মুসলিম বিয়ের গীত । সুমনকুমার দাশ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫, ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ, | ৫৬৯৬ বার পঠিত
বাঙালি সংস্কৃতিতে লোকসংগীতের যে কয়েকটি ধারা ক্রমান্বয়ে লোকসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে তার মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিয়ের গীত অন্যতম। এসব গীত লোকসাহিত্যের এক অমূল্য ভাণ্ডার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যদিও মুসলিম সমাজ ব্যবস্থায় সংগীত পরিবেশনের বিপক্ষে নানা মত রয়েছে। তবুও দীর্ঘকাল ধরে প্রায় সব মুসলিম পরিবারে বিভিন্ন উৎসব-আনন্দে সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে ওতপ্রোতভাবে মিশে রয়েছে সংগীত। সময়ের আবর্তে এসবই সাম্প্রতিককালে হয়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতির Spiritual Culture। হামদ, নাত, মারফতি ও মুর্শিদিসহ অজস্র সংগীতরীতি নানা আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মুসলিম সমাজে জিকির, খৎনা বা মুসলমানি এবং ক্ষীর খাওয়ানোর সময়ও বিভিন্ন ধরনের গীত পরিবেশন করা হয়।
মুসলিম সম্প্রদায়ের কাওয়ালী অথবা পির ও ফকিরি গীতির ন্যায় এতদিন ধরে এই বিয়ের গীতও একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে বিদ্যমান। বিবাহের বিভিন্ন পর্যায় যেমন—গায়ে হলুদ, ওয়ালিমাসহ নানা আয়োজনে মুসলিম নারীরা তাঁদের মনোবেদনা ও মনের সুখ আবিষ্কার করতেন নিজেদের মতো করে। বিয়ে উপলক্ষে অবসর মেজাজে সময় কাটানো এবং চিত্তবিনোদনের জন্য নারীরা এসব গীত পরিবেশন করে থাকেন। এতকাল ধরে গ্রামীণ নিরক্ষর নারীরাই মূলত বিয়ের গীতের প্রচলন, প্রসার ও বিস্তারে ভূমিকা রেখে এসেছেন। এসব গীতের আবেদনও উল্লেখ করার মতো। সুন্দর সাবলীল কথায় বর্ণিত এসব গীত কেবল শ্রুতিমধুরই নয় বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটে যাওয়া হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনা ও কৌতুকেরই অংশবিশেষ যেন।
বিয়ের দিনে ‘দামান’ অর্থাৎ বর আসার আগ-মুহূর্তে পাড়া-প্রতিবেশীরা কন্যার মাকে বলছেন :
. কি করো দুল্যাপের মালো; বিভাবনায় বসিয়া
. আসত্যাছে বেটীর দামান ফুল পাগড়ী উড়ায়া নারে
পাড়া-প্রতিবেশীদের কথার প্রতিউত্তরে তখন কন্যার মা তাদের বলছেন :
. আসুক আসুক বেটীর দামান কিছুর চিন্তা নাই রে,
. আমার দরজায় বিছায়া থুইছি কামরাঙা পাটী নারে।
. সেই ঘরেতে লাগায়া থুইছি মোমের সহস্র বাতি,
. বাইর বাড়ি কান্দিয়া থুইছি গজমতী হাতী নারে।
এভাবেই নানা কথায়, নানা ঢঙে এগোতে থাকে বিয়ের গীত। কিংবা বর আসার পরে কন্যার মাকে বর দেখার আহ্বান এবং বিভিন্ন উপমা প্রয়োগ করে বরের চেহারার বিবরণ জানিয়েও একধরনের গীত পরিবেশন করা হয়। সে রকমই একটা গীত হচ্ছে :
. কই গেলায় গো কইন্যার মা
. দামান দেখো আইয়া
. কইন্যার দাদী যে যাইন
. মিষ্টি আতো লইয়া ॥
. চোখ বালা দামান্দের
. টলমল টলমল করে
. আসমানের তারা যেমন
. ঝিলমিল ঝিলমিল করে ॥
. নাক বালা দামান্দের
. যেমন বুম্বাই মূলা
. কান বালা দামান্দের
. ধান ঝাড়িবার কুলা ॥
. চুল বালা দামান্দের
. যেমন ঘরের ছানী
. পাও বালা দামান্দের
. যেমন ঘরের থুনী ॥
বরের রূপ-বর্ণনার পাশাপাশি রয়েছে বিয়ের পর্বকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের গীত। বিয়েতে সারা বাড়িজুড়ে হইচই পরিবেশ স্বাভাবিক ঘটনা। বিয়ে বাড়ি মানেই হুলুস্থুল। কাজ-কাম আর সানাইয়ের শব্দে মুখরিত থাকে পুরো এলাকা। সবাই নববধূ আর বরকে নিয়ে মেতে ওঠেন নানা হাস্যরসে। এসব কাহিনিও রয়েছে বিয়ের গীতের পঙক্তিতে:
. ও কন্যা আতরজান
. অতো সুন্দর গতরখান
. দুধে আলতা দিয়া করলায় লাল
. বাজে ঢোলক বাজে রে করতাল ॥
. বিয়া বাড়ি হইচই
. নাচে গায় সখি-সই
. অলদি পিষতে কে লাগাইল ঝাল
. বাজে ঢোলক বাজে রে করতাল ॥
. হাতে চুড়ি পিন্দিয়া
. ভিজাইন শাড়ি কান্দিয়া
. দুলা মিয়ার ফুলা কেনে গাল
. বাজে ঢোলক বাজে রে করতাল ॥
. দুলা মিয়ার খেয়াল নাই
. শেরওয়ানীর বোতাম নাই
. পাগড়ির ভেতর মশা পালের পাল
. বাজে ঢোলক বাজে রে করতাল ॥
শ্রুতিমধুর এসব গানের মাধ্যমে অতীতে বিয়ের বর-কন্যাকে বরণ করে নেওয়া হতো। বর্তমানে শহরে আগের মতো প্রাণবান এবং উজ্জ্বল বিয়ের গীতের আসর খুব একটা চোখে না-পড়লেও গ্রামাঞ্চলে এখনো গ্রামীণ নারীরা জমকালো আয়োজনে বিয়ের গীতে পর্ব সম্পন্ন করেন। চলমান সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় অঞ্চলভেদে গায়কী ভঙ্গি ও কথায় কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত দেখা গেলেও সকল গানেরই উদ্দেশ্য অভিন্ন। প্রায় গানই সামাজিক সমস্যা, প্রেম-বিচ্ছেদ, দুঃখবেদনা, হাস্যরস ও চলমান জীবনের নানা কাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছে। দুই ধরনের দুইটি গানের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে :
. ১
. হাতে ওইনা জোড় মেন্দি
. কপালে সিন্তি
. ওগো রসমতি
. কে পিন্দাইল মেন্দি ॥
. আমারও যে ভাবীসাব তাইন বড়ো আউসীয়া
. তাইন আমারে কুলে লইয়া মেন্দি দিছইন পিন্দিাইয়া ॥
. আমারও যে ছোটোভাবী তাইন বড়ো রঙ্গিলা
. তাইন আমারে কোলঅ লইয়া মেন্দি দিছইন পিন্দাইয়া ॥
. ২
. ইন্দিল মন্দিল ঘরে
. কাজল কোঠা ঘিরিয়া
. পাশা খেলাইন গো ভাইয়ে
. ভাবীসাবরে লইয়া ॥
. তর অঙ্গ চাইতে মোর জ্বলে হিয়া
. কুন বুকে তোর বাবাইজ্জে ধইরা দিছে বিয়া ॥
. আমারও যে বাবাজী সানে বান্ধা হিয়া
. কাজীর ঘরও গিয়া বাবা কাবিন লইছইন লেখিয়া ॥
. তরও অঙ্গ চাইতে মোর জ্বলে হিয়া
. কুন বুকে তোর মাইজ্জে ধইরা দিছে বিয়া ॥
. আমারও যে মাইজী পাষান বান্ধা হিয়া
. সেই বুকে সোনার মাইজী ধইরা দিছে বিয়া ॥
বিয়ের গীত শুধু বিয়ে সর্ম্পকিত কথাবার্তা ও অনুষঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।এসব গীতের রচয়িতারা গানের পঙক্তিতে সমাজের সকল স্তরের অসঙ্গতি, দুর্ভোগ, ভালোমন্দ এবং সমাজ বিবর্তনের নানা চিত্র দরদী ভাষায় বিন্যস্ত করেছেন।তাই তাদের প্রণীত গীতগুলো হয়ে উঠেছে বাংলাসমাজ-সংস্কৃতির অন্যতম দর্পণও।
বৃহত্তর মুসলিম বাঙালির মানসজুড়ে যুগ যুগ ধরে বিয়ের গীত অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে এসেছে।বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের একটি অধ্যায় এই বিয়ের গীত।ফলে অতীত ও বর্তমানের সমাজ-সংস্কৃতির বিবর্তনের অন্যতম উপাদান হিসেবে এসব বিয়ের গীতের আবেদন নিছক কম নয়। শহরের আধুনিক মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রাচীন এসব বিয়ের গীতের পরিবর্তে সংযুক্ত হয়ে ক্রমশ নব্য-আবিষ্কৃত ব্যান্ড সংস্কৃতি।এতদিন ধরে চলমান সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় প্রবাহিত বিয়ের গীতকে ‘সেকেলে’ উপাধিতে অভিহিত করে আমরা নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি।দ্রুত নগরায়ণের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে মুসলিম সংস্কৃতির অতি উজ্জ্বল ও চিরপরিচিত লোকসংস্কৃতির অমূল্য উপাদান বিয়ের গীতের অনন্য অধ্যায়টি।
[লেখায় ব্যবহৃত সবকটি গান আমাকে সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন তরুণ কবি আবদুর রহমান খোকন। তার বয়স ৩২ বৎসর। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, সংগৃহীত এসব গান তিনি এক নারী গীতিকারের কাছ থেকে সরাসরি সংগ্রহ করেছিলেন। খোকনের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার আজমপুর গ্রামে।]