতি সে নিজে ইরেজ্ করে নিতে সক্ষম, অথবা মানুষের রয়েছে এক ইন-বিল্ট অটো-ডিলিটিং সিস্টেম। আদারোয়াইজ্ মানুষের স্মৃতিরোমন্থন থামানো যেত না কোনোভাবেই। এইসবই ছিল টক্ অফ দি ইভনিং বিফোর স্টার্টিং স্ট্রিটসাইড মিউজিক বোন্যানজা। ইট ওয়্যজ্ টেরিফিক্, রিজয়েসিং, য়্যু মাস্ট অ্যাডমিট। এ-নিয়া আগ্লি-বারে-ম্যে থোড়া-সা জান্-পেহচান্ হতে পারে। এতাবধি আপাতত। স্টুপিড, ক্রেইজি স্মৃতিচারণকারী হিশেবেই বিদায় নেই ইস্-বারে-ম্যে। লেকিন্, দ্য কোয়েশ্চন্ ইজ্, এপিস্টেমোলোজির একটা লাইনও কি দেখানো যাবে যেখানে স্মৃতি অনুপস্থিত? ওহো, লাইন্ তো অনেক লম্বি মামলা হ্যায়, মেমোরিহীন একটা হরফও কি দেখাতে পারবেন কেউ? উচ্চারিত ধ্বনি মাত্রেই স্মৃতিধারক, স্মৃতিদ্যোতক। ওয়েল দ্যান্, স্মৃতি ওয়্যজ্ নট রিডিকিউলড ওভার দ্যায়ার ইন্ দ্যাট ইভনিং-টেইব্যল্, মনে হয়, দি ডিবেইট ওয়্যজ্ সাচ্ অ্যা ডেলাইটফ্যুল্, উইল্ বি ডেলিনিয়েটেড সাম্-আদার ডে। এখন জরুরি জ্ঞাতব্য তথ্য এইটুকুই, জীবন মন্দ নয়; যাপন যতই হোক জীবিকাজান্তব ও শঠতাশাসিত, তবু বাঁচিয়া থাকা আর বাঁচিয়ে রাখা আনন্দময়। কেননা, বিদঘুটে বিকেল ফুরায়, আসে গলাখোলা গানের রজনী; মহাসড়কের ধারে একটি মৃদু কালভার্ট আছে এখনও দুনিয়ায়, আছে মৃত্যু আছে দুঃখ, এবং আছে জেমস।
পেশা সিরিজ্, কাভার ভার্শন্ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
এই তারপরেতে দ্যাখ ভালো / ঢাকা শহর চলে এল / দালানকোঠা দেখা গেল।। / … দালানকোঠা দেখা গেল / বিজলীবাতি চলে এল / রঙবেরঙের মানুষ এল।। / ঢাকা শহর চলে গেল / ‘কী চমেৎকার’ দেখা গেল / ‘কী চমেৎকার’ দেখা গেল।। / … এই তারপরেতে দ্যাখ ভালো / লাইলী-মজনু চলে এল / প্রেমসাগরে প্রেমডুবুরি। / প্রেমসাগরে প্রেমডুবুরি / মন-নগরে দিলপ্রহরী / দুজনার মন দুজন নিলো।। / … এই তারপরেতে দেখা গেল / ‘কী চমেৎকার’ দেখা গেল… / পাকুড় গাছের ছায়ায় ছায়ায় / যায় রে স্মৃতি যায় রে বেলা।। / … এই তারপরেতে দ্যাখ ভালো / লাইলী-মজনু চলে এল / প্রেমসাগরে প্রেমডুবুরি। / … এই তারপরেতে দ্যাখ ভালো / গাঁয়ের ঘাটে তরী এল / বধু আজি নাইওর গেল। / বধু আজি নাইওর গেল / সখা-সখি আলাপ দিলো / রাখাল বাঁশির সুর হারালো …
অনেকদিন পরে এই লিরিক্স পুরোটা গাইতে পারলাম গুনগুনিয়ে। দেখতে পেলাম অনেকদিনের ব্যবধানে এই বায়োস্কোপ। তবে এ-ধারার গানমালা অ্যালবামগুলোতে জেমসের কুশলী মিউজিক্ ও লিরিক্স চয়নের গুণে এতটাই সাফল্য কুড়াতে থাকে যে একের-পর-এক অ্যালবামে এই থিম্যাটিক্ গানসৃজন অব্যাহতভাবে বজায় থাকতে দেখা যায়। একটা বা একাধিক এমন গান জেমসের ব্যান্ড/সোলো অ্যালবামে হামেশা স্থান সঙ্কুলান করে নিতে থাকে। এক-সময় এগুলো লুপ্তপ্রায় পেশাগোষ্ঠীর মানুষের বিশ্বস্ত কথকতা আকারে আমাদের নিকট প্রতিভাত হতে শুরু করে। এক-সময় এগুলোকে পেশা সিরিজের গান হিশেবে শ্রোতারা চিনে নিতে থাকে।
‘পেশা সিরিজ্’ নিয়ে যে-ব্যাপারটা আমার মনে হয় যে, হ্যাঁ, খোদ গীত-ও-সুরনির্মাতা এইটেকে হয়তো ওইভাবে একটা আইডিয়ার আন্ডারে রেখে রচনা করে থাকতে পারেন, এর আগে-পরে এই ধারার দুর্ধর্ষ সব গান আমরা পেয়েছি এই মায়েস্ত্রোর হাত থেকে, যেমন ‘লেইসফিতা’, ‘মান্নান মিয়ার তিতাস মলম’, ‘সেলাই দিদিমণি’, ‘হাউজি’, অপূর্ব রৌশন অপেরার যাত্রা ‘বেদের মেয়ে জোছনা’, ‘নাগ-নাগিণীর খেলা’, ‘নাগর আলি কুঙ্কুম চাক্কুম চুক্কুম’ প্রভৃতি, সবই ঠিক আছে; কিন্তু গানগ্রহীতা হিশেবে এই জিনিশটিকে আমরা গানদাতার অভিপ্রেত (নিশ্চিত নই যদিও যে জেমস ব্যাপারটাকে ‘পেশা সিরিজ্’ লেবেলিং দিতে চেয়েছেন কি না) কম্পার্টমেন্টে রেখে দেখতে গেলে বেশ বিপদও তৈরি হয়, যেইটা আবহমান বিপদই বলা যায় যে-কোনো কম্পার্টমেন্টালাইজেশনের, গানটা ডানা মেলতে পারে না, গানটা খানিক খর্ব হয় কিংবা খর্ব হবার আশঙ্কা থাকিয়া যায়। যেইটা হয়েছিল মনে হয় ইন্ডিয়ান বাংলায় ‘জীবনমুখী’ লেবেলিঙের বেলায়। এক-পর্যায়ে অবশ্য ওরা ফাইট দিয়ে ‘জীবনমুখী’ ছাপ্পাটা খসাতে পেরেছে পেছনদেশ থেকে, বেশ বহু খড়কাঠ ও দিন ও ধ্যানধর্ণা খর্চা হয়েছে সেই খসানোতে, এখন ওরা হাজার বছরের বাংলা গান হইবার মর্যাদা আদায় করে নিয়েছে গানবিষয়ক বলিয়েদের কাছ থেকে, এবং ঘটনাটা আমরা বাংলা গানে নতুন একটা সময়ের অর্জনসাফল্য হিশেবেই দেখতে পারি।
কিন্তু আমরা আবারও যদি আমাদের ছোট এই তরীখানাকে — বাংলাদেশের গানের ছোট তরীখানা — ফের কম্পার্টমেন্টে নিয়া ঢোকাই, মুশকিল ঘনীভূতই হবে, পাৎলা হওয়ার বদলে। অ্যানিওয়ে। যেইটা বলতে চাই, এগুলো মহান বাংলা গানেরই উজ্জ্বল খণ্ড একেকটা, আমরা যাকে ‘পেশা সিরিজ্’ বলতে চেষ্টা করেছি সেগুলো সফলতায় এত উৎরেছে যে এখন শুধু পেশাতেই সীমায়িত নেই আর, বরং পেশাচিহ্নাদি ডিফিউজড হয়ে গেছে, জেগে উঠেছে অন্যান্য সমস্ত আবহমান চিহ্নগুলো। এই ‘বায়োস্কোপের খেলা’ গানটা আমরা প্রেমগান — আমাদেরই প্রেমের গল্পবলা গান সেইটা — ভাবতে পারি। ইন-ফ্যাক্ট, আমি গানটাকে প্রেমের গান হিশেবেই দেখেছি চিরদিন। নস্ট্যালজিয়্যা-উজ্জীবনী গানও বলা যাবে অবশ্য। অপূর্বভাবিত আধুনিক বাংলা গান সহজ কথায়। এখানে, এই সিক্যুয়েন্সের সব-কয়টা গানে, যে-বেদনা ভাষারূপ ও সুরমূর্তি পেয়েছে সেইটা পেশাগোত্রগোষ্ঠীনিরপেক্ষ অন্তিম বিচারে। এখানকার নস্ট্যালজিয়্যা, মানুষের মুখরতা ও নৈরব্য, ক্রন্দন ও খুশিঝিলিক, লুপ্ত ঐতিহ্যগরিমা ইত্যাদি সমস্তকিছুই তো আবহমানের।
একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হয় যে, নব্বইয়ের দশকে পোস্টমডার্ন ডগম্যা নিয়া হাউকাউ/হাঁউমাঁউখাঁউ অনেক হয়েছিল, তখন কবিতায় ‘ঐতিহ্য’ পুনরুদ্ধার ও পুনঃসৃজনের একটা চেষ্টা আমরা দেখেছিলাম খুব ট্রেন্ডি হয়ে উঠতে, ডেরিড্যা ও ডিকন্সট্রাকশন্ প্রভৃতি নিয়ে অ্যাঙ্গেল বদলে-বদলে এন্তার চ্যাঁচাম্যাচা আর নানাপদের গেরামভারিক্কী কথাবার্তা আমরা চালাইতে দেখেছি সে-সময়, এর ফল/কুফলও দেখেছি, হুবহু নকলনবিশিতে দেখেছি লিপ্ত অনেক কবিকে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য ইত্যাদি, ভীষণ ভুয়া কাব্য প্রণয়নের কাল হতে হতে কায়ক্লেশে বেঁচে গেছে নব্বই দশক মুষ্টিমেয় গুটিকয়েকের জন্যে, যে-কয়টা কাজ উৎরেছিল সেগুলোর বড় একাংশ ‘মৌলবাদের’ ক্রোড়ে যেয়ে ঢুকতেও দেখেছি, বিতিকিচ্ছিরিতীব্র প্রতিক্রিয়াশীলতার খুপরিতে যেয়ে টেক্সট খাবি খাচ্ছে দেখেছি, ‘ঐতিহ্য’ নিয়া মাতামাতি করার এই বিপদ সম্পর্কে আমরা বাংলাদেশের উত্তরাধুনিকতা নিয়া আলাপান্দোলনরত কবিদের কাণ্ডকারখানা থেকে প্রারম্ভেই সজাগ হতে পেরেছি।
কিন্তু ওই সময়টায় খেয়াল করবেন যে ব্যান্ডগান ‘ঐতিহ্য’ নিয়া কাজ করেছে দুর্দান্তভাবে। বুঝিয়া বা না-বুঝিয়া বাংলাদেশের ব্যান্ডগানে পোস্টমডার্নিটির যে-লক্ষণগুলো, তথা হেরিটেইজ্ ইত্যাদি ডিকন্সট্রাক্ট করা, নতুন অর্থারোপন, নবতর দৃশ্যকল্পবয়ন, সিরিয়াসনেসের বারোটা বাজায়ে সিরিয়াস কাজকারবার করা, আইকোনোক্লাস্ট এলিমেন্টগুলো গুঁজে নেয়া গানে চুপিসারে, জেমসের ও মাকসুদের গান হাতে নিয়ে এগুলো দেখিয়ে দেয়া যায়। এই জিনিশ বাংলাদেশে হয়েছে। এই জিনিশ বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিকে হয়েছে। এই জিনিশ বাংলাদেশের বা ইন্ডিয়ান-বাংলাভাষাস্থ মূলধারাবাহিত কবিতায় বেদম চেষ্টাচরিত্তির করেও বলার মতন সফল কেউই হতে পেরেছেন বলা যাবে না হুট করে। রিসার্চ প্রোজেক্ট হইলে অবশ্য জ্যাক্ ডেরিড্যা বা মার্শাল্ ম্যাক্লুহ্যান্ থেকে উদ্ধৃতি লিখে লিখে কেউ প্রমাণ করেও দিতে পারে যে পোস্টমডার্নের প্রথম পেহলোয়ান বাংলাদেশের কবি অমুক মির্জা অথবা ক্যালক্যাট্টানাগরিক তমুকেন্দ্রনাথ ঠাকুর। খালি চোখে আমি জেমস-মাকসুদকেই দেখি। এবং আরও অসংখ্য ব্যান্ডগানের কারিগরশিল্পীদেরকেও ভুলব না আমরা।
অ্যানিওয়ে অ্যাগেইন্। উপর্যুক্ত এপিগ্রাফে যে-টেক্সট কোট্ করা আছে লিরিক্সটার, সেইখানে ম্যাজিকটা নানা জায়গায় দেখায়ে দেন জেমস তার অননুকরণীয় গলা আর গায়কীর মাধ্যমে, মড্যুলেশন্ দিয়ে। এমনটা আশঙ্কা ছিলই যে শেষমেশ প্যারোডি হয়ে যেতে পারে, কিন্তু তা হয়নি, জেমসম্যাজিক্ এইখানেই। এ-ধারার গানগুলোতে অলমোস্ট সংগৃহীত কথা আর সুরভঙ্গি অবলম্বন করা হলেও কাজটা ফাইন্যালি কপিকাজ না-হয়ে মৌলিক কাজ হিশেবেই গণ্য হয় শ্রোতার কাছে। এবং অভাবিত দীপ্তির দেখা আমরা পাই এইভাবে জেমসের দৌলতে। এবং গানের গীতিভাগের সহজিয়া ভাবৈশ্বর্য উপেক্ষণীয় নয় : “পাকুড় গাছের ছায়ায় ছায়ায় / যায় রে স্মৃতি যায় রে বেলা” — এখানে পাকুড়গাছ উপস্থিত হওয়া মাত্র সমূল মনে পড়ে একদা আমাদের পূর্বজনপদের মানচিত্র-ভূগোলনিসর্গ এবং মনে পড়ে আমাদেরও অনেকেরই বিলীনপ্রায় দিবারাত্রিকাব্য।
নব্বইয়ের দশকের ব্যান্ডগানে এমন শতাধিক উজ্জ্বল কম্পোজিশনের গান পাওয়া যাবে যেগুলো পুনঃপুনঃ গাইবার যোগ্য। ঘটনাটা আমরা আংরেজি গানবাজনায় দেখতে পাই হামেশা, যাকে বলে কাভার ভার্শন্, অ্যালবামেও দেখি অবলীলায় কাভার ভার্শন্ স্থান করে নিতে, স্টেজে তো অবশ্যই। কিন্তু আমাদের দেশে একটা ভালো গান শিল্পীর জীবদ্দশায় সেভাবে দ্বিতীয় কোনো কণ্ঠে আদৃত হতে দেখা যায় কালেভদ্রে কদাচিৎ। যেমনটা ইংরেজি গানে ট্রেন্ড হিশেবেই চিরদিন বিরাজিতে দেখি আমরা, বাংলা গানেও ওইটা চালু করা যায় কি না ভাবাচিন্তা যায় না? ভালো কম্পোজিশনের মর্যাদা তাতে করে বেড়ে যাবে বৈ কমবে না। তা ঠিক। এমনকি কখনো কখনো মূল শিল্পীর জীবদ্দশাতেই কাভার ভার্শন্ শ্রোতাগ্রাহ্য হয় অভাবিতভাবে, এইটাও দেখতে পাই ইংরেজি গানে।
এইটা আমার সবসময় মনে হয়েছে গানের প্রতিই ট্রিবিউট। বব ডিলান পরিচিত হবার আগেই সমবয়সী জোয়্যন বায়েজ ববির লিরিক্সের জয়গান গেয়ে কন্সার্টে ডিলানের গানের জনপ্রিয়তা বাড়াতে দেখি আমরা, যেমন লেনার্ড কোহেনেরও। জন্ ডেনভার ‘কান্ট্রি রোডস্’ বা ‘লিভিং অন্ অ্যা জেটপ্লেন্’ গাইবার আগেই ‘পিটার, প্যল্ অ্যান্ড ম্যারি’ সেগুলো জনপ্রিয় করে তুলেছে দেখতে পাই। কিন্তু আমরা কাভার ভার্শন্ করা তো দূর, আমাদের এখানে সমসাময়িক ভালো গানটার উল্লেখ থেকেও সতর্ক বিরত থাকেন ফেলো আর্টিস্টরা। কাভার ভার্শন্ করে জেমস-মাকসুদ-বাচ্চুর গ্রেইট নাম্বারগুলো নতুন ওয়েইভ তুলতে পারে এখানকার গানে। এমনকি অসংখ্য অনামা ব্যান্ডেরও এমন অনেক গান রয়েছে যেগুলো নতুনভাবে প্যানোস্/ফোক্যাস্ করা যায়। এইটা, কাভার ভার্শন্ করার কথা, যদি ডিসিপ্লিনড একটাভাবে শুরু করতে পারি আমরা, বাংলা গান লাভবান হবে নিশ্চয়।
তা, আইডিয়া হিশেবে এইটা বাংলা গানে বেশ নতুনমতো শোনালেও যথেষ্ট বিপজ্জনকও। বিপদ কোথায়? ভেবে দেখুন, এমনিতেই বাংলা গানের শিল্পীদের জন্য রয়্যালিটি বিলিবণ্টনব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে। যেমন নেই লেখকদের ন্যায্য ন্যূনতম সম্মানী আদায়ের ব্যবস্থা এই দেশে। এরপর যদি শুরু হয় বিনা-অনুমতি মূল শিল্পীর কন্সেন্ট না নিয়া কাভার ভার্শন্ করবার ঋতু, তবে তো মাহমুদুজ্জামান বাবুর ন্যায় কালচারবণিকদের পোয়াবারো। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি বাংলায় গান গাই’ শীর্ষক গানটা বাবু অনুমোদন ব্যতিরেকে গেয়ে দেশেবিদেশে ফেমাস্ এবং তার কোটিপতি হওয়ার খবর দৈনিক পত্রিকায় না-এলেও রোজগারপাতি নিতান্ত মামুলি বা হেলাফেলার না এইটা আঁচ করা যায় বাবুসাহেবের জীবনযাপন দেখে। এরপর যদিও বাবু একাধিক অ্যালবাম করেছেন, লোকে তো পয়সা দিয়ে এলেবেলে পুঁছে না, বাবুর ডাক পড়ে ওই কুম্ভীলকবৃত্তির গুণেই। বিপ্লবপনা আর সাম্বৎসরিক চে-বিজনেস্ থেকেও স্পন্সরলিড বঙ্গীয় শীর্ষদৈনিক পত্রিকাটায় দিয়েথুয়ে কমিশন্ মন্দ না। কাভার ভার্শন্ যদি ডিসিপ্লিন্যারি সিস্টেম্ ডেভেল্যপ্ না-করে চালু হয় বাংলায়, বাবুবৃত্তান্তের পুনরাবৃত্তি শনৈ শনৈ বেড়ে যাবার আশঙ্কা। বাবুপ্রাদুর্ভাবে বাংলা গানবাদ্যবিকাশ বোধগম্যির বাইরে বেগবান হবে অথবা হবে ব্যাহত অপূরণীয়ভাবে। যে-দুইতিনটা ডাক পান বছরান্তের জলসায়-মেইফেলে জেমস ও অন্যান্য গুণী জিনিয়াস্ শিল্পীরা, তাদের রোজগারের প্রধান অংশ তো ওই কন্সার্টগুলো থেকেই আসে, তা-ও ফস্কে যাবে বেচারাদের গ্রিপ্ থেকে। কাজেই, আপাতত, যস্মিন দেশে যদাচার।
চানরাইতে আর পূজাপ্যান্ডেলে হিন্দি গানাবাজানা
একদা বাংলাদেশে এমন একটা কালখণ্ড এসেছিল যখন গলির মোড়ে মোয়ামুড়িনাড়ু আর চা-পানসুপুরিবিড়িচুরটের ঠেকগুলোতে ব্যান্ডগান বাজত অষ্টপ্রহর। শহুরে ড্রয়িংরুমগুলোতে, গ্রামগঞ্জ ও শহরতলির বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানে, এমনকি কাঁচাটাকা-বানানো লোকেদের সপরিবার পিকনিক-লংড্রাইভেও বাংলা গান জায়গা করে নিয়েছিল। অতঃপর পুনরপি বিগড়ে গেল জমানা। আবারও পূর্ববৎ হিন্দিগান হলো পুনরধিষ্ঠিত। তবে এক-সময় ব্যান্ডের অনেকানেক গানের পাশে ঈদের মরশুমে এবং পুজোয় জেমসের ‘ঠিক আছে বন্ধু’ গমগম করে বেজে যেত অন্তরীক্ষ জুড়ে। বেজে যেত ‘পথের বাপই বাপ রে মনা পথের মা-ই মা’, বাজত ‘দুঃখিনী দুঃখ কোরো না’, বাজত ‘কথা নয় মুখে মুখে কথা হবে মনে মনে’, বেজে যেত ‘সুস্মিতার সবুজ ওড়না উড়ে যায়’, ‘মীরাবাঈ’, ‘বিজলি’, ‘বিবাগী’, ‘জিকির’, ‘এপিটাফ’, ‘পাখি উড়ে যা রে’ … । এই ঘটনা আজব ও অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য বটে।
জেমস নিজেও বঙ্গবিজয় সেরে বহুদিন হলো উড়িষ্যা, বিহার, মুম্বই ইত্যাদি বিজয়াভিযানে বেরিয়েছেন — শুনতে পাই, সত্যি-মিথ্যা জানি না। ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস সর্বশেষ কবে কোন গোধূলিধূসর অতীতে গেয়েছিলেন কয়েকখানা বাংলা গান, গো+এষণায় বের করা লাগবে সেই কালখণ্ড। অথচ কোন সেই কারণে একজন কবীর সুমন চিরদিন বাংলায় লেখে এবং একলষেঁড়ে বাংলাতেই বাজিয়ে গেয়ে যায় আগাগোড়া, সাতষট্টি-প্রৌঢ় বয়সে এসে একটা সিনেমায় মিউজিক ডিরেকশন দিয়া পাঁচলাখ রুপিয়া সাইনিং মানি নিয়া আমাদেরকে অবাক করে জানায় যে এইটাই তাঁর এ-পর্যন্ত সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক, যেখানে আমাদের এই স্বাধীন বাংলার পোকায়-খাওয়া অলিগলির নকলিস্ট-ভাংড়া গাইয়ে-বাজিয়েরাও হপ্তায় পঞ্চলক্ষ পকেটে পোরে প্যাকেজ্ নাটকের মিউজিকপিস্ করে দিয়ে, এবং কোন সেই বিমূঢ়কর কারণে জেমস প্রমুখেরা পাঁচখানা বাংলাগান গাহিয়াই মনে করেন বাংলামুল্লুক পাশ দিয়া সারিয়াছেন, এইসব খুব ভাবায়। কেন — কর্পোরেট ক্যাপিট্যাল্? না মনে হয়। অ্যাট-লিস্ট একমাত্র/প্রধান না তো অবশ্যই। বৃহত্তর বাজারসদাই? তা-ও না মনে হয়। অ্যানিওয়ে।
একটা সাক্ষাৎকার পড়েছি কিছুদিন আগে, কবীর সুমনের, যেখানে সুমন তাঁর এই শিখরস্পর্শী স্কিল্ ও এক্সপেরিয়েন্সঋদ্ধ সত্তরছুঁই বয়সে এসে বাংলা গান নিয়ে কি করছেন প্রতিদিন, রোজকার রেওয়াজের বহর আগের চেয়ে কমেছে না বেড়ে গিয়েছে তাঁর, ইত্যাদি নিয়ে সেই ইন্টার্ভিয়্যু। ‘অনুষ্টুপ’ ২০১৪ প্রাক-শারদীয় সংখ্যায় সেইটা ছাপা হয়েছে, অনেক বড়সড় কলেবরের ইন্টার্ভিয়্যু, সুপ্রিয় রায় নিয়েছেন ইন্টার্ভিয়্যুটা। আগের চেয়ে অনেক বেশি রেওয়াজ করতে হয় এখন সুমনকে, জানিয়েছেন তিনি নিজেই, বার্ধক্যজনিত-বৈকল্যের-শিকার গলাটাকে একটু স্বনিয়ন্ত্রণে রেখে নেহায়েত নিজের গানের কাজটুকু চালিয়ে নেবার গরজেই সে-রেওয়াজ। মুখ্য উদ্দেশ্য, এইসব এক্সার্সাইজের, বৃদ্ধবয়সে গলার নমনীয়তা যতটা পারা যায় বজায় রাখা। না, স্টেজে উঠে লাফানো-গর্জানো অথবা ছায়াছবির পর্দায় স্পেশ্যাল-এফেক্টকৃপাধন্য উড়ে বেড়াবার বাসনা তাঁকে পেয়ে বসে নাই। গিটার আর কিবোর্ড/পিয়ানো বাজাতে গেলে আর্থ্রাইটিসের প্রভাবে করাঙ্গুলি কাঁপতে থাকে সুমনের, টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে দেখেছি আমরা। ব্যাধিটাকে বাগে রেখে একটু মনমতো সংগীতযন্ত্র বাজানোর জন্য তাকে হাতের ব্যায়াম করতে হয় কিছু রাবারের সরঞ্জামাদি দিয়ে। এরপর গলার ব্যায়াম করেন দীর্ঘ সময় নিয়ে। সেইসব ব্যায়ামের বিস্তারিত জানা যায় ইন্টার্ভিয়্যু পড়ে। রেওয়াজ করেন, কণ্ঠসাধার রেওয়াজ, মূলত ভারতীয় রাগসংগীতে। খেয়াল আঙ্গিকেই রেওয়াজ। তবলায় বিলম্বিৎ, একতাল কিংবা ঝুমরা কোনো-একটা ঠেকা ধরে অত্যন্ত বিলম্বিৎ লয়ে বা মধ্য লয়ের রেওয়াজ। কিসের জন্য এই এত কসরত? বাংলা গানের জন্য। নতুন বাংলা গান হয়তো হবে না আর তাঁর হাতে, হয়তো হবে, এতকিছু তবু নতুন বাংলা গানেরই নিমিত্তে — এই কথাগুলো সুমন না-বললেও আমরা শুনতে পাই, শুনতে না-পাবার মতো বয়রা আজও হই নাই নিশ্চয়! দেখুন কি বলছেন কবীর সুমন : “একটা জিনিশ এখন আমার ভাবনায় আসে। সেটা হচ্ছে আমার সময়ের। আর কতবছর থাকি। আমার বাবা-জ্যাঠারা আশি-একাশি বছর বেঁচেছেন। আমি যদি অতদিনও বাঁচি, তাও এখন আমার পঁয়ষট্টি পেরিয়ে গেছে এখন আর অত সক্রিয় থাকতে পারব না। ফলে আমি রোদ্দুর থাকতে থাকতে কিছু খড় শুকিয়ে নিতে চাই। বাজনা আমার প্রিয় জিনিশ। অনেক-রকম বাজনাযন্ত্রের আওয়াজ নিয়ে, ধ্বনি নিয়ে, আমি পরীক্ষানিরীক্ষা করি — এটা আমার নেশা। এর জন্য আমার অনেক খরচ হয়। ফলে ধ্বনি-বাজনা-মিউজিক — এসব নিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি কত বছর বাঁচব, সক্রিয় থাকব? ফলে বাকি আর অন্য কিছুতে আমি আর নিজেকে জড়াতে চাই না।”
পাক্কা নিশানা সুমনের। আর আমাদের, আপনার-আমার তথা জেমসের, নিশানা আপ-ডাউন করে মানি-ইনফ্লেইশনের সঙ্গে। এই কথাটা আমার আজকাল আরও বেশি করে মনে হয় যে আমাদের সম্বল, আমাদের বুনিয়াদ ও বনেদ, আমাদের দম ইত্যাদি তাবৎকিছুতেই হীন-দরিদ্র অবস্থাটা যেন অনপনেয় প্রকট। আমাদের কবিদেরকে পঞ্চাশ হবার আগেই সেলফোনফ্যান্টাসি নিয়া বইয়ের পর বই ভরিয়ে পইদ্য লিখে যেতে হয়। জেমস প্রমুখ আমাদের ব্যান্ডমিউজিশিয়্যান্ পঁয়ত্রিশ হতে-না-হতেই ইন্টার্ভিয়্যুতে বলেন যে বাংলা গানে তার যা-কিছু দেবার তা দিয়ে সেরেছেন, চূড়া ছুঁয়ে ফেলেছেন তার সাধ্যপর্বতের, আর নতুন কিছুই দিবার নাই তার পক্ষে। এখন, একজন সত্তর বছরে এসেও মনে করছে আরও কিছু করা যায় কি না ট্রাই করা যাক, আরেকজন কুড়িতেই বুড়িয়ে যেতেছে — এইটা আমার মনে হয় পুঁজিপাট্টার তারতম্যের কারণেই ঘটে। অ্যানিওয়ে অ্যাগেইন্। পুঁজিপাট্টা মানে কিন্তু মনিট্যারি পুঁজিপাট্টা না, কালচার্যাল্ ক্যাপিট্যাল্ বলে যারে। শেষের দেড়-দুই দশক ধরে রাহমান আর মান্নান সৈয়দ যা কারবার করে গেছেন, তা-সব দেখে ও পড়ে ভিমরি খেয়েছি তিনসহস্রবার এবং আল্লার আরশে দুই হাত তুলে খালি দোয়া করেছি নিজের জন্য, আল্লা, রাহমানরাহিম, তুমি আমারে পঞ্চাশপূর্তি ভিমরতি-উৎসবের আগেই তোমার সেক্রেটারিয়েটে প্রেষণে নিয়া যাও গফুরুর-রহিম! তবু নাতনি ও অন্যান্য নৌটঙ্কি নিয়া ফ্যাটিশ্ পয়্দাইতে না-হয় যেন। কবীর সুমনের ওই ইন্টার্ভিয়্যু পড়ে এমনকি হিন্দি ও অন্যান্য ভাষার আসনপিঁড়ি হলে পরে বাংলা গানের বিপত্তিগুলো অপূরণীয়-অচিকিৎস্য কোথায় কোথায় ঘটতে পারে এতদবিষয়ে বেশ-কয়েকটা আন্দাজ আমি করে নিতে পেরেছি।
কিন্তু ঘটনা সত্য, সংক্ষেপে এইটুকু কনফেশন্ করে রাখা যাক আপাতত সমস্বরে, ভিগি ভিগি ঈদের চান্দরাইতে কিংবা সার্বজনীন দুর্গাপূজার প্যান্ডেলে হামারি আধুরি কাহানি লিপিবদ্ধ থাক : জেমসের পরের গাইয়েরা তাইলে কি কি জিনিশপত্র-গানছত্র তৈয়ার করে চলিছেন? অবশ্যই ‘শিরোনামহীন’ স্মরণীয়। অরিজিন্যালিটির প্রশ্নে জেমসের টাচলাইনের পরে এই ‘শিরোনামহীন’ ব্যান্ডের কাজগুলো সংগীতে এবং বেয়াড়া গায়নে-বাণীতে ব্যাপক সন্দীপিত। দুঃখগাথা পাশে ঠেলে রেখে একটু ফুর্তি করা যাক, ঈদফুর্তি, বিজয়াফুর্তি, হিন্দি বিন্দাস্ গানাবাজানায় জেমস বছরভর মৌজে থাকুন। ঈদমুবারাক অথবা সার্বজনীন শুভ বিজয়া পাঠক-শুভানুধ্যায়ীদিগেরে, জেমসকে, আকাশভরা সূর্যতারা আর বিশ্বভরা হিন্দি শ্রোতাপ্রাণ সকলেরে। হিন্দিগানের সমুজদার, শুভানুধ্যায়ী, বিজ্ঞাপনদাতা, বাণিজ্যঅ্যাজেন্ট ও কলাকুশলী সকলেরে এবেলা খোলা বাজারে উয়িদাউট অ্যানি কম্পিটিটর মনোপোলি খেলা সাজানো ও গোল দেবার নেমন্তন্ন এইখানে গেল রাখা।
বাইজেন্টাইন্ সম্রাজ্ঞীর মতো
সম্রাট না, গ্ল্যাডিয়্যাটরের গনগনে গতিবিদ্যুতের কাহিনিকুমার তিনি। মহান গোঁয়ার, গোঁ-ধরে-থাকা অ্যালিয়েনের স্তব্ধ রোশনাই। বিদূষক ও ভাঁড়েদের জন্য বরাদ্দ দুনিয়ার ভালো ভালো উঁচা উঁচা অ্যাডজেক্টিভগুলো। মহামানবদের জন্যই রিজার্ভড সমস্ত দোয়াবাক্য। ড্যাম্ ইট্। দরকার নাই। পৃথিবীর ঘোড়াদের পিঠ থাকুক আবহমানের গাধাদেরে বহনের জন্য প্রশস্ত। সম্রাট না তিনি, বিদূষক না যেহেতু। নগরবাউল বললেই চিনে নেয়া যায় তারে, জেমস তিনি, গেয়েছিলেন সেই-যে একটা গান, অদ্ভুত কবিতা সেই, ‘প্রিয় আকাশী’, গীতিকার অবশ্য লতিফুল ইসলাম শিবলী, হিস্ট্রিপৃষ্ঠায় জেমসের দুর্ধর্ষ কয়েকটা গানের লিরিসিস্ট ইনি, কিন্তু কথা এইখানে সেইটা না; কথা হচ্ছে ‘প্রিয় আকাশী’ নানা কারণেই লিরিক্যাল-চন্দ্রপুষ্পমধুমণ্ডিতা বাংলা গানের কন্টেক্সটে, প্রেমের গানের উভয়-বঙ্গীয় গোলার্ধে, ট্রেন্ডস্যেটার ভায়োলেন্স এক, সুমধুর নৃশংসতা, আবহমান জোয়ান-বুড়ো মহান বাংলা গানে এইটা আরেক ফাল্গুন, ঘুমভাঙানো ভোমরাটার গুনগুনানি স্প্রিংটাইম নয়, এ হচ্ছে অশোক-কিংশুক-উপড়ানো বসন্তমদমত্ততা বাংলা গানে; একারে-ওকারে বিবিধ বাহানা আর আকারে-প্রকারে জেমস নামোচ্চারে যারা মার্ক নফ্লারে যেয়ে ঠেকায় তাদের আখাম্বা মাথা ও মুণ্ডি, কিসের-লগে-কি বলিয়া যারা সবিরক্তি গিয়া থামে এরিক ক্ল্যাপ্টনেই, ইংরিজিগাণ্ডু উহাদের থোতা-মুখ ভোঁতা করিবারে নাকি বিচ্ছুদল বিজুলিগিটার ও বঁটিদাও লইয়া শানাইছে সুরাসুর একাগ্রচিত্ত গোকুলধামের দাওয়ায় দিব্যোন্মাদ বসিয়া দিবারাত্র! ওই আসে ভৈরব হরষে, শোনা যায় জ্যান্ত ধ্বনি এইটুকুনি এই মর্গের সংস্কৃতিনিসর্গদেশে, চেয়ে দ্যাখো, উঠেছে নতুন সূর্য, উঠেছিল, পথে পথে রাজপথে, ভেবে দ্যাখো, ভেসেছিল সর্বনাশকতানাশী বিদ্রোহরঙ, তোমার তবু ঘুম ভাঙল না বাছা! গান শোনার কথা ছিল সারারাত তোমার, শোনানোরও, নৌকাও ছিল ঘাটে ভেড়ানো, তুমি তবু শুনলে না গান প্রিয়তমঃ, নমস্তস্যৈ নমো-নমঃ, তুমি তবু চুল খুলে পথে নামলে না, হায়, ভিয়েনার তারাজ্বলা রাত্রির আকাশের দিকে তাকিয়ে কেন তবু মনে তার পড়েছে তোমায়, এই মনে-পড়াপড়িটুকু জন্মজন্মান্তরের, হাজার বছর ধরে হেঁটে ফিরিতেছে সে বনলতামাদুলি গলায় ঝোলায়ে ব্যস্ত-ঘোরগ্রস্ত বোহেমিয়ানদের মতো ঘুরে ঘুরে বাংলাহাওর থেকে মাদ্রিদ-হামবুর্গ-নিউক্যাসল্-নেপোলি-প্রাগ-বুখারেস্ট-মেসেডোনিয়ায়, দেশে-দেশান্তরে গেয়ে ফিরিছে সে নানা ভাষা নানা সুরে কেবল বাংলা আকুতি ও দর্দ মিশিয়ে গলায়, এই সিস্ট্যাইন্-চ্যাপেলের সামনে দাঁড়িয়ে একবার নক্ষত্রের পানে ফের ছত্রিশবার বেদনামুখের নেকাব-সরানো উঁকিঝুঁকি চিরটাকালের, এই চিরটাকাল সঙ্গে রইবার লকলকে লেলিহান সাধ, ‘তারই লাগি কেন এত সাধাসাধি / অবুঝ আঁধারে কেন মরি কাঁদি’, ‘তোমার কুসুমবনে আমি আসিয়াছি ভুলে / কাঁদাতে এসেছি আমি হৃদয়নদীর কূলে’, এই ফিলিংস্, এই জেমস, রবি রক্স, কাজী ব্লুজ, নগরবাউল, এই ডিলান, কবীর ও কোহেন, বব মার্লে, লালন সাঁই আর জন লেনন, এই ডেনভার। এই সুর, বেঁচে-থাকার, এই ভোর, মুহূর্তগুলো দুপুর ও দয়িতার, এই নিভন্ত চুল্লি ও চ্যাপ্লিনের জ্যোকার, এই নিধুয়া মাটিজলহাওয়ার সার ও সারাৎসার, জীবনে কেঁচোযাপন ও ফ্রেন্ডশিপফুর্তির ফার্টিলাইজার, এই বিপন্ন বিস্ময় এবং অন্তর্গত রক্তপুরস্কার, এই কীর্তন ও অষ্টপ্রহর সংসার, টোয়েন্টিফোরাওয়ার্স ফড়িয়াদের টালবাহানার, এই গল্প স্বরলিপিহীন সুরকীর্তিত ভুবনডাঙার। এই হৃদয়, প্রেমের শীর্ষ, গান ও গায়িকার। এ-জীবন অপরূপায়িত কথার, মূর্ত ও বিমূর্ত মন্ময়তার, আর তারচেয়েও অধিক-অধিকতর গভীর-গহনগামী নীরবতার। ভুলভাল হলেও তবু সুরের, বেতাল একবিংশ হলেও তবু তোলো তাল, খোলো পাল, সময়ের ঝুঁটিটা বাগিয়ে ধরো শক্ত হাতে হে! হ্যাঁ, জেমস তো বলে, ব্যাপার না, ডাজ্’ন্ ম্যাটার একটুও, তোলো ভুল সুর, করো ভুল তাল, ঠিক আছে, আমি বলি ঠিক আছে! একক-দশক ফর্দাফাই করো, চূর্ণ করে পেইস্ট বানাও, শতকেরে শান্টিং-পিটানি দিয়া বানাও সোজাসাপ্টা আলিফ। শুদ্ধতাবাদ্যির বিরুদ্ধে দেখাও মধ্যমাঙ্গুলি, ইংলিশে। এবং কিচ্ছুটি পরিণামদর্শনচিন্তা না-করে, ফলের লাগিয়া গাছের সকাশে লাফালাফি না-করে, স্বেচ্ছায় বেবাক লুটপাট হয়ে যাও, চৌচির হয়ে যাও। বঙ্গীয় সুরব্যাকরণিকদিগেরে দে ধুইয়ে লেজেলেবেঞ্চুশে। এবং দিস্ ইজ্ দ্য ওয়ে, জেমসের, র্যাস্তাফ্যারিয়্যা, মার্লের। কথা সেইটা নয়। এইখানে কথা এইটাই যে, জেমসের সেই ‘প্রিয় আকাশী’ গানের একটা লাইন মনে পড়ছিল : ‘তোমার প্রিয় গায়ক জিম মরিসনের শেষ দিনগুলো কেটেছে এই প্যারিসে।’ … এবং সেইটা না, মনে পড়ছিল : ‘তুমি ভালো থেকো’ — বলবার সময়কার সর্বশরীর-নিংড়ানো আকুতি, মনে পড়ছিল, আ, ‘বাইজেন্টাইন্ সম্রাজ্ঞীর মতো / তোমাকে ঘিরে থাক পৃথিবীর সমস্ত সুখ’ — এই লাইন ছুঁড়ে দেবার সময়কার সম্রাটোচিত দরাজ দ্বিধাহীনতা। না, আমরা সেই ‘দি ডোর্স’ বরপুত্রের সর্বনাশা গান-কবিতা আপাতত তুলছি না আলাপে, একদিন নিশ্চয়ই জিমের সঙ্গেও মোলাকাত হবে আমাদের অ্যাথেন্সের কফিশপে কিংবা আজিজ বোর্ডিঙে অথবা বাংলার যে-কোনো রোডসাইড টিস্টলে আড্ডা দিতে দিতে। জেমসের সুদূর শৈশব, দামাল কৈশোর, সুরোন্মাদ তারুণ্য স্মরণ ও স্মৃতিচারণ করতে করতে এ-যাত্রা আমরা এই স্মৃতিনিবন্ধ থেকে বেরিয়ে রাস্তার ভিড়ে মিশিয়া যাই বরং। অথবা ‘বাইজেন্টিয়ামের উদ্দেশে নৌযাত্রা’ আবৃত্তি করি, ইয়েটসের ‘দ্য টাওয়ার’ বইপৃষ্ঠা আঙুলে চেপে, ‘সেইলিং টু বাইজেন্টিয়াম্’, নিশ্চুপ মধ্যরজনী ভিড়িতেছে যখন ক্রমশ প্রভাতবেলার তীরে; সে-দেশ নয় বুড়োদের, বাইজেন্টিয়াম্ সেই দেশটার নাম, যেইখানে লেপ্টে রয় দিবানিশি যুবকযুবতী বিভোর বাহুপাশে একে অপরের, সেখানে সকলে রয় ইন্দ্রিয়বিলাসী সুরে মেতে সারাবেলা, শোকতাপমৃত্যুহীন মননকীর্তিগুলো সকলেই সেই-দেশে করে হেলাফেলা। আকাশীর নাম ধরে জেমস গায় সেইখানে সেন্সুয়্যাল্ যৌবনের মহাস্তবস্তোত্র। ভোলা মন, ওরে আমার হৃদয় সংক্ষুব্ধ, চলো!
মরুপথে বেদুইন
জেমসের ব্যাপারে যে-কথাগুলো শুরুতে একেবারেই নিন্দার্থে ব্যবহার করতেন জেমসবিরাগী ব্যান্ডসংগীতের শ্রোতা, প্রায়শ বন্ধুবান্ধব তারা আমাদের এবং অভিভাবকবৃন্দ তো শুধু জেমস কেন গোটা ব্যান্ডগানেরই বিরোধী ছিলেন, আশ্চর্য যে একটা সময়ে যেয়ে একই সেই কথাগুলো লগ্নি করা হতে থাকে জেমসের গুরুত্ব-ও-গুণবাচক বৈচিত্র্যবৈশিষ্ট্য নিরূপণের কাজে। যে-বাটখারাগুলোর পরিমাপে জেমস ছিলেন নিন্দিত, অভিন্নপ্রায় বাটখারা দিয়েই তিনি অচিরাৎ নন্দিত হয়ে ওঠেন। ঘটনাটা ঘটিয়ে তোলেন তন্বিষ্ট জেমসশ্রোতারাই, বলা বাহুল্য, বিকাল ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামবার মুখেই শিল্পী নিজেও এমন-সব অভাবিত তাস বের করছিলেন যে টেবিলের বাকি-সমস্ত জুয়াড়িরা বাকস্তব্ধ হয়ে কেবল জীবনানন্দ জপ করছিলেন। অবিরত ষড়ঋতুদেশে কেবলই বিপন্ন কতিপয় বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করছিল উঠতে-বসতে; জেমস লম্বাঝাকড়া মাথার চুলে দেখা-যায়-না-এমনভাবে মুখ ঢেকে চোখ বুঁজে সাউন্ডস্ট্যান্ডের সামনে অচঞ্চল স্থির দাঁড়িয়ে গিটারের তারলগ্ন অঙ্গুলিগুচ্ছ সহযোগে যা করার তা করে যাচ্ছিলেন পবিত্র বঙ্গসংস্কৃতির নিন্দানন্দনকানন থেকে অ্যাবাউট-টার্ন পিঠ ফিরিয়ে। একটা আদিগন্তব্যাপ্ত যুগজন্ম চোখের সামনে দেখছিলাম আমরা ঘটতে। এবং তখন অসম্ভব শঙ্কার ভিতর দিয়াও সময়টা যাচ্ছিল; শঙ্কা এই কারণে যে, শেষে জ্ঞানী নিন্দুকের কথাই বাস্তবে মেনে নিতে হয় পাছে! জেমস তো তখনও অতটা যাবেন, আদিম দেবতাদের এই দেশে, দেবদ্বিজে একলব্য ভক্তির এই বনে, এতটা ভাবার ন্যায় আস্তিক্যবলে বলীয়ান ছিলাম বললে বেশিই বলা হবে।
বেতাল, বেসুর, বেলয়, বেলেহাজ-বেয়াদব-বেদিশা গানবাজনা করেন জেমস — এ-ই ছিল জেমসবিরাগীদের অভিযোগ। উগ্রতা আর মাতলামি, গাঁজাখোর ভাবভঙ্গি দিয়া মঞ্চে কন্স্যার্টে গুরুর ভং ধরা — তাদের অভিযোগের ফর্দ অনেক লম্বাচওড়াই ছিল। ওভারড্রিভেন্ ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ্ এবং একপ্রকার ডিজাইনড গলায় গেয়ে জেমস ক্ল্যাপ্স কুড়াতে চাইছেন, দুইদিনের বাদশা হতে চাইলে মহাকালের গানভুবনে জেমসের জন্য কোনো আসন বরাদ্দ থাকবে না — হ্যানত্যান এইসব অভিযোগের তোড়ে জেমস-অনুরাগীদের দশা ছিল কোণঠাসা। আরও বলা হতো, আজম খানের আসরের নিত্য সিদ্ধিগ্রহীতারা নতুন গুরু খুঁজছে বলেই উপস্থিত মুহূর্তে ভুলভাল গুরু বাছিয়া লইয়াছে, অচিরেই বাছারা তাদের ভুল বুঝিতে পারিয়া অন্য মাজারে ছুটবে। এত নৈরাজ্য, এত অ্যানার্কি, এত অরাজকতা, এত বিশৃঙ্খলা, ক্যাকোফোনি, ডিস্কোর্ডেন্ট মিক্সচার অফ সাউন্ডস্, সোজা ভাষায় স্রেফ নয়েজ্ দিয়া বাংলা গানের পারিবারিক ঐতিহ্যবাহী বাগানে একদণ্ডও খাড়ানো সম্ভব না, — তাহাদের এ-ই ছিল কথা।
কালক্রমে এই ক্রিটিকগুলো পজিটিভ কনোটেশন্ নিয়া হাজির হতে দেখব আমরা। বাংলারাজ্যে এদ্দিনকার গানে যে-নিয়মানুশাসন, এমনকি রকগান/পপগান/ব্যান্ডসংগীতের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটানো যায় যে গোটা ব্যাপারটা একটা অভ্যস্ততায় এসে গিয়েছিল শ্রোতাদের কানে, সেইখানে জেমস যা শুরু করলেন সেসবের নজির বাংলার পূর্বেতিহাসে নেই বিলকুল। ক্রমে জেমসের গানে এমন-এক ক্যাকোফোনিক্ মেলোডি ক্রিয়েট হতে দেখলাম আমরা, আর্তগর্জনের সুরবিন্যাস, বাদবাকি তিরিশ বছরের অধ্যায়ে এই চিৎকার মান্যতা আদায় করে নেবে মেইনস্ট্রিম্ মিউজিকের দহলিজগুলোতেও। অন্তত গোটা-সাতেক গানের ব্যবহার আমরা অচিরেই দেখব বাংলাদেশের এফডিসি-আঙিনায়, মেইনস্ট্রিম্ ম্যুভিতে ক্রেজ্ তৈরি হতেও দেখা যাবে জেমসের গান ঘিরে, এবং ম্যুভিগুলো বাণিজ্যিক সফলতা পাবে থোড়-বড়ি-খাড়া কাহিনি নিয়ে জেমসম্যাজিকে, — এইটা আমরা আন্দাজ করে নিচ্ছি আপাতত; পরে এক-সময় এর পক্ষে একটু সবিস্তার আসা যাবে এহেন অভিলাষ প্রকাশ করে রাখি।
কিন্তু বলা হচ্ছিল বাংলা গানের পূর্বেতিহাস নিয়া। বাংলা গানের লিখিত ইতিহাস, লক্ষ করে দেখবেন, অত্যন্ত সচেতনভাবে ছেঁকে-তোলা শ্রেণিপক্ষপাতগুণান্বিত অ্যারিস্টোক্রেইসির ইতিহাস। এমনকি যখন জনপদাবলিগীতিকা বা বাউল-ফকিরি ইত্যাদি গানের ইতিহাস লেখা হয়, সেইখানে অ্যারিস্টোক্রেইসির সাক্ষাৎ পাতায় পাতায় চাক্ষুষ করা যায়। এবং শহুরে বাঙালির মধ্যসংগীত বলে ডাকা হয় যে-জিনিশটা গানপণ্ডিতদের মহলে, যেইটার বৃহদাংশ হচ্ছে আধুনিক গান, সেইখানে যেন ডোমিন্যান্ট এই আশ্রাফপনা। বাংলা গানে এই ব্রাহ্মণ্য ভাবধারা আজও বহাল তবিয়তে দেখতে পাই; বাংলা কবিতা থেকে এর দৌরাত্ম্য ও অযথা দাপট গত দেড়-দশকে বেশ খর্ব হয়েছে বলা যায়, এবং এই খর্ব-হওয়াটা বাংলা কবিতা ও কবিদের জন্য গর্বের বটে। এই কিসিমে কথা বলে যেতে চাইলে এক্সাম্পল্ ছাড়া আলাপ-ঝালা আদৌ উচিত হচ্ছে না। তা, হ্যাঁ, এই কথাগুলো ছোটমুখে বড়কথা বা ধাপ্পার কাতারে থেকে যাবে যদি-না পাতে দুই-চাইরটা উদাহরণ তোলা যায়; সেইটা আলোচনা আরও বুঝসমুজগম্য করার ক্ষেত্রেও জরুরি। কিন্তু অনিবার্য কারণবশত উদাহরণ এই নিবন্ধেই প্রেজেন্ট করা যাচ্ছে না, বা হচ্ছে না, প্ল্যান্ অনুযায়ী আমরা আগাতে যদি পারি তো পরে যথাস্থানে ব্ল্যাকবোর্ডে এক্সাম্পল্ শো-আপ্ হবে একাধটা। আপাতত জরথুস্ত্রের নিটশে প্রণম্য। অর্থাৎ, চালাই আপ্তবাক্যে।
জেমস যা করেছেন, বাংলা কবিতায় এই জিনিশটাই নিয়ে এসেছিল মুক্তি। বিষয়টা আবছা-আবছা আমার যেমন মনে হয়, কিচ্ছুটি নিয়া আমি পূর্বদিগন্তে-সূর্য-ওঠানোর ন্যায় ক্লিয়ার না কোনোদিনই, একটু বুঝতে চেষ্টা করি নিজেই এখানে। জেমসের গানের ব্যাপারে বেতাল বলার, বেসুর বলার, বেলয় বলার সঙ্গে এই জিনিশটা আমরা পাশাপাশি রেখে বুঝতে চাইতে পারি। বিষয়টা হচ্ছে, যেই জিনিশটাকে কবিতায় আমরা বলি ছন্দ, গানে সেইটাই তাল। কবিতায় যদি স্বরবৃত্ত, তো গানে সেইটা কাহার্বা; তেমনি মাত্রাবৃত্ত সংগীতে এসে দাদরা, আমরা এইভাবে দেখতে পারি। এখন, কবিতায় মাত্রাবৃত্ত-স্বরবৃত্ত প্রভৃতির আট-ছয় বিভাজনের আওতায় নিয়মাবদ্ধ থাকাটা মাইকেল এসে ভেঙেছেন এবং অতঃপরবর্তী বিগত শতকাধিক কাল ধরে ভেঙেচুরে বাংলা আধুনিক কবিতা আজ এখানে এসেছে। কবিতায় সেই সনাতনী চোদ্দমাত্রাবদ্ধ পয়ারপনা ভাঙার ফল আমরা খাই তিনবেলা রোজ। অথচ গানে এই জিনিশটা কেন-যে এখনও অনড়, ছন্দখাঁচার ন্যায় তালখাঁচা ভাঙা তো দূরের কথা, সংগীতে তালখাঁচাটা খানিক সম্প্রসারণ করে নেয়াও বরদাশ্ত করা হয় না দেখতে পাই। এখনও ষোলোমাত্রিক ত্রিতাল, বারোমাত্রিক একতাল, দশমাত্রিক ঝাঁপতাল, আটমাত্রিক কাহার্বা, ছয়মাত্রিক দাদরা — আধুনিক বাংলা গান এর বাইরে কেন যায় না, আর কেউ যখন যায় তখন কেন ‘গেল গেল’ রসাতলের স্ল্যোগ্যান্ তোলা হয়, এবং ‘গেল’ যা তা-ও প্রকাশ্য দিবালোকে আনা হয় না যেমন তেমনি কী কী ‘এল’ তথা আমদানি নিয়াও কোনো খাজাঞ্চিবাবু অভিজাত তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বাইরে একটু পরপথসহিষ্ণু গলায় কথা চালাতে পারেন না। তালব্যাকরণ কী এতই নিনড়? অন্তর যদি বেতালেই বাজে, সেই বেতাল তবে তো তালজ্ঞানে গ্রাহ্য হবার কথা। বাংলা আধুনিক গানে একজন মাইকেলের আগমন আজও প্রতীক্ষার দূরত্বে দিন গুনে চলেছে।
জেমসের আবির্ভাবে, এবং আরও অনেকেই নিশ্চয় যাদের নাম উপস্থিত-মুহূর্তে নেয়া হচ্ছে না, সেই প্রতীক্ষাপারাবার খানিকটা আলোচ্ছটায় এসে গেল আমাদের। জেমস এসে অভাবিতপূর্ব শুরু করলেন বেখাপ্পার মাস্তানি, বেঢপের বাদশাহি, নয়া খাপ নয়া ঢপের তরফদারি। কিন্তু তালব্যাকরণের অনুশাসন নস্যাৎ করা বাগগেয়কার বাংলায় ভুরি ভুরি পাওয়া না-গেলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আছে বৈকি, যারা নিজেদের তালটা নিজেদের লয়টা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন, গ্র্যামারের আক্কেলগুড়ুম ঘটিয়েছেন যেমনটা তাদেরই উত্তরাধিকারী জেমস ঘটাতে চেয়েছেন, কোনো তালবণিকের টোটকা তারা মানেন নাই। কারা তারা? ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস এদেরকেই নিশানা মেনেছেন, এরাই ‘পথের মা’ ‘পথের বাপ’, ঘরে এবং ঘরানায় কস্মিনকালেও পথ পাওয়া যায় না। ঘরে থাকে আরাম, ঘরে সুখশান্তি-শানশওকাত, ঘর-ঘরানার এই কম্ফোর্ট-জোনটাকে জেমস নস্যাৎ করেছেন সুর দিয়ে বেসুর দিয়ে এবং অভাবিত গায়ন দিয়ে সর্বান্তকরণে।
রাতপাখা, হাতপাখা, তালপাখা
“রাখো / রাতপাখা আমার শিয়রে / রাখো হাতপাখা আমার মাদুরে উত্তর চব্বিশ-পরগণার যাত্রীবৈশাখ দূরে / ডাক দেয় জীবনবন্ধু রে তুমি / আছো নাকি জেগে” — এই পঙক্তিগুচ্ছ উৎপলকুমার বসু প্রণীত ‘লোচনদাস কারিগর’ কবিতাবইয়ের ‘সংসার’ শীর্ষক কবিতায় দেখতে পাই। শিয়রে তালপাখা হাতে জেমসকে দেখতে পাই একটা গানে, ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’ অ্যালবামে, প্রেজেন্টেশনের দিক থেকে সেইটা আধুনিক বাংলা গানের সংসারে এক উল্লেখযোগ্য বিস্ময়। কেন বিস্ময়, সেইটাই তো খুঁজতে নেমেছি। ঠিক পেয়ে যাব হদিস কিছুটা, ক্রমশ এগোই। কিন্তু তার আগে জেমসের সেই গানের বাণীচিত্র টুকিয়া রাখি কিয়দংশ। “তালপাখা হাতে নিয়ে / তোমার শিয়রে বসে / নির্ঘুম রাত / কাটিয়ে দেবো / ঘুমাও তুমি / ঘুমাও তুমি / ঘুমাও তুমি / ঘুমাও” … উপস্থাপনগত বিবেচনায়, মিউজিক্যাল্ প্রেজেন্টেশনের কথা বলছিলাম, এই গান উল্লেখযোগ্য প্রথম স্তবকের শেষস্থ ‘ঘুমাও’ শব্দটাকে জেমস যেইভাবে ডেলিভার করেন সেই কারণে। ব্যাপারটা কেমন? শুনে দেখলেই হয়, এবং শুনে তো নিতেই হয় শেষমেশ গানের আলোচনা গ্রাহ্যিতে নিতে গেলে বা অগ্রাহ্যি করতে, কিন্তু শোনাশুনিটা আপাতত মুলতুবি রেখে এই গানগত উপস্থাপনার অভিনবত্ব সম্পর্কে গুটিকয় কথা এখানে গুঁজে রাখা যাচ্ছে। যেমনটা আমরা আধুনিক কবিতায় দেখি যে একটা-কোনো ছন্দোবদ্ধ স্তবকের একটা লাইন সহসা লাফিয়ে গেল অতিরেকের মতো ছন্দোপ্রশাসন থেকে ছিটকে বেরিয়ে, এবং ফলত তৈরি হলো অন্যদ্যোতনা, জেমসের এই গানে সেই জিনিশটাই ব্যঞ্জিত হতে দেখি ওই ‘ঘুমাও’ শব্দটায় এসে। জেমসের গলায় এবং গায়নে এইভাবে অনেকানেকবার অতি সাধারণ শব্দছবিও অন্যমাত্রিকতা নিয়া হাজির হয়েছে আমাদের সামনে। যে-ব্যাপারটা গানটায় ঘটে, স্তবকের ওই বিশেষ শব্দটায় এসে, বাংলা কবিতায় একে আমরা অতিপদ/অতিপর্ব বলিয়া জানি। কী বিপুল বিক্রমে জেমস ব্যাপারটা ঘটিয়ে তোলেন, কী আলতো অথচ অবিশ্বাস্য গরিমায় জেমস ব্যাপারটা সামলান, না-শুনে মেহসুস্ হবার নয়। মিউজিকে এই-রকম অনিবার্য অতিরিক্ততা সাধারণত মিউজিশিয়্যানরা গানের গোটা আয়োজনটাকে সুরে এঁটে ওঠাতে যেয়ে ছেঁটে ফেলতে অভ্যস্ত দেখতে পাই। ইভেন্ অধিকাংশ অ্যাভারেজ্ কবিও তো অবিকল ওই কিসিমের ছেঁটেকেটে ছন্দে রেখে দেবার ছান্দসিক সোহবতপ্রাপ্ত লক্ষ করি। কিন্তু মহাজনরা যা-কিছু অভ্যস্ত তা-কিছু চুরমার করে ভেঙে ফেলতেই তো জন্মান। অনভ্যস্ততার অর্ণবপোতেই তারা আসনপিঁড়ি বসেন। ফলে জেমসের অতিকায় হিম্মতের নজির এই ‘তালপাখা’ গানটাতে পেয়ে যাই আমরা। শাস্ত্রীয় সংগীতে যেই জিনিশটা আমরা জানব ‘ধরা’ আর ‘ছাড়া’ নামে, যেখানে যেয়ে স্বরটা ছাড়লেন এবং কীভাবে ছাড়লেন ইত্যাদি মাপজোখ এবং স্থানকালপাত্র বুঝেশুনে বেরোনোও অতি নিগড়নিয়মের বাইরে, সেই-যে উস্তাদজি থামতে জানেন কি না জিগায়েছিলেন সংগীতরসিক বাংলার ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ব্যাপারটা আমলে রাখবেন এবং জানবেন যে কেবল যদি ধরেই থাকলেন এবং সপাট তানের খেলকারি আর বোলকারি থামাইলেনই না নিশাবসানের আগে, এইটা তাইলে কালোয়াতিই হইল, সংগীত পয়দাইল না। ‘তালপাখা’ গানের বিস্ময় এইখানেই যে জেমস ‘ঘুমাও’ অতিপর্বটাকে আশ্চর্য মুনশির মতো ধরে ফের ছেড়ে দেন, গোটা গানের বাদ্যবাদনও মুহূর্তে থেমে যায় এর সঙ্গে, এক অভাবিত নজিরের প্যজ্, ফের ধরে নেন গানের লাগাম জেমস তার অপরূপায়িত গলায়। এই বিস্ময়ের দেখা আমরা বারবার পেয়েছি জেমসের কাছ থেকে, জেমস যদ্দিন পর্যন্ত নিজে সুর দিয়েছেন, সংগীতায়োজন করেছেন গোটা গানটাকে নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে, জেমস যদ্দিন নিজের গানের লিরিক্স নিজে লিখেছেন বা দেখভাল করেছেন, এই বিস্ময় এবং অপরাপর অনেক পথিকৃৎ স্বরপ্রক্ষেপ দেখতে পেয়েছি তার ঝাঁপি থেকে বেরোতে। এমন অনেক পদক্ষেপ আমরা নিতে দেখেছি জেমসের গায়ন ও গলা মুবারকের মধ্য দিয়া, যা বাংলা গানে এর আগে হেরি নাই। কিন্তু পরে হেরিয়াছি, জেমস পথ-দেখানোর পরে হেরিয়াছি বটে, সেই গল্প এখন করা বারণ। পরের গল্প পরে ওঠানোই বাঞ্ছনীয়।
রঙচেতনা, ঠাকুরের চুনিপান্না, সুস্মিতার সবুজ ওড়না
তা, ব্যাপার হলো, সুস্মিতার ওড়নাটা দেখতে পাচ্ছি সবুজ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশেরও। অন্তত স্বদেশের প্রোফাইলপিকের ওড়নাটা আশা করি সবুজ সাব্যস্ত করাটা আমার বর্ণভ্রম নয়, যদিও আমি হামেশা লাল আর মেরুন্ এবং নীল ও সবুজে-কচুয়ায়-লিলুয়ায় ব্যারাছ্যারা লাগায়ে ফেলি। ব্যাপার না, ট্যাগোরেরও লাগত, প্রায়শ তিনি গোলমাল পাকিয়ে ফেলতেন রঙনির্ণয়ে, জানা যায় নির্ভরযোগ্য সূত্রে, ছিলেন বর্ণান্ধ তিনি — শোনা যায়। অ্যানিওয়ে। এই কারণেই কি-না জানি না ঠাকুর লিখেছিলেন, “আমারই চেতনার রঙে চুনি উঠল রাঙা হয়ে, পান্না হলো সবুজ” … ইত্যাদি। কিন্তু রবির এই বর্ণবিভ্রাটের কারণে আমরা হাতেনাতে লাভবান হয়েছি নিশ্চয়, আমাদের গোটা সাহিত্যের ভাষাটা ফায়দা তুলেছে রবির এই দ্বিধাবর্ণিল দৃষ্টি ও ভঙ্গির। ফলে এত সুর আর এত গান, এত প্রেম আর এত প্রাণ, পেয়েছি আমরা তার হাতবাহিত। রবীন্দ্রনাথ একলা রাঙিয়েছেন আস্ত পদ্মাপারের বদ্বীপ, শুধু সাতরঙে রাঙালে তো কথা ছিল না, রাঙিয়েছেন অনন্তসাত বর্ণে ও শীতগ্রীষ্মবসন্তবর্ষায়, এখনকার দিনের রঙবণিক অমুক-তমুক কোম্প্যানির চেয়েও দশাসই বিচিত্রবর্ণাঢ্য এক কালারব্যাংকের ঔনার-প্রোপ্রাইটার ছিলেন ভানুসিংহ এই পিরালি ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক। যদি তিনি আমাদের ন্যায় দেড়টাকার দেমাগওয়ালা রঙকারবারী হইতেন, তো বড়জোর দুই-তিন রঙেই কম্যার্শিয়্যাল্ ভেঞ্চার দাঁড়া করাইয়া কাঁড়ি কাঁড়ি মার্জিনপ্রোফিট গুণিতেন। ভাগ্যিস, রবিবাবু রঙান্ধা আছিলেন, নইলে আমরা আজো বেনীআসহকলায় পড়িয়া রইতাম। রঙের বেনিয়া হইতাম বড়জোর, লোকে বেশি-থেকে-বেশি রঙবেনে বলত, বর্ণোদ্ভাবক হওয়ার লাইনঘাট উনিই পয়লা ইন্ট্রোডিউস্ করাইলেন আমাদিগেরে। অ্যানিওয়ে, জেমসের স্বদেশের বা আমাদের সুস্মিতার প্রোফাইলপিকের ওড়না আদৌ সবুজ কি না, তা ব্যাপার না আসলে, ব্যাপার হলো সবুজ রঙটা আমাদের চারপাশ-আবেষ্টন-করে-থাকা বাস্তবজগতের হয়েও জাতিগতভাবে আমাদের মনোবাস্তবের সবচেয়ে আপন ও অনাড়ম্বর রঙ। ঘরের কোণের পুঁইলতাটা থেকে শুরু করে শিরোপরে পতপতে পতাকাটার রঙ প্রধানত সবুজ। সবচেয়ে অভ্যস্ত ও ঘরোয়া আমরা এই রঙটার সঙ্গেই। ইশকুলের ফ্ল্যাগ্ থেকে শুরু করে কব্বরের বা চিতার বাঁশদেহ জুড়ে এই রঙটাই আমাদের জীবনযাত্রাপালার বেইজ্ কালার বা ভিত্তিবর্ণ। অতিকল্পনা হবে না যদি বলা যায় যে এইটা আমাদের রঙমাতৃকা। জাতিগত আমাদের যা-কিছু গল্পশিল্পসাহিত্য সবকিছুর ভেতরে এই কথাটার একটা প্রত্যয়ন পাওয়া যাবে নিশ্চয়। কিন্তু সুস্মিতার ওড়নাকালার সবুজ সাব্যস্তকরণে একটুও ভুল হবার কথা নয় জেমসের গানের উঠতি দিনের যারা অনুরক্ত তাদের কাছে অন্তত। তো, ঘটনাটা ওড়না নয়, এমনকি ঠিক সবুজও নয়, ঘটনা হলো, আমাদের উঠতি বয়সে একজন গাইয়ে এসেছিলেন বাংলায়, তিনি একটা গান গেয়েছিলেন সুস্মিতার নাম ধার করে, সেই গানটা আমার বিবেচনায় রিয়্যালি অ্যা গ্রেইট কান্ট্রিস্যং, গানের লিরিক্যাল্ ইন্টেন্সিটি ও সুরায়োজন-সঙ্গীতাবহ অলটাইম্ ট্রিমেন্ডাস্। তো, গানটা আরও কয়েকভাবেই ডিকোড করা যায়, যে-কোনো ভালো গান বা কবিতা বা ছবি একাধিকভাবে ডিকোডেড হইবার সম্ভাবনা ধারণ করে ভেতরে — এইটা তো আমরা জানিই, এই গানটা আমি অ্যাট-লিস্ট ‘দেশের গান’ হিশেবে গেয়ে এসেছি, কিন্তু আর-পাঁচটা ছাতামাথার দেশাত্মবোধক সংগীতের মনোটোনাস্ ব্যাপার নয় একদম, কয়েকটা লাইন গেয়ে শোনাই একটু : “সুস্মিতার সবুজ ওড়না উড়ে যায় / ছুঁয়ে যায় নিঝুম মফস্বলের নিধুয়া মাঠ / ছুঁয়ে যায় দুঃখিনী মায়ের দুঃখিনী ললাট” … ইত্যাদি ইত্যাদি। লিরিক্স লিখেছেন জেমস ও দেহলভী মিলে যৌথভাবে, জেমসের তুঙ্গ সময়ের সুর গানটাতে লভ্য, একাংশে যেয়ে কথাগুলো সুরের প্রপেলার ভর করে ডানা ঝাপ্টায় যেন : “ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যায়, বাধাহীন উড়ে যায় / নীলাকাশ ছুঁয়ে যায়, রাতদিন উড়ে যায় / কাজলদিঘি ছুঁয়ে যায় / ছুঁয়ে যায় যমুনার বুকের মলাট / ছুঁয়ে যায় আকাশের নীল সীমানা / পথে পথে উড়ে যায়, সাঁওতাল ছুঁয়ে যায় / ছোট নদী বটগাছ, সমতট ছুঁয়ে যায় / ছুঁয়ে যায় পথিকের পায়ে-হাঁটা পথ / ছুঁয়ে যায় আমার বুকের জমাট” … ইত্যাদি। বয়স হয়ে গিয়েছে, সেই আগের মতো দম তো নাই যে জেমসের গান ওই বিশবছর আগেকার দুর্ধর্ষ জেমসস্টাইলে গেয়ে যেতে জোর পাবো, খোদ জেমসই তো ওই আগের মতন নাই আর, কাজেই আমি কোন ছার। কিন্তু জেমস আমাদের পুরাতনী-আধুনিকা বাংলা গানে একটা ঘটনা, এইটা বলবার মতন জোর আমি সংগ্রহ করছি রোজ একটু-একটু করে, অ্যানিওয়ে অ্যাগেইন্।
নৃত্যপর নক্ষত্র, ফ্রেইডরিখ নিটশে এবং জেমস
নৃত্যপর কোনো নক্ষত্রের জন্ম দিতে হলে ক্যাওস্ ব্যাপারটাকে ভেতরে ধারণ করতে হয়, — এমন একটা বাক্যই নিটশে বলেছিলেন জরথুস্ত্রের জবানিতে। নৃত্যপর নক্ষত্রের জন্ম দেবার ধ্বকের জন্য সর্বাগ্রে চাই নিজের ভিতরের ডামাডোল। প্রকৃত নৈরব্য তপোবনে নয়, পাওয়া যায় ব্যাকস্ট্রিট নয়েজে, কানাগলির মোড়ে এবং ল্যাম্পপোস্টের গোড়ায়, নির্জনতার প্রাপ্তিস্থান জনতাবাজারে; — এই বিবৃতি গ্রাহ্য হলে ফ্রেইডরিখ নিটশের ফিলোসোফিক্যাল্ ফ্যালাসি কিংবা তার পোলিটিক্যাল্ ভুলভ্রান্তি নিশ্চয় বোঝা যাবে না, বা যাবে না দার্শনিকের অতিমানব তল্লাশিবার কার্যকারণ বোঝা, কিন্তু জেমসের এবং যুগে-যুগে জেনারেশনের জ্যান্ত সংগীতের ধ্বকটুকু সম্যক যাবে ধরা।
বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতে এই নিটশেবর্ণিত নক্ষত্রজনয়িতা ডামাডোল অপরিমেয় মজুত রয়েছে। জেমসের সংগীতে এই ‘নৃত্যপর নক্ষত্র’ মুহুর্মুহু ফুটেছে বেশুমার। মিউজিকে, রেন্ডিশনে, লিরিক্সে। একদম গোড়ার দিককার জেমস দুইটা অ্যালবামের পরেই কী-যে টেরিফিক্ কলরোলের নৈস্তব্ধ্য উৎপাদনে ব্যাপৃত হন, উপভোক্তা মাত্রেই তা জানেন। মধুরতা বাদ দিয়ে এমন এক-ধরনের অসহ দমবন্ধ প্রশ্বাসনিঃশ্বাসের দোলা তার কাজে দেখা দিতে শুরু করে, জেমসের ঘোর বিরোধীরাও রুদ্ধবাক হয়ে যেতে থাকে এর ফলে। কেবল গিটার আর ড্রামসের কারণেই নয়, লিরিক্সও বড় ভূমিকা নিয়েছে এর নেপথ্যে। একদম শুরুর দিকের রৈখিক পরম্পরামান্য কথাকৃত্যের জায়গায় এসেছে রেখালুপ্ত পরম্পরাভাঙা লাইনের অগোছালো উৎকেন্দ্রিকতা। আর্বিট্র্যারি গিটার আর ড্রামস্-কিবোর্ড শুধু নয়, এক্সেন্ট্রিসিটি দিয়ে জেমসের লিরিক্স গোড়া-থেকে-চূড়া-পর্যন্ত মোড়ানো। উৎক্রম, উৎক্রান্তি এবং উৎক্রোশের ভুবনে জেমস দৈত্যপরাক্রমে এগিয়েছেন বল্গাহারা লাইনের লিরিক্স এবং ততোধিক ননলিরিক্যাল্ ইন্সট্রুমেন্টাল্ ননমেলোডিয়াস্ নয়েজের অশ্বপৃষ্ঠে চেপে।
এমনিতে জেমসের লিরিকসমূহ অলভ্য নয় আজ আর। বিশেষত হয়ে-ওঠা-পরবর্তী জেমসের লিরিক্স শ্রোতাসাধারণের প্রায় মুখস্থ। শুরুর দিকের সুন্দর সুখকর নস্ট্যালজিয়্যা বাণীচিত্ররূপমধুর গল্পধর্মী লিরিকগুলো মূলধারা বাংলা গানের ব্যালাড প্রকরণেই সৃজিত। উদাহরণ কয়েকটা না-এনে এখানে চেখে দেখা যায় একটাই : “চিরচেনা প্রিয় এই স্টেশনে / ট্রেনটা আমাকে নামিয়ে দিলো / মাস্টার সোমনাথ চশমা উঁচিয়ে / বেড়েছে বয়স নিজেকে শোনাল / মন্টুর স্টলে বয়-বেয়ারা / আগের কেউ আর কাছে নেই / জানি না কখন কীভাবে যেন / হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে / হায় চিরচেনা প্রিয় এই স্টেশনে / কেউ আমাকে চিনল না … / একটা ঘুড়ির পেছনে পুরো শৈশব / কেটে গেছে এলেবেলে-এলেবেলে / বোতাম-হারানো সেই দুপুরগুলো / চিনত আমায় কাছে পেলে / দরজার সেই বুড়ো বটগাছটা / আজও আগের মতোই আছে / তার নিচে বসে-থাকা মানুষগুলো / কেউ এল না আমার কাছে / হায় চিরচেনা প্রিয় এই স্টেশনে / চিনল না কেউ আমাকে … / হাপর-চালানো সেই কামারশালা / উঠে গেছে কখন যেন / পাশ দিয়ে বয়ে-যাওয়া সেই নদী / কেন-যে এত বুড়িয়ে গেছে / চৌরাস্তা থেকে ভাঙা সেই মন্দির / স্কুল-পালানো সেই বন্ধুরা / বদলে গেছে সবকিছু / নাকি আমি অনেক বদলে গেছি / হায় প্রিয় শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য / কেউ আমাকে চিনল না” — গানশ্রবণোত্তর সকলেই স্বীকার যাবেন যে এই গানটা গায়নশৈলীর বিচারে জেমসের চিহ্নলক্ষণ সুস্পষ্ট প্রকাশ করলেও কথাভাগ অপূর্বদৃষ্ট নয়; জেমসের পৃথক গানধর্ম পরিস্ফুট হতে দেখব আমরা ‘পালাবে কোথায়’ থেকে, ‘জেল থেকে বলছি’ থেকেই ইনডিড, ‘নগরবাউল’ অ্যালবামের পরে জেমসের টিপছাপ খুঁজতে যেয়ে কেউ ভগ্নমনোরথ হয় নাই। তাছাড়াও শুধু স্টেশন মোটিফটি নিয়ে জেমসের গান রয়েছে একাধিক, অনবদ্য প্রত্যেকটাই; মিস্টিক্ দ্যোতনায় স্টেশন শব্দটা বাংলা আধুনিক গানে এমনকি ফোক্ মিউজিকেও বরাবর ব্যবহৃত হতে দেখেছি আমরা, নাগরিক পরিসরের শিল্পী জেমসের গানে স্টেশন ওইধারা আধ্যাত্মিক চৈতন্যে ব্যঞ্জিত হতে দেখা যায় নাই, ‘ইশটিশনের রেলগাড়িটা / মাইপ্যা চলে ঘড়ির কাঁটা’ বা ‘রিটার্ন টিকিট হাতে লইয়া আইস্যাছি এই দুনিয়ায় / টাইম হইলে যাইতে হবে যাওয়া ছাড়া নাই উপায়’ ইত্যাদি ঐতিহ্যানুবর্তী মিস্টিসিজমের সোজা রাস্তা থেকে জেমসের স্টেশন নতুন দিশায় গিয়েছে, জেমসের স্টেশন রিয়্যালিস্টিক্ অ্যাপ্রোচে প্রেজেন্টেড এবং পিক্টোরিয়্যাল্ নস্ট্যালজিয়্যাঋদ্ধ। ‘স্টেশন রোড’ শিরোনামে গানটা ছাড়াও যেমনটা ‘নাটোর স্টেশন’ অনবদ্যভাবে জেমসমার্কড। শুধু শুরুতেই নয়, এ-পর্যন্ত জেমসগীতিভাগে ব্যালাড আঙ্গিক দুর্দান্তভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যাবে। সেইটা আদ্যোপান্ত কনভেনশন্যাল্ ‘তোমাকে খুঁজি’ ব্যালাড থেকে শুরু করে ‘পেশা সিরিজ্’ বা ‘হেরিটেইজ্ রেস্টোরিং’ কথাখ্যানের ভিন্ন দুইটা গানধারাবাহিকীর ক্ষেত্রেও সমান সত্যি। নিটশে-স্টেইটেড নৃত্যপর নক্ষত্রের সাব্লাইম্ ক্যাওস্ এবং সিরিনিটির দ্বন্দ্বসঙ্কুল ক্যাওটিক্ ওয়ার্ল্ডের দেখা আমরা পেয়ে যাই জেমসের গানেও।
জেমসের সংগীত, সন্দীপনের সাক্ষাৎকার
“যে-কোনো ভালো লেখক তার পাঠক তৈরি করে নেয়, আগে থেকে কোনো পাঠক থাকে না। জীবনানন্দ দাশের আগে থেকে কোনো পাঠক ছিল না। অত্যন্ত বাজে লেখক যারা, পুরনো লেখকদের অনুকরণ করে যারা লিখে যান, যেমন ধরা যাক সুবোধ ঘোষের মতো করে যারা পরে লিখেছেন, তাদের পাঠক আগে থেকেই আছে; কারণ, সুবোধ ঘোষই তাদের পাঠক তৈরি করে গেছেন। এ যেন বাপের টাকা খাওয়ার মতো।” — কথাগুলো সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একটা-কোনো কথোপকথনে একবার বলেছিলেন, উৎসের হদিস দিতে পারব না আজ আর। শুধু লেখার ক্ষেত্রে কেন, কথাগুলো সংগীতের বেলাতেও প্রযোজ্য হতে পারে। যে-কোনো ভালো সংগীতকার শিল্পী বা গায়ক তার শ্রোতা তৈরি করে নেয় নিজের হাতে। জেমস ক্রমে এই কাজটা করেছেন আমাদের চোখের সামনে। যে-ধরনের গান জেমস গেয়েছেন বাংলায়, সেই গানের শ্রোতা আগে থেকে এইখানে ছিল না, এই এবং ওই কোনো বাংলায়ই ছিল না, আংরেজিতে ছিল। ছোটমুখে বড়কথা হয়ে গেল না এইটা? আংরেজিতেও ছিল? হুবহু এই গানই ছিল? উন্মাদ, বধির ও গরুনিরীহ গবেষক ছাড়া বাংলায় জেমসের গানের অবিকল ট্যাম্পলেট ইংরেজি গানে দেখাতে ব্যর্থ হবে। ‘বাপের টাকা খাওয়ার মতো’ ঘটনা বাংলা আধুনিক, পুরাতনী ও মহাশাস্ত্রীয় সংগীতের বেসিক্ ফিচার বললেও কম বলা হয়। জেমসের সংগীতবৈভব সেদিক বিবেচনায় স্বোপার্জিত। জেমসের গানের শ্রোতারাও ঝাঁকের কৈ ফিশ্ কিংবা পালের গাইগোরু নয়, এই মহান শ্রোতারা আবিষ্কারক বলা আদ্যোপান্ত যুক্তিযুক্ত, নতুনের আবাহনকারী শিল্পী নিজে এবং তার শ্রোতৃবর্গ সকলে।
“লেখকের পক্ষে পাঠকের কাছে চলে যাওয়াটা ভালো। কারণ, পাঠকই হচ্ছে আসল জিনিশ। পাঠকের ভালোমন্দের বিচার পরে হবে। আর ধীরে ধীরে লেখক নিজেও তার পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করে নেবেন। পঞ্চাশটা লোক একটা বই পড়লে আটচল্লিশজন তাকে প্রত্যাখ্যান করবে কিন্তু দুজন পাঠক অন্তত সে পাবে।” — এই কথাগুলোও সন্দীপন কয়েছিলেন প্রোক্ত কথালাপনে। জেমস নিজের শ্রোতার কাছে গেছেন ঘুরপথে নয়, মিডিয়া বা ময়রা কারো দয়াদাক্ষিণ্যে নয়, একদম সরাসরি। বিটিভি তখন বছরে এক-দুইবার, এক/দুই ঈদে, ‘ব্যান্ড শো’ সম্প্রচার করত। কালেভদ্রে জেমস তথা ফিলিংস হোথায় পার্ফোর্ম করবার বা গাইবার সুযোগ পেত। মূলত ফিতেধৃত ক্যাসেট দিয়ে জেমসের সঙ্গে তার শ্রোতার চিনপরিচয় ও আশনাই। আর জেলাশহরগুলোতে স্টেজ্-শো। প্রচুর পরিমাণে স্টেজ্-শো করে জেমস উঠে এসেছেন লড়াইয়ের মূল সড়কে। এবং মঞ্চে জেমসের জোয়ারি হিম্মৎ হেরিবার নসিব যার হয় নাই, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে যেন প্রথম গান শোনার এক্সপেরিয়েন্সটা তার হয় — এই দোয়া ছাড়া আমরা আর-কিইবা করতে পারি সেই বদনসিব শ্রোতা ভাইবোনবন্ধুপ্রণয়িনীটির জন্য?
ভূতের মতো জ্যোৎস্না আর জল্লাদের ডিম
লক্ষ করা যাবে যে জেমসের গান রাত্রিবিধুর আর্তনাদের অভিজ্ঞান। ঘুরেফিরে জেমসের গান রাত্রির বর্ণনামুখর। বহু বর্ণের, বহু প্রচ্ছায়ের, বহু বিভঙ্গের রাত এসেছে জেমসের গানে একাদিক্রমে অনবদ্য অবিরলতা নিয়ে। একলা রাত্রির জঙ্গমতা জেমসের গানগুলো অতিজাগতিক অভিজ্ঞতার প্রলেপে রেখেছে মুড়িয়ে একদম গোড়া থেকে এ-যাবৎ। মুখ্যত ব্যক্তিবিবিক্ততার বয়ানে এইসব রাত্রি বিকীর্ণ। তপোবনের রহস্যাচ্ছন্নতা রাত্রিগুলোতে ঘেরা থাকলেও ঔপনিষদিক অনুধ্যানভরা রাত্রি জেমসের গানে দৃষ্ট নয়। এই রাত্রি গীতবিতানজাত নয়, সেই সৃজনশুদ্ধির সৌসাম্য নস্যাৎ করে দিয়েই জেমসের গানের রাত্রিরা ডাঙা পায়। “এই রাত্রিরা বেথেলহামকে ব্রথেলে পরিণত করে, করুণ কবাটের মতো ঝোলানো বাড়ির দেয়াল থেকে লুটিয়ে থাকে যেন বর্ম কিংবা বিরুদ্ধ পদ্ধতি হাওয়ার রূপালি চাবির অভাবে। এই রাত্রিরা সেই লাল আলোর ভালো যা তোমাকে প্রশস্ত স্ট্রিট থেকে নিয়ে যাবে কঙ্কালের সরু সরু পথে, অনাব্য স্ত্রীর মতো কেবলি অন্যদিকে; — যখন জানালায় ছিন্নপত্র ঝরে অবিচ্ছিন্ন, লোকালোক পুড়ে যায় বরফে। এই রাত্রিরা জিরাফের গলা বেয়ে লতিয়ে উঠতে দ্যায় আগুন, যেটা আমাদের আকাঙ্ক্ষা, অবশ্য যদি তার মাংস হতে রাজি হই তুমি আর আমি; ঈশ্বর নামক গৃহপালিত মিস্তিরি ভুল সিঁড়ি বানাচ্ছে আমাদের উঠোনে বসে — আগুনের, যে-অসম্ভবের সিঁড়িতে উঠতে উঠতে আমরা সবাই পাতালে নেমে যাবো হঠাৎ।” … রজনীর এহেন বর্ণনা আমাদের অনেকদিনের চেনা। ‘পাগল এই রাত্রিরা’ও নয় একটুও অনাত্মীয়। জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ। পরম্পরা-না-মানা মান্নান সৈয়দের অতিলৌকিক অশোকযামিনী। ‘সিংহের খাঁচায় বসে’ জেমস এই রাত্রিস্তোত্র তুলে নেন গলায় এবং উগরাতে থাকেন গানে গানে। একেকটা তার-উপড়ানি গিটারের অবোধ্য অথচ অবধ্য গোঙানো। ভয়াল বিষাদে এবং বেদনায় নিরুপমরূপে তেজোদ্দীপ্ত।
“জ্যোৎস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়, সব দরোজায়, আমার চারিদিকে যতগুলি দরোজা আছে সময়ের নীলিমার পাতালের; জ্বলছে গাছসকল সবুজ মশাল; বাস একটি নক্ষত্র, পুলিশ একটি নক্ষত্র, দোকান একটি নক্ষত্র : আর সমস্তের উপর বরফ পড়ছে।” … জেমসের গানে জ্যোৎস্না, রাত্রি, ফিরে ফিরে একেকটা গানে লতানো হতবুদ্ধিকর আদিম জ্যোৎস্নাচ্ছাদিত অতিকায়তা গানের গতরে এনে দিয়েছে এমন একটা আবহ যার পূর্বনজির বাংলা গানে নেই। কিন্তু কবিতায় আছে, আধুনিক বাংলা কবিতায়, পেলবতা ভেঙে বাংলা কবিতা স্বাবলম্ব-সাবালকত্ব অর্জনের পর থেকে। জেমসের মধ্য দিয়া গানে এর গোড়াপত্তনি। ঠিক যুক্তিসিঁড়ি বেয়ে এই রাত্রির কার্নিশ পর্যন্ত পৌঁছানো আদৌ সম্ভব নয়। যে-ধরনের রাত্রিদৃশ্যবিবরণী আবহমান বাংলা গানে দেখতে পাই, কথিত স্বর্ণযুগের গীতিকারেরা চাঁদফুলপাতালতানো প্রণয়লিরিকের পর্বতোচ্চ স্তূপ গড়িয়াছেন বলা বাহুল্য, জেমসের গানে এর অন্যথা রাত্রিঘটনা আমরা ঘটতে দেখব। স্যুরিয়্যাল্ রাত। স্যুরিয়্যাল্ জ্যোৎস্না। কাটা-কাটা আধফোটা বাক্য। ছবিগুলো অর্ধরচিত। কম্পোজিশন্ টোলভরা, ট্যাপ্-খাওয়ানো, ন্যারেটিভ নিটোল নয়। ইচ্ছেকৃত অনৈসর্গিক উদ্ভাসঋদ্ধ চূর্ণপঙক্তির লীলা। ঠাকুর ‘লীলা’ শব্দটা ট্র্যান্সলেইট করতে যেয়ে ‘প্লেজার’ করেছিলেন, মনে পড়বে আমাদের, জেমসের গানে এই ফিজিক্যাল্ নোশন্ লভ্য। সোজা বাংলায় প্লেজার, জেমসের রাত্রিজ্যোৎস্নাগুলো মান্নান সৈয়দীয় কবিতার মতো, স্যুরিয়্যাল্ লীলাবৈভবে সমৃদ্ধ। কবিতায় যেমন উল্লম্ফন, জাম্প-কাট পঙক্তিনির্মাণ, চলচ্চিত্রিক টেক্নিক্ হিশেবেও মন্তাজ্-কোলাজ্ প্রভৃতির প্রয়োগে যে-একটা ব্যাপারের প্রতিভাস আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর হয়, জেমসের গানে প্রায় একই দ্যোতনার নন্দনকৌশল প্রতিভাত হয়।
একটা-দুইটা নয়, জেমসের গানসমগ্রই বলা চলে রাত্রিনিঃসৃত। স্যুরিয়্যাল্ রজনীর রঙিনতা ও অবর্ণনীয় আঁধির অপরূপতায় জেমসের গান সহজেই নির্ণীত হতে পারে। এমন বনঝিম রজনীর পরাবাস্তবাবহ গোটা বাংলাগানের ইতিহাসে এত বহুলভাবে মেলে নাই এর আগে। জেমসের গানের রাত্রিগুলো জ্যোৎস্নায়িত। নতুন নয় বাংলা গানে এবং কবিতায়-আখ্যানে জ্যোৎস্না-রাত্রি-রৌদ্রের চিকিৎসা, বলা ভালো বহু ব্যবহারে বেহদ্দ পুরনো মোটিফগুলোর মধ্যে এ-দুটো উল্লেখশীর্ষস্থানীয়; তবে জেমসের জ্যোৎস্না-রাত্রির প্রায়োগিক অভিনবত্ব এইখানেই যে এগুলো রোম্যান্সের উপকরণ হয়ে থাকেনি শেষমেশ, রোম্যান্টিক্ ভাবালুতা প্রকাশের বাহন হবার বদলে জেমসের জ্যোৎস্না আর রাত্রি হয়েছে বরং ব্যক্তির অ্যালিয়েন্ মনোচৈতন্যের দ্যোতনাবাহিত। অব্যাখ্যেয় গ্রন্থিছিন্নতা/অ্যালিয়েনেশনের চিহ্নবহ। “জ্যোৎস্না কী? — না, জ্যোৎস্না হয় জল্লাদের ডিমের মতো চুলহীন জলবায়ুহীন মুণ্ডু, জোড়া জোড়া চোখ, সাতটি আঙুলের একমুষ্টি হাত, রক্তকরবীর অন্ধকার, এবং একগুচ্ছ ভুল শিয়ালের সদ্যোমৃত যুবতীকে ঘিরে জ্বলজ্বলে চিৎকার।।” — আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রথম-জীবনের কবিতা আমাদেরে যে-আবেগিক যুক্তিবিরানার অপরূপায়িত জগতে নিয়া যায়, জেমসের জ্যোৎস্নানিশীথা গানগুলো অনেকটা তার কাছাকাছি নিয়ে যেতে চেয়েছে।
রাত্রিখচিত কয়েকটা গানের নামমাত্র উল্লেখের দায় সেরে এ-যাত্রায় এগোনো যাক। উল্লেখবাহুল্য, জেমসের গানে দুপুর ও রৌদ্র প্রভৃতি অনুষঙ্গ সমুজ্জ্বলভাবে আলাদা স্থান পেলেও জ্যোৎস্না আর রাত্রির আবহ অধিকতর প্রণিধানযোগ্য। “সহসাই নেমে পড়ে অরণ্যের গভীরতা / ঘুম টুটে যায় চোখের সবুজ রাতে / যতদূর দৃষ্টি যায় চিরহরিৎ … চিরহরিৎ” — উদাহরণ হিশেবে এই গানটা পার্ফেক্ট বললেও কম বলা হয়। কিংবা আরেকটা যেমন, “যে-পথে পথিক নেই, বসে আছি সেই পথে / একা আমি একলা রাতে, শত শতাব্দী ধরে / চুপচাপ নিশ্চুপ চারিধার, বসে আছি এই আমি / একগ্লাস অন্ধকার আর একগ্লাস জোছনা হাতে / রাতজাগা অজস্র তারা বানায় আলোর সেতু / নীরব রাতের নীরবতা ভাঙে উড়ন্ত ধূমকেতু / ছায়াপথ ধরে আমি হেঁটে যাই / অসীম আমি, ঈশ্বরের মতো ভবঘুরে স্বপ্নগুলো / রাতের অরণ্যে ভোজসভায় উৎসবে মাতে / একা আমি একলা রাতে, শত শতাব্দী ধরে” — এই গানের রাত্রি কি জেমসের আগে হেরিয়াছিল বাংলা গান? রাত্রিবিকিরিত সুর ও বাদ্যযন্ত্রাবহে জেমসের গানের সংখ্যা কত, শুমার করা প্রায় বেদরকারি। কেননা গানগুলো মুখ্যত রজনীচিহ্নিত। কয়েকটা নাম বলে নেয়া যাক, গোটা গান শুনে দেখার দাবি পূরণ করা আগ্রহীদের এখতিয়ারে রয়েছে বলেই মনে করা আদৌ অসংগত হবে না, দৈবচয়িত উল্লেখে সেগুলো : ‘পূর্ণিমা নৃত্য’, ‘ঝড়ের রাতে’, ‘হেরেমের বন্দিনী’, ‘তারায় তারায়’, ‘নগরবাউল’, ‘জঙ্গলে ভালোবাসা’, ‘তবে বন্ধু নৌকা ভেড়াও’, ‘জানালা ভরা আকাশ’, ‘আমি ও আঁধার’, ‘মধ্যরাতের ডাকপিয়ন’, ‘বেদুইন’, ‘ঘুমাও তুমি’, ‘বিবাগী’ ইত্যাদি নিরুপমা রাত্রির বিচিত্র বৈভবে জেমসের গানভাণ্ডার পূর্ণ। কয়েকটা রাতের কিয়দংশ না-দেখাইলেই নয়, যেমন এই একটা : “বেদুইন আমি এক মরুপথের যাত্রী / আলেয়ার পিছু ধাই / মরীচিকায় ফিরে তাকাই / ক্যাক্টাসের কান্না শুনে কেটে যায় রাত্রি”; কিংবা আরেকটা এইভাবে : “এই শহরের কতশত অট্টালিকার ফাঁকে / আমার জানালা ভরে ছবি হয়ে ঝুলছে আকাশ / আমি আর একফালি নিষ্পাপ চাঁদ / সারারাত কথা বলে হয়েছি উদাস”; অথবা ব্ল্যাকম্যাজিকের অনবদ্য নমুনা আরেকটি : “গ্রিনরুমের বাতি নিভে গেছে / পর্দা খুলছে করতালিতে / জাদুকর শয়তান মন্ত্র পড়ে / ছুটে যায় নায়িকাকে বশ করতে”; এবং জেমসের কম্পোজিশনের আদি ও আসল চেহারা পাওয়া যাবে যে-কয়টা গানে চিরকাল, তার মধ্যে এই একটা হান্ড্রেড স্কোর করেও উপচে উঠবে সুধামাধুর্যে : “নিশ্চুপ এই রাতে, ছায়া-ছায়া এই ঘরে / শুধু আমি একা … আমি একা / স্বপ্নীল সম্মোহনে চেয়ে দেখি আকাশে / চাদর টেনেছে মেঘেরা / ভেজা-ভেজা জোছনাতে দুঃখগুলো অচেনা লাগে / অস্থিরতা বাড়তে থাকে মনের অজান্তে / তখনই ভাবনাগুলো জড়ো হয় মনের একান্তে / একাকিত্বের যন্ত্রণাতে গিটারটা হাতে / মাঝে মাঝে ম্যাজর স্কেলে / কোনো সুর নিজেই তুলি আবার ভুলে যেতে চাই” — এই লিরিক্স এবং এর অভাবনীয় কম্পোজিশন্, মর্ত্যভুবনের কারো পক্ষে এহেন মহাজাগতিক মাতলামো করা সাধ্যাতীত, এ শুধু জেমসের পক্ষেই সম্ভব। এইসব কম্পোজিশনে সেকেলে-একেলে-সর্বকেলে একামানুষের মুখ, দেহ ও অন্তরাবয়ব অঙ্কিত রয়েছে।
তিনস্তনা মাতাল রূপসী বনাম এক ঘোড়ামানুষ
‘‘দাও হে অভিধান ফেলে, তোমরা যাকে দুঃখ বলো তাতেই যদি আমি আনন্দ পাই, কী তাহলে উপায় তোমাদের? ছিঁড়ে ফ্যালো ব্যাকরণ, বিধান আমরা চাই না বলেই তো কবি, আমি এক নতুন ব্যাকরণ সৃষ্টি করব যা আসলে ব্যাকরণই নয়।’’ — হ্যাঁ, জেমস কথাটা না-বললেও ঘটনাটা ঘটিয়েছেন। কবির মতোই, কিংবা কবির চেয়েও, সৃজনোল্লাসে; নেসেসিটির চেয়েও অভাবিত প্রলয়ঙ্করী নির্মাণযজ্ঞে জেমসের ক্যারিয়ার পূর্ণ। কবিতায় যে-ব্যাকরণসৃষ্টির ঘোষণা আবদুল মান্নান সৈয়দের কণ্ঠে, জেমস বাংলা গানে সেই গ্র্যামার-গুব্লেট-করা ব্যাকরণ হাজির করেছেন। কোনো প্রকাশ্য কথা/ঘোষণা না-দিয়েও জেমস কথা রেখেছেন, মান্নান সৈয়দ কথা দিয়েও পরে তা আর রাখতে পারলেন কই? “আমার এক হাত ধরে টান দিয়েছেন শয়তান, আরেক হাত ঈশ্বর — কী উল্লাস আমাকে নিয়ে! আমি, ঐ দুজনের ভোজ, মাঝখান থেকে আমার দুহাত দুদিকে ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল, থামছে না, স্বগতের মতো উল্টোদিকে হাতদুটো চলে যাচ্ছে সম্পূর্ণ।” সৈয়দের কবিতায় এই-যে ‘আমি’, ঈশ্বর ও শয়তানের ভোজ্য, রক্তেমাংশে জেমস যেন ওই ‘আমি’ দৃশ্যমঞ্চে এনেছেন একের-পর-এক দানবীয় কম্পোজিশনে।
মধ্যরাতের ডাকপিয়ন
লতিফুল ইসলাম শিবলীর লিরিক্স এবং, বলা বাহুল্য, জেমসের সুরের যুগলবন্দী ক্লিক্ করে নাই এমন দুর্ঘটনা পাওয়া যাবে না প্রায় একটাও। কথাটা আরেকজনের ক্ষেত্রেও খাটে, দেহলভী সেই লিরিসিস্টের নাম। প্রথম যুগের জেমস এই দুই লিরিসিস্টের ওপর অনেকটাই নির্ভর করতেন মনে হয়। এদের সঙ্গে জেমসের টিমওয়ার্কটা সাফল্যগ্রাফের বিবেচনায় ঈর্ষণীয়। কেবল এই দুইজনের কথাই কেন বলা হবে, কেন অন্যান্য কথাকার বাদ যাবে, এরও উত্তরে থমকাতে হবে। কেননা আদিযুগের জেমস নিজের কম্পোজিশনের সঙ্গে আগাগোড়া নিজে লেগে রইতেন, ফলে ঠিক কোনো গীতিকারেরই গীতিকথা ব্যর্থ হতে দেখা যায় নাই জেমসের গানবাঁধন ও গায়নের গুণে। জেমস নিজে এককভাবে বেশ কয়েকটি লিরিক্স রচনার পাশাপাশি যৌথপ্রয়াসে একের-পর-এক নিজের অভিপ্রেত কথা বার করে এনেছেন কম্পোজিশনে। এছাড়া আরও অনেক তরুণ ও আনকোরা গানলিখিয়েকে জেমসের প্রোজেক্ট থেকে পেয়েছি আমরা, যারা আদতে জেমস ছাড়া আর-কারো জন্যে অ্যালবাম ভরে গান লিখেও অতটা গ্রাহ্য আর হইতে পারেন নাই পরবর্তীকালে। জেমসের চয়িত দুইয়েকটা গানের লিরিক্সেই তারা ভালো করেছিলেন। তার একটা মানে এইভাবেও করে নেয়া যেতে পারে, জেমসের সৃজিত সুর ও কম্পোজিশনগুণে ম্যাজিকমুহূর্ত তৈয়ার হয়; এবং, উল্লেখ আলাদাভাবেই আবশ্যক, আল্টিমেইটলি গাইতে যেয়ে জেমসের মহাজাগতিক মাতলামিঋদ্ধ গলাকারুকীর্তি তথা গায়নজনিত অনুকরণ-অসাধ্যপ্রায় ইউনিক্নেস্।
কথাকার হিশেবে জেমসের সঙ্গে কোলাবোরেটিভ অ্যাপ্রোচে যেসব স্যংরাইটার বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন অ্যালবামে কাজ করেছেন, পরিচিতি পেয়েছেন ওয়াইডার প্রিমাইসে জেমসের অ্যালবামের এক/দুইটা গানের গীতিপঙক্তি লেখার সুবাদে, এদের মধ্যে আসিরুদ্দিন মণ্ডল, লোকনাথ, রুদ্র পলাশ, আনন্দ, মারজুক রাসেল, বাপ্পি খান, সালাউদ্দীন সজল প্রমুখ উল্লেখণীয়। প্রত্যেকটা অ্যালবামে জেমস উল্লিখিত কথাকারের এক/একাধিকের প্রেজেন্স রেখেছেন। যৌথপ্রয়াসের গানও অন্তর্ভূত হতে দেখা যায় সেইসঙ্গে। এছাড়া শামসুর রাহমান, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং আবুল হাসান — এই তিন কবির যথাক্রমে ‘উত্তর’, ‘পুবের হাওয়া’ এবং ‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা’ কবিতার গানরূপায়ণে জেমস অনবদ্য সফল হয়েছেন। সর্বশেষ ব্যান্ডব্যানারে রিলিজড অ্যালবামে — ‘দুষ্টু ছেলের দল’, অবমুক্তিকাল ২০০১ — দেখা যায় একটি দৃষ্টিগ্রাহ্য ব্যত্যয়; এ-অ্যালবামের সর্বমোট দশটা গানের সব-কয়টায় জেমস ও বিশু শিকদার যূথবদ্ধ হয়ে কথাগুলো বসিয়েছেন। যথাপূর্ববৎ এইখানেও জেমস স্বকীয় ঘরানা বজায় রেখে একাধিক অ্যাঙ্গেলে নতুনতা আনয়নের ঔজ্জ্বল্য দেখিয়েছেন। শহুরে ইডিয়্যম্, কলোক্যুয়্যাল্ ফ্রেইজেস্, বাচনিক বৈদগ্ধ্য গুঁড়িয়ে দিয়ে লেখ্যরূপে অনভ্যস্ত শব্দের ব্যবহার বলবৎ রাখা, এমনকি সিটিস্লাম্ অ্যারিয়ায় চালু কথ্যবুলি, ইভেন্ নগরমধ্যবিত্তের অক্ষরভদ্র সমাজে ট্যাবু স্ল্যাং পর্যন্তও দুর্ধর্ষ উপায়ে এস্তেমাল করার সাহস দেখায়েছেন জেমস ‘দুষ্টু ছেলের দল’ অ্যালবামে, এমনটা আগে এতটা গ্রাহ্য প্রয়োগ করতে পেরেছেন কেউ বলা মুশকিল। মধ্যবিত্ত পুতুপুতু সুসামাজিকতা টাল-খাওয়ানোর এই ঘটনা বাংলা আধুনিক গানে ব্যান্ডগান ছাড়া আর কোথায় কে করেছে? ‘জীবনে শালার কিছুই পেলাম না’ … ইত্যাদি লাইন বাংলা গানে এত সফল ও অব্যর্থ প্রয়োগের ঘটনা আগে-পরে নেই বললেই চলে। পুরাকালের আখড়াই বা হাফ-আখড়াই সংগত কারণে এখানে ধর্তব্য নয়। কিন্তু প্রসঙ্গটা আবারও তোলা যাবে, এখন নয়, এই নিবন্ধের প্রকাশিতব্য পরবর্তী বৈঠকে। এখন শিবলী এবং দেহলভী প্রসঙ্গটুকু যতি টানা যাক।
লতিফুল ইসলাম শিবলী এবং দেহলভী লিরিক্স রচনায় জেমসের স্বর্ণদিনের সূর্যসারথী। টিউনিঙের দিক থেকে এই দুইজনে জেমসের রাফকাট্ অ্যাবসার্ডিটি এবং স্যুরিয়্যাল্ সাউন্ড ও মর্জি বিবেচনায় রেখে লিরিক্স ড্রাফ্ট্ করতে পেরেছেন সবচেয়ে বেশি। “একা একা দাঁড়িয়ে থেকো / স্বপ্নের ব্যাল্কোনিতে / দুষ্টু বালকের মতো / হেসেখেলে রাত ঘুমালে / জ্বলে জ্বলে যখন ক্লান্ত হবে / রাজপথে নিঃসঙ্গ নিয়ন / তখন তোমার কাছে আনবে চিঠি / মধ্যরাতের ডাকপিয়ন” … লতিফুল ইসলাম শিবলী লিরিক্স লিখেছেন প্রেমোজীব্য রোম্যান্টিক্, লিখেছেন অন্যান্য বৈচিত্র্যমণ্ডিত ভাব নিয়ে, ‘পেশাদার খুনী’, ‘প্রিয় আকাশী’ কিংবা ‘জোসি প্রেম’, ‘জেল থেকে বলছি’ ইত্যাদি ভীষণ বলিষ্ঠ কথাবাহী লিরিকগুলো। তদ্রুপ দেহলভী লিখেছেন ‘হুমায়রার নিঃশ্বাস’, ‘হারাগাছের নূরজাহান’, ‘যাত্রা’ গানপঙক্তিমালা।
শাস্ত্রীয় বন্দিশ ও ব্যান্ডসংগীত
দুর্বল গীত নিয়া আহাজারি, সিঁটকানো নাসিকা, আলজিভ ভেংচানো, উঁচ-কপালি বিহেইভিয়্যর ইত্যাদি দৃষ্ট বঙ্গে ব্যান্ডসংগীত নিয়া আলাপের দেড়-কথাতেই। তিষ্ঠ ক্ষণকাল, জন্ম যদি তব উচ্চাঙ্গ সুরগর্ভে, হে প্রেমরসিকা! শাস্ত্রীয় বন্দিশগুলোতে এমন কী পাও তুমি যা ব্যান্ডসংগীতে নেই? হিন্দুস্তানী ধ্রুপদ অত্যাভিজাত বস্তু, বুঝলাম, ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যালে এমন কী পাও যা বাংলার কোনো মধ্যসংগীত তোমারে দ্যায় না? যাকে তুমি লঘুসংগীত বলে চেনো, চটুল ও ছদ্মসংগীতও বলে ফ্যালো কখনোসখনো পণ্ডিতির ঠাপ দেখাইতে যেয়ে, সেই জিনিশটাকে এখানে রবি-দুখু ও অন্যান্য স্বর্ণসংগীতকারদিগের চেয়ে পৃথক চেনাতে যেয়ে এহেন শব্দপ্রয়োগ। মধ্যসংগীত। অবশ্য ওয়াহিদুল হক অধুনালুপ্ত ‘শৈলী’ পাক্ষিকে একবার ‘মধ্যসংগীত’ টার্মটা ব্যবহার করেছিলেন উনার একটা খামাখা আভিজাত্যদর্পী বিদঘুটে লেখায়। ব্যান্ডগান নয়, তিনি তার ছায়ানটপনার অন্তর্গত পঞ্চকবি আর তৎপূর্বাপর কিছু পুরাতনী মিউজিক্ অ্যাপ্রিসিয়েশনে লেখাটা ব্যয় করেছিলেন; যেমন তিনি বরাবর করতেন, বাংলাদেশে এক রবিগান ছাড়া আর কোনো সুরবাণী তিনি বিশেষ গেরাহ্যি করতেন বলে মনে হয় নাই কোনোদিন, এমনকি নজরুলের গানের ব্যাপকাংশ উনার মতে ডেকাডেন্সের ছোঁয়াচ এড়াইতে পারে নাই! নিশ্চয় লেখাটা একদিন ‘শৈলী’ পুরনোসংখ্যা ঘাঁটতে যেয়ে পেয়ে যাব, ১৯৯৮ অথবা কাছাকাছি খ্রিস্টাব্দের কোনো সংখ্যা হবে সেইটা; তার দরকার না-ও হতে পারে, কেননা ঠাকুরভক্ত ওয়াহিদুল হকের রচনাপত্রের সঙ্গে যারা পরিচিত তারা জানেন উনার জবানে এহেন কথা হামেশাই ছিল মজুত।
তো, বলছিলাম, সংগীতের লঘু-গুরু ওয়াহিদুল হক প্রমুখ প্রণম্য সংস্কৃতিহিতৈষীবৃন্দ কোন গগনের দাড়িপাল্লাবাটখারা দিয়া মাপাজুখা করেন জানিবার গাঢ় সাধ মিটিল না হায় জিয়ন্তে আমার। যাউকগা। আজ্ঞে, সেইটাই বলছিলুম দাদা, যাগগে। জেমসের গান ওয়াহিদুল হক গুরুগান বলেন নাই, বলা বাহুল্য, রিসিভারটা আসলে জেমসের ফ্রিকোয়েন্সি রিসিভ করার মতো প্রোগ্র্যামিংসম্পন্ন ছিল না তাদের জেনারেশনের। অবশ্য উন্নত ধারণক্ষমতার রিসিভার যার থাকে তার সাতাত্তরেও অবিকল থাকে, যেমনটা খান আতার ছিল, মোস্তফা মনোয়ারের আছে কিংবা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদেরও অল্পস্বল্প।
গোস্তাকি নিয়েন না। ‘শাস্ত্রীয় বন্দিশ’ শব্দবন্ধের পাশে একটা আলতো-ছোট সংযোজক অব্যয় দিয়া ‘ব্যান্ডসংগীত’ জুতে দেয়ায় খাপ্পা হয়ে খানাপিনা ক্লোজ্ করে দিয়ে এহেন দুষ্কৃতিকারীর জিনা হারাম করে দিয়েন না। আমরা হাল্কা চালাকি দিয়া মাঠগরম করার ন্যায় শীতবিলাসী নই। রীতিমতো খুন্ ও পসিনা ঝরায়া, জান্ আর জিগরের যাবতীয় জোর জড়ো করে বুকের পাতিহাড়গুলো একত্র যুঝাইয়া, আমরা বীণাপাণির জন্য সং-অফারিং তথা আরাধনানৈবেদ্য প্রস্তুত করিয়া থাকি। শীতকালে কাশ্মিরি আলোয়ান আর গ্রীষ্মকালে জয়পুরি কুর্তা-চুড়িদারের বাহার দেখানো খুশবুদার আয়েশের সরগম-তান-তারানা আমাদের নসিবে নাই। কিন্তু উচ্চাঙ্গ বন্দিশ আমাদের কর্ণকুহরে এলে যেমন সযত্ন শুনি, ঠিক ওই-সমস্ত বকাসুর বন্দিশান্ধ প্রতিবন্দিদের ন্যায় আহাউহুবাহা ক্যায়া-বাত আউর-থোড়া আদাব-আদাব তড়পানো আমাদের না-থাকলেও পূর্বশ্রুত কোনো স্বরাভিজ্ঞানের সঙ্গে বন্দিশের সাউন্ডটা আমরা মেলায়ে দেখতে বেদম কোশিশ করি, ক্রিটিক্যাল্ অ্যাপ্রিসিয়েশন্ করতে যেয়ে হয়তো-বা রাগের টাইটেলে এবং ঠাটে প্যাঁচ পাকায়ে ফেলি, গিমিকটা মারাই না পারতপক্ষে। ব্যান্ডসংগীত ব্যাপারেও তথৈবচ। বুঝি না গানাবাজানা, বাংলা আবহমান কবিতারই ন্যায় মিউজিকেও অবোধ-উম্মি আমরা, তাই বলে বেফায়দা আহাবাহা আর রশিদ খান বা আমজাদ বাঙ্গাশের পাঁচলাখ রুপাইয়ার শাল বা বাইশ ক্যারেট স্বর্ণখড়মের প্রশংসায় সাতমুখ হয়ে রেডওয়াইন্ সন্ধ্যারাতটা বানচাল করার ন্যায় বেল্লিক আমরা না। আমরা ডাইরেক্ট লাইন মারি, প্লেটোনিক্ প্রেম না, নিজের হৃদমাঝারের কারেন্ট কোনো-না-কোনো পয়েন্টে গানটা না-ঢুকায়ে সেই গানের গতর-অন্তর নিয়া তারিফ করা আমাদের ধাতে নাই। ঠিক যে বেফায়দা তারিফ যেমন শিখি নাই করতে, কেবল ‘বন্দরের ভাষা’ ক্ষ্যাপার ন্যায় তালাশিয়া বেড়াই দিনেরাতে, তেমনি বৃথা খারিজি খাসলতও আমাদের নাই। হিন্দুস্তানী মার্গীয় সপাট তান বা তাতার মাফিয়া বা হার্মাদের গান, সো হোয়াট, আমার দরকার মোমেন্ট, রক্-ন্-রল্ মুহূর্ত, হইলেই হইল, নয়তো নমস্কার।
ইউটিউবের জলসা আজকাল তো অত্যন্ত জমজমাট। জমে ক্ষীর কোকস্টুডিয়ো। তো, কইতে কথা বাঁধবে কেন? কহি আপন দুঃখ, গোপন মর্ম, ওপেন্ গঞ্জনা। কহি নিজের দেখাশোনা। আপনি কিরানা ঘরানার, পাতিয়ালা ঘরানার, মাইহার ঘরানার অমুক-তমুক কতশত প্রমুখের গানাবাজানা শুনে বিমোহিত। শুধু জেমসের গানে, ব্যান্ডের গানে, বাংলা গানে মুখব্যাদান! এমনকি কর্ণাটকী মিউজিকেও আপনি নিজের জিভে লালা খসাবার মতো লোভনীয় রস লাভ করেন, ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল্ তো অবশ্যই ইভেন্ চৈনিক সংগীতেও প্রভূত তরিতরকারির সোয়াদ পাইয়া যান, খালি বাংলা গান স্পেশ্যালি ব্যান্ডগান শুনতে গেলেই কহেন উহা ক্যাকোফোনি! বলি, মশাই, আপনার গান শোনার কান কুষ্ঠগ্রস্ত নয় তো? অনুভূতিরহিত? বস্তুত, বলতে বাধ্য, সংগীতানুভূতি সত্যিই আছে তো আপনার? সন্দেহ, গভীরতর সন্দেহ, অন্তত আমার। শোনেন যা, আমি দীর্ঘকাল ধরে খেয়াল করে এসেছি, এর একাংশ সরগম, বড়-একাংশ তান, লয়ের কিছু পপ্যুলার কাজ, দ্রুত এবং মোস্টলি বিলম্বিৎ, শেষের দিকটায় বেহদ্দ লম্বাচওড়া তারানা। সাউথ-ইন্ডিয়ানে এমনকি গিটকিরি পর্যন্তও তোফা লাগে আপনার! মশাই, আপনি তো খোদ উস্তাদের বাপেরও বাপ! গুণী মার্গপণ্ডিতজির গলায় বা বাদ্যযন্ত্রে স্বয়ং সুরেশ্বরের অধিষ্ঠান দেখে আপনি জীবনে কত সহস্রবার-ই-না মূর্ছা গেলেন! বলিহারি! রিসেন্টলি নোটিস্ করে দেখি কি, ইনডিড একটা গানেরই রিপিটেড রেন্ডিশন্ শুনিয়া আপনি জীবনভর অভিনয়টা চালাইয়া গেলেন। ব্র্যাভো! সত্যি যদি মিউজিকটা ভালো অধিগত করার ক্ষ্যামতা আপনার থাকত, নর্থ-ইন্ডিয়ান বা সাউথ-ইন্ডিয়ান, বঙ্গ-অবঙ্গ-ননইন্ডিয়ান-কোকস্টুডিয়োপাকিস্তান, অন্তত জেমসের গলার কারিকুরি আর বন্দিশগাইয়েদের মধ্যে একটা সাযুজ্য খুঁজে পেয়ে মজা নিতে পারতেন। মনে আমার বেজায় দুঃখ। বোকাহাঁদা আমার হইল না সালাত কায়েম, পূজাআচ্চা, নামাজ আদায়, জিন্দেগি-বন্দেগি বিলকুল বরবাদি হইয়া হায় গেল গইয়া গইয়া।
বাত্ তো সহি হ্যায় কি, হিন্দুস্তানী রাগাস্ বড়ি শানদার আর জবরদস্ত্ চিজ্। তবে আর-দশটা সাংগীতিক ধরনের ভেতরে একজন সংগীতশ্রোতা যা চান বা পান, ‘উচ্চাঙ্গ/শাস্ত্রীয় সংগীত’ পরিচয়ের মালসামান থেকে একই জিনিশ বৈ ভিন্নকিছু চান/পান বলিয়া মনে করার যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পাই না। ভান, বনেদি একটা আজদহা ভান, এবং মুখস্থ অভিনয় ছাড়া শাস্ত্রীয় সংগীতসমুজদার গোষ্ঠীর বেশিরভাগের কথাবার্তার মধ্যে তেমন কিছুই দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় না আমাদের। অধিকাংশ সময় ফেইক্ একটা অ্যাপ্রিসিয়েশন্ কথিত শাস্ত্রীয় সংগীত ঘরানার বারোটা বাজিয়েছে, সত্যিকারের শ্রোতার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এদ্দিন ধরে ফেইক্ শ্রোতার খপ্পরে একটা স্বাভাবিক সংগীতধারাকে ফেলে রেখেছে, এহেন অস্বাভাবিকতা যুগযুগান্ত জোর করেই জিইয়ে রেখেছে ফেইক্ এক উদ্ভট উটসম্প্রদায়। ব্যাপারটা জানতেন মনে হয় ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ। “আমাদের দেশে সংগীত এমন শাস্ত্রগত, ব্যাকরণগত, অনুষ্ঠানগত হইয়া পড়িয়াছে, স্বাভাবিকতা হইতে এত দূরে চলিয়া গিয়াছে যে, অনুভাবের সহিত সংগীতের বিচ্ছেদ হইয়াছে, কেবল কতকগুলা সুরসমষ্টির কর্দম ও রাগরাগিণীর ছাঁচ ও কাঠামো অবশিষ্ট রহিয়াছে; সংগীত একটি মৃত্তিকাময়ী প্রতিমা হইয়া পড়িয়াছে; তাহাতে হৃদয় নাই, প্রাণ নাই।” (সংগীতচিন্তা, বিশ্বভারতী, ১৩৯৯, পৃষ্ঠা ৮)। শাস্ত্রীয় অস্ত্রশস্ত্রমত্ত ওরাংওটাংদের যন্ত্রণাটা ঠাকুরের ন্যায় মিউজিশিয়্যানকেও ভুগিয়েছে! হ্যাঁ, বেহতর, ‘সংগীতচিন্তা’ বইটার বহু জায়গায় এর পক্ষে প্রমাণ ছড়িয়ে আছে, হে বন্ধু হে প্রিয়, সেসবের পরশ চাও তো কুড়িয়ে তুমি নিও। “হয়েছে কী, ও-সংগীত হয়ে পড়েছে ক্লাসিক। ক্লাসিক মানে একটা সর্বাঙ্গসুন্দরতার পারফেকশনের ফর্মে অচল প্রতিষ্ঠা। এ-হেন পূর্ণতা পূর্ণ বলেই মরেছে। পূর্ণতায় সিদ্ধির সঙ্গে আসে স্থিতি।” (ঐ, পৃ. ১২১)। মৃত্যুসংবাদ ঘোষণাকৃত বস্তুটা জাগিয়া উঠিল সহসাই! মৃত্যুর পরের কালে বিশ্বাসীরা আজকাল ইহকাল ভুলে স্টেডিয়াম দখল করে বেঙ্গলবাজি পোড়ায়। জেমসের কন্সার্ট নাই, মাকসুদ নাই, ফিডব্যাক নাই, ওয়ারফেজ শোনার মঞ্চ নাই, শিরোনামহীন নাই, আর্টসেল নাই, ব্যান্ডসংগীতের ওপেনএয়ার কন্সার্ট হয় না কালেভদ্রেও। উচ্চাঙ্গ বাংলাদেশের জন্যই তিতিক্ষার তরুগুলো জন্মেছিল অবহেলার ময়দানে। এইটা, মানো বা না-মানো মুহতারিমা, বাস্তবতা। “আজকাল ওস্তাদবর্গ যখন ভীষণ মুখশ্রী বিকাশ করিয়া গলদঘর্ম হইয়া গান শুরু করেন, তখন সর্ব প্রথমেই ভাবের গলাটা এমন করিয়া টিপিয়া ধরেন, ও ভাব বেচারীকে এমন করিয়া ত্রাহি ত্রাহি আর্তনাদ ছাড়ান যে, সহৃদয় শ্রোতা মাত্রেরই বড়ো কষ্ট হয়।” (ঐ, পৃ. ৯)। এই দেশে, শীতগ্রীষ্মবর্ষাবাসন্তী বিচিত্র ধ্বনিচিত্রের এই দেশে, ব্যান্ডের স্বতঃস্ফূর্ত সংগীতের জন্যে স্টেডিয়াম অ্যাফোর্ড করা যায় না, হায়! যে-গান গায় হাজার মানুষ, সেই ফোক্-রক্, যে-সৃজনোল্লাসের সঙ্গে জড়িত ভূখণ্ডের হাজার-লক্ষ তরুণযুবা, সেই মিউজিকের জন্যে, ব্যান্ডসংগীতের জন্যে, এয়ারটাইট টিভিস্টুডিয়ো! উদ্ভট অগ্রগতিচিত্র, বদ্বীপের, ভয়াবহ উচ্চাঙ্গপ্রিয় বাংলাদেশ! গ্য অ্যাহেড, দুঃখিনী, দুঃখ কোরো না, গ্য অ্যান্ড ফাক্ উইথ য়্যুর উচ্চাঙ্গ সোহবত্।
কবিতার ব্রাদার, সিস্টার, বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড
“আমরা যেমন আজকাল নবরসের মধ্যেই মারামারি করিয়া কবিতাকে বন্ধ করিয়া রাখি না, অলংকারশাস্ত্রোক্ত আড়ম্বরপূর্ণ নামের প্রতি দৃষ্টি করি না, তেমনি সংগীতে কতকগুলা নাম ও নিয়মের মধ্যেই যেন বন্ধ না হইয়া থাকি। কবিতারও যে-স্বাধীনতা আছে সংগীতেরও সেই স্বাধীনতা হউক; কারণ সংগীত কবিতার ভাই।” — কথাটা ঠাকুরেরই, বিশ্বভারতীনির্মাতার, প্রাগুক্ত বইয়ের ২১-পৃষ্ঠাঙ্ক দ্রষ্টব্য। কথা হচ্ছে, জেমসের কিংবা সামগ্র্য অর্থে ব্যান্ডের গান ক্রিটিক্ করতে যেয়ে ব্যাপারটা আমরা যেন ভুলিয়া না যাই যে কবিতাপঙক্তি আর গীতিপঙক্তির মধ্যে একটা ফারাক ডেলিবারেইটলি রাখা চাই। গীতিভাগের পঙক্তিমালা যদি কবিতার সঙ্গে কম্পিট করতে যায়, গীতের এবং কবিতার তাতে যেমনটা ফায়দা আছে তেমনি বিপদও কম নয়। বিনিময় হোক উভয়ের মধ্যে, লেনাদেনা হোক, দেয়ানেয়া থাকুক, তবে যার যার স্বাতন্ত্র্যের জায়গাটা ব্যাহত না-করে সেইটা হলেই বৈচিত্র্যবৈভব বাড়বে।
গানের কথাকাণ্ড যদি কবিতার শর্ত মেনে লতানো হয়, এবং ভাইস্-ভ্যার্সা, সেক্ষেত্রে সুর শ্বাসরুদ্ধ হবার আশঙ্কা থাকিয়া যায়। যেটুকু ফোকর ও ফাঁক রাখিয়া যাওয়া জরুর গানের কথাভাগ রচনাকালে, এহেন ফোকরফাঁক সুরের প্রবেশদুয়ার হিশেবে একজন গুণী গীতিকারকে রেখে যেতে হয় বৈকি, সেটুকু পরিসর না-রাখলে সেইটা গান না-হয়ে কবিতা হয় ঠিকই, কিন্তু হয় দ্বিতীয়/তৃতীয় সারির কবিতা প্রায়শ। কবীর সুমনের গান উদাহরণ হিশেবে ভাবা যাক। খুব উচ্চস্তরের কবিতা বলবেন সেগুলোকে? আঁটোসাঁটো পয়ারের সুরত ছেড়ে বাংলা কবিতা ডানা মেলেছে একশ বছর হয়ে গেছে। এই জিনিশটাকে এখনও আপনি যদি উন্নত কবিতা বলিয়া সাব্যস্ত করেন, অন্তত বাংলা কবিতার বিবর্তনের চিহ্নরেখা ঠাহর করে পথহাঁটা পাঠক ও সমুজদারবৃন্দ, তবে সেইটা হবে পোষা বেড়ালটারে আদর করিয়া বাঘ ডাকবার ন্যায় ব্যাপার। ব্যাপারটা আরও বোঝার জন্য রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের নামদুটো উচ্চারণ করা যায়, কিংবা বব ডিলান ও লেনার্ড কোহেন নামদ্বয়, এরা আলাদাভাবে গান ও কবিতা লিখতে গেলেন কেন বুঝবার জন্য আপনার কমনসেন্স লগ্নি করলেই হবে। জেমসের গান, বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিক্, এইখানেই সিগ্নিফিক্যান্টলি ডিফ্রেন্স হাজির করে আমাদের সামনে। এই গান নিজের স্বাতন্ত্র্যগুণেই ভিন্নযোগ্যতার মুক্ত শ্রবণ-সমুজদার শ্রোতা দাবি করে এবং টার্গেট অডিয়েন্স রেডিমেইড না-পেয়ে তিলে তিলে তিরিশ বছরে সেই ঈপ্সিত শ্রোতাগোষ্ঠী তৈয়ার করে তোলে।
যে-ব্যাপারটা বাংলা কবিতায় ঘটল তিরিশি পাঁচ কবির হাতে, একই ব্যাপার বাংলা আধুনিক গানে ঘটতে দেখব ফিডব্যাক-ফিলিংস-ওয়ারফেজ-ঢাকা-আর্টসেল-শিরোনামহীন প্রভৃতি ব্যান্ডের সম্মিলিত প্রয়াসে, জেমসের গানে সেই ঘটনা আমরা ব্যাপকভাবেই দেখতে পাবো ঘটেছে। ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করা যায়, কিন্তু অতিপ্রসঙ্গ হবার ভয়ে খুব বেশি বিস্তারের সুযোগ এই নিবন্ধে নেয়া আদৌ শোভনও হবে না মনে হয়। একটা সময়ে এসে, উত্তরকালে, ষাটের দশক থেকে সেই উত্তরকালের শুরু ধরে নিলে আশি হয়ে এই শতকের প্রথম দশক অবধি সেই টাইমফ্রেইম্ ধরে নেয়া যায় কিংবা তারপরেও হয়তো অনোয়ার্ডস্, বাংলা কবিতা মাইকেল-জীবনানন্দকালীন কবিতাধারণার অভাবিত ব্যাপ্তিবিস্তার ঘটিয়েছে; দ্ব্যর্থ ভুল বোঝার অবকাশ না-রাখার জন্যে একবার পুনরাবৃত্তি করি একটু-আগে-বলা কথাটার, কবিতার ভালোমন্দ অগ্রগতি কি হয়েছে বা হয় নাই তা না-ভেবে এহেন কথা প্রকাশ করতে চেয়েছে কবিতা সম্পর্কিত ধারণার ব্যাপ্তিবিস্তারণের বিষয়ে একটা সাধারণ বিবৃতি। কী এমন মহাসময় এসেছিল কথিত কয়েক দশকের খোপে, এবং কোন মহাজাগৃতি ঘটে গেল যে এমনকি জীবনানন্দও মুছে গেলেন জাব্দাখাতা থেকে? ব্যাপারটা সিরিয়াস্ কিছু না, সহজ ও অনুমেয় ব্যাপার, বললেই বুঝতে পারবেন। গত কয়েক দশকে ভেতরে-বাইরে নানাকিছুর অভিঘাতে ও সংঘাতে-দ্বন্দ্বে হয়েছে যেইটা, “আমরা যেমন সামাজিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্বাসগুলিকে হারিয়ে ফেললাম — তেমনই কবিতায় সুষ্ঠু, সুঠাম, ইউরোপীয় মনোলগ বা আত্মকথনের ভঙ্গিটি বিসর্জিত হলো; শুদ্ধ, পরিশিলীত ও নিটোল কবিতা রচনার প্রয়াস হাস্যকর হয়ে উঠল।” ঘটনাটা গানে কেন ঘটবে না তাহলে? কেন পুরাতনী পয়ারের পশ্চাদ্ধাবন করে যাবে বাংলা গান? উত্তরোত্তর ‘শুদ্ধ, পরিশিলীত ও নিটোল কবিতা রচনার প্রয়াস’ করে কেন নিজেকে একবিংশ শতকে এসেও হাস্যকর কবিতানুগামী করে রাখবে বেচারা হাজার বছরের বাংলা গান? কতকাল সে থেকে যাবে এহেন অন্ধ? কতকাল বন্ধ করে রেখে দেবে গুটিয়ে সে তার অনন্ত গগনে উড্ডয়নের পাখা? বাংলা গান কবে খেয়াল করে দেখবে যে, কবিতার মধ্যস্থ ‘কথা’ এরই ভিতরে পেয়েছে এক ট্র্যান্সগ্রেসিভ ল্যাঙ্গুয়েজ্ তথা যাবতীয় অর্থানর্থের নিষেধসীমা-লঙ্ঘনকারী ভাষা, যার দৌলতে কবিতা নিজেই নিত্যনব মিথ নির্মাণে সক্ষম, যেখানে গানের লিরিক্ তথা গানের ‘কথা’ আজও কবিতাপাশ ছেড়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে যায় না আশ্চর্য অক্ষমের ঔদাস্যে, কেন-যে হেন হতচ্ছাড়া ঘটনা তা হয়তো ভগ্মান জানে। এদিকে “গত কয়েক দশকের কবিতা ভরে গেল বহুবাচনিকতায় — এলোমেলো, গঠনহীন, উচ্ছৃঙ্খল, শতকৌণিক কথোপকথনের অনুপ্রবেশে। কবিতা হয়ে উঠল সর্বভাষিত আলোচনা বা ডিসকোর্স — যেখানে প্রলাপের একটি মাননীয় স্থান আছে এবং পাঠককে বুঝে নিতে হবে পাগলটি সে নিজেই।” ঠিক এই ব্যাপারটা বাংলাদেশের ব্যান্ডগানে সূচিত হতে দেখব গত কয়েক দশকের পট জুড়ে, জেমসের গানেই বিশেষভাবে ‘এলোমেলো, গঠনহীন, উচ্ছৃঙ্খল, শতকৌণিক কথোপকথনের অনুপ্রবেশ’ দেখব আমরা, দেখব ‘প্রলাপের একটি মাননীয় স্থান’ বাংলা ব্যান্ড গানে এবং জেমস ও মাকসুদের গানলিরিক্স ছাড়াও অন্যান্য অনেক ব্যান্ডসিঙ্গারের কাজে এই চিহ্নটির দেখা আমরা পাবো, শ্রোতাকে যেখানে বুঝে নিতে হয় যে এহেন প্রলাপের সমুজদার ও প্রলাপ-অনলবর্ষী শ্রোতাটি নিজেই। শীর্ষস্থ উদ্ধৃতির উৎস অত্র অনুনিবন্ধে বিরাজিছে তথাস্থানেই, কিন্তু পরের উৎকলনগুলোর উৎস ও প্রাপ্তিস্থান বলা হয় নাই এখনও; বলি এখন, উৎপলকুমার বসুর ‘সদাভ্রাম্যমাণ’ শিরোনামে একটা লেখা আছে, সেইখানেই উক্ত উদ্ধৃতিনিচয় পাওয়া যায়; সেজন্য দ্রষ্টব্য ‘গদ্যসংগ্রহ ১’, নান্দীমুখ, কলকাতা ২০০৫, পৃষ্ঠাঙ্ক ২৮২।
সংগীতের যে-স্বাধীনতার কথাটা ঠাকুর বলছিলেন, কবিতা বা আর-কোনো মহামার্গের অধীনস্থতা না-থাকা স্বাধীনতা, জেমসের সংগীতে তথা ব্যান্ডগানে সেই জিনিশ সীমিত হলেও সনাক্তযোগ্য সম্ভাবনাসমেত লভ্য। যত দ্রুত কথাটা আমরা যাচাই-বাছাই করে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত প্রকাশ করব, ততই মিউজিকের কল্যাণ, গোটা বাংলা আধুনিক গানের যাত্রা আগুয়ান হবে এই স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে।
কবিতার কথা, গানের কথা, স্বাধীনতা আর অধীনতা
কাজেই জিনিশটা আদৌ অবোধ্য হবার কথা না যে, একটা গানের লিরিক্স পাঠকৃতি বা টেক্সট্ হিশেবে পড়তে যেয়ে কবিতাপঙক্তির সবলতা-দুর্বলতা নিরূপণের বাটখারা মাথায় রাখার বাতিক থেকে কেন আমাদিগেরে বেরিয়ে আসতে হবে। এইটা বাংলা গান এবং বাংলা কবিতা উভয়ের জন্যই মঙ্গলবাহী। “গীতিকবিতা, আমরা জানি, সুর আর বাণীর সমন্বয়। কিন্তু সে কার কোড মানে? সংগীতের? না বাণীর?” — এই জিজ্ঞাসামালার মীমাংসায় আমরা নিশ্চয় লিপ্ত হব, অত্র অনুচ্ছেদে ভেদ সম্ভব না-হলেও গোটা নিবন্ধের বাইরে বেরিয়েও প্রশ্নোত্তরতৎপরতা আমরা থামাব না নিশ্চয়, তবে এসবেরও আগে একটা কথা আরেকবার বলে নেয়া যাক। বন্দিশের ক্ষেত্রে ‘কথা’ যেমন গৌণ, দুই-আড়াইটা বাক্যাংশে আধফোটা বোলের বেশি নয় শাস্ত্রীয় সংগীতের বন্দিশে কথাভূমিকা, আধুনিক গানের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অতদূর না-হলেও কথাপ্রাধান্য মোটেও মুখ্য নয়। তেমন যদি হতো তবে গান কোনোদিনই দাঁড়াতে পারত না কবিতার সঙ্গে প্রতিযোগে। এইটাও অন্ধ না-হলে দেখব যে, কবিতার কবিতাত্ব যেমন কথাভাগে নেই, তেমনি গানেরও গানত্ব কথায় বিরাজে না। দ্য ট্রুথ অ্যান্ড বিউটি অফ বোথ কবিতা অ্যান্ড গান হোথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে। দ্য ভেরি এসেন্স অফ কবিতা অ্যাজ্ ওয়েল্ অ্যাজ্ গান কথাগাত্রে কদাপি বিরাজে না।
আচ্ছা, তাহলে এইবার একটু বন্দুকটা রাখা যাক সতীর্থ কবির স্কন্ধে ফের। উদ্ধৃতি দীর্ঘ হবে, অগত্যা, প্রাগুক্ত উৎপলগদ্যসংগ্রহ থেকেই গৃহীত হতে যাচ্ছে উদ্ধৃতব্য কোটেশনটুকু। “কথা ব্যাপারটা কী? কেন হঠাৎ সুর-সমৃদ্ধ বাণীর বদলে সুরহীন, গদ্যময় কথার প্রয়োজন হবে? আমি এ-বিষয়ে একদা অল্প কিছু চিন্তাভাবনা করেছিলাম এবং আমার প্রস্তাব এ-ই যে, যাকে কথা বলে অভিহিত করা হচ্ছে অধিকাংশ স্থানেই তা হলো প্রোপোজিশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ। তার কোড হচ্ছে লজিকের কোড। কথ্য ভাষার ব্যাকরণসম্মত পদবিন্যাসের কোডের কাছে সংগীতের সুরবিন্যাসের কোডের নতিস্বীকার। এক্ষেত্রে ‘যদি’, ‘তবু’, ‘কিন্তু’, ‘যেহেতু’, ‘সেহেতু’ ইত্যাদি যুক্তি-আশ্রয়ী, শর্ত-আরোপকারী শব্দের আধিক্য দেখা যায়।” — এইখানে একটু বলে নেয়া দরকার হয় যে উৎপলকুমার বসু কথা বলছেন কীর্তন-পাঁচালী ইত্যাদি মাধ্যমের সংযোগপ্রক্রিয়া নিয়ে, কেন ও কেমন করে কীর্তনীয়া প্রসঙ্গান্তরে যাবার সময় সুর থেকে বেরিয়ে কেবল ‘কথা’ বলে শ্রোতার কাছে আসন্ন বিষয়ের অপরিচয় ঘুচাতেন। যদিও অত্র নিবন্ধে আমরা কীর্তনীয়া বা সংযোগপ্রক্রিয়া নিয়া ভাবিত নই, ওভারঅল্ গানের কথা নিয়া ভাবতে যেয়ে এহেন উদ্ধৃতির দুয়ারে দাঁড়ানো। পরে যেয়ে একই রচনায় এই কথাগুলো পাওয়া যাচ্ছে — “এবং দেখা যায় আরোহী এবং অবরোহী চিন্তার প্রকাশ। বা, ডিডাকটিভ-ইনডাকটিভ লজিকের সুরাশ্রয়ী সাবলীল বিচরণ। ডেসক্রিপশন সরে গিয়ে ন্যারেশনকে আসন ছেড়ে দেয়। আবার ন্যারেশনের স্থান নেয় ডেসক্রিপশন। বাঙালির গানে এই বৈশিষ্ট্যটি বারবার ফিরে-ফিরে এসেছে।” — এই রচনাটা প্রাগুক্ত গদ্যসংগ্রহে ‘নতুন বিষয়, পুরোনোভাবে ভাবা’ নামক গদ্যলেখায় পাওয়া যাবে, রচনাটা আছে ১৫১-১৫৮ পৃষ্ঠাঙ্ক জুড়ে, আমরা হাতে নিয়েছি ১৫৬ সংখ্যায় সূচিত পৃষ্ঠার দুইটা প্যারা। সেকেন্ড প্যারায় যেয়ে রবীন্দ্রসংগীতের কথাভাগ নিয়া ভাবনাটি পাচ্ছি একটি ইন্ট্রেস্টিং স্ট্যাটিস্টিক্স সহ — “উৎসাহী পাঠক লক্ষ করে দেখবেন, সতেরোটি রবীন্দ্রসংগীত ‘যদি’ দিয়ে শুরু হচ্ছে এবং তাদের লজিক্যাল কঠোরতা ঢাকা পড়েছে নিসর্গজাত চিত্রকল্পের প্রয়োগে, ধ্বনিমধুর শব্দ-সুর-তাল সংযোজনে। অর্থাৎ এ-জাতীয় গানে আমরা দেখতে পাচ্ছি বা শুনতে পাচ্ছি তিনটি কোডের গভীর সমন্বয় বা ওভারল্যাপ — শর্ত-আরোপকারী, কঠিন আদালতি গদ্যভাষার কোড; সংগীতের সুরবিন্যাসের কোড এবং কাব্যধর্মী লিরিক্যাল ইমেজ আর শব্দব্যবহারের কোড। পাঠক যদি খুব উন্নাসিক না হন তবে আধুনিক বাংলা গানেও এসব লক্ষণ নজর করে থাকবেন : হতাম যদি তোতাপাখি, তোমায় গান শোনাতাম / হতাম যদি বনময়ূরী, তোমায় নাচ দেখাতাম …” — কথাটা আপাতত এ-ই যে, লেনদেন বলি বা আদানপ্রদান, এইটা থাকতে হবে গানে, গভীরনিহিত সমন্বয় বা ওভার্ল্যাপিং থাকবে, কিন্তু সংগীতকে কবিতা হইবার কসরত না করতে হয় যেন। তখন কবিতাও হবে না, গানও হবে না, যা হবে বা যা হয়ে চলেছে তার নাম বলতে পারতেন পূজনীয় সুকুমার রায়। হাঁস ও সজারু যেন স্বীয় শরীর না-হারায়।
হে বঙ্গ, হে বেঙ্গল, হে ফাউন্ডেশন, বুদ্ধিবিমোহিত তরুণপ্রজন্ম হে
ব্যাংকে তোমার ব্যালেন্সের অ্যামাউন্ট কত, হে বেঙ্গল, তোমার ভাণ্ডারে বিবিধ রতনরাজির সঙ্গে হাঙরের সমুদ্রে হেনস্থা হয়ে লাইফ কাটায়ে যাওয়া পেইন্টারের ক্যানভাসগুলো তোমার বছরান্তের সম্পদশুমারিতে নেই, কিন্তু তুমি সংস্কৃতির মহান পৃষ্ঠপোষক হইয়া ধামা দিয়া চাপা দানিছ কতশতকিছু, তোমার সহৃদয় কৃপায় আমরা রাজাবাদশার দরবারি কানাড়া ও অন্যান্য মল্লার-জয়জয়ন্তী-ঝিঁঝুটি শুনিবার মওকা পাই, তোমার স্পন্সর্শিপে আমরা হামিদের মরখুটে ঘোড়াটার চিঁহিচিঁহি নিরবধি যাইছি শুনিয়া, আবহমানের গাধার পিঠে চেপে দেখি ফিরিতেছে সম্রাট ও ভাঁড়, তোমার দৌলতের বরাতে দেশজ ব্যান্ডগুলোকে ফেলে এখন আমরা বিদেশী ব্যান্ডের লাইভ কন্সার্ট উপভোগ করিবারে পারি টিকিট কাটিয়া সুশৃঙ্খল কিয়্যু দিয়ে, দেশের ব্যান্ডের কন্সার্ট প্রসঙ্গে নিরাপত্তা আমরা পারি না নিশ্চিত করিয়া উঠিবারে, হে জ্ঞানতাপসের জ্ঞাতি চিরপ্রণম্য মুরুব্বি আমাদিগের, ইন্ডিয়ান পণ্ডিত ও বিদূষীদের সামনে আমার মেয়েটা আমার ছেলেটা বাজায়ে-গেয়ে ঐতিহ্যগত ঘরোয়া আতিথেয়তাটুকুও প্রদর্শিবার যোগ্যতা আজও অর্জন করিতে পারিল না, আর তোমার ব্রাহ্মণ্য ওজনদারির পাল্লাপাত্থরে সে বা তারা তা পারিবেও না, আশ্রাফ ক্লাসের হে বিরাটবপু ষণ্ডা, স্বাধীনতার পর থেকে এতাবধি কিচ্ছুটি না-পেয়েও যে-ব্যান্ডটা মাটি ও মঞ্চ কামড়ে গেয়ে চলেছে খুন্ ও পসিনা ঝরায়ে, সেই ব্যান্ডটা আর সেই ব্যান্ডদলগুলোর সুযোগ জোটে না বিদেশী মহান রকারের সঙ্গে একটু জ্যামিং করিবারে, ‘জাস্ট অ্যা মিনিট’ মাতোয়ালা বাজিয়ে একটু হলেও নিজের বাদনদক্ষতাটুকু পরখিবারে, হে বঙ্গ, বলো, হে বেঙ্গল, এইসব দিয়া আমার বালের ফায়দাটা আমি বুঝে নেব কবে? কতকাল তুমি আমারে অ্যাপ্রেন্টিস্ ঠাওরে যেতে থাকবে, একটু মনের হাউশ মিটিয়ে নিজের অভিজ্ঞতাটুকু নিজের সৃজনত্রুটিটুকু শেয়ার করার সুযোগ দিবার যোগ্য মনে করবে আমারে কবে, হে, কবে? হে কর্পোরেটলর্ড আমার, মাগ্না চা খাইয়ে নেশা ধরিয়ে দেয়ার পরে বিকিকিনিকৌশলের বেনিয়াগিরি আমাদের অজানা নয়, আমরা চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো স্বদেশিনী, তুমি থাকো মুনাফাপারে, ওগো স্বদেশিনী! কিন্তু আমারও স্বভূমের নেশাভাং আছে, আমারও রয়েছে তালের রস ও আখের খুশবু, দর্শনার দিশি আমারও রয়েছে, সেসবের ঝাড়েবংশে বিনাশ ঘটানোর আগে তোমার এই মাল্টিপ্লেক্স আর স্টেডিয়াম দখল করে সেবাকারিক্রম থামিবে না আমি জানি। কিন্তু আমারও সৈন্যসামন্ত আজ তোমার কব্জায় বিমোহিত পপকর্ন আর মুর্গিমটনে। ক্যায়া ক্যাহনা, আফসোস, জানেজিগর ওগো দোস্তো! তরুণেরা আজি দিকে দিকে বেঙ্গলবিধৌত প্রশংসায় প্লাবিত। চৌদ্দগোষ্ঠী তার আজও শপাং-শপাং চাবুকাঘাতে চিৎকারিয়া যায় দিবারাতি, জীবিকাচাবুকে আর আচোদা মালিকের শেকলের চাপে, কিন্তু দ্যাখো সন্তানসন্ততিরা আজ গায় শান্তিহিম ঘুমের ছড়াগান। ওরে অবুঝ, ওরে আমার কাঁচা, তোর আধমরা মরমিপনা আর সুফিফেস্ট-ফোকফেস্টের ফাইজলামো কবে ভাঙিবে রে? ব্যান্ডের জন্য উন্মুক্ত ময়দান তুই কবে ক্লেইম্ করবি রে হতচ্ছাড়া? ফাউন্ডেশনের ফক্কিকারি কবে তুই বুঝিবি রে আমার শিবরাত্রির সলতে, রে অন্ধের যষ্টি পুত্তর আমার, রে কাঙালিনী সুফিয়ার বংশধর গুড়িয়া! “ধান নিয়ে গেল বোম্বেটে বর্গীতে / গানে গানে বুলবুলিটাকে দোষ দিতে / ফিরলে না তুমি সম্বিতে / নিভে গেল উনোনের আঁচ / মার খেতে খেতে বেধড়ক মার্কেটে / বেছে নিতে যদি একবার কোনোমতে / বেছে নিতে যদি একবার বড় ভালো হতো” — কবীর সুমনের গানের মর্মার্থ যদি হৃদয়ঙ্গম করতে একটাবার জীবনে, হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতনের স্বত্বাধিকারিক হে, তা সবে (অবোধ তুমি!) অবহেলা করিয়া যাইছ ডোভারলেইন্ মিউজিক্ কনফারেন্সের বাংলাদেশ চ্যাপ্টার হয়ে, ও আমার সন্ততিরা, হারাধনের দশা করে দিও না বাপেরে তোমার, হুঁশ ম্যে আও ম্যেরে লাল্, দমাদম মাস্ত কালামদার ছাড়াও সুফিগান আছে দুনিয়ায়, দ্যাখো খুঁজে আপন ক্বল্বের আয়নায়, জেমসও ব্লুজ গায় হে আমার হামসফর, বোগিও ব্লুজ গায়, জ্যাজ্ গায় মাকসুদ ও কতজনায় আরও, ওদের গানের গতিটা তো তোমাকেই বুঝে নিতে হবে হে, বেঙ্গল তোমারে নেবে না, জাতিসংঘ তোমারে নেবে না, ক্ষুধা নেবে, আদেহ ক্ষুধার ইতিহাস ও মুক্তচিত্ত সংগীতবুভুক্ষু ঐতিহ্য তোমার সম্বল, তুমি ইগ্নোর কোরো না তারে … এই-যে চাপাতিকীর্তিকলাপের মোচ্ছব, তোমার ধড় থেকে মুণ্ডু খসাবার এই-যে ঝননঝনন বঁটি-ছুরিকা বাজিয়া যাইছে অহর্নিশ, বন্দিশের আসরে আর ছায়ানটরাজ্যে এর নিদান সহসা নাই, “দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব / বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে”, এই মৃত্যুবর্ণ বদ্বীপে, “শ্মশানে-কবরে ঘুম জাগাও, জাগাও / বানিয়েছি ডুগডুগি বাজাও, বাজাও”, খুঁজে দ্যাখো, সময় এখনো তোমার হাতছাড়া হয় নাই, তোমার ডুগডুগি তোমার ডপকি আর তোমার ড্রামসের স্টিক্ এখনো তোমার অপেক্ষায়, যা বানিয়েছে জেমস-কফিল আর তাদের পূর্বজেরা “আমার মাথার খুলি, করোটি ও হাড়ে” … দ্যাখো হে, “ওঠো হে, দরজা-জানলা খুলে / সময়ের ঝুঁটিটা এইবেলা / শক্ত মুঠোয় ধরো / ওঠো হে” … দ্যাখো প্রতুল মুখোপাধ্যায় গানটা কবে গেয়ে থুয়েছে … বেঙ্গলে দণ্ডেক বেলা নাই হে … বেলা যায়, দ্যাখো, ভবের মায়ায়, বেঙ্গল শুদ্ধবাদগর্বা আসরের অসোয়াসায়, রইলি রে তুই ভুলিয়া … দ্যাখো তোমারে জেমস ডাক দিয়া যায় — “একবার খেলা ছেড়ে এসো ফিরে রে / এসো আপন ঘরে চলিয়া / ভবের মায়ায় রইলি রে তুই ভুলিয়া …
ক্যাপ্সুল্ ৫০০ মিগ্রা, স্ক্রুড্রাইভার এটেসেট্রা
বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিক্যাল্ অ্যাক্টিভিটি ছিল তখন সত্যিকার অর্থেই সৃজনোল্লাসে-কাঁপা আন্দোলনে বেগপ্রমত্ত। নব্বই দশকে এসে এর তুঙ্গস্পর্শ ও মুখ-থুবড়ে-পড়া প্রায় একইসঙ্গে সংঘটিত হয়েছে দেখতে পাবো। শতেক ব্যান্ডের মধ্যে এখন সাতটাও খুঁজে বের করা দায় হবে। এত উদ্যম, উচ্ছ্বল-উদ্বেল ওই দীর্ঘ বছরের সাংস্কৃতিক সোল্লাস তৎপরতা, মুহূর্তে উবে গেল! কর্পূরের মতো উদ্বায়ী ছিল বলে তো মনে হয়নি কখনো কর্মকাণ্ডগুলো। তবু কোন-সেই কারণে হেন পরিস্থিতি উদিত হলো? ছোটকাগজ তথা বাংলাদেশের লিটলম্যাগের ষোড়শোপচারের উদ্যম পঞ্চভূতে বিলীন হবার ন্যায় ব্যান্ডের পঞ্চত্বপ্রাপ্তিও অভিন্ন সমসাময়িক। দোষ কার? শুধুই বাজারের? বিপণনব্যবস্থার? কে সেই বাজারকর্তা বা বিপণনসর্দার? ভোক্তাদের কোনো দোষভার নাই? কিংবা নাই কোনো অত্যুৎসাহী পৃষ্ঠপোষক-স্কন্ধদায়কদের দায়ভাগ তাতে? এবং যারা ব্যান্ডের শিল্পী, বিভিন্ন বয়সী সমুজদার যারা, ‘বামবা’ ইত্যাদি শিল্পীজোটবদ্ধ সংগঠনকে বেকসুর খালাস দেয়া যাবে এই দেশের লড়াকু — মূলত মধ্যবিত্তের — শিল্পকলাধারা ব্যান্ডবংশ ধ্বংসের দায়ভার থেকে? এইসব প্রশ্নের সুরাহা আমাদেরে একদিন দেরিতে হলেও করে নিতে হবে।
‘ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম’ ধাঁচের পরিচয়ে একটা বাণিজ্যিক উদ্যোগ এতটা ধারাবাহিক হয়ে ওঠে একটা সময়ে এসে এবং অর্জন করে ব্যবসায়িক মুনাফাসাফল্য, তুলনামূলক বিচারে ব্যান্ডের সেল্ফ ইনিশিয়েটেড টাইটেলগুলো যথেষ্ট মোটা প্রোফিট নবাবপুর-পাটুয়াটুলিভিত্তিক অডিয়োপ্রকাশকের ঘরে এনে দিলেও মিক্সড মাসালার চেয়ে সেইটা স্বাভাবিকভাবেই ছিল কম অঙ্কের, ফলে ক্যাসেটকোম্প্যানিগুলো অধিক মুনাফা আর ম্যাক্রো অডিয়েন্স রিচ্ করার বাসনায় ব্যান্ডঅ্যালবাম বাজারজাত করার চেয়ে ব্যান্ডমিক্সড বের করার দিকেই নিবদ্ধ করে বেশি বিনিয়োগ। জগাখিচুড়ি ধীরে ধীরে বেড়ে চলে। এলেবেলে গজায়ে-ওঠা মিউজিক্-অ্যারেঞ্জারে ছেয়ে যায় ইন্ডাস্ট্রি। এক-সময় এলেবেলেদের ভিড়ে ব্যান্ডমিউজিশিয়্যানরাই কর্নার্ড হয়ে পড়েন। হুঁশ ফিরলেও ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। ব্যাহত হয়ে গেছে ব্যান্ড অ্যাক্টিভিটি। মিউজিক্ ছেড়ে বেশিরভাগ গাইয়ে-বাজিয়ে স্রেফ গ্রাসাচ্ছাদন জুটাতে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। এদের কেউ কেউ প্রবাসে দৈবের বশে, রেস্টুর্যান্ট বা গ্রোসারিশপে হপ্তা-মাইনেতে বাঁধা কাজের মাঝে মাঝে, কান্নাধারার দোলার ন্যায় থামাতে চেয়েও অপারগবশত বয়ে বেড়িয়েছেন গানটা, আন্দাজ করি; দেড়-দুই দশকের প্রবাসমুক্তির পরে দেশে ফিরে এসে এরা আবারও নতুন গ্রুপ্ গড়তে চেষ্টা করছেন গানের, এই ২০১৫-পর্যায়ে এসে, দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সময়ের এবং বয়সের তথা জেনারেশন্-গ্যাপের একটা কালকূটিল দুশমনি তো অস্বীকার করার নয় কারো পক্ষে। ব্যাপারটা প্রত্যাবর্তিত সংগীতপাগলপারা ব্যান্ডশিল্পীদের বেলাতেও লক্ষ করা যায়। এভ্রি জেনারেশন্ গেটস্ দি লিট্রেচার ইট্ ডিজার্ভস্, এভ্রি জেনারেশন্ গেটস্ দি মিউজিক্ ইট্ ডিজার্ভস্ — কথাগুলো মনে রেখে একবার ফিরে তাকালেই বিমূঢ়-করা দায়ভার আমার নিজেরেই নিতে হবে, এবং তখন বহুবিধ বন্দিশের বনেদিয়ানা ভুলে সেল্ফ-রিয়্যালাইজেশনের স্বরে রিসাইট্ করে যেতে হবে এই কবিতা : “আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে / আমরা দুজনে সমান অংশীদার; / অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে, / আমাদের ’পরে দেনা শোধবার ভার।” বলা বাহুল্য, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কবিতাটার রচয়িতা, ব্যান্ডসংগীত বা শাস্তরসংগীত প্রভৃতি ক্যায়োসের বাইরে এই কবিতার ফ্লাইট্ — কথাটা আদৌ বলার অপেক্ষা রাখে না।
ব্যান্ডমিক্সড অ্যালবাম বের করার আইডিয়াটা ভালোই ছিল গোড়াতে, একটা বৃহত্তর শ্রোতাগোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যান্ডের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে এরই কল্যাণে। একদম শুরুর দিকে আশিকুজ্জামান টুলু, আইয়ুব বাচ্চু, পার্থ প্রমুখ জড়িত ছিলেন প্ল্যানিং-অর্গ্যানাইজিং প্রভৃতির সঙ্গে। একটা স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখার চেষ্টা লক্ষ করা যেত গোটা আয়োজনে। তেরোমিশালী হয়েছে একটা পর্যায়ের পরে থেকে। মেইনস্ট্রিম্ কিংবা অফস্ট্রিম্ কোনো প্রকারের ব্যান্ডসাংগীতিক সোহবত্ ছাড়া ঝাঁকে ঝাঁকে অ্যারেঞ্জারে ক্যাপিট্যাল্ সিটির স্টেডিয়াম্-মার্কেট, নবাবপুর, পাটুয়াটুলি গিজগিজ করতে থাকে। এদের অ্যারেঞ্জমেন্টে বেরোতে থাকে ল্যাবগ্যাবে অ্যালবামগুলো। স্টলোয়ার্ট ব্যান্ডগুলোর ভোক্যাল্ সকলেই নির্বিচারে ক্যাশ্-ইন্-হ্যান্ড হপ্তান্তে একাধিক মিক্সড মাসালা গাইতে থাকেন। পরে যখন তারা তাদের ব্যান্ড থেকে অ্যাসোসিয়েটিভ ক্রিয়েশন্ হিশেবে অ্যালবাম ছাড়েন বাজারে, ম্যাস্-পিপ্যল্ তখন তাদের কাছ থেকে মিক্সডের চটপটি-ফুচকা আশা করে থাকায় সেইটা না-পেয়ে স্বভাবতই রিজেক্ট করে। একবার তোড়ে ভেসে গেলে ফের তীরে তরী ফেরানো অত সহজ নয়।
এর মধ্যেও রয়েছে বেশকিছু সুখকর অভিজ্ঞতা। ব্যান্ডমিক্সড ধরনের আয়োজনে বেশ কয়েকটা স্মরণীয় কাজ হয়েছিল, আমরা এইভাবেই প্রিন্স মাহমুদের মতো গুটিকয় ভালো সুরকার-সংগীতযোজনাকারী-গীতিকার পেয়েছিলাম, তবে এইটাও উল্লেখ্য যে এই প্রিন্স মাহমুদ ও অন্যান্য ব্যান্ডমিক্সড টাইপ্ সংকলনের সুরগীতিকারেরা আদৌ মৌলিক সংগীতকার বলে সেইভাবে কখনো মনে হয়নি; প্রিন্স প্রমুখেরা মাকসুদের জন্য সুর করেছেন ফিডব্যাকধারায়, হাসানের জন্য আর্কস্টাইলে, তেমনি বাচ্চুর জন্যে এলআরবি আর জেমসের জন্যে ফিলিংস/নগরবাউল ধাঁচ অনুসরণ করে। এইসব অনুসৃতির ভিতর প্রিন্স প্রমুখ কয়েকজন সফলভাবে উৎরে গেছিলেন। তবুও এরা কেউ স্বকীয় সুরধারা পারেন নাই তৈয়ার করতে। কয়েকটা ভালো মিশ্রসংকলনের নাম মেনশন্ করা যাক, যেগুলোতে জেমস তার নিজের ধারায় থেকে গেয়েছেন; ধরা যাক একেবারে গোড়ার দিককার একটা অ্যালবাম ‘শক্তি’, যেখানে জেমস গেয়েছেন ‘জানালা ভরা আকাশ’ এবং ‘আমি ও আঁধার’ শীর্ষক দুইটা দারুণ শক্তিশালী লিরিক্স ও কম্পোজিশন্; একইভাবে ‘আলোড়ন’ অ্যালবামে ‘জাদুকর শয়তান’, ‘টুগেদার’ অ্যালবামে ‘পরাধীন বাংলা’ ও ‘নাটোর স্টেশন’ শিরোনামক দুইটা গান, ‘গাঁয়ের খবর’ মিক্সডঅ্যালবামে নামগান ছাড়াও ‘অধিকার নেই’ শিরোনামে আরেকটা, ‘শেষ দেখা’ অ্যালবামে ‘এই গানই শেষ গান’, ‘ধুন’ সংকলনে দুর্ধর্ষ সেই ‘চিরহরিৎ’ ছাড়াও ‘একের ভিতর তিন’, সম্পূর্ণ ফোক্ ঘরানায় জেমস এ-যাবৎ একটা গানই গেয়েছেন এবং গানটা দিয়ে জেমস প্রমাণও করতে পেরেছিলেন যে ফোক্ গাইলে একেবারেই ভিন্ন ঝড় বহানোর ক্ষ্যামতা তিনি রাখেন, ‘রঙ্গমেলা’ অ্যালবামের মাধ্যমে সেই গানটা কানে এসে পশেছিল; সময় এখনও পগারপার হয় নাই, যে-কোনোদিন জেমস লালন বা আর-কোনো মহাজনের গান গলায় নিয়ে একটা অ্যালবাম করে ফেলতেও পারেন। তখন ব্যাপারটা কেমন হবে, ভাবলেও শরীর ও মন শিউরে ওঠে ম্যাজিক্ সন্দর্শনের আগাম সম্ভাবনায়। অ্যানিওয়ে। যা বলছিলাম … কী যেন বলছিলাম? আজ্ঞে হ্যাঁ।
মিক্সডঅ্যালবাম নয়, এখানে একজোড়া অ্যালবামের নামোচ্চারপূর্বক একটু পরিচয়সংক্ষেপ উল্লেখ করা যাক শুধু। ‘স্ক্রুড্রাইভার’ এবং ‘ক্যাপসুল ফাইভহান্ড্রেড মিলিগ্রাম’ সেই অ্যালবামদ্বয়ের নাম। এ-দুটো মিক্সড নয়, ভিন্ন ধাঁচের অ্যালবাম ছিল। জেমস এবং আইয়ুব বাচ্চুর যৌথ সংকলন। একপিঠে জেমসের এবং অন্যপিঠে বাচ্চুর পাঁচটা করে মোট দশটা গানের অ্যালবাম। প্রথমে ‘ক্যাপসুল ৫০০ মিগ্রা’, সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ‘স্ক্রুড্রাইভার’। এর পরে, এর অনেক পরে, ‘পিয়ানো’ নামে একটা অ্যালবামে এর অনুবর্তন লক্ষ করা গিয়েছিল শুধু। পরে এইধারা আর ফেরে নাই। ‘ক্যাপসুল’ অ্যালবামে জেমসের গানপঞ্চক ছিল যথাক্রমে ‘কতটা কষ্টে আছি’, ‘দূরে আছি তাই’, ‘যতটা পথ’, ‘হে পাগলী’, ‘নিষিদ্ধ ইতিহাস’; অনুরূপ ধারার ‘স্ক্রুড্রাইভার’ অ্যালবামে জেমসের গানগুলো একে একে ‘বাংলার লাঠিয়াল’, ‘যে পথে পথিক নেই’, ‘মধ্যরাতের ডাকপিয়ন’, ‘বেদুঈন’ এবং ‘ব্যাবিলন’। পরে কেন-যে এই ধারার অ্যালবাম কন্টিনিউ করে নাই, কে জানে। এরপর হাসান সহ ত্রয়ী শিল্পীর সহযাত্রায় বেশ দুই-তিনটা অ্যালবাম হয়েছিল, অত উৎরায় নাই আগেরগুলোর ন্যায়। অ্যানিওয়ে।
এশিরিয়ায়, মিশরে, বিদিশায়, ব্যাবিলনে
এমন নয় যে জেমসের কাঁধে ইতিহাসগ্রন্থি মোচন করার দায় নিতেই হবে। সেইটা আদৌ বলার বেতমিজি এখানে করা হচ্ছে না। তারপরও বলবার কথাটা আমাদের এ-ই যে, জেমসের অনেক গানে দেখা যায় এমনকিছু প্রসঙ্গের/অনুষঙ্গের উপস্থিতি যেগুলো দুনিয়ার/স্বদেশের ইতিহাসলগ্ন; যদিও গোটা গান শুনে শেষে সন্দেহ হয় এতদব্যাপারে, লিরিকানুষঙ্গিক সেই ইতিহাসব্যাপারে, এই গানের প্রকাশ্য শিল্পী বা আবডালের গানপ্রণেতা ব্যক্তিটি আদৌ সচেতন ছিলেন তো? মর্মে থাকা চাই ইতিহাসচৈতন্য ও পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান, — কবির বুনিয়াদভিত্তি হিশেবে এই-যে এক শর্ত শুনায়েছেন জীবনানন্দ, সংগীতকারের কাছে এতটা না-চাইলেও ন্যূনতম কমনসেন্স দিয়েই গীতিকার গোটা ব্যাপারটা কোনো-না-কোনো ফর্মে অ্যাড্রেস্ করবেন, এমনটা কাম্য। সবসময় যা কাম্য তা না-ও ঘটতে পারে। জেমসের বেলায় এইটা হয়েছে; যা কাম্য, হয় নাই তা আদৌ। সমস্যাটা খানিক খুলিয়াই বলা যাক।
‘বনলতা সেন’ কবিতাকিতাবে একটা ‘হাওয়ার রাত’ শিরোনামের কবিতা আছে, যেখানে জীবনানন্দ স্বপ্নবাস্তবিক স্বরে এশিরিয়া-মিশর-বিদিশা-ব্যাবিলন প্রভৃতি নিয়ে এসেছেন, শুধু ধ্বনিমাধুর্য নয়, সিগ্নিফিক্যান্সের দিক থেকেও কবিতাটা আলাদা মর্তবা সহ অস্তিত্ব বহাল রেখেছে। “যে-রূপসীদের আমি এশিরিয়ায়, মিশরে, বিদিশায় মরে যেতে দেখেছি / কাল তারা অতিদূর আকাশের সীমানার কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে / করে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন — / মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য? জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য? প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য?” কবির বর্ণনাগুণে একটা রাত কত অবর্ণনীয় উদ্ভাসের হয়ে উঠতে পারে, এর অনন্য নজির এই কবিতা। জানালা দিয়া রাতের বাতাস প্রবেশিছে ‘সিংহের হুঙ্কারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো’, অন্ধকার আকাশে নক্ষত্রগুলো ‘অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের মতো ঝলমল করছিল’, ‘জ্যোৎস্নারাতে ব্যাবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল’ করা আশ্চর্য উপমান-উপমেয় কুটুম্বিতাঋদ্ধ কবিতা-উপান্তে যেয়ে কবির হৃদয় ‘বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে, দিগন্তপ্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে’ এক অপার্থিব/অতিপার্থিব বোধোদ্ভাসে ভরে যায়, ‘মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব রোমশ উচ্ছ্বাসে, জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততায়’ একটা রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতা আমরা লাভ করি। জীবনানন্দকথিত ‘কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা’ আমরা এই কবিতায় এবং তৎরচিত অন্যান্য কবিতায় পেয়ে যাই। জীবনকবিতায় স্থাননামগুলো শোভাবর্ধক অনুষঙ্গ নয়, ইলাস্ট্রেশনের নন্দনরেখা মাত্র নয় সেসবের প্রেজেন্স, আলঙ্কারিক গরজেই উদ্গত নয় জীবনানন্দের স্থানিকতা। আপনাআপনি ইতিহাসচেতনা আর কালবিবেচনা তাতে পেয়ে থাকি আমরা তার কাব্য পড়তে যেয়ে। জেমসের এহেন অনেক গান রয়েছে যেগুলো ঐতিহাসিক অনুষঙ্গের আভাসবাহী হওয়া সত্ত্বেও মনে হয় না গানপ্রণেতা বা গায়ক গীতিধৃত অনুষঙ্গের ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে সচেতন। ফলত অহেতু-অনুরাগহীনতায় বীতশ্রদ্ধ হয় শ্রোতার হৃদয় নির্দিষ্ট ওই গানটা/গানগুলো শুনতে যেয়ে। এরচেয়ে সেই ইঙ্গিতপ্রবাহী সূত্রের উল্লেখ গানবাণীভাগে না-থাকলে বরং সদর্থে প্রেমরোম্যান্স বা আর-কোনো অচিহ্নিত রোম্যান্টিক্ ভাবাবেগে শ্রোতা ভালোই রিলেট করে নিত গোটা গানটাকে। একটা এক্সাম্পল্, জেমসের গান থেকে, নেয়া যাক হাতে : “ব্যাবিলনের ব্যস্ত পথে হারিয়ে ফেলেছিলে তোমার পায়ের নূপুর / প্রাচীন সেই শহরের আঙিনা জুড়ে ছিল মায়াবী দুপুর / সোনালি নূপুর পেয়ে যখন তোমাকে দিলাম / তোমার চোখে গভীর নীলে হারিয়ে গেলাম আমি / অন্যভাবে এসেছিলে সুখের মৌনতায় / তোমার ছবি বেঁচে আছে ইতিহাসের অলিতে-গলিতে স্মৃতির নীরব প্রহরে / হারানো অতীতে তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি / সময়ের বুকে কান্না আমার প্রদীপের মতো জ্বেলেছি / আজও তোমাকে খুঁজে ফিরি প্রতিটি প্রাচীন শহরে / ইতিহাসের অলিতে-গলিতে স্মৃতির নীরব প্রহরে” — এই লিরিক্সগাত্রে ব্যাবিলনের উপস্থিতি একদম সূচনাশব্দ হিশেবে দেখতে পেয়ে, এবং উল্লেখ্য যে গানটার শিরোনামও ওইটাই তথা ‘ব্যাবিলন’, চেতনাবাহক শ্রোতা আপনি উৎকর্ণ হলেন এবং গোটা গান খতম করে শেষে হলেন বিরসবদন; না, যা ভেবেছিলেন তা নয়, এই ব্যাবিলন নয় সেই ব্যাবিলন যা মার্লের ‘ফোর হান্ড্রেড ইয়ার্স’ বা ‘ব্যাবিলন্ সিস্টেম্’ সহ সমগ্র বব মার্লে মিউজিকে একাদিক্রমে এসেছে; এ নয় সেই সিস্টেম্ অফ ব্যাবিলন্ যা কালাআদমিদের রক্তচোষা, ব্যাবিলন্ বলতেই যে-সভ্যতার গালগপ্পো শোনায় আমাদেরে সভ্যতাযাজক মহামার্গীয় সফেদবর্ণারা — জেমসের ‘ব্যাবিলন’ যেন ওই মিথ্যাভাষ্যের প্রতিধ্বনিপ্রচারক; ফলে বেহদ্দ রক্তচোষকতন্ত্র তথা ব্যাবিলন্ সিস্টেমের ইশারা আমরা গানটাতে পেতে যেয়েও দুর্ভাগ্যবশত পাই না। জেমসের গানে, ব্যান্ডের বাংলা গানে, এহেন প্রত্যাশাহত হতে হয়েছে আমাদেরে বারবার। একটা মাত্র উদাহরণ এ-যাত্রা বাড়ানো যাক, অত্যন্ত জনপ্রিয় জেমসের সেই নাম্বারটার নাম ‘মীরাবাঈ’; ইতিহাসের, নারীনিগ্রহের সাংস্কৃতিক চর্যার এতদভূখণ্ডের ইতিহাসে, অল্পজ্ঞাত লোকেরও অজানা নয় মীরার সৃজনসংগ্রামী জীবনকাহিনি; মীরার ভজন শোনেন নাই এমন সংগীতানুশীলক বদনসিবগ্রস্ত সমুজদারের সংখ্যাও অঙ্গুলিমেয়। অথচ জেমসের গানের মীরা খালি ঝাকানাকায় ব্যয়িত হতে দেখা যায়। কেবল অঙ্গ নুয়াইয়া আর কোমর দুলাইয়া মাতোয়ালা করিতেই ব্যস্ত দেখা যায় জেমসের গানসৃষ্ট চরিত্রাটিকে। এমনিতে এই গানটা, বা ব্যাবিলন গানটাও, কম্পোজিশন্ হিশেবে নান্দনিক ও লক্ষ্যভেদী। কিন্তু গোলটা বাঁধে ইতিহাসাশ্রিত অনুষঙ্গ চয়নের কারণে, সেইটা গানরচয়িতার অনবধানবশত হয়তো, এমনও হওয়া আশ্চর্য নয় যে এহেন গোলকধাঁধা-দ্ব্যর্থক মরীচিকা তৈরি করা গানটার নেপথ্যজন সকলের অভিলষিতই ছিল। অবশ্য হুয়িম্সিক্যাল্ ক্যারেক্ট্যারিস্টিক্স সাইকেডেলিক্ রকের একটা সাধারণদৃষ্ট বৈশিষ্ট্যও।
তবে জেমসের গানে এই ইতিহাসপ্রাসঙ্গিক অচৈতন্যই শেষ কথা না; ব্যর্থতার পাশে এ-বাবতে সাফল্যও রয়েছে। একটা গানের অনবদ্যতা আমরা ভুলব না কোনোদিনই, ইন্ টার্মস্ অফ লিরিক্স এবং কম্পোজিশন্ ও রেন্ডিশন্ সবকিছু মিলেজুলে এর অবিস্মরণীয় উদ্ভাস, গানটা ‘সুধাংশু’ শিরোনামে চিহ্নিত। ‘মনে পড়ে সুধাংশু / সেই ঊনিশপাঁচদুই’ … ইত্যাদি কলি দিয়া গানটা শুরু হয় এবং জেমসের ঝড়ো দরদের গায়নশৈলী সিনেমার বিশাল স্ক্রিনের ন্যায় এক-লহমায় আমাদেরে দেখিয়ে আনে এতদঞ্চলের গরিমাকালের চুম্বক দৃশ্যান্তরাল। ‘জবাব চাই’, ‘রাজনীতি’, ‘হেরেমের বন্দিনী’ ইত্যাদি বেশকিছু গানে এই ধারার শস্য লক্ষ করা গেছে। কিন্তু ‘সুধাংশু’ কম্পোজিশনটা আরও কতিপয় চিহ্ন ধরে রেখেছে, এর মধ্যে লৌকিক চণ্ডাল বাংলার অনভিজাত/অসম্ভ্রান্ত সম্বোধনপদ এবং আঞ্চলিক কথ্যবুলির লাগসই ব্যবহার উল্লেখযোগ্য উজ্জ্বলতায় নিরুপম সুশ্রাব্য করে তুলেছে গোটা গানটাকে, এই দিগন্তের কথাবার্তা আমরা বাংলা গানের গোলাঘরে একদিন নিশ্চয় তাৎপর্যসমেত তুলিয়া আনতে উদ্যোগী হব।
লঙ্ঘিতে হবে দুর্গম গিরি দুস্তর পারাবার
বাংলায় জেমসের আগে এক কবি জন্মেছিলেন যার কাজকর্মের সামনে পর্বতদর্প মুহূর্তেই মিকিমাউসের ন্যায় মিইয়ে যেত, ঐশী নিরালম্ব পরাক্রমও কবিকৃত উচ্চারণের সামনে পেছিয়ে যেত সন্ত্রস্ত, হিমাদ্রিশিখর নুয়ে এসে কুর্নিশ করে যেত কবির উন্নতশির দ্রোহের সমক্ষে। লেটোর দল থেকে সেই কবি কালক্রমে ইংরেজকোম্প্যানির আরশ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। কবির নাম, জেমসের ভাষার পূর্বপুরুষ সেই নির্ঘোষ দাপুটে বক্ষপিঞ্জরসম্পন্ন কবির নাম, কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের কবিতা সামনে এলেই যেমন মনে হয় এ রচিত হয়েছে উচ্চারিত হবার জন্যে, জেমসের গানেরও এই এক ব্যাপার যে দেখামাত্র/শোনামাত্র সোচ্চার করে তোলে দর্শক-শ্রোতাদেরে। একটা ফারাক এ-ই যে, নজরুলের উচ্চারণ যেন সমষ্টিকে দাঁড় করাবার তাগাদাবাহী, কিন্তু জেমসের গান চায় ব্যক্তিকে দাঁড় করাবারে। একদম সটান, সতেজ, উন্নতশির, শতবর্ষের নির্জনতায় নির্দ্বন্দ্ব উচ্চারণোদ্যত। সংহত, শাণিত, সম্পন্ন, উদ্বোধিত, স্বোদ্ভাসিত। নজরুলের টানটান শ্বাসরুদ্ধকর ও তেজোদ্দীপ্ত উচ্চারণের গাম্ভীর্যসবল মন্দ্রসপ্তকের কবিতার ন্যায় জেমসের গানমালা সাম্প্রত বঙ্গের সংগীতমঞ্চে আনপ্যারাল্যাল্ এবং অদ্বিতীয় বললেও অত্যুক্তি হবে না। ব্যক্তির ভাঙনমুহূর্তে বাতায়নপাশে গুবাকতরুবীথিকায় স্বীয় দুঃখকথিকা গাইবার বাইরেও রয়েছে একটা আলাদাজাগতিক গান, সেই গানের জন্য ময়দান দরকার, কান্তার মরুর মহাশূন্যতা সামনে রেখে সেই গানের সত্যিকারের উড়ান বা ফ্লাইট, নজরুল জানতেন এই কথাটা, আর জানেন জেমস। ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্যনিরিখে যে-দুই প্রধান প্রবণতা বাংলা বর্ণমালার — অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ ধ্বনির ভিন্নতর তাৎপর্যদ্যোতনা — সেইদিক থেকে বলা যায় যে জেমসের গান নজরুলের মতো মহাপ্রাণজাত উচ্চারণের বৈভবে ভরপুর। জেমসের গান উচ্চারিত হবার জন্যে এমনকি নির্জীব-নিঃসাড় শ্রোতার জিহ্বায় এবং শরীরতন্ত্রে সাড়া জাগায়।
জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা
“উনিশশ’ পঁচাশি সনে একদিন লক্ষ্মীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিঁড়ে যায়।” — এই ছিঁড়ে-যাবার ইতিহাসবৃত্তান্ত কি জেমসের গানে পাওয়া যায়? এই সিচ্যুয়েশন্, এর অ্যানালিসিস্, ঝড়ো-হাওয়া আর প’ড়ো বাড়িটার সংগতিহীনতার গল্প অমিয় চক্রবর্তীর ন্যায় জেমসের গান পুঙ্খানুপুঙ্খ বলতে পেরেছে আমাদেরে? যে-আখ্যান শহীদুল জহির আমাদেরে শুনায়েছেন, অবিকল ওই আখ্যানভাগ পুনর্বয়নের কথা আমরা বলছি না। বাংলাদেশপর্বের টালমাটাল উত্থানের সেই টাইমলাইনে জেমসের গান কি নিজের করণীয় সুস্পষ্ট সম্পন্ন করেছে? সেই জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা ব্যান্ডের গানে এক্সপেক্টেড লেভেলে পেয়েছি কি আমরা? না, সংক্ষেপে উত্তর, দার্ঢ্য সহকারে জেমসের গানে সেই বাংলাদেশ আসে নাই। ফিডব্যাকে এসেছে কিছুটা, মাকসুদ থাকাকালীন ফিডব্যাকে, এবং কতকটা ঢাকা ব্যান্ডে, বেশকিছু ওয়ারফেজে, সে-সময়কার প্রমিথিউজ ও নোভা খানিকটা বাংলাদেশ ধরতে চেয়েছে মাঝখানে, রেনেসাঁ তাদের ‘তৃতীয় বিশ্ব’ অ্যালবামে একঝলক আশা জাগায়ে ফের বিবরে গেছে ফিরে। জেমসের অসংখ্য কম্পোজিশনে এই চিহ্নটুকু দরিশন সত্ত্বেও অন্তিমে খেদ রয়ে গেল। বব মার্লে যেমনটা তার কওমের কাছে, জেমস তেমন রাস্তায় গেলে একটু মন্থর গতিতে হলেও বরেণ্য হতেন আরেকটু অন্যতর উচ্চতায়। খেদ রয়ে যায়, হায়, কিছু আক্ষেপ রহিয়াই গেল বিলক্ষণ। কমলকুমার প্রণীত আখ্যানের সেই মায়া যেন। পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে না-পারা বাংলাদেশের স্যান্ডেল আজও ফট করে ছেঁড়ে লেনে-বাইলেনে, বছরে বছরে, পঞ্চবার্ষিক হিস্যা ভাগাভাগির গদিচিন্তা চমৎকারা রাজনীতিতে, জেমসের গানগুলো উনিশশ’ পঁচাশি সনের উত্তরকালীন হয়েও সমষ্টির সংগতিহীনতা আর সংগতিবিধানের টানাপোড়েন ও সদগতি নিয়া ভাবিত হতে দেখি না। নাই যা, তা তো নাই-ই, কী হবে সেসব নিয়ে ভেবে মিছেমিছি? ইতিহাসের একটা কাব্যিক সাঙ্কেতিকতা খানিকটা আছে বটে, বেশকিছু কম্পোজিশনে সেসব অনুষঙ্গচিহ্ন শ্রোতা নিজজ্ঞানে বুঝে নেন, কিন্তু খোদ শিল্পীর দিক থেকে খুব-একটা তো কনফিডেন্ট নয় সেসব প্রকাশনা। আমরা এখানে এই বিলাপ না-করি বরং। সময় তো ফুরায়েও যায়নি, শিল্পীও তো মঞ্চেই, ইস্তফা দেন নাই জেমস এখনো। ফলে এসব নিয়া আরও মন্থনের সুযোগ নিশ্চয় পাওয়া যাবে ভবিষ্যতে। জেমসেরও ছন্ন মতি ফিরবে নিশ্চয় বাংলা গানে ফের। তদ্দিন তো অপেক্ষা আমরা সানন্দ করতেই পারি।
মঞ্চারোহী নীলকণ্ঠ
শিবের আরেক নাম নীলকণ্ঠ, ব্যোমভোলানাথ, জগতের যাবতীয় গরল যিনি স্বীয় গলায় গিলে নেন। ঘূর্ণিনৃত্যে যিনি স্বর্গমর্ত্যপাতাল একাকার করে দেন। জটা থেকে বেরোয় নিরবধি নির্ঝরিণী। কিংবা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেও মন্থন করেন ব্রহ্ম। মঞ্চে জেমসের এই নীলকণ্ঠ দশা, ‘সাপের চোখের মতো চাওয়া-পাওয়া / জঙ্গলে ভালোবাসা’ গানের লাইনে এই শীতল সংগীতশীৎকারতুল্য শৌর্য, বারবার দেখেছে বেঙ্গলি মিউজিকশ্রোতাবন্ধু। ঘূর্ণিমাতাল সুরের শিবত্ব, মাস্ত-হাল দরবেশের হুয়ির্লিং, ঝুম কাওয়ালির মাতোয়ালা রাইতের দৃশ্য প্রকাশ্য অপরাহ্নেও! মঞ্চে জেমসের সত্যিকার উড্ডয়ন, দর্শকশ্রোতা মাত্রেই অবগত, দৃশ্যত সুনীল এবং প্রকৃত প্রস্তাবেও।
১৯৯৮ সালে এক কথোপকথায় জেমস জানিয়েছিলেন, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মাঠেঘাটে গেয়ে যেতে চান তিনি আজীবন। যদিও তখন চ্যানেল-ভি আর এম-টিভি ইত্যাদিতে গেয়ে বেড়াবার খোয়াবে বিভোর জেমসের সতীর্থ অনেকেই, ঠিক আজকে যেমন রিমিক্সমার্কা গানের কোকস্টুডিয়োতে গেয়ে বেড়ানো অনেকটা স্ট্যাটাস্ সিম্বল্, কিন্তু জেমস তখন জানাচ্ছেন বাংলাদেশের খড়বিচালিভরা মাঠে আর ক্ষেত-কেটে-নেয়া প্রান্তরের দিকেই স্থিরলক্ষ্য নিজের বাসনাগাথা। যেখানেই বিদ্যুৎ আছে, যে-গ্রামেই কিছু বন্দোবস্ত রয়েছে সাউন্ডসিস্টেম্ সচল রাখার, সেখানেই নিজের গানটা সামনাসামনি শ্রীযুক্তা মানুষের মাঝখানে দাঁড়ায়ে গাইবার অভিলাষ জেমসকে ব্যক্ত করতে দেখব। তখনও, ওই ৯৯/৯৮ পর্যন্ত, কোনো ওভার্সিজ্ ট্যুর করেন নাই জেমস সোলো/সদলবল। ওই সময়টায় ইউকে/ইউএসএ ভিজিট করছেন অনেকেই মিউজিশিয়্যান্ হিশেবে সেখানকার বাংলা কালচারাল্ ইভেন্টগুলোতে। জেমস তখনও বঙ্গোপসমুদ্রবর্তী ডেল্টার ঢাবি-চবি-জাবি-চুয়েট-বুয়েট-শাবি গ্রিনফিল্ড আর মঞ্চসমর্পিত। চোখ বুঁজে, ঝাঁকড়া চুলে ঝেঁপে মুখমণ্ডল, একঠাঁয় দাঁড়ায়ে গেয়ে চলেছেন অচঞ্চল ব্যোমভোলানাথ। মঞ্চে জেমস প্রত্যেকবার নবায়ন করে নেন নিজেকে, নিতে পারেন অভাবিত সব বাঁক নিজের মর্জি বিগড়ে না-গেলে, চেনা গানগুলোও মঞ্চে একেকবার একেক মনভোলানো অলঙ্কারে প্রেজেন্ট করতে জেমসের জুড়ি নেই।
কিন্তু শুরুর দিকে, জেমসের সঙ্গে চেনাচেনির সূচনাদিনগুলোতে, এমনটা আমরা ভাবতাম অনেকেই যে এই শিল্পী দ্বিতীয়বার একই গান অভিন্ন লয়-তাল বজায় রেখে পারবেন না গাইতে। কেন-যে এমনটা ভাবতাম, নিশ্চয় তা না-বললেও বোধগম্য। মনে হতো, গলাটা প্রায় কৃত্রিম এবং এর অবিকল রিপ্রোডাকশন্ সম্ভব নয়। এহেন কসমিক্ নয়েজ্ পুনরুৎপাদন কোনো জৈব প্রাণের পক্ষে নেক্সট টু ইম্পোসিব্যল্। কিন্তু না, আমরা ভ্রান্ত ভেবেছিলাম, অচিরে দেখা গেল শুধু পুনরুৎপাদন নয়, জেমস অধিকতর জাদুবিস্তার করে চলেছেন গানগুলো মঞ্চে এবং অন্য নানা মাধ্যমে লাইভ গাইতে যেয়ে। একেকটা গান অচিরে জেমসের প্রতিভাস্পর্শে রেগ্যুলার নব নব জন্মের ব্যঞ্জনা নিয়া হাজির হচ্ছিল আমাদের সামনে। এখনও হয়, আজও হয়, ইউটিউব ইত্যাদির সুবাদে জেমসের ‘কথা নয় মুখে মুখে / কথা হবে মনে মনে’ গানের একাধিক ভার্শন্ শুনে কিংবা ‘বাংলার লাঠিয়াল’ ও অন্যান্য অনেক গানের সঙ্গে খমক ইত্যাদি অ্যাক্যুস্টিক্ বাজায়ে জেমসের মঞ্চপরিবেশনার ভিশ্যুয়্যাল্ দেখে এই বিশ্বাস আপনার আরও পোক্ত হবে।
হোপ রোড … স্টেশন রোড …
শুরু হয়েছে ‘স্টেশন রোড’ দিয়ে। জেমসের মতো বব মার্লে অবশ্য ‘হোপ রোড’ নামে অ্যালবাম করেন নাই, কিন্তু হোপ রোডেই ছিল ববের নিবাস, আশার সরণী দিয়া মার্লের গতায়াত তার আপন জনগোষ্ঠীর জন্য মন্ত্রতুল্য বরাভয় হিশেবে আবির্ভূত হয়েছে দেখতে পাই। মার্লে যে-বছর মরে গেলেন অল্প বয়সে, ১৯৮১ সালে, সেই বছরেই ফিলিংস ব্যান্ডে জেমসের বাজানো শুরু; যদিও অ্যালবাম রিলিজের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৮৬ পর্যন্ত। ১৯৪৫ সালে জন্মানো বব ৩৬ বছরের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সফর সেরে চলে গেলেন চিরতরে। এ যেন মহাপ্রস্থানের চেয়েও অধিক কিছু, ববের এই আকস্মিক মৃত্যু, ধুমকেতুর পুরনো তুলনা টানার দরকার বাহুল্য। অন্তত স্বদেশবাসীর কাছে ববমৃত্যু অতিশয় ধাক্কার ন্যায়।
জেমসের শুরুটা মার্ক নফ্লার হুবহু মঞ্চে বাজিয়ে। বেঙ্গলের ‘ডায়ার স্ট্রেটস্’ হিশেবে ব্যান্ড ফিলিংস পরিচিত হতে শুরু করে জেমসের হাত ধরে এই সময়টায়। নিজেও অস্বীকার করেননি জেমস যে সেই-সময়টায় তিনি নোট-টু-নোট হুবহু যন্ত্রায়োজনে প্লে করে চলেছিলেন ইংরেজি চিরজনপ্রিয় রক্-ব্লুজ্ নাম্বারগুলো। ওই বিশেষ সময়ের চিহ্ন ধরা আছে জেমসের গোড়ার অ্যালবামদ্বয়ে। ‘স্টেশন রোড’ ও ‘অনন্যা’ অ্যালবাম দুইটাতেই ক্লিয়ার ‘ডায়ার স্ট্রেটস্’ ছাপটা আছে। জেমসের সোলো ‘অনন্যা’ এবং তার সুরে ও সংগীতায়োজনে বেরোনো একমাত্র মিক্সডঅ্যালবাম ‘সোনালী বিকেল’-এ একদম কপি টিউন বা নকল সুরও রয়েছে। ‘জেল থেকে বলছি’ অ্যালবামে জেমসকে আমরা আপন মহিমায় পেতে শুরু করব। পূর্ণ মূর্তি ‘পালাবে কোথায়’ এবং এরপর ফিলিংস থেকে বেরোনো ‘নগরবাউল’ অ্যালবামে কেউ সন্দেহ করে নাই জেমসের স্থায়িতা নিয়া। আইকন্ হয়ে উঠতে থাকেন জেমস। কোনটা সোলো আর কোনটা ব্যান্ডের অ্যালবাম, জেমস শুনতে যেয়ে কেউ প্রশ্ন করে না তারপর থেকে। জেমসের সিগ্নেচার চিনতে কেউ ভুল করে না হাজার মাইলের দূরত্বেও।
শুরুর দিকটায় গিটারে জেমসের আঙুল জলতরঙ্গের মতো সুরেলা লক্ষ করব। প্রত্যেকটা নোট স্পষ্ট পড়া যেত সূচনাকালীন জেমসের গিটারবাদনের। পরে এই জেমসই ডিসটিউনড স্টাইলের এমন অভাবিত টিউন্ ইন্ট্রোডিউস্ করেন যা তাকে স্কেলে ও কর্ডে একদম খোলনলচে-খুলে-ফেলা আলাদা জাতের গাইয়ে-বাজিয়ে হিশেবে প্রেজেন্ট করে মিউজিকামোদীদের কাছে। রেবেল্, ওয়াইল্ড, হার্শ বাট হাইলি ইল্যুসিভ; কর্কশ অথচ অদ্ভুত মায়াবী মিউজিকের উত্তুঙ্গ-তোলপাড় এক জগৎ উপহার দিলেন জেমস। বাংলা গানের হাজার বছরে এহেন ঝড়ো সৃজনযজ্ঞলীলা আগে হেরি নাই আমরা।
অ্যানার্কির কথাটা আবারও উঠাইবেন তো? নৈরাজ্য? বলুন দিকিনি, উস্তাদজির তালিয়াবাজ মহামহিম সমুজদারেরা, রাজ্যটা থাকবার সংগত কোনো কন্সিক্যুয়েন্স সত্যিই কি বিরাজে? সেই মিঞাঁ তানসেনের আমল থেকে দেড়-আংলা আগাইবার মুরদ হইল না আপনার, আবারও কহেন নৈরাজ-স্বরাজ, জপেন কি না রাখাল-গোপাল দ্বন্দ্ব সমাসের মুখস্থ কথিকা? লাজলজ্জা নাই আপনাদের? যত্তসব ফাউন্ডেশনের উমেদার কোথাকার!
হোপ রোডে হোক অথবা স্টেশন রোডে, আজিজ বোর্ডিং কিংবা রাজধানীর কোনো বেড়িবাঁধস্থ বস্তিতে, একটা-না-একটা আচম্বিত চিৎকারে ফেটে বেরোতে চেয়েছে যে-বস্তুপিণ্ড, উহাই মিউজিক্ অফ জেনারেশন্। যুগে যুগে সপ্রাণ গান বলতে ওইগুলোই। মিউজিক্ অফ এম্পিরর্স অ্যান্ড ক্লাউন্স, মিউজিক্ অফ রাজাস্, মিউজিক্ অফ মেকি অ্যান্ড মিথ্যুক মোসাহেবস্, বন্দিশ অফ বাদশাস্ তল্লাশিত হলে অবশ্য অন্য কথা। আমরা যারা গান চেয়েছি যুগে যুগে, চেয়েছি বেগতিক সময়ের মুখে যোগাতে ভাষা, জেমস এবং বব মার্লে তাদেরেই শুধু ত্বরাইবার জোখা মাতাল তরণী। কিংবা রামপ্রসাদ, লালন, রবি-দুখু-কোহেন-ডিলান। ক্ল্যাপ্স দিতে হ্যান্ডস্ নিশপিশ করে যাদের, মৌখিক তারিফের নানাবিধ বোল মুখস্থ করে যারা বড় হয়েছেন, গোল্ডের স্পুন্ মুখে নিয়া যারা মার্গসুখে বেড়ে উঠেছেন দীর্ঘ হয়েছেন, তাদের গুলজারের জন্যে এখন পৌষ-ফাগুনের এই বাংলায় বিবিধ বনেদিয়ানামত্ত মুশায়েরা আর নবঢঙা প্রাচীনগন্ধা আসর-মজলিশ আলোকসজ্জিত অপেক্ষায়।
ম্যান্ ব্যুকার, মার্লন্ জেমস, বব মার্লে
২০১৫ সালের ম্যান্ ব্যুকার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন যিনি, জ্যামাইকার ঔপন্যাসিক, তিনি মার্লন্ জেমস। উপন্যাসের কাহিনিকেন্দ্রে একজন সিঙ্গারকে দেখতে পাবো আমরা, যার নামোল্লেখ না-থাকলেও বুঝতে বাকি থাকে না যে এই সিঙ্গার ক্যারেক্টার তো বব মার্লে ছাড়া আর-কেউ নন। উপন্যাসটা মার্লন্ জেমসের তৃতীয় উপন্যাস, তথ্যবিবরণী থেকে এইটা আমরা জানতে পারছি; যদিও গল্পসারসংক্ষেপ নানাভাবে জেনে গেলেও উপন্যাসটা আদৌ অত্র নিবন্ধকারের পড়া হয় নাই কিংবা কোনোদিন-কখনো পড়া হবে কি না বলা যাচ্ছে না। ‘অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অফ সেভেন্ কিলিংস্’ উপন্যাসের নাম, যে-উপন্যাসের জন্য সম্মাননা লাভ করেছেন ঔপন্যাসিক। ১৯৭৬ সালটা জ্যামাইকার জাতীয় ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ বছর। ওই বছর তাদের দেশে ন্যাশন্যাল্ ইলেকশন্ হয়েছিল, ভোটাভুটি নিশ্চয় ইতিহাসের রেকর্ডবুকে রয়েছে; জ্যামাইকায় বছরটা তাৎপর্যবহ সেইজন্যে যতটা-না তারচে বেশি পিস্ কন্সার্টের জন্যে। সেই পিস্ কন্স্যার্টের মুখ্য ব্যক্তিটি ছিলেন বব মার্লে। সেই ডিসেম্বরে কন্সার্ট আয়োজনের ঠিক মুখভাগে মার্লেকে হত্যা করার একটা ষড়যন্ত্রচেষ্টা আমরা সকলেই জানি, সে-যাত্রা মার্লে বেঁচে যান যদিও এবং ঐতিহাসিক সেই মিউজিক্ কন্সার্টের ভিডিয়ো আজ আমরা দেখি ইউটিউবে, মার্লন্ জেমসের উপন্যাস সেই অ্যাসাসিনচেষ্টা থেকেই কাহিনির কঙ্কাল ও রসদ সংগ্রহ করেছে। এই ঘটনার পরের তিন দশকেরও অধিক কাল জুড়ে জ্যামাইকাব্যাপী ড্রাগডিলার, আর্মসডিলার, মার্সেইন্যারি, মাফিয়া, পার্লামেন্টারিয়্যান্, প্যুলিসম্যান্, গানম্যান্, বিউটিক্যুয়িন্, জার্নালিস্ট, সিআইএ অ্যাজেন্ট ইত্যাদি মিলেমিশে একাকার হয়ে ‘অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অফ সেভেন্ কিলিংস্’ কাহিনি স্পিড-আপ করেছে। এইটা ক্রাইম থ্রিলারের ধাঁচে লেখা হলেও রোডসাইড রগরগে থ্রিলার নয়। ফিকশনের এলাকায় শর্টলিস্টেড অন্য ছয়টি ম্যানাস্ক্রিপ্ট থেকে এইটা আলাদা করে শ্রেষ্ঠ ঘোষণার প্রাক্কালে জ্যুরিবোর্ডের বিবেচনাবাক্য শুনতে যেয়ে দেখি যে সেখানে বলা হচ্ছে, “এটি একটি অপরাধ-উপন্যাস যা অপরাধবিশ্বের বাইরে আমাদেরে সাম্প্রতিক ইতিহাসের ভিতরদেশে নিয়া যায় এবং বলা বাহুল্য যে-ইতিহাস সম্পর্কে আমরা জ্যামাইকার বাইরে-থাকা পাঠকবিশ্ব অতি অল্পই জানি; এর কাহিনি এগিয়েছে এক ভয়াবহ গতিতে এবং এইটাকে অচিরে আমরা আমাদের কালের একটা ক্ল্যাসিক্ হিশেবে গণ্য হতে দেখব।” উপন্যাসটা আমরা এখনও পড়ি নাই, ইনফর্মেশনটুকু পুরস্কারপ্রাপ্তির আগে-পরে জেমসের নানান ইন্টার্ভিয়্যু মারফতে পেয়ে যাচ্ছি। নিবন্ধে এই উপন্যাস পুরস্কারপ্রাপ্তির সংবাদটাকে আমরা আমলে নিয়েছি মিউজিশিয়্যান্ জেমস এবং বব মার্লে নামের দুই যুগন্ধর শিল্পীকে একটা কমন্ অ্যালাইনমেন্টে রেখে দেখবার মানসে।
এইবার আমরা মার্লন্ জেমসের কয়েকটি ইন্টার্ভিয়্যু থেকে এক/দুইটা উদ্ধৃতি নিতে চাইব, উদ্ধৃতি চয়নের আবশ্যকতা আপাতত না-জানিয়েই, বাংলাদেশের খবরকাগজে এই ইন্টার্ভিয়্যুগুলোর নির্বাচিত অংশ অনূদিত হয়েছে আন্দালিব রাশদীর হাতবাহিত হয়ে। কেমন ছিল গত সেঞ্চুরির এইটিজের জ্যামাইকা? মার্লন্ জানাচ্ছেন, “১৯৭৬-এ জ্যামাইকা ছিল একটি পুলিশরাষ্ট্র। কারফিউ জারি করে জ্যামাইকা শাসন করা হয়েছে। মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে। গ্রেফতার করলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করতে হবে, কিন্তু আটকে রাখলে চিরদিন এভাবে আটকে রাখা যাবে। এক বছরেরও বেশি সময় কেউ কেউ আটক ছিল। রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য শিশুদের এনে আটকে রাখা হয়েছে। এটা জ্যামাইকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। একে সমর্থন করেছে দেশের অপরাধ দমন আইন। পুলিশ শূন্যের মধ্যে দুর্নীতি করতে পারে না — তার দুর্নীতিকে সমর্থন দিতে একটি পদ্ধতির প্রয়োজন হয়।” এখন, না, প্রশ্ন করব না যে এই পদ্ধতিটা আমাদের চেনা-চেনা লাগছে কি না। না, ধানের দেশ গানের দেশ মাছেভাতে দেখনধন্য সম্প্রীতির দেশ সুবাতাসভরা বাংলাদেশের সঙ্গে জ্যামাইকার তুলনা আমরা করছি না। তারপরও গত শতকের এইটিজের জ্যামাইকার সঙ্গে সেই সময়ের বাংলাদেশ এবং এই ২০১৫-চলিষ্ণু বাংলাদেশের চেহারা মিলিয়ে দেখতে কেউ কেউ চাইতেই পারেন। নগরবাউল জেমসের শিল্পী হিশেবে জন্ম ও উত্থান ওই দশকেরই মধ্যভাগে। এরপরবর্তী গোটা নাইন্টিজ্ জুড়ে জেমসের চূড়াস্পর্শ। অথচ, সম্ভাবনা হাজির থাকা সত্ত্বেও, বব মার্লের পথ মাড়াতে দেখা গেল না জেমসকে, এই আক্ষেপটা আমরা আজীবন করে যাব কেউ কেউ। সুবাতাস বইছে, বাংলাদেশে, গণতন্ত্রের। বহুদিক থেকে চ্যাম্পিয়্যন্ আমরা, খালি চ্যাম্পিয়্যনশিপের ট্রফি দিকে দিকে, বাংলা গান বাংলা সিনেমা বাংলা উপন্যাস বাংলা কবিতা বাতাসের বাওগতিক বুঝেসমঝে পথ চলছে এক-আধখানা ব্যতিক্রম বাদে। কে একটাবার বাতাসকে বেঁকিয়ে দেবে? কে বইবে বাতাসেরও উল্টো স্রোতপ্রবাহে? কে যুঝবে প্রচলায়তের বিরুদ্ধে?
জেমসের গান গেল বিলাসের পথে, বেদনা প্রশমনের রাস্তা মাড়ালেন না তিনি, ‘বেদনার আমরা সন্তান’ বলেছিলেন জীবনানন্দ, ভীষণ অরাজকতা আর রাজনৈতিকভাবে উচ্চাসীন বণিকদের লুটতরাজের মাঝখানে বেদনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জেমস গেলেন বিলাসব্যসনের দিকে। বেদনার যারা সন্তান, তারা খাবি খাচ্ছে এতাবধি ত্রিকালপ্রাচীন একই সেই বেদনায়। জেমসের শুরুর দিককার হাবভাবে জেমসকে বেদনাস্বভাবী বেদ প্রণয়নে ব্যস্ত মনে হলেও অচিরে জেমসগান কেবলই নৃত্যকীর্তিকলাপ হবে এবং এর বাইরেকার যাবতীয় অ্যাভেন্যুগুলো রুদ্ধ হয়ে যাবে ক্রমে। এ নিয়া আহাজারি বৃথা। যে-জন বঙ্গে জন্ম সে এই ইতিহাস জানে এবং এর পেছনের খেলাটাও সম্যক বোঝে।
এখন কেমন আছে জ্যামাইকা? বাংলাদেশ এখন কেমন আছে? কেমন আছো ওগো মোর ধরিত্রীশ্রেষ্ঠা? বাংলাদেশের খবর আমরা জানি না। জ্যামাইকা আজও তথৈবচ। ১৯৭৬ সালে সেই পিস্ কন্সার্টের পর আহত বব মার্লে দেশ ছাড়েন এবং ২০১৫ সালে জেমস মার্লন্ সেই একই ভীতিকর বাকপরাধীন পরিস্থিতির মুকাবিলায় দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। “বব মার্লের ঘটনাটি আমার বইয়ে সংঘটিত ঘটনাসমূহের শেষদিকের একটি। এটিই সব কাহিনির বন্ধন হিশেবে কাজ করে। ১৯৭৬-এ জ্যামাইকা একটি চাতুরিময় ও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল। কেননা, নির্বাচনের বছর হওয়ার জন্য নয়, আশঙ্কা বিরাজ করছিল এটি কমিউনিস্ট দেশে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। এ-কারণে দেশটি শীতল যুদ্ধের দিকে গড়ায়। একই সময় সৃজনশীলতারও বিস্ফোরণ ঘটে — আমি মনে করি এমনটা আর আগে কখনো হয়নি। সংগীতে তো অবশ্যই চিত্রশিল্প ও চলচ্চিত্রে সেসবের ব্যাপক বিকাশ ঘটে।” এবং আমাদের ইয়াদ হবে যে এই বাংলাদেশের যুদ্ধোত্তর সাংস্কৃতিক বিকাশ ও নবগঠনের সুফলা সময়টি ঠিক সেই আশি-নব্বই জোড়বন্ধা কালপর্ব, যখন কবিতায় এবং শর্ট ফিল্ম ম্যুভ ইত্যাদি নানা আঙ্গিকে আমরা ছিলাম দেদীপ্যমান; বাংলা ব্যান্ডসংগীত ওই সময়ে যে-জায়গাটা অ্যাকোয়্যার করেছিল, পরে তেমনটা আর দেখা যায় নাই। ফিডব্যাক, ওয়ারফেজ, ফিলিংস, নোভা ব্যান্ডসমূহের পাশাপাশি সোলস, মাইলস, এলআরবি প্রভৃতি প্রচুর ব্যান্ডের ক্রিয়েটিভ অ্যাক্টিভিটি নিশ্চয় ইয়াদ করব আমরা। আগে এমনটা আর হয় নাই, পরেও না, নিশ্চয় ফিউচার মার্লে এবং জেমসদের দিকেই তাকিয়ে থাকব আমরা। আর এরশাদশাহি খতম হবার পরে হ্যাপিনেসে এতটাই বিভোর হয়ে রইলাম আমরা যে ব্যান্ডসংগীত ভেস্তে গেল, শর্ট ফিল্ম ফোরাম/ম্যুভমেন্ট ব্যাহত হলো, বিকল্প ম্যুভি নির্মাণের স্বপ্ন ভোগে উঠল, কোথাও কোনো ক্রন্দন শোনার ফাঁকফোকর-পরিসর রইল না, কোন ফাঁকে এবং কেন ঘটল এমন, নিশ্চয় এইটা আমরা ভাবতে বসব একদিন।
তখন বব মার্লে জ্যামাইকার বাইরে এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ নক্ষত্র। দুনিয়াজোড়া মার্লেনাম ধ্বনিত হচ্ছে। র্যাগে দিয়া আসমুদ্রহিমাচল দুলিয়ে দিয়ে চলেছেন বব। সঙ্গে তার র্যাস্তাফ্যারিয়া ফিলোসোফি নিয়াও লোকে আগ্রহী হচ্ছে। এরপরও বব ভুলছেন না জ্যামাইকার বস্তি, কিংস্টন্, ট্রেঞ্চটাউন্, ভুলছেন না জ্যামাইকা নাম্নী কালো হরিণীর বনপোড়া আর্তনাদ। একবারের জন্যও ববকে আমরা গা ভাসাতে দেখি না গড্ডালিকায়। সেই সময়টায় তিনি নিশ্চয়তা পেয়ে গিয়েছেন অ্যামেরিক্যান্ স্টুডিয়োকোম্প্যানির, বাঁধা অ্যালবাম রিলিজের চুক্তি, মোটা টাকার কন্সার্ট নিশ্চয়তা, বাঁধা প্রোডিউস্যর। এতকিছুর পরেও ববকে একলষেঁড়ের ন্যায় জ্যামাইকায় যেতে দেখব ফিরে ফিরে, যেতে দেখব লিরিকের প্রয়োজনে, একা এবং ব্যান্ড ‘দ্য ওয়েইলার্স’ নিয়ে, যেতে দেখব সুর ও সম্প্রীতি সংস্থাপিতে, যেতে দেখব শান্তির সন্ধানে। জ্যামাইকা মার্লের লিরিক্সে একটাবারের জন্যও টলতে দেখি না আমরা। জ্যামাইকায় কন্সার্টে দুই বিরোধী বিবদমান নেতার হাত মিলিয়ে দিতে দেখব রক্-ন্-রলের চেয়েও অপূর্বভাবিত উন্মাতাল র্যাগে-আবিষ্ট ববের স্বতঃসুরস্ফূর্ত ঘটকালি দিয়া। মার্লন্ জেমসকে জিগানো হয়েছিল ববের সংগীত তাকে তার বেড়ে-ওঠার দিনগুলোতে কেমন করে প্রভাবিত করেছিল, অথবা আদৌ প্রভাবিত হয়েছিলেন কি না, মার্লন্ বলেন যে তিনি ঠিক কোনো অর্থেই ইনফ্লুয়েন্সড হন নাই মার্লের মিউজিক্ দ্বারা। মার্লন্ জবাব দেন, “আমি বুঝতাম না, কারণ তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। রূপকালঙ্কার কিংবা দ্বৈত অর্থ তখন আমার বোঝার কথা নয়। মার্লে খুব ধূর্ত একজন গীতিকার ছিলেন, এ-সম্পর্কে অবশ্য কেউ তেমন কিছু বলে না। অন্যদের মেধা কিংবা সহজাত বুদ্ধির ঘাটতি আছে এমন নয় — কিন্তু কারো মধ্যে ববের সেই রসবোধ নেই। সে-কারণেই কোনো দ্বিতীয় বব মার্লে নেই। যখন তার ‘অ্যাম্বুশ্ ইন্ দ্য নাইট’ শোনা যায়, প্রথম দুই অনুচ্ছেদেই তার চারপাশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে, তার উত্থান প্রায় অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়।” এ হচ্ছে একজন ঔপন্যাসিকের জবানিতে তার জাতির এক অবিসংবাদিত প্রাণমানুষের প্রতি ট্রিবিউট। গোটা উপন্যাসে কোথাও বব মার্লের নাম উচ্চারিত হয় নাই, সিঙ্গার হিশেবে ক্যারেক্টারাইজড হতে দেখা যায় বলেই ইনফো অনুযায়ী আমরা জানছি, মার্লন্ এতদপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “লেখার সময় অনেক জায়গায় তার নাম দিয়েছিলাম। কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক তাতে লাভ হতো না, কারণ ঘটনার অনেক আগে ১৯৭৬ থেকেই মার্লে মূলত একটি প্রতীকী নাম হয়ে ওঠে। তিনি তখন অনেক কিছুর প্রতীক — দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের প্রতীক, নির্বাক মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক, অনেকের কাছে জাতীয় বিব্রতকর অবস্থার প্রতীক। কারণ তখন এই র্যাস্তাফ্যারিয়্যানকে দেখা হতো কালোদের লড়াইয়ের কণ্ঠস্বর হিশেবে; তিনি শিক্ষিত ছিলেন না, কখনো কালোদের শিল্প আন্দোলনে অংশ নেননি এবং তিনি কোনো বুদ্ধিজীবীও ছিলেন না। আমি মনে করি তিনি এখনো তা-ই আছেন … তাছাড়া বব মার্লেকে যেখানেই রাখবেন তার ঔজ্জ্বল্যের কাছে তা ম্লান হয়ে যাবে। কোনো চেষ্টা ছাড়াই তিনি দখল করে নেন।” ঘটনাটা আমরা খানিক আগায়ে এসে এইভাবে বলতে পারি যে, জ্যামাইকার সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদয় সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য সত্ত্বেও অনেকে জেমসের আবির্ভাবে একজন বব মার্লের পরিণতবুদ্ধিবিবেকের কমিটেড মিউজিশিয়্যানের ছায়া দেখতে উদগ্রীব হয়েছিলেন তার কারণ শুধু এ-ই নয় যে জেমসের ব্যক্তিক পরিস্থিতির সঙ্গে মার্লের মিল-মেলবন্ধ; বরঞ্চ অনেক বেশি এই কারণেই যে জেমসের গলা ও গায়ন এবং সর্বোপরি লিরিক্স ও কন্সার্টে রেন্ডিশন্ আমাদেরে সেইদিকে ভাবতে উদ্বোধিত করেছিল। এর কাছাকাছি অভিজ্ঞতা জেমসেরও আগে থেকে মাকসুদের গান শুনতে যেয়েও মনে হতো আমাদের। দুইজনের কেউই ঠিক ওইদিকটা এক্সপ্লোর করেন নাই বলেই মনে হয়। জেমসের বেলায় এই বিপথগামিতা ‘বড় বেদনার মতো’ হয়েই বেজে বেজে যায় আজও। অমন প্রভাবসঞ্চারী মিউজিক্যাল্ জিনিয়াস্ এবং অমন গলা ও গায়কী দিনদুপুরে বা রাতারাতি নাজিল তো হয় না। কাজেই ক্ষতিটা চটজলদি পূরণ হবারও নয়।
জেমস যা দিয়েছেন আমাদেরে, জেমস যেটুকু ও যতটা যা হয়েছেন, তাইতেই আমরা যারপরনাই প্রীত ও উপকৃত অবশ্যই। নিছক নান্দনিকতার বাইরে যেয়ে একটু অসাংগীতিক স্বপ্ন ও হতাশ্বাসের গল্প করা হলো এতক্ষণ। তবে এতদপ্রসঙ্গে এটুকু উল্লেখ থুয়ে রেখে এগোব যে এই নিবন্ধের দ্বিতীয়ার্ধে যেয়ে জেমসের গানের বাণীভাগ সামনে নিয়ে একটুখানি ডিপ-ইনসাইড দেখতে চেষ্টা চালাব যখন, বব মার্লে ফের একবার আলাপে এসে যাবেন। এবং সেই-সময় আমরা বাংলা একটা অল্পপ্রচারিত-অথচ-অসাধারণ বইয়ের সান্নিধ্য ও সাহচর্য পাবার জন্য প্রচেষ্টা চালাব, বইটার নাম ‘রাস্তাফারাই, রেগে ও বব মার্লি’, লিখেছেন কাজী মুনতাসির বিল্লাহ, বইটা ছাপা হয়ে বেরিয়েছে ২০১২ সালে, এইটা ছাপায়েছে ‘সংহতি’ নামে একটা অফবিট প্রকাশন সংস্থা, ঢাকা থেকে, অন্ বিহাফ অফ সমগীত; বলা বাহুল্য, ‘সমগীত’ একটা গানের দল, অমল আকাশ প্রমুখ শিল্পীরা বাজারের ভানসর্বস্বতার বাইরে দেড়/দুইযুগেরও অধিক সময়ব্যাপী মিউজিক্ করে চলেছেন মুখ্যত গাছতলার খোলা হাওয়ায় মাটির মঞ্চে, স্টেজলাইটিং ও অন্যান্য মঞ্চধামাকা থেকে নিজেদেরে বাঁচিয়ে রেখে। একের-পরে-এক অ্যালবাম প্রসবের মধ্য দিয়াই যারা নিজেদেরে অ্যালাইভ রাখার পন্থাটাকে একমাত্র পন্থা মনে করেন না, বছর-বছর বই বিয়োনোর বাইরেও যারা নিজেদের ক্রিয়েটিভ ফ্যাকাল্টি বাঁচায়ে রাখা যায় মর্মে আস্থা রাখেন, তাদিগের কাছে এ-বাবতের কথাবার্তা খানিকটা প্রাসঙ্গিকও মনে হতে পারে। এইসব নিয়াও ছুঁতোনাতায় এক-দুইটা বাক্য কখনোসখনো বলবার মওকা আমরা পাবো নিশ্চয়।
পোস্টস্ক্রিপ্ট ।। ইতিহাসের উল্লেখবাহুল্য একটি দিনে তিনি অবতরণ করেন দুনিয়াধামে। বেথেলহেমে নয়, এই বাংলায়, ঋতুবৈচিত্র্যপ্রবাহিতা বাংলাদেশের এক পাড়াগাঁয়। ফারুক মাহফুজ আনাম, ওর্ফে জেমস, নওগাঁয় স্পেসশিপ থেকে নেমে এসেছিলেন ১৯৬৪ সালের ২ অক্টোবর। এরপর থেকে গোটা বাংলা, মতান্তরে মুম্বই টু রক্-অ্যারাউন্ড-দ্য-ক্লক্ মেম্ফিস্ সহ গোটা বসুন্ধরা, ফারুক মাহফুজ আনাম ওর্ফে জেমসের কাছে একটা আস্ত নওগাঁ বৈ ভিন্নকিছু নয়। এতটা আপন, এতটা ওপেন, মঞ্চে গিটারকুঁজো জেমসের পদপ্রান্তে এসে যেন গোটা দুনিয়াটা মাথানত জিকিরের ভঙ্গিদিওয়ানা বসে থাকে। এবং প্রকাশ থাকুক এখানে যে এই নিবন্ধ টুকরাটাকরা আকারে শেইপ নেবার সময়ে বেশকিছু অংশ প্রত্যক্ষ ইন্টার্যাক্ট করেছে যাদের সঙ্গে, প্রত্যেকে যশস্বী তারা যার যার ভুবনে; — এদের মধ্যে নামের বর্ণানুক্রমে অর্পণ দেব, ইমরান ফিরদাউস, গ্যাব্রিয়েল সুমন, বিজয় আহমেদ প্রমুখ উল্লেখ্য। ধন্যবাদ জানানোটা বাংলায় বেখাপ্পা শোনায়, কৃতজ্ঞতা আভাসে-ইশারায় জানিয়ে রাখা যায়। এই নিবন্ধের সঙ্গে সাঁটানো জেমসের ক্যাসেটখাপগুলোর স্থিরচিত্র সংগ্রহ করা হয়েছে নিবন্ধকারের আবাল্যযৌবনের দোসর, ২০০৬ সালের অক্টোবরে অকালপ্রয়াত, রূপক দেবের ব্যক্তিগত সম্পত্তির দেবোত্তর দেরাজ থেকে; জেমসের প্রতিকৃতি ও নানাবিধ সক্রিয়তায় শিল্পীর বিভিন্ন পর্বের ছবিগুলো নিবন্ধকারের নিজস্ব সংরক্ষণকুঠুরির বিনোদনপাক্ষিকগুলো থেকে ক্যামেরায় ক্যাপ্চার করেছেন কবি ও স্থিরচিত্রকর আহমদ সায়েম; — অশেষ ঋণ অনস্বীকার্য দুইজনেরই কাছে, একজন যদিও অজ্ঞাতবাসে। জেমসের গান বিষয়ক স্মৃতিচারী নিবন্ধের প্রথমার্ধ প্রকাশের প্রাক্কালে এটুকু পোস্টস্ক্রিপ্টাম্ জরুরি। দ্বিতীয়ার্ধে যেয়ে এই নিবন্ধ অভিপ্রেত রূপ ও ঢপ পাবে, এবং হবে সেইটা সাধ্যানুযায়ী শিগগিরই, এটুকু হোপ্ অ্যান্ড প্রে। প্রেম ও প্রণাম সম্ভাব্য সব্বাইকে।