অন্ জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্ । মাকসুদুল হক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মার্চ ২০১৬, ১২:১৯ পূর্বাহ্ণ, | ৩২৪৯ বার পঠিত
রচনাটা পাঠের অব্যবহিত পূর্বে এই ইন্ট্রো অংশে একটু নজর বুলিয়ে গেলে এর প্রণেতা মাকসুদুল হক ওর্ফে ম্যাকের প্রতি কিছুটা জাস্টিস্ হয়। কেননা ম্যাকের এই সংক্ষিপ্ত কলেবরের দ্রুতলেখ রচনাটা আমরা পাচ্ছি একটা গানসংকলনভুক্ত প্রচ্ছদপরিচিতিমূলক ভাঁজপত্রের উল্টো পিঠে মুদ্রিত মুখবন্ধ হিশেবে। অ্যালবামের নাম ‘ওগো ভালোবাসা…’, প্রকাশকাল ১৯৯৯, বাংলাদেশে এবং বাংলা গানে প্রথম পূর্ণাঙ্গ জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্ অ্যালবাম হিশেবে এইটা আজও তুলনারহিত ও অবিস্মরণীয়। বইয়ের ক্ষেত্রে যেমন ব্লার্ব, সাধারণ্যে ফ্ল্যাপ্ বলিয়া যার পরিচয়, যেখানে সেই বইটির একটা চটজলদি পরিচিতি পেয়ে যান গ্রন্থাগ্রহী সম্ভাব্য ক্রেতা বা পাঠক, ফিতার ক্যাসেটের যুগে বাংলাদেশে ব্যান্ডসংগীতে একই কায়দায় ব্লার্ব/ফ্ল্যাপকথিকার সাক্ষাৎ পাই আমরা এবং লাভবান হই মিউজিক ও মিউজিশিয়্যান্ সম্পর্কিত খুঁটিনাটি কৌতূহল নিবৃত্তির উৎস নাগালে পেয়ে। জ্যাজ্ সম্পর্কে, রক্ সম্পর্কে, ফিউশন্ সম্পর্কে, কিংবা জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্ সম্পর্কে পাণ্ডিত্যপূর্ণ কোনো রচনা এইটা না, ক্যাসেটের খাপে সেই সুযোগ ছিল না বা দরকারও ছিল না প্রাথমিক পরিচয়কথিকায় পাণ্ডিত্য ফলানোর।
কাজেই যে-লেখাটা আমরা এখানে পেতে চলেছি, এইখানে ম্যাকের সংগীতজ্ঞান সম্পর্কে একটা আইডিয়া পাওয়া যাবে ভেবে কেউ পড়তে যেয়ে ম্যাকের প্রতি এবং অবধারিতভাবে নিজের প্রতিও অবিচার করবেন। এইটা ব্লার্বকথিকা বা ফ্ল্যাপের লেখা। প্রাথমিকী বিবেচনাবাহিত ঝটিতি রচনা এইটা। জ্যাজ্ সম্পর্কে, রক্ সম্পর্কে, ফিউশন্ সম্পর্কে ঢের জ্ঞানগম্যি ইত্যবসরে আমরা হাসিল করেছি হয়তো; তবে, মনে রাখতে হবে, এই লেখাটা প্রথম প্রকাশের কালে, সেই ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে, জ্যাজ্/রক্/ফিউশন্ প্রভৃতি সম্পর্কে তেমন-একটা জানাশোনার সুযোগ সংগীতানুশীলনের সংশ্রবহীন আমাদের জন্য অন্তত অবারিত ছিল না। আজকে যেমন হড়বড়িয়ে জেনে ফেলতে পারি পৃথিবীর পদ্মফুল থেকে শুরু করে স্বর্গপুষ্প পারিজাত অব্দি একক্লিকে, সেকালে সেই ৯৯ সালে উইকি ছিল না বা নানাবিধ বৈষয়িক অফিশিয়্যাল্ ওয়েবসাইট স্বপ্নেও ছিল না, ম্যাকপ্রণীত এই চিলতে লেখাটা আদ্যিকালের সেই নিষ্প্রযুক্তিঋতুতে এসেছিল দোরগোড়ায় আমাদের এবং অধিকতর সুনিবিড় জানাশোনার অ্যাপিটাইট বাড়িয়েছিল বৈকি।
কিন্তু রচনাটা তা-বলে হেলাফেলারও নয় একেবারে; কেননা এইটা লিখেছেন আমাদের সংগীতভাষায় চার-দশকেরও অধিক সময় ব্যাপিয়া নিয়োজিত একজন সংগীতশিল্পী, মাকসুদুল হক ওর্ফে ম্যাক, যিনি আধুনিক বাংলা গানে জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্ নিয়া হাতে-কলমে এবং গলায়-গানায়োজনে ব্যাপকবিস্তারী কাজ করেছেন। পরিমাণে সেসব কাজ খুব সংখ্যাবাহুল্যের প্রমাণ না-রাখলেও গুণমানে একেকটা পাক্কা ছাপ অবশ্যই। প্রায় দ্বিদশক পুরো হতে চলল ‘ওগো ভালোবাসা’ রিলিজের পরে, ‘মাকসুদ ও dHAKA’ ব্যান্ডের ১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘(অ)প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ’ সংকলন প্রকাশের দ্বিদশকপূর্তি তো হয়েই গেল বলতে হবে, এইসব হিসাবকিতাব মাথায় রেখে লেখাটা পাঠ করার ফজিলত বাংলাদেশের গানান্বেষী শ্রোতা/পাঠকেরা পাবেন আশা করা যায়। বিশেষ করে যারা বাংলা ব্যান্ডসংগীত সংক্রান্ত সমুদয় চিত্রাবলি পেতে চান, খোঁজপাত্তা চালান বাংলা রকের অনুপুঙ্খের, তাদের কাছে ম্যাকের এই এবং অন্যান্য বং-ইং লেখাপত্রাদি বিষয়গুণেই সমাদৃত হবে।
এইখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে ম্যাকের একাধিক কাগুজে মুদ্রিত গ্রন্থাবলির মধ্যে একমাত্র বাংলা বইটির দ্বিতীয় ও বর্ধিত কলেবরের সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে দীর্ঘদিনের ছাপা-দুষ্প্রাপ্য দশা কাটিয়ে ২০১৬ সনের ফেব্রুয়ারিতে। বইটা, ‘আমি বাংলাদেশের দালাল বলছি’ শীর্ষক ঠাসবুনিত হরফসজ্জার প্রায় চারশ পৃষ্ঠার বই, ছাপিয়েছে বাংলাদেশের ঢাকাস্থ প্রকাশনাপ্রতিষ্ঠান অগ্রদূত অ্যান্ড কোম্প্যানি। কিন্তু বক্ষ্যমাণ রচনাটা, ম্যাকপ্রণীত আরও অনেক হ্রস্বায়ত-মধ্যদৈর্ঘ্য রচনাপত্তরের মতো, ‘আমি বাংলাদেশের দালাল বলছি’ শীর্ষক পুস্তকের আওতায় পাওয়া যায়নি। রক্ সম্পর্কে, ব্যান্ডমিউজিক সম্পর্কে, ফোক্ সম্পর্কে, ফোক্-রক্ সম্পর্কে একাধিক রচনা স্থান করে নিয়েছে যদিও; গ্রন্থপ্রণেতা মাকসুদুল হক হয়তো সচেতনভাবেই ক্যাসেটফ্ল্যাপের ওরিয়েন্টেশন্যাল্ ওভার্ভিয়্যু টাইপের রচনাকে স্বতন্ত্র রচনামর্যাদা দিতে চান নাই। কিন্তু একজন মিউজিশিয়্যানের জ্যান্ত অভিজ্ঞতার বয়ান হিশেবে এই রচনাটাও সমান অভিনিবেশে পাঠ্য বলিয়া পাঠকের কাছে মনে হতে পারে।
এখানে, এইবার, একটানে ম্যাকের মূল রচনাটা পাঠ করে নেব। রচনাটা ক্যাসেটের ইনলে-কার্ডে ‘Jazz-rock fusion সম্পর্কিত’ উপশিরোনামে আরও কতিপয় উপরচনার সঙ্গে মুদ্রিত, ‘অন্ জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্’ শীর্ষনামটা আমরা এর নতুন পাঠকালে বাড়তি পাঠসংযোগসুবিধা পাবার আশায় রাখছি। মুখ্য রচনাপাঠান্তে ফের কিছু সংযোজনী ভাষ্য জুড়ে দিয়ে চেষ্টা করব ‘ওগো ভালোবাসা’ অ্যালবামের গোটা ব্লার্বকথিকাটা কালেক্ট করতে, যেন মহাকালের অভিলেখাগারে ব্যান্ডসংগীত ম্যুভমেন্টের ছোটখাটো প্রত্যেকটা স্টেপ্ সুরক্ষিত রয় এইটা আমরা কায়মনোবাক্যেই কামনা করি। অলমিতি বিস্তরেণ। অভিনিবিষ্ট হই ম্যাকের কথায়, লেট্’স্ সি, ম্যাক অন্ জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্!
[সংগ্রহ, ভূমিকা, পাদটীকা ও প্রয়োজনীয় যোজনা : জাহেদ আহমদ]
__________________________________________________
অন্ জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্ । মাকসুদুল হক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দু-শ’ বছর আগে ‘পাশ্চাত্যি শাস্ত্রীয়’ বা ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যালের ভিত থেকেই জন্ম হয় আজকের জ্যাজ্ সংগীতের। অ্যাফ্রিক্যান্ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসরা এই নয়া সংগীত উপস্থাপন করেন। মার্কিনী ইতিহাসের বর্ণবৈষম্যের সেই কলঙ্কময় অধ্যায়; — শ্বেতাঙ্গরা তাদের কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের সংগীত ছাড়া আর-কোনো মানসিক উন্নতির প্রয়াসকে প্রশ্রয় দিত না। সেই কৃষ্ণাঙ্গরাই আজ ‘বিশ্বসংগীতের’ পৃথিবীতে রাখছে অকল্পনীয় অবদান। ক্রীতদাসদের দুঃখ বেদনা ভালোবাসা ও কষ্ট সবকিছুরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই সংগীতের মাঝ দিয়ে এবং তা প্রতিফলিত হয় তাদের আধ্যাত্মিক ও রাজনীতিক চেতনার মধ্যে। অ্যাফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বৈচিত্র্যপূর্ণ ছন্দ বা রিদমের ইম্প্রেশন্ বা ছাপ পাশ্চাত্য সংগীতের প্রথমদিককার সংগীতজ্ঞদের কাজে নতুন মাত্রা সংযোজন করে। বাকিটা ইতিহাস।
মানবজাতির সময় ও ধৈর্য যখন টানাপোড়েন ও পরীক্ষার মুখে, ঠিক তখনই জ্যাজসংগীত ছন্দ, লয়, মাত্রা, উপস্থাপনা ও সুরের আবহাওয়াকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে। দ্রুতলয়, সোলো, ইম্প্রোভাইজেশন্, যুগলবন্দি ইত্যাদিতে এগিয়ে নিয়ে আসে এক অভাবনীয় নতুন ধারা। জ্যাজ্ সেই ‘তখন’ বা ‘এখন’ … কখনোই কমার্শিয়্যাল্ বা বাজারীয় সংগীত ছিল না, যদিও-বা জ্যাজকে ভাঙিয়ে অনেক নতুন সংগীত সৃষ্টি হয়, যার অন্যতম রক্, যা শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের অনুসরণে আবিষ্কার করে।
এ-কথাও বলে নেবার প্রয়োজন বোধ করছি যে জ্যাজ্ আমাদের দেশের শাস্ত্রীয় বা আধাশাস্ত্রীয় সংগীতের মতো শুধু সম্ভ্রান্ত সামাজদারদের সংগীত নয়, কোনোকালেই ছিল না। যেহেতু এ-সংগীতের জন্ম কোনো রাজপ্রাসাদের দরবারে হয়নি বা ধনীদের পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি, তা সাধারণ মানুষের সব স্তর ভেদ করে এসেছিল বলেই আজ এর বিশ্বজোড়া ব্যাপ্তি ও চাহিদা। মিল শুধু এতটুকুই যে জ্যাজ্ আমাদের শাস্ত্রীয় বা আধাশাস্ত্রীয় সংগীতের মতো চর্চার খুব অভাব।
জ্যাজ্ তাই সকল বিবেচনায় খুব উঁচুমাপের সংগীত এবং যে-কোনো সংস্কৃতির উঁচুমাপের সংগীতের সঙ্গে খুব সহজে ও সফলভাবেই সংমিশ্রণ বা ফিউশন্ করা সম্ভব। যেমন আমরা করার চেষ্টা করেছি মুর্শিদী, মারফতি এমনকি রবীন্দ্র সংগীত ছাড়াও আমাদের শাস্ত্রীয় কিছু ধারার সঙ্গে। কথাটা খুব হাল্কা শোনালেও সত্য, এই জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্ খুব ভালো জাতের আলু যা যে-কোনো তরকারিতেই মানানসই।
এই শতকের শেষে বিশ্ব যখন বর্ণ, জাত, স্তর বা ধর্মকে মানুষের যোগ্যতা নির্ণয়ের মাপকাঠি বলে আর মনে করছে না, যখন সংগীত কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা মেনে চলছে না, এই পরিবর্তিত পৃথিবী যেখানে কোনো আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক সংস্কৃতি নয় বরঞ্চ বিশ্বসংস্কৃতির বা গ্লোব্যাল্ কালচারের দিকে এগোচ্ছে, জ্যাজকে ঠিক তখনই বিশ্বজুড়ে সেমিক্ল্যাসিক্যাল্ বা আধাশাস্ত্রীয় সংগীত বলে গণ্য করা হচ্ছে।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী যখন ষাট দশকের আমাদেরই পথিকৃৎ বিটল্স্-এর সংগীতকে আধাশাস্ত্রীয় সংগীত বলে মনে করা হচ্ছে, দু-শ’ বছরের পুরনো জ্যাজ্ সংগীতকেও এখনো সেমিক্ল্যাসিক্যাল্ বা আধাশাস্ত্রীয় বলে গণ্য করা হয়, তাতে এই সত্য প্রমাণিত হয় জ্যাজ্ তার নিজস্বতা এতগুলো বছরেও হারিয়ে ফেলেনি। তার মূল কারণ, এই সংগীতধারা সময়কে ধারণ করেছে সঠিকভাবে ও অন্যসব সংস্কৃতির মাঝে নিজের একাত্মতা বা অস্তিত্ব দুই-ই সদর্পে বজায় রেখেছে এবং তা সম্ভব হয়েছে জ্যাজের সংমিশ্রণ বা ফিউশনশাস্ত্রের দর্শনের কারণে।
জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্ কখনোই ঐতিহ্যবাদী বা রক্ষণশীলদের সংগীত ছিল না। জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্ খুব গুরুগম্ভীর শোনালেও বাংলা ভাষাভাষীদের কানে, বিশেষ করে ব্যান্ডসংগীতের শ্রোতাদের কাছে, তেমন নতুন কিছুই নয়। কারণ জ্যাজের আদলে আমি এর আগে অনেক গান সৃষ্টি করেছি ‘ফিডব্যাক’-এ থাকাকালীন; ‘…নিষিদ্ধ’-তেও তার অনেক প্রমাণ মেলে। পার্থক্য এইটুকুই যে ‘ওগো ভালোবাসা’ সেই অর্থে সম্পূর্ণাঙ্গ একটি জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্ অ্যালবাম, সংকলন বা ফিতা। আমার ধারণা, বাংলা সংগীত শ্রবণের ক্ষেত্রে শ্রোতাদের কাছে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা বলেই বিবেচিত হওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে। আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি এখানেই লিপিবদ্ধ করলাম। আশা করি আপনারা যা শ্রবণ করছেন তা ভালো লাগবে। তদুপরি শুভ শ্রবণ, হ্যাপি লিসেনিং!
ম্যাকপ্রণীত রচনা পাঠান্তে একটি টীকাভাষ্য ও অন্যান্য যোজনা
অ্যালবামে ধৃত গানসংখ্যা মোটমাট দশ। প্রত্যেকটা গানের গীতিকথা, গানের ধাঁচ, যন্ত্রানুষঙ্গ ও যন্ত্রী, কথাকার ও সুরকারের নামোল্লেখ ছাড়াও সংকলনের সঙ্গে যুক্ত সুপরিসর ইনলে-কার্ডে আরও পাঁচটা ভাগে বিন্যস্ত খণ্ডগদ্য রয়েছে, যেখানে এই এফোর্টের বিস্তারিত জ্ঞাতব্য তথ্যাদি লিপিবদ্ধ। ক্রমান্বয়ে সেই চিলতে গদ্যগুলো হচ্ছে : ‘dHAKA সম্পর্কিত’, ‘Jazz-rock fusion সম্পর্কিত’, ‘কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ’, এবং সবশেষে ব্যান্ডের লিড মাকসুদুল হকের সংযোগঠিকানা ছাড়াও কন্সার্ট সংক্রান্ত যোগাযোগের জন্য ফোক্যাল্ পয়েন্ট হিশেবে রয়েছে সেকান্দার খোকার ঠিকানা। মাকসুদুল হকের টিপসহি/ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে ফ্ল্যাপের দীর্ঘ ভ্রমণ সমাপ্ত হয়।
এইখানে মূল রচনা হিশেবে প্রোক্ত পঞ্চখণ্ড স্বল্পায়ত গদ্যকথিকার মধ্য থেকে ‘Jazz-rock fusion সম্পর্কিত’ অংশটিকে ‘অন্ জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্’ শিরোনামে একটু আগে আমরা পড়ে এসেছি। কিন্তু অন্যান্য অংশ চতুষ্টয়ের মধ্যে তিনটে এখন সংযোজনী হিশেবে এই মোহাফেজখানায় নিচে রেখে দিচ্ছি; সিরিয়্যালি এরা হচ্ছে : ‘dHAKA সম্পর্কিত’, ‘আমাদের সহশিল্পীরা’, এবং ‘কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ’। উল্লেখ্য, গোটা অ্যালবাম উৎসর্গ করা হয়েছে ক্যান্সারে-অকালপ্রয়াত চিত্রশিল্পী দীপা হক (১৯৫৩-১৯৯৯) ও তাঁর স্মৃতির সম্মানে, যেমন মাকসুদের পূর্ববর্তী প্রোজেক্ট ‘নিষিদ্ধ…’ উৎসর্গিত হয়েছিল এসএম সুলতান ওর্ফে লাল মিয়ার নামে।
লক্ষণীয়, সংযোজিত অনুচ্ছেদগুলোতে যেসব শিল্পী-কলাকুশলীবৃন্দের নাম এসেছে, এরা ব্যান্ডের বর্তমান লাইনআপের সঙ্গে নেই অধিকাংশতই, কিংবা এক/আধজন ছাড়া বাকিদের সবাই ভিন্ন ভিন্ন পাটাতন থেকে ক্যারিয়ার করেছেন যার যার, ভালো করেছেন অনেকেই, কেউ কেউ লোকান্তরিতও হয়েছেন এরই মধ্যে — যেমন, ট্র্যাভিস্ এবং ইমরান চৌধুরী মবিন প্রমুখ। শুধু প্রকাশ থাকুক এটুকুই যে, ব্যান্ডের স্বর্ণযুগে বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে এইধারা আদব চালু হয়েছিল অলমোস্ট সমস্ত ব্যান্ডঅ্যালবামেই, বিস্তারিত তথ্যাদি লিপিধৃত রইত বিশেষত সহশিল্পীদের। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের ব্যাপারটাও সুন্দর ও সহজিয়া কালচারের সচলায়তন গড়ে তুলেছিল ওই মিউজিকোজ্জ্বল সময়টায়। এইবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক ম্যাকপ্রণীত কথকতায় —
‘ওগো ভালোবাসা’ অ্যালবামের ইনলে-কার্ডে ম্যাকপ্রণীত অন্যান্য রচনা
dHAKA সম্পর্কিত : অক্টোবর ১৮, ১৯৯৭ dHAKA-র জন্ম। ফিডব্যাক থেকে আমি অব্যাহতি নেবার পর আমরা ক’জন বন্ধু মিলে এই ব্যান্ডটি গঠন করি।
ফিডব্যাক থেকে আমার সঙ্গে এসেছিল পুরনো বন্ধু খোকা। যোগ্য এই Bassবাদক বাংলাদেশের Bandসংগীত আন্দোলনে শরিক হয়ে বিগত প্রায় ২৬ বছর যাবৎ একনিষ্ঠতার সাথে বাজিয়ে আসছেন ও তার নিজস্ব অবদান রেখেছেন। খোকা dHAKA ব্যান্ডে বাজানো ছাড়াও সদস্য-শিক্ষানবিশদেরকে জ্যাজের তালিম দিয়ে থাকেন।
মন2 dHAKA ব্যান্ডের গোলরক্ষক অর্থাৎ ছন্দের ধারক বা ড্রামার। প্রায় বারো বছর ধরে বাংলাদেশ ছাড়াও বিদেশে অনেক ক্ষ্যাপ বা gig মেরে বেড়িয়েছেন অনেক নামীদামী শিল্পীর সঙ্গে। dHAKA-ই তার জীবনের প্রথম ব্যান্ড। অত্যন্ত বিনয়ী, স্বল্পভাষী এবং রসিক এই শিল্পীর সম্পৃক্ততা মূলত রক্ ঘরানার ড্রামিঙের সঙ্গে হলেও dHAKA ব্যান্ডে তিনি জ্যাজ্ ড্রামার হয়ে ওঠার অপরিসীম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তন্ময় অসাধারণ মেধাবী ও সুস্থির গতিসম্পন্ন এবং হাড়ভাঙা শ্রম দিতে অভ্যস্ত আমাদের এই কৃতী কিবোর্ডবাদক। শৈশবে হার্মোনিয়্যম্ হাতাতে-হাতাতেই আপনাআপনি তার দখল চলে আসে কিবোর্ডে। তিনি যে সুরবিন্যাসেও দক্ষ, এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ‘হে প্রবঞ্চনা’ গানটা।
আমাদের পার্কাশনবাদক শাহেদ। প্রায় এক দশক জড়িত ছিলেন মরহুম ফিরোজ সাঁইয়ের সঙ্গে। বাজনার অভিজ্ঞতাতে তিনি সম্পূর্ণ ইস্টার্ন হলেও dHAKA-য় যোগ দেওয়ার পর আমাদের ব্যান্ডের চাহিদা অনুযায়ী অ্যাফ্রো-ক্যারিবিয়্যান্ জ্যাজ্ পার্কাশনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।
পিকলু আমাদের ব্যান্ডের সবচেয়ে বয়োকনিষ্ঠ সদস্য। বনানীর নর্থ-সাউথ য়্যুনিভার্সিটির সমাপনী বর্ষের ছাত্র। পাশ্চাত্যীয় রক্ ও হেভি-মেটাল্ ঘরানার গিটারিস্ট ও ‘দ্য জলি রজার্স’-এর মতো দুর্ধর্ষ ব্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মাঝখানে তিনি উচ্চতর শিক্ষা নেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। সেখানে মিশিগ্যান্ টেক্নোলোজিক্যাল্ য়্যুনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় মাইক আইরিশের কাছে জ্যাজের উপর তালিম নেন। বর্তমানে তিনি dHAKA ব্যান্ডের জ্যাজ্ ও রক্ উভয় স্বতন্ত্র ধারাতেই কৃতী বাদিয়ের ভূমিকা রাখছেন।
সেলিম, রুবাইয়াত ও নীলিম — এই তিন গিটারিস্ট আমাদের সঙ্গে অনেক শ্রম এবং মূল্যবান সময় দিয়েছেন। সেলিম আমাদের সঙ্গে আর পথ চলার ইচ্ছা পোষণ করলেন না, রুবাইয়াতের সঙ্গে পথ চলতে ব্যর্থ হলাম আমরা এবং নীলিম গিটারবাজনায় উচ্চতর তালিম নেওয়ার জন্য চলে যান লন্ডনের গিটার ইন্সটিট্যুট অফ টেক্নোলোজি (GIT)-তে। এই ত্রয়ীর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।
আমি মাকসুদ পেশায় ইংরেজি ও বাংলা ভাষার গায়ক, কবি, গীতিকার ও ফ্রিল্যান্স প্রাবন্ধিক (নিয়মিত, ‘এই নিষিদ্ধ সময়ে’, সাপ্তাহিক ‘চলতিপত্র’), dHAKA ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা, দলনেতা, প্রধান কণ্ঠশিল্পী ছাড়াও এই প্রথমবারের মতো সংগীতপরিচালক এবং শিল্পনির্দেশক হিশেবে আত্মপ্রকাশ করলাম। ব্যান্ডসংগীতে আমার অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যে ২৬ বছরেরও বেশি। এই অ্যালবাম অর্থাৎ সংকলন বা ফিতার পোস্টার, ক্যালেন্ডার ও প্রচ্ছদের মলাট অর্থাৎ কাভার ও ইনলে-কার্ড ইত্যাদির সম্পূর্ণ ডিজাইন আমারই করা। ডিজাইনের ব্যাপারে ‘সমলয়’-এর হুমায়ূনের সহযোগিতা আমার এই চেষ্টা হয়তো-বা সার্থক (?) করেছে।
আমাদের সহশিল্পীরা : যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত জ্যাজ্-নগরী ক্যান্সাস্ সিটির বাসিন্দা ট্র্যাভিস্ জেঙ্কিন্স। প্রায় ৩৮ বছর থেকে তার নিজের দেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে বহু গুণী ও নামীদামী শিল্পীদের সাথে বাজিয়েছেন এবং রেকর্ড করেছেন। বারিধারার ‘ঢাকা জ্যাজ্ এন্সেম্বল্’ নামের বিদেশী নাগরিকদের ব্যান্ডে তিনি বাজাতেন। সংগীতশিক্ষকতাই বাংলাদেশে তার মূল পেশা। তিনি টেনোর, সোপ্র্যানো স্যাক্সোফোন্, সিল্ভার ফ্ল্যুট ইত্যাদি যন্ত্র বাজাচ্ছেন। এদেশে আসার আগে তিনি পাপুয়া নিয়্যু গিনিতে অবস্থান করছিলেন। খ্যাতির চাইতে সংগীতে জীবনের ছাপ রাখার ব্যাপারে যারা বেশি আগ্রহী ট্র্যাভিস্ তাদের দলের। তাঁর মতো গুণী শিল্পীর সঙ্গে অনেক আগেই পরিচিত হওয়া উচিত ছিল আমাদের।
দিল্লীনিবাসী উর্মী ঢাকা য়্যুনিভার্সিটিতে অধ্যয়নকালীন আমার সহপাঠী। শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা প্রায় দু-যুগেরও বেশি সময় থেকে। বাংলাদেশে একাধিক বরেণ্য ওস্তাদের কাছে তালিম নেয়ার পর ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে প্রথমে লক্ষ্মৌয়ের ভাতখান্ড কলেজ্ অফ হিন্দুস্তানি মিউজিক্-এ এবং পরে দিল্লীর শ্রী রাম ভারতীয় কলাকেন্দ্র থেকে তাঁর সংগীতশিক্ষা সমাপন করেন। বর্তমানে মুম্বাইয়ের বিশ্ববরেণ্য শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী শ্রীমতী শোভা গুর্তু-র কাছে খেয়ালের কঠোর তালিম নিচ্ছেন তিনি।
রমা ধানমণ্ডির ইন্টার্ন্যাশন্যাল্ মিউজিক্ স্কুলের ছাত্রী। সম্পূর্ণ পশ্চিমা গায়কীর উপর তার তালিম চলছে। তার অবদান আমাদের অনেক সৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করেছে।
ডালিয়া উঠতি গায়িকা। বেশকিছু ফিতা তার বের হয়েছে। আমাদের সঙ্গে সহকণ্ঠ হিশেবে কাজ করেছেন একনিষ্ঠা নিয়ে।
মেহরীন অনেক গুণে গুণান্বিতা। একাধারে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষার গায়িকা, উপস্থাপিকা এবং সফল মডেল। গানের প্রতি তার আগ্রহ ও নিষ্ঠা আমাদের সঙ্গে বেশ মানিয়ে গেছে।
নীতিরঞ্জন তবলার উপরে ভারতের বরোদা এমএস্ য়্যুনিভার্সিটির সম্মান ও স্নাতকোত্তর উভয় পর্যায়েই ফার্স্ট ক্লাস্ ফার্স্ট উইথ ডিস্টিঙ্কশন্ নিয়ে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ গোল্ড মেড্যাল্ পাওয়ার পর এখন ভিনদেশে পিএইচডি অর্জনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাংলাদেশের তবলাজগতে বেশ বড় ধরনের হৈচৈ ফেলেছেন। dHAKA ব্যান্ড এবং জ্যাজ্ ও ফিউশন্ সংগীতে শিক্ষানবিশ।
স্কটল্যান্ডের অধিবাসী লিন্ডস্যে বৈবাহিক সূত্রে বাংলাদেশে আছেন। ‘পোচড্ ব্যুগি’ নামের বারিধারাস্থ বিদেশী নাগরিকদের একটি ব্যান্ডের প্রধান কণ্ঠশিল্পী তিনি। আমাদের সঙ্গে একটি গানের বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় কণ্ঠ দিয়েছেন।
বরোদা এমএস্ য়্যুনিভার্সিটির আরেক কৃতী ছাত্রী রূপশী যিনি ভায়োলিনে উচ্চতর তালিম নিচ্ছেন। আমাদের সঙ্গে একটি গানে সঙ্গ দিয়েছেন। ভায়োলিনবাদক হিশেবে ইতোমধ্যে এই উপমহাদেশে বেশ নামডাক হয়েছে তার।
কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ : সর্বপ্রথম বিনীত কৃতজ্ঞতা আমাদের সকলেরই সর্বশক্তিমান, ক্ষমাশীল ও দয়াবান সৃষ্টিকর্তার কাছে যিনি আমাদেরকে অনেক ধৈর্য ও পরীক্ষার মাঝ দিয়ে এই নতুন ব্যান্ড নিয়ে এই অ্যালবাম/সংকলন বা ফিতার কাজ শেষ করবার তওফিক দান করেছেন। ধন্যবাদ জানাতে চাই খোকার সম্পূর্ণ পরিবার ছাড়াও তার স্ত্রী শামীমা আরজুকে তার অনেক সাহায্যের জন্য। ধন্যবাদ এলিফ্যান্ট রোডে আমাদের প্র্যাক্টিস্ প্যাড-সংলগ্ন সকল বাসিন্দাদের যারা আমাদের সময়-অসময়ের উচ্চশব্দের মহড়া ও আমাদেরকে সহ্য করেছেন। ধন্যবাদ পল্লবীতে আমার মহল্লার বাসিন্দাদের যারা সময়-অসময়ে আমার উচ্চ ভল্যুমে আমার টেইপ্ বাজনা সহ্য করেছেন। কৃতজ্ঞতা কবি ফরহাদ মজহার, ফরিদা আপা ও UBINIG-কে, উনাদের অতি মূল্যবান কিবোর্ডটি আমাদেরকে ব্যবহার করতে দেবার জন্য; Miles-এর হামিন আহমেদ টোকনকে তার Crate গিটার অ্যাম্পলিফায়ার ব্যবহার করতে দেবার জন্য, Renaissance-এর ফয়সল সিদ্দিকী বগী ও ইমরানকে Ovation acoustic guitar ও percussion bag ব্যবহার করতে দেবার জন্য। কৃতজ্ঞতা সাউন্ডগার্ডেন স্টুডিয়ো-র প্রকৌশলী ইমরান আহমেদ চৌধুরী মবিনকে তার শব্দ-সংমিশ্রণের জন্য এবং তার সহযোগীদ্বয় চারু ও দূরেকে শব্দধারণের জন্য। একই স্টুডিয়োর মনোরঞ্জনদা, পরিমল, টিংকু ও মোহনকে রেকর্ডিং চলাকালীন অনেক ঝড়ঝাপ্টা হাসিমুখে সহ্য করার জন্য। কৃতজ্ঞতা পুরনো দোস্তো জানে আলমকে তার উপদেশের জন্য, ‘সিডি সাউন্ড’-এর আরিফ ভাইকে, আমার সংগীত বিশ্বাস করার জন্য এবং ধন্যবাদ অগণিত শ্রোতা ও গুণগ্রাহীদের যারা আমার জীবন পূর্ণ ও ধন্য করেছেন তাদের অনেক ভালোবাসার অভিব্যক্তির মাধ্যমে। ইন্টার্নেটযুগের বন্ধু (যার সাথে এখনও সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘য়্যুনিভার্সিটি অফ ন্যুইয়র্ক অ্যাট বাফালো’-তে কম্প্যুটার সায়েন্সে অধ্যয়নরত আমাদের ওয়েবসাইটম্যানেজার জয় গৌতমকে। সে তার মূল্যবান সময় দিয়েছে আমাদের ইন্টার্নেটযোগ্য একটি ওয়েবসাইট সৃষ্টি করে দিতে। ধন্যবাদ আমাদের লাইভ সাউন্ডকোম্প্যানি সাউন্ডস্টর্ম ও শিহাবকে, SAS-এর সোহেলকে, এবং ‘সাউন্ড মেশিন্’-এর মং তিথি ছাড়াও আমাদের roadie আব্দুর রহমানকে। ধন্যবাদ আমাদের ভিডিয়ো মেইকার অর্ণব ব্যানার্জি রিংগো, রূপশা ও বায়োস্কোপ প্রোডাকশন্স-কে, নিগ্যাটিভ প্রোডাকশন্স-এর পান্না খোকন ও আপিককে, ভিয়্যুমিডিয়া-র জিয়াউদ্দিন রিপন ও কাঞ্চনকে, কম্প্যুটার গ্র্যাফিক্স ও ডিজাইনের জন্য হুমায়ূন ও সমলয় এবং ধন্যবাদ চিত্রগ্রাহক মন্টি ও ট্র্যাভিসকে।