বই পড়ার স্মৃতি । নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ৩:০৬ পূর্বাহ্ণ, | ৩২৩৬ বার পঠিত
আমি ঠাকুরমার ঝুলি পড়ার বয়সে বড়দের বই পড়ি। আমার বাবার অনেক বই ছিলো। তাছাড়া টিফিনের টাকা জমিয়ে আমি বই কিনতাম। আর প্রায় প্রতিদিন তিনমাইল হেঁটে একটা এনজিওর পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে আসতাম। মনে আছে একই সঙ্গে কখনো এটা, কখনো ওটা এই করে পড়া শেষ করেছিলাম তিনটা উপন্যাস — ম্যাক্সিম গোর্কির মা, হাওয়ার্ড ফাস্টের স্পার্টাকাস, ভিক্তর ওগোর লা মিজারেবল। রাত জেগে বই শেষ করতাম, কোনোদিন শেষ করতাম দুটো বই। তখন আমি সিক্স / সেভেনে পড়ি। হয়তো এইভাবে আমি হয়ে গেলাম ইনসোমনিয়াক। সেই রোগ বয়ে বেড়ালাম ১৫/১৬ বছর।
আমি যখন ফোরে পড়ি তখন পড়ে ফেলি নজিবর রহমান সাহিত্যরত্বের আনোয়ারা উপন্যাস এইটা ছিলো আমার জীবনে পড়া প্রথম প্রেমের উপন্যাস। উপন্যাসে পড়া একটা দৃশ্য এখনো চোখে লেগে আছে। অসুস্থ হয়ে আনোয়ারাদের বাড়িতে আশ্রিত রফিক (সম্ভবত) তার সেবাযত্নে সুস্থ হয়, কিন্তু আনোয়ারার প্রেমে পড়ে যায়। ফলত তাদের গৃহত্যাগের প্রাক্কালে তার একগোছা চুল চুরি করে কেটে নেয় স্মৃতি হিশেবে। বইটা আব্বার কালেকশন থেকে চুরি করে পড়তে হয়েছে। কারণ তখন বাড়িতে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ‘আউটবই’ পড়া নিষেধ ছিলো। ফলত এই বইটা পড়েছি অনেক কষ্টে দীর্ঘদিন ধরে।
তারপর হাই ইশকুলে গিয়ে বইয়ের দোকানের পেছনে বসে পড়েছি অনেক সিরিজ বই ওয়েস্টার্ন, মাসুদ রানা, তিন গোয়েন্দা, কুয়াশা, দস্যু বনহুর, সাইমুম ইত্যাদি। আর পড়েছি অনেক লেখকের বই যথা বেদুঈন সামাদ, আকবর হোসেন, কাজী ইমদাদুল হক, হুমায়ুন আহেমেদ ইত্যাদির বই। একই সময় সেলিনা হোসেনের গায়ত্রীসন্ধ্যা এবং সমরেশ বসুর প্রজাপতিও পড়ি। কিন্তু আমাকে আকবর হোসেন এবং কাসেম বিন আবুবাকার বেশি আকর্ষণ করেছিলো। আকবর হোসেনের উপন্যাস পড়ার সময় আমার মনে হতো উত্তম সুচিত্রা অভিনীত সিনেমা দেখছি।
কাসেম বিন আবুবাকর আমার প্রিয় উপন্যাসিক ছিলো যখন সিক্স-সেভেনে পড়ি। আমাদের বাজারের বইয়ের দোকান ছাত্রবন্ধু আর আদর্শ লাইব্রেরির বইয়ের তাকের পেছনে ফাঁকা জায়গা ছিলো, ওখানে বসে প্রায় দিন ইশকুল ফাঁকি দিয়ে কাসেম বিনের বই পড়তাম। এইভাবে আমি তার টানা চল্লিশটা উপন্যাস পড়েছি। পরে ওইগুলি সংগ্রহও করেছি। এমডি মুরাদের ‘ঘুমন্ত গোলাপ’-এর পরই কাসেম বিন আবু বাকারের ‘ফুটন্ত গোলাপ’ বাজারে আসে। তার মতো আরো কয়েকজন লিখতে আসেন তখন তার মধ্যে আব্দুস সালাম মিতুল অন্যতম। আরেফা আহসান রত্না নামেও একজন উপন্যাসিক আছেন। তার লেখাও এই ধারার। যাই হোক কাসেম বিনের ‘আধুনিকা’ নামের উপন্যাসে প্রেমের কথা এখনো চোখে লেগে আছে। এইসব বই থেকে আমাদের সিনেমার স্ক্রিপ্ট বানালে আমাদের সিনেমার চেহারা পাল্টে যেতো। ফারুকির উচিত কাসেম বিনের শরণাপন্ন হওয়া। রোমেনা আফাজের পর কাসেম বিন আবুবাকরের উত্থান ঘটে বাঙলা সাহিত্যে। তার অনুকরণে আরো ৪/৫জন উপন্যাস লেখা শুরু করেন তার মধ্যে আব্দুস সালাম মিতুল, মোশারফ হোসাইন সাগর ইত্যাদি। তাদেরও আনেক উপন্যাস পড়েছি। বিষয়বস্তু মূলত ইসলামি সামাজিক প্রেম। এই লেখকগণ জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
আমাদের বয়োঃসন্ধির সব থেকে প্রিয় ছিলো রসময় গুপ্ত নামে গোপন এক লেখকের চটি বই। ওইসব পড়তাম আমার ইশকুলের বন্ধু রাসেলের কাছ থেকে নিয়ে। ওর বাসার ওয়ালমেটের পেছনে গুজে রাখতো সে এইসব পরম পুস্তিকা।
সে এক সময় ছিলো যখন দৈনিক দুইতিনটা বই পড়ে ফেলতাম, ইশকুল কলেজের সময়ে — একদিন পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে পড়ে দালিম ফুলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম সারাদিন। আম্মা ডাক দিতো, ভাত খেতে আয়। আমি ভাতের প্লেট নিয়ে দালিমগাছের সামনে বসে থাকি। এই রকম আরো অনেক বই পড়ে অনেক অদ্ভুত আর উদ্ভট আচরণ করেছি। আমার কোনো ইনটেশন ছিলো না। যেমন-ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড পড়ার পর হাঁটতে হাঁটতে কোনো নর্দমা, খাল দেখলেই মনে হতো হোসে আর্কাদিওর রক্ত গড়িয়ে আসছে। আমার এমন হতো। কেনো হতো জানি না। এখন চাইলেই বইটই ঘেঁটে কারণ বের করে ফেলতে পারবো। কিন্তু ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে না আমার টকটকে লাল দালিম ফুল হারিয়ে যাক।
তারপর আরেকটা প্রিয় বইয়ের স্মৃতি এখনো নিজের মধ্যে লালন করি, দস্তয়ভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট। নিজেকে রাস্কলনিকভ ভাবি এখনো। আর ভাবি, প্রেম অপেক্ষা শাস্তিই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ।
তারপর ধরেন সলবেলোর ‘হেন্ডারসন দ্য রেইন কিং’ — সৈয়দ শামসুল হকের অনুবাদে ‘শ্রাবণরাজা’ পড়ে তার মধ্যে অনেকদিন ডুবে ছিলাম।
প্রায় ১৫/১৬বছর আগে আমি সৈয়দ শামসুল হকের একটা উপন্যাস পড়েছিলাম, নাম ‘খেলারাম খেলে যা’। উপন্যাসের একটা চরিত্রের নাম ছিলো জাহেদা। যাকে নিয়ে বাবর আলী নামে এক মাঝবয়েসি আপাত লম্পট এবং মানসিক সমস্যায় জরজর এক লোক উত্তরবঙ্গের দিকে কোথায় বেড়াতে গিয়ে একটা গেস্টহাউজে উঠে। এবং জাহেদাকে মাঝরাতে যৌন সুরসুড়ি দেয়। জাহেদা ঘুমুতে পারে না।
আমাদের বয়োঃসন্ধির সব থেকে প্রিয় ছিলো রসময় গুপ্ত নামে গোপন এক লেখকের চটি বই। ওইসব পড়তাম আমার ইশকুলের বন্ধু রাসেলের কাছ থেকে নিয়ে। ওর বাসার ওয়ালমেটের পেছনে গুজে রাখতো সে এইসব পরম পুস্তিকা।
রবিনাথের গল্পগুচ্ছ ছোটোবেলায় আমার খুবই প্রিয় বইগুলির একটি ছিলো। আমি হৈমন্তী আর সমাপ্তির প্রেমে পড়েছিলাম। অনেকদিন পর শাস্তি গল্পটা আবার পড়ে চন্দরাকে নতুনভাবে বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। তখন চন্দরা রাগ-ক্ষোভের ওপরে চলে গেছে, তখন আর রাগ কিংবা প্রতিবাদ করে কোনো লাভও নেই। রাগ থাকলে সে ভাসুরের দোষ নিজের মাথায় নিত না, কখনো।তার বসয় ১৭/১৮।সে স্বামীকে ভালোবাসতো। সেই স্বামী যখন বলতে পারে বউ হারালে বউ পাবো, কিন্তু ভাই হারালে ভাই পাবো না। ছিদামের এই স্বার্থপর বাক্য শুনে সে প্রথমে পাথর হয়, পরে তা অভিমানে রূপ নেয়, এবং আত্মবিধ্বংসী হয়েই খুনের দায় নিজের ঘাড়ে নেয়। চন্দরার মরণ শব্দটি উচ্চারণের ভঙ্গি গল্প পড়ে আমি যা কল্পনা করি তাতে মনে হয়। এই শব্দে লুকিয়ে ছিলো অভিমান। আর তা তার অসহায় স্বামীর প্রতি যে ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বউকে জলাঞ্জলি দেয়। আর এই অভিমান থেকেই চন্দরা সবখানে বলে খুনটা সে নিজেই করেছে।
নাইন-টেনে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন পড়তে পড়তে দীপাবলিকে নারীই মনে হয়েছে। সে নিজের চেষ্টায় আইসিএস পাশ করার পর, সরকারের প্রশাসনিক পদে দীর্ঘদিন চাকরি করার করে নানামুখি সমস্যা এবং সংগ্রামের ভিতর দিয়ে পথ চলতে চলতে একসময় হোছট খেয়ে পড়ে। আর সব ছেড়ে ঠাকুর মা মনোরমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে, তখন তাকে আমার নারী মনে হয়েছে।
আরেকটা বই হুমায়ুন আজাদের নারী। যার বই পড়ার অভ্যাস আছে — সে কি বইটার মতো সহজ একটা বই পড়তে পারে না? আর বইটিকে আমি খুবি গুরুত্বপূর্ণ বই মনে করি, সিমোন দ্য বোভোয়ারের দ্বিতীয় লিঙ্গ এর পর। এবং এই বইটিকে আমি প্রতিটি নারী (যে নারী হয়ে জন্ম নেয় না, ক্রমশ নারী হয়ে উঠে) র জন্য বেদসম মনে করি। কেননা এটি তার নিজেকে চিনতে শেখায়।তার অবস্থান সম্পর্কে জানিয়ে দেয়। নারী নয়, মানুষ হিশেবে তার ঔচিত্যবোধকে জাগ্রত করে।
আমার নির্দিষ্ট কোনো প্রিয় বই থাকে না চিরদিন তবে অনেকবছর ধরে এখনো পর্যন্ত প্রিয় বই হলো কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদ ব্যাস রচিত মহাভারত।