মুহূর্তের আলো, কবিতার মুহূর্ত । ফজলুররহমান বাবুল
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ মার্চ ২০১৬, ৯:৫৬ পূর্বাহ্ণ, | ৩৫০২ বার পঠিত
The Poet’s Work is Done…
Within a Moment.
William Blake
একটি কবিতার মুহূর্ত মানে এক অথবা একাধিক বিষয়ে স্বকীয় সৃজনশীলতায় অনুপ্রাণিত হয়ে কোনো এক মুহূর্তের আলোয় মনোরাজ্যে কিছু শূন্যস্থান পূরণ হয়ে যাওয়ার মতো কিছু। একটি কবিতার মুহূর্ত একটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাও বটে। ভীষণ ভালোলাগায় কবিতার ভিতরে সময় উৎসবে উষ্ণ-মধুর; যেন কোথাও আর কিছু নেই কবিতার মতো। কবিতায় চড়তে-চড়তে সমুদ্র পাড়ি দেয়া। মাথার ভিতরে কবিতার ঘোরাঘুরি। কবিতা আসে—আর ভোর হয়ে আসে সমুদ্রে, তীরে। অথবা, যখন কবিতা আসে তখন যেন ভোর হয়ে আসে হালকা অথবা ভারী হাওয়ায়। কবিতা আসে আর আলো জ্বলে ওঠে। কবিতা আসে আর সূর্য ওঠে অদৃশ্য তরঙ্গে হৃদয়ের পাতায়। কবিতা আসে আর সৌন্দর্যের পায়ে উপচে পড়ে মুহূর্ত। বিকেলের হাওয়ায় কিংবা গভীর রাতে ক্ষীণ-আলোয় একটি কবিতার মুহূর্ত যেন একটি নতুন ভোর আলো-ছায়ায়। একটি কবিতার মুহূর্ত একটি স্বপ্নের ভিতরে-বাহিরে ভ্রমণ অথবা আগামী কোনো স্বপ্নের নমুনা কিংবা বিশ্লেষণ কল্পনাশক্তিতে, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সুষমায়, শব্দে, ছন্দে, রূপকে, এ্যালিউশনে, ব্যঞ্জনায়, উপমায়, বাকপ্রতিমায়…।
কবিতার দরজা-জানালায় উঁকি দেয় সুন্দর; সূর্য ওঠে। একটি কবিতার মুহূর্ত যেন চাঁদের উদয়ন, শব্দহীন। একটি কবিতার মুহূর্ত অদ্ভুত, সুন্দর এবং সৌন্দর্যালোকে মহীয়ান; যেন হঠাৎ আকাশ থেকে মৃত্তিকায় বৃষ্টি নেমে আসা কিংবা নিস্তব্ধ কোনো পুকুরের স্বচ্ছ জলে হঠাৎ কোনো উজ্জ্বল মাছের লাফ দিয়ে জলের উপরে উঠে বাতাসের জগতে প্রবেশের চেষ্টা করে আবার জলেই ডুবে যাওয়া। ব্যাপারটা যা-ই হোক —এখানে তো সৃজনমগ্নতারই যোগ, স্ফুরণ। মগ্নতা ছাড়া হয় কি এইসব কাজ? স্রেফ লেখালেখির ইচ্ছা থাকলে কবিতাচর্চা না-করে অন্য কোনো প্রকারের রচনায় ব্যাপৃত হওয়া যায়। কবি না-হয়ে, কবিতা না-লিখেও লেখক হওয়া যায়।
মানুষ কবিতা রচনা করে, গান রচনা করে, মানুষ গান গায় কিংবা কবিতা আবৃত্তি করে। মানুষ ফসল ফলায়, মানুষ কল-কারখানা চালায়, কতো কাজই করে। মানুষের রয়েছে কত কাজ। মানুষ খনির ভিতর থেকে কয়লা বের করে আনে, মানুষ পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্বের খোঁজ করে, মানুষ ভাস্কর্য বানায়; —মানুষের কাজের, শখের কিংবা খেয়ালের শেষ নেই। অজস্র কাজের ভিড়ে একটি কবিতার মুহূর্ত হতে পারে পায়ের তলায় একটি ঘাসফুল মাড়িয়ে দেয়ার মতো কোনো কষ্টের মুহূর্ত কিংবা একজন সন্ন্যাসীর দীর্ঘ ত্রিশ বছর অরণ্যে কাটিয়ে হঠাৎ কোনো অচেনা মহানগরে পৌঁছানোর মুহূর্তের মতো। বিশেষ কোনো মুহূর্তের উপলব্ধি/অনুভব একটি কবিতার উপকরণ হিসেবে কাজে লাগতে পারে। আমরা একটা মুহূর্তের কথা কল্পনা করতে পারি: ভাদ্রমাসের সন্ধেবেলায় ভ্যাপসা গরমের মধ্যে নিজের ঘরে বসে বই পড়ছেন একজন কবি (যিনি হাড়মাসে কবিতার অনুশীলনকারী); হঠাৎ আকাশে মেঘের গর্জন শুরু হলো; বিদ্যুৎ চলে গেল; কবির চোখের সামনে থাকা বইয়ের পাতার কালো আখরগুলো অন্ধকারে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল; সিলিংফ্যানের ঘোরাঘুরিও থেমে গেল; আর জ্বলে উঠল বিকল্প-বাতি। বড়ো রাস্তার ওপর দিয়ে কড়া শব্দে হর্ন বাজিয়ে দু-একটি বড়ো মালবাহী ট্রাক চলে গেল। এরকম মুহূর্ত কবির মনে বিশেষ কোনো অনুভূতির জন্ম দিলে কবি হয়তো লিখে ফেলতে পারেন একটি নতুন কবিতা। ঠিক একই মুহূর্তে অন্য-একজন কবির কাছে ব্যাপারটা বিরক্তিকর হতেও পারে। অন্য একজন কবি হয়তো বারান্দায় গিয়ে বসবেন, কিছুই লিখবেন না। আবার একই ভাব/বিষয়ে দুজন কবি কবিতা লিখলেও মেজাজে, উৎকর্ষতায় তা সমপর্যায়ের হওয়ার নিশ্চয়তাও নেই।
কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘যমুনাবতী’, ‘জাবাল সত্যকাম’, ‘আরুণি উদ্দালক’, ‘ভূমধ্যসাগর’, ‘কলকাতা’, ‘বাবরের প্রার্থনা’ — ইত্যাদি কবিতা কীভাবে লিখেছিলেন তার বর্ণনা আমরা পেয়েছি ‘কবিতার মুহূর্ত’ নামের একটি বই থেকে। কবি তাঁর অনুভব কিংবা উপলব্ধির আলোকে এক-একটি পরিখা খনন করতে-করতে যেন এক-একটি দৃশ্য পান করেন আর তাকে মুহূর্তে-মুহূর্তে ধারণ করেন কবিতায়।
একটি কবিতার মুহূর্ত হতে পারে একজন কবির ব্যক্তিগত/সামাজিক জীবনের কোনো আটপৌরে কিংবা সুনিবিড় অভিজ্ঞতার সূচিমুখ, নানা মাত্রার নানা রুচির রূপান্তরে যা প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো কিছু। আবার যে-ভাষায় কবিতার মুহূর্তটি ধরা পড়ে তা হতে পারে চেনা কিংবা অচেনা। মানুষের চেনা কিংবা অচেনা এই পৃথিবীতে মানুষ মূলত অসম্পূর্ণ, দুর্বল। মানুষের মন বিচিত্র; মানুষ ভালোবাসে নিজেকে; মানুষ ভালোবাসে মানুষকে এবং ঘৃণাও করে। মানুষ মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, শত্র“তাও করে। মেধায়, জ্ঞানে, কর্মাকর্মে মানুষ করতে পারে অনেক-কিছু। মানুষ প্রকৃতিতে সুন্দরতম জীব এবং মানুষ সুন্দরের চর্চা করে। মানুষ কবিতা রচনা করে। কবিতার মুহূর্ত হতে পারে ভালোবাসার কিংবা ঘৃণার।
…
ভাবি, কবিতার মুহূর্ত হয়ত কবিকে প্রদক্ষিণ করে এমন-সব ঘটনাবলির ভিতরে একটা মানসিক অবস্থার প্রতিফলন —কবি যাকে মুহূর্তের আলোয় শব্দে, বাক্যে সাজিয়ে তোলেন। কবি তো ছাগল-ভেড়ার খামারে বসে সমুদ্রের জলে ঘুরে বেড়ানো হাঙর নিয়েও কবিতা লিখতে পারেন। এটা কি তার মানসিক স্বাধীনতা? মানব-মন পারিপার্শ্বিক অবস্থার বাহিরেও ঘুরতে পারে? সিগমুন্ড ফ্রয়েড যে-অর্থে মনের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ তোলেন এই ব্যাপারটা হয়তো তা নয়। ফ্রয়েড তাঁর Psycho Analysis-এ বলেন—‘আপনারা যে গভীরভাবে মনের স্বাধীনতায় ও স্বাধীন নির্বাচনে বিশ্বাসী তা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক, বরং মানসিক জীবনও যে একটি নিয়ন্ত্রক শক্তি বা প্রক্রিয়ার অধীন তা মেনে নেয়া যুক্তিসঙ্গত।’—ফ্রয়েডের এই বক্তব্য ভাবনাসঞ্চারী।
অরো অনেকের মতো আমিও কবিতার সংজ্ঞার্থ নিরূপণের প্রয়াস নিরর্থক বোধ করি। একটি কবিতার ধরা দেয়ার মুহূর্তকে বুঝতে চাওয়া কিংবা বোঝানোও কঠিন। এক-একটি কবিতা তার স্বতন্ত্র প্রেক্ষিতে/স্বরূপেই তো ধরা পড়ে। কীভাবে, কখন কবিতা ধরা দেয় তা আগে থেকেই কে জানে!
উইলিয়াম ব্লেক সহ অনেক প্রথিতযশা সাহিত্যিকই মনে করতেন কবি দিব্যনেত্রসম্পন্ন। ১৩ মে, ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে আর্তুর র্যাঁবো তাঁর শিক্ষক জর্জ ইযামবার-কে এক পত্রে জানিয়েছিলেন ‘আমি কবি হতে চাই। আমি দিব্যনেত্র পাওয়ার লক্ষ্যে পরিশ্রম করে যাচ্ছি।’ একই পত্রে র্যাঁবোকে এই কথাও লিখতে দেখি—‘সমস্ত ইন্দ্রিয়কে অনিয়মে পরিচালনা করে এক অজানাতে উপনীত হবার সাধনা করছি আমি। এতে অনেক যন্ত্রণা, এরকম কিছু করতে হলে (মনে ও শরীরে) শক্তি থাকার প্রয়োজন হয়, আমি নিজেকে চিনতে পেরেছি, আমি কবি।’ এবং ‘জীবনস্মৃতি’তে দেয়া রবীন্দ্রনাথের নিজের বর্ণনা থেকে আমরা এটা বুঝে নিই যে, ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি কোনো দিব্যনেত্রের আলোকেই রচিত : ‘সদর স্ট্রীটের রাস্তাটা যেখানে গিয়া শেষ হইয়াছে সেইখানে বোধ করি ফ্রী-স্কুলের বাগানের গাছ দেখা যায়। একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেইদিকে চাহিলাম। তখন সেই গাছগুলির পল্লবান্তরাল হইতে সূর্যোদয় হইতেছিল। চাহিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ এক মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল। দেখিলাম, একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দে এবং সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত। আমার হৃদয়ের স্তরে স্তরে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমিষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক একেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। সেইদিনই ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি নির্ঝরের মতোই যেন উৎসারিত হইয়া বহিয়া চলিল।’
কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘যমুনাবতী’, ‘জাবাল সত্যকাম’, ‘আরুণি উদ্দালক’, ‘ভূমধ্যসাগর’, ‘কলকাতা’, ‘বাবরের প্রার্থনা’ — ইত্যাদি কবিতা কীভাবে লিখেছিলেন তার বর্ণনা আমরা পেয়েছি ‘কবিতার মুহূর্ত’ নামের একটি বই থেকে। কবি তাঁর অনুভব কিংবা উপলব্ধির আলোকে এক-একটি পরিখা খনন করতে-করতে যেন এক-একটি দৃশ্য পান করেন আর তাকে মুহূর্তে-মুহূর্তে ধারণ করেন কবিতায়। একটি কবিতার মুহূর্ত হতে পারে একজন বিনয় মজুমদার কর্তৃক ‘একটি উজ্জ্বল মাছ’-এর মতো কিছু লিখে ফেলা—
একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো—এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ় রসে আপক্ষ রক্তিম হলো ফল।
একটি রচনার কবিতা হয়ে ওঠার মুহূর্ত (তা যে-কোনো প্রেরণায়ই হোক)—ভাব, উপলব্ধি কিংবা চিন্তার রাজ্যে একজন শিল্পীর সন্তর্পণে, চুপিচুপি কিংবা হঠাৎ একটি লাফ দিয়ে কিছু ধরে ফেলা। একটি কবিতার মুহূর্ত মানে একটি উজ্জ্বল মাছ হঠাৎ জল থেকে লাফ দিয়ে হঠাৎ জলের উপরে বাতাসের জগতে প্রবেশের প্রচেষ্টা—তা হতে পারে অর্থময় অথবা অর্থহীন কিছু। একটি রচনার মুহূর্ত কখন কবিতার দিকে হয়ে ওঠে সফল কিংবা লক্ষ্যচ্যুতি ঘটে—কবি নিজেও আগে থেকে নিশ্চিত হতে পারেন না। কবি ও প্রাবন্ধিক খোন্দকার আশরাফ হোসেন ‘কবিতার অন্তরাল’ শিরোনামের এক নাতিদীর্ঘ গদ্যে একটি রচনার কবিতা হয়ে ওঠার মুহূর্তটির বর্ণনা দেন যেভাবে তা এখানে বেশ প্রাসঙ্গিক— ‘একটি রচনার কবিতা হয়ে ওঠার মুহূর্ত নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মতোই : ভূমধ্য-গিরি কাঁপিয়ে উচ্ছ্বসিত জলধারার মতো হঠাৎ উত্থান হতে পারে। আবার কখনো তার আগমন হতে পারে সন্তর্পণে, ধীর পায়ে, অন্ধকারে, তীক্ষ্ম একটি লক্ষ্যের দিকে শিকারি-জন্তু যেভাবে এগোয়, তারপর হঠাৎ একটি লাফ, একটি মুহূর্তকে আকড়ে ধরা, একটি তীব্র শীৎকারের মধ্য দিয়ে যেরকম অর্গ্যাজম, তেমন।’
একটি কবিতার মুহূর্ত যেন একজন শিল্পীর আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠে একটি চমৎকার দিবাস্বপ্ন দেখা। কোনো শিল্পী কিংবা কোনো কবিই জানেন না স্বপ্নের কবিতা কখন এসে ধরা দেয় তাঁর কাছে। হতে পারে, একটি কবিতার মুহূর্ত কোনো রহস্যময়তায় আকণ্ঠ ডুবে যাওয়া, অথবা একজন কবির নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলার মতো। আর এটা বিশ্বাস করতেই হয় যে, একটি কবিতার মুহূর্ত কবির বিশেষ আবেগ, অনুভব/উপলব্ধি কিংবা অন্তর্দৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ (কখনো-সখনো দৈবায়ত্ত হয়েও চর্চালব্ধ)। কবিতার মুহূর্ত শুধু পদ্য/ছন্দোবদ্ধ পঙ্ক্তির ভিতরেই আসে না; কবিতার মুহূর্তটি হতে পারে কোনো চলচ্চিত্রে, নাটকে, সংগীতে, ভাস্কর্যে, স্থাপত্যে কিংবা কোনো চিত্রকলায় গদ্যের ছলাকলায়। কবিতার মুহূর্তটি হতে পারে কোনো নকশি কাঁথায় অথবা হাজার কিংবা লক্ষ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কোনো বক্তৃতায়। স্বপ্নের ভিতরেও চলে আসে কবিতার মুহূর্ত। কবিতার সেই মুহূর্তটিকে কবি স্বপ্নেও সাজিয়ে নেন; অথবা স্বপ্নযোগে কোনো বিশেষ কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত হন। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য এর একটি উদাহরণ। স্বপ্নে-পাওয়া কবিতার কবিদের তালিকায় ইয়েট্স, কোলরিজ, বিষ্ণু দে, রিলকের মতো কবিরা তো আছেনই, এবং রবীন্দ্রনাথের ‘গানভঙ্গ’ কবিতাটিও স্বপ্নলব্ধ উপাদানে লেখা। কবিতার ঝলক আসে; দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, টের পাওয়া যায়, অনুভব করা যায়। এই টের পাওয়া কিংবা অনুভব কবিকে স্মরণ করিয়ে দেয় মুহূর্তকে আখর/ভাষার ফ্রেমে আটকে দিতে। অনেকে বলেন, লেখার শুরু হয় যন্ত্রণা, আবেগ থেকে। ‘রামায়ণ’ কাব্যের রচয়িতা বাল্মীকির কণ্ঠ থেকেও নিষাদকর্তৃক ক্রৌঞ্চবধের ঘটনার প্রেক্ষিতে উচ্চারিত হয়েছিল ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ’ এই রকমের কথা। বাল্মীকির কবিপ্রতিভা সম্পর্কেও দৈব-প্রেরণার জনশ্র“তি আছে। কবির মনোরাজ্যে কোন প্রেক্ষিতে কীভাবে কবিতার মুহূর্তটি আসতে পারে তার কোনো সুনির্দিষ্ট যুক্তি/ব্যাখ্যা আছে বলে আমার জানা নেই। একটি কবিতার জন্ম-মুহূর্তের জন্যে কবিকে অপেক্ষায় থাকতেই হয়; যেহেতু কবি চাইলেই যখন-তখন একটি সার্থক কবিতা লিখতে পারেন না। একজন কবি এজন্যে অপেক্ষা করেন, চর্চা করেন এই লক্ষ্যে—যদি একটি সার্থক কবিতা লিখতে পারেন। কবি তো তাঁর চোখে দৃশ্য দেখেন কিংবা মন দিয়ে কল্পনা করেন, এবং যতক্ষণ দৃশ্যের পর দৃশ্য দেখতে কিংবা কল্পনা করতে সক্ষম থাকেন—হয়তো তাঁর লেখার সামর্থ্যও থাকে ততক্ষণ! দেখায় বা কল্পনায় ধরা দৃশ্যগুলো থেকে কাটাকুটি করে অংশ-বিশেষ কিংবা পুরোটা কবিতায় যুক্ত হওয়া না-হওয়া রচয়িতার ইচ্ছে/রুচির ওপরে নির্ভর করে।
বিষয় অথবা দৃশ্যের বিষয়টি কখনো-কখনো অটোমেটিক আর বর্ণনা/উপস্থাপনের বিষয়টি কবির অর্জিত/ঐচ্ছিক। কিন্তু ঢালাওভাবে যদি বলা হয়—একটি কবিতার মুহূর্ত একজন রচয়িতার জন্যে বিশেষ দৃশ্যের মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্ত তাও হয় না ভুল। একটি কবিতার মুহূর্ত মানে একটি সৃজনীক্রিয়ার উদ্বোধন—যার পরিণতি ঘটতে পারে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সুষমায় ভাষার আখর, শব্দ, বাকপ্রতিমা, উৎপ্রেক্ষা, উপমা, ছন্দের মতো কত অনুষঙ্গের শৈল্পিক অভিষিক্ততায়।