যে কবির গ্রামের নাম পৃথিবী । এহসান হায়দার
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জানুয়ারি ২০১৬, ৩:৪৭ পূর্বাহ্ণ, | ৩১১৮ বার পঠিত
পৃথিবীতে হঠাৎ পায়ের ক্ষুধার নিচে রাস্তার শুষ্ক বালির ধোয়ায় শিল্প সৌন্দর্য দস্যুতা নজরুল, র্যাঁ বো, লোর্কা, আঁদ্রে ব্রেতোঁ, প্রস্ত, ক্যামু, সার্ত্রে, গালিব, কাফকা, পিকাসো, কামরুল, জীবনানন্দ, ব্যাবিলন, ট্রয়, আফ্রিকা, তিব্বত, মাদ্রিদ, ম্যানহাটন, নিউ ইয়র্ক, আগ্রা, জয়পুর, পেরু, গ্রিস, জাভা, আর্চাড রোড, ইসলামপুর, শিলাইদহ, চট্টগ্রাম, আলাস্কায়,চিল্কার হ্রদে… অথবা ‘চীনে রেস্তোরায়’ ‘মেধার শয্যায়’ সুলতার পরিচয় জানবার তীব্র প্রতিক্ষা নিয়ে আত্মপরিচয়ে থাকেন ‘মাঝামাঝি, শীতেও নরম’ সময়ের ‘উগ্র উত্তেজনা’ বাংলা কবিতার এস্কিমো পর্যটক ও কবিতার মহাবৈশ্বিক অন্ত্যমিলেরসুসংবদ্ধ নিজস্বতায় ছায়াছন্ন এবং আশ্চর্য বস্তুগত উপমা পরিভ্রমনের কবি সিকদার আমিনুল হক। গ্লোভাল ভিলেজ বলে যে অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদি ধারণা আজ চারপাশে হিং টিং ছট করছে সে কাঁশি ও কফের দুর্গন্ধময় পুঁজির ডাস্টবিনের বাইরে যে পৃথিবীটাই একটা গ্রাম সেই গ্রামের একজন প্রকৃত বাসিন্ধা হলেন সিকদার। যে দস্যি ছেলের মতন সারাটা গ্রাম চষে শুষে নেয় শব্দের অভিজ্ঞতার নিজস্ব পিপাসায়প্রকৃতি ও চৈতন্যের প্রতি ইঞ্চি থেকে সঞ্চিত সুমিষ্টদ্রাক্ষা। সকল ভয়কে ‘অগ্রাহ্য’ করে ‘দূরত্ব থেকে আরো…’ দূরত্বের পথে সাধাসিধে আবেগের আরবান চোখে শ্মশান থেকে অনিদ্রায় আতঙ্কের নিস্তব্ধতাগুলি ‘পূর্ণিমার নিরালায়’ যিনিদখল করে নেন ‘মৃত্যুঞ্জয় কাক’এর ভূমিকায়।‘মেঘের মতো সহজলভ্য তোমার প্রবঞ্চনা’ এমন সাধাসিধে কথার ‘দুরূহ শীতে’ দম্ভহীন আলিঙ্গনের উষ্ণতায় আমিনুল কবিতা যাপনের শুরুতে লাওৎ-এর অন্তর্গত ভাবদর্শনে মগ্ন নিজেকেই প্রথম প্রশ্ন বিদ্ধ করে ‘সংসার কি শুদ্ধ নির্মল’।
এরই উত্তর যেনো সিকদার তাঁর সমস্ত জীবন ধরে খুঁজেছেন নিরবধি।কি সেই শুদ্ধতা? কোন নির্মলতার জন্য এতো বিচলিত কবি?হাতের তালুতে ধরে রাখতে না পারা জলরাশির আর্তনাদ কিংবাঅদ্ভূত তামাশায় ভাঁড়ের মুখে মারি ও মড়কের গল্প শুনে অথবা উত্তরণের জন্য যারা কেবল বলে উঠে‘ ধর্মান্ধ হওয়া ছাড়া আমার কোন ভবিষ্যৎ নাই’ সেই সব চশমার ভাগ্যের দিকে তাকিয়েপথহীন দৃষ্টিহীন চেতনাহীন এক আগামির কথা চিন্তা করেবুকের ভেতর শিশুর মতন ভয় থেকেই কিএমন প্রশ্ন জেগে ওঠে।মানুষের ভেতর ক্রমাগত লাম্পট্য দানা বেঁধে উঠলে, প্রবঞ্চনার রন্ধনশালা থেকে ‘ক্লাউন সভ্যতা’র জিহ্বা লকলকে লালসার গন্ধ তেপান্তর থেকে সরাইখানা, বিছানা থেকে বিদ্যালয়, মর্ম থেকে অন্তর্লোকে ছড়িয়ে পড়লেই নিঃসঙ্গ পৃথিবীতে অন্ধকার শীতের বিরল ডাইনিরা এসে সাম্রজ্য গড়ে তোলে আর মানুষের যা কিছু মানবিক অর্জন তাকে বন্দি করে শুরু হয় ‘শকুনের মহোৎসব’ তখন চেতনার কাফেলায় স্বার্থপর পরকীয়ার ছায়া পড়ে ধূর্ত বাঘিনিরা সুলতার স্বচ্ছ শাড়ি ছায়া টেনে খুলে মাধুর্য আর জ্ঞানকে খুবলে ধরে তখন প্রকৃত-ই প্রশ্ন জাগে কোথায় রয়েছে প্রতারণাহীন প্রেমের শয্যা। কোথায় রয়েছে বিশ্বাসী চাঁদের পূর্ণিমা।
কোথায় মানুষ এতোটা সহজ যা ছিলো বলেই সে এতোটা পথ পেরিয়ে এসেছে শত মহীষাশুড়ের মস্তক ছিন্ন করে। যে কবির কাছে ‘সূর্যকে একটা বড়ো পতঙ্গের চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না।’ সে ভাষ্যকার তো এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেই পারেন।সিকদার আমিনুল হক আমাদের এমন সব আখ্যানের সামনে এনে দাঁড় করান, যেখানে আমরা রোজ দাঁড়িয়ে থাকি অথচ সফলতা আর বারোয়াড়ি শিল্প সৌন্দর্যের দুর্ভোগ ভোগ করতে করতে আমরা কখনো দেখি না সেই অন্ধকার যেখানেই লুকানো রয়েছে আমাদেরপৌঁছাবার আকাক্সক্ষা ও সেখানের সব আলোকিত লন্ঠনের প্রস্তুতি। তাহলে গন্তব্য কি কোনো শুদ্ধ নির্মল অবস্থান?কিভাবে নির্দেশিত হয় সেই পথ? অর্ন্তলোকের নির্মলতাই কি মুক্তি। ভারতীয় দর্শনের মূল সুরটিও সেই পথকেই সুপষ্টভাবে চিহিৃত করে। তাহলে কি আমিনুল এই শুদ্ধ নির্মলতাকেই আরাধ্য ভেবে তাঁর যাত্রা শুরু করে ছিলেন। কিন্তু আমরা যদি ভালো করে তার কবিতার পরিভ্রমনকে দেখি তাহলে দেখবো যে, তিঁনি তো সহজীয়া আক্রান্ত হননি কখনো। যদিও তাঁর ভাষা তাঁর ভাবনার জায়গা তাঁর উপলব্দির বয়ান এবং তাঁর শ্রেণীগত অবস্থান সেখানে মৃত্যু, মাতৃভূমি, নারী, প্রেম ও প্রণয় এমন ভাবে ব্যাপ্ত ও বিস্তৃত সঙ্কট শঙ্কা উৎকন্ঠা প্রতারণা প্রবঞ্চণা স্থূলতা মানুষের ভেতর জমে ওঠা ক্লেদ তাকে বিচলিত করছে ঠিকই কিন্তু পরিত্রাণের প্রতি তাঁর যেনো কোনো উৎসাহ নেই। যেনো কোনো পরিত্রাণ তিঁনি আকাক্সক্ষা করেন না। অথবা পরিত্রাণ সেই শুদ্ধতা যেখানে মানুষের সকল অন্ধকার পাঠ শেষ হয়ে গেলে আলোর তীব্র যে প্রস্ফুটন হয় সেই চেতনার খরস্রোত একদিন অনিবার্যভাবেই সময়ের হাত ধরে উপস্থিত হবে বলে ধরে নেন আমিনুল। কিন্তু সক্রিয় কোনো ক্রিয়া ছাড়া কিভাবে সেই সময়ের সাথে দেখা হবে বলে শুধু বিশ্বাস আর আপেক্ষায় মানুষ মগ্ন থাকতে পারে তাও একটা প্রশ্ন হয়ে আমাদের সামনে ঠায় বিষন্ন দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রেম, ব্যাক্তিগত সম্পর্ক, যৌনতা, দুষ্টুমী, ব্যাথা এবং মানুষের চিরায়ত ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতিমালা তাকে নতুন রূপে হাজির করে নতুন বিস্তারে ও বিশ্লেষণে নতুন আত্মদান ও আত্ম উপলব্দিতে স্বয়ংক্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে কবিরা বিশেষ করে যুগে যুগে নিবিষ্টভাবেই সক্রিয় ছিলো। সে সচল অনুভূতির চিরায়ত চাকাকে এক আশ্চর্য ব্যঞ্জন্যে আমিনুল আমাদের সামনে হাজির করেন
মানুষের পৃথিবীতে মানুষেরই প্রচেষ্টায় মুনাফা আর দম্ভের যে অসহিষ্ণুতার প্রতিপক্ষ সুলভ উন্মাদ প্রতিযোগিতার সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে তার থেকেই কি মুক্তি চাইছেন কবি?শুধুই কি সহিষ্ণুতা দিয়ে এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় ধ্বংসলীলার যে আস্ফালন ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের চেতনায় ও চর্চায় তার গতিরোধ করে আদরে হাত বুলিয়ে নির্মল কোনো স্বপ্নের অরন্য সংসারআবারো সচল করা সম্ভব? এই যে প্রশ্ন আর আর তার রহস্য সেই রহস্যের অন্তর্লোক, বহিরাবরণ ও তার সচল প্রক্রিয়া তার সাথে সে ভাবের ও বুদ্ধির সম্পর্ক সেখানেই মানুষের রীতিনীতি-নৈতিকতা-অর্থনৈতিক- রাজনৈতিক অর্ডারগুলির সাথে তার ঘনিষ্ঠা বা বৈরিতা এমনই একটি মুহূর্তেই যেনো আমিনুলের অনুভূতির সাথে তাঁর অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতালব্দ জ্ঞানের কথপোকথনের শুরু হয় এবং শব্দের বাক্যের ধাপগুলো পার হয়ে কবিতার পিরামিডটা তৈরি হয়। সেখানে কোনো নির্দিষ্ট চিন্তার প্রতি সিকদার সম্পূর্ণ আত্মসমর্পিত না হলেও মানুষের শুভ ও আলোক চেতনার প্রতি নিষ্ঠুর হলেও অগাধ একটা বিশ্বাস তাঁর রয়েছে। আমিনুল জানেন মানুষ তার ধ্বংস ও তান্ডবের মধ্য দিয়ে যে সভ্যতা গড়ে তুলছে যা তার অন্তর্গত স্বচ্ছতা ও গুণাবলিকেই প্রতারণা ও প্রবঞ্চনায় ক্ষয় করে ফেলছে সেই প্রকৃত সত্যের সাথে তাঁর দেখা হয়ে যাওয়া মাত্রাই সে ঘুরে দাঁড়াবে তাঁর ঘুরে দাঁড়াবার এবং সচলতার সুতীব্র সহজাত প্রবণতা থেকেই।সিকদার আমিনুল হক এখানে শিল্পের অর্ন্তগত অনুভবের সাথে সম্পূর্ণ সম্মিলিত হন এবং একজন শিল্পী ও রাজনৈতিক কর্মীর সাথে যে সূক্ষ্ম তফাৎ তা চিহিৃত করেন। এই চিহিৃন্তকরণের মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর কবি স্বত্ত্বাকে সামাজ-ইতিহাস-দায়বদ্ধতা সব কিছুর সাথে তাঁর যেটুকু সম্পর্ক ও সম্পর্ককে ক্রিয়াশীল রাখতে তাঁর যতটুকু সামর্থ তাকে স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন করেন। আমিনুল এই একটি বিষয় নিয়ে সম্ভবত সব সময়ই ভেবেছেন। তাঁর ভাবনা প্রক্রিয়ার মধ্যে এই রহস্যের সাথে তার সংযোগ ও দূরত্বের ক্ষেত্রে তিনি বরাবরই তাঁর শ্রেণীগত অবস্থান থেকে তার করণীয়র সাথে কোনো আপোষ করেননি। এই নিরাপোষী সহজাত সক্রিয়তার বুনন সিকদার আমিনুল হকের কবিতাকে তাঁর সময়ের থেকে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে।
দুই
বহু প্রাচীন প্রাসাদের জানালায় সিল্কের কোমল গন্ধ মাতাল মৌসুমী রোদ শুকায়।হোটেল বাথরুমে প্লাস্টিকের বালতি ধুয়ে নেয় চুমুর তৃষ্ণা; ক্লান্তি। অন্ধকার বারান্দায় আলস্যের শীতকাল গ্রীষ্মের দুপুর টেবিলে শহরের উগ্র ঐশ্বর্যের সৌভাগ্য মোড়ানোঅসম্ভব সুস্বাদু নাশপাতি কামড়ে ধরার মুহূর্তের উত্তেজনায় বসেও যে শান্তি সুবাস নেই যাপনের হৃদরোগগ্রস্থ সুসজ্জিত জাদুঘরে তার সাথে আয়নায় দেখা হয়ে গেলে সেই সব রমীনারা যারা সস্তায় শরীর ও মর্যাদা বিক্রি করে বালিশে ঘুমের ঘোরে শতাব্দী শতাব্দী ধরে ভৎস্নার চিৎকার শুনতে পায় তাদেরব্যাথার সব বরফ গলে কি এই জরাগ্রস্থ প্রতারক পৃথিবীসবুজ নির্মল স্বাভাবিক ভালোবাসায় ভরে উঠবে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিবে ‘তুমি কি দিয়েছো মুক্তি মেয়েটার হতাশ আশাকে?’ না’কি সভ্যতার এই ক্লেদ যন্ত্রণার হুলোড়ে নিজস্ব জীবনের সাত পাঁচ কেচে কেচে সচেতনতার আড়াল থেকে ভাবতেই থাকবো ‘লম্পটেরা তুলে দেবে, তাকে আজ সৌভাগ্যের গাছে!’ অথবা ‘তুমি কি থাকবে সুখী দুর্বিসহ তোমার দুর্ভোগে?’
ধিক্কার জানাবে কাকে ‘প্রেমের হয় না সিঁড়ি পরিণাম ভেবে।’ চুপচাপ ভালা লাগার গোলাপী সৌরভ গায়ে মেখে কার অপেক্ষায় উথালপাথাল রাত্রির সুঠাম লাবণ্য হেঁটে আসে ঘুমের প্রান্তর থেকে স্বপ্নের স্নানরত ভেজা শাড়ির আঁচলে লজ্জার স্বচ্ছ পুলকগুলি লুকিয়ে রেখে। শীতের নির্ভুল সূর্যাস্তের আগে ‘লাল-নীল-ফিরোজা-হলুদ-সবুজ’ রঙের বৈচিত্রময় ‘কোমরে মেদের ঘনঘটা’ ছায়া প্রতিচ্ছায় যে অপলক প্রতিক্ষার উৎকন্ঠা তাকে তো আর সেল ফোনে বা ই-মেইল এর টেকনোলজিক্যাল কোনো ইনফর্মে খুজে পাওয়া সম্ভব না। ভালোবাসার প্রতি যে বন্দনা যে আকন্ঠ উন্মদনা যে দুর্ধর্ষ আর্তি তা কেবল মানুষের সচল অনুভবের ভেতর দিয়ে অপর মানুষে সংক্রমিত হতে পারে। কিন্তু কোথাও যেনো সব অনুভূতিমালা প্লাষ্টিক সৌন্দর্যের দাস হয়ে গেছে। মিথ্যার ‘প্রত্যহ আমন্ত্রিত ডাস্টবিনে’ ঢুকে পড়ছে সকলে; সে কি উৎসাহ কৃত্রিমতার! প্রবঞ্চনার, লালসার, ক্ষুধার। মুনাফা সভ্যতার সয়ংক্রিয় অমানবীয় প্রচেষ্টায় মানুষ ভালোবাসাকেও করেতুলেছে একটি বহুল বিক্রিত পণ্য। এই তুখোড় সফলতা নিয়ে এগিয়ে চলেছে সভ্যতা! তবু মানুষের গহীনে প্রেমের অনন্ত রৌদ্রের সমুদ্র গান রয়েছে। এখনো রয়েছে ভালোবাসার প্রতি তীব্র দহন ও আনন্দ। কেননাসুলতা তো জানে ‘তোমার গান ছাড়া কোথাও আমার প্রবেশাধিকার নেই।’ইতস্তত এই সব গল্পের সাথে প্রায়ই আমাদের দেখা হয়ে যায় আমিনুলের কবিতার অন্তর্গত পাঠের সময়।প্রতিষ্ঠানের চারদেয়ালের মধ্যে থেকেও প্রতিষ্ঠানের স্থুলপ্রবঞ্চক চেহারার সাথে সম্পূর্ণ পরিচিত সিকদার তাঁর নিজস্ব শ্রেণীগত সীমাবদ্ধসহ শব্দ ও চিত্রকল্প দিয়ে সেই সব উপভোগ-বঞ্চনা-গ্লানি-আর্তনাদ-উৎসবকে খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং নিজস্ব পদ্ধতিতে অভিজ্ঞতার তীর্যক আত্মভাষনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করেন দ্বীধাহীনভাবে।
আমিনুলের ভাষা কখনোই খুব বিদ্রোহী বা অপ্রাতিষ্ঠানিক নয় তবু তাঁর যে সাহিত্য ভাষ্য তাঁর যে অন্তর্গত তৎপরতা তা এই মধ্যবিত্ত ভোগবাদি জীবনের যে অন্তঃসারশূণ্যতা তাকে কোথাও না কোথাও স্পষ্ট করে তোলে। কোথাও না কোথাও প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ কথা বললে মোটেই ভুল বলা হবে না যে কবি সিকদার আমিনুল হক হলেন মধ্যবিত্ত শঠতার কূপমন্ডুকতার এবং মধ্যবিত্ত রুচিবোধের যে শৈল্পিক ধারণা তার একজন সফল নির্মাতা। একটি কাব্য ভাষন তখনই সময়ের গন্ডি পেরিয়ে আসন্ন বর্তমানের ঘনিষ্ট আত্মীয় হয়ে ওঠে যখন সেই বাক্যের মধ্যকার অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও অনুভবে নতুনক্রিয়ায় সক্রিয় থাকে। প্রেম, ব্যাক্তিগত সম্পর্ক, যৌনতা, দুষ্টুমী, ব্যাথা এবং মানুষের চিরায়ত ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতিমালা তাকে নতুন রূপে হাজির করে নতুন বিস্তারে ও বিশ্লেষণে নতুন আত্মদান ও আত্ম উপলব্দিতে স্বয়ংক্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে কবিরা বিশেষ করে যুগে যুগে নিবিষ্টভাবেই সক্রিয় ছিলো। সে সচল অনুভূতির চিরায়ত চাকাকে এক আশ্চর্য ব্যঞ্জন্যে আমিনুল আমাদের সামনে হাজির করেন। বহু পুরাতন সেই সব কথা সেই সব ব্যাথা সেই সব প্রেম যৌনতা, শঠতা তার শব্দের চিত্রকল্পের উপাত্তরা আরো বহুদিন ধরে পাঠকের হৃদয়ের কাছাকাছি স্বজন হিসেবে নতুন মাত্রায় ও বৈচিত্রতা নিয়ে আবৃত থাকবেন। বিশেষ করেজীবনানন্দ পরবর্তী সকল কবির উপরেই এই ভয়ানক কবির স্বংক্রমন ছিলো চোখে পড়ার মতন আমিনুলের বাহাদুরিটুকু এই যে তিনি সমাজ ইতিহাস এবং সম্পূর্ণরূপে একজন গ্রহভিত্তিক কবি যে খুব সাবলিল ভাবে নজরুলের কথা বলতে বলতে লোর্কার শহরের রাস্তায় হেঁটে বেড়ান অতন্ত সাচ্ছন্দ্যে যেনো তিনি এই এখানেই আছেন কামরুলের বাড়ির সামনে দিকের গলিতে পিকাসোর সাথে আড্ডারত।
সমাজ বিকাশ ও তার সাথে শিল্পের সম্পর্ক একেবারেই অঙ্গাঅঙ্গিভাবেই জড়িত। সমাজের বেড়ে ওঠা কিংবা শিল্পের গড়ে ওঠা কোনোটাই বিচ্ছিন্ন বা সম্পূর্ণ আলাদা কোনো প্রক্রিয়া নয়। কোনোটা আগের কোনোটা পরে বলে কিছু নেই। মানুষ পরিবেশ প্রতিবেশ চেতনা প্রতিচেতনারআশ্চর্য সম্মিলনের মধ্যে দিয়েই মানুষের সভ্যতা এগিয়ে এসেছে এগিয়ে যাবে আরো সুদূর অব্দি এই সত্যের সাথে না শিল্পের না সমাজ বিকাশের কারোরই কোনো বিরোধ আছে।সমাজ বিকাশের শ্রমসাধ্য কাজে শিল্প একটা বৈচিত্রতার অনুভব যোগ করেছে। কোথাও কোথাও উৎসাহ জুগিয়েছে। মানুষের সভ্যতার সকল সৃষ্টি যদিও মানুষের কল্যাণে হয়েছে তবুও এই সকল সৃষ্টিই মননশীল চিন্তার বা চিন্তা চর্চার দীর্ঘ ধারাবাহিকতার অংশ। এটাই শিল্প। সৌন্দর্যবোধ থেকে শুরু করে ভাত খাওয়ার পাত্র বা কাপড় তৈরি পদ্ধতি বা লাঙ্গলের আবিষ্কার প্রতিটাই শিল্প। সে অর্থে নানা ঐতিহ্য নানা সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে পৃথিবী আজকের রূপে এসে উপস্থিত হয়েছে। সেখানে সমাজের যতোটুকু অংশগ্রহণ শিল্পেরও তার চেয়ে কম অবদান আছে বলে মনে হয় না।পুরো পৃথিবীটাকেই যদি একটি ভূখন্ড হিসেবে আমরা চিন্তা করি তাহলে একেক বাড়ির লোক একেক রকম হলেও তাদের প্রত্যেকের মধ্যে যে মানবীয় গুণাবলী ও ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা তা পরিবেশ ও প্রতিবেশের স্বাপেক্ষে আলাদা হলেও ভালোবাসা ঘৃণা ক্ষোভ উৎসাহ উৎকন্ঠা তার একটা সরল কাঠামো রয়েছে। এই সব অনুভূতির মূলত কোনো আলাদা ভুখন্ড হয় না। এই অবস্থনের সাপেক্ষে যদি আমরা আমিনুলের কবিতা যাত্রাকে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখবো তিনি যেনো ঠিক এই কথাটাই বলে চলেছেন তাঁর সম্পূর্ণ কাব্য অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। তাঁর কাছে ঢাকা কিংবা কেনিয়া একটা আলাদা অবস্থান মাত্র কিন্তু অন্তর্গতভাবে মানুষের কাছে যে মানুষের মূল্য তাকে পরাজিত করতে পারে না। সেখানে প্রত্যেকেই সমান প্রত্যেকেই একই হাওয়া জল মাটির সন্তান। যদিও সভ্যতা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা কে আগে কতোটা পেয়েছে এবং তা থেকে কে কতোটা তথাগতভাবে শিক্ষিত হয়ে উঠেছে তা একটা মাপ কাঠি হিসেবে এসে সামনে দাঁড়াবে। তবুও পৃথিবী নামক গ্রামটিতে কবি সিকদার আমিনুল হক বিচ্ছিন্নতা বা জড়তা নিয়ে ঘুরে বেড়ান না। তাঁর কাছে মাদ্রিদ্রের ঐশ্বর্যের কাছে শিলাইদহের পদ্মারপাড় কোনো অংশে সেই কম বা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটাই বিশ্বদৃষ্টি ভঙ্গির একটা প্রকাশ যা সিকাদরের কাব্য ভাবনার সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবেই জড়িত।
তিন
‘বিশ্বাস করতে হবে/আমাদের রাত ক্রন্দনরতা ধর্ষিতাদের চোখের জলেই এত/ তিক্ত ও নিথর’
রক্তে ও ক্ষরণের অগ্নোৎসবের পর যে স্বাধীনতা এলো তার বেনামি বিকৃত আর্তচিৎকারের পুষ্টিহীনতার আগ্রহে যে হাতগুলি তালি মেরেউঠলো তথাকথিত জ্ঞান ও মননের নিষ্ঠুর ব্যাভিচারেতখন সব গৌরব সকল নিহতের কান্না ‘বেলেল্লা’ ব্যাবসাদারদের ‘অর্থকুমিরের’ পৃষ্টপোষকতায় উজার হলো তখন আমাদের হৃদয়ের উত্তর জানালায় দাঁড়িয়ে ‘ফুঁপিয়ে কাঁদছে’ ‘প্রতিটি জানালার স্বাধীনতা’। আমাদের চুপ থাকার ভঙ্গি, সয়ে যাওয়ার ‘ধাপ্পাবাজি’ছাড়া কোথাও কোনো পুষ্ট সুসংবাদ রইলো না। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার আর মৌন শিল্পকর্মীদের তোষন— প্রতারণার আস্ফালনে আততায়ী লালসার গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলসব প্রতিজ্ঞা সব বিশ্বাসের তটভূমি।আদর্শেরআপোষচ্ছ্বাসের সচল দাসত্বের দক্ষতায় যে দুর্দিনকে আমরা আমাদের জন্য নিমন্ত্রণ জানালাম তার হাতভর্তি বিলাপ আর নীতিকথার বাগাড়ম্বর ছাড়া সাধারণের জন্যেই সত্যিই কোনো সকালবেলা থাকলো না।অপমান আর হাড্ডিসার মৃত্যু ছাড়া পাখিদের জন্য আজ আর কোনোশ্বাশত ডানা রইলো না। সব পাখি সব মানুষের জন্য তৈরি করে ফেলা হল একটা একটা করে সমকামি ‘কাঁচের বাক্স’, সকলের জন্য ‘লাল মোটা ভাতের..’ বদলে কারো কারো জন্য যে ‘মাখন ও রুটির’ জীবন আমাদের ‘বিষন্ন সকালবেলা’য় উন্নয়ন বিস্তারের একমাত্র আধিপত্যবাদি উপায় হিসেবেই যখন চর্চিত হচ্ছে তখন হে স্তব্ধতা, হে অহেতুক স্বাধীনতা, হে প্রতারক লম্পট সময় তুমি প্রেম আর প্রতিজ্ঞার উর্দি পড়ে কোথায় নিয়ে চলছে আমাদের কোন সম্মানিত শবযাত্রায় !‘হ্যাঁ, তাই তো!’ আত্মরক্ষার এ কোন আতঙ্কিত পেন্ডুলামের গুহায় বন্দি করে ফেলা হচ্ছে আমাদের বয়ে নিয়ে যাওয়া ভাষার জিপগুলি একে একে ঢুকে পড়ছে হ্যাঁ ঢুকে পড়ছে সেই সব বর্বর আর ক্রীতদাসী দেয়ালগুলির ভেতর যেখান থেকেই আমরা ক্রোধে আত্মমর্যদার আগুন জ্বালিয়ে সম্মিলিত দুর্ভাগ্যের থেকে প্রকৃতই মুক্তির জন্য ‘বিশাল মৃত্যুর পরেআর কোন / শোকের অবকাশ নেই’ বলে এগিয়ে এসেছিলাম ফসলহীন প্রান্তর থেকে আলোক উজ্জ্বল স্বাধীনতার নবান্নে।
কিন্ত না কোথাও কোথাওই তো কোনো ক্ষুধা আর কান্নাহীনতা নেই, নেই অগ্রাহায়ন, আত্মমর্যাদা বিচূর্ণ এই রিক্ত জীবনের নৈরাশ্য তো আকাক্সিক্ষত নিঃশ্বাসের বিশ্বাস ছিলো না! সিকদারের কবিতায় এই আর্তনাদ, এই রক্তছুরির ধারালো কাটাকাটি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আচ্ছাদনের মধ্যে থেকে ছিলো না। নিজস্ব জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভ্রমনের মধ্যে দিয়ে কবি যেখানে গিয়েছেন পৃথিবী নামক গ্রামটির যে প্রান্তেই সেখানেই দেখেছেন মানুষের শ্রম আর রক্তে গড়া যে অর্জন তার প্রতি পরবর্তী প্রজন্মের এক তীব্র মাথানত করা বিশ্বাস যাদের প্রতিটি রক্তবিন্দুর উৎসর্গের উপর দাঁড়িয়ে তারা আজ নিঃশ্বাস নিচ্ছে মুক্তির সেই সব পূর্ব পুরুষের স্বপ্নের কাছাকাছি একটা সমানুভব পৃথিবী নিমার্ণে তারা কতো ব্যস্ত কতো উদীপ্ত সচল। কিন্তু নিজের মাতৃভূমির প্রেমহীন পুষ্টিহীনতা, প্রায় আরোগ্যহীন প্রবঞ্চনা তাকে সব সময়ই বিচলিত করেছে, করেছে ক্ষত-বিক্ষত তাই এতো ক্রন্দন আর মৃত্যু আর অপব্যবহারের পরও আমিনুল বলছেন—
‘হে আমার স্বাধীনতা, তোমার মৃত সন্তানদের দিকে তাকিয়ে
এই বিশ্বাসের কসমগুলি আরেকবার
সকলের রক্তে স্মরণ করিয়ে দাও’
যদিও পুঁজিবাদি সমাজের মোহক্লিষ্ট এই সভ্যতার পথ চলা মানুষের জন্য এক দুরূহ যন্ত্রাণা ছাড়া কিছু নয়। এই ব্যবস্থা নিজেই এতোটা বৈষম্য আর প্রতিহিংসা পরায়ণ যে সে কখনোই প্রকৃত মানবিক দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবী এবং মানুষকে দেখবার মতন ক্ষমতা রাখে না। তবুও শ্রেণীবিভেদের এই রিরংসার মধ্যে মধ্যবিত্ত সব সময়ই একটা টানাপড়নের মধ্যে নিজেদের জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যায়। না সে পারে মুক্তিদাতারূপে সমস্ত শৃঙ্খলকে তুচ্ছ করে সটান দাঁড়িয়ে যেতে, না সে পারে সম্পূর্ণরূপে একজন ব্যবস্থাপনার নিয়মতান্ত্রিক দাস হবার পরও একজন ক্রীতদাস হিসেবে নিজের অবস্থানকে চিহিৃত করতে। এই যে নিজের ভেতরের প্রকৃত অনুসন্ধানকে সে চিনে তাই তার এতো ব্যাথা এতো না করতে পারার ব্যর্থবোধ এবং প্রতি মুহূর্তেই শিকল আবদ্ধ থেকেও শিকলকে অস্বীকার করার নষ্টতা। কবি সিকদার আমিনুল এই নষ্টামি নিয়ে বেঁচে ছিলেন। লিখেছেন। নিজের শ্রেণীগত অবস্থানে থেকে যেটুকু সম্ভব পাহাড়কে আঘাত করার তা করতে কখনোই তিনি দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন না। এখানেই তার সততা, এখানে তার কবিতার পূর্ণভূমির আবিষ্কার।
তাহলে প্রশ্ন জাগছেআমিনুলের বিদ্রোহটা কোথায়? আদৌ কি তাঁর কবিতা পরিভ্রমনের পথে কোনো দ্রোহ ছিলো? সম্পূর্ণ মধ্যবিত্ত একটা নিপাট জীবন কি কখনো ক্রোধে চেঁচিয়ে উঠতে পারে? ধারালো শব্দের শিহরণ নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে শাসকের মুখোমুখি প্রতিরোধ? এই প্রশ্নগুলো সিকদারের নিজেরও ছিলো-‘মাংস রান্নার গন্ধে জিব যেই / স্নিগ্ধতা পায়-আমার রক্ত কবিতার গন্ধে সে রকম উন্মাতাল কেন হয় না?’ স্নিগ্ধতা নিয়ে যার এতো সংশয় তার কাছে বিদ্রোহের দাবিটা একটু বেশিই হযে যায় না কি। কিন্তু ‘বিপ্লবের প্রশ্ন উঠলে আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষের দিকে তাকাই। এই / গ্রীষ্ম-দেশের যত ফল, তার প্রতিভার দিকে। শহীদের স্ত্রীদের বিলাপে, সন্তানের / নিপীড়ন আর বালিকাদের দিকে।’ যারা আমিনুলের নিবিষ্ট পাঠক তারা ঠিক টের পেয়ে যান তিনি কত সহজ ভাবে বারবার বারংবার নিজের বিরুদ্ধে হলেও সত্যের মুখোমুখি সটান দাঁড়িয়ে যান। অনুভূতির সরল প্রকাশের স্বাভাবিকতায়। পৃথিবীতে যখন মোহর আর বাজারই একমাত্র সত্য! তখন আমিনুল সকল সমাজ ও তার ‘উপদেষ্টাদের’ নিয়ন্ত্রিত সকল শৃঙ্খলের মধ্যে থেকেও তাঁর যা নিজস্ব ভাবনা তা অকপটে বর্ণনা করেন ভাষা ব্যবহার দিক থেকে যদিও সে কোনো ভাবেই চূড়ান্ত বৈপ্লবিক নন কিন্তু সত্যের স্বপক্ষ তিনি কখনোই ত্যাগ করেননি। এই সচেতন চেতনা তাঁর কবিতার একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য। বিষয়কে তিনি কখনোই বৃহত্তরের নিরপেক্ষ হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন সামগ্রিক যে চেতনা প্রবাহ তার নিরিক্ষে বা আরো খোলা ভাবে বললে— আক্ষরিক আর্থেই দৃশ্যগত অনুভব থেকে কিন্তু তাঁর নিজস্ব যে সত্য প্রতিক্রিয়া তা তিনি সব সময়ই সচল রেখেছেন।
বিদ্রোহটা হয়ত নজরুলের বিদ্রোহ কিংবা র্যাঁবোর বিদ্রোহের মতন নয় কিন্তু যে অন্তর্গত দ্রোহে তিনি সক্রিয় থেকেছেন তা কোনো অর্থে লোর্কার অন্তর্র্দৃষ্টির বাইরে বা হোসে মারতিসের প্রকৃতি ও প্রেমের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে আত্মগত মর্যাদা ও অধিকার বোধকে উসকে দিতে ব্যর্থ হয়নি বলেই মনে হয়। সিকদার আমিনুল হককে নিয়ে অনেক কথাই হয়েছে হবে পক্ষ বা বিপক্ষের বলে শিল্পে যে ঝগড়াটা জারি আছে তা আসলে নিয়ম করে বা আধিপত্য বিস্তার করে সচল নেই কারোর-ই মননে, ব্যাপারটা অতি সরল এবং স্বাভাবিক প্রবণতা পুরোটাই শ্রেণীগত অবস্থানের একটা প্রতিফলন মাত্র। এসব সব দিক মাথায় রেখে এগুলো আমিনুলের বিদ্রোহের পদ্ধতিটা চোখে পড়ে। ভাষাকে নয় ভাষা বয়ানের মধ্য দিয়ে চিত্রকল্প ও বৈষম্যমূলক ঘটনাগুলোর অতি সরল উপস্থাপনকেই তিনি তাঁর সচেতন চেতনার মূল স্বর হিসেবে প্রতি মুহূর্তে প্রাতিষ্ঠানিকতার দেয়ালে আবদ্ধ থেকেও ভাঙ্গার রসদ জুগিয়ে গেছেন ধারাবাহিক ভাবেই। কেননা কবিতার প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিলো তাই তো দ্ব্যার্থহীন ভাবে উচ্চারণ করেছেন— ‘রক্তক্ষরণ, আত্মার ঐশ্বর্য আর প্রণয়ের উৎসর্গ-পৃথিবীর ক্ষতগুলি ঢাকবার জন্যে / আপাতত এই তো যথেষ্ট!’যদিও সিকদার নিজেও জানতেন এইটুকুই যথেষ্ট নয় মৃত্যু আর বিষন্নতার কুৎসিত অপরাধকে নির্মূল করার জন্য। কিন্তু তাঁর পক্ষে এই যুদ্ধে যেভাবে অংশগ্রহণ করার সম্ভব সে পথ থেকে তিনি কখনোই সরে দাঁড়াননি ‘সকলের উৎসব ছিলো। সকলেই যে যার-মতো সম্মনিত হলে। আমি ওপরের / জানালার মানুষের মতো সেই শোভাযাত্রা তো দেখেছি; তোমাদের জয়যাত্রার/ দুঃখিত সাক্ষী’এই উপলব্দিই আমিনুলের সত্য। এই সত্য প্রকাশে তাঁর কোনো সংকোচ ছিলো না কখনো।
চার
‘..বাতিহীন প্রতিটি জানালা হবে মর্গ’
আমাদের এই বেঁচে থাকা যাপনের ক্লিষ্ট হামাগুঁড়ি ‘..শাদা ইলিশের মতো/ বাজারের ব্যস্ততায় মৃত পড়ে আছে।’লোভনীয় ‘ক্ষুরের আঘাতে’ রাত্রির স্তন কেটে বেড়িয়ে আসে ভালোবাসার রুগ্ন ফটোগ্রাফ। সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে আসে বিশালাকার উৎকন্ঠার শ্লেষ্মা। জীবনের স্বাভাবিক সত্যের পানশালায় ফালি করেকাটা তরমুজের শরীর চুঁইয়ে পড়ে রিরংসার ক্ষুধা। কোথাও কোনো জ্যোৎস্না নেই, তরুণ চাঁদের আলোয় সুচিন্তিত কোনো গানের উৎসব-আর্তি নেই। আলোর পোশাক পরে হাঙ্গরেরা বিরল মুদ্রায় লুকিয়ে রেখে হিংস্র তলোয়ার‘গোলাপ কিনতে গিয়ে হাত রাখে ছুঁড়ির জামায়…’এই প্রবঞ্চনা এই আত্মঘাতী জীবনের উৎসাহ কোথা থেকে উদগত হয়? কারা নিয়ে আসে আর্তনাদ আর রক্তের ছোপ ছোপ উত্তেজনা? কারা ‘অবিরাম মুগ্ধ চোখে’ মাধুর্যের নাম করেপ্রাণ আর প্রকৃতির স্বচ্ছ মুগ্ধতার গায়ে নান্দনিক পুঁজবিষ ছড়িয়ে দিয়ে ভোগ করে ‘নিরাপদ প্রাজ্ঞের জীবন।’ ওরা সেই হাহাকার আর ‘দুর্ধর্ষ ভক্ষক’ যারা নিঃশব্দে জলপাই বনের সবুজ জ্যোৎস্নার গানগুলোকে, সমুদ্রের বিষন্ন ঢেউয়ের বেহালাগুলোকে, বৃষ্টির অবিরাম ছটফটের মতন পিয়ানোগুলোকেকমলা বাগানের সতেজ বাতাসেরমধ্য রাতের আক্ষরিক ঠান্ডা ও মৌনতাকে ভয়ংকর দস্যুর মতন লুটে নিয়ে যায়। গভীর অন্ধকারের গুহা বরাবর সেই সব দানবদেরপায়ের চিহৃ বরাবর যে পথ সে পথের দিকেই আজ পৃথিবীর বিপুল উৎসাহ! কবি মাত্রই এই আতঙ্কে উদগ্রিব ব্যাথা আক্রান্ত এই রাত্রির কথা ভেবেই ‘সমুদ্র কাঁদতো’ কবির ভেতরও সেই একই কান্না ফুঁপিয়ে ওঠে। লোর্কা কিংবা সোমেন চন্দ যে যেখানেই অপূর্ব রাত্রি আর সমবন্টনের কথা বলতে গিয়ে একাকিত্বের ভয়াবহ অত্যাচার আর রুষ্ট সমাজ সভ্যতার চোখে কাঁটা হয়ে ওঠে সেখানেই‘কুটিল পৃথিবী এসে ভেঙ্গে দ্যায় গানের বিষাদ’আর‘..তারপর থেকে /আলো-ঝলমল কোন রাত্রি আর ফেরে নাই।’এই না ফেরার জন্য কোনো বেদনার আর্তি কোথাও অবশিষ্ট নেই।
সিকদার আমিনুল হকের সে যন্ত্রণা আছে। এই ব্যাথাবোধই তাকে সময়ের কাছে যে ঋণ তা থেকে মুক্ত হতে প্ররোচিত করেছে। কবি যে প্রকৃতই আধিপত্য আর শৃঙ্খলার দাসানুদাস নয় তার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।আমিনুল তাঁর কাব্য ভাষার স্বজাত স্বাভাবিকতার মধ্য দিয়ে সমাজ সভ্যতার সেই নিষ্ঠুর ‘দাঁত’কে দেখে ফেলেন; দেখে ফেলেন পৃথিবীতে ‘সর্বক্ষণ এক নিস্তব্ধতা’। এই চোখ এই বোধের ধার ‘মুমূর্ষ স্তন’এর দিশেহারা আর্তনাদ কেবল বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ ও নবারুণ ভট্টাচার্যের মধ্য দিয়ে আমাদেরপূর্ব অভিজ্ঞতায় উজ্জ্বল ভাবে স্মৃতিপ্রাপ্ত হয়। কবি বা কবিতার আলোচনায় কে কার চেয়ে বড় কিংবা কে কার থেকে উদগত তার থেকেও জরুরি অনুসন্ধানটি হলো—পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সঞ্চারিত হয়ে এসে কবি যখন অনুভূতির আখ্যান লিখতে বসেন সেখানে কবি নিজে কতটুকু উপলব্দিগত ভাবে উপস্থিত রয়েছেন। অস্তিত্বের সেই উপস্থিতি দিয়ে অনুভবকে কতোটা পুনঃনির্মণান করতে পারছেন। আমিনুলকে পাঠ করতে থাকলে একই যন্ত্রণা উপলব্দি ও উপস্থাপনের যে ভিন্নতা খুঁজে পাওয়া যায় তার স্বকীয় স্বরে এটাই যথেষ্ট যে তিনি কোনো ভণিতা বা মুখোশের অন্তরালে থেকে নিজের ভাষাকে ব্যক্ত করেননি। তিনি তাঁর ভেতর ঘটে যাওয়া অনুভূতিগুলোর চেতনার সাথে যে সম্পূর্ণ সহমত তা তাঁর শব্দের ব্যবহারই বলি আর চিত্রকল্প নির্মাণের বাহাদুরিই বলি বাংলা কবিতার পথে বিশ্বচেতনার যে ধারা তাকে স্বাভাবিক ভাবেই চিহিৃত করে। সিকদার কোনো অতি মাত্রার দুরূহ শিল্প তৈরি করার পক্ষপাতি ছিলেন না কবিতা সম্পর্কে তাঁর যে ধারণা তিনি সেটাকে বিশ্ব ভাবনার বাইরের কোনো আলাদা অনুসঙ্গ হিসেবে ভাবতেন বলে মনে হয় না। তাইতো তিনি অনেক স্বাচ্ছন্দে পৃথিবী ব্যাপী ভ্রমণ করেছেন নানা জায়গা থেকে নানা উপমা নানা অনুভূতি নানা চিত্রকল্প হুবহু তুলে এনেছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে সাবলিল কিন্তু কোথাও সেগুলোকে রেপ্লিকা মনে হয় না এতোটুকুও। এখানেই কবি সিকদার আমিনুল হকের কবিতার রোশনাই।
পাঁচ
যেনো সামান্যই অন্ধকার।বারান্দায় প্রিয় ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্ভবত বিচ্ছেদ; একই সঙ্গে দুরারোগ্য প্রেম এবং সমাধী, মনে হয় শতাব্দীর শীতকালের বরফ জনপদ। নিহত গাছের শেমিজ খুলে চিলতে চিলতে কাঠের তাজা গন্ধে কামার্ত ছুঁতোরের সংগমরত শৈল্পিক শরীরে, এস্কিমো জ্যোৎস্নার প্রস্থ বেত্রাঘাতে, সুমাত্রা দ্বীপের গোরস্থানে, রাতের ঠোঁটে জিবের নির্জনতায়, টিনের কৌটায়, রাত্রিবেলার ঠান্ডা জানাজায়, উদয়াস্ত ইতিহাসের ক্লেষে, হ্যাঙ্গারে ঝোলানো আমিষের স্বাদে, বৃষ্টিধোয়া পুরাতন এই গ্রহে কোথাও সুলতা; সুখলতা ‘তুমি নেই/ তোমার নাভির নিচে অপরাহ্নের সেই অন্ধকারও নেই’ অনন্তকাল হাঙ্গরের গান, মৃত্যু, প্রণয়, ফসফরাসের আয়ু, রূপসীদের ভৎর্সনা, অশ্লীল আর্তনাদ, জিহ্বার সাবলিল প্রতারক ব্যালকনি, ব্লাউজের সুঠাম টিটকারি, শাড়ির নিঃশব্দ শুভেচ্ছা, আলোকময় ‘স্বার্থের বজ্জাত’ বুর্জোয়া হাততালি, নকল শহরের ধূর্ত চুম্বন, বিজ্ঞাপন, ধাপ্পাবাজি ‘ঘেন্না লাগে যত দেখি এইসব কেঁচোদের বার্ধক্য বছর।’কোথাও কোনো ঘনিষ্ট উষ্ণতার শীতে তুমি আর মুগ্ধ হও না এখন আর। চারিদিকে আর্তনাদ, বর্বর ‘কম্পনের দাগ’। চারিদিকে ‘শূন্য হাতখানি মেলে ধরি’ কোথাও নেই কোনো প্রকৃত সুষমার আদর। যেনো সকলেই বিস্মৃত, পুড়ে যাওয়া আগুনের শেষ শিখার মতন বিষন্ন। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছ থেকে ভীষন দূরত্বে আলাদা অন্যদিন। অন্ধকার ঘিরে ধরারুমালের মোচড়ানো ধুমড়ানো মুখ। বাড়ানো হাতের দিকে সকলেরই ভয়। প্রানহীন মৃত অনুভূতি দিয়ে সাজানো স্বস্থিহীন সূর্যের চোরাবালিতে ক্লান্ত নিথর জীবনের ক্রীতদাস ছাড়া কেউ কিছু নয়। শুধু সংশয় শুধু বিস্মরণ আর উৎসবের মতন গভীর অন্ধকার। ভালবাসার নিপুন উচ্চাশার নির্বাসন ভোগ-ই যেনো মানুষের প্রেমের একমাত্র পরিণতি। ‘এখন জীবন্ত ফুল তোমার দিকে বাড়াতে ভয় হয়। কেননা আজ কাগজের/ ফুল এগিয়ে দিলেও তো তুমি একইভাবে উদ্ভাসিত হবে।’
তবে কি আবরণের উজ্জ্বলতাই আজ মানুষের পরিভাষা। প্রকৃত অনুভব অজ্ঞাত বলে ‘প্রচুর রাত আহত হলো’। কিন্তু ব্যাথা কৈ? বেদনার কোনো লালসাই তো মানুষের নেই। অথবা কেনইবা শুধু যন্ত্রণার ‘অতিকায় ক্রেন’টেনে নিয়ে যাবে অবসন্ন মানুষের সমুদয় প্রেম! সুলতা তোমার ‘ সোনার চিৎকার’, জানালার নিচে স্বচ্ছ যে কাচের জগৎ তার ছায়াছন্ন আবছায়া রোদেরপাতা সরিয়ে কবেই তুমি দেখে নিয়েছো সেই সব ভোর আর দহনের ইতিহাস। তাইতো পৃথিবীতে আজ আর ‘একজনকেও বিশ্বাস করে না সে, একজনও/ যথাযথ ডুবরির পোশাক পরেনি’ সকলেই যে যার মতন ‘আপাত সুস্থ’ কাদামাটি মেখে সকলের মতন হওয়ার ঈর্ষাতুর অভিনয় শিখে গেছে। কেউ কারো বিশ্বাস থেকে কিছুই সঞ্চয় করছে না আর কেননা সকলেই জানে ‘ পালকের ভিতরে আজ পালকের মতো’ স্তব্ধতা নিয়ে নিঃসঙ্গ সকলেই বিব্রত হয় ভালোবাসার দুশ্চিন্তায়।তবুও তো বারান্দার ছোট্ট ঝোলানো টবে কারোর ভীষন শুশ্রূষার নির্দোষ অপেক্ষা পেরিয়ে ‘ হরিণের মতো প্রমত্ত জ্যোৎস্নার নিরাপদ’ ভালোবাসায় ফুল ফুটে ওঠে। কারোর নিঃশব্দ ঘুমের মধ্যে বিশ্বাসী হাত মধ্যরাতে আদিম মোরগের ক্ষিপ্রতায় ভালোবাসার তীব্রগন্ধ ছড়ায়। এইটুকু ঝিঁঝিঁ ডাক এখনো মানুষ শুনতে পায় বলেই যাবতীয় লাম্পট্যের তামাশায় থমথমে সভ্যতার শোকাতুর চিল এখনো দুপুর রোদে একা একা কোথাও উড়ে বেড়ায় ব্যাথা আর ভালোবাসার প্রকৃত অপচয়ে। ‘ নিছক কঙ্কাল এসে তার নগ্নতাকে দেখে যায়-/ নিজের শাদার চেয়ে, নারীর শাদাটি বেশি ঘন’
সব ফেলে সব ভুলে কোথাও একটু অন্ধকারের আড়ালে লুকানো যায় যদি সবকিছু ফেলে সব পাপ-স্বর্গ-যুদ্ধ-ব্যাথা-ঘৃণা-ক্রোধ-প্রায়শ্চিত্ত-জন্মান্তর-বস্তু-শুষ্ক ঈশ্বর। আছে কোথাও স্বপ্নের ঘুম আচরণের মধ্যেও এমন কোনো আশ্চর্য জানালা অথবা কোনো পানশালার স্বল্প আলোর ‘উগ্র পাত্র’ যা থেকে এক ঢোঁকে পান করে নিলেই পৌঁছে যাওয়ারিরংসায় মত্ত এই ক্ষুধার্ত পৃথিবীর শ্বাসরুদ্ধ স্বার্থপর কাগজের ঝুড়ি থেকে দূরে;দূরত্বের সকল ক্ষতহীন ‘কল্প-মৃগয়ায়’। নেই বলেই মানুষের জানাযায় মানুষের শোকের দাগ ঢেউয়ের চেয়েও ক্ষনস্থায়ী। এই ঘুমন্ত চেতনার পাটাতনে দাঁড়িয়ে ‘তবু মূর্খ;পান করি’বৃষ্টিভেজা স্বপ্নের ছোবল। যদিও সহজ নয় মখমল কোনো রাত্রির আকাশ বা বিশ্রী দিনগুলোর ‘তীব্র অহংকার;/ আর অট্টালিকা চুরমার করা হাসি’ ঠোটে নিয়ে বিশাল অজগরের পেট থেকে বেরিয়ে যাওয়া। তবুও তো আর্তির সমুদ্র থেকে ফেনিল পরিত্রাণের কল্প ঝড়ো বাতাস এসে আছড়ে পড়ে আছড়ে পড়ে মানুষের বোধ আর বেদনার রুদ্ধ দেয়ালে। কেউ শুনতে পাচ্ছ কোনো গান। যে গান জন্ম থেকে নিরবধি মৃত্যুর চেয়ে ঢের সত্য স্বপ্নের অরণ্য নিয়ে আমাদের ছায়ার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। ঘুরে বেড়ায় ঠান্ডা শীতের উষ্ণতার মতন। চন্দ্রালোকে ডুবে যাওয়া রাত্রির অপূর্ব জ্যোৎস্নার মতন। ঘুমন্ত শিশুর মুখের সরলতার মতন। ব্যাবলিনের পথে শাদা ঘোড়ার উৎকন্ঠার মতন। আফ্রিকার বালির মখমল বিস্তৃতির মতন।সুলতার বিশ্বাসের মতন। লোর্কার কবিতার মতন। হ্যেল্ডোর্লিনের মুগ্ধ গীতবাদ্যের মতন। মরিশাসের বৃষ্টিতে ভেজা চেকোস্লাভ রুমালের ছিমছাম একান্ত নম্র নির্জনতার মতন।রাজস্থানের নির্বিকার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা উটের মতন। মোঙ্গলীয় নীলনয়নার চোখের মতন।তিব্বতে পাহাড়ের ঢালে গলে পড়া আলোর শেষ গোধূলীর মতন।রিলকের এলিজি ও জয়েসের বর্ণনার মতন। লারা, মিশা, কমরোভস্কি, ইলিয়াসের সঙ্গে বাষট্টির দিনগুলোর মতন।
কতো কতো মুদ্রাস্ফীতি, মৃত্যুভয়, ‘পশ্চিমের রক্তে খেলা; সাঁজোয়া বাহিনী, দস্যু ট্যাংক’, অবজ্ঞার কটাক্ষ, দুর্বত্ত দেশপ্রেমিক, শিল্পের রুগ্নতা, স্বাস্থ্যহীন ঋতু, নিস্তব্দ ‘মুমূর্ষর স্তন’, চুরুটের ছাই, মাধুর্যের রেপ্লিকা, লবণাক্ত নিয়তি, অভিভূত স্পর্শ, রোমহর্ষক শহর, গণিকার ঘাগড়ার মতন টাকশাল, ‘সহবাসরত মৃত পরি’, স্বৈররাষ্ট্রের দারিদ্রপীড়িত চাঁদ, সুলতার ‘শেমিজ লুন্ঠিত হয়’ এইসব দেখে দেখে এগিয়ে চলেন কবি আয়ুর মুখে বয়েসের দাগগুলো পুষ্ট হয়। ‘এখন নিঃশব্দ ঘরে, লাল নেই, শুধু অন্ধকার’ চেতনাহীন মর্গে মানুষ বেঁচে আছে ডাল-ভাত-টিফিন ক্যারিয়ারের সযত্ন ছকে।‘এরা জীবনের দাস, জীবিকার অদ্ভূত শিকার’ এই শিকার হওয়া জীবনের প্রতি সকলেরই ভীষন আগ্রহ। এখানে প্রশস্ত বিছানার নরম তুলোর নিরাপদ ঘুমের নিচে চাপা পড়ে আছে অগনন ব্যাথা আর আর্তির অসহায় চিৎকার। কিন্তু সেই আর্তনাদ সেই বেদনাকে তুচ্ছ করে নিজস্ব স্বপ্নের দেয়ালে ইচ্ছা মতো রঙ লাগতে না শিখলেই পিছিয়ে পড়তে হয়। প্রমোশন হয় না। গাড়ি গহনা বাড়ি অঢেল টাকার উপভোগের আয়োজন সমাপ্ত হয় না। এটাই শিখিয়েছে সভ্যতা মুনাফা মানুষের ভেতর লুকিয়ে থাকা মানুষহীনার জীবাণুরা। এই জীবন থেকে কিছুই দেয়ার নেই। কেবলই নেয়ার কেবলই প্রাপ্ত হওয়ার। অপরের যন্ত্রণা বেদনা বিধুর হওয়া সকলের জন্য সকলেই ভাবা কেবলই সময়ের ভীষন অপচয়। এই মিথ্যার পোশাকই সত্য। এই স্বার্থপর আত্মমৈথুন্যই অঙ্গিকার। যদিও এই অন্ধ অন্ধকারের বিপনন ও বিস্তৃতকারি কুশিলবেরা জানে না ‘…এই নাটকের নেই মেধা বা সংঘাত!’ এই পরজীবি জীবনের প্রতি মোহ তৈরি করেই চলছে যথেচ্ছা রীতিনীতি সর্বস্ব শৃঙ্খলেরকূপমুন্ডকতা। এই লালসার হাত ধরেই পৃথিবী হয়ে উঠেছে এক বিষাক্ত মৃত্যুপুরি।
একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়াবার বদলে সকলেই যখন যে যার মতন করে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে সুবিধা মতনতখন সবাই শিকারী সবাই নিখুঁত নিশানায় একে অপরের দিকে তাক করা। মৃত্যুও বড় অসহায় যেনো মানুষের হাতে ‘মৃত্যুর দূত মসজিদ অথবা গির্জার/ চেয়ে এখানেই যেন বেশি ঘোরে।’ মানুষের এমন বিপর্যয়ে ‘কামার্ত বগল যেই ডাক দ্যায় বিকট উল্লাসে’ তখন মনুষ ‘সে কেন অসাড় হবে, শুয়ে রবে দূরে ঐ বিছানায়?’ এমনই এক অনুভবের জগতে নিত্যদিন হেঁটে বেড়িয়েছেন আমিনুল। তাঁর কবিতার প্রকাশ ভঙ্গি এবং অন্তর্গত ভাবের যে সূক্ষ্ম অবস্থান সেখানে তিন এক ব্যাথাতুর আর্ত চিৎকারে ছটফট রত মানুষ যে মানুষ মানুষের ক্ষয় ও ক্ষরণের যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত আর্তনাদ করেছেন আর শব্দেরপর শব্দ দিয়ে সে ব্যাথাকে বুনেছেন। আর মানুষের অন্তসারশূন্যতার দিকে তাকিয়ে সুলতার হাত ধরে বলেছেন—
কোনো কোনো শোক, মর্মযাতনার যোগাযোগ
কেবল থাকবে দুজনেই সীমাবদ্ধ শেষাবধি
এই গ্রহে।